সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
স্তব্ধ নদী খাত জুড়ে শুকনো বালির বহমান শূন্যতা, ভূ-গর্ভের পান-যোগ্য জলের স্তর ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে আরও গভীরতর অতল পাতালে, তপ্ত আর অ্যাসিডিফাই হয়ে উঠেছে মহাসাগর, জ্বলছে মাটি, দম বন্ধ হয়ে পড়েছে পৃথিবীর বাতাস। একের পর এক দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি। প্রতিদিন ঘর হারাচ্ছে, ঠাঁই-নাড়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। গৃহহীন, কর্মহীন, পথহারা, দিকভ্রষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। অবাঞ্ছিত, রবাহূত অসংখ্য শিশুর বিপন্ন মুখ। বিশ্বজুড়ে চলছে গণহত্যা, যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত মৃত, অঙ্গহীন, রক্তাক্ত শিশুদের স্তূপের চূড়ায় উড়ছে পৈশাচিক উল্লাসের বিজয় পতাকা। দ্রুত বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। অবিচ্ছিন্নভাবে ঘটমান অনাহার, খরা, বন্যা, অনির্বাণ দাবানল। জঙ্গল সাফ করার কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। প্রকৃতির দেওয়া সর্বজনীন সহায় ও জীবনদায়ী সম্বল কর্পোরেট দখলে চলে গেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর যা কিছু 'গণতান্ত্রিক' মুখোশ ও পর্দা ছিল - সব ছিন্নভিন্ন হয়ে খসে পড়েছে। নৈর্ব্যক্তিক 'সিস্টেম' এর আড়াল ও কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে এসেছে 'রক্ত করবী'র রাজা। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কারচুপির জোরে ক্ষমতাসীন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অনির্বাচিত এবং সেই কারণেই জবাবদিহি-মুক্ত গুটিকয় ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় গোটা পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিসরে অভূতপূর্ব অস্থিরতা।
এরই মধ্যে, হামাস-দমনের অজুহাতে ইস্রায়েলের প্যালেস্টাইন দখলের উন্মাদনা যেভাবে অবিরাম গণহত্যা ও গণ-হারে শিশু হত্যা গত পাঁচ মাস ধরে চালিয়ে যাচ্ছে, তার তুলনা হলোকাস্টের বীভৎসতাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। একদা, আটলান্টিসিজম-চালিত (পশ্চিম-ইউরোপ সহ ব্রিটিশ-আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়ার পুঁজি নিয়ন্ত্রিত জোট) এবং মুখ্যত আমেরিকার হয়ে নজরদারি করা, সোসালিস্ট রাশিয়ার আগ্রাসনকে আটকানো ও জ্বালানি তেল-সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, ইহুদি অভিবাসীদের দিয়ে দখল করে নেওয়া প্যালেস্টাইনের একটা অংশে পেন্টাগন নিয়ন্ত্রিত পুলিস ফাঁড়ি তৈরি করা হয়।
এটাই কালক্রমে ইস্রায়েল নামে একটা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনবাসীদের ওপর হিংস্রভাবে বলপ্রয়োগ করে, ইহুদিদের বহু-আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র - ইস্রায়েল তৈরি হয়। একসময়ে, হিটলারের জাতিবিদ্বেষের শিকার ইহুদিরাই এখন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে সবচেয়ে নৃশংস পদ্ধতিতে সবচাইতে বড় গণ-হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। মানসিক বিকারগ্রস্ত ইস্রায়েলের রাষ্ট্র প্রধান ও তার সেনারা নির্বিচারে হাজার হাজার শিশুকে লক্ষ্য করে ধারাবাহিকভাবে মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে চলেছে, নির্দ্ধিধায়। ইজরায়েলের রাষ্ট্রীয় কাঠামো, রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক অবস্থান ও নাগরিক সমাজের বৃহত্তর অংশের নীতিবোধ এতটাই আগ্রাসী জাতিবিদ্বেষ-সর্বস্ব ও যুদ্ধ-নির্ভর, যে সেই রাষ্ট্রের প্রধান নেতা, কেবল মাত্র, দুর্নীতির অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরিস্থিতি এড়ানোর উদ্দেশ্যে একটা নৃশংসতম যুদ্ধ এবং শিশু হত্যা চালিয়ে গেলেও, তার বিরুদ্ধে ইস্রায়েলের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না, বরং, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে। গাজার লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত নর-নারী-শিশুকে দিনের পর দিন অভুক্ত রেখে, তাদের ন্যূনতম চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করে, আশ্রয়হীন, অনাথ, মরতে থাকা শিশুদের ওপর ইস্রায়েলের সেনাবাহিনী গুলি চালাচ্ছে, মিসাইল আক্রমণ চালাচ্ছে। অসহায় গাজবাসীদের পাশে কেউ নেই। ইস্রায়েল ও আমেরিকার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করাটাই পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র নেতার মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য এতটাই সংকীর্ণ, যে গাজায় শিশুদের রক্ষা করার জন্য ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধের সার-শূন্যতাকে আড়াল করারও বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই, গাজার প্রতিবেশী ইসলামপন্থী দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধানদের। গাজায়, মা-মরা সদ্যজাত শিশুদের মুখে একটা দুধের বোতল অবধি পৌঁছে দিতে অক্ষম রাষ্ট্রপুূ্ঞ্জ থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব প্রভূত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নেতা ও তাদের নীতিবোধ। ইস্রায়েলের মতো একটা ছোট দেশের একজন আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র প্রধান, কেবলমাত্র ক্ষমতাচ্যুত না হওয়ার উদ্দেশ্যে তার দেশের মানুষদের ক্রমাগত যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ ধ্বংসের ফানুসের মধ্যে বন্দী রেখে সামরিক শাসন চালিয়ে যাচ্ছে আর অমানবিকতার সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নিজেকে সদম্ভে উপস্থাপন করার পরেও তার এই শিশু-ভুক পৈশাচিক উল্লাসকে থামিয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ কোন দেশ নিতে পারছে না। খুব সম্ভবত নিতে চাইছে না। এই ভাবে নির্বিচার গণহত্যা চালানোর নজির সব শাসকই তাদের দুর্বিনীত নাগরিকদের সামনে তুলে ধরতে চাইছে হয়তো। 'হয়তো' কেন? চাইছে শুধু নয়, যে যার নিজের দেশে প্রয়োগ করতেও শুরু করেছে। কখনও, ভাড়াটে সন্ত্রাসবাদীদের দিয়ে নিজের দেশের নাগরিকদের হত্যা করে, যুদ্ধ ও রাষ্ট্রবাদ নির্মিত উগ্র এবং আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ চাগিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা, অথবা, কর্পোরেট স্বার্থকে নিরঙ্কুশ রাখার তাগিদে নিজের দেশেরই নিরস্ত্র নাগরিকদের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে, যুদ্ধজয়ের নির্বোধ আস্ফালনকে সামনে রেখে নিষ্ঠুর জনপ্রিয় ভোট-কুশলি রাজনীতি-চর্চা। চারদিকে ভয়, অসহায়তা আর ক্ষমতাবানদের প্রসাদলাভের আশায় তাদের সুনজরে থাকার লোভ। বিক্রিত সংবাদ মাধ্যমের বিকৃত সংবাদ পরিবেশন আর বিনোদনের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে সমস্ত মানবিক আবেগ। নর-নারী ও শিশু-নিধন-যজ্ঞে গণ- তান্ত্রিক বলি-কাঠের সামনে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত, নিরুত্তাপ, জাবর-বিলাসি দর্শকদের ভিড়ে আমিও দাঁড়িয়ে আছি, নিরাপদ দূরত্ব রেখে। সকলেই ভাবছে, 'আমি নই, এরপর অন্য কেউ, অন্য কারও সন্তান'। একবিশ্ব বদ্ধভূমির মধ্যে বন্দী আমি; আমারই মত অসংখ্য মানুষ - টিঁকে থাকার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে বিভ্রান্ত। মিথ্যে নির্মিত সত্য না সত্য-সদৃশ-মিথ্যে - ঠিক কোনটায় মোক্ষ-প্রাপ্তি?
মানব প্রজাতির আসন্ন অবলুপ্তি ঘটার এই শেষ বেলায়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর নৈতিক অবক্ষয় হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। মানব সভ্যতার অস্তিত্ব ও ভবিষ্যত ঘিরে যে বিরাট প্রশ্ন-চিহ্নের মুখোমুখি হয়েছি, সেখানে প্রশ্ন শুধু টিঁকে থাকার নয়, বরং কে, কীভাবে এবং কতটা সহ্য শক্তি নিয়ে, কতটা নিষ্ঠুর হয়ে বেঁচে থাকবো?
আমার নিষ্ঠুরতাকে আমি কতটা দেখতে পাচ্ছি? কতটা সহ্য করতে শিখিয়েছি চারপাশের নিষ্ঠুর বাস্তব অথবা পরাবাস্তব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নিজের যাপনকে? কতটা নির্লিপ্ত থাকা যায়, অস্থির হয়ে ওঠার ভান করে?
আমি কি আমার তৈরি করা এই বোধগম্য জগতে কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা? না কি অমোঘ, নির্বোধ নিয়মের নিয়ন্ত্রণে চালিত এই বিপুল জগতের একটা কণা মাত্র?
ঘটনাচক্রে, ছাপান্ন বছর বয়েসি, আপাতভাবে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতাহীন কিন্তু কার্যত অনেকটা অক্ষম ও মানসিকভাবে অসম্পূর্ণ একজন মানুষ আমি। প্রাণীজগতের (Kingdom) মধ্যে অ্যানিমেলিয়া (Animalia), পর্বগত (Phylum) পরিচয়ে কর্ডাটা (Chordata), শ্রেণিগত (Class) ম্যামেলিয়া (Mammalia), বর্গ (Order) প্রাইমেটস (Primates), গোত্র (Family) হোমিনিডি (Hominidae), গণ (Genus) হোমো (Homo) এবং প্রজাতি (Species) হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens) ভুক্ত একটা আস্ত এবং রীতিমতো বিজ্ঞান-স্বীকৃত মানুষ।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়, আমি Homo sapiens sapiens - আধুনিক মানুষ। এটা বলা হলো, যাতে করে বিলুপ্ত উপপ্রজাতি Homo sapiens idaltu-এর থেকে নিজেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়।
প্রতিদিন, আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে বাঁয়ে-ডানে উল্টেপাল্টে দেখি ও চিনি। চার মাত্রিক আমার অস্তিত্বের তিন মাত্রার ছায়ায় নিজেকে দেখি (অর্থাৎ, দ্বি-মাত্রিক প্রতিবিম্ব আর এক মাত্রিক সময়ের ছাপ)। আস্ত একটা মাত্রাকে হারিয়ে, প্রতিবিম্বিত বিভ্রান্তি নিয়েই নিজেকে দেখি। আমি সকলের মতোই একজন এবং একই সাথে আমি সবার থেকে আলাদা ।
আমার পরিচয়ের আধার বেশ লম্বা : পশ্চিম বঙ্গের জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা, বাঙলাভাষী, মধ্য-স্বত্ব-ভোগের উত্তরাধিকার প্রাপ্ত ও সুবিধাভোগী সংষ্কৃতি-লালিত, অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত একটি পারিবারিক পরিসরে এবং যাপনে অভ্যস্ত, জৈবিক প্রবৃত্তি চালিত বহুগামী যৌন সম্পর্কে বিশ্বাসী কিন্তু সামাজিক অনুশাসনে আত্মসমর্পিত পুরষতান্ত্রিক আচরণ-অনুগত একটি পরিবার কাঠামোর আরাম-ভোগী, একগামী বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষায় ব্রতী,
নিরীশ্বরবাদী অথচ, জন্মগতভাবে 'হিন্দু' পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকা, মোটের ওপর, নিজেকে শিক্ষিত ভেবে থাকা - একজন আড্ডা-প্রিয়, কুঁড়ে মানুষ। বেঁচে থাকার একটা অভ্যেস তৈরি করে ফেলেছি। প্রতিদিন, আমি 'ভালো থাকা'র মোহতে নিজের মধ্যে নিজেকে মুড়ে ফেলার চেষ্টায় আত্ম-কেন্দ্রীক হই, আর কিছুটা ঘটনা-পরম্পরায় কাছাকাছি চলে আসা মানুষজন, কুকুর বেড়াল, গাছ গাছালি, পাখি, কাঠবেড়ালী ইত্যাদি ইতর সাধারণকে 'ভালো রাখা'র শ্লাঘা নিয়ে নিজেকে প্রসারিত করারও চেষ্টা চালিয়ে যাই। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি। আমার মতো করে সেই চেষ্টা অনেক সময় ফলপ্রসূ হয় না। এমন কি, আমার অজ্ঞানতাকে আড়াল করে, প্রাতিষ্ঠানিক-মুনাফা-বান্ধব-পুঁজি-কেন্দ্রীক শিক্ষার অভিমানকে সম্বল করে অনেকের ভালো করার বাতিক ও বাধ্যতায় প্রণোদিত হয়ে অজান্তেই অনেকের ক্ষতি করে ফেলি।
মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা অনেক কথা, সংশয়, অনুভব, অর্জিত তথ্য ও জ্ঞান আর নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার আনন্দ, যা কিছু মুখে বলতে পারি না কিন্তু লিখে প্রকাশ করতে পারি - সে সব লিখে ফেলার দুঃসাহসিক তাগিদে এই সন্দর্ভ। মূলতঃ স্বগতোক্তি। কোনো কিছু প্রমাণ করার চেষ্টায় বিস্ফারিত গ্রন্থাবলীর তালিকা, অনুপুঙ্খ সালতামামি ও তথ্য পঞ্জির দীর্ঘতালিকা আমি দিতে চাই নি এবং দিইও নি। আড্ডা মারার সময় যে ভাবে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য, গ্রন্থ বা লেখকের ভাবনা কথার অনুসঙ্গে চলে আসে, সেই ভাবেই কিছু কিছু বই, লেখকের উক্তি, তথ্য এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া জিজ্ঞাসার উত্তর নিজের মতো করে খুঁজেছি। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে, খুব দ্রুত বদলাতে থাকা চারপাশ - চারপাশের বয়ে যাওয়া সময়ের সাথে ক্রমশ বাড়তে থাকা আমার নিজের সময়ের ব্যবধান যে গোলোক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে, সেখান থেকে নিজেকে খুঁজে বার করার চেষ্টায় এই সন্দর্ভ।
“We are more alike, my friends, / than we are unalike.”
— Maya Angelou (Human Family)
আমার মধ্যে তৈরি হওয়া, তৈরি করা যাবতীয় বিশ্বাস এবং ধারণা, যেগুলো আমি স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কোথাও গোপন করি, কোথাও প্রকাশ করি এবং কোথাও পালন করি - সে সব কিছুর সমন্বয়ে আমার বহুমাত্রিক পরিচয়। আমার জগৎ। এক একটা আলাদা পরিচয়ের আলাদা আলাদা set - পেশাগত, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক এবং কৌশল-চালিত। আমার পরিচিতির যে তালিকা দিয়েছি তার প্রতিটা স্থানাঙ্কের মাঝখানে সংযোগকারী রেখাগুলো কোনোটাই সরল নয়। বক্র রেখায় জুড়ে জুড়ে আছে। সেট থিওরির (set theory) প্রেক্ষিত পুরো বিষয়টাকে খুব সহজ করে ব্যাখ্যা করা যায়। এই বিশ্লেষণ আমার নিজের জন্য খুব জরুরি। এটা না করলে নিজের লালা-রসে নিজেকে ঘিরে যে শক্ত গুটি বানিয়ে ফেলেছি, সেটা ফাটিয়ে কোনো আলো দেখতে পারবো না ।
আমার পরিচিতির তালিকায় একটা সময়ের গণ্ডি, ভৌগলিক সীমানা, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি এক একটা দিককে যদি এক একটা আলাদা সেট হিসেবে কল্পনা করি, তাহলে এই সেটগুলোর মধ্যেকার ছেদ (intersection), মিলন বা সমন্বয় (union) ও সীমাবদ্ধতা (subset) নিয়েই আমার স্বতন্ত্র বস্তু জগৎ ও ভাব-জগৎ। প্রতিটা মানুষের যাপনে এই সেটগুলোর স্বতন্ত্র বিন্যাস। জীবনের কর্মব্যস্ত পর্বের একটা চূড়ান্ত পর্যায় অবধি সেটগুলো বাড়তে থাকে। জীবন যত দীর্ঘ হতে থাকে, অধিকাংশ মানুষের জীবনে সেটগুলোর সংখ্যা কমতে থাকে। অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আমরা আলাদা আলাদা প্রত্যাশার বিনময়ে সম্পর্ক সাজাই। প্রতিটা সম্পর্কের গুরুত্ব, গভীরতা এক একটা মানুষের সেটের সাথে আমার সেটের ছেদ ও মিলনের নিরিখে তৈরি হতে থাকে । আমার বাঙালি পরিচয়ের গর্ববোধ যে সব মানুষের সেটের সাথে ছেদ (intersection) তৈরি করছে তাঁদেরই অনেকের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কিত সেটে আমার সেটের ছেদ অনুপস্থিত। এই ভাবে অজান্তেই সেট এর গাণিতিক ছক আমাদের নানান পরিচিতিকে আলাদা আলাদা বন্ধুত্ব , আত্মীয়তা, সমিতি, সংগঠন, সংঘ, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের যুক্ত করে । আবার কখনও কখনও বিযুক্তও করে। সেটগুলোর মধ্যে একটা মোটা দাগের সমন্বয়, সমাজিক অস্মিতা, জাতিসত্তার একাত্মতাবোধ দেশাত্মবোধের আবেগ একটা বিমূর্ত রূপ নির্মাণ করে। এই পরিচিতিগুলোর মধ্যে কোনটা আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে কখন এবং কি ভাবে চলে আসছে, তা ঠিক করে সময়ের আত্মা। এক একটা সমাজের, একটা দেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিপথ । এই পথ ব্যক্তির ও ব্যক্তি সমষ্টির পরিচিতির বৈচিত্র্য কে অস্বীকার করে বৃহত্তর মানব সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন, বাতিল-প্রবণ (exclusive) একটা সংকীর্ণ পরিচয়ের কানা-গলিতে ঢুকিয়ে দেয় কখনও, আবার পরিচিতির বৈচিত্র্যকে মান্যতা দিয়েও এমন কোনো একটা পরিচয়কে তুলে ধরে যেটা মানব সমাজের বৃহত্তর পরিচিতির সামগ্রিকীকরণকে অন্তর্ভুক্ত (inclusive) করে।
প্রতিটি ব্যক্তির ভেতরের বিশ্বাস এবং বাইরের সমাজের মধ্যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও ভারসাম্য কাজ করছে। সেট সমূহের মধ্যেকার বিভাজন ও ছেদ না থাকা বিচ্ছিন্নতা যত বেশি হতে থাকে, সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত জনসমষ্টি ততই 'আমরা' ও 'ওরা'য় বিভক্ত হতে থাকে। সহানুভূতির চর্চা ও সহমর্মিতার সংষ্কৃতি যে সমাজের ব্যক্তি ও ব্যক্তি সমষ্টির পরিচিতির সেটে যত জায়গা করে নেয়, সেই সমাজের মানুষজনের প্রসারিত সেট বিচ্ছিন্ন সেটগুলোর otherness কে অস্বীকার করে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে নেয়। একটা সুপার-সেট নির্মাণ করে।
আমি যে সময়ে, যে সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি - আমার দেশীয় ও সামাজিক পরিচিতির যে ইতিহাস আমাকে যেখানে আজ পৌঁছে দিয়েছে, সেখানে আমার পরিচিতির সেটের সাথে আমার সদৃশ সেটগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এটা 'জেনারেশন গ্যাপ' এর হিসেব দিয়ে মাপা যাচ্ছে না। একই দেশে, একই সমাজে এবং একই পৃথিবীর মাটিতে - একদিকে, প্রযুক্তি সম্পৃক্ত শিক্ষা, জ্ঞান চর্চা, নাগরিক জীবনে আলো ও আলোর গতিতে বিশ্ব পরিক্রমার অভ্যেস, বৈভব, বিলাসের অাতিশয্য, মাত্রাহীন অপচয়ের সংষ্কৃতি-চালিত মানব প্রজাতিভুক্ত একটি অতিক্ষুদ্র অংশের অতি সুবিধাভোগী, বিপুল ক্ষমতার পরিচিতির সেট আর তার উল্টোদিকে প্রযুক্তি ব্যবহারের শিক্ষা, প্রযুক্তি-নির্ভর জ্ঞান চর্চা থেকে বিযুক্ত, সীমাহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে বেঁচে থাকা ক্ষমতাহীন, দাসত্বের সনদকে পরিচিতির সম্বল করে ভেসে থাকা অগণিত সেট। আমার পরিচিতির সেটের কোন পরিচয় এই দুটো আড়াআড়ি বিচ্ছিন্ন সেট এর সাথে ছেদিত (intercepted) হবে ও কালক্রমে মিলিত (United) হবে?
মানবোত্তীর্ণ বা post-human কোনো নতুন প্রজাতি রূপান্তরের প্রক্রিয়া কি শুরু হয়ে গেছে? বিপরীতমুখী দুধরনের অভিযোজন এই ধ্বংস হতে থাকা প্রাণ-বান্ধব পৃথিবীর মধ্যে মানব প্রজাতির কোন অংশ টিঁকে যাবে? না কি কেউই থাকবে না?
'আমি' মানব, একাকী - জেনেটিক- সিঙ্গুলারিটি নির্ধারিত একমেবোদ্বিতীয়ম - আমি, যে মহাজাগতিক যাত্রায়, প্রাক-প্রাগৈতিহাসিক পার্থিব পরিবেশের জটিল সংশ্লেষের পরিক্রমায় এই সময়ে এসে পৌঁছেছি, সে এক অসম্ভাব্য সম্ভবনাময় গতি পথ। আমার পরিচয়ের অনুসন্ধান জানিয়ে দেবে আমার প্রজাতির ভবিষ্যৎ।
(ধারাবাহিক)