সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
এই অনাথিনীকে দিয়েই শুরু করা যাক।
সৃষ্টির সেই আদিম লগ্নে এর জন্ম। তারপর যা হয় এসব ক্ষেত্রে, কত রোদের আদর, কত বৃষ্টির সোহাগ, কত ঝড়ের তাণ্ডব সয়ে এরা বাড়তে থাকে। বাড়া মানে তো আড়ে বহরে বেড়ে ওঠা নয়, বাড়ে দেখাশোনায় , বাড়ে অভিজ্ঞতায়। বাড়ে যন্ত্রণায়! সর্বংসহা হয়ে ওঠা এদের নিয়তি!
সেসব কথা থাক, কাজের কথা বলি। চেনা মানুষেরা নাড়া খেয়ে বলবেন, অনাথ এই জমির আবার কাজের কথা কী! আছে বৈকি, আছে! কাজের কথা আছে। অকাজের কথাও! কোন কথা কখন যে কেজো পথের তোয়াক্কা না করে অজানার সুরে ঘর করে, তার আমরা কী জানি! মাটির তলায় তলায়, বীজের ভেতরের সুরে সুরে, নাম না জানা গাছগাছালির শেকড়বাকড়ের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে সেই কথা , সেই সুর। কিচমিচ করতে করতে পাখিরা সেই সুরে তাল মেলায়, কত তুচ্ছ, নামহীন পতঙ্গের দল, কীটের দল কুট কুট, গুনগুন করে জানিয়ে যায় ‘আছি, আছি’! মোট কথা, এরা কেউ অনাথিনীকে একা হতে দেবে না!
অথচ আমি দেখি, ও একা। আমরা এখানে আসার সময় থেকে দেখছি, ও একা। সত্যি বলতে কী, সামনের জমিটা ফাঁকাই থেকে যাবে সারাজীবন, খানিকটা এই লোভেই , উল্টোদিকের এই জমি আমি পছন্দ করেছি। দালালও তাই বলেছিল, “এই জমিটা স্যার, বেওয়ারিশ! আপনি সামনের তিরিশ ফুট ফাঁকা পেয়ে যাবেন লাইফভর! আড়াআড়ি তিরিশ ফুট, লম্বায় পঁয়তাল্লিশ! বলে সেই খর্বকায় দালাল, জমির বেওয়ারিশত্ব প্রমাণের তাগিদেই হয়ত, সে জমির এক কোণায় গিয়ে পেচ্ছাপ করতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে সে আমার জমির গুণাগুণ বর্ণনা করে চলেছিল, তখন ওর গায়ে হেমন্তের রোদ্দুর এসে পড়েছিল। এই রোদ্দুরের মালিক এর পরে আমার হওয়ার কথা! মুফতে।
এরপর আমাদের বাড়িটা একটু একটু করে উঠেছে। আমরা প্রতিটি দিন সেই বেড়ে ওঠা দেখেছি। আমরা, মানে আমার পরিবার, আমার স্ত্রী, আমার কন্যা। ওরাই বেশি আসে, আমি সময় বার করতে পারলে বা জরুরী প্রয়োজনে আসি। আমার স্ত্রী মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে, নিজের পছন্দ অপছন্দ জানায়। হেডমিস্ত্রি কখনও হেসে এই মালকিনকে বুঝিয়ে বলে তাঁর কল্পনার অবাস্তবতার কথা! কখনও হিসেবের খাতায় উঠে যায় তাঁর চাহিদার মূল্য! মোট কথা, আস্তে আস্তে হয়ে ওঠা এই বসতবাড়িটাকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন তৈরী হয়, ঠিক যেমন আমার মেয়ের আগমন সংবাদ আসার পর আমাদের স্বপ্ন দেখা চাগিয়ে উঠত প্রতিদিন!
একসময় বাড়ি হল। আমার গিন্নির অনেক সাধ পূর্ণ হল না, কিন্তু ওর ইচ্ছেতেই দোতলায় একফালি বারান্দা হল। ওই ফাঁকা জমিটার দিকে মুখ । সেই বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ার রাখা, একটা দোলনা। যদিও আমিই সময় পেলে এখানে এসে বসি। আমার স্ত্রী আসেন না খুব একটা! মেয়েরও স্কুল, টিউশনির পালা চলতে চলতে দোলনা চড়ার বয়স পার হয়ে গেল! সামনের জমিটা সবই দেখছিল। চারপাশের সমস্তটা দেখে যাওয়াই তার কাজ।
আমি এ জমির ইতিহাস শুনি। ওর শেষতম মালিক ছিল এক খুনখুনে বুড়ি। জমিটার উত্তরের কোণে যে কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে, বা পড়ে ছিল, কিন্তু এখনও পড়ে আছে বলে মনে হয়, ওখানে আসলে একটা ঘর ছিল। মানে, এক কামরার বাড়ি। লাগোয়া বাথরুম। বুড়িকে একা সেই বাড়ি আগলে থাকতে দেখেছে অনেকেই। এ অঞ্চলের পুরোনো লোক যারা। তারা কোণার দিকের একটা জামগাছ দেখিয়ে বলবে, এ গাছ বুড়ির নিজের হাতে লাগানো।
আমি দোতলার বারান্দায় বসে গাছটির বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করি। জরিপ করার চেষ্টা করি ওর পাতার তলায় জড়ো হওয়া অন্ধকারের বয়স। কিন্তু আমার কল্পনা গাছের বেড় ছাড়িয়ে সেই বুড়ির কাছে পৌঁছে যায়। তখনও কি সে বুড়ি ছিল? না, যুবতী! না মাঝবয়সী প্রৌঢ়া। সকালের নরম রোদ থাকতে পুঁতে দিয়েছিল জামের বীজ। অথবা সে বীজ অনাহূত হয়ে হঠাৎই খুঁজে পেয়েছিল এই প্রশ্রয়ভূমি। তারপর বুড়ি তাতে নিয়মিত জল দিয়েছে, মাটিতে নিড়ান দিয়েছে, চারপাশে একটা কঞ্চির বেড়াও দিয়ে রেখেছে। আর সারা দিনের ঘরকন্নার কাজ সেরে মাঠের রোদ্দুরে মেলে দেওয়া কাপড় তুলে নেবার ফাঁকে একবার দেখে নিয়েছে, কতদূর বাড় হল সে গাছের।
বুড়ি তো আর সারাজীবন বুড়ি ছিল না। হয়ত আমাদের ছেলেবেলায় পড়া এবং ভুলে যাওয়া সেই কবিতার পংক্তির মতো ‘once she was young, would dance and play'! দিদাটা নাচত? আমার কন্যা হাততালি দিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে! আমি কিন্তু হাসি না। দেখতে পাই, এক চঞ্চলা যুবতীকে, পায়ে তার ঝুমঝুম করে মল বাজছে। নাকে ছোট্ট নাকছাবি। মাথার চুল পেছন দিকে টান করে বাঁধা। পরনে লাল রঙের ডুরে শাড়ি। আঁচল কোমরে বাঁধা। দুটো বেণী পিঠের ওপর দুলছে। কপালে ঘামের কুচি চিকচিক করছে। ওকে ওই অবস্থায় দেখেছিল ওর নাগর।
এই প্রেমিকপ্রবরের গল্প আমি অনেক শুনেছি, পাড়ার প্রবীণ লোকেদের মুখে। লোকটা পুলিশ না মিলিটারি, কীসে যেন চাকরি করত। লম্বা চওড়া, শা- জোয়ান চেহারা, পেল্লায় গোঁফ! গায়ের রঙ ফেটে পড়ছে। একমাথা চুল। টিকোলো নাক। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, এই রূপবর্ণনায় পাড়ার কাকিমা, মাসিমাদের কথা যেন আর থামতেই চায় না! সেই মানুষ যেন গ্রীক মহাকাব্যের নায়ক! পাড়ার প্রবীণ পুরুষদের কারুর মুখে আমি প্রথম শুনেছিলাম, লোকটা বিবাহিত ছিল, গাঁ মুলুকে বৌ-সংসার ছিল। সন্তানাদি হয়নি তাদের।
লোকটা সরকারি কাজের তাগিদে, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বিহিত করতে এই অঞ্চলে এসেছিল। সে সব খবর চাপা পড়ে গেছে, নয়ত ডালপালা গজিয়ে নতুন নতুন খবরের গাছ হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে তার চোখে পড়ে এই বুড়িকে, বা সেদিনের সেই ছুঁড়িকে। তখন এই সব অঞ্চলে দিনের বেলা শেয়াল দেখা যেত, রাতে তো কেউ একা আসবার সাহস করতই না! সেই সুযোগে যে যেখানে যা অপকর্ম করত, লুকোবার ঠাঁই হত এই অঞ্চল। সে অপরাধী নিজে হোক, কি তার অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণ ! সেই রকম কোনো তত্ত্বতালাশের কাজেই হয়ত বা এই মানুষও এসেছিল। এখানে তখন ছড়ানো ছেটানো দু’ চার ঘর মানুষের বাস। তারা দিনেমানে কাজ সেরে রাতে ঘরের ভেতর কুপি জ্বেলে পরেরদিন সকালের অপেক্ষা করে। যেমন এই মা-মরা ছুঁড়িকে নিয়ে ওর গান গেয়ে বেড়ানো বাপ থাকে। পুলিশ- বাবু এসে সে বুড়োকে জানিয়ে দেয়, এই মেয়েকে পছন্দ হয়েছে তার।
অতএব, মানুষটি সন্ধে লগনে ঘরে এলে বুড়ো বাপ মাধুকরীতে বেরিয়ে পড়ে! শূন্য ঝোলা শূন্যই থেকে যায় বেশিরভাগ, কখনও কলাটা মূলোটা ,কি দু’মুষ্টি আতপের ঠাঁই হয় ঝোলায়! রাতের বয়স বাড়তে বুড়ো বাপকে ঘরে ফিরতেই হয়। মেয়ে বাপের ভাত আগলে বসে থাকে, তার নাগর ততক্ষণে সংসারমুখী হয়েছে। একসময়ে বাপে শুনতে পায়, বিয়ে করেছে তার মেয়েকে ওই পুরুষ। বাপের মরার পথে আর কোনো চিন্তার কাঁটা, ভাবনার পাথর থাকে না। তবে মরব বললেই তো মরা যায় না, যার যেমন লেখন! বুড়ো দ্যাখে মেয়ে তার কিছুদিনের মধ্যেই ভরা পোয়াতি হয়েছে। ডাকাবুকো জামাইবাবাজী অবরে সবরে আসে, দেয় থোয় ভালোই ! বুড়োর গান গেয়ে গেয়ে হাত পাতা বন্ধ হয়েছে, মরণের ভাবনা ধীরে সুস্থে ভাবার তার অঢেল সময়! নজরে যাদের পাপ, তারা বলে বেড়ায় চেকনাই শুধু মেয়ের গতরে নয়, বাপের গতরেও পষ্ট!
সে নয় হল। কিন্তু এত কিছুর পরও নাতির মুখ দেখার আগেই বুড়ো পাড়ি জমালো পরপারে! মেয়ের ভিটেয় অন্ধকার আরো ঘন হয়ে গেল! ছেলের বাপ মাঝেমধ্যে আসে, সঙ্গে আনে অনেক কিছু! কী যে ঠিক আনে না, তার ঠাহর পায় না ছেলের মা! কিন্তু মানুষটা চলে যাবার পরই সেই শূন্যে হাঁ-মুখটা বড় হতে থাকে! এমনিতেই সে মানুষের আসাযাওয়া কমেছে অনেক। রোজ সন্ধেবেলায় গা ধুয়ে, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর দিয়ে, ধোওয়া কাপড় পরে, ছেলের কপালে কাজলটিপ, কড়ে আঙুলে কামড় দিয়ে যে প্রতীক্ষা শুরু হয়, তা ক্রমে শেষ হয় ঘন হয়ে আসা ঝিঁ ঝিঁর ডাকে, দূরে ডেকে ওঠা শেয়ালের বিলাপে!
একসময়ে সে অপেক্ষা জল না পাওয়া চারার মতো শুকিয়ে মরে! ছেলে ডাঁসো হয়ে ওঠে, তার মুখে বাপের আদলের কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে! ফেরে না তার বাপ। তাতে ছেলের হেলদোল নেই খুব! মায়ের শরীরে ভাঁটার টান লাগে। জমির শাকপাতা দূরের বাজারে বেচে, দিনেমানে ঘুঁটে দিয়ে, কাঠকুটো জোগাড় করে বুড়ি দুটো পেটের আগুন থামায়।
অন্যখবর কখনো না এলেও একসময় বাতাস বয়ে খবর আসে পুলিশবাবু, নাকি মিলিটারি, সেই ছেলের বাপের এন্তেকাল হয়েছে। স্ত্রী নাকি আগেই গত হয়েছিল, সে শোক সামলাতে পারেনি মিলিটারি চেহারার স্বামী। বাঁধা মেয়ে, সে ঘরের ছেলে, ডাক্তার-বদ্যি কাউকেই কোনো সময় সে দেয়নি! সাঁঝের সেই খবরে জামগাছের কোলে অন্ধকার আরো ঘন হয়ে নামে, বুড়ির চোখের বোধহীন শূন্যে তার ছায়া পড়ে! ছেলে ভুরু কুঁচকিয়ে খানিকক্ষণ মায়ের চোখের জলের অপেক্ষা করে, তারপর ওবেলার ভাতের হাঁড়ি হাতড়ায়!
ছেলে জোয়ানমদ্দ হলে হুঁশিয়ার লোকেরা বুদ্ধি দেয়, এই ছেলেই তার বাপের একমাত্র উত্তরাধিকারী, বংশে শিবরাত্রির সলতে! যাও, সরকারের দরজায় নাড়া দিয়ে বল, বাপের পাওনা গণ্ডা, চাকরির ন্যায্য হক তারই। আশার ভেলায় চড়ে মায়ে- পোয়ে এ দোর, সে দোর ঘুরতে থাকে। একসময় তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়, সরকারের দস্তাবেজ বলছে, এই মহিলা, এই ছেলে সে লোকের কেউ না!
এসব গল্প শুনে আমার বিশ্ববিদ্যালয়- পড়া মেয়ে অবাক হয়ে বলে, কেউ না? তারপর ও দোলনা ছেড়ে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসে। শূন্য জমিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে জামগাছটা জ্যান্ত হয়ে খাড়া আছে, সামনে গজানো একটা কুলগাছে দুটো সিপাহী বুলবুল হঠাৎ এসে বসল, আরো তাড়াতাড়ি উড়েও গেল। খুব ছোট একটা পাখি, তার নাম জানি না, এদিক ওদিক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিচ্ছিল গাছের ডালে বসে। আমি লক্ষ করলাম, জমিটার পাঁচিল ঘেঁষা কোণ দিয়ে একটা বেজি দ্রুত ছুটে গেল। মেয়ে আবার আবার কিছুক্ষণ বাদে স্বগতোক্তি করে, ‘কেউ না’ !
একটু রোদ মরে এলে পাশের বস্তির বাচ্চারা এবড়োখেবড়ো লগা নিয়ে আসে জাম পেকে উঠলে, অনেকে ঢিল ছুঁড়ে অনর্থ বাঁধায়! পায়ের তলায় পিষ্ট জামের রঙে মরা ঘাসে ছোপ লাগে। আমার মেয়ে আমার সামনে জিভ বের করে দেখায়, কতটা রঙিন আর ভারী হয়ে উঠেছে ওর জিভ!
খুনখুনে বুড়ির ছেলে হাতে পায়ে সেয়ানা হয়ে উঠেছিল। গাঁ- জঙ্গল ছেড়ে কাজকম্মের ধান্দায় ভিটে ছেড়েছিল। হয়ত তার মনে হয়েছিল, যেভাবে তাদের মা-ব্যাটায় এতদিন চলেছে, সেভাবেই মা তার একার পেট সামলে নেবে। অথবা, সে নিজের পেটের যোগাড়েই হিমশিম খাচ্ছিল, অন্য কারুর কথা ভাবার অবস্থা ছিল না। অথবা শহরে গিয়ে তার নতুন জীবন শুরু হয়েছিল নতুন মানুষের সাথে, দিনশেষের ক্লান্তিতে নতুন মানুষের হাত ধরে শহরের নিয়ন-ধোয়ানো রাস্তায় পায়চারি করত। পরের দিনের রসদ জোটানোর ভাবনা ছাড়া অন্য কিছু মাথায় ঢোকানোর সময় থাকত না! এ সবই দোতলার ব্যালকনিতে বসে আমার অলস কল্পনা! অন্য কোনো গল্পও থাকতে পারে। পুরোনো লোকেদের মুখেই শোনা, একদিন কাদের মুখে মুখে যেন খবর এল, পাখির ঠোঁটে নষ্টবীজ উড়ে আসার মতো, অমন মদ্দজোয়ান ছেলে নাকি রেললাইনে কাটা পড়েছে! দ্বিতীয় একদল বলত, সে ছেলের লরি চাপা পড়ার ঘটনা তারা প্রায় নিজেরা দেখেছে! ওদের সম্বন্ধী বা খুড়োশ্বশুর তখন সেই শহরেই ছিল! একথাও তারা প্রত্যেকবার বলত, এই খবর আসার পর সেই পাষাণী বুড়িকে কেউ কাঁদতে দেখেনি! কেউ না!
মোটকথা, বুড়ি ওর একাকী অবস্থা ঘুচিয়ে খুব দ্রুতই আবার একা হয়ে গেছিল। মাঝখানে দিনগুলো যেন সিনেমা, অথবা স্বপ্ন! কিন্তু এই জামগাছ, কুলগাছ, পাখপাখালির আনাগোনা, পোকামাকড়, বেজি, কুকুর বিড়াল এমনকি সাপখোপ নিয়ে তার বরাবরের ভরভরন্ত সংসার। নতুন বলতে তার হাতের লাঠি। বুড়ির কোমর পড়ে গেছে, হাতের লাঠি এখন সর্বক্ষণের সঙ্গী।
আমার মেয়ে জানিয়েছে, ওর সহপাঠীকে ও বিয়ে করবে। সে চাকরিসূত্রে পুনায় থাকে। আমাদের মন খারাপ। এতটা দূরে চলে যাবে একমাত্র সন্তান! কিন্তু সবই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয়। মেয়ের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম এখন ফোন। রাত দশটার পর মা-বেটির- আলাপ চলতেই থাকে। আমার ভাগে শুরুর মিনিট পাঁচ সাত। সেটুকু মেয়ের শাসন-তর্জনে কাটে! আমার জানানোর দায়িত্ব, কুলগাছে কুল পেকেছে কি না, জামগুলো টসটসে হল কি না! ভুতু নামের কুকুরটা এখনও আসে তো! ওকে খেতে দেওয়া হয় তো? মিনি বিড়ালটাকে?
বুড়ির মরার বর্ণনাটি খুব বিস্তারিত ভাবে পাওয়া যায় এপাড়ার বয়স্ক মানুষদের কাছে। যদিও কেউই বুড়িকে মরে যেতে দেখেনি! বুড়ি নাকি শীতের নরম রোদ্দুরে জামগাছটার কিছুটা সামনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল । হাত থেকে লাঠিখানা খসে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, বুড়ি ওর সমস্ত প্রাণবায়ু এই জমির ভেতরে সেঁধিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রাণপণে! সেই সময়ে এর বেশি আর কিছু দেওয়ার ওর ক্ষমতা ছিল না!
মেয়েকে কিছুদিনের মধ্যে আমরা আনতে যাব পুনায়। সে আমাদের জন্য খুশির খবর এনেছে। নতুন প্রাণের সম্ভাবনার কথা জেনেছি আমরা। সেই জন্যই বিদেশ বিঁভুঁইয়ে ফেলে না রেখে ওকে আমাদের কাছে নিয়ে আসব। আমাদের তাই চূড়ান্ত ব্যস্ততায় দিন কাটছে। ঘরদোর সব গোছগাছ করে, মেয়ের জন্য সবরকমের বন্দোবস্ত করে আমরাই যাব দুজনে মিলে মেয়েকে আনতে। এসময় খুব সাবধানে রাখতে হয়! আমার স্ত্রী একটা করে জিনিস গোছায়, স্যুটকেস থেকে বের করে আরেকটা ঢোকায়, আবার সেটা বাতিল করে আগেরটাই ব্যাগে পোরে! এইভাবে কতবার যে ব্যাগ, স্যুটকেস, তার ভেতরের জিনিসপত্র অদলবদল হল, তা আর কী বলব! অনেকগুলো প্যাকটে জড়ানো একটা বস্তুপিণ্ডের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি বললাম, ওটা কী? আমার স্ত্রী একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, আমাদের এই জামগাছের কতগুলো জাম নিয়ে নিলাম! বেশ ভালো জাতের গো! হৃষ্টপুষ্ট! এইসময়ে এগুলোর জন্য খুব লোভ হয়! আমি আমার স্ত্রীর মুখে এই কথা শুনে খুব অবাক হলাম! ওই দেশে কি জাম পাওয়া যায় না! এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে!
আমরা এখন মেয়ে জামাইয়ের তেরো তলার ফ্ল্যাটে বসে জানলা দিয়ে পুনের আকাশ দেখছি। কাল ফিরে যাব। বেশি রাতের ফ্লাইট। মেয়ের শরীর বেশ ভারী হয়ে এসেছে, বোঝা যাচ্ছে। এখন কয়েকমাস ও আমাদের কাছেই থাকবে। এখন আমার মেয়ে আমার পাশেই বসে। মায়ের আনা জাম খাচ্ছে।
জানলা দিয়ে খানিকটা আনমনেই ও জামের বীজ থু করে ছুঁড়ে দিল! তারপরেই লজ্জায় জিভ কামড়ায় মেয়ে! আমি ওর বেগুনি রঙের জিভ দেখে নীচের দিকে তাকাই! পতনশীল বীজের সঞ্চারপথের দিকে। কিছুই ঠাহর পাই না! কোথায় গিয়ে ঠাঁই পেল সেই বীজ!
সেই খুনখুনে বুড়ির ছেলের মৃত্যুর খবর সত্যি নাও হতে পারে, আমার হঠাৎ এমনটাই মনে হয়! আমার হঠাৎই বাড়ি ফেরার জন্য মন উচাটন হয়!
কাল ফিরছি জামগাছটার কাছে।