সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
প্রবন্ধটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত লেখকের The Concept of Bharatavarsha and other Essays বইয়ের প্রথম অংশ। এই বইয়ের প্রকাশক Permanent Black, Ranikhet।
এই প্রবন্ধের থিম হিসেবে ‘ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় ধারণা’ – বিষয়টি আলোচিত হওয়ার নানান কারণ আছে। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি, আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ - পোশাকী নাম INDIA। এর একটা মানচিত্র আছে, সেই মানচিত্রে নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে, যা এই দেশকে অন্য দেশ থেকে আলাদা করেছে। ১৯৪৭এর দেশভাগ এই মানচিত্রে বদল ঘটিয়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষ নাম, ও তার ধারণা একই রয়ে গেছে। ম্যাপে যে বদলই হোক না কেন, ‘দেশ’ সম্পর্কে তৈরি হওয়া ধারণাটা, পূর্বজদের থেকে আমাদের প্রজন্ম পর্যন্ত একই। অথচ ঐতিহাসিক পরিবর্তনের নিরিখে ভারতবর্ষ বা INDIA, ধারণাটিরও কালোচিত পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের দিকটিকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। অন্য কথায়, একটা ধারণা, বা তার দ্বারা ভৌগোলিক ভাবে সীমায়িত একটা রূপ, এবং তার ঐতিহাসিক সঞ্চারপথ, - এই দুইয়ের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক মূল্যায়নের দাবি রাখে। কেননা এখন আমরা যেটাকে ‘মান্য’ হিসেবে গ্রহণ করছি, সেটা কতগুলো ‘অনুমানের’ সমাহার মাত্র! আমার তথ্যসূত্রের মধ্যে একই কথার যথেষ্ট অর্থগত পার্থক্যকে আত্মীকরণ না করেই এই অনুমানের জন্ম, এবং তা ভারতের ইতিহাসের, বিশেষত প্রথম দিককার অংশের সাধারণীকরণে যথেষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের সবচেয়ে বড় অনুমান—ভারতবর্ষ ও INDIA-র অভিজ্ঞান (identity) গত ধারণা। এই ধারণার একীভূতকরণের ধারাটিকে ঐতিহাসিক ভাবে ব্যাখ্যা করা এই প্রবন্ধে সম্ভব নয়।কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, উনবিংশ শতাব্দীতেই, কী ইতিহাস রচনায়, কী সাধারণ চিন্তায়, এই অভিজ্ঞানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যাঁরা INDIA- র ওপর বা এই ধারণাটির ওপর লেখালেখি করেন, তাঁরা ধরে নেন, তাঁরা যে ভাবে এই ধারণাটিকে দেখাতে চাইছেন সেটাই ‘ভারতবর্ষ’। এবং উভয় ক্ষেত্রেই তারা দেশের অতীত বা ইতিহাস থেকে পাওয়া ধারণাটিকেই বহন করছেন। এমনকি ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চার শুরুর দিকে এ ধরনের ইতিহাসের কথা ভাবা যেত। সেই মৌলিক ধারাপথে সৃজিত হতে পেরেছিল ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ এর মতো গ্রন্থ। ভারতবর্ষ ও INDIA-র চিহ্নিতকরণের এক ইতিবাচক বিবৃতি আমরা পাই, পৌরানিক ভূ-বিবরণের (Puranic cosmography) এক প্রখ্যাত গবেষকের লেখায়। তিনি লিখছেন - “সুদূরতম দক্ষিণের ‘বর্ষ’ ‘ভারত’ হিমবাত এবং সমুদ্রের মধ্যে শায়িত, সেটাই নিশ্চিতরূপে ‘INDIA’ “ (নিম্নরেখা লেখকের)।
INDIA ও ভারতবর্ষের এই পরিচয়ের দ্বিধাহীন পরিগ্রহণ আরও সুসংহত রূপ পায় আমাদের সংবিধানের এই সুমহান ঘোষণায়—
“india that is Bharat shall be a union of states.” এই ঘোষণা, আমাদের দেশ-পরিচয়ে তথা জাতীয়তাবাদে ঐতিহাসিক সীলমোহর দিলেও, ইতিহাসে তার কোনো মান্যতা থাকে না, স্বভাবতই। মনে রাখতে হবে, এই নামের অনেকগুলি উৎসমুখ আছে। একদিকে ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা নির্দেশিত একটি দেশ, যার নাম ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করেছে, অপরদিকে ‘ভারতবর্ষ’ এই নামটি চিরকালীন না হলেও ধারাবাহিক ভাবে বিভিন্ন প্রাচীন লেখায় নানাভাবে, সম্পূর্ণ বিপরীত ভূ-বিবরণগত গঠনের মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং ‘ভারতবর্ষ’ এই নামটি একটি সম্পূর্ণ পৃথক অর্থমাত্রা বহন করে। বিভিন্ন লেখার মধ্যে এটাই উপস্থাপিত হয়, কীভাবে ‘ভারতবর্ষে’র এই ধারণা নানা বিভিন্নতাকে একসঙ্গে ধারণ করে। এই ‘নাম’এর পূর্ব ইতিহাস, এবং সম্ভাব্য স্বাধীন সূত্রগুলি অনুসরণ করে এবং যে ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ কথাটি উঠে এসেছে, সেই প্রসঙ্গ বিচার করলে তা অভূতপূর্ব এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। এই ইস্যুগুলিকে সংযোগ করা ইতিহাস রচনার বৈশিষ্ট্যও বটে! ভারতবর্ষ সংক্রান্ত ইতিহাসের সাম্প্রতিকতম চর্চার প্রয়াস সত্ত্বেও আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই ধারণাকেই মান্যতা দিয়ে এসেছি যে, যে দেশে আমরা বাস করি, তার সংজ্ঞা বরাবরই একই রয়ে গেছে। আমরা দেশকে যে ভাবে ভাবছি, তা অতীতেও একই ভাবে ভাবা হয়েছে। একই সময়ে এটা সাধারণ বোধের বিষয়ে যে, ভারতবর্ষের ভৌগোলিক স্থান ও তত্ত্বগত ধারণা বারবারই সংজ্ঞায়িত ও পুনর্সংজ্ঞায়িত হয়েছে। একটি স্থানের ইতিহাস ও মানুষজনকে বুঝতে হলে এই সংজ্ঞাকরণ ও পুনর্সংজ্ঞাকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে সচেতন হতে হয়। দ্বিতীয়ত একটি নির্দিষ্ট যৌথ সংবেদনশীলতা, যাকে সাধারণভাবে ‘জাতীয়তাবোধ’ বলা যায়, তার চিহ্নিতকরণে এই সামাজিক-ভৌগোলিক পরিসর বা সেখানে বসবাসকারী জনজাতির উৎকর্ষের দিকটি মর্যাদা পায় না। এটা এমন এক সংবেদনশীলতা, যা ঐতিহাসিকভাবে আহৃত, এবং তা নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। একটি দেশ বা সেই দেশের ধারণা স্বাধীন ভাবে সেই যৌথ সংবেদনশীলতায় বিরাজ করতে পারে, যদি না সেই ঐতিহাসিক ভাবে অর্জিত সচেতনতা নানা ধরনের স্পষ্ট ভাষ্যের মধ্যে দিয়ে প্রদর্শিত হয়।
এখন, যখন আমরা ভৌগোলিক ভাবে সীমাবদ্ধ (তা সে যে ভাবেই হোক না কেন) এবং সাংবিধানিকভাবে সংজ্ঞায়িত একটি বিশেষ ভূ-খণ্ডকে আমাদের দেশ হিসেবে মেনে নিয়েছি, যেখানে আমরা বসবাস করি, সেই ‘দেশ’ কথাটির মানে কী, তার কোন্ অতীত আমার কাছে ধরা দিচ্ছে, তা নিয়ে জরুরী আলোচনার দরকার হয়ে পড়ে নানা কারণেই। ইতিহাস রচনার দিক থেকে আমরা এই অর্থ সম্যকভাবে বোঝার একটি নির্দিষ্ট বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছি। বিশেষত INDIA ও ভারতবর্ষের ধারণা সম্পর্কে প্রচলিত মতগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন আছে। বিশদে না গেলেও বর্তমান লেখালেখি বা চর্চার মধ্যে একজন তিন-তিনটি বড় অবস্থানগত ভিন্নতা লক্ষ্য করতে পারবেন। এক, ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক গঠন থেকে সৃষ্টি হয়েছে, এটি আঞ্চলিক শাসনযোগ্য ইউনিট হিসেবেই সৃষ্ট। অন্য অংশ থেকে পৃথক হচ্ছে প্রশাসনিক কারণে। এই অংশটি INDIA তথা ভারতবর্ষের ধারণাটিকে সূদুর অতীতের জাতীয় ঐক্যের ধারণা দিয়ে দেখার পক্ষে। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত The fundamental unity of India র মত গ্রন্থ এই ঐক্যের ধারণাটিকে জোরের সঙ্গে উপস্থাপিত করে। এই ধারণায় ‘ঐক্য’ একটি দেশের মৌলিক গুণ, যার সাক্ষ্য পাওয়া যেতে পারে ভারতের ভৌগোলিক ধারণায়, পর্যটনকেন্দ্রগুলির কার্যকারিতায়, ভারতের সাম্রাজ্য জয় বা ঔপনিবেশিকতা স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে ঐক্য-আহ্বান প্রকাশিত, তার মধ্যে। ভারতের ঐক্যবদ্ধ চেহারার বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে ভারতের ইতিহাসের কিছু বইতে ছড়িয়ে আছে। অন্য অঞ্চলগুলির স্বকীয়তা সত্ত্বেও ভারতের এই ‘নেশনের’ ধারণাটি ‘ভারতবর্ষের’ ভূগোলের আলোচনায় বারবার আসছে, এখনও। ভারতবর্ষ তথা INDIA একটি প্রাচীন নেশন হিসেবে The fundamental unity of India নামক গ্রন্থে যেমনভাবে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনভাবেই পাওয়া যাচ্ছে The concept of India নামক সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থে। এই গ্রন্থে জানানো হচ্ছে-
“অবশ্যই এই উপমহাদেশের (যে দেশটি উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সমুদ্রের মধ্যে অবস্থিত) বাসিন্দারা পৌরাণিক লেখকদের বিবরণ অনুযায়ী, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ভাবে একটি ‘নেশন’ হিসেবে উল্লিখিত। এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই প্রতীতি আছে যে, এই সমগ্র উপমহাদেশে (অথবা এর একটা বড় অংশে) বসবাসকারীদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সেতু আছে, অথবা তারা একই সাংস্কৃতিক ছাতার নিচে, সাধারণ বৈশিষ্ট্যসহ বসবাস করে। সেটা এতটা গভীর, যে তাদের একটা সাধারণ নামে অভিহিত করা যায়—‘ভারতী’। সুতরাং রাজনৈতিক এবং জাতিগত ভাবে না হলেও, ভৌগোলিক এবং সংস্কৃতিগত ভাবে, ‘ভারতী’ একটি নেশন।“
Imaginary Institutoion of India প্রবন্ধটি, যা Subaltern studies সিরিজের একটি ভল্যুমে প্রকাশিত, সেই প্রবন্ধে ঠিক উল্টো অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে যথেষ্ট জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে—
“আজকের ইতিহাসে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতা সেটাই, যে নৈর্ব্যক্তিকতা ভারতবর্ষের মানুষদের স্পষ্টভাবে জানায়, স্বীকৃত বাস্তবতা হল, একে রক্ষা করা, ধ্বংস করা, তুলে ধরা, গঠন বা বিচ্ছিন্ন করা — সবই, পক্ষে বা বিপক্ষে সমস্ত ক্ষেত্রেই, বিষয়টি আবিষ্কারের নয়, উদ্ভাবনের । এটা উনবিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদী কল্পনার দ্বারা ঐতিহাসিক ভাবে নির্মিত।“ (নিম্নরেখা লেখকের)
এই বিবৃতিটি কোনো ঐতিহাসিক তথ্য-নির্ভরতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে কী নেই, সেই বিচার বাদ দিয়েও বলা যায়, এখানে কিছু নিহিত ধারণার কথা আছে, যা কয়েকটি প্রশ্নের উদ্রেক করে।
১. এখানে জাতীয়তাবাদের ‘ঐতিহাসিক বাস্তবতা’ ও ভারতবর্ষের ধারণার মধ্যে যে আবশ্যিক সমীকরণ স্থাপিত হয়েছে সে বিষয়ে
২. ‘উদ্ভাবন’ কোনো পূর্ব ধারণাসঞ্জাত নয়, বরং শূন্য-উদ্ভূত বা ভিন্ন ধরনের ‘নৈর্ব্যক্তিক ঠবাস্তবতা’ হলেও হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই জাতীয়তাকে চিহ্নিত করে না
৩ .ভারতের ঔপনিবেশিক অবস্থান থেকে আধুনিক ধারণার উত্থানের সম্ভাবনাকে এবং সেই উত্থানের সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সম্পর্কের নির্মাণকে উপেক্ষা করে জাতীয়তাবাদী কল্পনার ওপর ‘উদ্ভাবন’কে আরোপ করা।
একটি পূর্বজাতীয়তাবাদী অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে, এই প্রবন্ধ একই সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠান আদতে কী, তার সংজ্ঞা এবং ভারতবর্ষের ধারণা - উভয়কেই অস্বীকার করে। কেননা এটা ভারতবর্ষের ‘নৈবর্ক্তিক বাস্তবতা’ ও ভারতের জাতীয়তাবাদ, যা কি না আধুনিক, তাকে এক করে দেখে। এই অস্বীকরণ C.A.Bailey-র Empire and Information গ্রন্থেও দেখা যায়। এখানে ভারতবর্ষের ধারণাকে ‘জাতীয়তাবাদী সচেতনতা উন্মেষের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। একটা সময়ে ভূগোলকে ‘ব্রিটিশ উপনিবেশের তথ্য সংগ্রহের জন্য হৃদয়ের কাছাকাছি’ একটি সমাজ-বিজ্ঞান হিসেবে দেখানো হয়েছে। বেইলি ইউরোপিয়ান এবং তিনি ‘ভূগোলের হিন্দু ধারণাকরণে’র স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করেন, এবং এই বৈপরীত্যের আলোতে তিনি ভারতবর্ষকে হিন্দুর ‘পবিত্র’ স্থানের প্রতিফল হিসেবে চরিত্রায়িত করেন। ম্যাথু এডনির দৃষ্টিতে ভারতের মানচিত্রকরণে প্রথম ‘একটি অবোধ্য দৃশ্যপটের (নিম্ন রেখা লেখকের) ভূমিকে জ্ঞানের সাম্রাজ্যে পরিণত করার একটি প্রবল বৌদ্ধিক প্রচার চালানো হয়... ভূগোলকারেরা কোম্পানির সাম্রাজ্যের স্থানিক গতিকে সৃষ্ট এবং সংজ্ঞায়িত করেন’। একই সঙ্গে এর আঞ্চলিক সংহতি ও মূলগত অস্তিত্বকেও সংজ্ঞায়িত করেন। এডনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান, এটি কোনো মূল্যবোধহীন স্থান ছিল না, যেভাবে ব্রিটিশদের ‘উপস্থাপিত ভারত’ তাদের ‘ভারত’কে নির্মাণ করেছিল। এটাই ছিল সেই ‘ব্রিটিশ ভারত’, যেটুকু তারা বুঝেছিল, বা শাসন করেছিল।
তাহলে উপনিবেশ-পূর্ব সময়ের কী হল? আপাতভাবে পূর্বোক্ত দুটি ধারণার মাঝামাঝি এর কোনো অবস্থান ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরফান হাবিব দৃঢ়তার সঙ্গে এক সত্যের পক্ষে সওয়াল করে যাচ্ছেন যে, ভারতবর্ষ শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান মাত্র ছিল না, এর নির্দিষ্ট সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও ছিল যা চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের ভারতবর্ষকে অভিহিত করে। এটাই তার অন্যান্য দেশগুলির থেকে স্বাতন্ত্র্য বোধক চিহ্ন। হাবিবের মতে আল বিরুণির ভারত-বোধের মধ্যে যে ‘সাংস্কৃতিক ঐক্যের’ কথা পাওয়া যায়, তার ভিত্তি এই ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা। একই সঙ্গে তা পারস্পরিক মত বিনিময় ও সমঝোতার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার দ্বারা দৃঢ় হয়। ‘জাতীয়তাবোধের কিছু পূর্ব ধারণা … ব্রিটিশ সাম্রাজ্য জয়ের সময় অধিগত হয়েছিল ১৭৫৭ সালে … ভারত শুধু একটি ভৌগোলিক প্রকাশ মাত্র ছিল না, এটির একটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিতি ছিল।
হাবিবের নিজস্ব অবস্থান অনুসরণ করে যদি এ বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করা হয় যে, তাহলে কেন এরকম একটি সংপৃক্ত ক্ষেত্রকে পরিণত জাতীয়তাবোধের জন্য ঔপনিবেশিক মধ্যস্থতার অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তখন একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় দেখা যায়, তা হল, ভারতবর্ষ বা India-র সমস্ত না হলেও বেশিরভাগ আলোচনায় nation অথবা
nationalism এর ইস্যুটি যে করে হোক ঢুকে পড়েছিল।
এই মিশ্রণের কারণটি বোঝা গেলেও তা অপরিহার্য ছিল না। ‘ভারতবর্ষ’ বিষয়ে এই লেখার সময়ে আমি ঐতিহাসিকভাবেই এর ধারণাকে বুঝতে চেয়েছি। ‘ভারতবর্ষের ধারণা’ বিভিন্ন প্রেক্ষিতে যে ভাবে নির্দেশিত হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে চেয়েছি। এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে আদি ভারতের যে সম্ভাব্য ধারণাটি ইতিহাস রচনায় নিহিত হয়ে আছে, তার স্বরূপ উদ্ভাবনের চেষ্টা করেছি।
‘জন’ থেকে ‘জনপদ’
‘ভারতবর্ষের’ এই ধারণাটিকে নানা বৈচিত্র্যময় উৎসের দিক থেকে বিচার করলে, একজনের অবশ্যই মনে রাখা উচিত, আদি কালে ‘ভারতবর্ষ’ নামটি, এমনকি ভৌগোলিক অর্থেও লিখিত ভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। যেটা পাওয়া যায়, তা হল ‘জন’—লোকসম্প্রদায় অর্থে। সেই সঙ্গে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে কোনো নদী বা এরকম কিছুর নাম, যার পাশে ‘জন’টি অবস্থিত। এই ভাবেই ঋগ্বেদে ‘ভারত’ নামটি অন্য অনেক ‘জন’র সঙ্গেই এসেছে। এগুলোর কোনোটাই নির্দিষ্ট অঞ্চলকে চিহ্নিত করে না। বৈদিক গ্রন্থগুলিতে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম স্থানিক দিকচিহ্ন হিসেবে কেন্দ্রীয় অঞ্চল বা ওই ধরনের কথাগুলি আসে। ‘জন’ যেখানে থাকে, সেই স্থানকে ‘জনপদ’ বা একটি ‘বাসদেশ’ হিসেবে প্রথম চিহ্নিত হতে দেখা যায় তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, সৎপথ ব্রাহ্মণ ও আরও এই ধরনের গ্রন্থে। এই অভিমুখের তাৎপর্য, এটি ‘জনপদের’ সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এটি দেখায় যে ‘জনপদগুলি’ কীভাবে অবস্থিত হওয়ার কথা ছিল। এই নিয়ে আমি পরে আলোচনা করব। এভাবেই ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বলা আছে আলাদা অঞ্চলের কথা, সেখানকার বাসিন্দা ও তাদের যারা শাসন করেছে তাদের কথা।এই অন্তর্ভূক্তি ইন্দ্রের মহাভিষেকে দেখা যায়। ‘...এই পূর্বাংশে (প্রাচ্যনম দিশি) রাজা যে-ই হোন, ‘প্রাচ্যনম রাজন্য’ই প্রভূত্বের জন্য নিযুক্ত।.... সেই জন্য দক্ষিণাংশে রাজা যে-ই হোন, ‘সতবন্ত’রাই (দক্ষিণশ্যাম দিশি) চূড়ান্ত শাসনের অধিকারী। পশ্চিমাংশে (প্রতীচ্যম দিশি) রাজা যে-ই হোন, দক্ষিণ ও পশ্চিমের মানুষ স্ব-শাসনের জন্য নিযুক্ত। উত্তরাংশে (উদীচ্যমান দিশি) হিমবাতের বাইরে উত্তরা কুরু, বা উত্তরা মাদ্রাজের জনপদ, তাদের রাজা সার্বভৌম শাসনের জন্য নিযুক্ত। ....এই নির্দিষ্ট মধ্যাংশে ( ধ্রুবয়ম/ মধ্যমায়ম/ প্রতিস্থায়ম দিশি) ভাসাস, উর্মি নায়াম, কুরি পাঞ্চালদের যে-ই হোন তাঁর নিযুক্তি রাজত্ব চালনার জন্যই।
বাস্তবের রাজাদের বিভিন্ন অভিমুখগুলির সম্মিলিত ফলে দেখা যায় ভগবান ইন্দ্রের দেবত্ব প্রাপ্তির নিরিখে ব্রাহ্মণের রচয়িতা দৃঢ় ভাবে দেখিয়েছেন জনপদগুলির সঙ্গে অন্যান্য অংশের তুলনায় পশ্চিমাংশের অধিক নৈকট্যের কথা। ব্রাহ্মণ্যবাদের পরবর্তী আলোচনায় বিভিন্ন জনপদের গঠনের ক্ষেত্রে মধ্যাঞ্চলই অন্য অংশগুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
একটি দেশ, বা পৃথিবীর একটি স্থানিক অঞ্চলের ধারণা, যা বিভিন্ন অভিমুখের জনপদগুলিকে নিয়ে গড়ে উঠেছে, তা এই প্রথমবার জম্বুদ্বীপ নাম নিয়ে বৌদ্ধ রচনাগুলিতে উঠে এসেছে। চারটি বৃহৎ দ্বীপের বা চারটি মহাদ্বীপের একটি—যা মাউন্ট সিনেরু পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটি কাক্কাভাত্তি নামে এক শাসক দ্বারা শাসিত। বস্তুত এই রচনাগুলি অনুযায়ী বুদ্ধ, কাক্কাভাত্তিরেয়া সবাই এই জম্বুদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মৈত্রেয় বুদ্ধ যখন আবির্ভূত হলেন, তখন এই দ্বীপের জনসংখ্যা যথেষ্টই ঘন, এবং এখানে তখন চুরাশি হাজার নগর ছিল। Dictionary of pali proper names গ্রন্থের রচয়িতা মালালাশেখরের মতে শিহালাদ্বীপ এবং তাম্বপান্নি দ্বীপকে আলাদা করে দেখলে ‘জম্বুদ্বীপ স্পষ্টভাবে ভারতীয় মহাদেশের ইঙ্গিত দেয়।’
আবার কেউ যদি অঙ্গুত্তারা-নিকারার সূত্র ধরে তাহলে প্রতি ‘কাকরাভালা’ বা দিগন্তে একটি করে জম্বুদ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যাবে, যা থেকে ভারতবর্ষ নামে একটি নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে জম্বুদ্বীপের ভৌগোলিক কোনো যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
এই দ্বৈততা সত্ত্বেও জম্বুদ্বীপের ধারণাটি বিদ্যমান ছিল এবং এটি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ব্রাহ্মণ্য ধারণার অংশও ছিল। কখনও মনে করা হত জম্বুদ্বীপের অংশ ছিল ভারতবর্ষ, কখনও ভাবা হত, জম্বুদ্বীপ ও ভারতবর্ষ সমার্থক। এই টার্মটি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মৌর্য শাসক অশোকের আমলে একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক স্থানের নির্দেশ-চিহ্ন (point of reference) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানে জম্বুদ্বীপ এমন একটি স্থান, “যেখানে ঈশ্বরেরা আগে মানুষের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন না; কিন্তু তাঁরা এখন তাঁদের সঙ্গে একাত্ম।” যে জম্বুদ্বীপ সম্রাট অশোক শাসন করেছিলেন, তার ভৌগোলিক অংশ আফগানিস্তান থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণাংশ বাদে বাকি অংশের বাইরের অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। জম্বুদ্বীপ, এই বৃহৎ বিশ্ব পরিবারের অংশ , যা অনেকগুলি দ্বীপের সমাবেশ, এবং এখানে একটি বাস্তবিক দেশের ধারণাও গড়ে উঠছে, যেখানে পরিচিত জনপদগুলির অস্তিত্ব আছে। ভারতবর্ষও এই বিস্তৃত বিশ্ব-ধারণার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। কিন্তু এই ধারণার যে স্পষ্ট সীমারেখা আমরা আগামীদিনে পাব তার মধ্যে সময়ের নিরিখে অনেকগুলি অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তার নির্দিষ্ট ভৌগোলিক চৌহদ্দির মধ্যে ‘ভারতবর্ষ’ নামটি আগে কোনো অর্থই
বহন করত না, আর এখন সেটি একটি অস্পষ্ট যোগসূত্র তৈরী করে।
এই শব্দার্থের বিবর্ধনের ঐতিহাসিক ধাপগুলি যদিও পরিষ্কার নয়। কলিঙ্গ অথবা উড়িষ্যা উপকূলের রাজা খারাভেলা, খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতকে তাঁর শেষ লেখায় দাবি করেছেন, তিনি ভারতবর্ষ জয় করতে গিয়েছিলেন তাঁর রাজত্বের দশম বছরে। এটি তাঁর অন্যতম অভিযান ছিল। স্পষ্টতঃ, কলিঙ্গের শাসনকালে তাকে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি। বস্তুত, পুরাণ রচনার সময়েই, ভারতবর্ষকে এই বিশ্বজনীন ধারণার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট দেশ হিসেবে উল্লেখ করা শুরু হয়। এটা সেই ধরনের লেখ্য প্রমাণ, যা আমাদের কাছে এই টার্মটি (ভারতবর্ষ) যে ভাবে বাহিত হয়ে আসে, সেভাবেই এই স্থান, ও সহযোগী পাত্রপাত্রীকে বুঝে নিতে হয়। যে বিশ্বজনীন তত্ত্বের ‘ভারতবর্ষ’ একটি অংশ, তা নানাবিধ পুরাণগুলিতে প্রায় একইরকম ভাবে পাওয়া যায়। কিছু এদিক ওদিক হয়ত আছেই। দিগ্বিজয়ী মহাভারতের বর্ণনাতেও প্রথমবারের জন্য এটি পাওয়া যায়। এখানে একজন প্রথমবারের জন্য ভারতবর্ষের পূর্ণ উন্নত ধারণা বা তার স্থানিক অংশগুলির সঙ্গে পরিচিত হন। পুরাণ গ্রন্থগুলি বিপুল কলেবরের। এগুলোর মধ্যেকার বস্তুগত বিষয়গুলি নিয়ে, পুরাণগুলিকে ধরে ধরে আলাদা আলাদা আলোচনা করা অর্থহীন। তাই আমি শুধু বিষ্ণুপুরাণের আলোচনাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখব। সত্যিকারের ভৌগোলিক স্থানটির ধারণার নিশ্চিতকরণ ও প্রসারণের জন্য আমি আর দু’টি গ্রন্থের সাহায্য নেব। কালিদাসের রঘুবংশম, এবং রাজশেখর প্রণীত দশম শতকের গ্রন্থ কাব্যমীমাংসা। এই গ্রন্থগুলি বৃহত্তর সময়ের আধারে দেখায়, পুরাণ-ধৃত তত্ত্ব বিভিন্ন গ্রন্থে কতটা এক ধাঁচের এবং এখানে উল্লেখিত একই বিবরণে কতটাই ভিন্নতা!
পুরাণ গ্রন্থসমূহে ভারতবর্ষ
বিষ্ণুপুরাণের বিসয়ণবস্তুতে ঢোকার আগে পুরাণের সাক্ষ্যপ্রমাণের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করা যেতে পারে। পুরাণে যা ভৌগোলিক বিবরণ হিসেবে চিত্রিত, তা ভারতবর্ষের প্রকৃত বিবরণের অংশ নয়। পুরাণে একটা প্রাসঙ্গিক অংশ ‘ভারতবর্ষ-বর্ণনম’ নামে উল্লিখিত। কিন্তু সেটাও মহাবিশ্বের অংশ হিসেবে চিত্রিত, এর সঙ্গে সৃষ্টিতত্ত্বের কাহিনীও জড়িত। বিস্তারিত বংশেতিহাসের আলোচনা দেখায়, বংশেতিহাস ও স্পেসের আবশ্যিক সম্পর্ক। দেখায় পৃথিবীর বৃহত্তরে বিভাজন, বিশ্বমাঝে ভারতবর্ষের অবস্থান। এটা ভূ মধ্যেকার সবধরনের বিভাজনের মূল্যায়নও বটে! তাই ভারতবর্ষকে তার ভৌগোলিক অবস্থানের জায়গা থেকে বিচার করার আগে একে এর নির্দিষ্ট অবস্থানের নিরিখে বিচার করতে হবে। তা না হলে নানা বিভ্রান্তির আশঙ্কা থেকে যায়। বিভিন্ন পুরাণে বর্ণনাগুলির মধ্যে পার্থক্য আছে। একেকটি পুরাণের ভেতরে স্ববিরোধিতাও প্রচুর। সব পুরাণ পারস্পরিক আপসে মীমাংসার যোগ্যও নয়। এসব ছাড়াও পুরাণই হল সেই গ্রন্থ যা, মহাভারত থেকে পৃথকভাবে ভারতবর্ষের একটি সামগ্রিক ধাঁচাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসের নিরিখে ‘ভারতবর্ষ’ সংক্রান্ত ধারণার সন্ধান করতে হলে পুরাণের সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করাই অধিকতর সমীচীন।
বিষ্ণু-পুরাণের দ্বিতীয় গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ভারতবর্ষকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এর নাম জগৎ-সৃষ্টি-সম্বন্ধ-ভরত-বংশ-কথনম (বিশ্ব সৃষ্টির যোগে ভরত বংশের কাহিনী)।এখানে ভরত-বংশ স্বয়ম্ভূ বংশের সঙ্গে পরিবর্তনীয়, কেননা বংশধারাটি শুরু হয়েছে স্বয়ম্ভূ মনুকে দিয়ে। এই বংশেতিহাসে মনুর সাতটি পুত্রসন্তান সাতটি দ্বীপের দায়িত্বপ্রাপ্ত (জম্বু, প্লক্ষ্য, শাল্মলী, ক্রৌঞ্চ, কুশ, শক ,পুষ্কর)। এগুলির সমন্বয় হল এই বসুন্ধরা। বিষ্ণু-পুরাণের ভরত-বংশ-কথনম জম্বুদ্বীপ-বর্ণনমের অনুসারী।এরই সূত্র ধরে এল ভারতবর্ষ-বর্ণনম। পরবর্তী সময়ে ষটদ্বীপ-বর্ণনমকেও অনুসরণ করা হয়েছে।
প্রিয়ব্রতর পুত্রা অগ্নিধ্র শাসক হয়ে জম্বুদ্বীপকে ন’টি ভাগে ভাগ করেছেন। এদের মধ্যে হিমবর্ষ, পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষ নভির দ্বারা শাসিত হয়। ঋষভের পুত্র ভরত এই বংশধারার বাহক এবং ‘এই দেশটি ভারত হিসেবে চিহ্নিত হয়, যখন ভরতকে তার পিতা ত্যাগ করেন...’। ভরতের পর এই বংশেতিহাস প্রবাহিত হয়, এবং ভারতবর্ষ নয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ‘এটি স্বয়ম্ভূ মনুর সৃষ্টি। তাঁর দ্বারাই পৃথিবীতে মনুষ্য সৃষ্টি হয়েছে, যখন তিনি প্রথম মন্বন্তর পরিচালনা করেন।
বিষ্ণুপুরাণের দ্বিতীয় পুস্তিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে বিশ্বলোকের বিবরণ বর্তমান এবং তৃতীয় অধ্যায় শুরু হচ্ছে এই চরণদুটি দিয়ে—
উত্তরম ইয়াৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেক্ষীয় দক্ষিণম
ভর্ষম তাদ ভারতম নাম ভারতী যাত্রা সান্তাতিহ
এর আক্ষরিক অনুবাদ এরকম—
এই বর্ষ যা সমুদ্রের উত্তরে, এবং তুষারাবৃত পর্বতের দক্ষিণে,
তাকেই বলে ভারত, এর সন্তানকে বলা হয় ভারতী।
উদ্ধৃত পংক্তিদ্বয়ে যে ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার সম্ভাব্য অর্থকে বিচার করলে এটা মনে রাখা দরকার এখানে যে অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে তা কঠোর ও সঠিকভাবে চিহ্নিত নয়। এর ভৌগোলিক ও ভূ-বিবরণগত বর্ণনায় যে পর্বত ও নদীসমূহের কথা উল্লিখিত সেগুলি ভারত নামে চিহ্নিত এবং অন্য বর্ষ ও দ্বীপসমূহ থেকে পৃথকীকৃত, এবং একটি ভৌগোলিক অর্থে দীপিত। এই পর্বতমালার প্রতিটি কূল-পর্বতের নাম হল—মহেন্দ্র, মলয়, সহ্য, সুক্তিমত, রক্ষ্য, বিন্ধ্য এবং পরিপত্র। এদের থেকে উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন নদীগুলি নানা দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
এটা হল সেই দিকনির্দেশেরই কথা, যা মধ্য ভাগ বা মধ্যদেশের সঙ্গে যুক্ত, এবং যা ভারতবর্ষ গঠনের কথা বলেছে। এই ভাবে ভারতবর্ষ যে ন’টি ভাগে বিভক্ত বলে উল্লিখিত, তার সবকটি আবার আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত। এই ‘দিক’ নির্দেশ করে—কত বিভিন্ন জনপদ থেকে কত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ ‘ভারতবর্ষে’ এসেছে। বিষ্ণুপুরাণ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা যায়ঃ-
“ ভারতের পূর্বদিকে কিরাতরা বাস করে.......পশ্চিমে যবনেরা, মধ্যে (মধ্যভাগম) ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য এবং শূদ্ররা ……যারা তাঁদের কাজ অনুযায়ী ( ত্যাগ, অস্ত্রধারণ, বাণিজ্য ও সেবা) বিভিন্ন স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন”।
এখানে ‘দিক’ কথাটি মধ্যাঞ্চলের কেন্দ্রিকতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেটা খুব ভৌগোলিক কারণে নয়, বরং পূর্ব-পশ্চিমের বৈপরীত্যের কথা বোঝাতে, যেমনটি উল্লিখিত আছে বিষ্ণু-পুরাণে বা অন্যান্য পুরাণে। এই কেন্দ্রিকতার ধারণাটি বাহিত হয়েছে, ‘জনপদ’গুলির ভৌগোলিক অবস্থান বোঝাতে।এই ভাবেই কুরু এবং পাঞ্চালিরা মধ্য দেশের অন্তর্গত, কামরূপেরা ‘পূর্ব-দেশদিকের’, সৌরাষ্ট্র এবং ‘অভীরা’ অপরান্তের (পশ্চিম)।
বিষ্ণু-পুরাণে ‘ভারতবর্ষ’ বিষয়টা চারটি অধ্যায়ে বিধৃত।( অন্য পুরাণগুলিতেও এটি অনেক সময় বিস্তারে উপস্থাপিত)। এটি এসেছে ভূ-বিবরণের অংশ হিসেবেই। এই উপস্থাপনার বৈশিষ্ট্য হিসেবে নানা কথাই যেন উঠে এসেছে। প্রথমতঃ ‘ভারতবর্ষ’ স্পষ্টভাবেই এক বৃহৎ নকশার একটি অংশ। পদ্ধতিগতভাবে এর একেকটি অংশ সুনির্দিষ্টভাবে একেকটি ভৌগোলিক বাস্তবতার কথা বলে। একই সঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ গঠনের যে ভৌগোলিকতা ও সাংস্কৃতিক লক্ষণের কথা আমরা শুনি, তা পুরাণকারদের নির্মাণ। এই ভাবেই ‘ভারতবর্ষের’ রূপদানের ক্ষেত্রে প্রথমে চারটি অঞ্চল ও একটি কেন্দ্রাঞ্চলে বিভক্ত ক্ষেত্রর কথা ভাবা হয়েছে, পরে তা সাত কিংবা ন’টি ক্ষেত্রে বিভক্ত হয়েছে। এর ফলে এর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলি পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ অনুযায়ী আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়েছে।এই সব পুরাণ গ্রন্থসমূহ থেকে পাওয়া ভৌগোলিক জ্ঞান অনেক সময়ই অন্য সূত্রের সঙ্গে মেলে না। এভাবেই পুণ্ড্র, কলিঙ্গ, এবং মগধ—সবই বিষ্ণুপুরাণে একত্রিত হয়ে গেছে দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে। এবং এই তালিকা পশ্চিমাঞ্চলের (অপরান্ত) মধ্যেই কোনো সূত্র ছাড়াই উত্তরদিকের সাকালাভাসিন, সালভা, মদ্র, হুন, সৈন্দব ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এভাবেই পুরোনো গ্রন্থগুলিতে ভারতীয় ইতিহাসের নিরিখে দেখা যায়, এগুলিতে ভারতবর্ষের বিবরণ তার আনুপূর্বিক বিস্তারকে গুরুত্ব দেয় নি। ভারতবর্ষের সামগ্রিক গঠন এবং যে ভাবে এটা ভূবিবরণগত ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়েছে। তাকেই গুরুত্ব দিয়েছে, যেটা বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল। দ্বিতীয়ত পুরাণগুলিতে ভারতবর্ষের যে বর্ণনা রয়েছে তা অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত বংশেতিহাসের বিস্তৃত বিবরণের সঙ্গে, যা এই বিশ্বচরাচরের নকশাকে নানা স্তরে ধরে রেখেছে। মনুর সন্তানদের মধ্যে দিয়ে যার শুরু, এবং সাতটি সন্তানের মধ্যে আদি বিভাজন এখানে প্রকাশিত। তাই বিষ্ণুপুরাণের ভারতবর্ষের বর্ণনায় ‘ভারতী-সন্ততি’ বলতে, ভরতের সন্তানসমূহ না বুঝে, তাকে ভরতের বংশলতিকার সন্তানসমূহ হিসেবে গ্রহণ করাই সমীচীন। এই ভাবধারাটি সমান্তরালভাবে প্রকাশিত হয়েছে বায়ুপুরাণে।
তইর= ইদম ভারতম বর্ষম নব ভগাইর অলমক্রিতম
তেসম বংশ প্রসূতিয়াস = কা ভুক্তয়ম ভারতী পুরা।।
তৃতীয়ত জম্বুদ্বীপের অন্যান্য ভার্ষার মধ্যে ভারতবর্ষ শব্দটির অর্থ এর ভৌগোলিক অর্থকে ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এভাবেই ভার্ষাগুলিতে বিপর্যয়, বৃদ্ধত্বপ্রাপ্তি, ধর্ম, অধর্ম, উচ্চ, নীচ, যুগ-বিভাজন কোনো কিছুই ছিল না। ভারতবর্ষ বিভিন্ন যুগ অতিক্রম করেছে। এই ক্ষেত্রে কর্মা সক্রিয় ছিল, বর্ণ চর্চার মধ্যে দিয়ে তা চরিত্রায়িত হয়েছে। অন্যান্য ভার্ষাগুলি হল ভোগভূমি, যদিও কর্মভূমি হিসেবেই তা উঠে এসেছে। ভারতবর্ষ অন্যান্য ভার্ষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভার্ষার পৌরাণিক প্রক্ষেপণ শাসকদের বংশেতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। এটি সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রের সঙ্গে মাত্রাগত ভাবে যুক্ত, অথবা হতে পারে সার্বভৌমত্বের স্বপ্ন দেখা হয়েছে। ‘দিগ্বিজয়’ ধারণা দিয়ে এই তত্ত্বকে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এখন আমরা ‘ভারতবর্ষ’ শব্দটি অন্য কী অন্তর্গত অর্থের দিকে যেতে পারে, সেই খোঁজে যাত্রা করতে পারি। ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা রঘুর দিগজিগীষা বা ক্ষেত্রবিজয়ের ধারণা দিয়ে এটা ধরা যেতে পারে। এটি বিশেষভাবে কালিদাসের বংশেতিহাসের কাব্য ‘রঘুবংশম’এ চিত্রিত হয়েছে।
ক্ষেত্রবিজয় (দিগজিগীষা)
কালিদাসের বর্ণনা অনুযায়ী রঘুর বিজয়যাত্রা শুরু হয় পূর্ব ( প্রাচী ) থেকে। ক্রমশঃ এই দিক থেকে সে সমুদ্র উপকূলে এসে পৌঁছায়, যা তালবনবীথিকায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। এখানেই নৌ-বহরসহ বঙ্গীয় রাজকুমার সুমার মুখোমুখি হয়। কপিশা নদী পার হয়ে সে উৎকলের দিকে যায়। আরও এগিয়ে সে মহেন্দ্র পর্বতমালা পেরিয়ে কলিঙ্গদের পরাজিত করে। সমুদ্র উপকূল ধরে সেনাবাহিনী দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়, এরপরে তারা কাবেরী নদীর তীর ধরে মলয় পর্বতের কাছে গিয়ে পৌঁছোয়। এখানে অন্য যে উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির কথা বলা হয়েছে তা হল, তাম্রপানি নদী এবং সমুদ্র, যা কী না ‘এই অঞ্চলের স্তনযুগলের মতো’ (দিশাস্তস্বা)।সেখান থেকে আরও এগিয়ে রঘু যায় সহ্যা পর্বতে। অপরান্ত অধীনস্থ স্থান এবং কেরল ছাড়াও রঘুর লক্ষ্য ছিল ত্রিকূট যেখন থেকে স্থলপথে ( স্থল-বর্তমান) পারসিকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এই প্রসঙ্গেই যবনদের কথা উল্লেখিত। পশ্চিমী জনগণের সঙ্গে রঘুর তীব্র সংঘাত হয়। একজন সুদক্ষ অশ্বারোহী হিসেবে এর পরিণতি হয়—
“সে ভল্ল দিয়ে দাড়িওয়ালা মাথাগুলো আলাদা করে মাটিতে ছড়িয়ে দিল, ঠিক যেভাবে মৌমাছি চাক ঢেকে রাখে। বাকিরা নিজেদের শিরস্ত্রাণ খুলে তার শরণাপন্ন হল”।
রঘুর উত্তরমুখী যাত্রা (উদিচ্যী), যার ক্ষেত্রপ্রধান ছিলেন কুবের, তাকে হুনদের এবং কম্বোজদের বিরোধী করে তোলে। তার উত্তরমুখী যাত্রা তাকে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালা ও গঙ্গার উৎসস্থলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে তার সঙ্গে কিরাত এবং অন্যান্য পার্বত্য উপজাতিদের লড়াই হয়। কৈলাস পর্বত এবং লাউটিয়া নদী পেরিয়ে রঘু প্রাগজ্যোতিষ এবং কামরূপের রাজধানীতে এসে পৌঁছোয়, তাদের অধীনতা স্বীকারের পর রঘুর ক্ষেত্রবিজয় শেষ হয়, ‘বিশ্বজিত’ হবার বাসনাত্যাগের শুরুও বলা যায়। রঘুর এই ‘দিস’ জয় ও ত্যাগের মধ্যে দিয়ে তার সার্বভৌম শাসকের খেতাবপ্রাপ্তি সম্পন্ন হয়, যা কি না সব জিগীষু শাসকেরই চরম সাধ।
‘রঘুবংশম’এর যে প্রাসঙ্গিকতার প্রতি আমরা নজর দিয়েছি, তা হল, এই চারটি ‘দিসের’ মধ্যে দিয়ে যে ভৌগোলিক ক্ষেত্রের কথা উঠে এসেছে, যেখানে এক প্রাচীন রাজা অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্বের স্বপ্ন দেখেছে, এর ভাবটুকু আরেকটা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, তা হল, ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’। যাই হোক, সম্পূর্ণ ‘ভৌগোলিক’ দৃষ্টিকোণ থেকে যা আমাদের নজর কাড়ে তা হল—ভিন্ন গোষ্ঠী, প্রাকৃতিক ক্ষেত্রস্তম্ভ, তার গাছপালা-ভূপ্রকৃতি সবই শেষ পর্যন্ত চারটে ‘দিস’কে একই সূত্রে গ্রথিত করে, হতে পারে উপাদান গুলো আলাদা আলাদা।
রঘুবংশমের এই সূত্র নির্দেশ আমাদের ভারতবর্ষের কাঠামো সম্পর্কে কোনো অর্থপূর্ণ ধারণা দেয় না। যদিও ক্ষেত্রধারণার চাবিকাঠিটি একই। কালিদাস কট্টর ভাবে নিখুঁত কোনো ভৌগোলিক ধারণার কথা বলেন নি, কিন্তু নির্দিষ্ট বিন্যাসকে ব্যবহার করে একটি সার্বভৌম অঞ্চলকে চিহ্নিত করতে তা সাহায্য করে। একজন সহজেই কিছু অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। কলিঙ্গের পরেই দক্ষিণাংশের কথা এসেছে, কেরালা এসেছে সহ্যের পর। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কথা মলয়ের প্রসঙ্গ ছাড়াই এসেছে। কামরুপের প্রাগজ্যোতিষের থেকে পৃথকীকরণ এবং তার আরোপিত অঞ্চল রঘুর উদীচ্যার বিস্তৃত অভিযানের প্রসঙ্গেই এসেছে।
কালিদাস রঘুর ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়েই বেশি আগ্রহী ছিলেন, সেই প্রসঙ্গেই চারটে ক্ষেত্রের কথা এসেছে, ভৌগোলিক যাথার্থ্যের কথা পরে। বস্তুত এই ‘দিস’ ব্যবহার করে, পূর্বদিক থেকে ভ্রমণবৃত্তান্ত শুরু এবং প্রাগজ্যোতিষ ও কামরূপ দিয়ে শেষ করে কালিদাস একজন স্বাধীন শাসকের যাত্রার বৃত্তীয় পূর্ণতার কথা বলতে চেয়েছেন। ‘রঘুবংশম’এ চারটি দিকের ভৌগোলিক ধারণা ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানকার প্রধান ভৌগোলিক ক্ষেত্রগুলি (সমুদ্র, পর্বত, নদী ) এবং তার সূত্রে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের কথা এখানে আছে। ‘রঘুবংশম’এর আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য—এখানে নির্দিষ্ট স্থানের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্যের পরিচিতি আছে। স্থানভেদে অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্যের কথাও বলা আছে যা কিনা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরে। কালিদাসের ব্যবহৃত উপাদানের তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা আবার আলোচিত হবে, যখন আমরা ‘ভারতবর্ষের’ ধারণাটিকে একত্রে গুছিয়ে আনব।
এখন আমরা নবম-দশম শতকের একটি রচনার কথা বলব, যেখানে এক একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গের কথা এসেছে। কিন্তু সেখানেও ‘ ভারতবর্ষের’ আদি ধারণাটি ব্যক্ত হয়েছে। ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’ অর্থাৎ ‘ বিরামহীন গতিশীলের ক্ষেত্র’ হিসেবে যা সম্পর্কায়িত।
রাজশেখরের কাব্যমীমাংসাঃ
একটি সংশ্লেষণের (synthesis) অনুশীলন?
পুরাণে ভারতবর্ষের ধারণা দেওয়া আছে, বিবিধ গোষ্ঠী ও জনপদের মিলনস্থল হিসেবে। কালিদাস ‘ভারতবর্ষ’ কথাটি ব্যবহার না করে চারটি ক্ষেত্রের বিজয়-বিবরণ দিয়েছেন, যা ক্রমশঃ ক্ষেত্রগুলির একীকরণের দিকে এগিয়েছে। আলাদা আলাদা রচনায় সেগুলি আলাদা ভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’য় দেশ বিভাগের প্রসঙ্গটি এল। ‘জগৎ’(universe) এবং ভূবন(world) কাকে বলে, এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করে — ১) পুরো জগৎ অথবা ভূবনের একটা অংশ হল দেশ এবং ২) দেশ কাল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কবি ‘অর্থ-দারিদ্র্য’কে প্রকাশ করতে চাননি। এই দেশ প্রসঙ্গে আলোচনায় রাজশেখর ভারতবর্ষকে চিহ্নিত করেছেন, বহু ‘ভূবনে’র অস্তিত্বের কথা বলেছেন, ‘ভ্যূলোক’ বলতে ‘পৃথ্বী’র কথা বলেছেন, যেখানে সাতটা দ্বীপ আছে। নানা মতের উল্লেখ করলেও রাজশেখর ‘ভারতবর্ষে’র পুরাণ-বর্ণিত কাঠামোকেই ব্যবহার করেছেন। বিশেষত বায়ুপুরাণে এটি বিস্তারিতভাবে আছে। রাজশেখরও ভারতবর্ষকে ন’টি অংশে ভাগ করেছেন। তিনি বিভিন্ন জনপদকে গোষ্ঠীভিত্তিক ক্ষেত্র হিসেবে সাজিয়েছেন। যেটা তাৎপর্যপূর্ণ, রাজশেখর একেকটি ক্ষেত্রকে তাদের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। তার কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি চিহ্নিত হয়েছে আর্যাবর্ত নামে, যা মধ্যদেশের সমার্থক। ভৌগোলিকভাবে যা, পূর্ব ও পশ্চিম সাগরের হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী অংশ।
আর্যাবর্তের নিরিখে রাজশেখরের লক্ষ্য, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের সূচনাকে নির্দিষ্ট করা। এতে অধিক্রমণ (overlaps) অনিবার্য, বিশেষতঃ রাজশেখর যখন ‘দিকে’র বিভাজনের কথা বলেন। কোনো কোনো চিন্তকের কাছে এটা নড়বড়ে মনে হতে পারে, তবে ‘অন্তর্ভেদী’ থেকে কন্যাকুব্জ (কনৌজ)এর ধারণা দ্রাঘিমা রেখার মতো কিছুর কথাই বলে। আর্যাবর্ত এবং অন্তর্ভেদী (গঙ্গা-যমুনার মধবর্তী অঞ্চল) উভয়কেই মৌলিক দিকনির্দেশের জন্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই ভাবে আর্যাবর্ত যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম সাগর, হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তেমনই রাজশেখরের মতানুযায়ী, বারাণসী পূর্ব থেকে পূর্বদেশের শুরু। ‘দেবসভা’ থেকে পশ্চাৎদেশের(পশ্চিমদেশ) শুরু। ‘দক্ষিণাপথ’ মহিশমতি এবং উত্তরাঞ্চল প্রুদাকা থেকে শুরু।
ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও রাজশেখরের লক্ষ্য হল ‘ক্ষেত্র’র (‘দিশ’ দিক) কাঠামোকে বর্ণনা করা, তাদের প্রকৃত ভৌগোলিক অবস্থান থেকে। (যেমন বারানসী, মহিশমতি, প্রুদাকা ইত্যাদি)। এভাবেই এই অবস্থানকে ক্ষেত্রর সংজ্ঞা নির্ধারণের উপাদান হিসেবে গুরুত্ব আরোপ করা হল।
পৃথক ক্ষেত্রের কাঠামো নিয়ে রাজশেখরের বিস্তৃত আলোচনায়, একজন তিনটি প্রধান পৌরাণিক উপাদান লক্ষ্য করতে পারবেন। জনপদের সংখ্যা, ক্ষেত্র’র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পর্বতমালার সংখ্যা, এবং তা থেকে উৎসারিত নদীর সংখ্যা—এটা হল একটা ধাঁচা, যা প্রত্যাশিত বৈচিত্রসহ সব ‘দিস’য়েই বিদ্যমান। রাজশেখর যেটা অতিরিক্ত করেছেন, কালিদাসীয় ভঙ্গীতে, প্রাকৃতিক উপাদানের তালিকা তৈরী করেছেন, যা একেকটি ক্ষেত্রর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, উত্তরাপথে, এর গোষ্ঠীসমূহ ছাড়াও একে বর্ণিত করা হয়েছে এর উৎপাদিত সামগ্রীর দ্বারা। সরলা, দেবদারু, আঙুর, জাফরানি, কামরাঙা ইত্যাদি গাছ দিয়ে। মৃগচর্ম, সৈন্ধব লবণ, সৌধীরা, স্রতঞ্জনা,বৈদূর্য ও তুরঙ্গ। এই তালিকা যে খুব সুসংহত বা সঠিক, তা না ও হতে পারে, কিন্তু একেকটি ক্ষেত্রকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার পক্ষে যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে রাজশেখর নিয়ে আসেন ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’র ধারা। এটা তিনি জম্বুদ্বীপ, ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষের চারটি বিভাগ—ইত্যাদি আলোচনা প্রসঙ্গে এনেছেন। রাজশেখরের মত অনুযায়ী ‘চক্রবর্তী ক্ষেত্র’র প্রসার কুমারীপুরা থেকে বিন্দুসরোবর পর্যন্ত। এর সহস্রযোজন বিস্তার ভূগোলের নিরিখে পরিমেয় নয়। এর তাৎপর্য ভারতবর্ষের স্থানিক ধারণার সঙ্গে যুক্ত।
রাজশেখরের ক্ষেত্র বিভাজনের ধারণার আরও অনেক মাত্রা আছে, যা এই প্রসঙ্গে আলোচ্য নয়। যা রাজশেখরের লক্ষ্য ছিল, তা হল ‘ভারতবর্ষে’র রুপরেখা স্থির করতে পুরাণের উপাদানগুলিকে সংক্ষিপ্তকরণ করা, এমনভাবে যাতে সেখানে পুরাণের উপাদান আছে, তবে তা বংশগত যোগাযোগের বিষয়টি কর্তিতভাবে উপস্থাপিত। ভবিষ্যত রচয়িতাদের ক্ষেত্রে এই নকশা উপযোগী হয়েছে হয়ত।
ভারতবর্ষের অর্থ
ভারতবর্ষের বিস্তারিত বিবরণ তিনটি সময়ানুক্রমিক রচনায় এসেছে, তাতে এটা বোঝা যায়, এই সব রচনার রচনার রচয়িতারা কিভাবে ভারতবর্ষকে গ্রহণ করেছেন, এবং কিভাবে ভারতবর্ষ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি প্রকাশিত হয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, ভারতবর্ষ এক সুসংজ্ঞায়িত ভৌগোলিক অংশ হিসেবে তাদের কাছে ধরা দেয় নি। প্রথম দিকের ‘ভারতবর্ষ’ যেভাবে তাদের রচনায় এসেছে, তা পরবর্তী ‘ভারতবর্ষের’ অংশমাত্র। সেই ‘ভারতবর্ষ’ কুরু, কৌশল, মগধ, বৎস, এবং অন্যান্য জনপদের সূত্রেই এসেছে।
বস্তুত ‘ভারতবর্ষ’ নয়, ‘জনপদ’—এই শব্দবন্ধটির মধ্যে দিয়েই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে অভিহিত করা হত। এর পরে ভিন্ন ভিন্ন জনপদের নানা স্থানিক-সামাজিক উপাদানগুলি একত্রিত হয়ে ‘ভারতবর্ষ’—এই শব্দটির অর্থপ্রসারণ ঘটে। তবে অঞ্চলগুলি মধ্যাঞ্চলের নিরিখে বিভিন্ন ‘দিস’এ প্রসার লাভ করে।
‘দিসের’ মূল ভাবনার ওপর নির্ভর করে ‘ভারতবর্ষের’ ধারণা একটি ‘দেশের’ ধারণা হিসেবে উন্নীত হয়। ‘দেশ’¬—এই ‘দিস’ শব্দ থেকেই এসেছে। যদিও এই ‘দেশ’ সীমামুক্ত। ভৌগোলিকভাবে সীমায়িত কোনো ধারণা নয়। পুরাণে দেখা যায়, হিমবাত এবং সমুদ্রের মধ্যে বিরাজমান ‘বর্ষ’ই ‘ভারতবর্ষ’কে ভৌগোলিক আদল দিতে চেয়েছে, কিন্তু জনপদগুলির নানা গোষ্ঠী কখনই এ ধরনের কোনো সীমাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাজশেখরের উত্তরাপথ প্রুদাকা (আধুনিক হরিয়ানা) ছাড়িয়ে যার শুরু, সেখানে শক, কৈকেয়, বোক্কানা, হুন, বানায়ুজ, কম্বোজ, লিম্পক তানজানা, তুরস্ক, তুষার এবং আরও অনেক স্থানের কথা এসেছে। অবশ্য ‘দিস’এর ধারণা ভৌগোলিক নয়, একটি আধারাকৃতি ধারণা। সেখানে কোনো দৃঢ় সীমার কথা বলা নেই, যদিও জমি হস্তান্তরের প্রসঙ্গে জমির সীমা বা মর্যাদার কথা এখানে অনেকবারই এসেছে। একইরকমভাবে সিংহল বা শ্রীলঙ্কা দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত, এই তথ্য রাজশেখরের লেখায় বা অন্যান্য সূত্রে আছে। অন্যান্য রচনা থেকেও এরকম আরও অনেক উদাহরণ টানা যায়। এই সূত্রে বলা যায়, অতীতে ‘ভারতবর্ষ’ নামে কোনো নির্দিষ্ট, দৃঢ়ভাবে সংজ্ঞায়িত দেশের কথা পাওয়া যায় না, যেখানকার মানুষরা সেই ‘দেশবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
এরপর ‘ভারতবর্ষ’ এক মুক্তসীমা অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হয়, যা এতক্ষণ আলোচিত হয়েছে। এটি পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্ব বা বিশ্ববীক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিভাত। একটি রাজ-বংশ সৃষ্টির কাহিনী এখানে গ্রথিত (ভরত বংশ যার একটি অংশ)। একই সঙ্গে ‘ভারতবর্ষে’র ধারণা কোনো স্থবির ধারণা নয়। পুরাণে ভারতবর্ষের গঠনগত ক্ষেত্রের ধারণা পাওয়া যায়। তার পাহাড়, নদী ইত্যাদির বর্ণনা। অপরদিকে কালিদাসের রচনায় পাওয়া যায়, স্থানীয় জীবনযাপন, সম্পদের বৈচিত্র্য ইত্যাদি। রাজশেখরের রচনায় ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে, তার ‘দেশ পরিচয়’ অধ্যায়ে। সময়ের সঙ্গে ভৌগোলিক জ্ঞানের বৃদ্ধি, নদী, পর্বত অঞ্চলের নির্দিষ্টকরণ সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের ধারণাটি পুষ্ট হয়েছে। সময়ানুক্রমিক সাক্ষ্যের মধ্যে দিয়ে গেলে একজন জন থেকে জনপদ, জনপদ থেকে বর্ষ, বর্ষ থেকে দেশ—এই ধারণার ক্রমবিকাশ প্রত্যক্ষ করতে পারে।
‘ভারতবর্ষে’ কোনো ‘পবিত্র স্থান’ ছিল না, ছিল না ‘an incomprehensible spectacle’ যেমনটা Edney বলেছেন। কর্মার নীতি অনুযায়ী শাসিত জম্বুদ্বীপের ‘বর্ষ’র ধারণার মধ্যে থেকেও ভারতবর্ষের ধারণাটি উঠে আসতে পারে। এটা হল সেই স্থান, যেখানকার বাসিন্দারা চারটি অংশে বিভক্ত ছিল( চতুর্বিধা)। অথবা চারটি বর্গ। এটা ‘দিসে’র ধারণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা সেটা ছিল কেন্দ্রীয় অঞ্চল (মধ্যদেশ, অথবা আর্যাবর্ত , যা আদর্শ (মডেল) হিসেবে ছিল। রাজশেখর যেভাবে বলেছেন —‘এর চতুর্বর্ণ এবং চতুরাশ্রমের শৃঙ্খলা রয়েছে। সেটাই সু-আচরণের শিকড়’।
আর্যাবর্তের নৈকট্য বা দূরত্ব ছিল এই মডেলের প্রতি আনুগত্যের পরিমাপক। আর্যাবর্তের বাইরের জাতিগোষ্ঠীকে মনু চিহ্নিত করেছেন ‘ম্লেচ্ছ’ বলে।
অতএব, ভারতবর্ষ, একটি কেন্দ্রীয় ক্ষেত্র ও চারটি (পরে সেটা সাতটি বা নয়টি) প্রান্তীয় ক্ষেত্র নিয়ে বিরাজিত ছিল। এগুলিতে নানা ধরনের ‘জনপদ’ থাকত। নিজেদের জনপদ অনুযায়ী এই মানবগোষ্ঠীগুলির স্বাভিজ্ঞান চিহ্নিত হত। ‘এরা ভারতবর্ষের মানুষ’ এভাবে চিহ্নিত হত না। একজন ব্যক্তি নিজেকে ঘোষণা করতেন, আমি মগধ, কোশল, দ্রাবিড়, কঙ্কণ বা অবন্তীর; অথবা গান্ধার কুরু বা মদ্র থেকে আসছি, কিন্তু কেউই বলতেন না — আমি ভারতবর্ষ থেকে আসছি। এই জন্যই তার জনপদ ছাড়া ‘ভারতবর্ষ’ কথাটা সেভাবে কোনো অর্থ বহন করত না। তাই ভারতবর্ষ আমাদের প্রথম দিকের জাতীয় সচেতনতার ক্ষেত্র ছিল কিনা; হয় সম্পূর্ণ অঙ্কুরিত বা সদা-অঙ্কুরিত বৈচিত্র্য হিসাবে, এ প্রশ্নটাই অপ্রাসঙ্গিক। ‘ভারতবর্ষে’র ধারণার সঙ্গে ‘স্বদেশ’ বা ‘বিদেশ’ শব্দগুলির কোনো প্রাসঙ্গিক যোগ নেই। সুতরাং ‘ভারতবর্ষের’ আদি ধারণা ভারতীয় জাতীয়তাবোধের কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আলোচ্য বা অনুধাবনযোগ্য। তাই ‘সীমা (border)’, ‘সীমান্ত (frontier)’, ‘বিদেশী (foreigner)’ এই শব্দগুলোর ধারণা ‘ভারতবর্ষ’ শব্দব্যঞ্জনায় অপ্রাসঙ্গিক।
যদিও প্রথমদিকের তথ্যসূত্রগুলিতে বারংবার ‘বিদেশী’,‘বিদেশী অনুপ্রবেশ’ ও হানাদারির সামাজিক-রাজনৈতিক কুফলের কথাই বলা আছে, ভারতীয় সমাজে গভীর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে এই বিদেশী আক্রমণকারী দলগুলি সাঙ্ঘাতিক এক অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিল; এমন ধারণা কিন্তু ভারতবর্ষ এবং ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে পুরাকালের ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে মানানসই নয়।
কোনো বহিরাক্রমণ একজনকে অন্যদের থেকে আলাদা করেনি, ভারতের সমাজে প্রধান বিভাজন ঘটিয়েছে বর্ণ। এটা ঘরে, বাইরে সব ধরনের পার্থক্য ঘটানর মুলে।
যেভাবে India ও ভারতবর্ষের রূপরেখা ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে তৈরী হয়েছে, সেখানে পূর্বতন ধারণা অনেকটাই সরে এসে একটা সুগঠিত, মানচিত্রায়নযোগ্য, সংহত অঞ্চলের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। যা ছিল একটা মুক্তসীমা অঞ্চলের ধারণা, তা হল সীমায়িত, প্রশাসনিক ভাবে সংজ্ঞায়িত এক দেশ। স্থানিক অংশ, ইতিহাসের নির্দিষ্ট স্থান হিসেবে চিহ্নিত হল, যা আগে ছিল না। এই ধারণার মধ্যেই লুকিয়ে আছে, ‘বিদেশী’, বৈদেশিক আগ্রাসন’, ‘অন্ধকার যুগ’ এই সব শব্দগুলি। অতীতের বিরাট অংশের ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে এই একই রকম পূর্বাভাস প্রবেশ করেছে।
এই নবরূপে সীমায়িত ভারতবর্ষ শুধুমাত্র একমাত্রিক ঐতিহাসিক আখ্যানের ক্ষেত্র হিসেবেই চিহ্নিত হল না, এটা অনেক ইচ্ছুকদের কাছে অচেতনভাবে কালানৌচিত্যের শিকার হল। তৈরী হল ভারতীয় জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা। এইভাবে একজন সহজেই বুঝতে পারে, রাজনৈতিক একীকরণ, বিকেন্দ্রীকরণ ও অনৈক্যের ভাবনা, কিভাবে আমাদের সহজে অর্থোদ্ধারযোগ্য ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের ওপর চাপ তৈরী করে।
ভারতবর্ষের উপনিবেশ-পূর্ব অতীতের কালগত বিভাজন ‘হিন্দু’, ‘মুসলিম’—এই দুই ভাবে খোদিত হয়ে রইল, যা আজও নির্মূল হয় নি। এটা ভারতীয় চিন্তাধারার অতীতের সম্পর্কে এক নতুন প্রেক্ষাপট তৈরী করল, যা আগে ছিল না। এটা হিন্দু শাসন ও মুসলিম শাসনের মধ্যবর্তী প্রক্ষেপণের পরিসরটুকু মুছে ফেলল। রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ এক জাতির থেকে আরেক জাতির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকল। এটা, বোঝাই যায়, ‘ভারতবর্ষ বা India’ গঠনের এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, নারকীয় অপচেষ্টা। অতীতের ভারতবর্ষ অনেক ধরনের পরিসর, নানান সামাজিক বৈশিষ্ট্য ও আদর্শকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখত।
ঔপনিবেশিক পর্বে সৃষ্ট India-র ধারণা ‘ভারতবর্ষ’র অভিজ্ঞানে চিহ্নিত হয়ে একটি দায় তৈরী করল, যা বাধ্য করল এক নব্য জাতীয়তাবাদের যুগের দিকে আমাদের নিয়ে যেতে, এবং সম্ভবত তাকে গৌরবান্বিত করে তুলতে।
এক কথায়
এবারে ‘ভারতবর্ষের’ ধারণা সম্পর্কে আমি আমার উপসংহারীয় বক্তব্য পেশ করতে চেষ্টা করব, অন্য একটি প্রামাণ্যের কথা উল্লেখ করে, তা হল লিপি। লিপিকে ঐতিহাসিকরা অতীত সম্পর্কে জ্ঞানের নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে মান্যতা দিয়েছেন। মোটামুটি দশম থেকে চতুর্দশ শতকের সময়কালকে চূড়ান্ত করার জন্য লিপিগুলি নির্বাচিত হয়েছে। এই কালখণ্ডের বিস্তারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেন না, এটা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের একত্রীকরণের চরম কালপর্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
মর্জিমাফিক এই লিপিগুলিকে বাছাই করলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট এলাকা, অঞ্চল বা স্থানকেন্দ্র অসমরূপে অন্যগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এবং মূল ‘ভারতবর্ষে’র ধারণাটিকে নির্মাণ করেছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। উত্তর কর্ণাটকের রাষ্ট্রকূট লিপি (৯২৯-৩০) থেকে পুরিকারা নামে একটি জনপদের কথা জানা যাচ্ছে। এটি ভারতমহিমামণ্ডলের অলঙ্কার হিসেবে বর্ণিত। ভারতমহিমামণ্ডল একটি ছোট্ট অঞ্চল হিসেবে নির্দেশিত। এটা বিভিন্ন সূত্রের উদ্ভব ও তার প্রয়োজনীয় নিয়মতান্ত্রিকতাকে নির্দেশ করে। কর্ণাটকের বেলারি জেলার কুরগদ-এর দ্বাদশ শতকীয় লিপি থেকে জানা যায় (AD 1181) কুন্তলার দেশের কথা, যা ভারত-ক্ষেত্রে অবস্থিত। এটা জম্বুদ্বীপের অংশ, যা গভীর সমুদ্র-বেষ্টিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ও চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অন্ধ্রের পূর্ব গোদাবরী জেলার পিথাপুরম অঞ্চলের কিছু লিপি থেকে জানা যায়, দক্ষিণ সমুদ্র থেকে পর্বতরাজ হিমালয় পর্যন্ত যে ভূমি প্রসারিত, তা-ই ভারতবর্ষ। অন্ধ্র সেখানেই অবস্থিত, যাকে বলা হত ত্রিলিঙ্গ ভূমি। এই তিনটি লিঙ্গ (shrines) দ্বারা অভিহিত শ্রীশৈল, কালেশ্বর, এবং দ্রাক্ষর্মা.....এখানে পাঁচটি বাগানের নাম দক্ষ, অমর, ক্ষীর, কুমার এবং প্রাচ্য। শিবের ক্রীড়া ক্ষেত্র এবং পবিত্র নদী হিসেবে নাম আছে গৌতমী, কৃষ্ণবেণী, মালপ্রভা, ভীমারথি এবং তুঙ্গভদ্রার। কৃষ্ণা নদীর তীরে শ্রীকাকুলা, বিষ্ণুর বাসস্থান। তিনি ত্রি-জগৎকে রক্ষা করেন। বোঝা যায়, মহাকাব্য-পুরাণে ভারতবর্ষের যে ধারণা উচ্চারিত হয়, তা স্থানিক ভাবে উদ্ভূত অঞ্চলবিন্যাসের এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রের কথাই বলে। এটাই সার্বিকভাবে স্বীকৃত মহাবৌদ্ধিক ধারণাকে উন্নীত করেছিল। এভাবেই একটি নব্য রাজবংশ নিজেদের পুরাণের বংশেতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করে থাকে। এই একই ব্যাপার দেখা যায় একটি চতুর্দশ শতাব্দীর লিপিতে। একই অঞ্চল থেকে উদ্ভূত কোনো ভূ-ক্ষেত্র , ন’টি খণ্ডে ভাগ হয়ে জম্বুদ্বীপ ও ভারতবর্ষ পর্যন্ত গেছে। এ হল সেই স্থান যেখানে কর্মফল পাওয়া যায়। নানা ভাষা ও প্রথা বিরাজ করে। এই ক্ষেত্রটি কিন্তু বহু দেশে বিভক্ত। তাদের একটির নাম ত্রিলিঙ্গ—এর মধ্যে দিয়ে অনেক নদী প্রবাহিত হয়েছে। এখানে অনেক উন্নত শহর, সুন্দর পর্বত, গহন বন, গভীর নদীখাত, ও দুর্ভেদ্য দুর্গ আছে। স্পষ্টতই এই সময়ে ভারতবর্ষ তার মহাকাব্যিক-পৌরাণিক ইমেজসহ একট প্রসরমান ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা ক্ষুদ্র বা বৃহৎ কোনো স্থান হিসেবে হয়ত নথিবদ্ধ আছে।
(ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় হুগলী জেলার উত্তরপাড়ার মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। পরে কেমব্রিজ থেকে পি.এইচ.ডি. করেন। ২০০৪ সাল অব্দি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। ২০১৭ সাল নাগাদ সিমলার ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। পড়িয়েছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীতেও। বিশেষ করে মধ্যযুগের ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিখ্যাত। তাঁর প্রকাশিত বহু বইয়ের কয়েকটির নাম দেওয়া গেলঃ Coins and Currency System in South India (1977); Aspects of Rural Settlements and Rural Society in Early Medieval India (1990); The Making of Early Medieval India (1994); Representing the Other Sanskrit Sources and the Muslims (1998)Studying Early India: Archaeology, Texts and Historical Issues (2003)। তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে আছে D. D. Kosambi, Combined Methods in Indology and Other Writings (2002, 2009) এবং A Social History of Early India (2008)। ১৯৭৮ সালে তাঁর Coins and Currency System in South India ইন্সটিটিউট দে ফ্রান্সের পুরস্কার পেয়েছিল। ২০০২ সালে কোলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ভারতীয় ইতিহাসে তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য পান হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী জন্মশতবার্ষিকী স্বর্ণ পদক। ৭৮ বছর বয়সী শারীরিকভাবে অসুস্থ এই ঐতিহাসিক বর্তমানে বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলির বাসিন্দা।)