সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আজ দুপুরে, বসেছিলাম মাটির এক গোল ইস্কুল ঘরে। আমার এই গ্রামের সাথে অনেক দিনকার সম্পর্ক। হয়তো সময় মেপে দেখতে গেলে সাত বছর, কিন্তু সময়কে যদি পরিবর্তন এর মাপকাঠি হিসেবে ধরি, তাহলে যেন এক জন্ম কেটে গেছে এখানে। অন্তর ও বাহিরের পরিবর্তন। মধ্য ভারতের বেশির ভাগ গ্রামের মতই এই গ্রামটাও পাহাড়ের ঢালে সাজানো। ঢালের একেবারে তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক নদী, তার উপর সাজানো সারি সারি ধানক্ষেত। পাহাড়ের ঢাল ধরে আরো একটু উপরে গেলে পাওয়া যাবে আদিবাসীদের সুন্দর নিকোনো ঘর। নীল দেয়াল এর উপর হলুদ, সবুজ, কালো’র বিভিন্ন প্যাটার্ন। দেখে মনে হবে, এখানে কোনো দুঃখ নেই। তবে কান, চোখ, মন খোলা রেখে কয়েক বছর কাটালে বোঝা যায়, ক্ষুধা, অভাব, অত্যাচারকে মোকাবিলা করতে আদিবাসী মানুষজনদের সাহায্য করে এই রঙ আর আলপনা। এবার পাহাড়ের গা ধরে আরো একটু উঠলে আরম্ভ হয়ে যায় এলোমেলো ভাবে সাজানো ঝোপঝাড় আর ছোট ছোট গাছপালা। এর আগে চললে কিন্তু পথ হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে যদি না আমরা গাঁয়ের মানুষের তৈরি করা পথ অনুসরণ করে চলি। বড় গাছ, ছোট গাছ, জীর্ণ গাছ, অপুষ্ট গাছ, মানুষের আকাঙ্ক্ষার মতো মৃতপ্রায় গাছ, মুছে দেওয়া হাসির মতো শুকনো গাছের গুঁড়ি। আবার এরই মধ্যে দেখা যায় কিছু দুর্বল গাছ একে অপরের সাহায্য নিয়ে বেড়ে চলেছে সূর্যের দিকে। সবল হোক বা দুর্বল, এই জঙ্গল হচ্ছে জীবনদায়ী। এই জঙ্গল বর্ষার জলকে ধরে রাখবে জলের ট্যাংকের মতো- লতায়, পাতায়, শিকড়ে, এমনকি ঝরে যাওয়া পাতায় তৈরি জৈব পদার্থেও। তার সারা শরীর ও মন দিয়ে সে ধরে রাখবে জলের প্রতিটি কণা আর মাটির তলায়, আমাদের অদৃশ্যে পাতা হবে লক্ষ লক্ষ সরু সরু অতিসূক্ষ্ম নল, যার মধ্যে দিয়ে জল ভিজিয়ে রাখবে নিচের গ্রামের মাটি, ধান আর সবজির ক্ষেত। এই জল, প্রাণ জোগাবে গাছ, ফসল, পোকামাকড়, পশুপক্ষী, আদিবাসীদের নাচ, গান, মাটি-লেপা বাড়িকে। প্রাণিত করবে তাদের স্বপ্ন, কল্পনা আর নতুন দিনের ভোর।
আবার কিছু মানুষ প্রবহমান এই জল বোতল-বন্দি করে, ফন্দি আঁটবে আলাদিনের গল্পের দৈত্যর মতো ব্যবহার করতে। তার জন্য সে সব গাছ গুঁড়ি পর্যন্ত কেটে দেবে, মাটির তলার লক্ষ লক্ষ কৈশিক নল (অতিসূক্ষ্ম নল) নষ্ট করে ফেলে সন্ধান করবে সোনা, রূপা, ক্রোমিয়াম, কয়লা, মাইকা আরও অনেক অনেক খনিজরূপ খাদ্যের, যা দিয়েও তার অফুরন্ত ক্ষুধা মিটবে না। এই দৈত্যদের দলবলই একদিন ধাওয়া করবে মানব সমাজ। তখন কী হবে তার কিছুটা আভাস আমরা আজকেই পাচ্ছি।
এই গ্রামের জঙ্গল ছিল জীর্ণ। চেষ্টা করে ও ধরে রাখতে পারত না জলের শতসহস্র কণা। তারও তো নিজের তাড়া আছে। যেতে হবে তাকে নদী-পথ হয়ে বিশাল সমুদ্র তৈরি করতে। প্রাণ দিতে আরো অনেককে। এই আদিবাসী গ্রামে তো তার থেমে থাকলে চলবে না।
যেতে দেবো, কিন্তু গ্রামে আমার স্পিড লিমিট মানতে হবে - এই ছিল জলের সঙ্গে জঙ্গলের চুক্তি। আমার এলাকা দিয়ে যদি বইতে হয়, আমার গ্রামের চাষের জমি ভেজাতে ভেজাতে যেতে হবে।
প্রাণ নিয়ে তো দর কষাকষি করা যায় না, যে ওই প্রাণ বেশি দামী তাই আমি চললুম সেখানে- সেটা মেনে নেয়নি জঙ্গল। হয়তো জলও গোটা পৃথিবীর প্রাণ ব্যবস্থা বুঝে এই চুক্তি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বাইরে থেকে আসা কিছু লুটেরা মানুষের দৈত্য সদৃশ খোঁজার লালসায় জঙ্গল হয়ে গেছিল দুর্বল, খুবই দুর্বল। এত দুর্বল যে জঙ্গলের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে জল চলে যেতে আরম্ভ করে ছিল দ্রুত বঙ্গোপসাগরে। ভালবাসা বা চুক্তি কোনোটাই আর বেঁধে রাখতে পারেনি জলের এই প্রবাহ। তাই এখানকার মানুষ, গাছ, চাষ, পোকা-মাকড়, নাচ-গান আর স্বপ্ন সব হয়ে পড়েছিল ক্লান্ত, নিরাশ, নিরানন্দ।
এমনি এক সময় কিছু বছর আগে গ্রামের কিছু চিন্তাশীল মানুষ বুঝে ছিল যে গ্রামের ইতিহাস, এলাকার ইতিহাস, দেশের এবং মানব সভ্যতার ইতিহাস পূর্ব নির্ধারিত নয়। পুরোটা নিজের মতন করে না হলেও, ইতিহাসের পথ আমরা সবাই একটু একটু করে তৈরি করতে পারি, ছোট ছোট চুক্তি করে, বন্ধুত্ব করে আবার অনেক সময় শত্রু বুঝে নিয়ে। ঠিক যেমন জলের সাথে যখন চুক্তি করেছিল জঙ্গল, তখন গ্রামের ইতিহাস ছিল এক, আবার যখন চুক্তি ভেঙে গেলো তখন ইতিহাস নিলো অন্য রূপ। এই গাঁয়ের মানুষরা খুঁজছিল বন্ধু এবং অন্য মানুষজন , যাদের সঙ্গে ওরা কিছু ন্যায় সঙ্গত চুক্তি করতে পারত। আদালতের দ্বারা অনুমোদিত চুক্তি নয়, উভয় পক্ষকে ভালোবাসার ডোরে বাঁধতে পারে এমন চুক্তি। নাহলে ইতিহাস যেদিকে যাচ্ছিল, তা ছিল তাদের জন্য হতাশা ভরা, অন্তর্জলী যাত্রা। এই ইতিহাসের মুখ ঘোরাতে গ্রামের মানুষ হয়ে উঠল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ঠকানো, গা জোয়ারি, মিথ্যা, লুট, প্রতারণার সঙ্গে তারা ভালো মতোই পরিচিত, তাই তারা খুব সাবধানে বন্ধু খুঁজতে বেরোলো।
সেই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এই গ্রামের মানুষেরা এগিয়ে গিয়েছিল গুটি গুটি পায়ে, জঙ্গলের সঙ্গে জলের পুরোনো চুক্তি ফিরিয়ে আনতে। ন্যায়ের খাতিরে এই অসম চুক্তির দুর্বল দিকটা বেছে নিয়েছিল গ্রামের মানুষ আর তাদের বন্ধুরা। এখানে গ্রামের নাম উল্লেখ করা যাবে না, দৈত্য দানবেরা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ফিরে আসি আজকের দিনে। যে মাটির ইস্কুল ঘরে বসে আছি, তার পাশেই রয়েছে এক টিনের চালের ঘর। গ্রাম আর জঙ্গলের মাঝামাঝি এই স্কুল ঘর। জমি দেওয়ার সময় হয়তো মানুষ ভুলতে পারেনি তাদের জীর্ণ জঙ্গলের কথা। হয়তো তারা ভেবেছিলেন, বাচ্চাদের দেখে জঙ্গলও আনন্দ পাবে। হয়তো আদিবাসী মানুষেরা ভেবেছিলেন, যে ভাবে শিল্পকলা দিয়ে তাঁরা ক্ষিদে আর অভাবের সঙ্গে লড়াই করেন, জঙ্গলও হয়তো বাচ্চাদের হাসির মধ্যে খুঁজে পাবে বেঁচে থাকার, যুঝবার শক্তি। ঠিকই ভেবেছিলেন তাঁরা।
এই ইস্কুল তৈরির পর দেখা দিলো বাচ্চাদের খাবার জলের অভাব, তৈরি হলো কুয়ো। সেই কুয়োতে বেশি দিন জল থাকলো না, কেন না মাটির তলার লক্ষ লক্ষ কৈশিক নল না থাকলে, কুয়ো জল ধরে রাখবে কী ভাবে? এখান থেকে আরম্ভ হলো জলের সঙ্গে ধরপাকড়, কথোপকথন, মিষ্টি কথা আর তর্ক। কিছুটা চাপ, কিছুটা মন থেকে, জল ঠিক করলো আর একটু বেশি সময় দেবে এই গ্রামে। ধরা দিলো নিজেকে নতুন ভাবে খনন করা পুকুরে, পাথর ঘেরা ছোট ছোট বাঁধে। জল হোঁচট খেলো হাজার হাজার ছোট ছোট গর্তে যেগুলো গ্রামের মানুষ আর তাদের বন্ধুরা ধীরে ধীরে কেটে ছিল। জলের সাথে খুব বেশি গা জোয়ারি বা বলপ্রয়োগ চলে না, এটা গ্রামের মানুষ জানত। জলকে তো যেতে হবে সাগরে, না হলে সাগরও অতৃপ্ত থেকে যাবে। অন্যকে দুঃখ দিয়ে কী নিজের সুখ সৃজন করা যায়? সেটা তো দৈত্য দানবদের কাজ। এখানকার মানুষ বোঝে, সুখ পাওয়া যায় না। সুখ একটা ব্যবস্থার ফল মাত্র, যে ব্যবস্থায় সবাই জড়িয়ে আছে - পোকামাকড়, গাছপালা, জন্তু জানোয়ার, মানুষজন, মাটি পাথর ... সবাই। জল বুঝেছিলো এই গ্রামের মানুষের আবেদন ও নম্র বিনতি। সে কিছুটা সময় গ্রামে রইলো। এই থেমে থাকা জল ঢুকতে থাকলো ভূগর্ভে আর কেঁচো, পিঁপড়েদের তৈরি সরু সরু চ্যানেল দিয়ে খুব ধীরে বইতে রইল তার গন্তব্যের দিকে। ইস্কুলের কুয়োতে জল থাকতে শুরু করলো আর একটু বেশি সময় ধরে ।
এবার ইস্কুলের বাচ্চারা চলল জঙ্গলের দিকে তাদের শিক্ষিকা শিক্ষকদের সঙ্গে। শিক্ষিকা এবং শিক্ষকদের হাতে আর কাঁখে ঝুড়ি। ঝুড়ির মধ্যে রাখা মাটি-ছানা শ’য়ে শ’য়ে লাড্ডু। এই মাটির লাড্ডুর মধ্যে আছে অনেক রকমের বীজ- শাল, মহুয়া, কেন্দু, নিম, পলাশ, শিমুল- আরো কত সব বীজ, সব বীজের নাম তাদের জানা না থাকলেও গ্রামের মহিলারা জানেন । মহিলারা এই বীজ কুড়িয়ে, মাটির ডেলা পাকিয়ে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ছিলেন। সেই ভেজা মাটির ডেলা রোদে শুকিয়ে এই লাড্ডু বানান হয়েছে । জীর্ণ জঙ্গল তার বুকে ঝরে পড়া বীজের ভাল করে লালন পালন করতে পারেনা। যেখানে মাটি ধুয়ে গেছে, পাথর বেরিয়ে গেছে। যেখানে পাতা পড়ে সার তৈরি হয়না, সেখানে নতুন জীবন কী ভাবে জন্ম নেবে? অথচ এই পৃথিবীতে প্রাণের লালন পালন করেছে জঙ্গলই।
শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের সঙ্গে ক্ষুদেরা দমাদম এই বীজ ছড়িয়ে দিলো জঙ্গলে। এক শিক্ষিকা বললেন, বর্ষার জলের ফোটা যখন এই মাটির লাড্ডুর উপর পরবে, তখন বীজের মধ্যে অনেক দিন ধরে কুন্ঠিত প্রাণশক্তি আহ্বান পাবে বেরিয়ে আসার। সেই শক্তি শিকড় ছাড়বে মাটির খোঁজে আর ডগা বেরোরে সূর্যের খোঁজে। প্রাণ! প্রাণ ফুটে উঠবে এই জীর্ণ জঙ্গলে। কোন ইস্কুল কলেজ এমন প্রাণদায়ি বিদ্যা অর্জন করতে পারে ক্ষুদেরা? আমার তেমন কোন ইস্কুল জানা নেই।
গ্রামের বড় মানুষেরাও ছড়াতে থাকলেন। হাজার হাজার বীজ, লাগাতে থাকলেন গাছের পর গাছ । বর্ষার জল পড়তেই গজিয়ে উঠলো ছোট বড় গাছ। ছড়িয়ে দিলো তাদের ডাল পালা। অনেক ছোট ছোট গাছ, লতান গাছেরা বড় গাছকে আলিঙ্গন করে তেড়ে ফুঁড়ে উঠলো আকাশ ছোঁবে বলে। কোলাহলটা যেন ধীরে ধীরে গানের রূপ নিতে আরম্ভ করলো। ফিরে এলো খরগোশ, শেয়াল, হায়েনা, অজগর। ময়ূর পেখম মেলতে দ্বিধা বোধ করলো না, প্রজাপতি ডানা ঝাপটে ঝড় তুলে দিলো রাজধানীগুলোতে, কেঁচোরা লেগে গেলো মাটি নরম করার কাজে। যেন রবি ঠাকুরের গান বেজে উঠলো এই গাঁয়ের জঙ্গলে -
কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।
এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে॥
গানে গানে তৈরি হতে লাগলো মাটির তলার লক্ষ লক্ষ অতিসূক্ষ্ম সব নল ও চ্যানেল । গাঁয়ে ফিরল গান, মাদলের শব্দ। ছোট ছোট নদী নালাগুলো ঠিক করলো যে বর্ষা ফুরোলেই যে তারা থেমে যেত, সেটা যেন ঠিক না। এই ভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকাটা কি মানায়? স্কুলের ওই ক্ষুদেগুলো কী ভাববে? চলো স্বনির্ভর হই, বর্ষার শেষে কিছু দিন নিজেরাই টানি - কেঁচো, পোকামাকড়গুলো যখন এত কাজ করেছে, আমরাও কাঁধে কাঁধ মেলাই।
ধানের ক্ষেতে এখন অনেকটা রস থাকে বর্ষার বেশ কয়েক মাস পরেও। ধান গাছ মরার প্রশ্নই ওঠে না। ধান কাটার সময় এখন মাঠ ভর্তি জল। কাস্তে দিয়ে ধান কাটার শব্দ মিশে যায় জলা মাঠে পা ফেলার সাথে, আকাশের জল দিয়ে ভরা এই ভূস্বর্গের মাঠ। চারিদিকে এতটাই জল যে মানুষে সরষে, বেগুন, আলু, টমেটো, লঙ্কা, কত কিছুই না লাগাতে আরম্ভ করেছে । রবি ফসলে পুষ্টি আর আয় দুইই আছে। জঙ্গলের গান নেমে এলো মাঠে - হাওয়ার দোলায় ফসলের গান, ধান কাটার গান, ধান ঝাড়ার গান, দুবেলা পেট ভরার গান, বেজে উঠল এই গ্রামে। পলাশের লাল-কমলা হ’ল আরো উজ্জ্বল, তিতিরেরা সব আরো চঞ্চল। ইস্কুল ঘরের বাচ্চাদের কন্ঠ হলো সতেজ।
বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেলো, অবশ্য যদি পরিবর্তন দিয়ে গুণি সময়কে। পাল্টালো পরিবেশ, মানুষের শরীর, মন আর চেতনা। এমনি একদিন গাঁয়ের এক পাড়ায় আলোচনা সভা- ধীরে ধীরে মানুষজন তাদের কাজ সেরে আসছেন। রমেশদা বললেন গাছের তলায় বসলে ভালো হয়, তাই আমরা সবাই হাঁটতে থাকলাম গাঁয়ের সীমানার দিকে। চাষের কথা জিজ্ঞেস করতে, একজন বললেন- এইবার যা সরষে চাষ হয়েছে, বাইরে খাটতে যাইনি। কেই বা আর যেতে চায় ঘর পরিবার ছেড়ে!
রমেশদা পরে আছেন এক সিমেন্ট কোম্পানির গেঞ্জি- চাষী মানুষের শরীর ব্যবহার করেছে সেই কোম্পানি বিজ্ঞাপনের জন্য। কোমরে গামছা এবং মাথায় বাঁধা সাঁওতালি পঞ্চি। গ্রামের বন্ধুরা বাইরের থেকে এসেছে বলে দৌড়ে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের সবুজ চেয়ার নিয়ে এলেন। তার ভাঙা হ্যান্ডেল সাইকেলের টিউব দিয়ে বাঁধা। এখানে বসুন!
কথার মধ্যে একটা অদ্ভুত লয়। যেন দৌড়ে গিয়ে, হঠাৎ থেমে যাচ্ছেন আর গভীর ভাবে ভাবছেন পরের পদক্ষেপটা। আমরা বললাম, আপনি চেয়ারে বসুন আমরা মাটিতে বসছি। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, না না আমি চেয়ারে বসিনা, মাটিতে বসি। আমরা বললাম তাহলে আমরা সবাই মাটিতেই বসি? হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই ভালো, বললেন রমেশদা। খানিক থেমে বললেন, মাটিতে বসেই খাঁটি কথা হয়। সেটাই ভালো। রমেশদার এই কথা আমাদের নাড়িয়ে দিলো। চেয়ার, গদি, উপরে বসা, নিচে বসা তাঁর চেতনার উপর কতটা প্রভাব ফেলেছে! বাইরের মানুষের থেকে খাঁটি কথা শুনতে তারা অভ্যস্ত নন। কোনো চুক্তি কোনোদিন ন্যায় সঙ্গত হয়নি। মিথ্যা দিয়ে তাদের জঙ্গল, জমি, স্বপ্ন, ভালবাসা চুরি হয়েছে। মাটি আর খাঁটিতে যে ছন্দ মিলেছিল তাতে তাঁর কোনো উৎসাহ বা আগ্রহ ছিলনা। পরে জানলাম, সেই দানবের আনাগোনা আবার আরম্ভ হয়েছে। থাবা বসাতে চায় ওরা ওই পলাশ এর লালের ওপর, হাজার হাজার কেঁচোদের তৈরি সুড়ঙ্গ আর চ্যানেলের ওপর, ক্ষুদেদের লাগানো জঙ্গলের উপর। মাদলের আওয়াজ, ধান ক্ষেতের গান থামিয়ে দিতে চায় ওরা যন্ত্রের কর্কশ শব্দ দিয়ে। তা অত সহজ হবে না, বুঝলে দানব! ক্ষুধার জ্বালার সঙ্গে লড়ায়ের ক্ষমতা তোমার নেই!
অনেক কিছু ঠিক হ’ল এই আলোচনায়। ঠিক হ’ল যে কয়েক দিন ধরে গ্রাম থেকে গ্রাম পদযাত্রা করে যাওয়া হবে। নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে, কথা বলে, নাটক করে, আলোচনা করে, মাদলের তালে সেই অদৃশ্য সূত্রকে মজবুত করা হবে যা সবাইকে বেঁধে রেখেছে - ঠিক যেমন মাটির তলার জল ধরে রেখেছে সবার প্রাণ। যেমন অদৃশ্য প্রাণদায়ি প্রক্রিয়াগুলো বোঝা দরকার তেমনি অশ্রুত প্রাণঘাতি পায়ের শব্দকেও চিনতে আর শিখতে হবে যৌথ ভাবে।
এর পর ইস্কুল ঘরের দিকে যেতে হবে, মাঠ আর কিছুটা জঙ্গল পেরিয়ে। পথ প্রদর্শক রমেশদা। ওনার খালি পা, আমাদের পায়ে চটি। রমেশদার পদক্ষেপগুলো নিঃসংশয়, আমাদের হাঁটায় কিছুটা অনিশ্চয়তা। তাই, অনুসরণ করে চলেছিলাম, রমেশদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। আল দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেক চাষ জমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এটা ওমুকের ধান জমি, ওটা তার, এই ভাবে দেখাতে দেখাতে এগোচ্ছিলেন রমেশদা। কিছু মাঠে জল দেখা যাচ্ছে এখনো, বর্ষার ছয় মাস পরেও। কিছু জায়গায় সবুজ ঘাস জানান দিচ্ছে মাটির তলায় জলের উপস্থিতি। জঙ্গলের ধরা জল, গ্রামের মানুষের ধরা জল নিজের ধীর গতিতে প্রবহমান, ভূগর্ভে অতিসূক্ষ্ম সব নল দিয়ে।
যেতে যেতে চোখে পড়ল একটা উজ্জ্বল সবুজ জমির টুকরো। যেমন নীল আকাশ হারিয়ে যায় টিয়া পাখির সবুজে, তেমন ভাবে যেন, সিঁড়ির মতন সাজানো জমির অগুণতি খণ্ড মিশে গেল ওই এক টুকরো উজ্জ্বল সবুজে। বুঝলাম ধানের কচি, কোমল চারা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে ধান-তলায়। এখান থেকে তারা ছড়িয়ে পড়বে ভিন্ন ভিন্ন মাঠে, যেখানে তারা নিজেদের মতন করে বড় হবার সুযোগ পাবে। তবে, এই সময় ধান-তলা? এ তো খরা মরশুম! অবাক কাণ্ড, কয়েক বছর আগে তো এখানে বর্ষার ধানটাই ভাল করে হত না! খরার ধান লাগিয়েছে, রমেশদা বোঝালেন। খরার ধানে অনেক জল লাগে কারণ আকাশের জল আসে না। এখানকার মানুষের এই স্পর্ধা দেখে আমার মন আনন্দে কেঁদে উঠলো। কী অপূর্ব দৃশ্য! সংঘর্ষ এবং নির্মাণের দুটো নদী যেন এসে মিলেছে এই সবুজ ধান- তলায়। একদিকে শাসক বলছে– বাঁচতে দেব না, খেতে দেব না, খাদ্য উৎপাদনের পরিকাঠামোটাই নষ্ট করে দেব! অন্য দিকে মানুষ বলছে– আমরা বর্ষার ধান লাগিয়ে বেঁচে থাকবো, খরার ধান লাগিয়ে পুষ্ট থাকবো, আমাদের মানবতা আমরা কেড়ে নেব! এই বেঁচে থাকাই আমাদের শোষণ আর অন্যায়ের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ।
চাষের মাঠ আর ছোট এক টুকরো জঙ্গল পেরিয়ে আমরা গিয়ে উঠলাম এই নতুন মাটির গোল ইস্কুল ঘরে। এখান থেকে একটু দূরেই শুরু হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের খাড়া ঢাল যাকে ঢেকে রেখেছে এই এলাকার জীবনদায়ি জঙ্গল। এতো বছর জঙ্গলটা গ্রাম থেকে দূরে পালাচ্ছিল, কয়েক বছরের কাজের পর, সে প্রথমে পলায়ন বন্ধ করল এবং তার পর গুটি গুটি পায়ে সে গ্রামের দিকে ফিরে আসতে লাগলো। গ্রামে যখন জল এলো, চাষ বাড়ল, তখন মানুষেরও গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া কমল।
গ্রামের মানুষ আর তাদের বন্ধুরা বুঝলেন, এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এর পিছনে অনেক ইতিহাস আছে, অনেক ছোট বড় শক্তির জটিল প্রক্রিয়া আছে – সেটা কিছুটা হলেও বোঝা দরকার। বন, জল, মানুষ, মানুষের চেতনা, পশু, পাখি, সরকারি নীতি, বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তন– আরো কত কিছু। এই জটিলতায় তারা পা দিয়েছিল অনেকটা বিনম্রতার সঙ্গে। ওরা বুঝেছিল, এর মধ্যে অনেক কিছু আছে যা তারা বোঝে না আবার কিছুটা বোঝেও বটে। এই অল্প জানার আর বোঝার উপর পা রেখে তারা ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়েছিল অজানার দিকে। বিনম্রতা আর ধৈর্য হাতিয়ার করে, ছোট ছোট করে পা ফেলা– সফল হলে এগিয়ে যাওয়া না হলে পিছিয়ে এসে অন্য পথ ধরা। কাজের মাধ্যমে শেখা এবং সেই শিক্ষা ব্যবহার করে আরো একটু ভাল ভাবে কাজ করা – এই ভাবেই গ্রামের মানুষ এবং তাদের বন্ধুরা এগিয়ে ছিল । তারা নতুন কিছুই করছিল না, বন যেখানে বাড়তে চায় সেখানে তাকে সাহায্য করা, জল যেদিকে যেতে চায় তার বন্ধু হয়ে সঙ্গে থাকা, আবার ভাল বন্ধুর মতন তার অনিচ্ছা থাকলেও একটু থামতে বলা, একটু জিরিয়ে নিতে বলা, জঙ্গলের সঙ্গে চুক্তি অবমাননা না করা, ইত্যাদি। প্রকৃতির ছিঁড়ে যাওয়া সুতোগুলো জোড়া লাগানোই ছিল তাদের কাজ, তার খুব বেশি কিছু হলেই যে কোনখানে ছন্দ পতন হবে তা বলা মুশকিল।
হাজার হাজার বছর ধরে সৃষ্ঠ এখানকার মাটি আর সেই মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন গ্রামের মানুষেরা তাঁদের নতুন ইস্কুল। ঘরের বাইরের দেওয়ালে আঁকা তাদের জলের সাথে বন্ধুত্বের গল্প, জঙ্গলের সঙ্গে হাত মেলানোর গল্প, আগুন না লাগানো বা সাপ হতে সাবধান হবার বার্তা । অন্যকে পথ চলতে দিতে গেলে মাঝে মাঝে পথ ছেড়ে দাঁড়াতে হয়। যদিও গ্রামের মানুষের সেটা অজানা নয়, দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসের ফলে সেটা ভুলে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয় – জঙ্গল ফেরা মানে তো সাপ ও বিছাদেরও ফেরা। তাই সাবধানে থাকা কেবল নিজের জন্য নয়, জঙ্গল আর তাদের বাসিন্দাদের প্রতি একটা কর্তব্যও বটে।
মাটির দেয়ালের উপর টিনের ছাদ, ঘরের পরিধি ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে, যার জন্য একটা সুন্দর বারান্দা তৈরি হয়েছে চারিদিকে। গ্রামের মানুষের আঁকা সব গল্প বর্ষার জলে ধুয়ে যাবে না, কেবল ধুয়ে যাবে অনাহার আর অভাব। গরম কালে ঠাণ্ডা থাকে এই ঘর। তিন দিকে তিনটি জানালা। জানালারা সব এখানকার মানুষের হৃদয়ের মতন উদার– মাঝে কাঠের শিক না থাকলে মনে হত যেন ছোটখাট দরজা। মনের জানালা খোলা না রাখলে প্রকৃতির হৃদকম্পন বোঝা যাবে কী করে?
কোন আলোড়ন না করে, জানান না দিয়ে বাতাস ঢুকছে উদার জানালা দিয়ে, সঙ্গে নিয়ে আসছে জঙ্গলের সুবাস। হেঁটে আসার অল্প ক্লান্তি যেন এই বাতাস মুহূর্তের মধ্যে মুছে দিল। কয়েক জন বাচ্চা বসে আছে ঘরের দেয়াল ঘেঁষে গোল করে। আমরা আর রমেশদা এসে সেই গোলে যোগ দিলাম। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। মাটির শীতল স্পর্শ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল, এ কোন দেশ? কোন পৃথিবী? সম্পর্ক দিয়ে গড়ে উঠেছে এই দেশ- মানুষের সাথে মানুষের, মানুষের সাথে মাটি ও জঙ্গলের, জঙ্গলের সঙ্গে কেঁচোর। সম্পর্ক ছাড়া কি দেশ গড়া যায়! সম্পর্ক দিয়েই তো এই পৃথিবীর গড়ে ওঠা, পৃথক কোনোভাবে নয়।
বন্ধুর কন্ঠস্বর তন্দ্রা ভেঙে দিল। বন্ধু বলছিলেন, আমরা নিজেদের মধ্যে পরিচয় করে নিলে বেশ ভালো হয়। নাম, গ্রামের নাম এবং আমরা কী ভালোবাসি- এই ভাবে পরিচয় দিলে অভিনব ভাবে একে অপরকে জানতে পারা যায়। বেশ, তাই ঠিক হলো! সবাই বলতে লাগল তাদের নাম ও গ্রামের নাম। কেউ বলল ফুটবল খেলতে ভালোবাসে, কেউবা সাইকেল চড়তে ভালোবাসে, গাছে চড়তে ভালোবাসে... আরো অনেক ভালবাসার জায়গা উঠে এলো একে একে সবার পরিচয়ের মাধ্যমে। এবার রমেশদার পালা। সে তার নাম ও গ্রামের নাম বলল। তারপর, আমি ভাবলাম সে থামবে, দৌড়ে এসে থামার অভ্যাসবশত। কিন্তু সে থামলো না, ভুরু কুচকে বলল, আচ্ছা, তোমরা তো কেউ বললে না যে ভাত খেতে ভালোবাসো! তোমাদের মধ্যে কি কেউ সত্যি ভাত খেতে ভালোবাসো না? আমি ভাত খেতে ভালোবাসি! রাগ, বিষাদ আর অভিমানে ভরা তার কন্ঠস্বর। সবাই এটার মানে নিজের মতন হয়তো করে নিলো। আমার কাছে রমেশদা ইতিহাসের একটা বড় টুকরো- ভাত না খেতে পাওয়া থেকে ভাত খেতে পাওয়া পর্যন্ত। আগামী দিনের ইতিহাসটা কী ভাবে তৈরি হবে, তার ও একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে রমেশদা।