সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মুর্শিদাবাদ জেলার শামসেরগঞ্জে গত ১১ ও ১২ (২০২৫) এপিল নয়া ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করতে গিয়ে দাঙ্গার পরিস্থিতি গড়ে তোলা হয়েছিল। তার আগে ৮ এপ্রিলে উমরপুর মোড়ে বিক্ষুব্ধরা জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন, স্থানীয় পুলিশের সাথে সংঘাতে যান। যার জেরে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছিল। শামসেরগঞ্জ, উমরপুর দুটোই জঙ্গিপুর মহকুমা তথা জঙ্গিপুর পুলিশ-জেলার অন্তর্গত।
১১ এপ্রিল সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় সুতি থানার সাজোর (ঔরঙ্গাবাদ) মোড়ে সড়ক অবরোধ হয়। সরকারি বাসে আগুন লাগানো হয় (সাংবাদিকের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়, মোটর বাইক পুড়িয়ে দেওয়া হয় – এমন অভিযোগ ছোট পত্রিকার সম্পাদক, কল্যাণ সংঘের জেলা সম্পাদকের)। অবরোধ হটাতে পুলিশ গুলি চালায়। আহত হ’ন কাশিমনগরের যুবক প্রব্রজনকারী শ্রমিক এজাজ আহমেদ, যিনি দুদিন পরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
ওইদিনই সেই ১১ এপ্রিল ধুলিয়ান ডাকবাংলো মোড়েও সড়ক অবরোধ করা হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের দু-তিনটি দোকানে ভাঙচুর হয়। অন্যদিকে আবার এক হিন্দু মালিকেরই চালু দোকান ভাঙচুর রুখে দিয়েছেন এলাকার মুসলমান ব্যবসয়ীরা। ধুলিয়ান পুরসভার কাঞ্চনতলা থেকে একটা বড় মিছিল ডাকবাংলো মোড়ের দিকে এগোতে থাকলে বাজার এলাকার পাশাপাশি দু-তিনটে বাড়ি থেকে মিছিলের উপর ঢিল ছোঁড়া হয়। কয়েকজন আহত হন। ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় অধিক কিন্তু মুসলিম বাসিন্দা সংখ্যায় নগণ্য হলেও ব্যবসায়ীদের নধ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন সংখ্যায় ও বেচাকেনায় অনেক এগিয়ে।
ঢিল খাওয়া মিছিল এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কাছেই পুলিশ থানা ও মহকুমা পুলিশ আধিকারিক দপ্তর থাকলেও পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ঢিল ছোঁড়া হয় যে বাড়িগুলো থেকে সেগুলো স্থানীয় হিন্দুত্ববাদীদের বলেই চিহ্নিত। গুজব তৈরি হয় নানাবিধ এবং দ্রুত ছড়িয়েও পড়ে। রানিপুরে পালেদের দুটো বাড়ি ও সংলগ্ন দোকান ভাঙচুর, লুঠ হয় এবং আগুন লাগিয়ে গোটা বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই মালিকেরা আদতে পূর্ব বাংলা থেকে এসেছিলেন ৫০/৬০ বছর আগে। কিন্তু এপারে এসে কোন দিন কোন হাঙ্গামা দেখেননি আগে। এখানেও পুলিশ আসেনি। বিএসএফ এলে পরিস্থিতি কিছু নিয়ন্ত্রণে আসে। পর দিন বাজারে মুসলমান সম্প্রদায়ের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর, লুঠ হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বেশ কিছু উত্তেজিত মানুষ, দুটি পৃথক দলে ধুলিয়ান পুরসভা এলাকার বেদবোনা এবং তিন-পাকুড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার জাফরাবাদ গ্রামে গিয়ে হিন্দু বাড়িতে হামলা চালায়, ভাঙচুর ও লুঠ হয়। বেদবোনায় শতাধিক বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। তবে বেদবোনায় কোন খুন বা রক্তপাত না ঘটলেও জাফরাবাদে একই হিন্দু বাড়ির দুই জন খুন হন, সম্পর্কে তাঁরা বাবা-ছেলে। তাঁদের বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে কিছুটা দূরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়েছে। পরে অবশ্য জানা গিয়েছে এই খুনের নেপথ্যে পুরনো বিবাদ রয়েছে।
আক্রান্ত এলাকা দুটি শামসেরগঞ্জ থানা থেকে বেশি দূরে নয়। বেদবোনা ধুলিয়ান পুরসভার অন্তর্গত, জাফরাবাদ-তিন পাকুড়িয়া গ্রামপঞ্চায়েতের।পুলিশ খবর পেয়েও দুজায়গার কোনটিতেই যায়নি। বিএসএফ বাহিনীও এসেছে অনেক পরে, ভাঙচুর, আগুন লাগানো, লুঠ ইত্যাদি হয়ে যাওয়ার পরে। হামলাবাজদের সকলেই মুখ ঢেকে এসেছিল, কারও হাতে খোলা তলোয়ার, পিস্তল, পরণে কারও কারও হাফ প্যান্ট। এই হাঙ্গামা চলে মোটামুটি দুপুর পর্যন্ত। সাংসদ, বিধায়কদের বাড়ি কাছাকাছি হলেও তাঁদের রাস্তায় ১২ এপ্রিলের হামলা চলা পর্যন্ত দেখা যায়নি। মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা কামাদ-অনুপনগরে (পুরসভা অধীন) হিন্দু পূজাভূমি অক্ষত থাকল, অথচ হিন্দু এলাকার মন্দির আক্রান্ত হয়েছে।
প্রশ্ন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। তারা কোন জায়গাতেই গেল না কেন? বিএসএফকে ১১ এপ্রিল ডাকল কে, দ্বিতীয় দিন তারা আবার হামলা চলাকালে এল না কেন? পোড়া ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে পাল ভায়েরা দুদিন ঝাড়খণ্ডে আত্মীয় বাড়িতে কাটিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু বেদবোনা থেকে নদী পেরিয়ে মালদার পারলালপুর গ্রামে সাময়িক আশ্রয় নেওয়া প্রায় তিনশো মানুষ কুড়ি দিন পরেও ফিরে এলেন না কেন? অবশ্য তাঁদের নিজেদের বাড়িগুলো হামলার প্রায় ভস্মীভূত। হামলা চালিয়েছিল কারা? স্থানীয় বা বহিরাগত মুসলিমরা? নাকি মুখ ঢাকা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী বা ভারতীয় জনতা দলের রাষ্ট্রীয় মুসলিম মোর্চার লোকেরা? বিএসএফ বা বিএসএফ পোশাক গায়ে কেউ কি গুলি চালিয়ে পুরসভা এলাকার সতেরো জনকে মারাত্মক আহত করেছিল? হামলাকারীরা এলাকায় গিয়ে হাতের পিস্তল ব্যবহার করল না কেন? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন চল্লিশ বছরের মধ্যে যাঁরা কোন দাঙ্গা, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দেখেননি তাঁদের এমনটা দেখতে হল কেন?
মনে পড়ছে ভা-জ-পা নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বছর খানেক আগের হুঙ্কার, তাঁরা গোটা রাজ্য জুড়ে এমন পরিস্থিতি গড়ে তুলবেন যাতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়। ওই দলের রাজ্য সভাপতি আবার সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ চাইবেন বলে জানিয়েছিলেন। এই আইন জারি হলে যে কোন হাবিলদার পদমর্যাদার সেনাও গুলি চালিয়ে হতাহত করার, সন্দেহজনক যে কোন ব্যক্তিকে তল্লাশি করার, তার বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। রাজ্যপাল, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরা আক্রান্ত হিন্দু এলাকা পরিদর্শন করলেন, আক্রান্ত হিন্দুদের সাথে কথা বললেন, কিন্তু গুলিবিদ্ধ মুসলমানদের পরিবারগুলোর খোঁজ নিলেন না। রাজ্যপাল নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করা তাঁর রিপোর্টে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশ থেকে 'জঙ্গি' আমদানি করে তাদের দিয়ে দাঙ্গা বাধানোর ষড়যন্ত্রের কথা বললেন!
মুর্শিদাবাদ জেলায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কি এই প্রথম? আশির দশক থেকেই জেলায় একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের সংগঠন যথা আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারত সেবাশ্রম এবং মুসলমানদের সংগঠন যথা মুসলীম লিগ, জামাত বাড়তে থাকে। বাম আমলে সরকার বিরোধী আন্দোলন পুলিশ ও দলীয় বাহিনীর সাহায্যে শুরুতেই শেষ করে দেওয়ার ফলই কি এমন ধর্ম ভিত্তিক সংগঠনের বাড়-বাড়ন্ত? ইদানিং আবার মুসলমান মেয়েদের মধ্যে হিজাব পরা, বোরখা পরা বেড়েছে। মসজিদের সংখ্যা বেড়েছে, নামাজ পড়ার মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে হিন্দুদের বিশেষত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের মন্দিরে যাওয়ার ঝোঁক বেড়েছে।
১৯৮৪ সালের অক্টোবরে জলঙ্গি থানার ধনিরামপুরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অন্যতম জেলা সম্পাদক জগদীশচন্দ্র সাহা খুন হয়েছিলেন। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর শিখ প্রহরীদের হাতে ইন্দিরা গান্ধী খুন হলে বহরমপুরে জাতীয় সড়কের ধারে জনপ্রিয় পাঞ্জাবীর হোটেল আক্রান্ত হয়, মালিককে মার খেয়ে থানায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের জুন মাসে, ১৮৯৭ সালের পরে যেখানে নমাজ পড়া হয়নি সেই কাটরা মসজিদেই হঠাৎ মুসলিম লীগের পক্ষে সরকারি নিষেধ অগ্রাহ্য করে নমাজ পড়ার অভিযান শুরু হলে আতঙ্কিত হিন্দুদের ধারালো অস্ত্রে সরকারি হিসাবে ৯ জন এবং বেসরকারি হিসাবে মোট ২১ জন মুসলমান খুন হয়েছিলেন এবং এই হত্যালীলা কাশিমবাজার ছাড়াও জেলার অন্য এলাকাতেও ছড়িয়ে গিয়েছিল। সেই দাঙ্গাকালে বহরমপুর থানা ও জেলা পুলিশ সুপারের নির্লিপ্ততায় যথেষ্ট প্রশ্ন উঠেছিল।
১৯৯৯ সালেও দৌলতাবাদে এক মসজিদের দ্বিতল নির্মাণের কাজ কোন যুক্তি না দেখিয়েই পুলিশ বন্ধ করে দিলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ২০০৯ সালে নওদা থানার ঝাউবোনা উচ্চ বিদ্যালয়ে হঠাৎ হিন্দু ছাত্ররা সরস্বতী পুজো করার দাবি তোলে। তাদের এই দাবি মান্যতা না পেলে তারা শুক্রবারের টিফিনের সময় কমানোর দাবিতে বিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে। যার জেরে ওই এলাকার কয়েকটি হিন্দু দোকান আক্রান্ত হয়, পরের দিন মুসলমানদের এক শান্তিপূর্ণ জমায়েতে হঠাৎই পুলিশ গুলি চালিয়ে তিন বালককে খুন করে। বেলডাঙা থানা এলাকায়, শক্তিপুর ও সন্নিহিত এলাকায় প্রায়ই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষের জেরে ধ্বংসকাণ্ড ও মারামারি হয়ে থাকে। বেলডাঙার ভারত সেবাশ্রমের দায়িত্বে কার্তিক মহারাজের আসার পর থেকেই এমন হানাহানি শুরু হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। ভরতপুর-২ ব্লকে মালিহাটি-কান্দরা গ্রামে মহরম ও দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জনের দিন ঝামেলা হ’ত বাম আমল ও তার আগে। এইসব হানাহানি শুরু হলেই বামপন্থীদের বড় অংশকেই ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে ফেলতে দেখা গিয়েছে।
১৯৮৯ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজে এক বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের প্রাক্তন নেতা লিখিতই জানিয়েছিলেন যে মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্ত এলাকার প্রায় সব বামপন্থী আসলে কোন না কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমর্থক, মদতদাতা। তাছাড়া বাম আমলেই বামপন্থীদের মধ্যেও সুবিধাবাদী ঝোঁক, স্বজনপোষণ, সরকার বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলন সম্বন্ধে নিস্পৃহতা বেড়েছিল। তাঁদের এই আলস্য, স্বার্থপর আচরণ ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহ যুগিয়েছে।
নবাব আমলেও মুর্শিদ কুলী খাঁ একই অপরাধের জন্য হিন্দু জমিদারদের চেয়ে মুসলমান জমিদারদের লঘু শাস্তি দিতেন। তাঁর স্বল্প সময়ে কাটরা মসজিদ শেষ করার তাগিদে কাছাকাছি কয়েকটি হিন্দু দেবালয় নাকি ভাঙা হয়েছিল এবং বিনা বা স্বল্প মজুরিতে খাটানোর জন্য হিন্দু যুবকদের টেনে আনা হ’ত। প্রজাদের উপর অত্যাচার করার জন্য মুর্শিদকুলী খাঁ হিন্দু জমিদারদার শাস্তি না দিলেও বাংলার পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিন কিন্তু প্রাণদণ্ড দিয়েছেন জমিদারদের। একথা লিখেছেন নিখিলনাথ রায় তাঁর 'মুর্শিদাবাদের ইতিহাস' বইয়ে। এই বইটি প্রকাশনার পূর্ণ ব্যয় বহন করেছিলেন কাশিমবাজার রাজবাড়ির মনীন্দচন্দ্র নন্দী। কমল বন্দোপাধ্যায় তাঁর 'মুর্শিদাবাদ থেকে বলছি' বইয়ে লিখেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা টাকা চেয়ে প্রায়ই জৈন ব্যবসায়ী জগৎশেঠ মহাতাপচাঁদকে দরবারে ডেকে পাঠিয়ে বেইজ্জত করতেন। একবার মুসলমান প্রথায় সুন্নত করিয়ে দেওয়ার ভয়ও দেখিয়েছিলেন। কারগিল যুদ্ধ কালে ১৯৯৯ সালে মুসলমান চিকিৎসকদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। মুসলমানদের দেশ ভারত নয়, পাকিস্তান বলে অনেক হিন্দু প্রগতিশীল ব্যক্তিও সজোরে প্রচার করেন। সংবিধানে সংখ্যালঘুদের বাড়তি কিছু সুযোগ দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা এই সুযোগ সম্প্রসারিত হলে সরকার মুসলমান তোষণ করছে বলে তোপ দাগেন।
ভারতের সংবিধানের মুখবন্ধে সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সবাইকে সম মর্যাদা দেওয়ার শপথ বাণীর উচ্চারণ আছে। মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যর ভিত্তি হচ্ছে, আমাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য, অভিন্ন অভীষ্ট ও অভিন্ন দুঃখবেদনা। পরস্পরের দুঃখ বেঁটে নেওয়ার পারস্পরিক সহিষ্ণুতায় ওই এক লক্ষ্যে পৌঁছবার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল সহযোগিতা।’
আমাদের দেশের সাংসদ, বিধায়কেরা প্রায়ই অন্য ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে কটূ, উগ্র বক্তব্য ছোঁড়েন। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায়ই মুসলমানদের ঘুষপেটিয়া বলে ঘোষণা করেন, লুঙ্গি-দাড়ি নিয়ে বিদ্রুপ করেন। আর নয়া ওয়াকফ আইন তো দেশের সংবিধানের একাধিক অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লঙ্ঘন। তাই শুধু মুসলমান প্রধান মুর্শিদাবাদ জেলাতেই নয়, দেশের অন্যত্রও মাঝে মাঝে দাঙ্গা লাগছে।
অন্য সমস্যা মাথা চাড়া দিয়েছে। সরস্বতী শিশু মন্দিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় মাদ্রাসা ও আলআমিন মিশনের সংখ্যা বাড়ছে। জনসংখ্যা বিচারে মুসলমানদের আনুপাতিক হার ১৯৫১ সালের ৫৫% থেকে শেষ আদমসুমারিতে ৬৭% হল কীভাবে? বৃটিশ শাসন আমলে দীর্ঘ দিন মুর্শিদাবাদ জেলায় কিন্তু হিন্দুরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানদের আনুপাতিক সংখ্যাবৃদ্ধিতে বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরীর আশঙ্কা, বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মুর্শিদাবাদ ও পাশাপাশি কয়েকটি জেলা মিলে ভারত থেকে বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তুলবে। এই সংখ্যাবৃদ্ধি এবং শ্রী চৌধুরীর আশঙ্কা কি হিন্দুদেরও আতঙ্কিত করেছে?
যে জেলায় ১৯৪৬ সালের দেশভাগের দাবিতে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় রাম মন্দির ও বাবরি মসজিদ কাণ্ডে গড়ে ওঠা দাঙ্গার কোন ছাপ পড়েনি সেই জেলা স্থানীয় কারণেও পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ জাহির করছে কেন? (এবারের ওয়াকফ আইন নিয়ে ক্ষোভ অবশ্য স্থানীয় নয়।) মুসলমান ও হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে এই জেলায় বাউল-ফকির ও দলিতদের নানাভাবে নিপীড়িত হওয়ার খবর মিলছে। এ জেলার নওদা থানার শালিখডাঙ্গা গ্রামের দলিতরা হিন্দু মন্দিরে ঢোকার সু্যোগ না পেয়ে নিজেরা পৃথক পুজো করেন। এগুলো জাতি বা বর্ণ দাঙ্গা বলে এড়িয়ে গেলে বা মৌলবাদ আখ্যা দিয়ে নিস্পৃহ থাকলে ভবিষ্যৎ কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে। তার সাথে অর্থ ও পেশিবলের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারি সুযোগ হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে নিরাশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে।
বারো এপ্রিল থেকে গভীর রাতে পুলিশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের নিয়ে আগাম অনুমোদন ছাড়া ও মহিলা পুলিশ সঙ্গে না নিয়েই জোর করে বাড়ি বাড়ি ঢুকে কিশোর, যুবকদের ঘুম থেকে তুলে মারতে মারতে নিয়ে গিয়েছে, গ্রেপ্তার করেছে, এমন মার ও তুলে নিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাড়ির মহিলাদের অকথ্য ভাষায় কথা বলেছে পুলিশ ও জওয়ানরা, কিন্তু জবাব দেয়নি। আবার পরবর্তীতে জানা গিয়েছে যে আলি লস্করপুর এলাকায় সঞ্জয় দাস নামের এক যুবক শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে স্থানীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হুমকি, হামলার শিকার হয়েছেন। প্রায় কুড়ি দিন লেগেছে ধুলিয়ান ও সংলগ্ন এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য, শ্রমজীবীদের রোজগারে এগারো এপ্রিলের পূর্ব স্বাভাবিকতায় ফিরে যেতে।
এই দাঙ্গা জেলার বামপন্থীদের গৃহকোণ সর্বস্বতা, পুলিশের একাংশের মুসলমান বিদ্বেষ, ক্ষমতালোভী হিন্দুত্ববাদীদের উগ্র ও হিংস্র বাসনার প্রকাশ ঘটিয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করেছেন বা করার নির্দেশ দিয়েছেন অনেক দেরিতে। মুর্শিদাবাদ জেলার বাইশ জন বিধায়কের মধ্যে ২০২১-এর নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেসীরা শূন্য হয়ে গেলেও ভারতীয় জনতা দলের প্রার্থীরা দুটি কেন্দ্রে জিতেছেন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়ী তিন তৃণমূল প্রার্থীর সাথে জোর টক্কর দিয়েছিলেন। অবশ্য অঘোষিত বাম-কংগ্রেস-ভাজপা জোটের কথাও গোপন নাই। এর ফল দাঁড়িয়েছে যে আর একটু চাপ দিলে দলীয় নেতাদের বড় বড় আর্থিক দুর্নীতি প্রকাশে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেসকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে আসতে দেখা যাচ্ছে না