সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
১
সমাজের সংজ্ঞা ও বিন্যাস
ভারতীয় সমাজতত্ত্বে সমাজের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা বেশ জটিল, সম্ভবত জটিলতার কারণেই ভারতীয় সংবিধান সমাজের কোনো সংজ্ঞা নিরূপণ করে নি। ইয়োরোপীয় সমাজতত্ত্বে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা খানিকটা জাতিরাষ্ট্রের (nation-state) অনুরূপ, এবং সে কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর বহু দেশ জাতি-রাষ্ট্র নয়। অতএব সামগ্রিক বিচারে সমাজের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। কিন্তু বিন্যাসের বিবরণ আছে। হেনরি লুইস মর্গান সমাজকে দু’ভাগে ভাগ করে দেখিয়েছিলেন। তাঁর মতে, দুরকমের সমাজ হয়, এক—মূলবাসী-আদিবাসীদের আত্মীয় সংঘ থেকে গড়ে ওঠা সমাজ বা gentile society, দুই—নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং সম্পত্তিকে ঘিরে গড়ে ওঠা সমাজ বা political society। মূলবাসী-আদিবাসীদের আত্মীয় সংঘ থেকে গড়ে ওঠা সমাজই নানা বিবর্তনের পথ ধরে আমাদের আজকের সমাজে পরিণত হয়েছে। আর ভূখণ্ড এবং সম্পত্তিকে ঘিরে গড়ে ওঠা সমাজের নামই হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের দ্বৈত রূপ -- সমাজ এবং সংস্থা। রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক সংস্থাও বটে। সরকার তারই একটি অঙ্গ। সংবিধানে ফেডারেল কাঠামোর সংস্থান থাকলে সরকারেরও দুই রূপ – কেন্দ্র ও রাজ্য বা প্রদেশ। আমাদের দেশে কেন্দ্র-রাজ্য। রাজ্য সরকারগুলির কিছু নিজস্ব স্বাধীনতা ও ক্ষমতাও থাকে।
২
বিদ্বজ্জনদের আলোচনায় সমাজ
কিছুদিন ধরেই দেখছি বেশির ভাগ বিদ্বজ্জনদের কটু রসালো মন্তব্য সহযোগে তুমুল সব আলোচনা সরকার আর রাষ্ট্রকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। একথা বলা যাবে না যে তাঁদের সেইসব আলোচনায় ‘সমাজ’ নেই, যেহেতু বিস্তৃত অর্থে political society আছে, কিন্তু যেটা নেই সেটা হল gentile society। কারণ এই gentile society-র অর্থ প্রধানত গ্রামসমাজ, তাঁদের আলোচনায় যে গ্রাম নিয়ে আলোচনার ভাগ অতি সামান্য। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে গ্রামের সংখ্যা ছিল ৪০,২১৮ এবং গ্রামবাসীর সংখ্যা ছিল ৬,২১,৮৩,১১৩, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৮.১৩ শতাংশ। আর তবু তাঁরা রাজনীতির দাঁওপ্যাঁচ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যান। একদিক থেকে তাঁরা ঠিক, কারণ, সত্যিই তো, গ্রামসমাজটা কোথায়, আর একদিক থেকে বেঠিক, কারণ যে দেশের বাসিন্দার সিংহভাগই গ্রামে থাকে, তাঁদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় তাদের নিয়ে ভাবনার কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের দেশের গ্রামসমাজের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং এই যে বিদ্বজ্জনদের ভাবনায় গ্রামসমাজের অনুপস্থিতি দুটোই যুগপৎ উপনিবেশিকতার সঙ্গে যুক্ত।
এ নিয়ে কালধ্বনিতে আগেও আলোচনা করেছি। তবু আরো একবার পুরোনো কাসুন্দে না ঘেঁটে উপায় নেই।
৩
পুরোনো কাসুন্দে
ফিরে আসি আগের কথায়। আমাদের দেশে মর্গান–কথিত সমাজের চেহারাটা ব্রিটিশ আসার আগে পর্যন্ত কেমন ছিল? অন্যান্য আরো বহু দেশের মত আমাদের দেশেও সমাজ ছিল দু’ভাগে বিভক্ত – গ্রাম ও নগর। যদিও গ্রামের তুলনায় নগরের সংখ্যা ছিল অতি সামান্য, কিন্তু কেন্দ্রগত অবস্থানের হিসেবে নগরগুলির গুরুত্ব ছিল বেশি। নগরগুলি ছিল বৃত্তের মতন এবং সেই বৃত্তকে ঘিরে চারপাশে সরলরেখায় ছিল গ্রামগুলির অবস্থান। নগরগুলি গ্রামগুলির প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করত। প্রতিটি গ্রামই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ আর সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলিতে বাস করত কৃষক, কারিগর, কলু, গোয়ালা, রাখাল, ধোপা, নাপিত, জ্যোতিষী, পুরোহিত, গুরুমশাই, বৈদ্য ইত্যাদি। গ্রামের যা কিছু প্রয়োজন তা গ্রামের মধ্যেই মিটে যেত, বাইরের কোনো সাহায্য লাগত না। গ্রামের ভেতরের সমস্ত পেশার মানুষের মধ্যে একটা পরিপূরক সম্পর্ক ছিল। ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটা পারস্পরিক সম্পর্কও। গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও ছিল নগরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং সে হিসেবে অন্যান্য গ্রামগুলির সঙ্গেও।
আরো একটা ব্যাপার আছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই গ্রামগুলি ছিল স্বায়ত্ত শাসিত। ভারতীয় গ্রামসমাজ বলতে তার দুটি বাহুকে বোঝায়—১. স্বয়ংসম্পূর্ণ ২. গ্রামীণ স্বায়ত্ত শাসন। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত হিসেবে গান্ধীজি পঞ্চায়েতি রাজের মাধ্যমে গ্রাম স্বরাজ চেয়েছিলেন। পঞ্চায়েতি রাজ বলতে বোঝায় গ্রামীণ স্বায়ত্ত শাসনকে যাতে প্রতিটি গ্রাম তার নিজস্ব বিষয়ের জন্য দায়ী থাকবে। তিনি চেয়েছিলেন এইভাবে পঞ্চায়েতি রাজের মধ্যে দিয়ে সরকারের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকৃত হোক। গান্ধীজির স্বপ্ন সফল হয়নি। রাজস্থানের নাগাউরে ১৯৫৯ সালের ২রা অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিন উপলক্ষে নেহরু যে পঞ্চায়েতের সূচনা করেন, তাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কোনো লক্ষণ ছিল না। ভারত অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত একটি সরকার গঠন করেছে। তার ফল হয়েছে এই, কোনোকিছুই আমাদের গ্রামসমাজের নিয়ন্ত্রণে নেই। তার জল নিয়ে, তার জঙ্গল নিয়ে, তার জমি নিয়ে কোনো কথা বলার অধিকার তার নেই। তার কাজ দাঁড়িয়েছে শুধু এই কেন্দ্র হোক বা রাজ্য হোক ওপর থেকে সরকার যেসব প্রকল্প তৈরি করে পাঠিয়ে দিচ্ছে সেই প্রকল্পগুলি অনুযায়ী পঞ্চায়েতকে চালনা করা। এখানে কাট মানির কথাটা আর বললাম না।
প্রাচীন ভারতের সমাজ নিয়ে অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ দুটো গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেই নিবন্ধদুটিতে তিনি সমাজের দুটি অঙ্গের কথা লিখেছিলেন —একটি সভা, অপরটি সমিতি (সভাসমিতির কথা উঠে এসেছিল বেদ থেকেই)। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী বর্ণব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে এইসব সভাসমিতিগুলোই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করত, সমাজ পরিচালনা করত। বিদ্যাভূষণ একটা চমৎকার কথা লিখেছিলেন, “সভা ছিল সামাজিকভাবে মেলামেশার কেন্দ্র—আর সমিতি ছিল সমগ্র জনসাধারণের সঙ্ঘবদ্ধ বাণী।”
বিদ্যাভূষণের লেখায় ব্যবহৃত ‘বর্ণব্যবস্থা’ শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ল্যুই ডুমোর (Louis Dumont) মতে, শব্দটা গোড়ায় ছিল অনুক্রম (Hierarchy) এবং অনুক্রমটা ছিল ধর্মীয়। একটা পর্যায়ক্রম, এক একটা ধাপ। কোনো পর্যায় বা ধাপই বিচ্ছিন্ন নয়, সবে মিলে একটি সমগ্র। শর্টার অক্সফোর্ড ডিক্সনারি অনুসরণ করে তিনি দেখিয়েছিলেন, কেমনভাবে সেখানে অনুক্রম শব্দটাকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। দেবদূতদের বেলায়, পুরোহিত বা পাদ্রীদের বেলায়। কিন্তু সভ্যতার পথ চলার সঙ্গে সঙ্গে অনুক্রমটা শুধুমাত্র ধর্মীয় ব্যাপারের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি।
আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বিন্যাসটা প্রায় অনুরূপ। যদিও অনেকে এই ব্যবস্থাকে পেশাভিত্তিক সামাজিক স্তর বলেও মনে করেন। ব্যতিক্রম শুধু এই যে, বৈশ্যরা ধর্মে জৈন হয়েও বর্ণব্যবস্থাকে মানত, সে হিসেবে তারাও বর্ণব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিল (কারণ তীর্থঙ্কররা বর্ণব্যবস্থাকে স্বীকার অস্বীকার কোনোটাই করেন নি)। অনেক পরে আরও একটা বর্ণের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। তারা ছিল পঞ্চম বর্ণ, সামাজিক স্তরের দিক থেকে তারা ছিল অচ্ছ্যুৎ।
একেবারে গোড়ায় বর্ণের কোনো পরিষ্কার ধারণা ছিল না এবং মর্যাদার বাইরে ব্রাহ্মণদের কোনো বিশেষ অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ শেষ মৌর্য সম্রাটকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র ক্ষমতায় বসার সময় থেকে মনুর হাতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র জন্ম নেয়। এই বিজয়ী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে সাতটা পরিবর্তন পাকাপাকি আনতে পেরেছিল। আম্বেদকর মনুস্মৃতি থেকে একে একে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, ১. ব্রাহ্মণরা শাসন করার ও রাজহত্যা করার অধিকার প্রাপ্ত হয়; ২. ব্রাহ্মণরা একটি বিশেষ শ্রেণিতে পরিণত হয়; ৩. বর্ণকে তারা জাতে রূপান্তরিত করে; ৪. বিভিন্ন জাতের ভেতর সংঘর্ষের ও অসামাজিক অনুভবের বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়; ৫. শূদ্র এবং নারীদের অধোগামী করে; ৬. সমাজে নানারকম শ্রেণিভাগ করে অসাম্যের সূচনা করে; ও ৭. সামাজিক ব্যবস্থাকে আইনানুগ ও কঠোর করে তোলে যা আগে ছিল না।
৪
আধুনিক কাল
ব্রিটিশশাসনতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অনুরূপ। তবু যা হোক প্রাচীন সমাজ তখন বিলুপ্ত হয় নি, এরই মধ্যে নিজের মতো করে বেঁচে বত্তে ছিল, সেই প্রাচীন সমাজ বিলুপ্ত হয়েছিল ব্রিটিশের হাতে। কোনো কোনো ব্রিটিশ প্রশাসক প্রাচীন সমাজকে একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। ভারতের গ্রামসমাজ নিয়ে ১৮৩০ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেলের (লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক) কাউন্সিলের সদস্য চার্লস মেটকাফ লিখেছিলেন,
গ্রামসমাজগুলো হল ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র, যা কিছু তাদের প্রয়োজন সবই তাদের আছে এবং তারা কোনো বৈদেশিক শক্তি-নির্ভর নয়। যেন মনে হয় কোনো কিছুই যেখানে স্থায়ী নয় সেখানে তারা স্থায়ী। রাজবংশের পর রাজবংশের পতন ঘটে, এক বিপ্লবের পর আর এক বিপ্লব আসে; হিন্দু, পাঠান, মোগল, মারাঠা, শিখ, ইংরেজ, একাদিক্রমে প্রভু হয়, কিন্তু গ্রামসমাজগুলো একই রকম থাকে।
এর প্রায় পঁচাত্তর বছর পরে বাংলাদেশের জলকষ্ট সম্পর্কে সরকারের মন্তব্য ছেপে বেরোলে ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শনে ‘স্বদেশী সমাজ’ নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সে প্রবন্ধে তাঁর আক্ষেপ ছিল এই নিয়ে যে ‘আমাদের যে একটি ব্যবস্থা ছিল, যাহাতে সমাজ অত্যন্ত সহজ নিয়মে আপনার সমস্ত অভাব আপনিই মিটাইয়া লইত—দেশে তাহার কি লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকিবে না।’ এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গক্রমে আরো এমন বহু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, যেসব কথা উদ্ধৃত হবার অপেক্ষা রাখে। নিচে তার অংশবিশেষ তুলে দেওয়া হল।
ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার প্রাণশক্তি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত। সাধারণের কল্যাণভার যেখানেই পুঞ্জিত হয়, সেইখানেই দেশের মর্মস্থান…বিলাতে রাজশক্তি যদি বিপর্যস্ত হয়, তবে সমস্ত দেশের বিনাশ উপস্থিত হয়। এইজন্যেই য়ুরোপে পলিটিক্স এত অধিক গুরুতর ব্যাপার। আমাদের দেশে সমাজ যদি পঙ্গু হয়, তবেই যথার্থভাবে দেশের সংকটাবস্থা উপস্থিত হয়। এইজন্য আমরা এতকাল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ করি নাই কিন্তু সামাজিক স্বাধীনতা সর্বতোভাবে বাঁচাইয়া আসিয়াছি। নিঃস্বকে ভিক্ষাদান হইতে সাধারণকে ধর্মশিক্ষাদান এ সমস্ত বিষয়েই বিলাতে স্টেটের ওপর নির্ভর—আমাদের দেশে ইহা জনসাধারণের ধর্মব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত—এইজন্য ইংরেজ স্টেটকে বাঁচাইলেই বাঁচে, আমরা ধর্মব্যবস্থাকে বাঁচাইলেই বাঁচিয়া যাই।
মনে রাখা প্রয়োজন এই ধর্মব্যবস্থা কিন্তু আর এস এস/বিজেপির ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নয়।
৫
ব্রিটিশ ও আমাদের সমাজ (১)
অটোমান সাম্রাজ্যের বাহুবিস্তারের পর থেকে, বিশেষ করে ইয়োরোপীয়দের গর্বের বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অটোমানদের হাতে ইতি ঘটার পর থেকে, ইয়োরোপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই বিষবাষ্প তারা উপনিবেশগুলোতেও ছড়িয়ে দিয়েছিল। পলাশী যুদ্ধের আগে পর্যন্ত সামরিক ও অসামরিক চাকরির ক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত ও অসম্ভ্রান্ত উভয় প্রকার মুসলমানদের একটা প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি পাবার পরপরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুসলমান সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়। তার ফলে ওপর নিচু উভয় তলার কর্মচারিরাই বেকার হয়ে যায় এবং দারিদ্রের মধ্যে গিয়ে পড়ে। রাজস্ব বিভাগ ঢেলে সাজানোর সময়ও প্রচুর মুসলমান কর্মচারির কাজ যায়।
১৭৭০ সালের ভয়ংকর খরাজনিত দুর্ভিক্ষে এমনিতেই কৃষকের দুর্গতির সীমা ছিল না, তার ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমির ওপর উঁচু হারে কর চাপিয়ে এবং খাজনা আদায় করে কৃষকদের আরো দুর্গতিতে ফেলে। এছাড়াও ব্যবসাবাণিজ্য যারা করত তারা খাদ্যশস্য মজুত করে কৃত্রিম হারে তা বিক্রি করতে চাওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে সেইসব খাদ্যশস্যর নাগাল পাওয়া দুর্লভ হয়ে উঠল। এই দুর্ভিক্ষে সাধারণ মানুষের এক তৃতীয়াংশ নিঃশেষ হয়ে যায়। এরপর ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা নামে। এতদিন পর্যন্ত জমি পণ্য ছিল না। জমি ছিল একাধারে কৃষকের এবং রাজার। কারুরই জমি বিক্রির কোনো অধিকার ছিল না। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ জমিদার সৃষ্টি করে সেই জমিদারদের জমি বিক্রির অধিকার দিয়ে দিল, যার ফলে জমি পণ্য হয়ে গেল।
১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাগু হবার সময়, ঐ বছরই গ্রাম্য পুলিশ প্রথা তুলে দেওয়ার কারণে ঐ পেশায় বহাল থাকা প্রচুর মুসলমান আরো এক দফা বেকার হয়। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আমাদের দেশের দুটো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি করেছিল। এক, যে কথা আগেই বলেছি, জমিকে তারা পণ্যে পরিণত করেছিল। দুই, কৃষি ও তাঁতকে ধ্বংস করে গোটা গ্রামসমাজকেই শুধু তারা বিধ্বস্ত করে দেয়নি, হিন্দু-মুসলমানে বিভেদেরও জন্ম দিয়েছিল। কারণ, কৃষক ও তাঁতিদের বড় অংশটাই ছিল মুসলমান।
আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সবথেকে বেশি লাভবান যে হিন্দুরা হয়েছিল সেটা একটা বহুচর্চিত কথা। হঠাৎ নবাব আর অনুপস্থিত জমিদারে দেশটা ভরে গিয়েছিল, বিশেষ করে শহরগুলো। গ্রামসমাজের প্রতি এদের কোনো দায় ছিল না। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকলেও শহরগুলো গড়ে ওঠে মূলত পরিযান বা migration-এর মধ্যে দিয়ে। এক এক জন এক এক গ্রাম থেকে আসা মানুষ। ফলে গ্রামের গোষ্ঠীগত সম্পর্কও তাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। নগরায়নের সঙ্গে শহরের সম্পর্ক, তাদেরও সম্পর্ক। আর সে সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল বিলাসিতা আর উচ্ছৃঙ্খলতায় ভরা।
গ্রামসমাজও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী ফসলগুলোর জায়গায় ব্রিটেনে (এবং চীনে) চালান করার জন্যে ব্রিটিশরা অর্থকরী ফসলের ফলনে জোর দিয়েছিল। যেমন নীল, পাট, গম, চা, আফিম ইত্যাদি। এর মধ্যে নীলচাষ চাষিদের সবথেকে বেশি ক্ষতি করেছিল, মাটিরও খুব ক্ষতি করেছিল। এ ব্যাপারে দুটো উদাহরণই যথেষ্ট। প্রথমটা হল নীলচাষের উদাহরণ। যেসব চাষিরা এতদিন খাদ্যশস্য উৎপাদন করত, ব্রিটিশরা তাদের বাধ্য করেছিল নীলের চাষ করতে। বাজারদরের মাত্র এক চতুর্থাংশ টাকা দিয়ে সেই নীল তারা কিনত। চড়া সুদে দাদন দিত, যার ফলে চাষিরা এমন ঋণে জড়িয়ে যেত, যার থেকে সারা জীবনে তারা বেরিয়ে আসতে পারত না। আর যে মাটিতে একবার নীলচাষ হত, সেই মাটিতে পরে আর কোনো চাষ করা যেত না। দ্বিতীয়টা হল, শিল্পবিপ্লবের পর ব্রিটেন থেকে মিলের কাপড় (powerloom) বাজারে এসে যাওয়ায় আমাদের তুলো এবং ধুনুরি কারুরই আর বাজার রইল না। কারণ আমাদের তাঁতের কাপড় মিলের কাপড়ের থেকে উৎকৃষ্ট মানের হলেও মিলের কাপড় দামে সস্তা হওয়ায় বেশি বিক্রি হতে লাগল। ফলে তাঁতের কাপড়কে বাজারদরের অনেক নিচে তাদের উৎপাদন বিক্রি করতে হতে লাগল, মজুরিও গেল নেমে। যারা ব্রিটেনের কারখানার জন্যে কাঁচা মাল উৎপাদন করতে অস্বীকার করতে লাগল, তাদের কপালে জুটতে লাগল জরিমানা, চাবুক, জেল, বন্ড লিখিয়ে নেওয়া। এইভাবে আমাদের হস্তচালিত তাঁতও (handloom) ধ্বংস হয়ে গেল। বিশ্বখ্যাত মসলিনের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস আমরা সবাই জানি।
ব্রিটিশ শাসনের সময় কৃষিক্ষেত্রে চার ধরনের ভাগ ছিল। সবার ওপরে ছিল জমিদাররা। ১৭৯৩ সালের লর্ড কর্নওয়ালিস-কৃত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে যেসব অনুপস্থিত ভূস্বামীকে ব্রিটিশ জমির মালিক করে দিয়েছিল, সেইসব হঠাৎ গজিয়ে ওঠা জমিদারের সঙ্গে চাষবাসের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাদের কাজ ছিল ব্রিটিশের হয়ে কর সংগ্রহ করা, এবং সেই সূত্রে নিজেদের ভোগবিলাসের জন্যে বাড়তি কিছু সংগ্রহ করা। তারপর আসে জোতদারদের কথা। অনেক সময় ‘জমিদার-জোতদার’ শব্দটা একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়। তারাও আসলে কোম্পানি শাসনের সময় কৃষিপ্রধান বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির একটি সামাজিক স্তর। এরাও প্রকৃতপক্ষে কৃষক ছিল না, কিন্তু ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্যে কৃষকের (রায়তের) বিধিসম্মত মর্যাদা আদায় করেছিল। তার পরে আসে প্রকৃত রায়তদের কথা, যাদের মধ্যে ছিল মোট চারটি ভাগ —মধ্য চাষি, ক্ষুদ্র চাষি, বর্গাদার (ভাগচাষি) ও কৃষিমজুর। এইভাবে প্রাক-ব্রিটিশ আমলের কৃষিসমাজটা ব্রিটিশ শাসনের সময় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রাক-ব্রিটিশ আমলের পরিপূরক অর্থনীতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি ব্রিটিশ আমলে পারস্পরিক সংঘাতে বদলে গেল। কৃষিসমাজটা চার ভাগে ভাগ হয়ে গেল। সমাজের আগেকার অখণ্ড অস্তিত্ব বলে কিছু রইল না।
কারিগরদের ক্ষেত্রেও তথৈবচ। ব্রিটিশ যে বাজারদর বেঁধে দিয়েছিল, সেই দরে তাদের কাজ করতে এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করতে ব্রিটিশ বাধ্য করল। শিল্পবিপ্লব এবং ব্রিটিশ বাণিজ্য নীতি দুয়ে মিলে ভারতীয় দ্রব্যের দিশি-বিদেশি দুরকম বাজারই বন্ধ করে দিল। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র এবং পুনর্বিনিয়োগ করার মত পুঁজির অভাব এই তিনে মিলে দ্রুত দক্ষ কারিগরের বিলোপ ঘটাতে লাগল। সর্বোপরি ব্রিটিশের তৈরি দ্রব্যের বাজার আমাদের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের বাজারকে শেষ করে দিল।
ব্রিটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত পুকুর খোঁড়া, বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ করা এদেশের চিরাচরিত প্রথা ছিল। পানীয় জলের জন্য এবং সেচের কাজের জন্যে বড় বড় জলাধার নির্মাণ করা হত। ব্রিটিশ আমলে দেখতে দেখতে পুকুরগুলো সব ভরাট হয়ে গেল, সেসব জায়গা ধানক্ষেতে ভর্তি হয়ে গেল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ভাষায়, “বৎসরের মধ্যে ৬ হইতে ৮ মাস পর্যন্ত গ্রামে জলাভাবে অতি সাধারণ এবং কর্দমপূর্ণ ডোবার দ্বারা যে পানীয় জল সরবরাহ হয়, তাহা ‘গলিত জঞ্জাল’ অপেক্ষা কোন অংশে ভাল নহে। এই সব স্থানে প্রতি বৎসর কলেরা ম্যালেরিয়াতে বহু লোকের মৃত্যু হয়।” ‘স্বাভাবিক জলনিকাশের পথরোধ’ সম্পর্কে ডাঃ বেন্টলী লিখেছিলেন,
সমস্ত জলনিকাশের পথেরই গতি নদীর দিকে। ঐ সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী আবার জলরাশিকে পদ্মা ও যমুনার গর্ভে ঢালে। দেশের অবনমন ঢালুতা বা ‘গড়ান’ ৬ ইঃ হইতে ৯ ইঃ পর্যন্ত। দুর্ভাগ্যক্রমে, যে সমস্ত ইঞ্জিনিয়ার এই অঞ্চলে জেলাবোর্ড ও রেলওয়ের রাস্তাগুলি তৈরি করিবার জন্য দায়ী, তাঁহারা দেশের স্বাভাবিক জলনিকাশের পথের কথা লইয়া মাথা ঘামান নাই। কাজেই, রাস্তা ও রেলওয়ে বাঁধগুলিতে যে সব কালভার্ট বা পয়োনালীর ব্যবস্থা হইয়াছে তাহা যথেষ্ট নহে। জলপ্রবাহ অনিষ্টকর নহে, কিন্তু উহার দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা করিতে হইবে। বন্যা যা প্রায় বাৎসরিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার কারণই এই যে, রেলওয়ে লাইন তৈরি করিবার ত্রুটির দরুন বাংলার নদীগুলির স্বাভাবিক কার্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হইয়াছে। আমাদের সম্মুখে প্রধান সমস্যা এই-স্বাভাবিক জলনিকাশের পথের পুনরুদ্ধার – যাহাতে প্রত্যেক বর্ষার পর জল দ্রুতগতিতে বাহির হইয়া যাইতে পারে।
জাহাজের জন্য, এবং রেলের স্লিপারের জন্য কাঠের প্রয়োজনে এবং জঙ্গল ফাঁকা করে রাস্তা তৈরির প্রয়োজনে ব্রিটিশ আমাদের অরণ্য ধ্বংস করে দিল। শুধু তাই নয়, আবাদের জন্যও তারা অরণ্য ধ্বংস করে দিল। যেসব আদিবাসী জঙ্গলে থাকত, তারা তাদের এই যুক্তিতে জঙ্গলের বাইরে বার করে দিতে লাগল যে তারা গাছ কেটে অরণ্যের ক্ষতি করে, যখন নাকি আদিবাসীদের কাছে জঙ্গলের প্রতিটি গাছই হচ্ছে ‘পবিত্র কুঞ্জবন’ (sacred grove) ।
৬
ব্রিটিশ ও আমাদের সমাজ (২)
এইবার আসা যাক আর এক প্রসঙ্গে। প্রাক-ব্রিটিশ আমলে গ্রামগুলো সামাজিক ক্ষেত্রে যৌথ পরিবার, জাতবিন্যাস ও গ্রাম পঞ্চায়েতগুলো যেভাবে প্রচলিত বিধিনিষেধ মেনে কাজ করত, ব্রিটিশ এসে সেই ব্যবস্থাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল, তার জায়গায় কেন্দ্রীয় স্তরে প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলে গ্রামগুলিকে তার অধীন করে দিল। ফলে আলাদা করে গ্রামসমাজ বলে আর কিছু রইল না, গ্রামবাসীরা সবাই হয়ে উঠল রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী। উদাহরণের মত দু’একটা পেশ করা যায়।
১৮৫৬ সালে বঙ্গীয় চৌকিদারি আইন তৈরি করে ব্রিটিশ চৌকিদারি কর বসাল। এই সেই চৌকিদারি আইন যার বিরুদ্ধে ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে আইন অমান্য সংগঠিত হয়, যাতে সবচেয়ে বেশি যোগদান করেছিল মূলবাসী-আদিবাসীরা। ১৮৬১-র পুলিশ আইনে ব্রিটিশ সর্বভারতীয় স্তরে, যার মধ্যে বাংলাও ছিল, পৃথক প্রশাসনিক সংগঠনের সৃষ্টি করল, যার ফলে গ্রাম-নগর দুয়েরই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের সর্বময় কর্তৃত্ব চলে গেল পুলিশের হাতে, মাথার ওপরে রইলেন ব্রিটিশ অফিসাররা স্বয়ং। সেই নিয়ন্ত্রণের চেহারা অনেকটাই আজকের ইউএপিএ-র মত।
ব্রিটিশ ইংরেজি ভাষাভিত্তিক পশ্চিমী ধারার এমন এক সংস্কৃতির পত্তন করল যার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির আমূল তফাৎ ছিল। ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকাউলের পরামর্শে ব্রিটিশ আগেকার গুরুকুল শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিল। দেশজ ভাষাগুলোর ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিয়ে ব্রিটিশ তার নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন করল। ইংরেজিই হয়ে গেল একমাত্র শিক্ষামাধ্যম, যার ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থা গড়পড়তা লোকজনের আওতার বাইরে থেকে গেল।
প্রাথমিক স্কুলগুলোর জন্যে যথেষ্ট টাকা বরাদ্দ করা হত না। ইংরেজি জানা না জানার ভিত্তিতে সমাজটা ‘শিক্ষিত-অশিক্ষিত’ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা এলিট শ্রেণির সৃষ্টি হল, এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। যারা সম্পদের ও ইংরেজি শিক্ষার দৌলতে উকিল, ব্যারিস্টার, জজ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে উঠতে পারল, তারা হয়ে গেল এলিট শ্রেণির অংশ, যার যার সমাজে স্বমহিমায় বিরাজ করতে লাগল। আর নিচের স্তরে নিম্নবর্গে একইভাবে কৃষকরা, কারিগররা, আদিবাসীরাও নানা ভাগে ভাগ হয়ে গেল। অখণ্ড সমাজ বলে কিছু রইল না, শুধু তাই নয়, রইল না রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘অত্যন্ত সহজ নিয়মে আপনার সমস্ত অভাব আপনিই মিটাইয়া’ নেবার ক্ষমতাও।
৭
আধুনিক ভারত
১৯৫০ সালে সংবিধান তৈরি হল। ১৯৫১/৫২ সাল জুড়ে হল প্রথম লোকসভা ও একই সঙ্গে বেশ কিছু বিধানসভার নির্বাচন। বিলুপ্ত সমাজকে কেন্দ্র করেই শুরু হল নয়া যাত্রা। শুরু থেকেই একের পর এক স্ক্যান্ডাল আর স্ক্যাম। নেহরুর আমলের টি টি কৃষ্ণমাচারি থেকে শুরু করে মোদির আমলের আদানি-আম্বানিকে সামনে রেখে ‘দুনিয়ার গুজ্জু এক হও’। শুরু হল ভোট রাজনীতির খেলা। প্রথম প্রথম খেলাটা ছিল প্রতিশ্রুতির। আলমোড়া জেল থেকে বেরিয়ে নেহরু বললেন, মজুতদার আর মুনাফাখোররা গরিবের শ্ত্রু। ক্ষমতায় এলে দুনিয়ার সব মজুতদার আর মুনাফাখোরকে ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাব। কিন্তু ক্ষমতায় যখন এলেন, তখন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও অর্থমন্ত্রী সি ডি দেশমুখ এই বিষয়ের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় তিনি তাঁদের ওপর অসন্তুষ্ট হলেন। পরে অবশ্য তিনি ১৯৫৫ সালে এ ব্যাপারে একটা আইন করেন তবে সে আইন তেমন কাজ দেয় নি। যেমন, মোদি। তিনি বললেন, কালো টাকা উদ্ধার হলে প্রত্যেক নাগরিককে তিনি ১৫ লক্ষ করে টাকা দেবেন। আহা সই কেবা শুনাইলে শ্যামনাম। পাবলিক কিন্তু সেভাবে খেল না। এ নিয়ে গুঞ্জন চলতে লাগল। তখন মোদির ডানহাত বাঁহাত অমিত শাহ এবিপি নিউজে বসে বললেন, ওটা তো ‘জুমলা’ ছিল। প্রধানমন্ত্রী তো তা বলেন নি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, কালো টাকা উদ্ধার হলে তিনি সেই টাকা গরিবের উপকারে লাগাবেন। মিটে গেল ঝামেলা। জুমলা একটা উর্দু শব্দ, হিন্দিতে এসে মিশেছে। প্রবাদবাক্য হিসেবে এর অর্থ হল ‘ফাঁকা আওয়াজ’। অমন একটা ফাঁকা আওয়াজ মেরেও প্রধানমন্ত্রী দিব্যি পার পেয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে এল টাকা দিয়ে উপহার দিয়ে ভোট কেনা পর্ব। ১৯৫২ সালে যখন প্রথম নির্বাচন হয় তখন দল ছিল মোট ৫৫টি। ২০১৪-তে সেই দল এসে দাঁড়াল ৪৬৪-তে। কে কাকে ভোট দেবে একেবারেই নিশ্চিৎ নয়। অতএব মধ্যকালীন পর্বটা হয়ে দাঁড়াল টাকা দিয়ে উপহার দিয়ে ভোট কেনার পর্ব। শুধু টাকা দিয়ে নয়, নানা রকম উপহার দিয়েও। যার মধ্যে আছে মদের বোতল থেকে শুরু করে রঙিন টিভি। যদিও ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে দেখা যায় এতেও খুব একটা কাজ হয়নি। কারণ অপর পক্ষও সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। পরিণামে সব পক্ষই একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। এবং নির্বাচকদের ওপরেও এসবের প্রভাব খুব একটা পড়ে না। এর সঙ্গে আছে ঘোড়া কেনা বেচা। এই দুষ্কর্মের শিরোমণি হচ্ছে বিজেপি।
তৃতীয় অধ্যায়ের বিশিষ্ট নাম হল জয়ললিতা জয়রাম। ১৯৯১ সালে তিনি প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন। এর পর থেকে একদিকে ছ’বারের মুখ্যমন্ত্রীত্বের মধ্যে ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগে বারে বারে জেল, অপরদিকে সমাজকল্যাণমূলক প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে জনপ্রিয়তা বজায় রাখার চেষ্টা। জয়ললিতার ‘দোলনা শিশু যোজনা’ (cradle baby scheme) খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এই যোজনায় মায়েরা তাদের নবজাতকদের দত্তক নেবার জন্যে বেনামে প্রস্তাব করতে সক্ষম হয়। এছাড়া ছিল ভরতুকিযুক্ত ক্যান্টিন, আম্মা ব্রান্ডের বোতলজাত জল, নুন, সিমেন্ট ইত্যাদি পণ্য।
অনেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর জনমোহিনী রাজনীতির জন্যে জয়ললিতার সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁদের ভাষ্য অনেকটা এরকম, জয়ললিতার মত এও হল পাইয়ে দেবার রাজনীতি। এ তুলনা কিন্তু ঠিক নয়। ঠিক, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকল্পগুলি ভোট পাওয়ার কাজে লাগে, কিন্তু সেগুলি শুধু সমাজকল্যাণমূলক নয়, সেই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক পরিবর্তনও আনে। উদাহরণ স্বরূপ ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের কথা বলা যায়। কন্যাশ্রী প্রসঙ্গে মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,
এখানে সম্পদের পুনর্বন্টন ব্যবস্থাটা এমন ভাবে করা যাতে সুফলের ভাগ পৌঁছে যাচ্ছে সমাজের সবচেয়ে নীচুতলার বাসিন্দাদের কাছে। এদের প্রান্তিকতার স্বরূপ দু-ভাবে নির্মিত: একটির স্বরূপ মেয়ে হিসেবে, এবং অন্যটি তাদের বেশির ভাগই সমাজের সর্বাধিক নিপীড়িত অংশ, দলিত, আদিবাসী ও মুসলমান হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যায় দলিত-আদিবাসী-মুসলমান মিলে ৫৬ শতাংশ; গ্রামাঞ্চলে, স্বাভাবিক কারণে আরো অনেক বেশি – প্রায় তিন চতুর্থাংশ। সংখ্যায় বিপুল হওয়া সত্ত্বেও, এবং সামাজিক উৎপাদনে তাঁদের বিপুল অবদান থাকা সত্ত্বেও, সামাজিক ফলগুলো থেকে তাঁরা বঞ্চিত। সম্পদের পুনর্বন্টনের মধ্যে দিয়ে তাঁদের কাছে কিছু পৌঁছনো মানে তাই, পাইয়ে দেওয়া নয়, বরং তাঁদের ন্যায্য অধিকারের কিছুটা স্বীকৃতি দেওয়া।
সামাজিক পরিবর্তনের হাল ধরার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঈষৎ ব্যতিক্রম। ১৯৭৭ সালের ‘অপারেশন বর্গা’ নামক ভূমি সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ এই হাল ধরতে চাওয়ার উদাহরণ। কিন্তু অপরদিকে বাম সরকারের ৩৪ বছরের দীর্ঘ শাসনকালে গ্রাম ও শহর উভয় সমাজের দৈনন্দিন জীবনে সর্বত্রই পার্টি বা দল গিয়েছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, যে সর্বত্রগামিতা এ আমলেও বহতা। রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন্ দল তুমি কোন্ দল। এর মধ্যে সমাজ কোথায়?
৮
উন্নয়নের ঢক্কানিনাদ
ব্রিটিশ নদীগুলিকে যেভাবে শেষ করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় ভারত সরকারও আমাদের নদীগুলিকে শেষ করে চলেছে। ব্রিটিশের সময় কারখানার পরিমাণ ছিল অপেক্ষাকৃত কম, তাই শিল্প বর্জ্যের পরিমাণও ছিল কম। এখন কারখানার পরিমাণ অনেক বেশি, শিল্প বর্জ্যের পরিমাণও বেশি। তার মধ্যে বেশ কিছু আবার বিষাক্ত। তার ওপর শহর মফস্বলের অপরিশোধিত নালাগুলো পরিষ্কার না হওয়ায় নদীগুলোর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। জলবিদ্যুতের জন্য বাঁধ তৈরি করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন করা হচ্ছে, সেই সঙ্গে ধ্বংস করে হচ্ছে নদীর পরিবেশকেও। এখন হতে চলেছে নদীগুলির সংযুক্তিকরণ। বিরোধী পক্ষ এবং বেশ কিছু পরিবেশবিদের আপত্তিকে পাত্তা না দিয়েই।
ব্রিটিশের ধারাবাহিকতায় ভারত সরকার জঙ্গলও ধ্বংস করে চলেছে। ঘন বন প্রায় উধাও। প্রতি দুবছর অন্তর বেরোনো ফরেস্ট রিপোর্টে ফাঁকা বনকেই বন বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে শহরের পার্কের গাছগুলিকে, রাস্তার দুপাশের গাছগুলিকে ঘন বনের অন্তর্ভুক্ত করে। ২০২৩-এর রিপোর্টে বাঁশ ঝাড়, নারকোল গাছের বাগান, বাগিচাগুলোকেও ঘন বনের অন্তর্ভুক্ত করে হিসেব ঠিক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে আদিবাসীদের সঙ্গে জঙ্গলের সম্পর্ক সুপ্রাচীন ও পরস্পরের পরিপূরক, যে আদিবাসীদের জীবিকার বৃহত্তম উৎস জঙ্গল সেই অরণ্যের অধিকার তাদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্রমশই তাদের জঙ্গল থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। অনেক আন্দোলন করে ২০০৬ সালে আদিবাসী এবং তপশিলী উপজাতিদের জন্যে কিছু অধিকার আদায় করা গিয়েছিল। বন বলতে সে আইনে বুঝিয়েছিল অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান সহ সব ধরনের অরণ্য যেসব জায়গায় আদিবাসীদের অধিকার বজায় থাকবে। ১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইনকে সংশোধন করে ২০২৩ সালে বিল এনে চেষ্টা করা হচ্ছে সেই বনভূমিগুলিকে আলাদা করার যেগুলির ব্যবহারের অনুমোদন নেই। আলাদা করা সেই বনভূমিকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে নির্মাণের জন্য, জাতীয় নিরাপত্তা প্রকল্পের জন্যে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের জনসংখ্যাস্ফীতি ঘটেছে। ১৯৪৭ সালে জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটির কিছু ওপরে, ২০১১ সালে সেই জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়ে গেছে। মোট জনসংখ্যার আদ্ধেকের ওপর জনসমষ্টি আবার বেঁচে থাকার জন্যে চাষবাসের ওপর নির্ভর করে, এদিকে চাষী-ভিত্তিক জমির পরিমাণ খুবই অল্প। এক দশক আগেও একজন চাষীর হাতে গড়পড়তা চাষজমির পরিমাণ ছিল ৩ একর, এখন আরো কম। কেরালা, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, তামিলনাডুতে এই পরিমাণ আরো কম – আধ একর থেকে দু’ একর। অনস্বীকার্য যে এই বিপুল জনগোষ্ঠী কৃষি থেকে যে আয় করে তাতে জিডিপির মাত্র ১৫ শতাংশ আসে এবং সে হিসেবে এই ক্ষেত্রটা তেমন উৎপাদনশীল নেই আর। কিন্তু সে সমস্যার সমাধান ১৮৯৪ সালের উপনিবেশিক জমি আইন নয়। কৃষিক্ষেত্র কিভাবে আরো উৎপাদনশীল হয়ে উঠবে তাই নিয়ে ভাবা যেত। তার বদলে স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা জমি অধিগ্রহণ করে সেই জমিকে উন্নয়নে লাগানোই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলেন। উন্নয়ন বলতে প্রধানত উচ্চবর্গের জন্য গৃহ নির্মাণ, ভারী শিল্পের পরিকাঠামো ইত্যাদি। ১৮৯৪ সালের আইন ব্যবহার করে শিল্পায়ন ও নগরায়নের নামে যদৃচ্ছ জমি অধিগ্রহণ হল। ১৮৯৪ সালের আইন ব্যবহার করে তাঁরা দুটো সমস্যাই মিটিয়ে ফেললেন—এক, অনিচ্ছুক বিক্রেতার সমস্যা, দুই, অনিশ্চিত বা বিতর্কিত স্বত্বগুলির সমস্যা। ১৯৪৭ সাল থেকে এপর্যন্ত ভারত সরকার কর্তৃক হয় অধিগ্রহণ নয় চরিত্র বদলে ফেলা জমির পরিমাণ ৫০০ লক্ষ কৃষিজমি। দেশের মোট জমির ৬ শতাংশ। আর এই অধিগ্রহণের ফলে জমি হারাল প্রায় ৫০০ লক্ষ কৃষক। কেউ কেউ সামান্য ক্ষতিপূরণ পেল, কেউ ঠিকমত পেলই না। যারা ঐ জমির ওপর নির্ভরশীল ছিল বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হল তারা, কারণ তাদের বেলায় ক্ষতিপূরণের তো প্রশ্নই নেই, তার ওপর চাষের জন্য জমিও রইল না। জমির বদলে খুব সামান্যই পুনর্বাসন দেওয়া হল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হল আদিবাসী ও দলিতরা। বিনোবা ভাবে বলেছিলেন জনসংখ্যাস্ফীতি থেকে বেরোনোর একমাত্র উপায় হচ্ছে নারী সশক্তিকরণ। মেয়েরা নিজেরা ঠিক করবে তারা ক’টা বাচ্চা চায়। বিনোবাজির কথা বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এবং পুরুষতান্ত্রিক সরকারও বিনোবাজির কথায় কান পাতে নি।
এগুলোই হল ভাবনার বিষয়, রাজনীতির দাঁওপ্যাঁচ নয়।
সাহায্যসূত্রঃ
১. অমূল্যচরণ রচনাবলী, খণ্ড ১
২. B R Ambedkar, Alienation of Castes
৩. Louis Dumont, Homo Hierarchicus
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বদেশী সমাজ
৫. আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আত্মচরিত
৬. মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা ভট্টাচার্য মেমোরিয়াল লেকচার