সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক নির্মল কুমার বসু গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহাত্মা গান্ধী ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে দুটি পর্যায়ে মোট বারোটি বক্তৃতা করেন ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬৯ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৭০ এর মধ্যবর্তী সময়কালে। এই পর্যায়ে ১১ তম বক্তৃতার শিরোনাম ছিল গান্ধীবাদ এবং গণতন্ত্র। প্রসঙ্গত এই বক্তৃতামালার উদ্বোধন করেছিলেন ‘সীমান্ত গান্ধী’ খান আব্দুল গফ্ফার খান। বক্তৃতাগুলি Gandhism and Modern India শীর্ষক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে আলোচিত বিষয় ভাবনার সঙ্গে দুটি তথ্য পাঠককে সাহায্য করতে পারে। ১৯১৬ থেকে ১৯১৯ এর মধ্যে মহাত্মা গান্ধী বিহারের চম্পারণের নীল আন্দোলন তথা কৃষক আন্দোলন এবং আহমেদাবাদের বস্ত্র শ্রমিকদের দীর্ঘ ধর্মঘটের সফল নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। বস্ত্র শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সময় শ্রমিকদের জন্য পরিপূরক কাজ খুঁজে বের করে তাদের আত্মসম্মান বজায় রাখার দিকে বিশেষ নজর রাখা হয়েছিল।
একটি বক্তৃতায় সম্পূর্ণ মার্কসবাদ এবং গান্ধীবাদের তুলনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় এবং তা সম্ভবও নয়। কিন্তু আজ এখন আমাদের পরিকল্পনা হল দুটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিস্তৃত তুলনা করা যাতে বিশেষ করে গান্ধীবাদী পথের কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরা যায়। এই প্রচেষ্টার সময় মার্কসীয় পথের প্রতি অবিচার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যেতেই পারে; তবে যদি আমরা মনে রাখি যে বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্য সীমিত, তাহলে সবাই এই সত্যটি উপেক্ষা করতে পারবেন না যে এখানে মার্কসবাদকে তার সমস্ত ব্যাপকতা সহ উপস্থাপন করা হচ্ছে না।
মার্কস এবং গান্ধীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল যে, মার্কস তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনকে সু-যুক্তিপূর্ণ, বিস্তৃত বই আকারে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন; অন্যদিকে গান্ধী প্রতিদিন লিখতেন এবং যখন যে সমস্যার মুখোমুখি হতেন তার উপর লিখতেন। তিনি কখনও তার মতামতের কোনও পূর্ণাঙ্গ দলিল তৈরি করেন নি; বরং তিনি বিস্তৃতভাবে কিছু নির্দিষ্ট স্থির নীতির দিগ্দর্শনের উপর আস্থা রেখেছিলেন। ফলত যেভাবে তার বক্তব্য প্রকাশ বা ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এবং তিনি যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন তার প্রকৃতির মধ্যে যথেষ্ট ফারাক পরিলক্ষিত হয়েছিল। তাই বিশদভাবে বুঝতে গেলে মনে হয়, যেন তিনি সময়ে সময়ে তার নিজের কিছু বক্তব্যের সঙ্গে বিরোধিতা করছেন। সুতরাং, উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতির যথেচ্ছ ব্যবহার ও শিল্পায়ন সম্পর্কে গান্ধীর ধারণা, পেশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জাতিপ্রথা, এমনকি পংক্তি ভোজন এবং আন্তঃবিবাহ সম্পর্কে, বর্ণ সম্পর্কে তার মতামত; জমিদার শ্রেণী সম্পর্কে তাঁর মতামত, রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে, সব মিলিয়ে ১৯০৯ সালে লেখা তাঁর 'হিন্দু স্বরাজ' বা 'ইন্ডিয়ান হোম রুল' বা ১৯২৫ অথবা ১৯৩১ এমনকি ১৯৪৭ সালের তুলনায় যথেষ্ট ভিন্নতা দেখা গেছে।
কিন্তু যখন এই পরস্পরবিরোধী কিছু বক্তব্য তাঁর সামনে তুলে ধরা হয়েছিল, তখন তিনি রসিকতার সুরে পাঠকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, তাদের কেবল সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলিই গ্রহণ করা উচিত, যদি না পূর্ববর্তী বিবৃতিগুলিতে তাদের পছন্দ করার নিজস্ব বিশেষ কারণ থাকে। এই বিবৃতির সময়, তিনি আরও বলেছিলেন যে তিনি সর্বদা এই মুহূর্তে যা সত্য বলে মনে করেন তা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন এবং যদি কেউ যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে দেখেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে তিনি যে মৌলিক সত্যগুলির প্রতি বরাবর আনুগত্য রেখেছেন তা সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়েছে।
গান্ধীজী এবং তাঁর রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শন অধ্যয়নের সময় আমাদের এই বিষয়টি মনে রাখতে হবে; এবং তাহলে আমরা তাঁকে আরও ভালভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব।
মার্কসীয় এবং গান্ধীবাদী পদ্ধতির মধ্যে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। বিপ্লবের মার্কসীয় পদ্ধতিতে, সশস্ত্র শ্রমিকদের দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা জয় করতে হবে এবং সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব হিসাবে যে সামাজিক পরিস্থিতির কল্পনা করা হয়েছে তা গ’ড়ে তুলতে হবে। সেখানে সশস্ত্র শ্রমিকদের শাসিত রাষ্ট্র তাদের স্বার্থ দেখবে ও তাদের অবস্থা উন্নত করবে। তার জন্য তাদের স্বার্থের প্রতিকূল প্রতিটি বিরোধী স্বার্থকে নির্মমভাবে চূর্ণ করবে। প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা আর্থ-সামাজিক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যা স্বাভাবিকভাবেই শোষণের উপর ভিত্তি করে চলে, তা বিলোপ করতে হবে। নতুন আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে এবং তারপর যারা এতদিন ধরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যদের পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত ছিল, তাদের হয় উচ্ছেদ করা হবে, অথবা নতুন প্রতিষ্ঠানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে তাদের 'নতুন অভ্যাস' গড়ে তুলতে হবে।
১৯১৭ সালে লেখা তাঁর ধ্রুপদী গ্রন্থ 'দ্য স্টেট অ্যান্ড রেভোলিউশন'-এ লেনিন সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বকে অন্তত এভাবেই বর্ণনা করেছেন। আর একটি খুবই আকর্ষণীয় বিষয় হল, সেই বইটিতে লেনিন অন্যান্য অনেক মার্কসবাদীরা যেভাবে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে মার্কস এবং এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে ভুল করেছিলেন, তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। একটি বিবৃতিতে তিনি ক্ষুব্ধভাবে আরও বলেছিলেন যে নব্বই শতাংশ, বা তারও বেশি তথাকথিত মার্কসবাদীরা সর্বহারা বিপ্লবে রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে মার্কস যা লিখেছেন তা সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি। আমি স্বীকার করতে চাই যে এই প্রসঙ্গটি আমার কাছে খুবই স্বস্তিদায়ক। কারণ যদি পেশাদার বিপ্লবী এবং মার্কসবাদের সনিষ্ঠ ছাত্ররাও মার্কসকে ঠিক ভাবে বুঝতে না পারেন, এবং যদি মার্ক্সের নিজস্ব লেখার স্পষ্টতা এবং যুক্তি ধারা থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে এটা অপ্রত্যাশিত নয় যে গান্ধীর ক্ষেত্রেও ভুল বোঝাবুঝি দেখা দেবে, যিনি সপ্তাহ থেকে সপ্তাহান্তে লিখেছিলেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সাথে তার পথও পরিবর্তন করেছিলেন।
যাই হোক, আসুন দেখি রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধী কী ভাবতেন।
টলস্টয়ের দর্শনে গভীরভাবে প্রভাবিত একজন ব্যক্তি হিসেবে, গান্ধীজি কখনই রাষ্ট্রের মতো একটি একক প্রতিষ্ঠানে আরও বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পক্ষে ছিলেন না। তিনি একবার বলেছিলেন যে তিনি একজন দার্শনিক-নৈরাজ্যবাদী। কিন্তু, একজন প্রায়োগিক আদর্শবাদী হিসেবে, তিনি এটাও জানতেন যে রাষ্ট্র ভবিষ্যতে চিরকালের জন্য থাকবে। অতএব, তার সুপারিশ ছিল যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং কার্যাবলী ন্যূনতম স্তরে রাখা উচিত; বর্তমানে রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত বেশিরভাগ কাজ শত শত বিভিন্ন ধরণের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা উচিত।
অন্যভাবে বললে, যদিও সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের বিপরীতে 'রাষ্ট্রের ক্ষয়' শুরু হওয়া উচিত একটি প্রক্রিয়ার অঙ্গ হিসেবে, কিন্তু গান্ধীজির ধারণা ছিল এই ক্ষয় এখনই শুরু হওয়া উচিত। শ্রমিকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে সমস্ত বিরোধিতা দূর করার কাজটি কেবল রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত করা উচিত নয়। বরং তা শ্রমিকদের সম্মিলিত অহিংস প্রচেষ্টার মাধ্যমে হওয়া উচিত। যখনই কর্তৃত্বের অপব্যবহার হয় তখন তা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হওয়া উচিত। ক্ষমতা বন্টন এবং 'স্বরাজ'-এর অর্থ সম্পর্কে এটাই ছিল তাঁর ধারণা।
সেই ধারণা অনুযায়ী এই কাজ সম্ভব করার জন্য, তিনি ভারতে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাথমিক পর্যায়েই, মূলত গঠনমূলক কাজের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন; যেমন খাদি, গ্রামীণ শিল্প, মৌলিক শিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছিলেন, যাতে ভারতীয় মানবতার শোষিত অংশকে অর্থনৈতিক শক্তি-সম্পন্ন করা যায়। যদি রাষ্ট্র তার জাতীয়তাবাদী সহকর্মীদের অধীনে এই লক্ষ্য পূরণে ইচ্ছুক হয়, তবে তিনি তা স্বাগত জানাতেন। কিন্তু যদি তারা এই কাজে শ্রমজীবীদের সাথে সহযোগিতা না করে, তবে তিনি নিজের পথে যেতেন এবং জনসাধারণে, সহায়তা-বঞ্চিত-শক্তির উপর নির্ভর করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন।
একজন বাস্তববাদী মানুষ হিসেবে, গান্ধীজিও বুঝতে পেরেছিলেন যে জনগণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন হতে পারে। তাই রাষ্ট্রকে জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতিকূল সেইসব স্বার্থকে উচ্ছেদ করতে হবে। তিনি আরও বলেছিলেন যে খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদির মতো পরিপূরক প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনের উপায়গুলি জনগণের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। সেই উদ্যোগ জনগণের স্বেচ্ছাসেবী জোটের অধীনে, শত শত ধরণের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এবং শত শত বিভিন্ন স্তর বিশিষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু যেখানে এটি সম্ভব নয়, সেখানে তার মালিকানার নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত করা উচিত।
অন্য ভাবে দেখলে, এভাবেই গান্ধীজি সমাজতান্ত্রিক অবস্থানের যতটা সম্ভব কাছাকাছি এসেছিলেন; কিন্তু তিনি তার ধারণা, সমাজ বদলের রূপরেখা এবং মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক মতবাদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্রবক্তারা আজকের শোষক শ্রেণীর সদস্যদের রূপান্তরে বিশ্বাস করেন না। আর তার বিপরীতে গান্ধীজি তাদের রূপান্তরের সম্ভাবনার প্রতি বিশ্বাস বজায় রেখেছিলেন এবং সম্মিলিত শ্রমিকদের অহিংস প্ররোচনার চাপে তাদের রূপান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে ভেবেছিলেন। যদি তাও তাদের পরিবর্তন না হয়, তাহলে সত্যাগ্রহীদের অহিংস অসহযোগের মাধ্যমে তাদের সৈন্যবাহিনি এবং চাকরদের মন জয় করে তাদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে। মানব প্রকৃতির বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শোষণের এই পচে যাওয়া প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রবিন্দুকে বিচ্ছিন্ন করাই হবে, একজন অহিংস মানুষের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে পারার উদ্দেশ্য বা সীমানা।
গান্ধী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে একটি শোষণমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থেকে, যারা সেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন সেই ব্যক্তিদের মানুষ হিসাবে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করা উচিত। এটা হতেই পারে, যে তারা প্রতিষ্ঠানটি নিজে গড়ে তোলেননি বরং উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন এবং এর অধিকার ও সুবিধাগুলি উপভোগ করছিলেন। তাই তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রচার করেননি, কেবল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই প্রচার করেছিলেন। সত্যাগ্রহের পরিকল্পনা হল বীরত্বপূর্ণ অহিংসার মাধ্যমে তাদের মানসিকভাবে রূপান্তরিত করা এবং তা হলে তারপর নতুন শোষণমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করা সম্ভব। এই কারণেই, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, অথবা 'শহরবাসী' শ্রেণীর বিরুদ্ধে, অথবা সাধারণভাবে ধনীদের বিরুদ্ধে গান্ধী তাঁর কোন লেখায় জনগণের ক্রোধ জাগানোর চেষ্টা করেননি। তিনি সর্বদা বলতেন যে যেখানে সাম্রাজ্য শক্তি অব্যাহত আছে বা পুঁজিবাদ তার সাম্রাজ্য কায়েম করে রেখেছে, সেখানে তা অব্যাহত আছে শুধু এই কারণে নয় যে শ্রমজীবী মানব সম্প্রদায়কে দমনমূলক চাপের মুখে কেবল বশ্যতা স্বীকার করানো হয়েছে। বরং তারা ভয়ের কাছে পরাজিত হয়ে বা ক্ষুদ্র তাৎক্ষণিক লাভের প্রতি ভালোবাসার কারণে তাদের প্রতি দমনমূলক সেই ব্যবস্থার সাথে 'সহযোগিতা' করেছিল। তাই প্রকৃত ‘অনুসন্ধানের প্রদীপ কে নিজের ভিতরে ফিরিয়ে আনা’ এবং অনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতার প্রলোভন থেকে নিজেদের মুক্ত করা, আমাদের নতুন জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজন। তা সে সাম্রাজ্যবাদী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে হোক বা ধনীদের শাসনের বিরুদ্ধে হোক এবং তা অহিংস অসহযোগের মাধ্যমে দুটি স্তরে হতে পারে- এক গঠনমূলক কাজ আর দ্বিতীয়ত আইন অমান্য আন্দোলন।
অতএব, প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গান্ধীজী ব্যক্তিকে যে অবস্থান দিয়েছিলেন, তা এমন একটি বিন্দু যেখানে তিনি মার্কসবাদী বা সমাজতন্ত্রের অন্যান্য ধারার থেকে পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে গান্ধীবাদের কিছু ছাত্র এই পার্থক্যকে অতিরঞ্জিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সমালোচকদের একটি গোষ্ঠীর অভিমত এই যে গান্ধী সামাজিক পরিবর্তনের পথ হিসেবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নৈতিক রূপান্তরের উপর নির্ভর করেছিলেন। তবে এটি একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি বলে মনে হয়।
টলস্টয় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, একজন ব্যক্তির উচিত যীশু খ্রীষ্টের দ্বারা নির্ধারিত নৈতিক নীতির উপর নির্ভর করে তার জীবনকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা। যদি তিনি তা পুরোপুরিভাবে করেন, তাহলে তাকে মন্দ প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাগুলিকে প্রতিরোধ করার কোন প্রয়োজন হবে না। সমর্থনের অভাবে শেষোক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাগুলিও নিশ্চিহ্ন হবে। তিনি তাঁর নীতিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন - 'মন্দকে প্রতিরোধ করো না'। কিন্তু গান্ধী যদিও টলস্টয়কে এমন একজন মহান শিক্ষক হিসেবে দেখতেন, যার প্রতি তিনি ঋণী ছিলেন, কিন্তু তবুও তিনি তার গুরুর থেকে এই বিষয়ে একেবারেই আলাদা মত পোষণ করতেন। গান্ধী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তিনি কেবল ব্যক্তিসমষ্টির রূপান্তরের জন্য অপেক্ষা করতে পারবেন না। মানব-প্রতিষ্ঠান এবং মানব সমাজকে রূপান্তরিত করার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক নিখুঁত বা প্রায় নিখুঁত ব্যক্তি কখনও থাকবে না। তার মধ্যেই মানবজাতি অনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাগুলি থেকে উদ্ভূত আগুনে আচ্ছন্ন হতে পারে। অতএব, তার পরিকল্পনা ছিল মানুষকে তাদের মতো করে নেওয়া, বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাগুলির ভুল কী তা তাদের জানানো এবং 'সম্মিলিত অহিংস' প্রচেষ্টার মাধ্যমে, নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা গড়ে তোলার চেষ্টা করা এবং অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে মন্দকে শেষ করা।
তিনি জানতেন যে শোষণমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরোধে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে উঠে দাঁড়াতে পারে না। তাই তাঁর পরিকল্পনা ছিল তাদেরকে ধাপে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ১৯২১ সালে, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তা ছিল মৃদু; ১৯৩০ সালে জনগণকে কেবল মাত্র কারাবরণের পরিবর্তে শাস্তিমূলক জরিমানা দেওয়া এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বুলেটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এবং এই সময়ে, তিনি সত্যাগ্রহীদের ছোট ছোট দল গড়ে তোলারও চেষ্টা করেছিলেন যারা অহিংস প্রতিরোধের আরও গভীরে যাবে এবং জনসাধারণের মধ্যে যারা এখনও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উচ্চতায় উঠতে পারেনি তাদের জন্য একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। এইভাবে গান্ধী অহিংসার অনুশীলনে জনগণকে ব্যক্তিগতভাবে নয় বরং সম্মিলিতভাবে, প্রগতিশীল পর্যায়ে উন্নীত করে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। এবং এই উদ্যোগ কেবল উচ্চ নৈতিক স্তর অর্জনের জন্য নয়, বরং পুরানো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার এবং তাদের জায়গায় নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য গ্রহণ করা হয়েছিল। কোনওভাবেই তার এই উদ্যোগকে, টলস্টয়ের মতো কেবল ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে উদ্দেশিত তা বলা যায় না। এমনকি তিনি এক সময় বলেছিলেন যে 'যুদ্ধ শত্রুর শিবিরে নিয়ে যাওয়া উচিত'; যে কথাটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণা থেকে অনেক দূরে।
মানব প্রকৃতির রূপান্তরের সম্ভাবনার প্রতি গান্ধীজির বিশ্বাস এবং যারা মন্দ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পক্ষে সম্পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে তাদের ঘৃণা করতে অস্বীকৃতির তত্ত্ব, আসলে সত্য প্রচারের উপায় হিসেবে ‘অহিংসার’ উপর নির্ভরতা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। একজন মার্কসবাদী সব সময় পরিস্থিতির ক্রমাগত পরীক্ষা করে সত্যের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের চেষ্টা করেন। তিনি 'বিজ্ঞানী'। তিনি তার সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ করেন যাতে তার কোন ভুল না হয়, দলের মধ্যে তাদের সমালোচনার আহ্বান জানান। কিন্তু একবার তিনি একটি ‘থিসিসে’ পৌঁছে গেলে; তখনকার মতো অন্তত, সেই ‘থিসিসের’ সঠিকতার কারণে তিনি মনে করেন যে প্রয়োজনে সহিংসতার মাধ্যমে অন্যদের উপর পার্টির ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার অধিকার রয়েছে।
আমাদের সময়ে, আমরা দেখেছি যে মার্কসবাদীদের একাংশের ইচ্ছাশক্তি অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে এমনভাবে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তারাও নিজেদের মার্কসবাদী বলে দাবি করে। ট্রটস্কি বা বুখারিন, হাঙ্গেরি বা চেকোস্লোভাকিয়ার ইতিহাসের দুঃখজনক গল্পগুলি আমাদের পড়তে হবে না; কিন্তু যখন আমরা আজ বিশ্বে কী ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করি, তখন আমরা নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে যে এ কি কেবল সহিংসতা, নাকি একটি দলের ইচ্ছাকে অন্য দলের উপর চাপিয়ে দেওয়ার দক্ষতাই একজনের উদ্দেশ্যের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ। আর যদি 'নৈতিকতা' শব্দটি অভিশাপ হয়, তাহলে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে পারি: অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব কি বিজয়ী দলের 'থিসিস'-এর বৈধতার প্রধানতম প্রমাণ?
সারা পৃথিবী আজ এই ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আজকের পরিস্থিতি নতুন পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে; আধুনিকতম যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে অথবা কোনধরণের হুমকির মাধ্যমে মানুষ একের পর এক নতুনতর অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। ফলস্বরূপ, বিশ্ব যে বিভিন্ন দলের নেতৃত্বে চলছে, তাদের প্রত্যেকেই দাবি করে যে তারা 'বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে' পরিস্থিতিকে সর্বোত্তমভাবে বুঝে সেইমতো ব্যবস্থা নিচ্ছে। পুরোহিত বা ব্রাহ্মণদের একটি নতুন শ্রেণী, ক্ষত্রিয়ের ভূমিকা নিয়ে সময়ে সময়ে ব্যাখ্যা করছে কোনটি 'প্রগতিশীল' এবং কোনটি 'পশ্চাদগামী' ঘটনা। আর তাদের নেতৃত্বে জনসাধারণ তাদের পরিবর্তনবিহীন একই অবস্থানে থেকে যায়; তাদের পদক্ষেপের সঠিকতা সম্পর্কে সন্দেহ করে, সংশয়ী হয়ে ওঠে। 'সঠিকতার' চূড়ান্ত প্রমাণ 'সাফল্য', এবং তা ক্ষমতা প্রদর্শন বা ব্যবহারের মধ্যে নিহিত বলে মনে হয়।
সময়ের এই সন্ধিক্ষণে গান্ধী এমন একটি পদ্ধতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যা তাত্ত্বিকভাবে দেখতে গেলে এই রকম যে - কোনও মানুষ, কোনও দল, কোনও জাতি সত্যকে তার সম্পূর্ণতায় দেখে না। প্রত্যেকেই কেবল টুকরো টুকরো করে সত্য দেখে, এবং প্রতিটি ব্যক্তি এবং সংস্থার উচিত হল তার 'ধর্ম' অনুসারে জীবনযাপন করা এবং অন্যদের 'নিজস্ব ধর্ম' অনুসরণ করার অধিকারকে সম্মান করা। কিন্তু এমনও হতে পারে যে একজনের 'ধর্ম' অন্যজনের 'ধর্ম'-এর সৌহার্দ্যপূর্ণ হবে না বরং সংঘর্ষপূর্ণ হবে।
ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সংরক্ষণ এবং নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বে সৎভাবে বিশ্বাস করে। ব্রিটিশদের সেই ‘ধর্ম’ থেকে যারা ভারতীয়দের শ্রমজীবী জনগণকে রক্ষা করতে চায় তাদের অধিকার ও কর্তব্য অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই তাকে ব্রিটিশদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে। এইরকম পরিস্থিতিতে গান্ধী যা চেয়েছিলেন তা হল ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব 'ধর্ম' অনুসারে জীবনযাপন করবে এবং ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের নিপীড়নের বিরোধিতা করবে। কিন্তু সেই বিরোধিতা কেবল অহিংসার মাধ্যমে হওয়া উচিত, কখনও হিংসার সাহায্যে নয়। কারণ তিনি মনে করতেন যে অহিংসা, সত্যাগ্রহ এবং আইন অমান্যই গণতন্ত্রের গ্যারান্টি; সহিংস সংগ্রামের নীতি অনিবার্যভাবে একনায়কতন্ত্রের দিকে পরিচালিত হয়, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক। এমনকি নাগরিক প্রতিরোধের মধ্যেও, যখন মানুষ তার নিজস্ব সত্যের দৃষ্টিভঙ্গি, তা যতই অসম্পূর্ণ হোক, অনুসারে জীবনযাপন করতে সক্ষম হয় এবং অন্যদেরও তাদের মতো জীবনযাপন করার অধিকার নিশ্চিত করে, সেটাই গণতন্ত্র। প্রতিটি দলের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে শালীন, সভ্য প্রতিরোধের মাধ্যমে অন্যদের নিজেদের মতাবলম্বী করা।
গান্ধী ভেবেছিলেন যে, এইভাবে বিকশিত গণতন্ত্রই কেবল মানব স্বাধীনতা এবং অগ্রগতির নিশ্চিত গ্যারান্টি হতে পারে।