সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতির এক আধার মনুসংহিতা। বর্তমান সময়েও ভারতীয় রাজনীতিতে মনুসংহিতা অন্যতম আলোচ্য বিষয়। মনুসংহিতায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে খাদ্য নিয়েও নানা বিধিনিষেধের কথা বলা আছে। ভক্ষ্য ও অভক্ষ্য বিষয়ে সেখানে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেখানেও বৈষম্য রয়েছে। যেমন পঞ্চম অধ্যায়ের ৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, রশুন, গৃঞ্জন (গাজর), পলাণ্ডু (পেঁয়াজ), কবক অর্থাৎ ছত্রাক (ব্যাঙের ছাতা), এবং মলমূত্রাদিপরিপূর্ণ দূষিত স্থানে উৎপন্ন শাকপ্রভৃতি দ্রব্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য এই বর্ণত্রয়ের পক্ষে অভক্ষ্য কিন্তু শূদ্র যদি এইসব ভোজন করে, তাহ’লে দোষের হয় না।
৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, রক্তবর্ণ বৃক্ষনির্যাস – যা কঠিনতা প্রাপ্ত হয়েছে, ব্রশ্চন অর্থাৎ বৃক্ষচ্ছেদন, তার ফলে নির্গত নির্যাস শেলু অর্থাৎ চালতা, এবং নবপ্রসূতা (প্রসবের পর দশ দিন অতিক্রান্ত হয় নি এমন ) গরুর পেয়ুষ [সদ্যঃপ্রসূতা গোরুর দুধকে আগুনের তাপে কঠিন করা হ’লে তাকে পেয়ুষ বলা হয়] – এই সব জিনিস ব্রাহ্মণ সযত্নে বর্জন করবেন।
১৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, যে যার মাংস খায় তাকে ‘তন্মাংসাদ’ তার মাংসভোজী বলে (যেমন, বিড়াল ইঁদুরের মাংস খায়, তাই বিড়াল মূষিকাদ’, নকুল অর্থাৎ বেজী ‘সপার্দ’); কিন্তু যে ‘মৎসাদ’ অর্থাৎ মৎস্যভোজী, তাকে সর্বমাংসভোজী বলা চলে। (এমন কি তাকে ‘গো-মাংসদ’ও বলা যায়)। অতএব মতস্য-ভোজনে যখন বিষম পাপ হয়, তখন তা পরিত্যাগ করিবে।
পরের শ্লোক অর্থাৎ ১৬ নং শ্লোকেই আবার বলা হয়েছে, মাছের মধ্যে পাঠীন অর্থাৎ বোয়াল মাছ এবং রোহিত (রুই মাছ), রাজীব (যে মাছের গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে), সিংহতুণ্ড (যে মাছের মুখের আকৃতি সিংহের মতো) এবং শল্ক অর্থাৎ আঁস-বিশিষ্ট সকল মাছ হব্য এবং কব্যে অর্থাৎ দেবকার্যে ও পিতৃকার্যে নিবেদন করার পর খাওয়া যায়।
১৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, পঞ্চনখ প্রাণীদের মধ্যে শ্বাবিধ (শজারু), শল্যক (শজারুসদৃশ স্থূললোমযুক্ত প্রাণী), গোধা অর্থাৎ গোসাপ, গণ্ডার, কূর্ম (কচ্ছপ), শশক (খরগোস) – এই ছয়টি ভোজন করা যায়। একতোদৎ অর্থাৎ এক পাটী দাঁত বিশিষ্ট পশুদের মধ্যে উট ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর (যথা, গরু, মেষ, ছাগল, হরিণ) মাংস ভোজ্যরূপে গ্রহণ করা যায়।
২৭ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, প্রোক্ষিত অর্থাৎ যজ্ঞের হুতাবশিষ্ট মাংস ভোজন করবে। বহু ব্রাহ্মণের অনুমতিতে মাংস ভক্ষণ করা যায়। যথাশাস্ত্র শ্রাদ্ধাদিতে নিযুক্ত মাংস ভক্ষণ করা যায়। খাদ্যদ্রব্যের অভাবে প্রাণসংশয় উপস্থিত হ’লেও মাংস ভক্ষণ করা যায়।
৪৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, প্রাণি-হিংসা না করলে মাংস উৎপন্ন হয় না; কিন্তু প্রাণি-বধ স্বর্গজনক নয় (অর্থাৎ নরকবাসের কারণ)। অতএব অবিহিত মাংস ভোজন করবে না।
আবার ৫৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, অনিষিদ্ধ মাংস ভোজনে কোনও দোষ নেই, ক্ষত্রিয়াদির পক্ষে মদ্যপানেও কোনও দোষ নেই এবং বৈধ মৈথুনেও কোনও পাপ হয় না। এইগুলিতে মানুষের স্বভাবসিদ্ধ প্রবৃত্তিই হ’য়ে থাকে (অতএব এই তিনটি ক্ষেত্রে কোনও দোষ হয় না)। তবে এগুলি থেকে নিবৃত্ত হওয়াই মহাফলজনক।
কিন্তু একাদশ অধ্যায়ের ৯৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, সুরা হ’ল অন্নের মলস্বরূপ; আবার পাপকে মল বলা হয়। এই কারণে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এদের পক্ষে সুরাপান করা কর্তব্য নয়। (মনুসংহিতা, সম্পাদনা ও অনুবাদঃ অধ্যাপক ডঃ মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শাস্ত্রী, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার)
স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর ‘বাঙালি মধ্যবিত্তের ধর্মটর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রান্নাবান্নার আগে ঠাকুরমা দাদুকে জিজ্ঞাসা করে নিতেন – আজকে কী তিথি? – নির্দিষ্ট কিছু তিথিতে নির্দিষ্ট কিছু সবজি নিষিদ্ধ। যেমন ত্রয়োদশীতে বেগুন, প্রতিপদে কুমড়ো, তৃতীয়াতে পটল, চতুর্থীতে মুলো, নবমীতে লাউ খাওয়া চলত না।’
‘বৃহৎ লক্ষ্মীচরিত্র’তে লক্ষ্মী ব্রত কথায় কবে কী খাওয়া নিষিদ্ধ সে বিষয়ে বিধান দেওয়া হয়েছে।
“পঞ্চমীতে শ্রীফলে কলঙ্ক অতিশয়।
ষষ্ঠীতে খাইলে নিম্ব পশুযোনি হয়॥
তাল খেলে দেহনাশ সপ্তমীর যোগে।
অষ্টমীতে মূর্খ হয় নারিকেল ভোগে॥
অলাবু গো-মাংস তুল্য নবমী তিথিতে।
দশমীতে কুক্কুট ভক্ষণ কলম্বীতে॥
শিমে মহাপাপ একাদশীর নিয়ম।
দ্বাদশীতে পুঁইশাক ব্রহ্মহত্যা সম॥
ত্রয়োদশী তিথিতে বার্ত্তাকু যদি খায়।
নিশ্চয় তাহাতে জেনো পুত্রহানি হয়॥
চতুর্দ্দশী তিথিতে যেবা নরগণে।
চিররোগী হয় মাষকলাই ভক্ষণে॥
অমাবস্যা পূর্ণিমাতে যদি খায় মাংস।
পূর্ণরূপে মহাপাপ প্রকাশে পাপাংশ॥”
ধর্মীয় অনুশাসনের কারণেই এদেশে হিন্দু বিধবাদের মাছ-মাংস খাওয়া নিয়ে কঠোর বিধি নিষেধ চালু ছিল। এমনকি একাদশীর দিন নির্জলা উপবাস থাকতে হতো। জলও খাওয়া যেত না। বৃদ্ধ কুলিন ব্রাহ্মণের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালিকা স্ত্রী যার সব কিছু বুঝে ওঠার সময়ই হয়নি তাকেও বৈধব্য পালনের অজুহাতে খাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হত।
বিভিন্ন পুজোর জন্য উপোস বা ব্রত পালনের সময়ও নানা বিধি নিষেধ মানা হয়। কিছু কিছু পরিবারে এই বিধির পরিবর্তন হলেও এখনো বহু পরিবারে তা মেনে চলা হয়। সারা বছর ধরে নানা ধরনের পুজো এবং ব্রত পালন করার সময় উপোস থাকার কারণে অনেকেই আলসার সহ গ্যাস অম্বলের রোগে ভোগেন।
বিগত শতাব্দীর সাতের দশকে হঠাৎ করেই ‘জয় সন্তোষী মা’র আবির্ভাবে গ্রাম বাংলা জুড়ে চালু হয়ে যায় প্রতি শুক্রবারে সন্তোষীমাতার পুজো। ছোলা ও গুড় দিয়ে পুজো করা এবং শুক্রবারে টক খাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যদিও বর্তমানে এর প্রভাব কিছুটা কমেছে, তবু অনেক বাড়িতেই শুক্রবারে টক না খাওয়ার এই প্রথা চালু রয়েছে।
সোমব্রত সরকার তাঁর ‘তান্ত্রিকের রান্না’ গ্রন্থে তান্ত্রিকদের রান্নার নানা উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বক্রেশ্বরের অঘোরী সাধকদের পরম্পরাতে দেখেছি শ্মশানে মড়া এলেই অঘোরীরা প্রস্তুত হয়ে উঠতেন কখন ডোম চিতায় জ্বলা মড়ার মাথা ফাটিয়ে দেবেন বাঁশ দিয়ে। ফাটানো মাত্রই অঘোরী তান্ত্রিক ওই ভোগলা মাথার নীচে গিয়ে চিতার আঁচ বাঁচিয়ে কপালপাত্র ধরবেন। অখান হতে বের হওয়া ঘিলুরস এনে তিনি চিতার নিভুনিভু আঁচে ভাত বসাবেন। সেই ভাতের সঙ্গে মড়ার মাথার ঘিলুরস মিশিয়ে তিনি ভোগ দেবেন এবার মায়ের। তারপর সেই প্রসাদই তিনি পরম তৃপ্তি ভরে গ্রহণ করবেন।’ (তান্ত্রিকের রান্না, সোমব্রত সরকার, মান্দাস, ২০২৪)। আপনি, আমি বাজারে প্রচলিত আড়াই প্যাচের জিলাপি খেতে অভ্যস্ত হলেও তন্ত্রসাধকরা সাড়ে তিন প্যাচের জিলাপি খান।
মিলন দত্ত তাঁর ‘বাঙালির খাদ্যকোষ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইসলাম ধর্মানুসারে বৈধ ও পবিত্র হল হালাল আর অবৈধ ও নিষিদ্ধ হল হারাম। খাদ্যের ক্ষেত্রেও এই নির্দেশ প্রযোজ্য। মুসলমানের বিভিন্ন কাজ এবং জীবনাচরণের ক্ষেত্রে হালাল হারামের বিধি ও নির্দেশ কঠোরভাবে মানা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বেই বিশ্বাসী মুসলমান হালাল খাদ্য খেতে চান। আল্লার নাম নিয়ে গলার নলি কেটে প্রাণী বধ করলে তবে সেই মাংস হালাল। এক কোপে গলা কেটে বধ করলে সেই প্রাণীর মাংস হারাম। … মুসলমানদের জন্য কোন কোন জন্তুর মাংস হালাল বা হারাম তাও বিশদে বলা আছে কোরানে। কোরানে দশ রকমের মাংস হারাম বলে উল্লেখ রয়েছে।’
‘সূরা বকরা’তে বলা হয়ছে, ‘তোমাদিগের সম্বন্ধে শব, শোণিত ও বরাহমাংস এবং যাহা ঈশ্বর ভিন্ন অন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলি প্রদত্ত হইয়াছে ইহা বৈ নিষিদ্ধ নহে, পরন্তু যে ব্যক্তি অত্যাচার ও সীমা লঙ্ঘন না করিয়া বিপদাকুল হইয়াছে তাহার পক্ষে দোষ নাই, নিশ্চয় ঈশ্বর ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ একই কথা বলা হয়েছে, ‘সূরা নহল’-এ। ‘তোমাদের সম্বন্ধে শব, শোণিত, বরাহ-মাংস এবং যাহার উপর ঈশ্বর ভিন্ন (অন্য দেবতার) নাম গৃহীত হইয়াছে, এতদ্ভিন্ন অবৈধ নহে; পরন্তু যে ব্যক্তি (ক্ষুধায়) কাতর হইয়া পড়ে অমিতাচারী ও অত্যাচারী নয় (তাহার পক্ষে সে সকল বৈধ,) অপিচ নিশ্চয় ঈশ্বর ক্ষমাশীল, দয়ালু। ‘সুরা মায়দা’ তে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যাহা জব করিয়াছ তদ্ব্যতীত শব ও শোণিত এবং বরাহমাংস, ও যাহা ঈশ্বর ব্যতীত অন্য দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হইয়াছে এবং গলা চাপায় মরিয়াছে ও যষ্টির আঘাতে মরিয়াছে, এবং উচ্চস্থান হইতে পড়িয়া মরিয়াছে, ও শৃঙ্গাঘাতে মরিয়াছে, এবং যাহা হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করিয়াছে (এ সকল) তোমাদিগের প্রতি অবৈধ; এবং নির্দিষ্ট স্থান সকলে জব করা হইয়াছে, আজলাম যোগে তোমরা যাহা বিভাগ কর (অবৈধ) ইহা দুষ্কর্ম; অদ্য কাফেরগণ তোমাদের ধর্মে নিরাশ হইয়াছে, অনন্তর তোমরা তাহাদিগকে ভয় করিও না, এবং আমাকে ভয় করিও, অদ্য আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করিয়াছি, এবং আমার দান তোমাদের সম্বন্ধে পূর্ণ করিয়াছি, তোমাদের জন্য এসলামকে ধর্মরূপে মনোনীত করিয়াছি, অনন্তর যে ব্যক্তি পাপের প্রতি অননুরক্ত ক্ষুধায় কাতর, পরে নিশ্চয় ঈশ্বর (তাহার) ক্ষমাকারী ও অনুগ্রহকারী।’
মদ্যপান করাও কোরানে নিষিদ্ধ। ‘সূরা বকরা’তে বলা হয়েছে, ‘তাহারা সুরাপান ও দ্যূত ক্রীড়াবিষয়ে তোমাকে (হে মোহম্মদ,) প্রশ্ন করিতেছে, এই দুই বিষয়ে গুরুতর অপরাধ, এবং লোকের লাভও আছে; কিন্তু এই দুইয়ে লাভ অপেক্ষা অপরাধ গুরুতর অপরাধ।’ ‘সূরা মায়দা’তে বলা হয়েছে, ‘হে বিশ্বাসীগণ, সুরা, দ্যুতক্রীড়া, “নবস” (দেবাধিষ্ঠানভূমি) “আজলাম” (ভাগ্যনির্ধারণের বাণাবলী) শয়তানের অপবিত্র ক্রিয়া ভিন্ন নহে, অতএব এ সকল হইতে নিবৃত্ত হও, ভরসা যে তোমরা মুক্ত হইবে।’ আরও বলা হয়েছে যে, ‘সুরা ও দ্যূতক্রীড়াতে তোমাদিগের মধ্যে ঈর্ষা ও শত্রুতা স্থাপন এবং তোমাদিগকে ঈশ্বর স্মরণ হইতে ও উপাসনা হইতে নিবৃত্ত রাখা শয়তান ইহা ভিন্ন ইচ্ছা করে না, অনন্তর তোমরা কি নিবৃত্ত হইবে?’ (কোরান শরীফ, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অনুবাদিত, হরফ প্রকাশনী, Edition 2023)
রমজান মাসে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস থাকতে হয়। ভোরবেলা রোজা শুরুর আগে শেহরিতে একরকমের খাবার খেতে হয়, উপবাস ভাঙ্গার পর ইফতারে আরেকরকম এবং রাতে অন্যরকম ভোজনের আয়োজন হয়।
‘ইসলাম’ গ্রন্থে মিলন দত্ত লিখেছেন, ‘কুরবানির মাংসের তিনভাগের এক ভাগ মালিক, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও বাকি এক ভাগ দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করার নিয়ম।’
‘নামাজ থেকে ফিরে দুধে ভেজানো শুকনো খেজুর খাওয়া রেওয়াজ। ইদের খাওয়া-দাওয়ার আবশ্যিক অঙ্গ হল বিভিন্ন রকমের সিমাই, সেমাই বা সামাই। সেই সেমাইয়ের রান্নার রকমভেদও বিস্তর। সিমাই ছাড়াও ফিরনি, লাচ্ছা সেমাই, ক্ষীর এবং অন্যান্য মিষ্টি খাওয়ার চল রয়েছে।’ (ইসলাম, মিলন দত্ত)
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে ধর্মের ভিত্তিতে খাওয়া দাওয়া নিয়ে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি মানুষকে ঘর থেকে বের করে এনে খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের রাজ্যের সাবির মল্লিক নামে এক যুবক শ্রমিক হিসেবে হরিয়ানায় কাজ করতে গিয়ে গোমাংস খাওয়ার ‘অপরাধে’ খুন হয়ে গেলেন। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে মেরেছে গোরক্ষা কমিটির লোকজন। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ অগস্ট, ২০২৪) হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী এই ঘটনাকে মানুষের আবেগ বলে দায় সেরেছেন। অর্থাৎ তিনি প্রকারান্তরে আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব এড়িয়ে ‘মানুষের আবেগ’ বলে এই ঘটনাকে সমর্থন করলেন।
বিভিন্ন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা খাবারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করছেন। কখনও নবরাত্রি, কখনও রামনবমীতে নিরামিষ খাওয়ার বিধান দিচ্ছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক নির্বাচনী জনসভায় শ্রাবণ মাসে, নবরাত্রির সময় মাছ-মাংস খাওয়াকে মোগলদের মানসিকতা বলে বিরোধী দলের নেতৃত্বকে আক্রমণ করেছেন। বিজয়া দশমীর আগের নবরাত্রি বা দুর্গাপুজোর সময়, শ্রাবণ মাসে বা রামনবমীর আগে চৈত্র নবরাত্রিতে আমিষ খাওয়ার বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ধরেই প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হিন্দুত্ববাদীরা।
(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪)
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের আমরোহার একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের পাঁচ বছরের শিশুকে টিফিনে আমিষ খাবার নিয়ে আসার কারণে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
(আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)
আমাদের রাজ্যেও এই ঘটনা ঘটেছে। নবদ্বীপ এবং পুরুলিয়ায় জনপ্রতিনিধিরা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নিরামিষ খাওয়ার ‘আবেদন’ জানিয়েছেন।
ইতিহাসে ভিন্ন ধর্মের মানুষের ওপর জোর করে তাঁদের কাছে নিষিদ্ধ খাদ্য জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এবং খাদ্যের কারণে শাস্তি দেওয়ার অনেক ঘটনা আছে। পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা ‘খানা তল্লাশি’ থেকে এখানে দুটি উদাহরণ দেওয়া হল-
কোফতা ও ধর্মান্তরণ এবং শাস্তি
কোফতা (কোপ্তা) একটি জনপ্রিয় খাবার। এই শব্দটির উৎস পারস্য শব্দ ‘কোফতে’ থেকে যার অর্থ মাংসের কিমার মণ্ড বা গোলা। এই খাবার পদটিই একসময় স্পেনে ধর্ম পরিচিতি বোঝার এবং শাস্তির হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তরোয়ালের জোরে খ্রিষ্ট-ধর্মালম্বী মানুষের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। ইহুদিরা নিজেদের ধর্ম গোপন করতে খ্রিষ্টানদের দলে মিশে যেত গা ঢাকা দেওয়ার জন্য। সেই কারণে প্রকৃত ধর্ম জানার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল ভোজসভার। রাজা ভোজসভা আয়োজন করলে সেখানে আমন্ত্রিত সকল প্রজাদের উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক। সেই ভোজসভায় অন্যান্য পদের সঙ্গে শুয়োরের মাংস দিয়ে তৈরি কোফতাও পরিবেশন করা হত। খাওয়া শেষ হলে আমন্ত্রিতদের ধন্যবাদ জানানো হতো এবং যে পদগুলি খাওয়ার জন্য পরিবেশন করা হয়েছে তার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হতো। স্বাভাবিকভাবেই ইহুদিরা তাঁদের ধর্মে নিষিদ্ধ মাংসের কথা শুনে বমি করতে ছুটত। সেই সময় তাঁদের গ্রেফতার করে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো। আর যে সকল ব্যক্তি এই ধর্ম চিহ্নিতকরণের পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করত না তাঁদের সহজেই ইহুদি হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হতো।
ইনকুইজিশন ও ভিন্দালু
যোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে বিভিন্ন মিশনারির দল আমাদের দেশে এসেছে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারের জন্য। গরিব এবং নিম্নবর্ণের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছে কিছু পাওয়ার আশায়। ধর্মান্তর ঘটলেও নিজেদের পুরোনো সংস্কৃতি মানুষ ভুলতে পারেনি। তাই খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও সন্তানের অন্নপ্রাশনের সময় মন্দিরের প্রসাদ খাওয়ানো বা উপনয়ন অনুষ্ঠান করা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। খ্রিষ্ট ধর্মালম্বী মানুষের সংখ্যা বাড়লেও ধর্মান্তরিত পরিবারগুলিতে পুরোনো আচার পালন রয়েই গেল। এসব দেখে যাজকরা ভাবলেন তাঁদের ধর্মের পবিত্রতা বিপন্ন হচ্ছে। তাই ধর্মের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে ১৫৬০ সালে চালু হল ইনকুইজিশন। ধর্মান্তরের পাশাপাশি পুরনো ধর্মের কোনো আচার পালন করলে ধর্মান্তরিত পরিবারের ওপর নেমে আসত ভয়ানক শাস্তি। গোয়াতে আগের ধর্ম পালনের জন্য ১২১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল যার মধ্যে মহিলা ছিলেন ১৬ জন। শাস্তি দেওয়া হয়েছিল ৪০৪৬ জনকে যার মধ্যে মহিলা ছিলেন ১০১২ জন।
এই কারণে পর্তুগিজরা এদেশে এসে এখানাকার খাবার এবং নানা আচারে অভ্যস্ত হয়ে ঊঠলেও গোয়ার মানুষরা ভারতের সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পর্তুগালকে আঁকড়ে ধরল। সেই সময়ের পর্তুগিজ খাবার ‘কারনে দ্য ভিনো ই আলহোস’ (ওয়াইন, ভিনিগার, রসুন দিয়ে মাংসের একটি পদ) গোয়ায় ‘ভিন্দালু’ নামে পরিচিত হয়ে উঠল। তবে ভিনিগারের পরিবর্তে এখানে ব্যবহার হল তেঁতুল এবং কালো মরিচের মিশ্রণ। এই ভিন্দালু বর্তমানে পৃথিবীতে ভারতের এক সিগনেচার পদ হিসেবে পরিচিত।
(খানা তল্লাশি, পিনাকী ভট্টাচার্য, আনন্দ পাবলিশার্স)
রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থে খাদ্য নিয়ে বিভেদ তৈরি করতে ধর্মকে হাতিয়ার করছে। আমরা প্রচলিত একটি ছড়া দিয়ে আপাতত আমাদের কথা শেষ করতে পারি। -
‘ধর্ম যেদিন ক্লান্ত হবে,
ব্যর্থ হবে সকল ভয়।
বুঝবে খিদে ভাতেই মেটে,
বাইবেল, কোরাণ, গীতায় নয়।।’