সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
জাতি পরিচয়ের প্রধান উপাদান বা উৎস ভাষা। ভাষাকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে জাতির সংস্কৃতি, ঐক্য চেতনা। এবং সংস্কৃতির মধ্যে প্রকাশ পায় জাতির সামগ্রিক জীবনচর্চা। এই কারণেই সংস্কৃতিকে বলা হয় জাতি পরিচয়ের দর্পণ। এইভাবেই দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে জাতীয় ঐতিহ্য। যে গাছ যত উপরে ওঠে, তার শিকড় থাকে মাটির তত গভীরে। জাতি বিকাশের ক্ষেত্রেও কথাটা সমান সত্য। জাতি বিকাশের শিকড়ও থাকে ঐতিহ্যের গভীরে। ঐতিহ্য ছাড়া কিংবা স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে কোনো জাতি বেশিদিন টিঁকে থাকতে পারে না। ঐতিহ্য-চেতনা এবং ইতিহাসবোধ মানে স্থবিরতা নয়, বরং অগ্রগতির দিগদর্শন।
ধর্ম কোনো জাতির পরিচয় বহন করে না। ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও জাতি পরিচয়ের ভিন্নতা পৃথিবীর সর্বত্র দেখতে পাই। ভাষার ভিন্নতা সত্ত্বেও রাষ্ট্র-আরোপিত কৃত্রিম জাতিপরিচয়ের পরিণতি, আমরা দেখেছি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সমসময়ের বিপর্যয় এবং তার করুণ পরিণতির মধ্যে। দেখেছি, পূর্ববাংলায়। দেখছি পাকিস্তানের বালুচ, সিন্ধি, পুশতু (খাইবার পাখতুন খোয়া) ও অন্যান্য ভাষাভাষীদের দ্বন্দ্ব। দেখেছি শ্রীলঙ্কার তামিলভাষী, কানাডার ফরাসিভাষীদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে। দেখেছি বহুজাতিক ভারতবর্ষে; জাতি এবং ভাষা প্রশ্নে অবিরাম রক্তক্ষরণ।
আমরা ভাষার সাহায্যে চিন্তা করি, ভাষার সাহায্যে জ্ঞান লাভ করি এবং ভাষার সাহায্যে তা মস্তিষ্কে ধরে রাখি। জীবজগতে একমাত্র মানুষেরই ভাষা এবং বর্ণমালা আছে। ভাষার কারণেই মানবসভ্যতার এত অগ্রগতি ও বিকাশ। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। ধর্মকে বাদ দিয়ে ব্যক্তি, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র চলতে পারে। কিন্তু ভাষাকে বাদ দিয়ে কখনই নয়। বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় এবং অন্তরতম নিয়ামক তার ভাষা। ধর্ম নয়, ভাষাই জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তি। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বাঙালির জাতীয় ঐক্য। তাই সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদ প্রতিরোধেও ভাষাভিত্তিক জাতি চেতনা সমাজবিকাশে এক বড় হাতিয়ার।
ব্যক্তি মানুষের এবং সামাজিক প্রয়োজনে ভাষার সৃষ্টি এবং তার বেড়ে ওঠা। তাই ভাষার বিকাশ ব্যক্তি এবং সমাজবিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যে কোনো সমাজে ভাষা হল, সেই সমাজবদ্ধ মানুষের যৌথসৃষ্টি। ভাষার কোনো শ্রেণি বা ধর্মচরিত্র বা পরিচয় নেই। সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেণিচরিত্র আছে। কিন্তু ভাষা শ্রেণির ঊর্ধ্বে। জাতির জাতিগত পরিচয়কে মুছে ফেলার সহজতম উপায়, জাতির নিজস্ব ভাষা থেকে সেই জাতির জনগণকে বিচ্ছিন্ন করে বিজাতীয় ভাষার দাসত্ব তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। হিটলারের মৃত্যুশিবির বা গ্যাসচেম্বার যা পারে না, কোনো জাতির ভাষাকে মুছে দেওয়া গেলে তা-ই সম্ভব। ভাষা বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে জাতিগত পরিচয়ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। সাহিত্য শ্রেণিবিভক্ত, কারণ তা শ্রেণিচেতনার সৃষ্টি। ভাষা শ্রেণির উর্ধ্বে, কারণ তা শ্রেণিনির্বিশেষে সমগ্র সমাজের যৌথসৃষ্টি। এই কারণেই সাহিত্যের উপর আক্রমণ আর ভাষার উপর আক্রমণ এক কথা নয়। ভাষার উপর আক্রমণ হলে মানুষ শ্রেণি-ধর্ম নির্বিশেষে তা প্রতিরোধ করে। এইভাবেই পূর্ববাংলার জনসাধারণ উর্দু সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ প্রতিরোধ করে বাংলা ভাষার স্বাধিকারকেই শুধু প্রতিষ্ঠা করেনি, নিজেদের জাতিগত স্বাধীন পরিচয়কেও বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা করেছে-তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে।
দুই
এই পটভূমিতেই আমরা দেখব, এপারে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিগত অস্তিত্বের সংকট এবং 'জাতীয় সংহতি'র আড়ালে দিল্লি-হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রটি। ভারত একটি বহুজাতিক দেশ। ভারতীয় বলে কোনো জাতি নেই। ভারতীয় বলে কোনো একক ভাষা বা সংস্কৃতি নেই। ভারতে রয়েছে বিভিন্ন জাতি, রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষা (১৯৭১-এর লোকগণনায় ভারতে তিন হাজারেরও অধিক ভাষা ও উপভাষা তালিকাভুক্ত করা হয়) ও সংস্কৃতি। ভারতীয় সংবিধানে বর্তমানে (২০২৫) অষ্টম তপশিলভুক্ত (Eight schedule) ভাষার সংখ্যা ২২টি। শুরুতে ১৯৫০-এ মূল সংবিধানে ১৪টি ভাষাকে এই তপশিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭, ১৯৯২ এবং ২০০৩ সালে বিভিন্ন সংশোধনী এনে আরো ৮টি ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ২২টি ভাষায় ভারতের ৯৬.৭১% মানুষ কথা বলেন। এর মধ্যে বাংলা: ৮.০৩%, মারাঠি ৬.৮৬%, তেলুগু ৬.৭%, তামিল: ৫.৭%।
হিন্দিভাষী অঞ্চলের নেতা, মন্ত্রী এবং ক্ষমতার কৃপাধন্য অহিন্দিভাষী অনুচরদের দ্বারা হিন্দিকে 'রাজভাষা' বা 'National Language' বলে অহিন্দিভাষীদের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া প্রচেষ্টা ১৯৪৭ পরবর্তী সময় থেকে অব্যাহত থাকলেও, ভারতীয় সংবিধানে 'রাজভাষা' বা 'National Language' বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। সংবিধানের Article 343-তে হিন্দি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাকে 'Official Languages' বলা হয়েছে। ২০১০ সালে গুজরাট হাইকোর্ট এক রায়ে এর সত্যতা দেশবাসীকে জানিয়ে বলেছে যে, 'Hindhi is not the National Language of India'। এ বিষয়ে কংগ্রেস দলের (দক্ষিণ ভারতীয়) নেতা সাংসদ শশী থারুর-এর বক্তব্য আগ্রহী ব্যক্তি ইউ টিউবে শুনে নিতে পারেন। (সূত্র: 'Shashi Tharoor on Hindhi Being The Official Language')
আমাদের পাসপোর্টে জাতীয়তার (Nationality) পাশে 'ভারতীয় (Indian) বলে যা লেখা থাকে, তা মোটেই আমাদের জাতীয় পরিচয় নয়। বর্তমান রাষ্ট্রীয় পরিচয় মাত্র। রাষ্ট্রীয় পরিচয় অস্থায়ী, জাতি পরিচয় স্থায়ী। এই রাষ্ট্রীয় পরিচয়টিও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের উত্তরাধিকার হিসেবেই প্রাপ্ত। এছাড়া অভিযোগ বর্তমান 'ভারতীয় ভাবনা এবং ভারতীয়ত্ববোধের মধ্যে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক চিন্তা বা মানসিকতা।' আবুল মনসুর আহমদ তাঁর 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইতে বলেছেন,
বাংলার রাজনীতি ভারতীয় রাজনীতি হইতে ছিল বেশকিছু পৃথক ও স্বতন্ত্র। নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে হিন্দুরা যে নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক শাসন চাহিতেন, বাংলার বেলা তা চাহিতেন না। বাঙালি হিন্দুরা বাংলায় মেজরিটি শাসন ও পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন উভয়টারই বিরোধী ছিলেন। এটা অবশ্য হিন্দুদের সাম্প্রতিক মনোভাব। উনিশ শতকের শেষে বিশ শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু কবি-সাহিত্যিক ও রাষ্ট্রনেতারা 'বাঙালি জাতিত্ব', 'বাংলার বৈশিষ্ট্য', 'বাংলার কৃষ্টি', 'বাংলার স্বাতন্ত্র্য' ইত্যাদি প্রচার করিতেন। অনেকে বিশ্বাসও করিতেন।
গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় ভোটাধিকার প্রসারে বাংলার রাষ্ট্রীয় অধিকার মেজরিটি মুসলমানের হাতে চলিয়া যাইবে এটা যেদিন পরিষ্কার হইয়া গেল, সেইদিন হইতে হিন্দুর মুখে বাঙালি জাতিত্বের কথা, বাংলার কৃষ্টির কথা, আর শোনা গেল না। তার বদলে, ভারতীয় জাতি', 'ভারতীয় কৃষ্টি', 'মহাভারতীয় মহাজাতি' ও 'আর্য সভ্যতা'র কথা শোনা যাইতে লাগিল।
বাঙালি হিন্দুদের বিষয়ে আবুল মনসুর আহমদ-এর এই সমালোচনার বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিত স্বীকার করে, বাঙালি জাতি প্রশ্নে তাঁর নিজস্ব অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসে, তিনি নিজে কি ধর্মের ঊর্ধ্বে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতি ভাবনার দ্বারা, নাকি ধর্মকে সামনে রেখে শুধুমাত্র উর্দুভাষীদের জন্য নিজস্ব হোমল্যাণ্ড গঠনে উর্দুভাষী কবি ইকবালের স্বপ্ন ও তত্ত্বে আস্থা রেখে ছিলেন?
উর্দুভাষী কবি ইকবাল মনে করতেন, শুধু ধর্ম প্রশ্নে মুসলমান হিন্দুদের থেকে আলাদা নয়, তাদের সংস্কৃতিও আলাদা এবং এই প্রশ্নে সারা ভারতে তারা কালচারাল মাইনরটি। মুসলমানদের নিজস্ব হোমল্যাণ্ড আদায় করেই তা রক্ষা করতে হবে। এবং তা ব্রিটিশদের অধীনে থেকে হলেও কবি ইকবালের আপত্তি নেই। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা বাংলা, বাংলার সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতি প্রশ্নে শাসক উর্দুভাষীদের কোন ভূমিকায় আমরা দেখলাম?
১৪ আগস্ট ১৯৪৭-এর পূর্বে পূর্ববাংলার জনসাধারণের জাতিগত পরিচয় ছিল বাঙালি। রাষ্ট্রগত পরিচয় ছিল 'ভারতীয়'। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ থেকে তাদের রাষ্ট্রগত পরিচয় হল 'পাকিস্তানি'। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের দিন থেকে পূর্ববাংলার মানুষ ঘাড় থেকে ঝেরে ফেললেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের বকলস। সেদিন থেকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় হল- বাংলাদেশি। এই ভাবে ২৪ বছরের মধ্যে পূর্ববাংলার জনসাধারণের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পালটে যায় তিনবার। পালটে যায় স্বাধীনতা দিবসের তারিখ। কিন্তু ব্রিটিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশ, তিন পর্বে তিন শাসনেই বাঙালির জাতিগত পরিচয় থাকে অভিন্ন। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় 'আমি কংগ্রেসিদের ভারতীয় জাতীয়তা বুঝি না, আমি বুঝি বাঙালির জাতীয়তা।' (আচার্য প্রফুল্লন্দ্র রায়)
বিগত এক দশকেরও কম সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন পালটে দিয়েছে পরিচিত পৃথিবীর মানচিত্র। জন্ম নিয়েছে নতুন দেশ, নতুন পতাকা। বহুজাতিক ভারতবর্ষের বুকেও ধূমায়িত হচ্ছে জাতিগত নানা অসন্তোষ। স্বাধীনতাকামী ও দেশপ্রেমিক জনসাধারণের রক্তে ভিজে যাচ্ছে কাশ্মীর, পাঞ্জাব, আসাম, মিজো ও নাগাভূমির মাটি।
এই প্রেক্ষাপটে প্রথমেই আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন, ব্রিটিশ শাসন এবং ১৯৪৭-এর পরবর্তী শাসনে বহুজাতিক ভারতের ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়টির উপর। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসক ভারতের প্রদেশগুলিকে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে তোলেনি। সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনিক স্বার্থ এবং সামরিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে শাসন বিভাগসমূহ গঠন করা হয়েছিল। অথচ, ১৮৩৭ সালে প্রাদেশিক সরকারগুলিকে জেলাস্তরের যাবতীয় কাজকর্ম মুঘল শাসনামলে প্রচলিত দরবারি ফারসি ভাষার পরিবর্তে, সেই প্রদেশের ভাষায় পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠিত না হওয়ার ফলে, এই নির্দেশে এক প্রদেশের মধ্যে অন্য ভাষাভাষী জনগণ বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হন। ফলে তাঁদের ভাষাকেও সেই প্রদেশে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার, অন্যথায়, সেই ভাষার জনসাধারণ যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই প্রদেশের সঙ্গে তাঁদের অঞ্চলকে যুক্ত করার দাবি জানান। যেমন মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত সম্বলপুর জেলার অধিকাংশ অধিবাসী ছিলেন ওড়িয়াভাষী। মধ্যপ্রদেশ সরকার যখন হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করলেন, তখন সম্বলপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ ওড়িয়াভাষী জনগণ ১৯০১ সালে চিফ কমিশনারকে এক লিখিত আবেদনপত্রে এর প্রতিবাদ করেন, এবং ওই জেলায় ওড়িয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার আবেদন জানান। অন্যথায় ওই জেলাকে ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানান। ইতিপূর্বে ১৮৯৫ সালের ১০ মে মধুসূদন দাসের সভাপতিত্বে কটকে অনুষ্ঠিত এক সভায়, সমস্ত ওড়িয়াভাষী অঞ্চলকে একই শাসন বিভাগের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হয়। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন আন্দোলনের ফলে ১৯০৫ সালে ওড়িয়াভাষীদের দাবি সরকার আংশিকভাবে হলেও মেনে নিতে বাধ্য হয়। সম্বলপুর জেলাসহ আরো কিছু ওড়িয়াভাষী অঞ্চল ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
১৯২৪ সালের 'রিফর্মস এনকোয়ারি কমিটি' এবং ১৯৩০-এর 'স্ট্যাট্যুটারি কমিশন' ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। কেননা একমাত্র ভাষার মাধ্যমেই সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। কংগ্রেস দল পূর্ব থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসনাধিকারের দাবিকে শক্তিশালী করার উদ্দেশে ভারতের প্রদেশগুলিকে ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠনের দাবি করে। ওই দাবির ভিত্তিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ১৯২০ সালের নাগপুর কংগ্রেস সম্মেলন কংগ্রেস দলের প্রাদেশিক কমিটিগুলিকে ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করে।
১৯৪৭-এ ক্ষমতা পাওয়ার পূর্বে কংগ্রেস ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের দাবির প্রতি কেবল যে সমর্থন জানিয়েছে কিংবা নিজ দলের প্রাদেশিক কমিটিগুলিকে ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করেছে, শুধু তা-ই নয়। এই দাবিতে আন্দোলনও সংগঠিত করেছে। ১৯১৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস দলের অধিবেশনে ভাষার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়।
ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবি ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠলে, ১৯২৮-এ অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় এক সম্মেলনে ওই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে এ বিষয়ে উপযুক্ত সুপারিশের জন্য মতিলাল নেহরু-র নেতৃত্বাধীন এক কমিটির উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনকে যুক্তিগ্রাহ্য এবং ন্যায়সংগত বলে বিবেচনা করে। কিন্তু অন্যান্য সকল বিষয়ের মতো ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের প্রশ্নেও কংগ্রেস দলের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পালটে যায়, ইংরেজের কাছ থেকে ক্ষমতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর কংগ্রেস আবিষ্কার করে 'ভাষা মানুষকে শুধু ঐক্যবদ্ধই করে না, পৃথকও করে। অতএব প্রদেশের সীমানা পুনর্বিন্যাসের সময় ভাষার সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা, জাতীয় সংহতি এবং অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশ্নটাও বিবেচনা করে দেখা দরকার'।
তিন
গণপরিষদের খসড়া কমিটির অনুমোদনক্রমে ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় এক সদস্য বিশিষ্ট 'Linguistic Provinces Commission'। কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এস কে ধরকে। ধর কমিশনের রিপোর্টে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিটি চূড়ান্তভাবে অবহেলিত হয়। ফলে, ধর কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আটদিন পর কংগ্রেস দল এই প্রশ্নে জয়পুরে এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে।
কমিটির দায়িত্বে ছিলেন জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও সীতারামাইয়া। ১৯৪৯-এর ১ এপ্রিল প্রকাশিত জে ভি সি কমিটির সদস্যদের নামের আদ্যক্ষর অনুসারে কমিটির নামকরণ। রিপোর্টে বলা হয়-
বর্তমান পরিস্থিতি নতুন প্রদেশ গঠনের অনুকূল না হলেও, রাজ্যের জনগণ এ বিষয়ে খুব আগ্রহী হলে গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে কংগ্রেস দল ভারতের সামগ্রিক কল্যাণের সঙ্গে সংগতি রেখে জনগণের এই দাবি মেনে নিতে কুণ্ঠিত হবে না।
ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের দাবির প্রতি সম্পূর্ণ বিরোধিতা করলে, বিষয়টি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে এবং কংগ্রেস দলও তার জনভিত্তি (ভোট) হারাতে পারে, একথা বিবেচনা করেই কংগ্রেস ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবির বিরোধিতা সরাসরি না করে, করে ঘুরিয়ে। এবং আত্মসমালোচনার (নাকি প্রতারণা) ভঙ্গিতে বলে, কংগ্রেস দল যখন ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবি সমর্থন করেছিল, তখন তারা এই নীতি কার্যকর করার সমস্যা, ফলাফল ও পরিণতির কথা বিবেচনা করে দেখেনি।
ব্রিটিশ ভারতে তেলুগুভাষী জনগণের স্বতন্ত্র অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের দাবি পূরণ হয়নি। তাদের আশা ছিল, 'স্বাধীনতা'র পর অবশ্যই তা কার্যকর হবে। কিন্তু ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পূর্ব প্রতিশ্রুতি থেকে শাসক কংগ্রেস দল সরে গেলে, তেলুগুভাষী জনগণ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের পথই বেছে নেন। সংবিধান তৈরি হওয়ার পরপরই স্বতন্ত্র অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবিতে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। ১৯৫২ সালে ওই দাবিতে অনশনে শ্রীরামালু-র আত্মাহুতিদান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। শহিদ বিপ্লবী যতীন দাস (জন্ম: ২৭ অক্টোবর ১৯০৪, অনশনে মৃত্যু: ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৯)-এর পর রামালু দ্বিতীয় ভারতীয় যিনি অনশনরত অবস্থায় প্রয়াত হন। বিক্ষুব্ধ জনতা রেলস্টেশন, থানা, পোস্ট অফিস প্রভৃতি আক্রমণ করে প্রশাসনকে সম্পূর্ণ অচল করে দেয়। আন্দোলনের তীব্রতার সামনে নতিস্বীকার করে স্বতন্ত্র অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য গঠনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় দিল্লি। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা, অন্যত্র ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবি এবং আন্দোলনে প্রেরণা জোগায়। ফলে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিষয়টি আর ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না, একথা বিবেচনা করে রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পার্লামেন্টে এক কমিশন নিয়োগের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু রাজ্য পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে গঠিত ওই কমিশনের জন্য যে নীতি স্থির করে দেওয়া হয়, তাতে প্রধান বিষয় হিসেবে রাখা হয়, ভারতের ঐক্য ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা এবং তা শক্তিশালী করার বিষয়টিকেই। ১৯৫৫ সালে ওই কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে। রাজ্য পুনর্গঠনে ভাষাই একমাত্র প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু তা না করে 'জাতীয় নিরাপত্তা'-র প্রশ্ন জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করে যে অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্যের সীমানার সঙ্গে রাজ্যের ভাষা ও অঞ্চলের নানা অসংগতি থেকে যায়। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবি দিল্লির কাছে 'জাতীয় সংহতির পরিপন্থী'। কারণ ভাষার সঙ্গে স্বতন্ত্র জাতিগত পরিচয়, জাতিগত চেতনা, জাতি মুক্তি ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নও জড়িত। আর এসব প্রশ্ন সামনে আসতে শুরু করলে, 'ভারতীয়' রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের আড়ালে বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলির উপর দিল্লি-হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দিতে পারে। এই আশঙ্কার কারণেই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনে দিল্লির বিরোধিতা। বরং দিল্লির পছন্দ এবং প্রস্তাব ছিল, দুই বা ততোধিক রাজ্য নিয়ে দ্বিভাষী বা বহুভাষী রাজ্য গঠন করে ভাষা এবং জাতিগত আত্মপরিচয়কে গুলিয়ে দেওয়া। এবং সবার উপর হিন্দির দাসত্ব চাপিয়ে দিল্লি নিয়ন্ত্রিত সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী করা।
দিল্লির ওই ষড়যন্ত্রমূলক মনোবাঞ্ছা পূরণে প্রথমে এগিয়ে এলেন, পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিংহ। তাঁরা বাংলা ও বিহার রাজ্যের সংযুক্তি প্রস্তাব করেন। বাংলা ও বিহার রাজ্যের সংযুক্তির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ওই প্রস্তাবকে জাতীয় সংহতির পক্ষে এক দৃঢ় পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ ওই প্রস্তাবের সমর্থনে পার্লামেন্টে বলেন, 'বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে যেভাবে বিচ্ছিন্নতা, স্বতন্ত্রবোধ ও ভাষার জন্য উন্মাদনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাকে স্তিমিত করার একমাত্র উপায় হল বহুভাষী বৃহৎ রাজ্যগঠন।'
দ্বিভাষী বা বহুভাষী প্রদেশ বা রাজ্যগঠনের পক্ষে কেন্দ্রীয় সরকার বা কংগ্রেস দল যাই বলুক, পশ্চিমবাংলার জনগণ তীব্র প্রতিবাদ জানালেন, বাংলা-বিহার সংযুক্তি নামক ওই ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। মানভূমের লোকসেবক সংঘ এবং পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন গণসংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সাহিত্যসভা এবং অকংগ্রেসি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে। প্রস্তাবিত ওই সংযুক্তির প্রতিবাদ করে তৈরি হয় নানারকম ব্যঙ্গ-কৌতুক। ওই সকল ব্যঙ্গ কৌতুকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছিল, পশ্চিমবাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল (১-১১-৫১ থেকে ৮-৮-৫৬) হীরেন্দ্রচন্দ্র মুখার্জির স্ত্রীর নামকে কেন্দ্র করে। তৎকালীন রাজ্যপালের স্ত্রীর নাম ছিল বঙ্গবালা মুখার্জি। কৌতুকে বলা হয়, বাংলা-বিহার সংযুক্তির পর তাঁর নাম হবে 'বিহঙ্গবালা' এবং ওই সংযুক্তির সঙ্গে ওড়িশা যোগ হলে তাঁর নাম হবে 'বিকলাঙ্গবালা'। বাংলা-বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে প্রধান যে সকল যুক্তি ছিল, তা হল, ওই সংযুক্তির ফলে নতুন সৃষ্ট প্রদেশে বাঙালিরা সংখ্যালঘু পরিণত হবে এবং নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাবে। তাছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দির চাপ সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা ও বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে বাঙালির জাতিগত অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে।... ইত্যাদি।
অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় ওই প্রস্তাব কার্যকর করতে ব্যর্থ হলে পদত্যাগ করার অঙ্গীকার করেন। ১৯৫৬-র ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখটি বাছা হয় পশ্চিমবাংলা রাজ্য বিধানসভায় ওই প্রস্তাব উত্থাপনের দিন হিসেবে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন কমিটি এবং বামপন্থী দলগুলি ওই দিনটিকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত করে হরতাল পালনের ডাক দেন। প্রতিবাদের ব্যাপকতা ও গভীরতা লক্ষ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ বিষয়ে আর অগ্রসর হতে দ্বিধা করে। ওই সময়ে কংগ্রেস দলের শক্ত ঘাঁটি কলকাতার উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রধান রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ওঠে বাংলা-বিহার সংযুক্তি প্রস্তাব। নির্বাচনে কংগ্রেস দলের প্রার্থী অশোক সেন পরাজিত ও বাংলা-বিহার সংযুক্তিবিরোধী বামপ্রার্থী মোহিত মৈত্র বিজয়ী হলে, ১৯৫৬ সালের ৩ মে পশ্চিমবাংলার মন্ত্রীসভায় বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব বর্জনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দ্বিভাষিক রাজ্য গঠনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলার ওই আন্দোলন আরো একবার প্রমাণ করে দেয় যে, ভাষাভিত্তিক রাজ্যই জনগণের লক্ষ্য ও কাম্য।
চার
দ্বিভাষী রাজ্য গঠনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলার জনসাধারণের আন্দোলন এবং প্রতিবাদ থেকে দিল্লির নেতৃবৃন্দ কিন্তু কোনো শিক্ষা গ্রহণে রাজি ছিলেন না। কারণ এর পরেও তারা মারাঠা ও গুজরাট নিয়ে দ্বিভাষী বৃহত্তর মুম্বই রাজ্য গঠনের প্রস্তাব করে এবং ১৯৫৬-র ১০ আগস্ট তা পার্লামেন্টে অনুমোদিত হয়। ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও মারাঠি এবং গুজরাটি জনগণ তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৫৭-র নির্বাচন মারাঠা ও গুজরাটের সংযুক্তির প্রশ্নকে কেন্দ্র করে (ওই অঞ্চলে) অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত অঞ্চলে কংগ্রেস দল, মহাগুজরাট পরিষদ ও সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতির প্রার্থীদের নিকট বহু আসনে পরাজিত হন। এতে শঙ্কিত হয়ে কংগ্রেস দল বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নেহরু কন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধিকে ওই অঞ্চলে প্রেরণ করে। পরবর্তী সময়ে শ্রীমতী গান্ধির রিপোর্টের ভিত্তিতে কংগ্রেস সভাপতি মুম্বই রাজ্যকে বিভক্ত করে স্বতন্ত্র মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট রাজ্য গঠনের সুপারিশ করেন। ১৯৬০ সালের ১ এপ্রিল লোকসভায় ওই প্রস্তাব অনুমোদিত হলে গুজরাটি ও মারাঠি জনগণের বহু আকাঙ্ক্ষিত মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্যের সৃষ্টি হয়।
পাঞ্জাবি (বর্ণমালা গুরুমুখী) ও হিন্দিভাষী সমন্বিত দ্বিভাষী রাজ্য পাঞ্জাবকে ভাষার ভিত্তিতে ভাগ করে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পাঞ্জাবি জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষিত হয়ে আসছিল। পাঞ্জাবকে ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত না করার দিল্লির নানা অজুহাতের মধ্যে প্রধানতম অজুহাত ছিল, সীমান্তবর্তী রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করলে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী নেহরু ১৯৬০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ওই কারণ দেখিয়ে পাঞ্জাব সুবার বিরোধিতা করেন। ফলে সারা পাঞ্জাবে অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পাঞ্জাবি এবং হিন্দিভাষী জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শাসন ব্যবস্থাতেও দেখা দেয় অচলাবস্থা। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার মূল সমস্যার সমাধানে না গিয়ে, নানাভাবে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
অপরদিকে আকালি দলের নেতৃত্বে স্বতন্ত্র পাঞ্জাব রাজ্যের জন্য আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ওই সময় মাস্টার তারা সিং ও সন্ত ফতে সিং ওই দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করলে অবস্থা ভয়ংকর রূপ নেয়। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় লোকসভার স্পিকার সর্দার হুকুম সিংয়ের নেতৃত্বে ওই বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য এক পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করতে। সমস্ত দিক পর্যালোচনার পর কমিটি ভাষার ভিত্তিতে পাঞ্জাব রাজ্য পুনর্গঠনের জন্য সুপারিশ করে। ১৯৬৬ সালের ১ নভেম্বর ওই সুপারিশ পার্লামেন্টে অনুমোদন লাভ করে সৃষ্টি হয় পাঞ্জাবিভাষী (গুরুমুখী) অঞ্চল নিয়ে পাঞ্জাব এবং হিন্দিভাষী অঞ্চল নিয়ে নতুন হরিয়ানা রাজ্য। কিন্তু রাজধানী চন্ডিগড়কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করা হয় আর এক নতুন সমস্যা।
বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলির ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দুর্বার আন্দোলনের ফলেই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠিত হলেও, রয়ে গেছে নানা অসংগতি। এখনো একভাষী অঞ্চল রয়ে গেছে অন্যভাষী রাজ্যের মধ্যে। যেমন বাংলাভাষী মানভূমের পাঁচটি থানা অঞ্চল। এ ছাড়া ধলভূম, সিংভূম, কাছাড়, গোয়ালপাড়া প্রভৃতি জেলা বা অঞ্চলগুলি রয়ে গেছে অন্যভাষী রাজ্যের মধ্যে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ভারতীয় সংবিধানের ৩নং ধারার স্বৈরাচারী ও আগ্রাসী ব্যবস্থার প্রসঙ্গটি। ওই ধারার বলে রাজ্যের গোটা অস্তিত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জিনির্ভর। ভারতীয় সংবিধানে ৩নং ধারার সাহায্যে যে কোনো রাজ্যের নাম পরিবর্তন, সীমানা পরিবর্তন এমনকী কোনো রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটিয়ে তা অন্য রাজ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার সাংবিধানিক ক্ষমতা পর্যন্ত রয়েছে দিল্লির হাতে। ১৯৫৫ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পূর্ব পর্যন্ত কেন্দ্রকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মতামত (অনুমতি নয়) গ্রহণ করার একটি আনুষ্ঠানিক বিধি পালন করতে হত। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীর পর সংশ্লিষ্ট রাজ্যের 'মতামত' নেওয়ার বালাইও ফুরিয়েছে দিল্লির।
ব্রিটিশ শাসনে ভারতের ভাষা বৈচিত্রে্যর কথা বিবেচনা করে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এই শতকের (বিংশ শতাব্দী) প্রথম দশক হতেই ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন এবং প্রাদেশিক স্তরে স্বায়ত্ত শাসনাধিকারের দাবি উত্থাপন করে। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে যে সর্বদলীয় সংবিধান কমিটি গঠিত হয়, সে কমিটিও ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন এবং ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো প্রবর্তনের সুপারিশ করে।
পাঁচ
১৯৪৬ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে কংগ্রেস ভারতের অঙ্গরাজ্য সমূহের স্বেচ্ছামূলক সংযুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করে। ওই প্রস্তাবে বলা হয় অঙ্গরাজ্যসমূহ হবে স্বয়ংশাসিত এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদত্ত সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কিত অত্যাবশ্যকীয় ক্ষমতা ব্যতিরেকে, বাকি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হবে রাজ্য। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশনের নিকট তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক-বিষয়ক এবং যোগাযোগ এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রের হাতে রেখে বাকি সমস্ত ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যগুলিকে প্রদানের প্রস্তাব করেন। তাঁর প্রস্তাবে এই তিনটি বিষয় ছাড়া আর সমস্ত বিষয় থাকবে রাজ্যের ক্ষমতায়। ১৯৪৬-এর ১৩ ডিসেম্বর গণপরিষদের সভায় জওহরলাল নেহরুর সাংবিধানিক নীতিবিষয়ক ঘোষণাতে বিকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব এবং জণগনের দ্বারা নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভার আইন প্রণয়নের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানে রাজ্যকে সেই অধিকার দেওয়া হয়নি। রাজ্য বিধানসভায় আইন পাশের অধিকার থাকলেও, রাষ্ট্রপতির (কেন্দ্রীয় সরকার) সম্মতি বা অনুমোদন ছাড়া, সেই আইন কার্যকর বা প্রয়োগ করার অধিকার রাজ্যের নেই।
ব্রিটিশ সরকার ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব হিসেবে ১৯৩৩-এর মার্চে এক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। সংবিধানের ওই খসড়া প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা করে দেখার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক যুক্তকমিটি গঠন করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যুক্তকমিটি ১৯৩৫-এর ৫ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাব, কমন্স সভায় বিল আকারে পেশ করে। বিলটি পার্লামেন্টের উভয় সভার অনুমোদন লাভ করে ১৯৩৫-এর ২ আগস্ট 'ভারত শাসন আইন'-এ পরিণত হয়। ১৯১৯-এর ভারত শাসন আইনের ব্যর্থতার কারণেই ১৯৩৫-এ নতুন আইন বা সংবিধানের সৃষ্টি। ১৯৩৭-এর ১ এপ্রিল, ব্রিটিশ-ভারতে আইনটি কার্যকর হয়।
১৯৩৫-এর 'ভারত শাসন আইন' প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দিল্লিতে কেন্দ্রীভূত করা হয়। রাজ্যের হাতে ক্ষমতা বলতে প্রায় কিছুই থাকে না। স্বেচ্ছামূলক সংযুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার এবং বিকেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার 'সমর্থক' কংগ্রেস ১৯৩৫ সালের 'ভারত শাসন আইন'-এর কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতাই শুধু করে না, ১৯৩৬-এ লখনউতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস দলের সম্মেলনে দলের সভাপতি জওহরলাল নেহরু ওই আইনকে 'দাসত্বের নয়া সনদ' বলে বর্ণনা করেন। তিনি এমন হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন যে, ওই আইনের আওতায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কংগ্রেস অংশগ্রহণ পর্যন্ত করবে না।
১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন বা সংবিধানের ভিত্তিতে ব্রিটিশ-ভারতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৭-এর জানুয়ারি মাসে। কংগ্রেসও ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে 'ভারতের আপামর জনগণের সামনে কংগ্রেসের ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্যই...'। ১৯৩৭-এর নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে (যুক্তপ্রদেশ) কংগ্রেস মুসলিম লিগের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করে যৌথভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। মুসলিম লিগের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাতের কারণ ছিল, নেহরু ভেবেছিলেন কংগ্রেস এককভাবে ওই রাজ্যে (উত্তরপ্রদেশে) ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কিন্তু নির্বাচনে কংগ্রেস একাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়। ফলে মুসলিম লিগের প্রয়োজনও কংগ্রেসের কাছে ফুরিয়ে যায় এবং মন্ত্রীসভায়ও মুসলিম লিগের স্থান হয় না। উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশ মুসলিম লিগ নেতা খালিকুজ্জামান মন্ত্রীসভায় তিনটি আসন বা পদ চেয়েছিলেন। কংগ্রেস দলের ওই অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং মন্ত্রীসভা পরিচালনার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দু-মুসলমান জনতাকে ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত করে দেয়। ১৯৩৭-এর নির্বাচনে এ কে ফজলুল হক ('কৃষক প্রজা পার্টি') কংগ্রেস দলের সঙ্গে বাংলায় কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৭৯৩-এর 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত'-র ফলে সৃষ্ট জমিদারদের স্বার্থরক্ষাকারী কংগ্রেস ছিল, ফজলুল হকের কৃষক-কৃষি দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী। তাই ফজলুল হকের আহ্বান কেন্দ্রীয় কংগ্রেস দল প্রত্যাখ্যান করে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ওই নির্বাচনেই 'কৃষক প্রজা পার্টি'র চোদ্দো দফা নির্বাচনী ইস্তাহারে বাংলার জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়েছিল। ফজলুল হক বুঝেছিলেন, হিন্দু- মুসলমান ঐক্য ছাড়া বাংলার উন্নতি সম্ভব নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস দলের বিভেদপন্থী এবং বাঙালি বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের অন্যান্য স্থানের মতো, বাংলার মুসলমানকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি ঐক্যের পরিবর্তে, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় ঐক্যের দিকে কার্যত ঠেলে দেয়। ১ এপ্রিল ১৯৩৭তারিখে মুসলিম লিগের সঙ্গে মিলে ফজলুল হক বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রী বলা হতো) হিসেবে শপথ নেন। ওই বছর তিনি মুসলিম লিগের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে অংশ নেন। তিনি বাংলা প্রদেশের মুসলিম লিগের সভাপতি হন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪০-এর ২৩ মার্চ মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে ঐতিহাসিক 'লাহোর প্রস্তাব' (ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ। পাকিস্তান নামটি অবশ্য প্রস্তাবে ছিল না।) উত্থাপন করেন শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক। এই প্রশ্নে অবশ্য বাংলার জমিদারদের নির্মম প্রজাশোষণ এবং বাঙালি মুসলমানদের প্রতি বর্ণহিন্দুদের নিষ্ঠুর অমানবিক ব্যবহারকেও দায়ী করা হয়।
১৯৩৭-এর নির্বাচনে জয়ী প্রদেশগুলিতে 'ভারতের জাতীয় কংগ্রেস' মদন মোহন মালব্যের 'হিন্দু, হিন্দি, হিন্দুস্থান' নীতিকে কার্যকর করতে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, পরবর্তীতে তার মূল্য দিতে হয় কোটি কোটি দেশবাসী এবং বিশেষ করে বাংলা ও পাঞ্জাবকে। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে বৈষম্য মূলক আচরণ-অবিচার ও অন্যায় জুলুমের কারণে, সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক নষ্ট হয়। অনৈক্যের সৃষ্টি করে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের। ক্ষেত্র তৈরি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। মুসলমানদের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার কংগ্রেসশাসিত প্রদেশগুলিতে সংগঠিত হয়, তা অনুসন্ধানের জন্য মুসলিম লিগ অনুসন্ধান কমিটি নিয়োগ করে। একটি কমিটি গঠিত হয় পিরপুরের রাজার অধীনে। ওই কমিটির রিপোর্ট 'পিরপুর রিপোর্ট' নামে পরিচিত।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ওই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কংগ্রেস দলের তিন বর্ণের পতাকা বিভিন্ন সরকারি ভবনে উত্তোলন করা, মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদের 'বন্দেমাতরম' গানটি গাইতে এবং গান্ধিজির ছবিকে পুজো করতে বাধ্য করা হয়। এছাড়া মুসলমানদের গরুর মাংস খাওয়া থেকে জোর করে বিরত রাখা ও সকল প্রতিষ্ঠান থেকে মুসলমানদের ছাঁটাই করা হয়।
ছয়
১৯৩৫ সালের কেন্দ্রীভূত ভারত শাসন আইনের বিরোধিতায় কংগ্রেস দলের আসল উদ্দেশ্য ছিল, বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলির জাতিগত স্বাধীনতা ও স্বাধিকার-চেতনাকে প্রতারিত করা। এই একই প্রক্রিয়ায় প্রতারিত করা হয়েছে বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি ও জনগণের নানা আশা-আকাঙক্ষাকে। যেমন, ১৯৪৫ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন, 'স্বাধীন ভারতে কালোবাজারিদের নিকটতম ল্যাম্প-পোস্টে ঝোলানো হবে'। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৬৪-র ২৭ মে, জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ওই দীর্ঘ সময়ের (১৬ বছর ৯ মাস ১২ দিন) মধ্যে কতজন কালোবাজারিকে তিনি ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে ছিলেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। ভারতবর্ষের মানুষ কিন্তু 'চাচা নেহরু'-র রাজত্বকালেই জেনে গিয়েছিলেন অন্য কথা। 'যার টুপি যত সাদা, তার তত কালো টাকা'। এই আলোচনায় এ কথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ১৯৮৯ সাল ছিল ক্ষুদিরাম, শরৎচন্দ্র বসু, মুজফফর আহমেদ ও জওহরলাল নেহরু-র জন্ম শতবর্ষের বছর। তার আগের বছর ১৯৮৮ ছিল অবিভক্ত বাংলার প্রথম শহিদ প্রফুল্ল চাকী-র জন্ম শতবর্ষের বছর। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল এক অমাবস্যার রাতে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু বোমা ছুড়ে কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে, ভুল করে অন্য এক ইংরেজ মহিলা ও তাঁর কন্যাকে হত্যা করেন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন ১ মে, আর প্রফুল্ল চাকী গ্রেপ্তার এড়াতে মোকামাঘাট স্টেশনে নিজের রিভলবার দিয়ে আত্মহত্যা করেন ২ মে ১৯০৮। (তিনি আত্মহত্যা করেন, না কি তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ এবং বিতর্ক আছে।)
মজফফরপুর জেলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় ১৯০৮-এর ১১ আগস্ট। কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকদের কাছে একমাত্র নেহরু ছাড়া অন্য সবাই ব্রাত্য। এই সূত্রে উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৫৬ সালে মজফফরপুরে পণ্ডিত নেহরু শহিদ ক্ষুদিরাম-এর মূর্তিতে মালা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। নেহরু-র এই আচরণের প্রতিবাদে 'বনধ' পালিত হয় বিহারে। গণতন্ত্র ও 'সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ'-এর নামে বহুজাতিক ভারতবর্ষে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন 'রাজপরিবার'-এর শাসন। তাই রাজীব গান্ধি দাদুর জন্মশতবর্ষে সরকারি কোষাগারের তিনশো কোটি টাকা খরচ করে নেহরু-গান্ধি রাজপরিবারের মহিমা প্রচার করলেন, 'রাজ' পারিবারিক শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে। যেন নেহরু-গান্ধি পরিবারের মহিমা কিছুমাত্র মলিন হলে 'ভারতীয় ঐক্য সংহতি' হবে বিপদাপন্ন, স্তব্ধ হবে দেশের এগিয়ে চলা এবং 'মেরা ভারত মহান'-এর মুখে পড়বে চুনকালি। একথা যেমন জানেন নেহরু-গান্ধি পরিবারের চাকর-বাকরতুল্য কংগ্রেসি নেতা এবং দিল্লি ক্যাবিনেট ও পার্লামেন্টের ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যরা; তেমনি মানেন অন্যান্য 'সর্বভারতীয়' দলের নেতৃবৃন্দও। ডান-বাম নির্বিশেষে ভারতীয় রাজনীতির এখন একমাত্র বিবেচ্য বিষয় 'সবার উপর সংহতি সত্য, তাহার উপর নাই'। সেই কারণেই পশ্চিমবাংলার প্রতি দিল্লির সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসন এবং রবীন্দ্র-নজরুলের জন্মভূমিতে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির উপর নির্বিচার ধর্ষণকার্য চললেও, 'আমরা চাপ সৃষ্টি করার জন্য এমন কিছু বলতে বা করতে পারছি না যার ফলে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়'। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের 'সেফটি ভাল্ড' ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের মতো 'বাঙালির অভিভাবক' জ্যোতি বসু-র এই উক্তির পরেও তাঁকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, কেন তাঁরা ১৯৫৬-র বাংলা-বিহার সংযুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন? কিংবা 'পশ্চিমবাংলাকে দিল্লির কলোনি বানাতে দেব না' এমন বিপজ্জনক ও চরম বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান ১৯৭১ পর্যন্ত কেন দেওয়ালে লিখেছিলেন?
অভিযোগ বহুজাতিক ভারতবর্ষের জাতিগুলির সঙ্গে কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতারণার মতোই, পশ্চিমবাংলার জনগণের সঙ্গে প্রায় একইভাবে প্রতারণা করে চলেছে 'মার্কসবাদী' নামধারীরা। এই সূত্রে 'মার্কসবাদী মুখ্যমন্ত্রী'-র ওই মন্তব্য প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সুইডেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯০৪ সালে নরওয়ের জন্ম হলে, নবজাত ওই রাষ্ট্রকে স্বাগত জানিয়েছিলেন স্বয়ং লেনিন।
সাত
যে নেহরু স্বয়ং ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনকে বলেছিলেন 'দাসত্বের নয়া সনদ', সংবিধান তৈরির পর, সেই নেহরু-র কণ্ঠেই উচ্চারিত হতে শোনা যায় 'আমরা ১৯৩৫ সালের আইনের কোনো পরিবর্তন করিনি'। 'অবশ্য কোনো পরিবর্তন' না করার কথাটাও সত্য নয়। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনেও যেটুকু ক্ষমতা রাজ্যের ছিল, 'স্বাধীন ভারতের সংবিধান' তাও কেড়ে নেয়। ১৯৩৫-এর ব্রিটিশশাসিত সংবিধানে রাজ্যের নিজস্ব বেতারকেন্দ্র স্থাপনের অধিকার ছিল। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি গৃহীত ভারতের সংবিধানে রাজ্যের সে অধিকার রাখা হয়নি। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮৬ বার' তা সংশোধন করা হয়েছে (১৯৯৫ সময়কাল পর্যন্ত)। প্রায় প্রতি সংশোধনে রাজ্যকে বঞ্চিত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে দিল্লিতে। যেমন জরুরি অবস্থার দুঃশাসনকালে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে রাজ্য তালিকা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যৌথ তালিকায়। কেন্দ্রীয় তালিকার মতো যৌথ তালিকার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রই শেষ কথা। এই সূত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭৭-এর সাধারণ নির্বাচনে জরুরি অবস্থার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণেই নেহরু-গান্ধি পারিবারিক শাসনের সাময়িক অবসান ঘটে। কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয় বামপন্থীদের 'বন্ধু' জনতা সরকার। কিন্তু বামপন্থীদের দাবি সত্ত্বেও 'বন্ধু' সরকারের ২৮ মাসের আয়ুষ্কালেও শিক্ষাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি রাজ্য তালিকায়।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল প্রশ্নে বহুজাতিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি এবং জনসাধারণের উপর সংবিধানের নামে যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আসলে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের এক আইনি ব্যবস্থা মাত্র। ওই ব্যবস্থার কারণেই অন্যান্য জাতিগুলির মতো বাঙালিও আজ নিজভূমে পরবাসী এবং আধিপত্যবাদী শাসন-শোষণের শিকার। ফলত ১৯৪৭-এর বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যা পেয়েছে, তা শাসক-শোষক প্রভু বদল ছাড়া অন্যকিছু নয়।
দুশো বছরের ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নির্মম শাসন ও তীব্র শোষণেও বাংলা ও বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচয় বিলুপ্ত হয়নি। বরং একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইংরেজ আমলেই বাংলা গদ্য চর্চার শুরু এবং তার বিকাশ। ১৮০০ সালের মে মাসে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং উইলিয়াম কেরির অবদানে ১৮০১ সালে প্রকাশিত হল রামরাম বসুর 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত'। বাঙালি লেখকের রচনায়, বাংলা হরফে মুদ্রিত এটিই ছিল প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ। এর মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতির উৎকর্ষ এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছয়, যে তা শুধু বাংলাকে নয়, বিশ্ব সভ্যতার ক্রমবিকাশেও বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হয়।
অথচ ৪৮ বছরের দিল্লির শাসনে বাঙালির জাতিগত অস্তিত্বের নাভিশ্বাস উঠছে (১৯৯৫ বর্ষ ধরে)। এবং রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের জন্মভূমি পশ্চিমবাংলা থেকে বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি আজ মুছে যাওয়ার উপক্রম। কারণ 'দেশে অনেকগুলি ভাষা থাকার ফলেই অনেক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। একটি জাতীয় ভাষা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে দূরদর্শন, বেতার ও চলচ্চিত্র'। হিন্দি সাহিত্যের জন্য 'ভারত ভারতী পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির উক্তি, ৬ ডিসেম্বর ১৯৮৫।
রাজীব গান্ধির ওই মন্তব্যের সূত্রে স্মরণে আসে ১৯৫২-র ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পলটন ময়দানে পাকিস্তান মুসলিম লিগের সম্মেলন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত এক সভায় 'একাধিক রাষ্ট্রভাষা থাকিলে কোনও রাষ্ট্র শক্তিশালী হইতে পারে না'। পাকিস্তানের তৎকালীন মুসলিম লিগ প্রধানমন্ত্রী উর্দুভাষী খাজা নাজিমুদ্দিন-এর এই মন্তব্য স্মরণে আসে। ওই মন্তব্যের কয়েকদিন পর ৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাক প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বলেন, 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে বাহিরের হুমকি অপেক্ষা প্রাদেশিকতাই অধিকতর মারাত্মক।'
বেতার, চলচ্চিত্র, দূরদর্শন এবং দিল্লি-নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠান আজ হিন্দির স্টিম রোলারে পরিণত। এই স্টিম রোলার অন্যত্র, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তীব্র বাধা পেলেও, পশ্চিমবাংলায় এর বিচরণ অবাধ ও সীমাহীন। নেহরু থেকে নরসীমা (শেষোক্তজন অবশ্য ভরতের মতো প্রক্সি দিচ্ছেন নেহরু-গান্ধি পরিবারের পঞ্চম পুরুষের অভিষেকের জন্য) যাঁরা গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দির অবাধ বিচরণ দেখতে চান অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো, তাঁরা কিন্তু ভুলেও একটি হিন্দি শব্দ উচ্চারণ করেন না দক্ষিণ ভারত সফরে গিয়ে। বরং 'রাষ্ট্রীয় মোর্চা' ক্ষমতায় এলে দক্ষিণ ভারতীয়দের উপরও তারা হিন্দি চাপিয়ে দেবে বলে প্রয়াত রাজীব গান্ধি গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেন তামিলনাডুর নির্বাচনী জনসভায়। এমনকী হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান'-এর উগ্রবাদী সংগঠন বি জে পি-ও 'দক্ষিণ ভারতীয়দের হিন্দিবিরোধী মনোভাবকে মর্যাদা দেয়'। [মুরলী মনোহর যোশী, সভাপতি বিজেপি। সূত্র: আজকাল ৭-৬-১৯৯১]।
দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে হিন্দিওয়ালাদের এই মনোভাব ও মানসিকতার পিছনে গণতান্ত্রিক চেতনা বা উদারতা নয়; আছে দক্ষিণ ভারতীয় জনসাধারণের ভাষাগত এবং জাতিগত স্বাধিকার চেতনা বিষয়ে ভয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, হিন্দি আধিপত্য প্রতিরোধ করেই ১৯৬৭ সালে তামিলনাডুতে ডি এম কে সরকারের প্রতিষ্ঠা। এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত (২০২৫) আর কোনো তথাকথিত 'সর্বভারতীয়' রাজনৈতিক দল ওই রাজ্যে আর ক্ষমতার কলকে পায়নি। শুধু তাই নয়, ডি এম কে দলের প্রতিষ্ঠাতা আন্নাদুরাই হিন্দি চাপাবার প্রশ্নে ভারতীয় সংবিধান পুড়িয়ে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এইসব কারণেই দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে যে সতর্কতা এবং আড়ালের প্রয়োজন হয়, পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে দিল্লির সে বালাই নেই। কারণ আমরা 'এমন কিছু বলতে বা করতে পারছি না যার ফলে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়'। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী রাজীর গান্ধির মন্ত্রীসভার 'কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী' রামনিবাস মির্ধাও কলকাতায় এসে স্বচ্ছন্দে আমাদের জ্ঞান দিয়ে যান-সমস্ত ভারতবাসী যেদিন একই ভাষায় (হিন্দিতে) কথা বলবেন, সেদিন বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা সমস্ত ভারতবর্ষকে যে ঘোর সংকটের সামনে এনেছে, তা-ও দূর হবে।' [সূত্র: আজকাল ১৭-৯-৮৯] জাতীয় সংহতির ঘোর সংকট থেকে দেশকে উদ্ধার করতে শুধু 'সর্বভারতীয়' রাজনৈতিক দলগুলিই নয়, এগিয়ে এসেছে বেসরকারি ব্যবসায়ী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। তাই পশ্চিমবাংলায় তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা আজ ব্রাত্য!
আট
এপারে যেমন ভারতীয় সংহতি রক্ষার জন্য মাথাব্যথা, ওপারেও তেমনই ছিল। যে পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে ১৩০০ মাইলের ব্যবধানে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত, সেই পাঁচ প্রদেশের বালোচ, সিন্ধি, পশতু, পাঞ্জাবি, বাংলা- ভাষার কবর রচনা করে তার উপর উর্দুসাম্রাজ্যের নিজস্ব হোমল্যান্ড ও রাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তান সংহতির বুলি আওড়েছে। যদিও এই সত্য আমাদের অনেকের জানা নেই, যে পাঁচটি প্রদেশ বা স্থান নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়ে ছিল, ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বর্তমানে যে চারটি অবশিষ্ট রয়েছে, তার কোনো প্রদেশের ভাষা উর্দু ছিল না, নয়। দখলদার বাহিনীর মতো উর্দুকে উপর থেকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৪৮-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য এক সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ও মুসলিম লিগ নেতা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ মুসলিম লিগ সদস্যদের বিরোধিতায় ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায় এবং তিনি লাঞ্ছিত হন। কারণ তাঁদের কথায় 'মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এবং দেশের সংহতি রক্ষার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে মাত্র একটি এবং তা হবে ইসলামের ভাষা উর্দু'। তাদের দর্শন ও দৃষ্টিতে বাংলা ভাষা ছিল হিন্দুদের ভাষা এবং বাংলা ভাষার দাবি 'হিন্দু ভারতের চক্রান্ত'। পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লাঞ্ছিত হন 'হিন্দু ভারতের চর' হিসেবে।
১৯৯৪-এ প্রকাশিত 'শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক গ্রন্থ'-এর সম্পাদকীয় কলমে, সম্পাদক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন-
পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার পরে জন্মভূমি ত্যাগ করে ধীরেন্দ্রনাথ চলে যাননি- যদিও তিনি জানতেন যে, ভারতে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে সম্মান আর পাকিস্তানে নিগ্রহ। এরও কারণ, যে-মানুষের মধ্যে তিনি জন্মেছিলেন, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে তাদের সঙ্গে তাঁর একাত্মবোধ। নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেই তাই তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও সমান মর্যাদা দিতে হবে। এ ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলার দাবি জানানোর প্রথম পদক্ষেপ। সেদিন তাঁকে অনেক রূঢ় কথা শুনতে হয়েছিল, আখ্যা পেতে হয়েছিল দেশদ্রোহীর। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামীর জন্য এ-অভিধা অপপ্রযুক্ত হলেও সেদিনকার বাস্তব পরিবেশে তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সেই অনাড়ম্বর প্রয়াস থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়ে গেল, এ ঐতিহাসিক সত্য অস্বীকার করবার জো নেই।
১৯৭১-এর মার্চে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কুমিল্লার বাড়িতে নিজ হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলেন। ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে ১৯৭১-এর মার্চ মাসের ২৯ তারিখ বর্বর পাক সেনা এবং দেশীয় রাজাকাররা তাঁকে এবং তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর ৮৫ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং পুত্রের দেহেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কতটুকু মর্যাদা এবং সম্মান পেয়েছেন ভাষা সংগ্রামী শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত? বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম তাঁকে কতটুকু জানেন?
ভারতীয় সংবিধান রচয়িতা বি আর আম্বেদকর-এর দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল বহুজাতিক ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে 'বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য' নীতির পরিপন্থী বা বিরোধী। ভারতের মতো এক বহুজাতিক বিশাল দেশের সংবিধান রচয়িতা ছিলেন ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের ঘোর বিরোধী। এবং ভাষাপ্রশ্নে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় স্তরে একমাত্র হিন্দি ব্যবহারের পক্ষে। আম্বেদকরের মতে প্রত্যেক রাজ্যকে যদি নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী সরকারি ভাষা নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়, তবে সমগ্র ভারতের জন্য একটি জাতীয় ভাষা (হিন্দি) প্রবর্তনের পথে শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে, তাই নয়; ভাষাগত বৈচিত্রের জন্য শাসন ব্যবস্থাতেও সৃষ্টি হবে এক অচলাবস্থা।
প্রথমে কংগ্রেসের দলীয় সভায় মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে হিন্দির পক্ষে প্রস্তাব পাশ হলেও সাংবিধানিক সভায় হিন্দিকে সরকারি কাজের ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রশ্নে সদস্যদের মধ্যে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। আম্বেদকর নিজেই স্বীকার করেছেন এ কথা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সাংবিধানিক সভার সদস্যদের কেউ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সদস্য ছিলেন না। তাঁরা মূলত ছিলেন শাসক কংগ্রেস দলের ছত্রছায়ায় থাকা কৃপাপ্রার্থী। তা সত্ত্বেও হিন্দি চাপাবার প্রশ্নে অহিন্দিভাষী সদস্যদের বিরোধিতার মধ্যে ধরা পড়ে অহিন্দিভাষী জনগণের মানসিকতা। এ প্রসঙ্গে ওড়িশার বিশ্বনাথ দাস এবং বাংলার সতীশচন্দ্র সামন্ত-র নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত মহকুমা জাতীয় সরকারের (ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ওই বিপ্লবী সরকারের স্থায়িত্ব ছিল ১৭ডিসেম্বর ১৯৪২ থেকে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪।) প্রথম শাসনকর্তা সতীশচন্দ্র সামন্ত সাংবিধানিক সভায় বাংলাকে সরকারি কাজের ভাষা করার দাবি জানান।
সংবিধানের ৩৪৩ নং ধারায় নাগরী হরফে (হিন্দির নিজস্ব কোনো হরফ না থাকায়) লিখিত হিন্দি ভাষাকে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষারূপে গ্রহণ করা হয়। তবে যেহেতু এক্ষুনি ইংরেজির সম্পূর্ণ অবসান সম্ভব নয়, সেহেতু সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরও আরো পনেরো বছর ইংরেজির ব্যবহার চলবে বলে স্থির হয়। সংবিধানের ৩৪৫ নম্বর ধারায় রাজ্যগুলিকে সরকারি কাজ পরিচালনার জন্য নিজেদের পছন্দমতো এক বা একাধিক ভাষা অথবা হিন্দি ভাষা গ্রহণের অধিকার দেওয়া হয়।
হিন্দিকে কীভাবে এবং কত দ্রুত ইংরেজির পরিবর্তে সর্বত্র ব্যবহার করা যায়, তা বিচার করে দেখার জন্য সংবিধানের ৩৪৪ নম্বর ধারায় সংবিধান গৃহীত হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে একটি ভাষা কমিশন নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়। এবং ভাষা কমিশনের সুপারিশ বিচার-বিশ্লেষণের জন্য পার্লামেন্টের উভয়পক্ষের সদস্যদের নিয়ে এক পার্লামেন্ট কমিটি নিয়োগের কথাও বলা হয়। সংবিধানের ৩৪৪ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি ১৯৫৬ সালে এক ভাষা কমিশন গঠন করেন। ভাষা কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার এবং কংগ্রেস দলের একান্ত আস্থাভাজন ও অনুগত বি জি খের-এর উপর।
ভাষা কমিশন উচ্চ বিচারালয় (সুপ্রিম কোর্ট) সহ কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে হিন্দি ভাষার ব্যবহার ত্বরান্বিত করার বিষয়ে সুপারিশ করে। এবং ১৯৬৫-র বর্ষ শুরু থেকে ভারত সরকারের যাবতীয় কাজে হিন্দি ভাষার একমাত্র ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করার জন্য ভাষা কমিশন সময়ের সীমারেখা টেনে দেয়। ভাষা কমিশনের ছ-জন সদস্য কমিশনের এই সুপারিশের বিরোধিতা করেন। অনেক সদস্য স্বতন্ত্র রিপোর্টে ইংরেজিকে প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করেন। এই প্রসঙ্গে (একদা যিনি হিন্দি ভাষার প্রতি ছিলেন বিশেষ অনুরক্ত এবং ওই ভাষীদের দ্বারা পুরষ্কৃত) ভাষা কমিশনের বিশিষ্ট সদস্য প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর মন্তব্য স্মরণযোগ্য-
আজ যেন দেশের একমাত্র কাজ হল হিন্দি ভাষার উন্নতিসাধন। যেভাবে হিন্দি ভাষাকে জোর করে অন্যের ওপর চাপানো হচ্ছে এবং প্রচার করা হচ্ছে যে হিন্দিই হল ভারতের ঐক্যের আদর্শ তাতে অন্যান্য সকল ভাষা নিজ নিজ রাজ্যে পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। ফলে প্রচণ্ড জনবিক্ষোভের সূচনা হবে। আমি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি যে এইভাবে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার ফলে ভারত কিছু ভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যাবে।
হিন্দি প্রশ্নে সুনীতি চট্টোপধ্যায়ের ভূমিকা বিষয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি মন্তব্য উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন,
'উনি (সুনীতি চট্টোপধ্যায়ের) হিন্দিভক্ত ছিলেন খুবই, ভীষণ হিন্দিভক্ত। এবং হিন্দিওয়ালাদের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু পরে কাণ্ডকারখানা দেখে ক্ষেপে গেলেন। হিন্দি চাপাবার বিরোধিতা করলেন। কিন্তু তখন বিরোধিতা করে কীহবে? গাছে তো উঠিয়ে দিয়েছেন আগেই। গাছে উঠিয়ে দেওয়ার পর দেখলেন, ওরা কীরকম বাঁদর। (সূত্র: দেশভাগ বাংলা ও বাঙালি)
অহিন্দিভাষী জনসাধারণের মনে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়ে এতকাল যে ভয় এবং শঙ্কা ছিল, সরকারি ভাষা কমিশনের রিপোর্টে তা সত্য বলে প্রমাণিত হল। তাই ভাষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর অহিন্দিভাষী জনসাধারণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ দেখা দেয়। দক্ষিণ ভারতের তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীগণ ভাষা কমিশনের রিপোর্টের বিরোধিতা করে এক যুক্ত বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় কাজে ইংরেজি ভাষাকে অব্যাহত রাখার আবেদন জানান। ১৯৫৭-র ২২ ডিসেম্বর তৎকালীন মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) অনুষ্ঠিত এক সম্মেলন এবং ১৯৫৮-র মার্চে কলকাতায় অনুষ্ঠিত অপর এক সম্মেলন হতে কোনো সময় নির্দিষ্ট না করে ইংরেজিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষারূপে ব্যবহার অব্যাহত রাখার আবেদন জানানো হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিও ভাষা কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভ্রান্ত এবং বিভেদমূলক বলে বর্ণনা করে।
ভারতের ন্যায় একটি বহুজাতিক দেশে, হিন্দির মতো একটি সংখ্যালঘু ভাষাকে সাহিত্যসমৃদ্ধ উন্নত ভাষাগুলির সংখ্যাগুরু জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নির্লজ্জ দালালির পুরস্কার হিসেবে বি জে খের ভূষিত হন 'পদ্মবিভূষণ' নামক রাষ্ট্রীয় খেতাবে।
ভাষা কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে সারা দেশে যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, তাতেই কিছুটা পিছু হঠতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। পার্লামেন্টারি কমিটি ভাষা কমিশনের রিপোর্ট কিছুটা সংশোধন করে তা পার্লামেন্টে পেশ করে। ১৯৬৫ সালের মধ্যে এককভাবে হিন্দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হিসেবে গণ্য করার যে সীমারেখা ভাষা কমিশন নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, পার্লামেন্ট কমিটি তা সংশোধন এবং এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট তারিখ না রাখার পক্ষে মতপ্রকাশ করে। পার্লামেন্টারি কমিটি দুটি স্তরে ধীরে ধীরে হিন্দিকে ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তাব করে বলে, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজি হবে প্রধান ভাষা এবং হিন্দি দ্বিতীয় ভাষা। ১৯৬৫ সালের পর থেকে হিন্দি হবে প্রধান ভাষা এবং ইংরেজি অপ্রধান। পার্লামেন্টারি কমিটির সংশোধনী প্রস্তাবেও স্বাভাবিক কারণেই অহিন্দিভাষী জনগণ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁরা সংসদের ভিতরে এবং বাইরে হিন্দি-প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নেহরু অহিন্দিভাষীদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, বলপূর্বক হিন্দি তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। ১৯৬৩ সালে তিনি বলেন, 'অহিন্দিভাষীদের সম্মতি ও অনুমোদন ছাড়া ইংরেজি ব্যবহারে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন করা হবে না।' এটা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত মত নয়, নেহরু-র এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ১৯৬৩ সালে ভাষা আইন প্রবর্তন করা হয়। ওই আইন অনুসারে ১৯৬৫ সালের পরও কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় কাজে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়।
নয়
একদিকে হিন্দিবিরোধী আন্দোলন, অপরদিকে সংবিধানের ৩৪৫ নং ধারার বলে রাজ্যে রাজ্যে নিজ নিজ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়। ফলে অহিন্দি ভাষাসমূহ হিন্দি ভাষার প্রসারকে ছাপিয়ে যায়। বহুজাতিক ভারতবর্ষের হিন্দিভাষী এবং তাদের আজ্ঞাবহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এতে আশঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের মতে, রাজ্যের ভাষাসমূহের সঙ্গে সঙ্গে আন্তঃরাজ্য সংযোগসাধনকারী ভাষা রূপে হিন্দির বিকাশ না ঘটায় ভারতের 'অখণ্ডতা ও সংহতি' বিপন্ন হয়ে পড়ছে। বিপন্ন অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার প্রয়োজনেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নিয়ে গঠিত 'জাতীয় সংহতি কমিটি'র এক সভা আহ্বান করা হয় ১৯৬১ সালে। জাতীয় সংহতি কমিটির মুশকিল আসানের ফর্মুলা ছিল রাজ্যে প্রশাসনিক কাজে (এক্ষেত্রে অতীতে যেমন বর্তমানেও ব্যতিক্রম পশ্চিমবাংলা। কারণ ১৯৬১ সালে রাজ্যে আইন হওয়া সত্ত্বেও, ২০২৫ সালেও, রাজ্য প্রশাসনিক কাজের ভাষা বাংলা নয় এবং শিক্ষায়ও প্রায় ব্রাত্য বাংলা!) এবং শিক্ষাক্ষেত্রে 'আঞ্চলিক' ভাষা দ্রুত প্রসারের ফলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে একটি সর্বভারতীয় ভাষা গড়ে তোলা খুবই জরুরি। সংবিধান যেহেতু হিন্দিকে আন্তঃরাজ্য সংযোগসাধনকারী ভাষারূপে ঘোষণা করেছে, সেহেতু অবিলম্বে হিন্দির বিকাশের জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা দরকার। ওই কমিটির মতে, তা না হলে এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সংযোগ রক্ষা করাই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
জাতীয় সংহতি কমিটির প্রতারণামূলক ওই তত্ত্ব আবিষ্কার এবং সিদ্ধান্ত হিন্দিওয়ালাদের উৎসাহিত করে। ওই সিদ্ধান্তের পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তর থেকে এক বার্তা পাঠিয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরবর্তী পরীক্ষা (১৯৬৪) থেকে ইংরেজির সঙ্গে হিন্দিকেও অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া ১৯৬৫ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম যাতে হিন্দিতে হতে পারে সেইজন্য এক পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এক নির্দেশনামায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল দপ্তরকে আসন্ন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। স্থির হয়, হিন্দিভাষী রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত যোগাযোগের মাধ্যম হবে হিন্দি। এবং অহিন্দিভাষী রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজির সাথে হিন্দি তরজমা বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত আদেশপত্র ও সার্কুলারে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজি থাকলেও, কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত দপ্তরের নাম হবে হিন্দিতে এবং ভারতীয় গেজেটের নাম 'ভারতকা রাজপত্র' হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
এ ভাবে পিছনের দরজা দিয়ে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সমগ্র অহিন্দিভাষী অঞ্চল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আনা হয় প্রতারণা এবং প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অভিযোগ। দক্ষিণ ভারতের তিরুচিতে হিন্দিবিরোধী এক সম্মেলনে মহারাষ্ট্র, কেরল, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর প্রতিনিধিরা হিন্দি চাপাবার কেন্দ্রীয় নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানান। তামিলনাডু সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশাবলিকে প্রকাশ্যে অমান্য করার কথা ঘোষণা করে। এবং হিন্দিতে লিখিত কোনো পত্র কেন্দ্রীয় সরকার পাঠালে, তা গ্রহণ না করে ফেরত পাঠাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যান্য অহিন্দিভাষী রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবাংলায়ও হিন্দি চাপাবার নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। হিন্দির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১৯৬৫-র প্রজাতন্ত্র দিবসকে তামিলনাডু-র দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম (ডি এম কে) শোকদিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬৫-র ২৫ জানুয়ারি থেকে তামিলনাডুতে হিন্দিবিরোধী আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। ওই দিন মাদ্রাজ (চেন্নাই) শহরের ১৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রী সেক্রেটারিয়েটের সামনে বিক্ষোভ জানালে পুলিশ গুলি চালায়। দাবানলের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। বিক্ষুব্ধ জনতার উপর পুলিশ বিভিন্ন স্থানে গুলি চালায়, এতে সরকারি হিসেবে একমাত্র তামিলনাডুতেই ৬৬ জন নিহত হন। এছাড়া তিরুচি, কোয়েম্বাটোর প্রভৃতি স্থানে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে কেউ কেউ বেছে নেন আত্মাহুতির পথ। কেন্দ্রীয় সরকারের দু-জন (কংগ্রেস) মন্ত্রী সি সুব্রহ্মণ্যম এবং সি ভি আলগেসান হিন্দি চাপাবার নীতির প্রতিবাদে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এইভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র অহিন্দিভাষী অঞ্চলে।
দশ
হিন্দি চাপাবার প্রশ্নে অবস্থা ক্রমেই গুরুতর হতে থাকায় কেন্দ্রীয় সরকার তার নির্দেশাবলি তুলে নিতে বাধ্য হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ১১ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৫) এক বেতার ভাষণে নেহরু-প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার কথা ঘোষণা করেন। মুখের কথায় আর চিড়ে ভিজবে না, একথা বুঝতে পেরে- অহিন্দিভাষীদের উপর হিন্দি চাপাবার আশঙ্কা বা ভীতি দূর করার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রতিশ্রুতিকে আইনানুগ রূপদানের জন্য পার্লামেন্টে বিল আকারে পেশ করা হয়।
হিন্দি চাপাবার নীতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের পিছু হঠার সিদ্ধান্তে এবার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে হিন্দিভাষী অঞ্চল। হিন্দিভাষীদের আশা ছিল ১৯৬৫ সালের মধ্যে হিন্দিকে সম্পূর্ণভাবে ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত করা হবে। সরকারের পিছু হঠার সিদ্ধান্তে তাদের সে আশা ব্যর্থ হয়। হিন্দির সমর্থনে আন্দোলনের তীব্রতা বেশি দেখা যায় উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লিতে। ১৯৬৭-র ১ ডিসেম্বর বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে ঘটে আন্দোলনের সূত্রপাত। 'হিন্দি চালাও, আংরেজি হঠাও' ধ্বনি দিয়ে রেলস্টেশন, দোকান-বাজার, রাস্তাঘাট সমস্ত জায়গা থেকে ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড ভেঙে উপড়ে ফেলা হয়। ভাষাবিলের কপিতে আগুন দেওয়া হয়। জনসংঘের পার্লামেন্ট সদস্য পার্লামেন্টের ভিতরে ভাষাবিলের কপি পোড়ান। উত্তরপ্রদেশের দুজন মন্ত্রী ভাষাবিলের প্রতিবাদে দিল্লিতে কারাবরণ করেন। শাসক কংগ্রেস এবং বিভিন্ন দলের ২০০ জন হিন্দিভাষী পার্লামেন্ট সদস্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে লিখিত এক চিঠিতে নতুন ভাষাবিলে হিন্দি ভাষা প্রবর্তনের কোনো সুনির্দিষ্ট দিন ঘোষিত না হওয়ায় প্রতিবাদ জানান। কেউ কেউ রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত পদ্মভূষণ, পদ্মশ্রী প্রভৃতি সম্মান পরিত্যাগ করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গোপাল প্রসাদ ব্যাস, রামকুমার ভার্মা, শেঠ গোবিন্দ দাস। হিন্দিভাষী অঞ্চলের 'হিন্দি চালাও'- এর দাবির বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে অহিন্দিভাষী অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে। সেখানে হিন্দিবিরোধী আন্দোলন নতুন করে জেগে ওঠে। বিক্ষুব্ধ জনতা দলবদ্ধভাবে রেলস্টেশন, সিনেমা হল এবং অন্যত্র আক্রমণ করে। আক্রান্ত হয় দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রচারণী সভার অফিস। উপড়ে ফেলা হয় হিন্দি সাইনবোর্ড, বন্ধ করে দেওয়া হয় হিন্দি সিনেমা ও হিন্দি গান।
পরস্পরবিরোধী এই আন্দোলনের মধ্যে ১৯৬৭ সালে সরকারি ভাষা (সংশোধনী) আইন পার্লামেন্টে গৃহীত হয়। ওই আইন অনুসারে ঠিক হয় কেন্দ্রীয় সরকারের কাজে হিন্দির সঙ্গে থাকবে ইংরেজিও। ওই সংশোধিত ভাষা আইনের বিরুদ্ধেও রয়েছে অহিন্দিভাষী জনগণের প্রতিবাদ এবং ক্ষোভ। কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সংশোধিত ভাষা আইনকে 'হিন্দির আধিপত্য স্থাপনের উপায়স্বরূপ' মনে করে। কারণ ওই আইনে দ্বিভাষী তত্ত্বকে কার্যত অস্বীকার করা হয়েছে।
সাবেক বহুজাতিক সোভিয়েত ইউনিয়নে অরুশিদের উপর রুশ ভাষার আধিপত্য চাপাবার পরিণতির সঙ্গে কেউ কেউ ভারতে হিন্দি চাপাবার পরিণতির কথা উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সোভিয়েত রাষ্ট্রে রুশ, আর ভারতে হিন্দি চাপাবার বিষয়টির মধ্যে গুণগত এবং মাত্রাগত কিছু পার্থক্য আছে। প্রথমত, রুশ ভাষা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার শতকরা পঞ্চান্ন জন (৫৫%) মানুষের ভাষা। অর্থাৎ রুশ ভাষা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। দ্বিতীয়ত, রুশ ভাষা পৃথিবীর একটি উন্নত ও সাহিত্যসমৃদ্ধ ভাষা। তৃতীয়ত, ওই ভাষাটি দীর্ঘকাল ধরে সরকারি কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। অপরদিকে প্রথমত হিন্দি ভারতের একটি সংখ্যালঘু (এক-তৃতীয়াংশের) ভাষা। কেন্দ্রীয় সরকার এবং হিন্দিওয়ালারা বারবার নানা প্রতারণা ও মিথ্যের আশ্রয় নিয়েও এর সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু ব্যর্থতা সত্ত্বেও বন্ধ হয়নি প্রতারণা। কারণ তাঁরা জানেন, 'Failure is the pillar of success'। এই প্রসঙ্গে 'গণশক্তি' পত্রিকার ১৫ জুলাই, ১৯৮৬ সংবাদসূত্রে উল্লেখ করা যায়, ১৯৮৬-র ১৪ জুলাই তামিলনাড়ুর কৃষিমন্ত্রী কে কালিমুস্থ এক অভিযোগে জানান, উত্তর ভারতের ৮১টি কথ্য ভাষাকে হিন্দি শ্রেণিভুক্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দির সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। চতুর্থ, ১৯৪৭-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে হিন্দি কখনো কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি।
বর্তমানে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার অহিন্দিভাষীদের উপর হিন্দি চাপাবার প্রশ্নে যে পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করছে, তার কিছুই অভূতপূর্ব নয়। সবই ইতোপূর্বে সংগঠিত নীতি ও কাজের অনুসারি হয়ে তারা অনুসরণ করছেন। সেই কারণে আপন ভাষা রক্ষার প্রশ্নে ইতিহাসের পাতায় চোখ রেখেই লক্ষ্য ও কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
প্রথমেই বলেছি রাষ্ট্র অস্থায়ী, জাতি স্থায়ী। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে আমাদের আপত্তি নেই বরং আগ্রহী এবং ভারতীয় ঐক্যের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু তা আমাদের ভাষা ভিত্তিক জাতি পরিচয় বিলুপ্ত করে নয়।
বহুজাতিক ভারতবর্ষে জাতি পরিচয়ের সামনে রাষ্ট কর্তৃক আরোপিত সকল বাধা উৎপাটিত করে জাতি বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করেই তা প্রতিষ্ঠা হতে পারে। একথা ভারতের রাষ্ট্র নেতাগণ যত বেশি উপলব্ধি করবেন, ততো ভারতীয় ঐক্য, সংহতি শক্তিশালী হবে।
তথ্যঋণ:
'ভারতের ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রনীতি' ড. স্নেহময় চাকলাদার এবং নানা পত্র-পত্রিকা।
টীকা: ১
ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃতিপাপ্ত ২২টি সরকারি ভাষা:
১৯৫০ সালে স্বীকৃতি পায় (১) অসমিয়া (আসাম), (২) বাংলা (পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা), (৩) গুজরাটি (গুজরাট), (৪) হিন্দি: (উত্তর ভারত), (৫) কাশ্মীরি (জাম্বু ও কাশ্মীর), (৬) কন্নড়: (কর্ণাটক), (৭) মালায়ালম (কেরল), (৮) মারাঠি (মহারাষ্ট্র), (৯) ওড়িয়া: (ওড়িশা), (১০) পাঞ্জাবি (পাঞ্জাব, চণ্ডীগড়), (১১) সংস্কৃত: (কর্ণাটকের মাথুর গ্রাম), (১২) তামিল: (তামিলনাড়ু, পদুচেরি), (১৩) তেলুগু: (অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা), (১৪) উর্দু (উত্তর ভারত)। ১৯৬৭ সালে স্বীকৃতি পায়- (১৫) সিন্ধি: (রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গুজরাট)। ১৯৯২ সালে স্বীকৃতি পায়- (১৬) কোঙ্কোণী: (গোয়া, কর্ণাটক), (১৭) মণিপুরি (মণিপুর), (১৮) নেপালি (সিকিম, পশ্চিমবাংলার দার্জিলিং)। ২০০৩ সালে স্বীকৃতি পায়- (১৯) বোড়ো (আসাম, পশ্চিমবাংলা), (২০) ডোগরি: (জম্বু, হিমাচলপ্রদেশ), (২১) মৈথিলী (বিহারের কিছু অংশ), (২২) সাঁওতালি: (ঝাড়খণ্ড, বিহার, এবং পশ্চিমবাংলার উপজাতি অঞ্চল)।
বন্ধনির মধ্যে অবস্থিত নামের সাহায্যে যে রাজ্য ও স্থানে ওই ভাষা প্রচলিত তা বোঝানো হয়েছে।
টীকা: ২
বিজাতি-বিভাষী পরিচালিত শাসক মুসলিম লিগের আহ্বানে সংঘটিত 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম' (আগস্ট, ১৯৪৬) এবং সামান্য সময়ের ব্যবধানে নোয়াখালির সাম্প্রদায়িক মধ্যযুগীয় বর্বরতা ইত্যাদি ধর্মভিত্তিক বাংলা ভাগ অনিবার্য করে তুলেছিল। দু-বাংলার অনেক সমাজ চিন্তকের এমনই অভিমত। তাঁদের কারও কারও মতে ১৯৪৬-এর প্রথমভাগেও অনুমানের অধিক ছিল ধর্মভিত্তিক বাংলাভাগ। বিংশ শতাব্দীর চার দশকের মাঝামাঝি সময়েও (১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব গৃহীতত হওয়ার পরবর্তী) হিন্দুজনগোষ্ঠী ঢাকা এবং অন্যত্র নিজস্ব দালানকোঠা নির্মাণ ছাড়া অনেক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের প্রশ্ন: বাংলা ভাগের সম্ভবনা সামনে থাকলে এ সব কি তাঁরা করতেন? এই সূত্রে উল্লেখ করা যায় ওই সময়ে নির্মিত বাংলাদেশের বিখ্যাত 'হরগঙ্গা মহাবিদ্যালয়' এবং তার ঋদ্ধ গ্রন্থাগার।
টীকা: ৩
আনন্দবাজার পত্রিকা ০৭/০১/১৯৮৭
হিন্দু সমর্থকরা পাকিস্তানের কথা যেন মনে রাখে: জৈল
বাঙ্গালোর, ৬ জানুয়ারি-অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে জোর করে হিন্দি চাপানোর বিরোধিতা করেছেন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং। দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে আজ এখানে রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দির প্রসারের প্রয়োজন আছে ঠিকই। তবে তা জোর করে নয়, ভালবাসার মধ্যে দিয়ে। পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর জোর করে উর্দুভাষা চাপানোর পরিণতি শুভ হয়নি। পাকিস্তান দু'ভাগ হয়ে গেছে। জৈল সিং বলেন, ভারতের সব সরকারি ভাষাই যাতে ঠিকভাবে প্রসার লাভ করে, সেদিকে নজর দিতে হবে। সমস্ত সরকারি ভাষার উন্নতি হওয়া দরকার। তবে একই সঙ্গে সমস্ত সরকারি ভাষার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করতে পারবে, এমনও একটি ভাষা থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সেই সেতু-বন্ধনের কাজ একমাত্র হিন্দি ভাষার মাধ্যমেই ভালভাবে সম্ভব। রাষ্ট্রপতি বলেন, অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার স্বার্থ-হানির বিনিময়ে হিন্দির প্রসার কখনোই ইওয়া উচিত নয়। অ-হিন্দিভাষীরা যাতে স্বেচ্ছায় ওই ভাষা শিখতে এগিয়ে আসেন, সেটাই দেখতে হবে। তাঁদের মনে যেন কোনও আঘাত না লাগে। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলি উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম ভারতে শেখানোর জন্যও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
হিন্দি সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি গোবিন্দ শেনয় (কেরল), বীরজগন্নাথন (তামিলনাডু), বি আর নারায়ণ (কণটিক) এবং আর মাধবরাউকে পুরস্কার দান করেন।
অনুষ্ঠানে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী রামকৃষ্ণ হেগড়ে -বলেন, দক্ষিণ ভারত বা অ-হিন্দিভাষী অন্যান্য রাজ্যের জনসাধারণ হিন্দির বিরোধী নন। কিন্তু যেভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই নীতির তাঁরা বিরোধিতা করবেন। হেগড়ের ভাষণ শেষ হওয়ার পরেই জৈল উঠে দাঁড়ান এবং জানতে চান, তিনি উত্তর ভারত না দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা। হেগড়ের হিন্দি বাচনভঙ্গির প্রশংসা করে জৈল বলেন, হেগড়ে যখন হিন্দিতে কথা বলেন, তখন খুবই আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। বিহার, পশ্চিমবাংলা বা কেরলের কোনও লোক হিন্দিতে কথা বললে, তাঁর মাতৃভাষার টান সহজেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু হেগড়ে এসবের ব্যতিক্রম।
ব্যস্ত কর্মসূচির মধ্যেও রাষ্ট্রপতি এদিন স্থানীয় এয়ারফোর্স হসপিটালে গিয়ে ফিল্ড মাশলি কারিয়াপ্পার সঙ্গে দেখা করে আসেন। ফিল্ড মার্শাল বর্তমানে ওখানে ভর্তি রয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর হাতে একটি ফুলের তোড়া তুলে দেন। তাঁর স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন। হাসপাতালে রাষ্ট্রপতি মিনিট দশেক কাটান। তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন কণটিকের রাজ্যপাল এ এন ব্যানার্জি এবং মুখ্যমন্ত্রী হেগড়ে। -পি টি আই, ইউ এন আই