সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বিধান নগরের একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত আবাসনের পাশের মাঠে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রত্যেকদিন সকালে এক দুজন মানুষ এসে দাঁড়াতেন এবং তারপর কিছু হালকা ব্যায়াম করতেন, এরকমটা প্রত্যেক দিন হতো। ক্রমে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হল। তারপর দেখা গেল এই দলটি একটি লাফিং ক্লাবে পরিণত হয়েছে। আরো পরে কেন্দ্রে বর্তমান সরকারের অধিষ্ঠান হওয়ার সময় থেকে এই দলটির চরিত্র বদলাতে লাগলো। এদের মধ্যে খাকি হাফপ্যান্ট পরা লোক বাড়লো। মহিলারা চুড়িদার পড়ে আসতেন এবং ব্যায়ামের পাশাপাশি কিছু শপথ গ্রহণ মৃদু শ্লোগান ইত্যাদি চলতে লাগল। এতকাল ধরে যে বিষয়টি অত্যন্ত নিরীহ বলে সবাই অবহেলা করেছে, আজ কিন্তু তা কারো কারো নজরে পড়ল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই কার্যকলাপকে বন্ধ করে দেয়া হলো। মানুষ সচেতন হয়েও বিষয়টিকে খুব একটা বিপজ্জনক ভাবলেন না।
ঠিক এইভাবেই আপাত নিরীহ চেহারা থেকে একটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর মতাদর্শ সমাজের মধ্যে পৌঁছে দিতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তার শাখার মাধ্যমে। সম্প্রতি যে তথ্য এসেছে তাতে জানা যাচ্ছে যে ৮৬ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে যে ৫৩০ টি শাখা ছিল সেটি গত ১৪ বছরে পাঁচ গুণ বেড়ে আড়াই হাজার হয়েছে। এই শাখা গুলি মূলত একটি অখন্ড ভারতের কল্পনায় হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ বীজ বপন করে চলে। বয়স্ক মানুষদের শাখা সাধারণত কম। এই শাখার উদ্দেশ্য হল কম বয়সীদের মধ্যে ছোটবেলা থেকে এই ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া। বড় হয়ে হিন্দি হিন্দু হিন্দুত্ববাদ নিয়ে তাদের মনের ভিতর এমন একটি জগদ্দল পাথর তৈরি হয়ে যাবে যা কোনোভাবেই নড়ানো যায় না। একশ বছর ধরে সংঘ পরিবার এই কাজটিই করেছে এবং এক মহারাষ্ট্র ছাড়া কোথাও এর বিকল্প সমান্তরাল কোন ব্যবস্থা নেই। মহারাষ্ট্রে এর বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্র সেবা দল তৈরি হয় বহু আগে এবং আজকের মহারাষ্ট্রে মেধা পটেকর সহ বহু সমাজকর্মী এই সেবা দল থেকে উঠে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গে ছোটোবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে সমাজচেতনা জাগানোর উধষদ্যোগ তেমন কখনো ছিল না। আর ইদানীং তো সবই সামার ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে।
আজ পশ্চিমবঙ্গে মাঠে ঘাটে হাটে শহরে বন্দরে কলেজে বিদ্যালয়ে ট্রেনে বাসে সর্বত্র খোলাখুলি ভাবে মানুষ যে সম্প্রদায়িক কথা বলছেন, তার মূলে এই সংঘের শতবর্ষের চাষ। 'ক্যাচ দেম ইয়ং' কম বয়সে ধরো, এটা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মতো আর কেউ বোঝেনি। তাছাড়া তাদের ধৈর্য্য অপরিসীম। নিষ্ঠাও তেমনি। আপনার ঘরের কাছে আপনার কান ঘেঁষে তারা প্রত্যেকদিনই সংঘের শাখা পরিচালনা করে, আপনি বুঝতেও পারেননি। তাছাড়া আছে সরস্বতী বিদ্যা মন্দির বা বিবেকানন্দের নাম দিয়ে বিভিন্ন স্কুল যেগুলিকে 'মেধা' তৈরির ভালো স্কুল বলে ধরে নিয়ে চাকুরিজীবিরা তাদের সন্তানদের জন্য উপযুক্ত মনে করেন।
সাম্প্রদায়িকতা এখানে বরাবরই আছে অথবা বলা যেতে পারে বিভাজন আছে। বাংলার গ্রামাঞ্চলে এবং শহরে সম্প্রদায়ভিত্তিক পাড়া ও মহল্লাতে মানুষ বাস করে, কবি লেখেন 'গাঁয়ের বামুনপাড়া তারি ছায়া তলে'। কিন্তু পাশাপাশি সখ্য তেমন নষ্ট হয়নি। নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে নিয়ে পাড়াগুলি তৈরি। জাতপাতের মতোই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাও বরাবর আছে। দেশভাগ সেই পথেই এসেছিল কেউ ঠেকাতে পারেনি। রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও বিভাজনের রাজনীতি তাকে প্রবল আকার দেয় কিন্তু বীজ সুপ্ত ছিল।
একসময় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে মুসলিম ছাত্র পড়তে আসা নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। রবীন্দ্র কাজী নামক একটি ছেলে ভর্তি হতে চেয়েছিল, তার বাবার এতটাই রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন যে তিনি ছেলের নাম সেই নামে রাখেন। পরবর্তীকালে তার বাবা ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করলেও এই ছেলেটির সাথে একসাথে খাওয়া নিয়ে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেই অর্থে প্রথম মুসলমান ছাত্র এসেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই একসাথে খাওয়ার ব্যাপারে কিছু করতে পারেননি। বরং মহাত্মা গান্ধী যখন আলী ভাইদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে আসেন তখন তার একসাথে খাওয়ার কারণে এই ব্যবস্থাটি ভেঙে যায়।
এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিয়েই কিন্তু স্বাধীন ভারতে আমরা গিয়েছি কিন্তু সেকুলার ভারতবর্ষ নিয়ে যথেষ্ট গর্ব করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের অন্যতম পরিচয় হিসেবে পৃথিবীতে উঠে এসেছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র এই ধর্মনিরপেক্ষতার উপরেই দাঁড়িয়ে । কিন্তু সমস্যায় জর্জরিত এই দেশ এবং এদেশের মানুষ তার বিপন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শেষ পর্যন্ত একটি মতাদর্শের দিকেই ঝুঁকবে এটা বুঝতে হতো। হিন্দুত্ব অনেকের কাছেই এক শক্তিশালী বিকল্প। যদিও আজকের ভারতে সেই বিকল্পটির রাজনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ।
ভারতে ১৪৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১২৪ কোটি অমুসলিম, হিন্দু কম বেশি আশি শতাংশ হবে। এই আশি শতাংশ হিন্দু খতরে মে হ্যায় এ কথাটা কিন্তু বিরাট সংখ্যক মানুষকে বোঝানো গেছে, পশ্চিমবঙ্গেও। একটা সময় ছিল যখন আর এস এস নিয়ে মানুষের মনে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া ছিল, আর এস এস যারা করতেন কার্যত তারা সামনে আসতেন না, গোপনে কাজ করতেন। যে কোন ফ্যাসিস্ট শক্তির মতই আর এস এসের নির্দিষ্ট শত্রু ছিল। মুসলমানের সাথে সেখানে যুক্ত ছিল মার্কসবাদী। মুসলমান বিদ্বেষের মূল উপজীব্য ছিল দেশভাগের ইতিহাস এবং বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন। তবে দ্বিতীয় বিষয়টি অতটা গুরত্ব পেত না কারণ বাংলাদেশের গোড়াপত্তনের সাথে ভারতীয় রাজনীতির যোগ, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব ইত্যাদি। এই আবেগের অন্যতম পুষ্টি ছিল পাকিস্তান বিরোধিতায়, ১৯৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত যার কোনো বিরাম নেই। তসলিমা নাসরিন 'লজ্জা' বইটি লেখার পর সেটিকে পুস্তিকা আকারে ছাপিয়ে ব্যাপক প্রচার করে আর এস এস। বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়নের গল্পটি শিকড় পায়। ২০০৬ সাল নাগাদ সাচার কমিটির রিপোর্টে স্পষ্ট হয় যে ভারতে মুসলমানরা কী নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে আছেন। এইখান থেকে গোটা ভারতের মত পশ্চিমবঙ্গেও মুসলমান সমাজের মধ্য থেকে নিপীড়িত গোষ্ঠীর বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্বর জোরালো হয়, নেতৃত্ব নির্মিত হয়। এতদিন রাজনৈতিক দলে মুসলমানদের অবস্থান ছিল কিন্তু নির্ণায়ক ভূমিকায় তাদের বিশেষ দেখা যেত না। ভোটের আগে তাদের কাঁধে চেপে বৈতরণী পারের চেষ্টা অবশ্যই ছিল। মুসলমানের কল্যাণ বলতে কিছু ধর্মীয় সুযোগ সুবিধার কথা আসতো, শিক্ষা স্বাস্থ্য রোজগার তেমন গুরুত্ব পেত না।
এই পথ ধরেই বাংলায় পালাবদল হয়। আলোচনায় আসে মুসলমান সমাজের অবস্থান। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তোষণ শব্দটিকে ব্যবহার করতে থাকে সংঘ পরিবার। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের সব ধারার রাজনীতিতেই উচ্চবর্ণীয়েরা ক্ষমতাসীন, তাই সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা এখানে ছিলই। সামগ্রিক অভ্যাসে শিক্ষা ও সংস্কৃতির জগতেও উচ্চবর্ণীয় আধিপত্যের কারণে অন্যান্য বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর কথা সামনে এসেছে কম, এখনো তাই। ইতিমধ্যে মুসলমান সমাজের মধ্য থেকে শিক্ষা আন্দোলনের দায়িত্ব নিয়েছে মিশন স্কুলগুলো। সরকারি প্রত্যাশার অপেক্ষায় না থেকে গোষ্ঠীগত এই উদ্যোগের ফলে পিছিয়ে রাখা সমাজ থেকে উঠে আসা কৃতি ছেলেমেয়েরা সর্বত্র দৃশ্যমান হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই নিজের অধিকার অর্জন করছে। অদ্ভুতভাবে এই উত্থানকে সবর্ণ সমাজ ভালোভাবে নিতে পারছে না। মুখে যাই বলা হোক ভিতর পর্যন্ত ঢুকে থাকা বর্ণশ্রেষ্ঠত্বের অভিমান সবখানে। খবরের কাগজের পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনই তার যথেষ্ট প্রমাণ।
এই সমাজ আদ্যন্ত সংরক্ষণ বিরোধী। যেন ভুলে না যাই মন্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু হওয়ার বিরুদ্ধে পথে নেমে এরা জুতো পালিশ করছিল, বর্ণগত ঔদ্ধত্যের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে। এখনো সরকারি কর্মক্ষেত্রে এস সি এস টি দের সোনার চামচ সোনার টুকরো বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। মুসলমানের ওবিসি সংরক্ষণ তো কোনোভাবেই সহ্য হবে না।
অতঃপর হিন্দুত্বই একমাত্র ভরসা। লক্ষণীয় বিষয় দুটি। শিক্ষিত সবর্ণ হিন্দুদের খোলাখুলি হিন্দুত্বের পক্ষে দাঁড়ানোর, গরবসে কহো থেকে মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে। আর অন্যদিকে একদা কম্যুনিস্টদের হঠাৎ ব্রক্ষ্মজ্ঞান লাভ। অতঃপর সংঘপরিবারের নিশানায় রইল মুসলমানের পাশাপাশি আরবান নকশাল।
হঠাৎ করে বাংলার অন্যতম নায়ক হয়ে উঠেছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যার আদ্যোপান্ত ইতিহাস বেশ অন্যরকম। যে হিন্দু মহাসভার ইনি সভাপতি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের প্রায় কোনো ভূমিকাই ছিল না। পরে তিনি অদ্ভুতভাবে মতাদর্শ গত অমিল সত্ত্বেও হক সরকারে যোগ দেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নেহরুর মন্ত্রীসভায়। গান্ধী হত্যার পর হিন্দুত্ববাদীদের তখন সঙ্গীন অবস্থা, প্রায় একঘরে। এমতাবস্থায় হিন্দু মহাসভা কে রাজনীতি থেকে দূরে থেকে কাজ করার প্রস্তাব দেন তিনি।যে চরিত্র নির্মাণ তার এখন চলছে সেখানে প্রশ্ন ওঠা আবশ্যক কারণ বাংলা ভাগ হওয়ার পক্ষে যে তিনি ছিলেন সে কথাটা গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যথার্থ মূল্যায়ন ছাড়াই তিনি এখন 'বীর' আর এক 'বীরে' র মত যার কলঙ্কিত ইতিহাস চাপা দেওয়ার জন্য গোটা সরকারি ব্যবস্থা তৎপর।
এই 'বীর', হলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান চিন্তক ব্যক্তিত্ব বিনায়ক দামোদর সাভারকর। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্বের এই নায়কের উঠে আসা কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারত থেকে। লন্ডনে তিনি আইন পড়েছেন, শেক্সপিয়ার পছন্দ করতেন, বাইবেলের কদর করেছেন। জাতীয়তাবাদের বিখ্যাত ইশতেহার এসেন্সিয়াল হিন্দুত্ব ১৯২৩ সালে জেলে বসেই লিখেছেন, তথাকথিত বহিরাগতদের হাত থেকে প্রাচীন মাতৃভূমির উদ্ধার নিয়ে ভাবনায়। ইংরেজ তার কাছে বহিরাগত নয়, তার প্রধান শত্রু মুসলমান। জাত পাতে দীর্ণ সমাজকে এক সূত্রে বাধার উপায় একটি সাধারণ শত্রু নির্মাণ, এক্ষেত্রে সেটি মুসলমান। লিখেছেন Hatred separates as well as unites, বাটোগে তো কাটো গে, আজকের ভারতে যে বাণী হিন্দুত্ববাদীদের হাতিয়ার।
সাভারকর অজ্ঞেয়বাদী, তার নির্মিত হিন্দু জাতীয়তাবাদের নাম হিন্দুত্ব যা হিন্দু ধর্মের চেয়ে আলাদা। তার অদ্ভুত যুক্তি যে প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে মুসলমান মেয়েদের উপর অত্যাচার করতে হবে। বলাবাহুল্য যে কোন স্বৈরতান্ত্রিক মৌলবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মেয়েদের উপর আক্রমণ প্রায় স্বত:সিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়। প্রথমত ধর্মীয় আইন-কানুর মূলতঃ মেয়েদের উপর চাপিয়ে তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করা হয়, আবার ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের উপর আক্রমণের ছুরি শানানো হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষ নিজেদের আধুনিক অর্থে হিন্দু বা মুসলমান বলে কখনো ভাবেনি সাধারণ মানুষের অনেক রকম পরিচিতি ছিল স্থানিক, জাতভিত্তিক, পেশাভিত্তিক এবং পারিবারিক। উনবিংশ শতাব্দীতে উচ্চ বর্ণীয় হিন্দুরা খ্রিস্ট ধর্মের মতই বিশুদ্ধ ধর্মনির্মাণে আগ্রহী হন। এখান থেকেই ব্রিটিশদের তৈরি ইতিহাসে আমরা বিশ্বাস করতে থাকি যেখানে তার মূল উপজীব্য হলো হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব যদিও ভারতবর্ষে বহু অপূর্ণতার মধ্যে ধর্মীয় বহুত্ববাদ এবং সহনশীলতাই ছিল সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
ফিরে আসি সাভারকারে, জেলে থাকাকালীন সাভারকার ভেঙে পড়েন অসুস্থতা, নির্জন বাস, বছরের পর বছর পরিবারকে দেখতে না পাওয়া এবং অত্যাচারে । শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে বন্দি অগণিত বঙ্গ সন্তানরা যা নিদারুণ কষ্টেও করেননি, সাভারকার তাই করলেন। একরকম হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইলেন এবং পরবর্তী জীবনে ব্রিটিশ বিরোধিতা না করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আন্দামান থেকে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল পশ্চিম ভারতের একটি জেলে। তিনি ছাড়া পাওয়ার আগেই ভারতের আকাশে গান্ধী মুখ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছে। অহিংসা, নৈতিকতা, সমাজ সংস্কার এবং হিন্দু মুসলিম ঐক্য তখন রাজনীতির বিষয়। নতুন সাভারকারের কাছে মুসলমানের পাশাপাশি দ্বিতীয় শত্রু হয়ে দাঁড়ালেন মহাত্মা গান্ধী। সাভারকার মনে করতেন বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা নীতির কারণেই হিন্দুরা পরবর্তীকালে দুর্বল হয়ে যায় ঠিক যেমন নীৎসে মনে করতেন খ্রিস্ট ধর্ম রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেয়। ক্ষমা, অহিংসা, মানবাধিকার এগুলি ঠিক রাষ্ট্রকে মানায় না। অহিংসা মানুষকে নপুংসক করে, হিংসা দিয়েই তার মোকাবিলা দরকার। যে কোন স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতই যুদ্ধ জিতলে বিপক্ষে সকলকে কোতল করতে হবে, মেয়েদের ধর্ষণ করতে হবে এবং ধর্মীয় স্থানকে ধ্বংস করতে হবে।
হিন্দু মহাসভার ভীষ্ম পিতামহ ছিলেন ডাঃ ধর্মবীর বালকৃষ্ণ মুঞ্জে। উনি রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে দুইবার হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি ছিলেন। বুয়র যুদ্ধের সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর অতিথি হয়েছিলেন। গান্ধী তখনো ভারতে পরিচিত নন। মুঞ্জে সেইখানে বিশেষ বিরক্ত হয়েছিলেন কারণ গান্ধীর বাড়িতে যিনি রন্ধনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি দলিত সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা মুসলমান। মুঞ্জের মত মানুষ ভাঙ্গীর হাত থেকে খাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না, ঘৃণায় জর্জরিত তার মানসিকতা। এই মুঞ্জে ও তার সাথীরা ১৯২০ সালে নাগপুরে কংগ্রেস অধিবেশনের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু এই অধিবেশনে অজস্র মুসলমান এবং অভাবনীয় মহিলাদের উপস্থিতিতে গান্ধীর প্রভাবে হিন্দু-মুসলমান ও ব্রাক্ষ্মণ- অব্রাক্ষ্মণের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়। এই সভার অন্যতম বক্তা ছিলেন ব্যারিস্টার জিন্না। সভার পরে জিন্না এবং মুঞ্জে দুজনেই বোঝেন কংগ্রেসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চলবে না।
এই পথ ধরেই আর এস এসের প্রতিষ্ঠা। আর এস এস কমবয়স থেকেই হিন্দুদের তাদের ভাবনায় দীক্ষিত করতে শুরু করে। প্রতিদিনের শাখায় 'হিন্দুয়ো কা হিন্দুস্তান' জাতীয় খেলা খেলানো হয়। একটি কল্পিত হিন্দু অতীত নির্মাণ করা হয় এবং ধীরে ধীরে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিষ ছড়িয়ে দেয়। এখানে মুসলমানের প্রবেশ নিষেধ। মানবাধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করাই এর প্রধান ভিত্তি।
গান্ধী হত্যার ব্যাপারে সাভারকারের মুখ্য ভূমিকার কারণে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাভারকার নিন্দিত ছিলেন। সময়টি গান্ধী পরবর্তী কংগ্রেসের। আর যা কিছুই বদলাক সেই কংগ্রেস মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধ ছিল। পূর্ণ জীবন পেয়েও সাভারকার হতাশাতেই মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার বিষবৃক্ষের বীজটি ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তার শাখার মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষে পুঁতে চলেছে। আজ তার বৃহৎ বৃক্ষ গুলি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
পাশাপাশি ইদানিং উচ্ছেদের তালিকায় নতুন করে যে গোষ্ঠীকে ঢোকানো হয়েছে তথাকথিত 'হিন্দুরাষ্ট্রে'র ভাবনা নিয়ে সেটি অবশ্যই মুসলমান জনগোষ্ঠী। আমরা বারবার লক্ষ্য করছি যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে 2019 সালের সিএএ আন্দোলনের পর থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর এক সন্ত্রাস শুরু হয়েছে যেহেতু সি এ এ আইনের বিরুদ্ধে গোটা দেশ জুড়ে যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মুসলমানেরা তাই তাদের উপর প্রতিশোধ মূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেছে যেখানেই বিজেপি সরকার আছে। আমরা অতীতের কথা জানি। ভারতের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ কে একইভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তখন এই যন্ত্রটি আনা হয়নি। যন্ত্রটির নাম বুলডোজার যা ইসরায়েল বহুকাল ধরে প্যালেস্টাইনের অধিবাসীদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছে। এই বুলডোজার সন্ত্রাসের ফলে তারা প্যালেস্টাইনের মানুষের ভেঙে যাওয়া বসতির উপরে নিজেদের নগর নির্মাণ করার চেষ্টা করেছে। ভারতে ইসরাইলি মতবাদের অন্যতম অনুগামী সংঘ পরিবার স্বাভাবিকভাবেই এই একই জিনিস আমদানি করেছে।
একই সাথে এটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বটে। কোনো এলাকায় কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর বসবাসকে ধ্বংস করতে পারলে সেখানকার সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবচ্যুত হয়ে যায়। এই ঘরহারা সংস্কৃতি হারা মানুষজন সম্পূর্ণ প্রান্তিক হয়ে এখানে ওখানে নিতান্তই আগাছার মতো বেঁচে থাকে। তখন তাদের সস্তা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা যায়, দলদাস হিসেবেও তাদের কাজে লাগানো যায়। তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রের পরিকল্পনার মধ্যে যে এই ভয়াবহ হিংসা লুকিয়ে আছে তা প্রতি নিয়ত স্পষ্ট হচ্ছে। সেই আলিবাবার গল্পের মত প্রত্যেকটি ঘরকে চিহ্নিত করা চলছে যেমন বলা হচ্ছে দোকানের উপর দোকানীর নাম লিখে রাখতে হবে। যাতে যে কোনো রকম সাম্প্রদায়িক অজুহাতে মুসলমানদের দোকানপাট ধ্বংস করা যায়। আমাদের জন্য আরো বিপজ্জনক এ নিয়ে এদেশের এক বিপুল সংখ্যক মানুষের কোন হেলদোল নেই। আমার প্রতিবেশীকে বাস্তচ্যুত করা হলো আমার কিছুই মনে হলো না, এরকম ভয়ংকর অবস্থা ভাবতে খারাপ লাগে।
ভারতের বর্তমান সরকার ও তাদের পিছনের মদতদাতা শক্তি নারীর অধিকারকে ধর্মের বিধান দিয়ে মাপে, সেখানে মেয়েদের চলাফেরা, যাপন সবই পুরুষের অধীন। তাই এই দেশ এই প্রথম সভয়ে লক্ষ্য করে যে গণধর্ষণ কারী ও শিশু হত্যাকারী পুরুষ শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে জেল থেকে ছাড়া পায়। এই দেশেই আন্তর্জাতিক পদক বিজয়ী মেয়েরা যৌননিগ্রহকারীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে তাদের উপর নামে রাষ্ট্রের প্রহার। দলিত মেয়ের ধর্ষণের খবর করতে গেলে সাংবাদিককে বিনা কারণে আটক করা হয়। অন্যদিকে মেয়েদের জীবনকে যা বিশেষভাবে প্রভাবিত করে সেই পার্সোনাল ল নিয়েও জলঘোলা হচ্ছে। অবশ্যই এই আইনগুলির সংস্কার প্রয়োজন কিন্তু সেগুলিকে একীভূত করা নিয়ে সমস্যা আছে। সব ধর্মেই নারীর অবস্থান টলোমলো কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে মেয়েদের সাম্প্রদায়িক করে তোলা হচ্ছে এবং ধর্মযুদ্ধের হাতিয়ার করে তোলা হচ্ছে। মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু , সিরিয়ালে আর সিনেমায় বিষয়টি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে। মেয়েদের ভালোবাসাকে লাভ জেহাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে গোটা দেশের মত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত হিন্দু সমাজের এক বড় অংশ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় মেতে আছে। পহলগাঁওতে হত্যাকাণ্ডের পরে পরেই মুসলমান বিদ্বেষ চরমে। সম্প্রীতির গান গাওয়া অতি চেনা লোকেদের মুখোশ খসে গেছে। সর্বোপরি বাংলার যে সংবাদ মাধ্যম নিরপেক্ষ যুক্তি নিষ্ঠার দাবি করতো তার সর্বস্ব গেছে। গোদী মিডিয়ার পূর্ণ রূপে সে এখন প্রকাশিত। চিরকাল বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এর আবহে যে বাঙালি রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী একসাথে পালন করতো, আজ কোথাকার এক ভুঁইফোড় কীসের কুসুম বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, মানুষ সহ্য করছে। তারপর যুদ্ধ। গোবলয়ের সন্তানদের মত বাঙালি নিধিরাম সর্দার সেজে চ্যানেলে চ্যানেলে যুদ্ধ দেখছে আর মুসলমানদের দেশদ্রোহিতার তকমা দিচ্ছে। বাংলাদেশও এখন শত্রু কারণ সেখানে সরকার বদলেছে। গোদি মিডিয়ার দৌলতে হিন্দু নির্যাতনের খবরে ভরপুর সংবাদ ও সমাজ মাধ্যম। শুরু হয়েছে দাদাগিরি। একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাতব্বরি করা যে যায়না, সে কথা কে বোঝাবে!
অথচ আমাদের সাথে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ জীবনভর যিনি সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। নিজের সময় থেকে বহু আগে থাকা রবীন্দ্রনাথ ১৯১৭ সালে একটি বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যাশনালিশম এর মত বক্তৃতা দিয়েছেন। অদ্ভুতভাবে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ রচিত জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে আপত্তি উঠলে আমরা ক্ষুব্ধ হই, কিন্তু নিজের দেশে রবীন্দ্রনাথের কথাকে মানি না। এই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কবি তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান আর আজ আইআইটির সাবেক অধ্যাপক অযোধ্যা দেখার জন্য ভিড় জমাচ্ছেন। এই বাংলায় ধর্মমোহের মত কবিতা সবাই আওড়াতেন, এখন উত্তরপ্রদেশ থেকে আমদানি করা রামনবমীর কুৎসিত মিছিলে মানুষ মাতেন। বিজ্ঞানমঞ্চ ঘুরে ঘুরে যুক্তিবাদের প্রদর্শনী করতেন, এখন বিজ্ঞানীরা হাতে ধারণের আংটি নিয়ে রকেট ওড়ানোর জন্য প্রার্থনা করছেন। এই ধর্মমোহ কিন্তু ঘাতক। এর লক্ষ্য কোনো আত্মোপলব্ধি নয়, শুধুমাত্র অন্য ধর্মের প্রতি বিষোদগার।
রাজনীতির কান্ডারীরা এতটাই ধর্ম দ্বারা চালিত যে আপাত সেক্যুলার দল ও এখন ধর্মীয় উৎসব ও মন্দির প্রতিষ্ঠায় মেতেছেন। রামনবমীর গোবলয়চালিত মিছিলকে ঠেকাতে নিজেরাই মিছিল করছেন, আবার জায়গায় জায়গায় হনুমান মন্দির তৈরি হয়েছে। বছরভর চলছে অষ্টপ্রহর হরিনাম, উল্টোদিকে জালসা। যে কোন শিবমন্দির থেকে বেরিয়ে আসা দর্শনার্থীদের যে বয়সেরই হোক কপালে দেখা যাচ্ছে ত্রিপুন্ড্র চিহ্ন আঁকা। এই বাংলায় একদা হিন্দু মহিলাদের অনেকেই সিঁদুর পরতেন না, এখন সিঁদুরের ঘটা দেখলে অদ্ভুত লাগে। পোশাকে প্রচুর আধুনিকতা কিন্তু মাথা ভরা সিঁদুর। এতটাই যে সাম্প্রতিক যুদ্ধ অভিযানের নাম হল অপারেশন সিন্দুর, সম্ভবত বাংলা বিহারে হিন্দু ভোটের কথা ভেবে।
বাংলার ধর্মীয় পরম্পরা কিন্তু বরাবরই ভিন্ন। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে বৌদ্ধ তন্ত্র মিশেছে হিন্দু ভাবনায়। লোকায়ত জীবনে এই চর্চা বরাবরই সমন্বয় মুখী, ক্ষিতিমোহন সেন যাকে বলবেন 'যুক্ত সাধনা'। বৈষ্ণব শাক্ত বাউল ফকির কত কী যে মিশেছে এখানে যার সবখানে ছিল সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের ছোঁয়া। চন্ডীদাসের মহান বাণী সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই, এ তো গোটা বিশ্বের মানবাধিকার আন্দোলনের প্রধান বার্তা। যে কোনো কারণেই হোক, বাংলাও আজ দুর্বৃত্তদের কবলে যাদের একমাত্র উপজীব্য বিদ্বেষ। মুশকিল এই যে সমাজ মাধ্যমে আলোচনা ও সমালোচনাতেই আমাদের কাজ শেষ। পথে নেমে কাজের লোক কম। আর এখন সুস্থ পরিসর ও নেই। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের মাথায় তিলক কেটে আসতে দেখছি, তথাকথিত 'মেধাবী' ছেলেমেয়েরাও ধর্মীয় প্রতীক নিয়ে বেশি ভাবছে। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের কারণে মুসলমান মেয়েদের মধ্যেও হিজাব বোরখার চলন বেড়েছে। আদিবাসী গোষ্ঠীতে সারি সারনার দ্বন্ব বেড়েছে। এখন কে কার থেকে কতটা আলাদা এটাই প্রতিষ্ঠা করার সময়। আবার এই বাংলাতেই যথাযথ দলিত আন্দোলন না হওয়ার বর্ণব্যবস্থায় বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের একটা অংশকে হিন্দুত্বের আওতায় আনা গেছে। এও এক অদ্ভুত অবস্থা। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় এদের ভৃমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অথচ ধর্মীয় কাঠামোর ভিতরে এদের অবস্থান খুবই খারাপ।
আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে রাজনীতির উদ্দেশ্য ধার্মিক না হয়ে ধর্মের উদ্দেশ্য রাজনীতি হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা মুক্তির অপেক্ষায় আছি। আমাদের ভাবতে হবে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের এই বাংলার এমন অবস্থা কীভাবে হল। আমরা রবীন্দ্রনাথ নজরুল রোকেয়া সকলকেই বিস্মৃত হয়েছি। তাদের উত্তরাধিকার বহনের সামর্থ্য আমাদের নেই। আমরা মধুসূদনকে ভুলেছি, ভুলেছি যুক্তি, ভুলেছি মুক্তি। বাংলা পথ দেখায় না, বাংলা অনুসরণ করে ধর্মের নামে এক বিরাট রং তামাশাকে। এখন শুধুই রামের নামে হনুমানের নামে আস্ফালন মাত্র। চৈতন্য যাদের চেতনার মুক্তি ঘটিয়েছিলেন তারা আজ গোঁড়া বর্ণবাদী।
লড়াইটা কঠিন। কিন্তু করতে হবে। যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেইখান থেকেই শুরু করতে হবে। জনসাধারণের মাঝে সেই সম্পদ আছে, আমাদের লোকায়ত পরম্পরায় সেই পথ আছে। আজ 'শিক্ষিত' মানুষের মন শুদ্ধ করতে হবে। আর যেখানেই সাম্প্রদায়িক কথা, যেখানেই ঘৃণার চর্চা সেখানেই প্রতিবাদ করতে হবে। আজ দেশজুড়ে এই সমান্তরাল প্রয়াস নানাভাবে চলছে। বাংলাতেও আছে। যারা শুভকর্মে আছেন যারা পৃথক পৃথকভাবে ভালোবাসার সমন্বয়ের সহযোগিতার দীপ জ্বালছেন, তারা কাছাকাছি এলে সেই আলোতে অন্ধকার অবশ্যই দূরে যাবে। 'ধর্মকারার প্রাচীরে আঘাত হানো/ এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো। '