সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গেলেই কি একটা দেশ গণতন্ত্র? ইদানিং বেশির ভাগ গণতন্ত্র বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, না। একে তো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রায়শই হয় না, তার ওপর নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি না থাকে, তো সে দেশটাকে গণতন্ত্র বলা যাবে না। বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে ভারতে এই অর্থে আর পূর্ণ গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রকে পর্যবেক্ষণ করাই যাদের কাজ সেইসব সংগঠন সবাই একবাক্যে ভারতকে ‘হাইব্রিড শাসন’ বলে অভিহিত করেছে, যার অর্থ হল এ দেশটা এখন ‘না পূর্ণ গণতন্ত্র না পূর্ণ স্বৈরতন্ত্র’। ২০২১ সালে ‘ফ্রিডম হাউস’ তার মূল্যায়নে ভারতকে ‘পূর্ণ’ থেকে ‘অংশত পূর্ণ’তে নামিয়ে দেয়। ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মতে ভারত একটি ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’। ঐ ২০২১ সালেই সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষণ, প্রয়োগ করেছে ‘ভ্যারাইটিজ অফ ডেমোক্র্যাসি প্রকল্প। তাদের মতে ভারত এখন একটি ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’।
যথারীতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ এই সব মূল্যায়নের সজোরে প্রতিবাদ জানায়। বলা হয় এগুলো পশ্চিমী প্রবণতার নজির। কিন্তু পশ্চিমী প্রবণতার দোহাই দেওয়াটা ভুল। এই সংস্থাগুলো পশ্চিমী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দোষগুণেরও সমান সমালোচনা করে। আসলে আন্তর্জাতিক স্তরে যেটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের গণতান্ত্রিক অধঃপতনের অর্থ হল গণতান্ত্রিক পৃথিবীটার দুর্বল হয়ে যাওয়া।
FPTP ও অন্যান্য নির্বাচনী প্রসঙ্গ
প্রথমেই আসা যাক নির্বাচনের কথায়। নির্বাচন নিয়ে আমাদের সংবিধানেই এমন একটা ব্যবস্থা আছে যার ফলে বাস্তবে আমাদের গণতন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যালঘিষ্ঠের গণতন্ত্র। ব্যবস্থাটা হল First Past the Post System। এই সেই ব্যবস্থা যার জোরে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় এসেছেন। FPTP যেসব দেশে চালু, তার মধ্যে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, লাতিন আমেরিকার বহু দেশ এবং ব্রিটিশের অধীনে থাকা উপনিবেশিক দেশগুলি, যার মধ্যে ভারত অন্যতম।
উপনিবেশিক ভারতে এই ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলেই চালু হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সংবিধান থেকে নিয়ে ১৯৫০ সালে আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। FPTP-র অর্থ হল একটি একক সদস্যের নির্বাচনকেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের থেকে মাত্র একজনকেই ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। যেহেতু নির্বাচনকেন্দ্রগুলিতে বহু প্রার্থী থাকে এবং ভোটগুলি ভাগ হয়ে যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পেয়েও একজন জিতে যেতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ কোনো একটি নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রে ধরা যাক ১০০ জন ভোটার আছে এবং প্রার্থী আছে ৩ জন। ক, খ ও গ। ধরা যাক ক ভোট পেয়েছে ৩৬, খ ৩৫ এবং গ ২৯। এক্ষেত্রে সর্বাধিক ভোট (৩৬) পেয়ে প্রার্থী ক-ই বিজয়ী ঘোষিত হবে, যদিও সে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করছে না।
এ পর্যন্ত যে ষোলোটা লোকসভার সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে সর্বাধিক ভোটদানের হার ছিল ২০১৪ সালে, ৬৬.৪ শতাংশ। তার মধ্যে এনডিএ-র প্রধান দল বিজেপি ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। এর অর্থ হল মোট ভোটারের (১০০-৬৬.৪)=৩৩.৬ শতাংশ হয় ভোট দিতে পারেন নি, বা ভোট দিতে চান নি বা তাঁদের ভোট দিতে দেওয়া হয় নি। আবার, এই ৬৬.৪ শতাংশেরও অর্ধেকের কম ভোটে (৬৬.৪-৩১) জিতে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। স্বাধীনতার সময় থেকে সর্বাধিক আসন পাওয়া (২৮২) একটি দলের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ধরলে এই সংখ্যাটা ছিল সবথেকে কম। ২০১৯ সালে সংখ্যাটা ছিল আরো কম, ২৫.১৫ শতাংশ, অর্থাৎ মোট ভোটারের এক চতুর্থাংশ। নির্বাচন মিটে যাবার পর এহেন ‘low mandate’ নিয়ে এবং এসংক্রান্ত আরো কিছু প্রশ্ন তুলে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফরমস অ্যান্ড কমন কজ সুপ্রিম কোর্টে যায়, আজ অব্দি সে কেসটা তালিকাভুক্ত হয়নি। এমনকি নির্বাচন কমিশনের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ তুলে এবং জানতে চেয়েও লাভ হয় নি। ২০১৯ সালের নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ নিয়ে বহু শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন আমলা সমালোচনা করেছিলেন, সমালোচনা করেছিল নাগরিক সমাজ সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলি, কিন্তু নির্বাচন কমিশন এসব মতামতকে কোনো পাত্তা দেয় নি।
২০২১ সালে সিটিজেন্স কমিশন অন ইলেকশনস, যার মাথায় ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতি, দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। বিবেচ্য বিষয় ছিল ভোটার তালিকার বিশুদ্ধতা ও অন্তর্ভুক্তি, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং (ইভিএম/ভিভিপ্যাট) ইত্যাদি। দেখা গেল সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হতে পারে এমন সব গোষ্ঠীর নাম, সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর নাম, মুসলমান বা খ্রিস্টানদের মত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাম বাদ গেছে। ভোটকেন্দ্রে মাইগ্র্যান্টদের পক্ষে ভোট দেওয়াও একটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সব থেকে, বড় কথা, কমিশনের মতে, ভোটার আইডিকে আধারের সঙ্গে যুক্ত করার যে প্রয়াস নির্বাচন কমিশন চালাচ্ছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, কারণ এই প্রয়াসের ফলে ব্যাপক পরিমাণ তথ্য প্রকাশ্যে চলে যাবে, তথ্য জালিয়াতি হবে এবং চুরি হবে। ইভিএম/ভিভিপ্যাট সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গণতান্ত্রিক মূলনীতিগুলির শর্ত ইভিএম পূরণ করতে পারে নি। ভোটাররা যে ভোট দিচ্ছেন সেই ভোটগুলি তাঁরা যেখানে চাইছেন সেখানেই পড়ছে কিনা ভোটারদের কাছে তা জানার কোনো সরাসরি উপায় নেই। হ্যাকিং থেকে, ভোট নষ্ট করা থেকে, ভোট জাল করা থেকে প্রদত্ত ভোটকে (polled votes) যে আটকানো যাচ্ছে তার কোনো প্রমাণযোগ্য গ্যারান্টি নেই। যদিও প্রতিটি ইভিএমেই ভিভিপ্যাট আছে, ফলাফল ঘোষণার আগে প্রদত্ত ভোটের সঙ্গে প্রকৃত ভোট গুণে বা মিলিয়ে দেখা হয় না।
এতো গেল ইভিএম/ভিভিপ্যাটের জালিয়াতি। এছাড়াও রয়েছে অপরাধীকরণ, টাকা ও ক্ষমতার খেলা এবং ইলেক্টোরাল বন্ড। ২০০৯ সালে ১৪ শতাংশ এমপি-র বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ছিল, ২০১৪ সালে সেটা এসে দাঁড়ায় ২১ শতাংশে, ২০১৯ সালে ২৯ শতাংশে। এঁদের মধ্যে কারো কারো অপরাধ রীতিমতো গুরুতর। এবং শতাংশের হিসেবটা ক্রমশই বাড়তির দিকে। আমাদের দেশে দুর্নীতির সবথেকে বড় উৎস হচ্ছে নির্বাচনে টাকা ও ক্ষমতার খেলা। নির্বাচন এবং পরবর্তীতে নীতিনির্ধারণ নিয়ন্ত্রণ করে বৃহৎ পুঁজি। ইলেক্টোরাল বন্ডেও বড় পুঁজির খেলা বেড়েছে, যার পুরো সুবিধাটাই পেয়েছে শাসক গোষ্ঠী। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করেছিল রাজনৈতিক দলগুলি, ৬০,০০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে শাসক বিজেপি একাই ব্যয় করেছিল ২৭,০০০ কোটি টাকা, প্রতি আসনে ৮৯ কোটি টাকা। সে বছর এনডিএ মোট আসন পেয়েছিল ৩০৩।
মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট নিয়ে নির্বাচন কমিশন ছেলেখেলা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী যাতে সমস্ত প্রকল্পগুলির (১৫৭টি) উদ্বোধন করতে পারেন, নির্বাচনের সময়সূচীকে এত দীর্ঘ (৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ) করে দিয়েছিল যা আমাদের দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে কখনো ঘটে নি। এছাড়াও ছিল সংবিধানের ৩২৪ ধারা অনুযায়ী নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ না করে শাসক গোষ্ঠীর প্রতি নরম মনোভাব দেখানো, নির্বাচন কমিশনের একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন নিয়মানুযায়ী যাঁর চিফ ইলেকশন কমিশনার হওয়ার কথা, সেই অশোক লাভাসাকে পেছনের দরজা দেখিয়ে দেওয়া, নির্বাচনের প্রয়োজনে শাসক গোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী নামানোর সিদ্ধান্তের মঞ্জুরি দেওয়া এবং ইত্যাদি। ২০২৪ সালেও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার এই ধরন অব্যাহত ছিল।
সবার ওপরে ছিল মিডিয়ার ভূমিকা। প্রধান সংবাদমাধ্যম এবং গণমাধ্যমগুলি শাসক গোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তি করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। না তারা এসংক্রান্ত নির্দেশিকাগুলির বা নিয়মকানুনগুলির কোনো তোয়াক্কা করেছিল, না নির্বাচন কমিশন এসংক্রান্ত বিধিভঙ্গের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিল। ২০১৯-এর মার্চ মাসে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠে ‘নমো টিভি’ এবং এই টিভিটি খোলাখুলি শাসক বিজেপির হয়ে প্রচার চালায়। নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয় নি।
জরুরি অবস্থার সময় আরএসএসের ভূমিকা
ভারতের গণতন্ত্র আগে আরো একবার দুর্বল হয়েছিল। সেটা ছিল ২৫ জুন ১৯৭৫ থেকে মার্চ ১৯৭৭ সাল। ২১ মাসের সেই কালো অধ্যায়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপর যে আঘাত এনেছিলেন তার জন্যে তাঁকে আগে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করতে হয়েছিল। শ্রীমতী গান্ধী নির্বাচন নিষিদ্ধ করেছিলেন, সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, নাগরিক অধিকারগুলোকে ধ্বংস করেছিলেন, স্বাধীন মিডিয়াগুলোর কণ্ঠরোধ করেছিলেন, সাংবাদিকদের জেলে পুরেছিলেন। তিনটে এমন সাংবিধানিক সংশোধনী এনেছিলেন, যা আদালতের ক্ষমতাকে খর্ব করেছিল।
কিছুদিন আগে বিজেপি ঘোষণা করেছিল যে কংগ্রেসের স্বৈরতন্ত্রের স্বরূপকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে তারা ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার কথা তাদের প্রচারে আনবে। ঘোষণা অনুযায়ী তারা ২৫ জুন সংবিধান হত্যা দিবস পালন করেছে। জরুরি অবস্থার ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু যেটা জানি না ভারতীয় জনসংঘের এবং জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী মাত্র দুদিন জেলে ছিলেন এবং তাঁকে ছেড়ে দিলে তিনি সরকারবিরোধী কোন কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করবেন না এই শর্তে মুচলেকা দিয়ে প্যারোলে মুক্তি পান। এই তথ্যের জোগানদার স্বয়ং সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী। ২০০০ সালের ১৩ জুনের ‘হিন্দু’ সংবাদপত্রে তাঁর লেখা The Unlearnt Lessons of Emergency নামক নিবন্ধ থেকে এই কথাগুলো জানা যায়। ঐ একই নিবন্ধে তিনি আরো জানিয়েছেন ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ আরএসএস নেতারা জরুরি অবস্থাকে পূর্ণ ও খোলাখুলি সমর্থন জানিয়ে একটি দলিল প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেন। জরুরি অবস্থা ঘোষিত হবার পর আরএসএস নেতা মাধবরাও মুলের ওপর ভার পড়ে সরকারকে বিব্রত না করে সাংগঠনিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার। একনাথ রানাডেকে বলা হয় সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছতে। সেই সময় সুব্রহ্মনিয়াম স্বামীকে দেওয়া হয়েছিল ব্রিটেন সহ অন্যান্য দেশ থেকে জরুরি অবস্থা বিরোধী আন্দোলনের সপক্ষে সমর্থন আদায় করার কাজ। কিন্তু ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে মুলে স্বামীকে কাজ বন্ধ রাখতে বলেন, কারণ আরএসএস খসড়া ‘document of surrender’ চূড়ান্ত করে ফেলেছে যেটা সই হবে জানুয়ারি মাসের শেষে। এ তথ্য শুধু স্বামীর লেখায় নেই, আছে তৎকালীন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান টি. ভি. রাজ্যেশ্বরের ‘India-The Crucial Years’ বইতে এবং আরো কোনো কোনো নিবন্ধে।
এই সময় আরএসএসের সরসংঘচালক বালাসাহেব দেওরস শ্রীমতী গান্ধীকে মোট তিনটি চিঠি লিখেছিলেন। শ্রীমতী গান্ধী ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। সেই বছরই স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লা থেকে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে এবং দেশের নিরাপত্তার খাতিরে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছে এবং যারা এর বিরুদ্ধাচারণ করছে তারা দেশদ্রোহী। এর এক সপ্তাহ বাদে ১৯৭৫ সালের ২২ অগস্ট বালাসাহেব দেওরস শ্রীমতী গান্ধীকে প্রথম চিঠিটি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি ১৫ তারিখের ভাষণের জন্যে শ্রীমতী গান্ধীর খোলাখুলি প্রশংসা করেন। তিনি বলেন যে জরুরি অবস্থা জারি করাটা খুবই সময়োচিত এবং যথাযথ কাজ হয়েছে। আরএসএস সম্পর্কে শ্রীমতী গান্ধীর ভুল ধারণা ভাঙতে তিনি এই চিঠি লিখেছেন। তিনি যেন আরএসএসের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ আছে সেটা তুলে নেন। আরএসএস একটি হিন্দুদের সংগঠন তৈরির চেষ্টা করছে মাত্র এবং তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে নন। দ্বিতীয় চিঠিটির একটি প্রেক্ষাপট আছে। ১৯৭৫ সালের ২৪ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্বাচনে সরকারি ক্ষমতা অপব্যবহারের ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগে শ্রীমতী গান্ধীর নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করে। যার ফলশ্রুতি পরের দিনই অর্থাৎ ২৫ জুন জরুরি অবস্থা জারি। রায়ের বিরুদ্ধে শ্রীমতী গান্ধী সুপ্রিম কোর্টে যান। এবং ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ বশংবদ সুপ্রিম কোর্ট শ্রীমতী গান্ধীর নির্বাচনকে বৈধ ঘোষণা করে এবং তাঁর সমস্ত ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার এই হাল দেখে গণতন্ত্রপ্রেমী প্রতিটি মানুষ সেদিন জেলের ভেতর থেকে বাইরে থেকে এই রায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল, শুধুমাত্র আরএসএস বাদে। এর ঠিক তিন দিন বাদে ১০ নভেম্বর ১৯৭৫ বালাসাহেব দেওরস শ্রীমতী গান্ধীকে লিখেছিলেন, “Let me congratulate you as five judges of the Supreme Court have declared the validity of your election.” দুটো চিঠির একটাকেও শ্রীমতী গান্ধী কোনো গুরুত্ব দেন নি। এর পর তৃতীয় চিঠিটি দেওরস লেখেন, কিন্তু এবারে আর শ্রীমতী গান্ধীকে নয়, বিনোবা ভাবেকে, যিনি আরএসএসের বন্ধু ছিলেন এবং শ্রীমতী গান্ধীর ওপরও তাঁর কিছু প্রভাব ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে শ্রীমতী গান্ধী বিনোবা ভাবের আশ্রমে যান। এবং এই সময় দেওরস ভাবেকে একটা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে শ্রীমতী গান্ধীকে বলার জন্য ভাবেকে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন নিষেধাজ্ঞা যদি তুলে নেওয়া হয়, তাহলে সংঘের স্বয়ংসেবকরা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে প্রগতি ও সাফল্যের স্বার্থে যে কর্মযজ্ঞ চলছে তাতে অংশ নিতে পারবে।
নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা
- অঘোষিত জরুরি অবস্থা?
সেই সময়কার হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের ও বিজেএসের উত্তরসূরি হল আজকের বিজেপি। বোঝাই যাচ্ছে জরুরি অবস্থা নিয়ে তাদের কোনো ছুৎমার্গ ছিল না। কারণ এই দলটি মূলত স্বৈরতান্ত্রিক। কিন্তু সুচতুর এই দলটি সহজেই বুঝতে পেরেছে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও স্বৈরতান্ত্রিক হওয়া যায়। ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই ব্যাপারটা নতুন। গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে স্বৈরতান্ত্রিক হওয়া যায় না বলেই শ্রীমতী গান্ধীকে আগে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল। বিজেপি সে রাস্তায় হাঁটে নি। জরুরি অবস্থা জারি না করেই জরুরি অবস্থার মত পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছে। আনল’ফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ইউএপিএ), ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (এনএসএ), প্রিভেনশন অফ মানিলন্ডারিং অ্যাক্ট (পিএমএলএ)-মত দানবীয় আইনগুলোর যদৃচ্ছ প্রয়োগ করে, সে একই কাজ করছে। ইলেকশন কমিশনকে ব্যবহার করে নির্বাচন জেতা থেকে শুরু করে সিবিআই, ইডি, আইটি দিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে সদাসন্ত্রস্ত রাখার কৌশল (বেশ কিছু বিরোধী দলের নেতা মন্ত্রী ইতিমধ্যেই এই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে), প্রতিটি নাগরিক সংগঠনের ও ব্যক্তির ওপর তীক্ষ্ণ নজরদারি (বেশ কিছু নাগরিক সংগঠন ইতিমধ্যেই এই তীক্ষ্ণ নজরদারির শিকার হয়েছে) ১১ বছরের শাসনকালে সবই বিজেপি করে দেখিয়ে দিয়েছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বন্ধু পুঁজিপতিদের সাহায্যে বশংবদ বানিয়ে নিয়েছে। তারা হয়ে গেছে শাসক দলের মাউথপিস। বাকি যেসব স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এখনো অতটা বাধ্য হয়নি তাদের দেয় সরকারি বিজ্ঞাপনের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। হুবহু শ্রীমতী গান্ধীর স্টাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ২০২৬ সালের মধ্যে তিনি নকশালদের নিকেশ করে ছাড়বেন, যদিও একদা সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেছিল, Republic must not kill its own children। সব মিলিয়ে এখনকার অবস্থার সঙ্গে শ্রীমতী গান্ধীর ২১ মাসের জরুরি অবস্থার তেমন তফাৎ নেই। এই জন্যে অনেকেই বলছেন এ হল ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’। এমনকি বিরোধী পক্ষের নেতা কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খাড়্গেও অনুরূপ কথা বলেছেন। অবশ্য শ্রীমতী গান্ধীর ২১ মাসের সঙ্গে একটা তফাৎ আছে। জরুরি অবস্থা ছিল ২১ মাসের, বিজেপির ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’র ১১ বছর চলছে।
২০২৩ সালে ৪৭টা বিল পেশ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৩০টা বিল সংসদের উভয় কক্ষই পাশ করে দিয়েছিল। যেহেতু নরেন্দ্র মোদীর সরকার রাজ্যসভা লোকসভা উভয় সভাতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ, লোকসভার নিয়মকানুনের কোনো ধার ধারে নি, বিরোধী পক্ষের মতামত জানার জন্যে সিলেক্ট কমিটিগুলির কাছে পাঠানো অব্দি হয় নি। এইসব বিলের বেশির ভাগই রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে গেছে, আইন হবার অপেক্ষায়।
বাজেট অধিবেশনে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীকে ডিস্কোয়ালিফাই করা নিয়ে বিরোধী পক্ষ প্রতিবাদ করেছিল এবং আদানির টাকাকড়ি নিয়ে জয়েন্ট পারলিয়ামেন্টারি কমিটির তদন্ত দাবি করেছিল। বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিরোধী পক্ষ মণিপুরের ঘটনা নিয়ে তুমুল আওয়াজ তোলে এবং এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অন্তত একটা বক্তব্য দাবি করে। পরিণামে ৫ জন লোকসভার সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়। শীতকালীন অধিবেশনে যেটা ঘটল সেটা অভাবনীয়। বিরোধী পক্ষের ১৪৬ জন সদস্যকে (রাজ্যসভার ৪৬ জন ও লোকসভার ১০০ জন) কোনো নিয়মকানুন না মেনেই অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সাসপেন্ড করা হয়। যে ২৪৬টা প্রশ্ন তাঁরা তুলেছিলেন তা নথি থেকে মুছে দেওয়া হয়, যার অর্থ হল ২৪ কোটি ভারতীয় যারা তাঁদের নির্বাচিত করেছিল অগণতান্ত্রিকভাবে তাদের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়া। প্রতিবাদ আর সাস্পেন্সনের ফাঁকে ফাঁকে তড়িঘড়ি বিলগুলোকে কোনো আলোচনা ছাড়াই পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল, খতিয়ে দেখার জন্যে বিলের খসড়া বিরোধী পক্ষকে পাঠানো অব্দি হয় নি।
২০২৪ সালে দেওয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বয়ান অনুযায়ী মাত্র ১৬ বছরের শাসনকালে (অটলবিহারী বাজপেয়ীর ৬ বছর ও মোদির ১০ বছর) বিজেপি মোট ২২টি সাংবিধানিক সংশোধনী আইনে পরিণত করেছে, যার বেশ কিছু নিয়ে তীব্র আপত্তি উঠেছে। যার মধ্যে সর্বাধিক বিতর্কিত ইউএপিএ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ও ন্যায় সংহিতা।
পাথালগড়ি আন্দোলন
শুরুরও যেমন শুরু থাকে, তেমনি ২০১৯ সালের ইউএপিএ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টেরও একটা শুরু আছে। সেটা ছিল ২০১৭ সালের ঝাড়খন্ডের খুঁতি জেলার আদিবাসীদের পাথলগড়ি আন্দোলন। বিরসা মুন্ডার অকালমৃত্যুর পর পাথলগড়ি আন্দোলন প্রথম দানা বাঁধে। পাথরে লিখে জমির অধিকার ও এলাকার স্বায়ত্তশাসনের কথা ঘোষণা করা হয়। যার ফলে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় ১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট রূপায়িত করে জমির অধিকার আদিবাসীদের ফিরিয়ে দিতে। মূলত পাথরগুলি স্বশাসন নির্দেশ করার জন্য, সার্বভৌম অঞ্চল নির্ধারণ করার জন্য ও বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য লেখা হয়েছিল। স্ল্যাবের শব্দগুলি ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত অর্থের সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে না।
২০১৬ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় সরকার দুটি অর্ডিন্যান্স জারি করে আদিবাসীদের জমি সরকারকে হস্তান্তরের পাশাপাশি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। এই দুটি অর্ডিন্যান্সের প্রতিরোধেই পাথলগড়ি আন্দোলন আবার জেগে ওঠে। ২০১৬-১৭ সালে বিজেপির ঝাড়খন্ড সরকার হুবহু কেন্দ্রীয় সরকারি পদ্ধতিতে ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট ১৯০৮ সংশোধনের জন্য বিধানসভায় অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুরমু-র কাছে বিল পাঠায়।
প্রস্তাবিত বিলটির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের বিক্ষোভ ক্রমশই তীব্র আকার ধারণ করে। বিলের সংশোধনীর বিরুদ্ধে মোট ১৯২টা স্মারকলিপি রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিল। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুরমু শেষপর্যন্ত বিলগুলিতে সম্মতি দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং সেই সঙ্গে স্মারকলিপিগুলি সহ বিলটি রাজ্য সরকারকে ফেরত পাঠান।
ঘটনার অবশ্য এখানেই শেষ নয়। ২০১৯ সালের মধ্যে প্রায় ১০০০০-১৫০০০ জন আদিবাসীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। হাজার হাজার আদিবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কারো কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে এই ২০১৯ সালেই ইউএপিএ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের জন্ম হয়।
ইউএপিএ অ্যাক্টে আগে যেখানে শুধুমাত্র সংগঠনগুলিকেই সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘোষণা করা যেত, ২০১৯ সালে ১৯৬৭ সালের সেই আইন সংশোধন করে একজন ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘোষণা করার আইন চালু হল। এই সংশোধনী ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিকে (এনআইএ) এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের তদন্তের ক্ষমতা দিল, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দিল।
ভীমা কোরেগাঁও কেস বা এলগার পরিষদ কেস যাকে সংক্ষেপে বলা হয় বি১৬ তাতে কিছু খ্যাতনামা মানবাধিকারকর্মীকে/সমাজকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাঁদের মধ্যে ছিলেন রোনা উইলসন, ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, ফাদার স্ট্যানস্বামী, অরুণ ফেরেইরা, গৌতম নওলাখা, আনন্দ তেলতুমড়ে এবং ভারনন গঞ্জালভেস। ইউএপিএ আইনে এঁদের সবাইকে এনআইএ গ্রেপ্তার করেছিল এবং দীর্ঘদিন যাবৎ কোনো জামিন দেয় নি। অসুস্থ ফাদার স্ট্যানস্বামী কোনো জামিন ছাড়াই জেলবন্দী অবস্থাতেই মারা যান, যদিও তাঁর পারকিনসনস ছিল। ইতিমধ্যে আমেরিকার একটা ডিজিটাল ফরেনসিক কোম্পানি রোনা উইলসনের কম্পিউটার হ্যাক হওয়ার অব্যর্থ প্রমাণ দেয় এবং যে ২২টা ফাইল ভীমা কোরেগাঁও কেসের প্রধান সাক্ষ্য সেগুলো কিভাবে একটা ইজরায়েলি সফটওয়ারের সাহায্যে উইলসনের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু এনআইএ এই অভিযোগ স্বীকার করে নি, আদালতও ব্যাপারটার গুরুত্ব দেয় নি।
সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নানা কারণেই দেশেবিদেশে নিন্দিত হয়েছে। তার মধ্যে সবথেকে বড় দুটো কারণ হল ভারতীয় নাগরিকদের ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা যা সরাসরি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শবিরোধী ও মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করার বন্দোবস্ত। ন্যায় সংহিতার নামে যে তিনটি নতুন আইন আনা হয়েছে তা আসলে নতুন বোতলে পুরোনো মদ। নাম পালটে সেই একই ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, সেই একই সিআরপিসি, সেই একই ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট। তবে যেভাবে বদলানো হয়েছে, কপিল সিবালের বিশ্লেষণে ন্যায় সংহিতা হয়ে উঠেছে ভারতকে পুলিশ স্টেটে পরিণত করার চেষ্টা।