সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মন খারাপ হলে খবর্দার শোপেনহাওয়ার পড়তে বসবেন না। এটি, যাকে বলে, একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। সুগার হলে রসগোল্লার ওপর নিষেধাজ্ঞার মতো। কেন পড়বেন না, সে অনেক গল্প। কিন্তু কথা হল, মার্কামারা হতাশাবাদী বলে শোপেনহাওয়ারের এমনই বদনাম যে মন খারাপ না থাকলেও ওঁকে সাবধানে হ্যান্ডেল করবেন।
শোনা যায় তলস্তয় একবার শোপেনহাওয়ার পড়তে বসেছিলেন। তখন তাঁর বিশেষ মন-টন খারাপ ছিল এমন শোনা যায় না। আঠের’শ ষাটের দশকের শেষ দিক সেটা। মধ্য চল্লিশের কাউন্ট তলস্তয় সৃজন শক্তির মধ্য গগনে। War and Peace এর শেষ খণ্ডও প্রকাশিত হয়েছে। অসামান্য ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে রুশ দেশের বাইরেও। তখনও পর্যন্ত সুখী সাংসারিক জীবন কাটাচ্ছেন। এমন সময় শোপেনহাওয়ার পড়তে বসে অনুভূতিপ্রবণ মানুষটির চেতন অবচেতনে আঁধার ঘনিয়ে এল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতে থাকল হতাশ আতঙ্কে। শেষে এমনকি অমন যে উত্তুঙ্গ প্রতিভাধর, শক্তিশালী স্রষ্টা তাঁরও নাকি ‘মরিবার হলো সাধ’। আমাদের সৌভাগ্য তলস্তয় নিজেকে সামলে নিতে পেরেছিলেন। তবে পুরোপুরি নয়। আন্না কারেনিনাকে আত্মহত্যা করতেই হয়েছিল।
সেই জন্যেই বলছিলাম, আর্থার শোপেনহাওয়ার হইতে সাবধান। যা দিনকাল, অসতর্ক হলেই খিটখিটে মেজাজের এই ঠোঁটকাটা জার্মান দার্শনিক মনের আনাচে কানাচে উঁকি-ঝুঁকি দিতে পারেন। আপনার দর্শন চর্চার বাতিক নেই বলছেন? তাতে কি, বাজারে তো যান। রোববার সকালে ভালোমানুষের মতো থলি হাতে বাজারেই তো গিয়েছিলেন, দার্শনিক সন্দর্ভ নিয়ে তো আর বসেন নি। কিন্তু ফিরে এসে মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে না? ‘এই বেআক্কেলে মানুষ জাতটা ...’ বলে মোক্ষম একটা গালি দিতে ইছে করছে না? সাবধান! মাথাটা ঠাণ্ডা করুন। মাথার ওপর ফ্যানের স্পিডটা না হয় শেষ ধাপ অব্দি বাড়িয়ে দিন। প্রাজ্ঞ ভালোমানুষরা বলেন এই তিতকুটে মনের অবস্থা, এই ক্ষিপ্ত মেজাজ নাকি একটি বিষম ব্যাধি। এমতাবস্থায় শুধু শোপেনহাওয়ার কেন, তস্য চেলা নিটশে অব্দি হাজির হতে পারেন আর আপনি হেন ভালো মানুষও ‘সব ব্যাটাকে চাবকে সিধে করা উচিত’ বলে রাম নবমীর মিছিলে বেরিয়ে পড়তে পারেন!
কই, সকাল বেলা তো দিব্যি ভালো মুডেই বাজারে বেরিয়েছিলেন। অবিশ্যি শোপেনহাওয়ারের কথা একটিবার মনে হয়েছিল ঠিকই। সেটা ওই বাজারে ঢোকার মুখে চলচ্চিত্র তারকার পোস্টার দেখে। ছেলেটার হাসি হাসি সুন্দর মুখের ওপর একটা বিচ্ছিরি শুকনো গ্যাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। এই হিড়িক আবার এখানে কবে থেকে শুরু হল? এরা পারেও বটে। কিছু না কিছু একটা হুজ্জুতি ছাড়া চলে না। আচ্ছা, এরা কেন ধরেই নিচ্ছে যে ওদের হিরো আত্মহত্যা করতে পারে না? ছবি দেখে তো মনে হয় সেনসিটিভ ছেলে ছিল (আপনি আবার এই বাজারে ফস করে বলে বসবেন না যেন যে ওর কোন সিনেমা দেখা তো দূরস্থান, মারা যাওয়ার আগে নামটার সাথে অব্দি পরিচিত ছিলেন না) আর নরম মনের মানুষ আঘাত পেলে কখন যে কী করে বসে। শোনা যাচ্ছে, পড়ুয়া ছেলে ছিল। আরে! ও আবার শোপেনহাওয়ার পড়তে যায় নি তো! বলা যায় না, যে ছেলে কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে মেতে থাকতো বলে শোনা যাচ্ছে তার শোপেনহাওয়ার পড়ার দুর্মতি হওয়া আশ্চর্যের নয়। আর শোপেনহাওয়ার ভর করলে গলায় দড়ি দেওয়ার সাধ হওয়া আশ্চর্যের কী? সবাই তো তলস্তয় নয় যে চল্লিশ বছর বয়সে হতাশার তেতো দর্শন পান করে আশি বছর অব্দি নীলকণ্ঠ হয়ে অমৃত সৃজন করবে।
মেজাজটা খিঁচড়ে যাওয়া শুরু হল পটল কেনার সময় থেকে। না, এখন আর পটলে রঙ দেওয়া নিয়ে সব্জিওলার সাথে খিটমিট করেন না। চাষি বেচারাকে দোষ দিয়ে কী হবে? পটলের রঙটা ফ্যাকাসে দেখালে, বোঁদের মাঝে টুকটুকে লাল দানা উঁকি না দিলে আমাদের মুখে যদি না রোচে তাহলে বিষই খেতে হবে। কিন্তু রাগ যেয়ে পড়লো ওই ফ্যান ছোঁড়াগুলোর ওপর। রাগ হবে না? তোরা সব কি রে! মানলুম না হয় যে হিরো অসময়ে মারা যাওয়ায় তোদের যারপরনাই দুঃখ হয়েছে। হওয়ারই কথা। কিন্তু এই সব্জিবাজারে হিরোর ফ্লেক্সটা লাগানোর সময় তোদের একবারও চাষিদের কথা মনে হয় নি? যে চাষিরা এই বাজারে সবজি নিয়ে বসেন, সবজি পাঠান তাঁদের কথা? তোরা তো সব খবর রাখিস। হিরো কতটা লম্বা, পাঁচ আট নাকি ছয় সে নিয়ে থিসিস অব্দি লিখতে পারিস। তা, শুনিস নি প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে চাষি আত্মহত্যা করে চলেছেন? এক-দু’ জন ঝোঁকের মাথায় বিষ খাচ্ছেন না? গত দশ-পনের বছর বা তারও আগে থেকে দেশজুড়ে চাষিদের মৃত্যুর মিছিল চলছে? কই, তাঁদের দু-এক জনের ছবি টানাতে পারিস না? তোদের হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটি তাঁদের খবর দেয় না বুঝি? নাকি দিলেও তোদের তাতে কিছু যায় আসে না? ওরে অলম্বুষের দল, হিরো হিরোইনদের নাচন-কোঁদন না দেখলেও মরে যাবি না - বরং একটু সুস্থভাবে বাঁচবি - কিন্তু চাষি চাষ করা ছেড়ে দিলে যে সব না খেয়ে মরবি হতচ্ছাড়ারা।
মাথাটা আরো বিগড়ে দিল ওই ব্যাটা নগেন পাল। নাঃ, আপনারই ভুল হয়েছিল ও’রম গাম্বাট লোকের সাথে ভরা বাজারে তক্ক করতে যাওয়া। বাজার করতে এসে অকারণে পলিথিনের প্যাকেট চাওয়া নিয়ে তো এর আগেও এর তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, লাভ হয়েছে কিছু? এমন কি সেনবাবুর সরু ফ্রেমের চশমার পেছনে সদয় বুদ্ধিদীপ্ত চোখের ওপর ভরসা করে একদিন সন্ধে বেলা বাড়ি বয়ে গপ্পো করতেও তো গেছলেন। কায়দা করে পেড়েছিলেন শুধু শুধু গুচ্ছের পলিথিন ব্যবহার করে সর্বনাশ ডেকে আনার কথা। যুক্তির মাঝখানে এট্টু আবেগের সঞ্চার করার জন্য গরুদের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন, বেচারারা বাছবিচার না করে সব খেয়ে ফেলে ...। কিন্তু সেনবাবু কথাটাকে আর বাড়তে দেন নি। কপালের ওপর ঝুঁকে আসা পাতলা কাঁচাপাকা চুলের গোছা আলতো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে বলেছিলেন, ‘সে শুধু আমি-আপনি ব্যবহার না করলে কি আর হবে বলুন? নিন চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তারপর, ছেলের কোন ক্লাস হলো’।
এই সব অভিজ্ঞতার পর বাজারের মাঝখানে নগেন পালের থলির মধ্যে উঁকি দিয়ে ‘ও মশাই, আপনার থলিতে তো দেখছি যতগুলো সবজি ততগুলোই প্যাকেট’ বলে খোঁচা দিয়ে পরিবেশ চেতনা জাগ্রত করার প্রচেষ্টাটা যে সুবিবেচকের কাজ হয় নি সে নিশ্চই মানবেন। তবে নগেনের অমন তেড়িয়া হয়ে ওঠারই বা কি হ’লো? খোঁচা খোঁচা চুলের নীচে চোখদুটো পাকিয়ে গাঁক গাঁক ক’রে চেঁচাতে লাগলো, ‘আপনার তাতে কি মশাই! নিজের চরকায় তেল দিন গে যান। এই বয়সে আর আঁতলামো করতে হবে না’। ইত্যাদি, ইত্যাদি। এমন অসভ্য লোকের পাল্লায় পড়ে বাজার তো মাথায় উঠলো। রাস্তা পেরিয়ে দুধের প্যাকেট কিনে বাড়ি ফিরবেন ভাবছিলেন কিন্তু সেখানেও এক বখেড়া। সহেলী দিদিমণি, ইস্কুলে পড়ান, সকালে খুব তাড়া, পিঙ্ক রঙের স্কুটি একপাশে কাত করে এক পা মাটিতে রেখে শিরস্ত্রাণ পরিহিত অবস্থাতেই আমুল কোম্পানির দই-এর ছোট ছোট বাটি কিনছেন। সেও সব ‘প্ল্যাস্টিক’এর বাটি। কিন্তু সমস্যা সেটা নয়। সমস্যা হল, হেলমেটের ভেতর থেকেই দিদিমণি কোন কারণে বিদ্যাসাগরকে - হ্যাঁ, সকালে দুধ-দই নিয়ে যে ছেলেটি রাস্তার ধারে বসে তার বাবা-মা তাকে বিদ্যাসাগর নামই দিয়েছেন - বকুনি দেওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু সে বেচারা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, অল্প বিস্ময় মুখে বোঝানোর চেষ্টা করছে দাম সে ঠিকই নিয়েছে, ‘এক্সপায়ারি ডেট’ও দেখে নিয়েছে তাহলে তার অপরাধটা কী? দিদিমণির ইস্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে, হেলমেটটা যে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা আছে সে কথা ভুলে এক ঝটকায় খুলতে যেয়ে আরো রাগত হয়ে স্কুটি থেকে নেমে শিরস্ত্রাণ যখন খুললেন তখন তাঁর মুখমণ্ডল তাঁর বাহনের মতই বর্ণ ধারণ করেছে। ‘ব্যাটা শুনতে পাও না? তখন থেকে বলছি দইয়ের কাপের সাথে প্ল্যাস্টিকের যে চামচগুলো থাকে সেগুলো দে, কথা কানে যায় না, না?’ দোষ স্বীকার করে, এই নিন দিদি বলে, একগুচ্ছ খুদে খুদে প্ল্যাস্টিকের চামচ করকমলে সমর্পণ করে বিদ্যাসাগর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে চামচগুলোও একটা ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের মোড়কে সুরক্ষিত।
রোদ চড়চড়ে হয়ে উঠছে, মাথাও ঝাঁ ঝাঁ করছে। না, না, ঢের শিক্ষা হয়েছে। বিদ্যায়তনে শিক্ষাদান লগ্ন বয়ে যাওয়ার মুখেও প্ল্যাস্টিকের চামচ সংগ্রহ করা কেন জরুরী বিবেচিত হয়েছিল সে নিয়ে দিদিমণির সাথে যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার দুর্মতি আর আপনার হবে না। কিন্তু এ তো বেশ গেরো। আপনার কাছে যেটা জলের মতো সোজা যুক্তি লোকে সেটা মানা তো দূরের কথা শুনতেই চায় না কেন? উলটে তেড়ে আসে। দেশসুদ্ধ লোকের মাথা খারাপ হয়ে গেল, নাকি, আপনার নিজের মাথাটাই বিগড়েছে? ভারি ফ্যাসাদে পড়া গেল!
ফ্যাসাদটা যে কী, গেরো যে কত গুরুতর সেটা টের পাবেন বাজার সেরে বাড়ি ফিরে। বেরোনোর সময় অর্ডার ছিল শুক্তোর সব উপকরণ নিয়ে আসার। সেই মতো নিখুঁত হিসেব করে কাঁচকলা, পেঁপে, বেগুন কিনেছেন কিন্তু তারপরই এই সব যুক্তিতর্কে মাথা গুবলেট হয়ে শুক্তোর মধ্যমণি উচ্ছে ব্যাটাই স্রেফ গপ্পো হয়ে গেছে। ব্যাস। এর পরের চিত্রনাট্য আপনার জানা। অপরাধ ধরা পড়া, ম্যাডামের চার্জশীট দাখিল, ম্যাডামের আদালতেই বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া আর তাঁরই হাতে ফাঁসির পদ্ধতিগুলো আপনার বহু পরিচিত। ‘জানতাম এটাই হবে! একটা কাজের কথাও কি কানে ঢোকে না? কোন জগতে থাকো? কই, অফিসের কাজে তো ভুল হয় না? ...’
কোন শালা বলে, মানুষ নাকি rational animal! না, না, ঠিক আছে, আপনার লজ্জা পাওয়ার কিছু হয় নি। মুখ ফস্কে বলে ফেললেও শালা শব্দটা ঠিক গালাগালির মধ্যে ধর্তব্য নয়। কথামৃতের পাতায় পাতায় ঠাকুর ওটাকে শুদ্ধ করে দিয়েছেন। আর শোপেনহাওয়ারও ওই কথাই বলতেন। জার্মান ভাষায় শালা বলতেন কিনা সে কথা হচ্ছে না, তবে বলতেন আপনি যে ভুলটা করছেন ঠিক সেই ভুলটাই আজ অব্দি সব দার্শনিকরা করে এসেছেন। এ্যদ্দিন অব্দি সবাই মানুষকে চিন্তাশীল, বুদ্ধিমান প্রাণী বলে এসেছেন। সব্বাই মানুষকে যুক্তিশীল প্রাণী rational animal বলে ঠাউরেছেন। এই সনাতনী গোড়ার গলদের জন্যেই লোকে যুক্তি দিয়ে, তর্ক করে অন্যকে সহমত করার বৃথা চেষ্টা করে। আপনার মনমেজাজের যা হাল তাতে শুনতে ভালোই লাগবে যে শোপেনহাওয়ার বলছেন, যুক্তি দিয়ে আজ অব্দি কেউ কাউকে কোন ব্যাপারে একমত করতে পারে নি। কারণ মানুষ আদপেই যুক্তির ধার ধারে না। মুখে যে যাই ভড়ং করুক লোকে আসলে নিজের তালে, নিজের ধান্দাতেই চলে আর সেই মতো যুক্তি সাজায়। নৈয়ায়িকরা যুক্তিবিদ্যার চর্চা করে বটে কিন্তু সে তো ওদের পেশা, ওই দিয়েই ওদের রোজগার।
হ্যাঁ, কটু চাঁছাছোলা কথা বলতে শোপেনহাওয়ারের সঙ্কোচ ছিল না। আর মজার কথা হল, মানুষ যুক্তিশীল নয় এই কথাটা বলতে যেয়ে ওঁর ক্ষুরধার প্রতিভা শাণিত যুক্তিতে ঝকঝক করে। মেনে নিতে পারুন বা না পারুন, শোপেনহাওয়ারের বক্তব্যটি ঋজু। আমরা যাকে সচেতনতা বলি সেটা আসলে আমাদের মনের স্রেফ ওপরের স্তরটুকু মাত্র। পৃথিবীর ওপরের স্তরে মাটির আবরণের মতো। মাটির নীচে বিপুল গভীর স্তরগুলো নিয়ে আমরা যেমন কমই জানি তেমনি চেতন স্তরের নীচে মনের পরিচয় দুর্জ্ঞেয়। শোপেনহাওয়ার অবিশ্যি বলবেন তিনি জানেন। সচেতন বুদ্ধির নীচে নিরন্তর জেগে আছে প্রাণচঞ্চল ‘ইচ্ছে’, চেতন বা অচেতন বাসনা। এই ‘ইচ্ছে’, ‘বাসনা’রাই নিয়ত ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে নগেন পাল, সেনবাবু, সহেলী দিদিমনির মন। এই জন্যেই যুক্তি দিয়ে আপনি কাউকে স্পর্শ করতে পারছেন না। তবে শোপেনহাওয়ার আপনার যুক্তিবাদী চেতনার গর্বকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন। বলবেন, তোমার যুক্তিবাদী বন্ধুরা যতই চেঁচাক তোমাদের সবাইকেও পেছন থেকে চালায় তোমাদের ‘ইচ্ছে’, ‘বাসনা’। যুক্তি শুধু রাস্তা দেখিয়ে দেয়।
আপনি মানতে পারবেন না। শোপেনহাওয়ারের তাতে ভারি বয়েই গেল। ভারি অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। দার্শনিক বললে যে আপনভোলা, অমায়িক, শান্তস্বভাব মানুষটির ছবি দেখেন তার সাথে মেলাতে পারবেন না। রূঢ়প্রকৃতি, আত্মকেন্দ্রিক, বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ শোপেনহাওয়ার সঞ্চিত অর্থ বাজারে খাটাতেন ঝানু বিনিয়োগকারীর দক্ষতায়। নিজের প্রতিভা নিয়ে তুমুল আত্মবিশ্বাসী আর সে ব্যাপারে বিনয়ের ধার ধারতেন না। অক্লেশে বলতে পারতেন, কান্ট আর তাঁর মধ্যবর্তী সময়ে নাকি দর্শন নিয়ে বলার মতো কাজ কিছুই হয় নি। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই “The World as Will and Idea” এর মুখবন্ধে ঘোষণা করলেন এর পর এই বই শত শত নতুন বই আর গবেষণার উৎস হবে।
দুঃখের কথা, নেপোলিয়ন পরবর্তী যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অবসন্ন ইউরোপের মন মেজাজ দর্শন চিন্তার অনুকূল ছিল না। অসামান্য এই গ্রন্থটি প্রকাশের ষোল বছর পর প্রকাশক জানালেন অধিকাংশ বই বাজে কাগজ হিসেবে ওজন দরে বিক্রি হয়েছে! শোপেনহাওয়ার অবশ্য তাতে দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। বললেন, বই আর মাথার ঠোকাঠুকিতে ফাঁপা শব্দ হলে দোষটা কি সব সময় বইয়ের? বইয়ের শুরুর বাক্য ছিল, ‘দুনিয়াটা আসলে আমার ভাবনা’। ইংরেজী অনুবাদে, “The world is my idea.” তা, লোকে নাকি জানতে চাইত, ওর বউ এটা শুনে কী বলেছে? কথাটা শোপেনহাওয়ারের কান অব্দি পৌঁছেছিল কিনা জানা নেই, পৌঁছলেও উত্তর দেওয়ার দায় ছিল না। কারণ তাঁর কোন স্ত্রী ছিলেন না। সংসার ছিল না। জীবনের শেষ তিরিশ বছর থেকেছেন একটা বোর্ডিং-এর দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে। একমাত্র সঙ্গী তাঁর কুকুর। নাম রেখেছিলেন, ‘আত্মা’। হ্যাঁ, সংস্কৃত শব্দ আত্মা, যদিও দুষ্টু লোকে বলতো, বাচ্চা শোপেনহাওয়ার। রাতের খাওয়ার জন্য প্রায়ই যেতেন এক ইংলিশ রেস্তোঁরায়। খেতে বসার আগে টেবিলের ওপর একটা সোনার গিনি রাখতেন আর খাওয়া হয়ে গেলে সেটা তুলে পকেটে পুরে ফিরে যেতেন। দিনের পর দিন এই কাণ্ড দেখে রেস্তোঁরার ওয়েটার একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, এই কাণ্ডটার মানে কী? শোপেনহাওয়ার বললেন, যে দিন দেখব ওই ইংরেজ অফিসারগুলো খাওয়ার টেবিলে বসে ঘোড়া, মেয়েমানুষ বা কুকুর ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কথা বলছে সেদিন এটা তোকে দিয়ে যাবো।
সে না হয় হল। কিন্তু কুকুরের নাম আত্মা কেন? সে গল্পের জন্য শোপেনহাওয়ারের দর্শনের একটু খোঁজ নিতে হবে। গোদা ভাবে বললে, শোপেনহাওয়ারের ধারণা সহেলীর বাজার করা থেকে বিশ্ব প্রপঞ্চের সব কিছুর মূলে ইচ্ছে বা বাসনা। “ইচ্ছেই মনের একমাত্র স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয় উপাদান ... ইচ্ছেই চেতনাকে ধরে রাখে, তার সমস্ত ভাবনা চিন্তার মধ্যে সমন্বয় করে”। খুদে খুদে প্ল্যাস্টিকের চামচগুলো সংগ্রহ করার কোন কারণ ছিল বলে দিদিমণি ওগুলো চাইছিলেন তা নয় ওগুলো চাইছিলেন বলেই নানা কারণ দেখিয়ে বিদ্যাসাগরকে ধমক-ধামক দিচ্ছিলেন। বুদ্ধি বা মেধা বাসনার ভৃত্য বই নয়, ইচ্ছে চরিতার্থ করার জন্যই প্রকৃতি মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন। কিন্তু সহেলী দিদিমণি চামচগুলো চাইছিলেনই বা কেন? প্রশ্ন করতে পারেন, ইচ্ছেরও তো একটা কারণ আছে, তারও তো যুক্তি থাকতে পারে? শোপেনহাওয়ার বিশেষ পাত্তা দেবেন না, বলবেন ইচ্ছে ওসব যুক্তি-টুক্তির ধার ধারে না। বাসনা অন্ধ। নাঃ, এ লোকের সাথে পারা যাবে না। এই পাগলামো নিয়ে একটা কমপ্লেন করলে হয় না? আচ্ছা, আইনস্টাইন শুনেছিলেন এই সব অদ্ভুতুড়ে কথা? শুনেছিলেন। আর আপনার অভিযোগ শুনলে মুচকি হেসে বলতেন, হের দার্শনিক বলছেন আপনার যেটা ইচ্ছে হয় আপনি তাই করেন কিন্তু আপনি ইচ্ছে অনুযায়ী ইচ্ছে করতে পারেন না!
অর্থাৎ কিনা, ইচ্ছে বা বাসনা স্বয়ম্ভূ। ইচ্ছেই মানুষের সত্তা, তাকে আপনি কখনোই সম্পূর্ণ জানতে পারবেন না। মানুষের মন, তার সত্তা দুর্জ্ঞেয়। কেন, মন দুর্জ্ঞেয় হতে যাবে কেন? তাকে জানা যাবে না কেন? আরে মশাই, জানবেন কী দিয়ে? বুদ্ধি দিয়ে? বললাম না বুদ্ধি হল ইচ্ছের চাকর! বুদ্ধি মনের একটা প্রকাশ মাত্র, ওর কাজ ইচ্ছের হুকুম পালন করা, ওই কাজের জন্যেই ওর সৃষ্টি, ও শুধু ওটুকুই পারবে কিন্তু যার আজ্ঞা বহন করছে তার নাগাল পাবে কী করে? শুধু আপনার বুদ্ধি কেন, আপনার শরীর, তার শারীরবৃত্তীয় কাণ্ডকারখানা সবই এই ইচ্ছে-স্বরূপ সত্তার প্রকাশ। ভোজনেচ্ছার জন্য পরিপাকতন্ত্র ... ইত্যাদি ইত্যাদি। মা বলেছিলেন না খোকাকে, ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে। এর মানে দাঁড়াল, আপনি যে আপনি সেই আস্ত মানুষটাই ইচ্ছের প্রকাশ। শুধু আপনি নন সেনবাবু, নগেন পাল, সহেলীদিদিমনি, তলস্তয়, অকালপ্রয়াত চিত্রতারকা সব্বাই। শুধু আমরা নই, আপনার নেওটা কুকুর লালু, বজ্জাত হুলো ভজা এরাও সব ইচ্ছের প্রকাশ। ওই যে শিরীষ গাছ ওর ডালগুলো নীচু করে পাঁচ আঙুল ছড়ানো হাতের মতো দোলাতে দোলাতে ‘সে কি এল, সে কি এল’ ভাবছে, সেও। গাছের নীচে লাল কাঁকুরে মাটি, মাটি থেকে অল্প একটু মাথা তুলে উঁকি দেওয়া পাথর ওরাও। আর্থার শোপেনহাওয়ার বলবেন জগতের সব প্রাণ এবং অপ্রাণ এক অখণ্ড সত্তার বিশেষ বিশেষ প্রকাশ।
চেনা চেনা লাগছে না তত্ত্বটি? ঠিক ধরেছেন। বিশ্ব চরাচর জুড়ে সর্বত্র অখণ্ড সত্তার বিচিত্র প্রকাশের ধারণার কথা শুনলে উপনিষদের কথাই মনে পড়বে। শোপেনহাওয়ার ছিলেন উপনিষদের একনিষ্ঠ পাঠক, উপনিষদের প্রজ্ঞার উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সরব। তবে কিনা উপনিষদে এই সত্তার পরিচয় নির্গুণ আত্মা আর শোপেনহাওয়ার দাবী করতেন এই সত্তা আসলে বদগুণ ইচ্ছে। আর কুকুরের নাম রেখেছিলেন আত্মা! তো সে যাই হোক, শোপেনহাওয়ার বলতেন তাঁর প্রেরণা প্লেটো, কান্ট আর উপনিষদ। প্লেটোকে কেন গুরু বলে ঠাউরালেন ঈশ্বর জানেন - প্লেটোর চিন্তার প্রভাব তাঁর দর্শনে খুঁজে পাওয়া মুশকিল - কিন্তু ইমানুয়েল কান্টের যে তিনি চ্যালা সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এসব বখেড়ায় আপনার কোন ইন্টারেস্ট নেই বলছেন? তা না-ই থাকতে পারে। কার যে কিসে ইন্টারেস্ট কে বলতে পারে? তবে, দু’ পাতা শোপেনহাওয়ার পড়ে বলতে পারি আপনিই কি জানেন কিসে আপনার ইন্টারেস্ট? জানবেন কি করে? ইন্টারেস্ট তো আপনার নয়, আপনিই ইন্টারেস্টের। আপনি তো আপনার ইন্টারেস্টের দাস মশাই!
রেগে গেলেন নাকি? এই দ্যাখো! স্রেফ এট্টু লেগ পুলিং করছিলাম। তাও আপনার নয়, শোপেনহাওয়ারের। ওসব ছাড়ুন, বলছিলাম, আপনার একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে না, ‘পরিপ্রেক্ষিত’ পত্রিকায়? হিন্দু ধর্মের উৎস সন্ধানে, বা ওই রকম কিছু একটা? হেব্বি লিখেছেন কিন্তু। কখন পড়েন এত সব! তবে, ইন্টারেস্টের কথা যখন উঠলই তখন একটা কথা শুধোই। এত খেটেখুটে দাঁতভাঙা সব রচনা লেখেন কেন বলুন দিকিনি। হিন্দু কথাটা সিন্ধুনদ থেকে এসেছে নাকি গঙ্গায় ভেসে উঠেছে তাই নিয়ে কার মাথাব্যথা? হ্যাঁ, যে সাড়ে তের জন আপনাদের ওই পত্রিকা পড়েন তাঁদের অবিশ্যি সব কিছু নিয়েই মাথাব্যথা, ত্রিভুবনে হেন জিনিস নেই এঁরা জানেন না। ওঁদের আর নতুন করে কী শোনাবেন? নাকি আশা করেন মাথায় ফেট্টি বেঁধে যে মস্তানগুলো রামমন্দির নিয়ে চেঁচাচ্ছে তারা আপনার প্রবন্ধ পড়ে ভুল বুঝতে পেরে হিন্দু ধর্মের উৎস সন্ধানে উপনিষদ খুলে বসবে? ধন্যি আশা মশাই আপনাদের! আপনারা কি ভাবেন যে একদল অসভ্য ভুলভাল বকে লোক তাতাচ্ছে আর লোকেও নাচছে সে শুধু কয়েকটা তথ্য জানে না বলে? আচ্ছা নাহয় মানলাম, লোকে ইতিহাস ঠিকঠাক জানে না। কিন্তু চারপাশটা তো দেখতে পায়? সবাই তো দেখতে পাচ্ছে হিন্দুত্ব-অলারা মাসল ফুলিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় একজন মুসলমানকে পিটিয়ে, খুঁচিয়ে মারলেও পেয়াদা দেখতে পাবে না। নেহাত যদি হলফনামা দাখিল করে কেউ না বলে যে আমি অমুকচন্দ্রের গুণধর পুত্র তমুক সাঙ্গোপাঙ্গো সমভিব্যাহারে শেখ তমুককে পিটাইয়া হত্যা করিয়াছি তাহলে প্রমাণ অভাবে মামলা খারিজ হয়ে যাবে। এসব দেখেশুনেও লোকে কি করে বলে বেড়ায় বলুন তো যে, হিন্দু খতরে মে হ্যায়? আপনি কী করবেন? কী আর করবেন, আরেকটা প্রবন্ধ লিখতে বসে যান। এক দুই তিন চার যুক্তি আর তথ্য সাজান। কারণ আপনি বিশ্বাস করেন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে। মানুষ যা দেখবে জানবে তাই তো বিশ্বাস করবে।
আপনার মুণ্ডু! লোকে যা বিশ্বাস করে তাই দেখতে পায়। সংস্কৃতিবান উচ্চশিক্ষিতও অফিস এসে গলা বাজিয়ে বলতে পারেন আগের দিন সন্ধেবেলা শপিং মলে একদল বোরখাপরা মহিলাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন - ভাবুন, দিনে দিনে কী হল, এরপর তো ‘আমরা’ই সংখ্যালঘু হয়ে যাবো। আপনি আপনার চারপাশে এইসব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছেন না? এর পরও বলবেন, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। আপনার মুশকিল কি জানেন, সেই যে ক্লাস এইটে বিজ্ঞান ক্লাসে মদনবাবু পড়িয়েছিলেন, প্রথমে পরীক্ষা তারপর পর্যবেক্ষণ আর তারপর সিদ্ধান্ত ওইটেই মাথায় গেঁথে আছে। কাঁচা আমের রঙ সবুজ। কী করে জানলাম। আমে কামড় দিয়ে দেখলাম টক আর দেখতেই তো পাচ্ছি রঙটা সবুজ। অতএব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে নির্ভুল সিদ্ধান্ত। মদনবাবু বোধহয় কান্ট পড়েন নি। তা নইলে এও বলে রাখতেন, তোর চোখে রঙটা সবুজই লাগছে বটে কিন্তু তাই বলে নিশ্চিন্ত হতে পারিস না যে আমটা সবুজই। কোন রঙ দেখবি সেটা নির্ভর করছে তোর ওপর, আমটার ওপর নয়। তুই কালার ব্লাইন্ড হলে সবুজ নাও দেখতে পারিস। ওই যে কাঠবেড়ালিটা লেজে ভর দিয়ে ডালের ওপর সোজা হয়ে বসে সামনের পা দুটোয় কী একটা জাপটে ধরে টুকটুক করে খেয়ে যাচ্ছে ও আমটার রঙ কী দেখছে সেটা জানারও কোন উপায় নেই।
মদনবাবু এসব কিছুই বলেন নি বটে তবে তপনবাবু কিন্তু ক্লাসে পড়িয়েছিলেন, আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে ... । সাঙ্ঘাতিক কথা মশাই! চুনি রাঙা হয়ে ‘উঠল’। ওর নিজের নয়, আমার চেতনার রঙে! তবে বাঙলা ক্লাসে কী পড়া হল সে আর কে পাত্তা দেয়। ভালো ছেলেরা মুখ নামিয়ে হাসে, এসব ন্যাকা ন্যাকা ব্যাপার ওদের পোষায় না। আপনিও নির্ঘাত সেই দলে ছিলেন, সায়েন্স ক্লাসের জন্যে মুখিয়ে থাকতেন। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত। খাঁটি জ্ঞান হল অভিজ্ঞতা লব্ধ। বাস্তবের কষ্টি পাথরে যাচাই করে নেওয়া। ওই যে আমপাতাটা ভেসে ভেসে দুলে দুলে মাটিতে এসে পড়ল, সেটা যে মাধ্যাকর্ষণের জন্যে সে তো স্পষ্ট চোখে দেখা। পাথর হলে ধাঁই করে এসে পড়ত। তার মানে বায়ুস্তরে যে পাতাটা বাধা পাচ্ছে সেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
বটে! কান্ট বলবেন পাতাটা পড়ছে এটা দেখতে পাচ্ছো কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের জন্যেই পড়ছে এটা আবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল কীভাবে? কান্ট অবিশ্যি ঠিক এভাবে বলেন নি কিন্তু আপনাকে মানতেই হবে যে মা ধরিত্রীকে মাধ্যাকর্ষণের হাত বাড়িয়ে আমপাতা পাড়তে আপনি দেখেন নি। সত্যি বলতে কি, আমরা যাকে কার্য-কারণ সম্পর্ক বলি, মানে এই ঘটনার জন্য ওই ঘটনাটা ঘটল বলে ব্যাখ্যা করি, তাকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি বলে দাবী করতে পারি না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে এইসব উষ্টুম ধুষ্টুম ভাবছেন এমন সময় তপনবাবু এসে ‘হাঁ করে মাঠের দিকে তাকিয়ে কী দেখা হচ্ছে’ বলে কষে কানটি দিলেন মলে। এমতাবস্থায় ইমানুয়েল কান্ট যদি এসে কূট তর্ক জুড়ে দেন যে তপনবাবুকে তুমি কান মলতে দেখেছো এটা তোমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, কানটি যে লাল হয়ে আছে সেও দেখাই যাচ্ছে কিন্তু তপনবাবুর কান মলে দেওয়াই কান লাল হওয়ার কারণ এটা তোমার নিজের সিদ্ধান্ত তাহলে কানের সাথে মাথাটাও আপনার এমনি গরম হবে যে বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিককেই হয়তো এক ঘা লাগিয়ে দেবেন। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবে দেখুন, কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। গেল বিষ্যুদবার সেভেন বি’র ক্লাস নিয়ে তপনবাবু যখন করিডোর দিয়ে ফিরছিলেন তখন আপনি থামের আড়াল থেকে ওনার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বানানো নিকনেম “তকুভ!” বলে ডেকেছিলেন না? স্যার নির্ঘাত শুনতে পেয়েছিল আর আজ তাই সুযোগ বুঝে কষে কানটা মলে বদলা নিয়ে নিল। আপনার সিদ্ধান্ত হয়তো নির্ভুল। আপনি বলবেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এই সিদ্ধান্ত। তর্ক করবো না, আপনার মন মেজাজ ভাল নেই, শুধু বলতে হবে একে যদি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলেন তাহলে মানতেই হবে সেটা শুধু আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতা নয়। ওতে অনেকখানি আমাদের মনের মাধুরী - কিম্বা বিষ - মেশানো থাকে। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে তো আপনি এই সিদ্ধান্তও করতে পারতেন যে তপনবাবুর পুরো ক্লাসটাতেই আপনি অমনোযোগী ছিলেন তাই কান মলা খাওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। তা কিন্তু করলেন না। প্রতিশোধ বলেই মনে করলেন। কী করে অস্বীকার করবেন তাহলে যে এই কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজাটা আপনার মন গড়া।
কান্ট বলেন কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজা সব সময়ই আমাদের মন গড়া। শুনে আপনার হাড় পিত্তি জ্বলে যাবে। আপনি শুনেছেন কান্ট ছিলেন ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শনের পুরোধা। আর মার্কস তো সেই কবেই চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান ঘোষণা করে দিয়েছেন। তাহলে আর এসব পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটার মানে কী? তা, মন্দ বলেন নি। যদিও কান্টের জ্ঞানতত্ত্ব মার্কস কীভাবে যুক্তি দিয়ে খারিজ করেছিলেন সে মনে করতে পারবেন না। বইপত্তরগুলো নামিয়ে ধুলো ঝেড়ে দেখবেন নাকি একবার? এই জন্যে বলছিলাম যে, ‘তকুভ’ যে আসলে আপনার ওপর প্রতিশোধই নিচ্ছিলেন এই তত্ত্বটি প্রমাণ করতে হলে কান্ট ছাড়া আপনার গতি নেই। সব কিছু আপনি চোখে দেখেন নি তো কী হয়েছে, যেটুকু দেখেছেন তার থেকে দুইয়ে দুইয়ে চার করলে এটাই হয়। এইবার কান্ট আপনার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলবেন, জ্ঞানতত্ত্বের এটাই গোড়ার কথা। ইন্দ্রিয় অনুভূতিজাত অভিজ্ঞতা জ্ঞানের একটা উৎস, একমাত্র উৎস নয়। অন্য উৎসটা আছে আপনার ভেতরে। কান্ট বলবেন, পূর্বজ্ঞান, a priori. কাঁচা আমের রঙ সবুজ আপনার এই জ্ঞানের একটা উৎস আমের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে আসা সূর্যের আলো কিন্তু ওই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকে যে আপনি সবুজ বলেই চিনবেন এটা আপনার মধ্যে পূর্বনির্ধারিত, a priori. আপনি তো ততদিনে ক্লাসে পড়েছেন যে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আপনার মধ্যে বিভিন্ন রঙের অনুভূতি তৈরি করে আর তারও একটা সীমা আছে। ওই সীমার চেয়ে কম বা বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আপনার চোখে পড়লেও আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না। এসব তো আপনি জানেন। তাই কান্ট যদি বলেন, বাইরের জগত ইন্দ্রিয়ানুভূতির ভেতর দিয়ে কীভাবে আমার কাছে ধরা দেবে সেটা পূর্বনির্ধারিত, এই পূর্বনির্ধারিত ছন্দের সীমার মধ্যেই তাকে ধরা দিতে হবে তাহলে অত খাপ্পা হয়ে ওঠার কি আছে! কবিও তো বলেন সীমার মাঝেই অসীম সুর বাজিয়ে চলেছে। আপনার আবার কবিতা-টবিতা বিশেষ পোষায় না। তা বেশ তো, ওই যে দুইয়ে দুইয়ে চার হওয়ার কথা বললেন ওখানেও গল্প আছে। কোত্থেকে জানলেন, দুই আর দুইয়ে চার হয়? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা? অ, ছোট্টবেলায় মা মার্বেল দিয়ে শিখিয়েছিলেন বলছেন? ভালো কথা। তা, এই যোগফলটা কষে ফেলুন তো। ৩৩+৪৩+৫৩। বাঃ, দিব্যি তো ঝপ করে করে ফেললেন। মাসিমা কি এটাও মার্বেল দিয়ে শিখিয়েছিলেন নাকি! নাকি সুধন্যবাবুর অঙ্ক ক্লাস থাকলে বস্তা করে মার্বেল নিয়ে আসেন? তখন তো দেখি কোন দিকে না তাকিয়ে খাতার ওপর ঝুঁকে ইন্টিগ্র্যাল ক্যালকুলাসও কষে ফেলছেন। কোন অভিজ্ঞতা থেকে? কোথায় তখন আপনার পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত?
যদি রাগ না করেন, একটা কথা বলি? ছাত্রজীবনে আমরা যে শুধু সুশিক্ষাই পেয়েছি এমন বলা যায় না। ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক তর্ক, সন্ধেবেলায় শ্রমিক মহল্লায় পড়ানো এগুলো মূল্যবান শিক্ষা। কিন্তু সব কিছুর ভেতরেই ‘দল’ এর উত্তেজনা ছিল। ‘কোন দিক সাথী কোন দিক বল/ কোনদিক বেছে নিবি তুই!’ দুরন্ত এর আবেদন। তীব্র নেশা এই উত্তেজনার। এই নেশার ঘোরে মানুষ, সমাজ, চিন্তা, দর্শন, সংস্কৃতি সবকিছুকেই শিবির ভাগাভাগির দাগ টেনে দেখাটাই কর্তব্য জ্ঞান করেছি। দর্শনের দুটো শিবির। বস্তুবাদী আর ভাববাদী। বস্তুবাদী দর্শনটাই ঠিক আমরা তাই ওই শিবিরে - কিম্বা আমরা বস্তুবাদী শিবিরে বলেই ওটা ঠিক। ব্যস। লক্ষণের গণ্ডি কেটে দেওয়া হল। খবরদার এর বাইরে পা বাড়াবি না! ভাববাদী রাবণ মায়াবী রূপ ধরে ধরে নিয়ে যাবে। সেই নেশা, উত্তেজনা কবে কেটে গেছে। দলও ইতিহাসের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কিন্তু কর্তা গঙ্গালাভ করলেও কর্তার ভূত তো যেতে চায় না। শিবির কবে ডেরাডাণ্ডা উঠিয়ে নিয়েছে, আমার আপনার মতো লোকে সমাজ অর্থনীতির প্রচলিত প্রবাহেই নেমে পড়েছে। শুধু হৃতগৌরব বনেদিয়ানার নির্বোধ অহঙ্কারের মতো মাথার মধ্যে শিবির থেকে গেছে। আর কারুর তাতে কোন ক্ষতি হয় নি। আমার আপনার হয়েছে। কি প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য, দর্শন চর্চার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। হস্টেলের ভাষায় একে বলে গাঁটামো।
তা নইলে, কান্টের সাথে একমত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল যে গণিতের ধারণাগুলো অভিজ্ঞতা থেকে আসে নি। কোত্থেকে এসেছে তাহলে? কান্ট হয়তো প্রশ্নটাকে পাত্তাই দেবেন না। কোত্থেকে এসেছে আবার কি! মানুষের মন কি স্রেফ সাদা কাগজ? পরিষ্কার স্লেট? লকের দাবী মতো tabula rasa? ইন্দ্রিয় অনুভূতি বাইরে থেকে যা এঁকে দেবে ওইটুকুই কি মানুষের মন? মন, তোমার মন নাই? আছে বই কি। বাইরের দিকে তাকিয়ে সে যা দেখে, শোনে সেসব কিছু নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েই তৈরি করে ধারণা, জ্ঞান, সত্য। যা রচিবে তাই তোমার সত্য। এই রচনার ভাষা তার একান্ত নিজের, বাইরে থেকে শেখা নয়। ভোরের অস্ফুট আলোটুকুই সে চোখে দেখে কিন্তু ওই আলো দেখার আনন্দটা তার। সেই আনন্দ থেকে উৎসারিত ভৈরবী রাগিণী তার একান্ত আপনার। প্রকৃতির বিচিত্র ছন্দকে যে গণিতের ভাষায় সে ‘ব্যাখ্যা’ করে সে ভাষায়ও তার জন্মগত, বাইরে থেকে শেখে নি। কার্য-কারণ নিয়ে ধারণাটাও তার নিজের। অভিজ্ঞতা থেকে সে দুটো আলাদা ঘটনা জানে কিন্তু ঘটনা দুটোর মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক সে অভিজ্ঞতা থেকে শেখে না। এমন কি আপনি যে তন্ময় হয়ে আম পাতাটাকে ওপর থেকে নীচে, এদিক থেকে ওদিকে দুলে দুলে পড়তে দেখে কান মলা খেলেন কান্ট বলবেন আপনি বিভিন্ন বিন্দু থেকে আসা আলো দেখছিলেন কিন্তু ওপর, নীচ এসব তো দেখেন না। স্পেসের ধারণাও অভিজ্ঞতা থেকে পান নি, ওটাও আপনার মাথার মধ্যেই ছিল, আছে। যা দেখেন তাকে ওই স্পেসে সাজিয়ে নেন।
এইটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? এই তো দাঁড়িয়ে আছি করোনেশন সেতুর ওপর, পায়ের নীচে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে নেচে তিস্তা ছুটে যাচ্ছে, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছি মাথার ওপর সেবক পাহাড়। এই সব কিছুকে বিভ্রম বলে মানতে হবে নাকি! প্রশ্ন করতেই পারেন। তবে স্পেসের প্রশ্নটা বিচার করার সময় গুরুর তত্ত্বের সমর্থনে শোপেনহাওয়ার যে উদাহরণ দিয়েছিলেন সেটাও খেয়াল রাখবেন। যষ্টি হাতে অন্ধের পথ হাঁটার উদাহরণ। আপনিও প্রতিদিন স্টেশনে দেখেন না, ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম ..’ গাইতে গাইতে লাঠি হাতে টুক টুক করে অন্ধ মানুষটিকে ঘুরে বেড়াতে? ওঁর সিঁড়ি ওঠার পদ্ধতিটা লক্ষ্য করেছেন? লাঠিটা একবার ঠেকাচ্ছেন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেই ধাপে, তারপর একটু তুলে সিঁড়ির পরের ধাপে, একবার বাঁদিকে লোহার রেলিঙটাও লাঠি দিয়ে স্পর্শ করে নিচ্ছেন। এইভাবে লাঠি দিয়ে স্পর্শ করে করেই সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, নামছেন, বাঁ দিকে ডান দিকে ঘুরছেন। শোপেনহাওয়ারের মোক্ষম প্রশ্ন সিঁড়ির ধাপের সাথে লাঠির যে স্পর্শ তিনি হাতের তালুতে অনুভব করছেন সেই স্পর্শের অনুভূতি তো ওপরের ধাপ বা নীচের ধাপে একই। রেলিঙের লোহার সাথে স্পর্শও ডানদিকে বাঁদিকে একই। জন্মাবধি তিনি কখনো ওপর নীচ ডান বাম এসব ‘দেখেন’ নি। তাহলে এই স্পর্শ দিয়েই ‘মানস চক্ষে’ স্পেস তিনি ‘দেখতে’ পাচ্ছেন কি করে যদি না স্পেস তাঁর মানসেই থাকতো?
যাই হোক, স্থান-কাল-পাত্রের এ সব কূটকচাল নিয়ে আপনার হয়তো মাথাব্যথা নেই। তবুও, একই সাথে কান্ট আর উপনিষদের কাছে শোপেনহাওয়ারের নাড়া বাঁধার গপ্পের খাতিরেই কথাগুলো উঠছে। ফিল্মের গপ্পো একেবারে বাদ দিয়ে তো হিরো-হিরোইনদের কেচ্ছা জমবে না! কান্টের মতিগতি দেখে আপনার সন্দেহ হতে পারে এই ভদ্রলোকও বোধহয় শেষমেশ ‘জগত মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য’-এ যেয়ে ভিড়বেন। তা কিন্তু নয়। কান্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে অলীক বা বিভ্রম বলে সন্দেহ করেন নি। মনে করতেন, জগতের স্বরূপ দেখার বেলায় আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের মনের সীমার মধ্যেই জগত আমাদের বোধে ধরা দেবে। জগতের সমগ্র রূপ আমাদের বোধে ধরা পড়বে না। বলতেন, জগতের এই বস্তু সত্তা - thing-in-itself - এক অখণ্ড, অভিন্ন সত্তা। আমরা স্থান আর কালের ধারণার মধ্যে দিয়ে এই অখণ্ড সত্তাকে নির্দিষ্ট, খণ্ড চেহারায় দেখি।
আপনার নির্ঘাত ‘চলচ্চিত্ত চঞ্চরী’র খণ্ডাখণ্ড তত্ত্বের কথা মনে পড়ছে। আর এই তত্ত্বের ব্যাপারে শোপেনহাওয়ার এক্কেবারে গুরুর চেলা। ঘটনাকে আমরা যেভাবে দেখি স্থান আর কাল তার-ই অঙ্গ, thing-in-itself এর নয়। স্থান আর কাল-ই অখণ্ড অস্তিত্বকে খণ্ড অস্তিত্বে ভাগ করে রাখে। আমাদের এই দেখাকে শোপেনহাওয়ার বলবেন মায়া। স্থান-কালের এই মায়ার আবরণ সরিয়ে নিতে পারলে সব খণ্ডের মধ্যে অখণ্ড, সব বিশেষের মধ্যে অবিশেষ আমাদের চোখে ধরা পড়তো। হ্যাঁ। মায়া শব্দটাই ব্যবহার করতেন। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? আমরা কিন্তু বিশ্বস্ত সূত্রে জানি শোপেনহাওয়ারের পড়ার টেবিলে রাখা ছিল কান্ট এবং বুদ্ধের আবক্ষ মুর্তি আর টেবিলে প্রায় সব সময় খোলা পড়ে থাকতো উপনিষদের একটা খণ্ড। রাত্রে নাকি উপনিষদ হাতে নিয়েই শুতে যেতেন। বলতেন, বহুত্ব বা বৈচিত্র্য যে অখণ্ড সত্তার আপাত রূপ মাত্র এই ধারণার কথা কান্টের বহু আগে বেদ এবং উপনিষদে নানাভাবে বলা হয়েছে। মনে করতেন তাঁর শতাব্দীর “মহত্তম উপহার” হল ইউরোপের কাছে সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার খুলে যাওয়া।
শোপেনহাওয়ার অবশ্য সংস্কৃত জানতেন না। সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার তাহলে ওঁর কাছে খুলে গেল কীভাবে? সে গল্পটাও শুনে রাখুন। শোপেনহাওয়ার উপনিষদ পড়েছিলেন ল্যাটিন অনুবাদে। অনুবাদ করেছিলেন ফরাসী পণ্ডিত অ্যানকুতিল দ্য পেরন। সেও কিন্তু মূল সংস্কৃত থেকে নয়, ফারসি অনুবাদ থেকে। কী বললেন, উপনিষদের আবার ফারসি অনুবাদ কবে হল? ঠিকই, আপনার অবাক হওয়ারই কথা। দারা শিকো, সম্রাট শাজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র, সংস্কৃত থেকে উপনিষদের ফারসি অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদই ফরাসী পণ্ডিতের হাতে ল্যাটিনে অনূদিত হয়ে শোপেনহাওয়ারের পড়ার টেবিলে পৌঁছেছিল।
সে তো হল, কিন্তু এ হেন উপনিষদে মগ্ন দার্শনিককে পড়ে তলস্তয়ের গলায় দড়ি দেওয়ার সাধ জেগেছিল কেন?
মুশকিল ওখানেই। শোপেনহাওয়ার কেন হতাশাবাদী সে নিয়ে দু’ চারটে বই ঘেঁটে আপনি একখানি প্রবন্ধ নামিয়ে দিতে পারেন। লিখবেন নাকি, পরের সংখ্যায়? নাঃ, থাক। ওই যে বলছিলাম, এঁকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাটি না করাই ভালো। একে তো বাজারে আপনার বদনাম হবে। প্রগতিবাদী তত্ত্বালোচনার অলিখিত নিয়ম হল রূপকথার গপ্পের মতো হ্যাপি এনডিং হতে হবে। আর এই ভদ্রলোক কিনা রাজ্যের যত জ্ঞান ভাণ্ডার ঘেঁটে, তত্ত্বের বিপুল কাঠামো বানিয়ে বলবেন, দেখেছেন তো শেষ অব্দি আপনার গলায় দড়ি দেওয়াই ভালো!
বিশ্বাস হচ্ছে না তো? সেই ভালো, বিশ্বাস করে কাজ নেই। এমনিতেই আপনার মন মেজাজ ভালো না। কিছুই ভালো লাগে না। হস্টেলের কৌশিককে মনে পড়ে? ভারি সুন্দর পোস্টার লিখতো। একদিন দেখা গেল বারান্দার দেওয়াল জুড়ে এ্যত্ত বড়ো বড়ো হরফে লিখে রেখেছে, ‘আর ভাই!’ রোজ সকালে চোখটা খুলে ওই কথাই মনে হয়। তবু প্রবন্ধ লেখেন। ভালো ভালো কথাই লেখেন। লিখতে ভালো লাগে। মনটা কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভালো থাকে। ছেপে বেরোনর পর জনা তিনেক বন্ধুও দুটো ভালো কথা বললে দিনটা ভালো যায়। সে ঠিক আছে। কিন্তু, যা বলছেন সেটা বিশ্বাস করেন? না, না, ব্যাপারটাকে পারসোনালি নেবেন না। আমার আপনার মতো লোকের জেনেরিক সমস্যা হিসেবে বলছি। আমরা সমাধান জানি না এমন সমস্যা তো বোধহয় ভূভারতে নেই! তাই পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের করতে অসুবিধে হয় না। নাগরিক পঞ্জি থেকে জৈব চাষ, জলের আকাল থেকে ট্রাম্পের বিদেশ নীতি। এত কনফিডেন্স কোত্থেকে আসে মশাই? সমাজে যা যা হবে বলে সেই কবে থেকে বলে আসছি সব তো তার উল্টো উল্টো হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ নিয়ে ইদানীং যা বলা শুরু করেছি সেগুলো অবশ্য শুনতে ভালোই লাগছে। কারণ আমরা তো আর কোদাল কুপিয়ে চাষ করতে বা জল ধরে রাখতে যাচ্ছি না।
যাক গে। যে কোন কথাতেই দুই বুড়োকে টেনে আনা একটা বাতিক হয়ে যাচ্ছে, তবু তত্ত্বালোচনার চেয়ে ওই বুড়োদের গল্প করাই বরং ভালো। সবাই জানে, দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনটাতে গান্ধী বেলেঘাটায় ছিলেন। সারা দিন কাটিয়েছেন উপবাস আর প্রার্থনায়। যে দিনটার জন্য দীর্ঘ দীর্ঘ বছর নিরলস পথ হেঁটেছেন সেই দিনে পৌঁছে কী বলেছিলেন শুনেছেন? শোনেন নি। কেন, পণ্ডিত নেহরুর tryst with destiny তো মুখস্থ বলে দিতে পারবেন। না, দোষ আপনার নয়। বলি শুনুন, আরো কয়েক বছর পিছিয়ে যান। ভয়াবহ দাঙ্গার খবর পেয়ে নোয়াখালি যাচ্ছেন গান্ধী। যাওয়ার পথে বলছেন, এখন দেশের আর কোথাও আমার অন্য কোন কাজ নেই। এখন শুধু ওই গ্রামগুলোতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হবে। কারণ, পথ দেখতে পাচ্ছি না। চল্লিশ বছর ধরে যে সত্য আর অহিংসার ওপর ভরসা করেছি এখন সেটা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। তারপর জীবনের বাকি বছরগুলো এই আত্মহননের আগুন নেভানোর জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন নোয়াখালি থেকে বিহার, কলকাতা, দিল্লী, পাঞ্জাব। প্রার্থনা করেছেন, শান্ত হতে বলেছেন, অনুতপ্ত হতে বলেছেন, ভালোবাসতে বলেছেন কিন্তু মিছে আশা দিয়ে বলেন নি যে এই পথেই মুক্তি। স্বীকার করেছেন, তিনিও পথ খুঁজছেন, তাই ১২৫ বছর বাঁচতে হবে ওঁকে। বেলেঘাটার রাস্তায় চোখের সামনে সন্তানকে হত হতে দেখলেন যে মা, তাঁকেও সান্ত্বনা দেন নি। বলেছেন, যিনি তোমাকে সন্তান দিয়েছেন তিনিই ফিরিয়ে নিয়েছেন, কাঁদছো কেন। আর তো কিছু বলার ছিল না। সেদিনও কিছু বলার ছিল না যেদিন বড়ো বেদনার মতো এলো তাঁর স্বরাজ। দুদিন ধরে বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দেশ বিদেশের যতো সংবাদ মাধ্যম। বহু কাঙ্ক্ষিত স্বরাজ লাভের ঐতিহাসিক দিনে মিস্টার গ্যান্ডি কী বলেন শোনার জন্য। মিস্টার গান্ধী বলছেন একটাই কথা। ওঁর কিছুই বলার নেই। নাছোড়বান্দা সাংবাদিকের দল সে কথা শুনবে কেন। ওদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নির্মল কুমার বসু। বি বি সি’র সাংবাদিক এত জ্বালাচ্ছিল যে নির্মল কুমার বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতর এসে বললেন, আর তো পারা যাচ্ছে না, আপনি না হয় কিছু একটা বলেই দিন। বাপু বললেন, ওদের বলো, আমি যে ইংরেজি বলতে পারি সে কথা ভুলে যেতে।
বুঝেছেন, একে বলে সততা। আপনার ব্লগবিহারী ফেসবুক বিপ্লবীরা আর কিছু না হোক বাপুর কাছ থেকে এই সৎ আত্মঅনুসন্ধানটুকুও শিখলে দেখতে পেতেন সমাজকে দেখায়, মানুষকে দেখায় কত কিছুই শিখতে বাকি। বস্তুত, মানুষকে তো ওঁরা দেখতেই চান নি, উৎপাদন সম্পর্ক আর শ্রেণী সংগ্রামের বাই প্রোডাক্ট ধরে নিয়ে রণনীতি আর রণকৌশলের অঙ্ক কষা নিয়ে মেতে থেকেছেন। যাই হোক, বিপ্লবীদের ব্যাপার স্যাপার ওঁরাই বুঝুন। তবে আপনি একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখতে পারেন। আমরা জানি, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এখানের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে গান্ধী ধীরে ধীরে জাতীয় আন্দোলনের আর কংগ্রেস সংগঠনের মেজাজ, চরিত্র পালটে ফেলছিলেন। লক্ষ্য করুন, এই পালটে ফেলার গোড়ার ধারণাটা ছিল স্বরাজ মানে শুধু যেনতেন প্রকারেণ ব্রিটিশদের বিদায় করা নয়। বাকি সব বন্ধনগুলো থেকেও মুক্তি। উচ্চবর্ণের হাতে অবমাননা থেকে, সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ থেকে, ব্যক্তিজীবনে লোভ আর বাসনা থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় বেশ কয়েকবার ওঁকে ইংল্যান্ড যেতে হয়েছিল আর সেই সময় পরিচিত হন তলস্তয়ের ভাবনার সাথে। তলস্তয়ও তখন সাহিত্য সৃষ্টি থেকে দার্শনিক, রাজনৈতিক ভাবনায়, লেখালেখিতে বেশি সময় দিচ্ছেন। লিখছিলেন, কুসংস্কারমুক্ত কোন লোককে বলে দেখুন একটা সওদাগর সংস্থা দু’ কোটি মানুষের একটা জাতিকে পরাধীন করে রেখেছে, লোকটা বুঝতেই পারবে না কথাটার মানে কী? তিরিশ হাজার লোক, কেউ তারা মোটেই ব্যায়ামবীর নয়, বরং রুগ্ন সাধারণ লোকজন, তারা দু’ কোটি প্রাণবন্ত, চতুর, দক্ষ, স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষকে পরাধীন করে রেখেছে - কী অর্থ হতে পারে কথাটার? এটাই বোঝা যাচ্ছে না কি যে ইংরেজরা নয়, ভারতীয়রাই নিজেদের পরাধীন করে রেখেছে? কথাটা মনে ধরেছিল তরুণ মোহনদাসের। তারপর সারা জীবন ধরে নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করেছেন পরাধীনতার এই বাঁধনগুলো, খুঁজেছেন বন্ধন থেকে উত্তরণের পথ। নিরলস বলার চেষ্টা করেছেন অস্পৃশ্যতা দূর করা, গ্রাম অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, হিন্দু মুসলিম ঐক্য, মদ্যপান নিবারণ এইসব কর্মসুচীর কোনটাই রাজনৈতিক স্বাধীনতার কর্মসূচী থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গোলটেবিল বৈঠকের সময় লন্ডন থেকে একবার যুক্তরাষ্ট্রে বেতার ভাষণ দিচ্ছিলেন। তার আগে এ রকম অভিজ্ঞতা ছিল না, যন্ত্রপাতিগুলোও অচেনা, তাই ভাষণ শুরুর আগে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় কথা বলতে হবে গো, এখানে বুঝি? জানতেন না যে ততক্ষণে ‘অন’ হয়ে গেছেন, তাই মহাসাগরের ওপারের শ্রোতারাও শুনলেন সে কথা। আর তারপর শুনলেন, এই অদ্ভুত মানুষটি বলছেন ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলন এযাবৎ অন্য সব জাতীয় মুক্তি লড়াইয়ের থেকে আলাদা। কারণ আমরা শুধু আমাদের মুক্তির জন্য লড়ছি না, মানুষের মুক্তির জন্য লড়ছি। কাউকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, সবাইকে আপন করে কাছে টেনে নেওয়ার জন্য।
অবিশ্যি এও ঠিক যে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী, অনুগামীরা ঠিক এরকম ভাবে দেখতেন না। ঘনিষ্ঠ বৃত্তে কুমারাপ্পার মতো কয়েকজন সহকর্মীর কথা বাদ দিলে বাকিরা বাপু বলছেন বলেই মেনে নিতেন। পণ্ডিত নেহরু যেমন হিন্দু-মুসলিম সমস্যাকে ব্রিটিশের divide and rule এজেন্ডার বাইরে দেখতে চাইতেন না। ভরসা করতেন মানুষের শ্রেণীচেতনার ওপর। মুসলিম লীগ আর হিন্দু মহাসভার নেতারা যতোই উস্কানি দিক শেষ পর্যন্ত সাধারণ দরিদ্র কৃষক তাঁদের শ্রেণীশত্রুদের চিনতে পারবেন। আশা করতেন দেশ স্বাধীন হলে, আধুনিক শিল্প অর্থনীতির প্রসার হলে ধর্মীয় পরিচয়ের ভেদাভেদ এমনিই মুছে যাবে। কী হয়েছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কথা হল, পণ্ডিতজী শোপেনহাওয়ার পড়েন নি? মানুষের মধ্যে নিহিত অদম্য বাসনার তত্ত্বের কথা শোনেন নি। শুনেছিলেন। শোপেনহাওয়ারের গুণগ্রাহীও ছিলেন। কিন্তু মেজাজের দিক থেকে দুজন ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর। গত শতাব্দী যে যুগান্তকারী পরিবর্তনের আশা নিয়ে এসেছিল নেহরু ছিলেন সেই আশার আলোয় স্নাত। আধুনিক প্রযুক্তি আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানুষের সব কালো সব অন্ধকার মুছে ফেলবে এই উদ্দীপনার মেজাজ শুনতেই চাইবে না যে অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে মানুষের নিজের মধ্যেও। নবযুগ আনার ব্যস্ততার মুখে ‘বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়’ সে কূট আলোচনাও যে পাপ।
উল্টোদিকে শোপেনহাওয়ারকে আচ্ছন্ন করেছিল বিপ্লব পরবর্তী যুদ্ধক্লান্ত ইউরোপের বিষণ্ণতা। অসামান্য প্রতিভাধর হলে কি হবে, ওঁরও ছিল আমার আপনার মতোই মন খারাপের ব্যামো। ব্যক্তিগত জীবনেও নিঃসঙ্গতা। সেই জন্যেই হয়তো উপনিষদ নিত্য পাঠ্য হলেও উপনিষদের শান্ত, উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিস্ময়মুগ্ধ মেজাজ ওঁকে স্পর্শ করে নি। জগতময় অখণ্ড সত্তার ধারণা গ্রহণ করলেও ঈশোপনিষদের সর্বব্যাপি, জ্যোতির্ময়, শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ সত্তাকে খুঁজে পান নি। দেখতে পেয়েছেন জগতব্যাপী অশুভ বাসনার ঘন অন্ধকার। যে বাসনার করাল গ্রাস থেকে মানুষের রেহাই নেই। থাকবে কি করে। বাসনাই তো মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। বাসনা তৃপ্তির নিরন্তর চেষ্টার পরেও বাসনা অতৃপ্তই থাকবে। ভিক্ষা যেমন ভিক্ষুকের ক্ষুধার নিবৃত্তি করে না শুধু আরো ভিক্ষা চাওয়ার জন্যে বাঁচিয়ে রাখে। মৃত্যু ছাড়া তো এই খিদের অবসান নেই। শোপেনহাওয়ার বলবেন, মৃত্যুতেও নেই। ব্যক্তি মানুষের মৃত্যু হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাসনার অপ্রতিহত যাত্রা। তাহলে, হের দার্শনিক, আমাদের কি কোন গতিই নেই? জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। শোপেনহাওয়ার কিন্তু বলবেন না, যে, না কোন গতিই নেই। হাজার হোক, জার্মান তো। কৌশিকের মতো ‘আর ভাই!’ বলে বসে থাকতে পারেন না। বলবেন, আছে, সচেতন বুদ্ধির একটাই উপায় আছে অচেতন বাসনাকে হারিয়ে দেওয়ার। আত্মহত্যা! ব্যাস, বাসনার সব জারিজুরি বন্ধ। বুদ্ধির নিরঙ্কুশ জয়।
তাই বলছিলাম, শোপেনহাওয়ারকে বেশি ঘাঁটাবেন না। আপনি দুর্বল চিত্ত মানুষ। প্রবন্ধ লিখছেন লিখুন। সাবজেক্টের কি অভাব নাকি মশাই। নাগরিক পঞ্জি, জৈব চাষ এসব একঘেয়ে হয়ে গেলে গ্রেটা থুনবার্গ, বিল গেটস এবং করোনা চক্রান্ত, বিশ্বভারতীর পাঁচিল। ইস্যু আসতেই থাকবে। শুধু যাই বলুন না কেন শেষে একটু আশা ছুঁইয়ে রাখবেন। তা না হলে বাজারে দুর্নাম হবে আর একলা পড়ার টেবিলের আশেপাশে শোপেনহাওয়ার ঘুরঘুর করতে পারেন। সব ব্যাপারে সমাধান বাতলানো চাপের ব্যাপার বলছেন। আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না। কায়দাটা শিখলেন না এখনো? শুনুন, যে ইস্যু নিয়ে লিখবেন - করোনা ভাইরাস, রবীন্দ্রনাথ বহিরাগত কিনা, অনলাইন ক্লাস বাঞ্ছনীয় কিনা, যাই হোক - প্রথমে বেশ খানিক বিশ্লেষণ করে আপনাকে দেখাতে হবে সমস্যাটি একচেটিয়া পুঁজির দাপটের ফলশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যাস। হয়ে গেল। আপনার কাজ মোটামুটি শেষ। কারণ পুঁজির মোকাবিলা কী করে করতে হবে সে আবার আপনাকে বলে দিতে হবে নাকি। আর্কাইভ ভর্তি বই আছে, যার দরকার দেখে নিতে পারে। আর তাছাড়া আমাকে আপনাকে তার জন্যে বিশেষ কিছু করতেও হবে না। পুঁজির এই হয়ে এল বলে। বিপ্লবীরা তো তাই বলেন। সঙ্কট ঘনায়মান। বিশ্বাস হয় না বলছেন? এই দ্যাখো! বিশ্বাস করতে কে বলেছে। আশা করতে হবে আপনাকে। আর আশাবাদী হওয়ার এই হলো খাঁটি যুক্তিবাদী পদ্ধতি।
দারা শিকো মহাভারতেরও একটা অনুবাদ করলেন না কেন? সাইজ দেখে ঘাবড়ে গেছলেন? রাজশেখর বসুর মতো কাটছাঁট করে নিতে পারতেন। তাহলে হয়তো শোপেনহাওয়ার মহাভারত পড়ারও সুযোগ পেতেন। ভারি খুশি হতেন বক আর যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নোত্তর শুনে। বার্তা কী? এই মহামোহরূপ কটাহে কাল প্রাণিসমূহকে পাক করছে। মাস-ঋতু তার আলোড়নের দর্বি। এই বার্তা। সাধু, সাধু, শোপেনহাওয়ার বলতে পারতেন, কান্টও বলেছেন টাইম আর স্পেস ফেনোমেনানের হাতা খুন্তি বই নয়। আশ্চর্য কী? প্রাণিগণ প্রত্যহ যমালয়ে যাচ্ছে, তথাপি অবশিষ্ট সকলে চিরজীবী হতে চায়, এর চেয়ে আশ্চর্য কি আছে? নাঃ, এইটা কেমন উত্তর হল। নেহাত বকের রূপ ধরে ধর্ম প্রশ্নগুলো করছিলেন তাই যুধিষ্ঠির পার পেয়ে গেলেন। শোপেনহাওয়ার প্রশ্নকর্তা হলে ধর্মপুত্র পাশ করতেন না। এতে আশ্চর্যের কি দেখলে হে? প্রাণিগণকে এর চেয়ে যুক্তিশীল আচরণ করতে আবার কবে দেখলে। চাকরিবাকরি নেই, যাদের ছিল তাদেরও হয় তিরিশ শতাংশ মাইনে ধরিয়ে দিচ্ছে কিম্বা তাড়িয়ে দিয়েছে অথচ ব্যাটাদের রাত্তিরে ঘুম হচ্ছে না ফিল্মের হিরো কেন মরল তাই নিয়ে। বাসনা, বুঝেছ হে, অন্ধ বাসনা। হাতের কাছে কাউকে একটা চাই সবাই মিলে কিল মারার জন্য, ট্রোল করার জন্য, রাস্তায় থেঁতলে দেওয়ার জন্য। রামলালার পার্মানেন্ট রেসিডেন্স হয়ে গেল কিন্তু মুসলিমগুলো চুপ মেরে গেছে। তাহলে আর ওহি বানায়েঙ্গে বলে লাভ কি হল? নতুন কিছু চাই। হিরোর একটা বাঙালি গার্ল ফ্রেন্ড ছিল না? ওই নিশ্চই কিছু করেছে। হে ধর্মপুত্র, আপনি শুনেছেন আপনার আর্যাবর্তের উচ্চশিক্ষাবিদ্যালয়ে যুবক যুবতীরা এখন বিশ্বাস করছে বাঙ্গালী মেয়েরা কালা যাদু জানে। বাঙ্গালীরা তো সব মুসলমান। কেন নয়? ওরা তো বাঙ্গলাদেশী, হিন্দিও বলে না, দাড়িওলা কবির ছবি দেওয়া টিশার্ট পরে, ওই কবিটাও তো হিন্দু ছিল না।
আশ্চর্য নয়? মানুষকে যুক্তিশীল বলে আশা করেছিলেন, ধর্মপুত্র? হ্যাঁ, যুক্তির চর্চাও করেন কেউ কেউ। আপনি ফেসবুক করেন নি, জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব? সঞ্জয় তো করতেন। ওই দেখেই তো অন্ধ কুরুপতিকে যুদ্ধের বর্ণনা দিতেন। আপনিও ফেসবুকে যেয়ে দেখুন যুক্তিশীলরা এসব দেখে শুনে আশায় উল্লসিত। সঙ্কট পেকে উঠেছে। এই তো বিপ্লবের মহালগ্ন। বন্ধুগণ, আমি আগেই বলেছিলাম। জার্মানদেশীয় পণ্ডিতের আর কি দোষ বলুন? নিজের গলায় নিজেই এমন জয়মাল্য পরানোর চেয়ে এক গাছা দড়ি ...।
আট
আড়মোড়া ভাঙতেই পুরোনো কফিন চৌচির। বাঁচতে চায় বলে মৃতরা যে যার লাশ আর লাশ গুলো মাপ মত পায়জামা খুঁজে ঢুকে পড়ল তার ভিতরে।এতদিনের ঠান্ডা শরীরে উত্তাপ ফিরছে দেখে মমি রক্ষনাবেক্ষনে যারা ছিল তাদের অনির্দিষ্ট কাল ছুটি ও ব্যাজার মুখ।
কতকাল পরে এরা বাঁচতে শিখছে দেখে পলাশ আরো লাল হল। কেউ দেখেনি। পাখি’রা বহুদিন বাদে গানে ফিরলো। কেউ শোনেনি। আকাশ আরো নীল, উঁকি দিল কৃত্তিকা। বাঁচবে বলে এ শহর ভুল উল্লাস ছেড়ে উড়াল দিয়েছে ছায়াপথে। আকাশগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে পুরোনো পালক।
নয়
এ একটা ভাঙাচোরা ক্যারাভান অথবা নূহের নৌকো। মরুসমুদ্রে ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই। উথালি পাথালি নাও বুক চেপে উগরে দিচ্ছে ভয় আর শ্বাসকষ্ট। অকরুণ আগুন পুড়িয়ে দিচ্ছে চোখ, চুল, পায়ের পাতা আর হিমস্রোতে কুঁকড়ে যাচ্ছে কেউ। ক্লান্তিহীন উজানে চোখে জুড়ে ইঁদুরের মৃত্যু ভয় অথবা আরারাত পাহাড়। ফ্যাসফ্যাসে শুকনো গলায় ঈশ্বর ও তার দালালদের অভিশাপ দিযে লুটিয়ে পড়লো কেউ। ওরা হাঁটছে। পায়ে পায়ে ধুলোমেঘ। কতকগুলো চলমান ধুলোমেঘ আরারাত পাহাড়ের খোঁজে সারারাত্রি হেঁটেছে। নষ্ট বলতে কয়েকটা ইঁদুর।