সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ এক লোকসংগীত শিল্পী শিবব্রত কর্মকার এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে লোকান্তরিত হলেন। ১৯৯০তে লোক বাদ্যযন্ত্র ও লালন ফকিরের ওপর রবীন্দ্র সদনে ভ্রমরার এক পালাগান অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ও অনুষ্ঠানটি দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। ওই দিনই আলাপ করি শিবব্রতর সঙ্গে, সঙ্গে ছিলেন তথাগত চক্রবর্তী। অনুষ্ঠানের আগে বাংলার লোকসংগীত নিয়ে ভ্রমরার একটি পুস্তিকা বেরিয়েছিল, অধ্যাপক সুজিত ঘোষের অনুরোধে ওই পুস্তিকায় লোকসংগীত নিয়ে আমার প্রথম লেখা।
এরপর প্রতি রবিবার কাঁকুড়গাছিতে ভ্রমরার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যেতে আরম্ভ করি। গায়ক শিবব্রতর আরেকটি পরিচয় শিক্ষক শিবব্রতর সঙ্গে পরিচিত হই। অসাধারণ এই গায়ক কখনো আত্মপ্রচারমুখী হননি। খ্যাতি অর্জনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেননি। প্রচার মাধ্যম নিজেই এসেছে তাঁর কাছে, শিবব্রত ভ্রমরা শিল্প গোষ্ঠীকেই তুলে ধরেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরেছেন লোকশিল্পীদের সন্ধানে, মূল গায়কীর সন্ধানে মাঝে মাঝে অনেককে কলকাতায় নিয়ে এসেছেন, শিক্ষা শিবির করেছেন, ভ্রমরার অনুষ্ঠানে গাইয়েছেন বা যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের দিয়ে বাজিয়েছেন। তাঁদের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন, অর্থ সাহায্য করেছেন। এমন সব গান তিনি নিজেই, ভ্রমরার শিল্পীদের দিয়ে ও ‘বৃহত্তর’ সারা বাংলার শিল্পীদের দিয়ে গাইয়েছেন বা লোকবাদ্য ব্যবহার করিয়েছেন সেসব গান ও বাদ্যযন্ত্র সাধারণভাবে দেখাই যায় না। প্রতিমা বড়ুয়ার মতো শিল্পী বারবার এসে ভ্রমরার নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের গান শিখিয়েছেন। মাটির সঙ্গে যোগাযোগে ভ্রমরার যে মাটির মধ্যে লোকসংগীত এর শিকড় সেই শিকড়ের সন্ধান ও চর্চা সারা জীবন ভ্রমরার শিল্পীদের নিয়ে করে গেছেন।
‘গৌড়বচন’ নামে আমার একটি ছোট্ট কবিতা বেরিয়েছিল ১৯৮৯ সালে, যা মূলত বাংলার প্রাচীন ও লোকসংগীত উৎসের। শিবব্রতর বইটি পড়ে ভালো লেগেছিল, প্রস্তাব করলেন এগুলির সংগীত রূপ দেবেন। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। সমগ্র ভ্রমরা গোষ্ঠীকে নিয়ে ঋতবান ঘটকের Dat যন্ত্রে এর মধ্যে দশটির রেকর্ডিং হয়েছিল ১৯৯২তে। অসামান্য সুর করেছিলেন শিবব্রত, তেমনি সমবেত গায়কী ও বাদ্যবাদন।
এর পরে ঠিক হল মূলস্রোতের লোক শিল্পীদের নিয়ে বাংলার বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীতের রেকর্ডিং করা হবে ও শিকড়ের সন্ধানে নামে একটি ক্যাসেট সিরিজ হবে। তাই হলো। অরোরা স্টুডিওতে দুদিন ধরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকশিল্পীদের নিয়ে রেকর্ডিং হল, ক্যাসেট বেরোলো চার খণ্ডে, যাতে লোকসাধারণের মধ্যে বাংলার মাটির গান প্রচার পায়, সেখানে নেই নাগরিক সংযোজন।
এমন সব ধরনের কাজের সঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে গ্রাম গ্রামান্তরের শিল্পীদের নিয়ে কয়েকটি ওয়ার্কশপও পরিচালনা করেন। এগুলি খুব কার্যকর হয় এবং
সিডি-ও প্রকাশিত হয়েছিল।
শিবব্রতই একমাত্র বাঙালি, যিনি লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে পিট সিগার পুরস্কার-এ সম্মানিত হয়েছেন। দুই হাজার সালের গোড়ায় সেই অনুষ্ঠানে পিট সিগারের ভাইপো ও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাকে সম্মানিত করা হয়েছিল।
শিবব্রতর আদর্শ ছিল লোকসঙ্গীতের মূল সুরগুলো সংগ্রহ করা এবং সেইভাবে গায়নের শিক্ষা দেওয়া। অনেক লুপ্তপ্রায় গান তিনি সংগ্রহ করেছেন, বিরল বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বারবার প্রদর্শনী করেছেন আর তরুণ শিল্পীদের নিয়মিত শিক্ষা দিয়ে এসেছেন। এখনো তার স্ত্রী লক্ষ্মী এই ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন।
দীর্ঘ, ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে তাতে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি আমি।