সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
এক
গোপন কথাটি
পিছনে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না কিছুতেই। কী যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে চলেছে সিমিকাকে। কে আছে ওখানে? কী আছে? কুয়াশা ক্রমশ ঘন। সাদা অন্ধকারের ভিতর কয়েকটা কালো ঝাপসা দাগ, ওগুলো পাইন বা রডোড্রেনডন হবে হয়ত। ওখানেই কী সে আছে। হয়ত অপেক্ষা করছে সিমিকার জন্য। যে কথাগুলো বলা হয়নি বলতে চাইবে কি যদি দেখা হয়? হ্যাঁ ঠিক যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে দু এক পরত পর্দার পিছনে। সিমিকাও দাঁড়িয়ে পড়ে। সব অপেক্ষার তবে শেষ! একটা বুনো গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে, ছায়া শরীর পর্দা ভেদ করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। সিমিকার স্নায়ু টানটান। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে ওর, এমন শীত সকালেও ঘাম ফুটে উঠছে কপালে। বাঁহাত ধরে হ্যাঁচকা একটা টান, কেউ মুখটা চেপে, জাপটে ধরে ফেলল বড় গাছটার পিছনে। উত্তেজনায় চিৎকার করতে ভুলে গিয়েছে সিমিকা তবু সম্বিৎ পেয়ে গোঙানির আওয়াজ করতেই ডানকানের কাছে ফিসফিস, ভালু হ্যায়! ম্যাডাম, এক্কেবারে চুপ। নীরজের কন্ঠ। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখল সামাণ্য দূরেই ভাল্লুকটা কিছু খুঁজছে এখন দুপা নয় চারপায়েই ঘুরছে। গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগোচ্ছে ওদের দিকে। নীরজ হাত সরিয়ে নিয়েছে মুখ থেকে। দুজনে ধীরে ধীরে একটা একটা করে গাছ অতিক্রম করছে। দূরত্ব বাড়ছে ভাল্লুকের সাথে। পিছন দিকে হেঁটে প্রায় কুড়ি মিনিট পর ওরা বড় পিচ রাস্তায় নেমে এল। টেনশান একটু কমল কারণ এখানেই রেঞ্জারস্ কোয়াটার্স এবং ফোনের টাওয়ার পাওয়া যায়। সামনের ঢালু বেয়ে বেশ খানিকটা নীচে নামলে বাঁহাতে সিমিকার ভাড়াবাড়িটি আছে। নীরজের আঙ্কেলের প্রপার্টি। দুজনে নিঃশব্দে হাঁটে। পাহাড়ি মানুষগুলোর এই এক আশ্চর্য স্বভাব, কখনও অধিক কৌতুহল দেখায় না। সবেতেই বড় শান্ত।
- ম্যাডাম, দো চারদিন ওদিকে মাত যানা। আর গেলে লকড়ি লেনা।
ওর বাংলা বলাটা দুবছরে অনেক বদলেছে। সিমিকা ঘরে চলে গেলে নীরজ চুপচাপ চেয়ে থাকে সেদিকে। রামধুরার এই অংশটা ভীষণ নির্জন। হোমস্টে আছে তবে কম। বছর দুয়েক আগে ভদ্রমহিলা যখন বাড়ি ভাড়া চাইল নীরজের আঙ্কেল পালদেন ভুটিয়া আমতা আমতা করেছিল, একা লড়কি! ক্যানোও নিবে? তবে শেষ পর্যন্ত ঘরটা দেওয়া হয়েছে, নীরজ আর ওর মায়ের মধ্যস্ততাতেই। ওর মা প্রথমেই বলেছিল, একা মেয়েকেই তো দেবেন ভাইয়া, ওর প্রয়োজন কতখানি হলে একাই থাকতে চাইছে।
প্রথম প্রথম পাহাড়ের ধারে পাথরে একা বসে থাকতে দেখেছে, গান গাইছে বা কবিতা বলেছে একা চোখে জল। সবাই ভাবত ওর বোধহয় মাথা খারাপ। পরে নীরজ বুঝেছে মানুষটি আসলে একা। কম্পিউটারে কাজ করে সিমিকা কখনও দিনে কখনও রাতে। নীরজ ঠিক বোঝেনা কী কাজ। পৃথিবীতে কত রকম যে কাজ আছে! ম্যাডাম সত্যিই অদ্ভুত, এই কথা বলে এই চুপ। দু'বছরে তার সাথে যে সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে। একটা বিশ্বাস বা ভরসা পেয়েছে সিমিকা নীরজের কাছে। কিন্তু নীরজ ধীরে ধীরে বড্ড বেশি জড়িয়ে পড়েছে। ম্যাডামের পাশে থাকাই যেন তার কাজ। সিমিকা জানলা দিয়ে দেখল, নীরজ হেঁটে চলে যাচ্ছে। কালো কফি, অমলেট আর দুপিস্ পাউরুটি আজ তার বরাদ্দ। এরপরেই কাজে বসবে, ফ্লায়ার বানতে হবে দুটো আর একটা উপন্যাসের ভূমিকার প্রূফ রিড করতে হবে। ফোনের রিংটা যখন এল তখন সবে অমলেটে কাঁটা চামচ ডুবিয়েছে সিমিকা।
- হঠাৎ?
- কোথায়?
- নিভৃতবাসে।
- একা!
- নাহ্!
-আমাদের দলের জন্য একটা স্ক্রিপ্ট পাঠানো যাবে?
সিমিকা উত্তর দেয় না। প্রশ্ন আসে, করে দেওয়া যাবে? সিমিকা চুপ করে থাকে। প্রশ্ন কাতরতায় বদলে যায়, সিমি, ক্ষমা করা যায় না? একটিবার ফেরা যায় না। ফোনটা কেটে দেয় সিমিকা। নাহ্ কোনো অনুভব বেঁচে নেই। সব তেতো কফির স্বাদের মতো। এপ্রিল মাসটা বড় মধুর। ফুলে ফুলে পাহাড় ঢেকে থাকে। খাদের দিকের দরজাটা খুলে ব্যালকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে। চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। দুবছরেও পুরোনো হয়নি। তান্নু ধীর পায়ে খাদের দিকের সরু পথ দিয়ে ঝুড়ি ভরে কাঠকুটো নিয়ে ফিরছে। ওর শরীর ভরা নদীর মতো কিন্তু গতি ঝরনার। তান্নু হাসল। এগিয়ে এসে ঝুড়ি নামিয়ে ভিতর থেকে খুঁজে খুঁজে একটা পাথর তার দিকে এগিয়ে দিল। সিমিকা চমকে ওঠে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে। ওর মুখে আলো খেলে যায়। তান্নুকে বলে, তুমি দেখেই বুঝেছ? তান্নু হাসে। সিমিকা আকাশের গায়ে তুলে ধরে পাথরটা ঠিক যেন একটা পেঁচা মুখ ফিরিয়ে বসে। তান্নুর হাত ধরে বলে, এভাবেই চিনতে শিখে যাবে সব। সেও গভীর আবেগে হাত চেপে বলে, আমাকে সবাই চিনবে? ফটো বেরোবে কম্পিউটারে? সিমিকা হাসে। পাথরটা ফেরৎ দিয়ে বলে দেয় বাকি কাজগুলো করে রোহন সিং এর কাছে নাম লিখে জমা করতে। এখানে একটা ছোট্ট সংগ্রহশালা খুলেছে সবাই মিলে। কী রাখা হবে তা মূলত সিমিকা আর রোহন নির্ধারন করে। গত এক বছরে মন্দ হয়নি সংগ্রহ। উৎসাহী দু একজন টুরিস্ট আসে বইকি। সামান্য প্রবেশ মূল্য ঠিক করা হয়েছে, কিছু কিছু বিক্রি ও হচ্ছে। সব দায়িত্ব রোহনের যেহেতু ওরই পৈত্রিক বাড়ির একটা অংশে সংগ্রহশালা। সিমিকা ধীরে ধীরে কাজে ডুবে যায়। খানিকপর খিদেটা চনমন করতেই ল্যাপটপ বন্ধ করে। বাঁদিকে গোলাপি হাইডেনজিয়া থোকা থোকা ফুলে ভরে আছে। বাবার সাথে সে প্রথম দেখেছিল এই ফুল। ওর বাবা আর পাঁচজনের বাবার মতো বিজ্ঞ, লড়াকু মোটেই ছিল না। বরং গোবেচারা মানুষটি একটু বেশি ভুল করে ফেলত জীবনে। ওর মায়ের সেসব নিয়ে অভিযোগ ছিল বরাবর, তোর মেসো কত চৌখশ কিন্তু তোর বাবা! ওতখানি জমি সব দান করে দিল পাড়ার লাইব্রেরী কে আশ্চর্য। এসব কথা শুনেও মার প্রতি কোনো অভিযোগ ছিল না সিমিকার কিন্তু বুঝত মা বড্ড অপরের কথায় প্রভাবিত হয়। ওর বাবা ধার করে বেড়াতে নিয়ে আসত পাহাড়ে, বলত, দেখ সিমি না বেড়ালে মনটা খোলে না রে। কী সব ফুল চারপাশে বল! বড় দোকানে খাওয়াতে পারত না বাবা, সেসব দোকান দেখিয়ে বলতেন, অনেক বড় হও যেন সব আনন্দ পেতে পারো। যদিও বাবাকে দেখেই ও বুঝেছে সুখ থাকে মনে। খাবার, পোষাক সবেতেই বাবার মতো ঔদাসীন্য তার। কোনো কিছুতেই মোহ নেই। স্নান সেরে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে তাকিয়ে রইল। পাহাড়ের সবুজ ঢালে থোকা থোকা সাদা মেঘ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়ি। বড় ভালো লাগে এই মায়া। ঘড়িতে সময় ঠিক দুপুর দেড়টা। নীরজ ঢাকা বাটিতে কিছু একটা খাবার নিয়ে এল, ঘরে রেখে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, খেয়ে নেবেন। ওর গায়ের গন্ধে ঘর ভরে আছে, সিমিকা জানে ওর চলে যাবার পরেও গন্ধটা পিছু ছাড়বে না।
- আপনি কথা বলছেন না কেন? আমি জানি আপনাকে আমি শুধু বিরক্ত করি! ঠিক আছে চলে যাচ্ছি। রাতে খাবার করবেন না মা খেতে বলেছে।
নীরজ অভিমানে একাই চোখ ফিরিয়ে চলে যায়, পাথরের মতো সিমিকাকে পিছনে ফেলে। ধপধপিয়ে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নেমে আসে। কী এত ভাবে মানুষটা, কিসের এত কষ্ট? এই ভাবনায় ছটফট করতে থাকে। দু বছরে সিমিকা যখন যেখানে গিয়েছে তাকেই নিয়ে গিয়েছে। সংগ্রহশালার বিভিন্ন কাজের বিষয়েও আলাপ আলোচনা করে কেবল নিজের কথা বলেনা কিছু। চারমাস আগে হঠাৎ কালিম্পং গিয়েছিল। একরাত ছিল, হোটেল এলগিন সিলভার ওকের আলাদা ঘরে। কালিম্পং পৌঁছেই বলেছিল, রক্সবেরী পাবে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছে। তখন সবে অন্ধকার জমে উঠছে পাবের ওক কাঠের চেয়ারে। অতি সাধারণ এক বাঙালি পুরুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সিমিকা। লোকটার ঠোঁট অল্প কাঁপছে। খুব দৃঢ় অথচ শান্ত স্বরে সিমিকা বলে, কেমন আছিস কৌশিক? নীরজ দেখল লোকটার চোখে জল। চেয়ারে বসে বলল, তুই এখানে থাকিস?
-না, আমি নর্থ সিকিম থাকি।
চমকে ওঠে নীরজ, মিথ্যে শুনে। সিমিকা বলে চলেছে, তোর সাথে দেখা করতে এসেছি। তুই লীনা আর গীতিকে ছেড়ে চলে গিয়েছিস কেন? ওটুকু বাচ্চা বাবা ছাড়া বড় হবে?
- তোর আমার জীবন যে শেষ করল তার সাথে থাকতে বলিস না।
সিমিকা হঠাৎ নীরজকে বলে, নীরজ তুমি গাড়িতে অপেক্ষা করো আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। খুব অপমানিত বোধ করেছিল নীরজ। বলেছিল, আপনি এখানে একা থাকবেন? সিমিকা গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয়, বিরক্ত করো না, যাও। মাথা নীচু করে চলে গিয়েছিল নীরজ। সেদিকে তাকিয়ে মন খারাপের হাওয়া বয়ে গিয়েছিল।
-তুই জানিসনা কতটা ঘৃণা করে তোকে লীনা!
-কারণটা তুই আর তোর বাড়ির লোক। সব ব্যাপারে আমার
উদাহরণ টেনে টেনে ওকে পাগল করে তুলেছিলি তোরা।
-তাই বলে এত প্রতিহিংসা। তোর জীবন থেকে সব সম্পর্ক মুছে
দেবে?
-বোকার মতো অন্যকে বিচার না করে নিজের কর্তব্য কর।
আমার খোঁজে তোর কী? আমি তোর কে?
-কেউ না তুই আমার?
বিরক্ত হয় সিমিকা। মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। কফি চলে আসে ততক্ষণে। সিমিকা ফোন করে নীরজকে ডাকলে সে চুপচাপ ভিতরে এসে কফি নিয়ে বেরিয়ে যায়, অনুরোধ সত্ত্বেও স্ন্যাক্স নেয় না। কৌশিক ওকে ভালো করে দেখে।
-ছেলেটা কে?
-আমার বন্ধু।
-লিভ টু গেদার?
চমকে তাকায় সিমিকা! চোয়াল শক্ত করে বলে, জবামাসি ফোন করে ভীষণ কাঁদছিল, তাই তোর সাথে যেচে দেখা করলাম। মাসি চায় তোর সংসার জোড়া লাগুক। শেষ বয়েসে মানুষটাকে একটু শান্তি দে কৌশিক। আমার অনুরোধ তুই সবার কথা ভেবে ফিরে যা। কৌশিক মাথাটা নীচু করে রাখে, চোয়াল তারও শক্ত।
- কোনোদিন লীনা মাকে আমাকে শান্তি দিয়েছে? তুই কেবল জেদ করে গেলি সব বিষয়ে।
সিমিকা উঠে দাঁড়ায়, তখনই কাপ রাখতে নীরজ ভিতরে প্রবেশ করে। শোনে সিমিকা বলছে, আমার জেদটুকু বজায় থাকুক কৌশিক, আর কিছুই তো আমার রইল না। বিল পেমেণ্ট করে সিমিকা বেরিয়ে যায় দ্রুত, নীরজ পিছন পিছন বেরিয়ে আসে। চুপ করে বসে থাকে কৌশিক। প্রথম প্রথম তখন সূর্যেন্দুর সঙ্গে আলাপ হল সিমিকার। ওরই মাসির ছেলে। সূর্যেন্দু যাদবপুর, ফিজিক্স। সিমিকা ইংরেজি। ওর মা প্রথম টের পেয়েছিল।
- সিমিকে তাহলে তুই বাঁধতে পারলি না। দেখাতে পারলি না তোর ভিতরটা। সূর্যেন্দুর আগুনে মেয়েটাকে পুড়তে দিবি?
কৌশিক বোঝেনি কেউ আছে এমন যে তার থেকে সিমিকে কাড়তে পারে। মা না বললে ও হয়তো দেখতেই পারত না। যখন দেখল তখন আগুন দেখতে পেল না। বরং ওদের দেখে নিজেই পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে গেল। অবশিষ্ট রইল না কিছু। ভালোবাসতে পারল না কাউকে। সূর্যেন্দু আষ্টেপৃষ্টে ধরল সিমিকে। দমবন্ধ হয়ে আসত কৌশিকের। গেটটুগেদার গুলোতে সিমিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করত চরম যদিও যাকে নিয়ে এতকিছু তার কোনো হেলদেল নেই। লীনা একবার কালো শাড়িতে বেশ সেজে এসেছিল। সূর্যেন্দুর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করতেই ছোবল নেমেছিল, লীনা তুই সিমিকার রিপ্লেসমেন্ট কিসের জোরে হবি? যতই সাজ ওর স্নিগ্ধতা তোর নেই, ঝগড়া করার গলা থাকলেও ওর মতো কবিতা বলতে পারবি না। তাহলে কেন করছিস এসব?
লীনা ভস্ম করে দিতে চেয়েছিল সিমিকে। যদিও সে নির্লিপ্ত। একমনে কী যেন লিখছিল। কৌশিক কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, বাবি লেখাটা শেষ হল, একবার পড়ে দেখ। ছোঁ মেরে নিয়েছিল সূর্যেন্দু।
- আমি আগে পড়ব।
- বেশ তো পড়।
কবিতাটার একটা লাইনও সেদিন মাথায় যায়নি। সবাই বাহ্বা দিল, সূর্যেন্দু বুক ঠুকে ঠুকে বলল, আমার হবু বউ লিখেছে বুঝলি! কৃত্তিবাসে বেরোলে একা একা ঘরে বসে পড়েছিল কৌশিক। আশ্চর্য নরম লেখা। সেদিন এই কবিতা পড়ে সূর্যেন্দু অত চিৎকার করল কী করে কে জানে? ঘোর কাটলে মেসেজ করেছিল, এমন প্রেম কি তুই সূর্যেন্দুর কাছে পেয়েছিস? উত্তর দেখার সাহস হয়নি। বেশ কয়েকদিন পর, সূর্যেন্দু রিসার্চ করতে মিশিগান ইউনিভার্সিটি চলে গেল, তারও কয়েক মাস পর সরোবরের ধারে ওরা বসেছিল দুজন। সিমিকা নীল বড় ঘেরওলা স্কার্ট আর লাল টুকটুকে টপ পরেছিল। মুগ্ধ কৌশিক চায়নি ওর দিকে।
-সূর্যেন্দুর ভালোবাসা দুর্বার, ধ্বংসাত্মক। আমার চারপাশের সবকিছু শূন্য করে আমায় পেতে চায়। আমি ওকে এড়াতে পারিনা। তবে আমার ভিতরে যে পুরুষের ছবি কখনও সখনও উঁকি দেয়, সে ভিন্ন তার সাথে সূর্যেন্দুর মিল নেই। তাও কেন যে সূর্যেন্দুর অনুপস্থিতি আমায় কাঁদাচ্ছে? আমি নিজেকে চিনতে পারছি না, বুঝতে পারছি না বাবি।
সিমি সহজে কাঁদেনা, অস্হির হয় না কিন্তু সেদিন অস্থির ছিল। ওর বড়বড় চোখ দুটো জলে টলটল করছিল। কৌশিক অসহায়। সেদিন আরও বড় সর্বনাশের কথা সে বলতে গিয়েছিল কিন্তু পারেনি। অস্থির বন্ধুকে আরও অস্থির করতে বলতে পারেনি, লীনা কীভাবে তাকে জোঁকের মতো ধরেছে। সেদিন মতো আজও বলতে পারল না, যাসনা সিমি। এভাবে অজ্ঞাতবাসে যাসনা। দুটো বছর পর তোকে দেখলাম। তুই কত দূরের হয়ে গেলি। আমি তোর হাতদুটোও ধরতে পারলাম না।
গাঢ় কুয়াশায় সব ঢাকতে শুরু করেছে। এলগিন সিলভার ওকের ঘাসজমি পর্যন্ত কুয়াশার চাদর জড়িয়ে নিঝুম হয়ে রয়েছে। অস্থির নীরজ, সিমিকার রুমের বাইরের ব্যালকনিতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। ডিনারের জন্য ডাকতে এসেছিল রুমসার্ভিসের ছেলেটি। ওকে বাইরেই আটকেছে। খানিকপর মৃদু টোকা দিতেই সিমিকা দরজা খুলল। চোখদুটো টকটকে লাল, গালে মুছে ফেলা জলের দাগ, চুল কিছুটা এলোমেলো। নীরজ মাথা নামিয়ে বলেছে, কিছু খাবেন? নিয়ে আসব? এই সামান্য শব্দে এত মায়া এত আদর কী করে নীরজ এনেছিল সিমিকা ভেবে পায়না। দরজায় ঠেস দিয়ে কেঁদে ওঠে, নীরজ দ্রুত ঘরে ঢুকে ওর মাটিতে নেমে আসা শরীরটা তুলে ধরতেই সিমিকা ওকে জড়িয়ে নেয়।
-আমি বুঝিনি নীরজ আমার চারপাশের মানুষ কেন আমার এত শত্রু হয়ে গেল। কেন এত কষ্ট দিল আমায়? আমি একা হয়ে গেলাম, ভীষণ একা।
নীরজের ভীষণ ইচ্ছে করছিল সিমিকাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখতে। ইচ্ছে করছিল...না, সেসব কথাকে প্রশ্রয় দেয়নি নীরজ। কাঁদতে দিয়েছে যতক্ষণ সে কেঁদেছে, কেবল হাতদুটো শক্ত করে ধরে রেখেছিল। অনেকটা কেঁদে শান্ত হয়েছিল সিমিকা। লজ্জা পেয়েছিল। নীরজের আনা চিকেনস্যূপ খেয়েছিল। তারপর ফিরে এসে ভীষণ রকম চুপ হয়ে গিয়েছে সিমিকা। এটাই নীরজকে কুড়েকুড়ে খায়। কেন বলেনা কিছু? নীরজের সাথে তার কি কোনো
রিস্তা নেই?
দুই
ভালোবাসি, ভালোবাসি
'জবামাসি, ও মাসিইইই' ছুটতে ছুটতে আসে সিমিকা, জড়িয়ে ধরে জবাকে। জবাও বুকে শক্ত করে চেপে ধরে মেয়েকে। আদর করে বলেন, কী হয়েছে রে? সিমিকা জড়িয়ে ধরেই বলে, সিএবি থেকে ডাক পেয়েছি মাসি, টরেন্টো যাচ্ছি। ওরা এবার দশজন তরুণ কবি লেখককে ডেকেছেন। আমিও আছি। চোখ ভরে আসে জবার, মেয়াটাকে চুমু খেয়ে বলেন, তুই আরও অনেক বড় হবি মা। অনেক আশীর্বাদ। সিমিকা অস্ফুটে বলে, ভাবছি মিশিগানে দুটো দিন থেকে আসব মাসি তোমার আপত্তি নেই তো?
-কেন রে আপত্তি কিসের? সূর্যেন্দু গিয়েছে তাও কতদিন হবে রে?
-দু বছর চারমাস।
-তোর সাথে খবরাখবর আছে তো? শুনছি লীনার ছোটোবোন ওখানেই আছে। সূর্যেন্দুর সাথে বেশ ভাব হয়েছে। লীনা খুব গল্প
করে ওদের।
ক্রমশঃ শরীর হালকা হতে হতে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল সিমিকা, জবামাসি দুহাত বাড়িয়ে দিল কিন্তু সিমিকা ধরতে পারল না। চিৎকার করে বলতে চাইল, মাসি, আমার জোর ফুরিয়ে যাচ্ছে মাসি আমার হাতদুটো ধরো। কিন্তু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে আরও খাদের দিকে গড়াতে লাগল সিমিকা। ঘুমটা ভেঙে গেল তখন। অনেকটা সময় চুপ করে বসে রইল। মাথার ভিতরটা শূন্য। সারা শরীর দিয়ে কিছু একটা বেরিয়ে আসতে চাইছে। লীনার কনে সাজা মুখটা মনে পড়ছে। কী সুন্দর দেখতে লাগছিল ওকে। বিয়ের সময় যখন সিঁদুর দান হচ্ছিল কৌশিক হঠাৎ ওর বাবার কথা মনে করে কেঁদে ফেলেছিল। মাল্টিমিডিয়ায় কাজ করা তরুণ যুবকের এই আবেগ নিয়ে লোকেরা গুণগুণ করেছিল। ওদের বিয়ের মাস দুয়েক পর জবামাসি প্রথম বলেছিল, কেন কেঁদেছিল সেদিন কৌশিক কিছু জানিস সিমি?
-মেসোর জন্য গো তবে ও নিজেই খুব দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। ওর মতো এত বুঝদার ছেলে এতটা ব্যাকুল হবে ওই পরিস্থিতিতে আমি বুঝতে পারিনি।
-ব্যাস্ কেবল বাবার কথা মনে হতেই ও এভাবে বিয়ের বাসরে কাঁদল?
সিমিকা ঘাবড়ে গিয়েছিল মাসির মুখে কথাটা শুনে। খুব উদ্বেগ নিয়ে বলেছিল, তাহলে কেন মাসি? এই বিয়েটা তো ওরা
ভালোবেসেই করছে?
- না সিমি, এটা ভালোবাসার বিয়ে নয়, নিজের থেকে পালানোর বিয়ে, ফাঁদে পড়া বিয়ে। সেই এইট থেকে তোরা একসাথে তবু কোনোদিন কী করে তুই বুঝলি না, ও তোকে কী ভীষণ ভালোবাসে?
-কী বলছো মাসি, সে ভালোবাসা নিপাট বন্ধুত্ব।
-না বন্ধুত্ব নয়। যাক্ আজ আর সেসব ভেবে কাজ নেই। যা হবার হয়ে গিয়েছে। তুই সূর্যেন্দুকে বিয়ে করার আগে অবশ্যই ভেবে নিস, সেই তোর ভালোবাসা তো?
সিমিকা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। কুয়াশা আজ এই বিকেলেই সব জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে। জবামাসি তার জীবনে মায়ের মতোই। যে মাসি নিজের মেয়ে ছাড়া তাকে কিছু ভাবতে পারেনি, সেই মাসি তাকে এত বড় কথা লুকিয়ে গেল? কিন্তু যে সত্য তার বোঝা উচিৎ ছিল তার দায় মাসিকে দেওয়া বোধহয় সঠিক নয়। পাহাড় জুড়ে ঝিঁঝিঁদের কনসার্ট। বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে উঠেছে উল্টো দিকের পাহাড়ে। মন উদাস হয় সিমিকার, এক অসীম শূন্যতার মাঝে কার উপস্হিতি তাকে বিচলিত করে সে জানে তবু নতুন করে কোনো কষ্ট সে পেতে চায়না। দরকার হলে সরে যাবে আবার। ফ্রেশ হয়ে কাজে মন দিল। গত দুবছরে স্ক্রিপ্ট লিখছে চারটে সিরিয়ালের, এছাড়াও পোস্টারমেকিং, এডিটিং, নিজের লেখালিখি তো আছেই। ছোড়দা একসময় ওর লেখার খুব ভক্ত ছিল, বলত, সিমির লেখা নাটক আমি মঞ্চস্ত করব দেখো মা। মার এসব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। বাবা চলে যাবার পর একটাই কথা ছিল, রোজগার বাড়াতে হবে। বড়দা, ছোড়দা, সিমি দিনরাত তাতেই লেগেছিল। বছর দুয়েক পর সিমিই প্রস্তাব দিয়েছিল, এত বড় বাড়ি ফেলে না রেখে, ভাড়া দাও মা। অনেকটা টাকা পাওয়া যাবে। রাজি হয়েছিল সবাই। দাঁড়িয়ে থেকে ওদের মা রেনোভেট করেছিল। অথচ টরেন্টো যাবার সময় প্রথম আশ্চর্য কথাটা শুনেছিল। মা অগোছালো ভাবে ঘরে ঢুকে এসেছিল, সিমি কোথায় পেলি তুই টাকা? তুই নাকি তিনজন ভাড়াটের থেকে দু লাখ করে এডভান্স নিয়েছিস? সিমিকা অবাক হয়ে চেয়েছিল মুখে কোনো কথা আসেনি। অস্ফূটে বলেছিল, মা! উদ্যোক্তারা আমার যাতায়াত, টরেন্টোতে থাকার সব খরচ দিচ্ছেন আমি কেবল, মিশিগানের খরচটা দিচ্ছি। আমি কেন নেব এডভান্স? কে বলল এসব? মা শুধু বলেছিল, সব খবর আছে আমার কাছে। তুই ভাবিস না আমি কিছু বুঝি না।
সিমিকা ভেবে পায়না, কেন এখনও চোখে জল আসে? হল তো অনেক বছর।
-ম্যাডাম আসব?
রোহন সিং এর গলা পেল সিমিকা। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল। ভিতরে এলেন বছর পঞ্চান্নর দীর্ঘাঙ্গ মানুষটি। এক সময় রামধুরা অঞ্চলে এদের জমি জায়গা ছিল সবচে বেশি। মানুষটির তেজ, মেজাজ বড্ড বেশি ঠিকই কিন্তু সকলের জন্য ভাবেন।
-আমার বাড়ির পূবের অংশটা রেনোভেট করে হোমস্টে করতে চাইছেন এক বাঙালি ভদ্রলোক, লিজে নেবেন, ভালো টাকা দেবেন। এলাকার ছেলেমেয়েদেরকেই কাজ দেবেন, আপনি কী বলেন?
-এতো খুব ভালো কথা। অবশ্যই করুন। তবে সংগ্রহশালাটা কি
সরাতে হবে?
-না ম্যাডাম, এখানেই থাকবে। ভদ্রলোক নিজে আর্টের লোক। ওনার খুব ভালো লেগেছে। অনেক কিছু সাজেশান দিলেন।
আরও কিছুক্ষণ কথা চলল, সিমিকা কফি খাওয়াল। বাড়ির সামনে একটা জিপ দাঁড়ানোর আওয়াজ। রোহন সিং উঁকি দিলেন, বাইরেটা দেখে নিয়ে বলেন, ম্যাডাম নীরজ আয়া, কোথাও যাবেন নাকি? এখন তো রাত হয়ে গেল। সিমিকা হাসল।
-আপনাদের এখানে রাত আমাদের কোলকাতায় কিন্তু সন্ধ্যা।
-আপনি আমাদের নন ম্যাডাম?
-হ্যাঁ আপনাদের রোহনজি।
নীরজ উঠোনে বসে একটা ছোটো পাইনকাঠ জ্বালায়। উঠোনের মাঝেই গর্ত মতো করা আছে। তাকিয়ে দেখে রোহন সিং। নীরজ নমস্কার জানায়। লোকটার তাকানোয় কিছু একটা আছে, চোখ নামিয়ে নেয়।
-তুই ফর্মটা ফিলাপ করলি না!
-জি না।
-এভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দিবি? তোর বাবা আমাদের এলাকার গর্ব ছিল। আর তুই কিছুতেই সেদিকে গেলি না।
-আমি তো পিতাজিকে পাইনি। মা! সারাজীবন একা। আমি মাকে ছেড়ে যাবনা।
-যতসব বাজে সেন্টিমেন্ট। এভাবে গাড়ি চালিয়ে কী পাবি জীবনে?
-জানিনা, তবে রাতে বাড়ি ফিরলে মায়ের মুখে খুব সুন্দর একটা হাসি দেখতে পাই। আমার এটুকু থাক।
গজগজ করতে করতে সিংজি বেরিয়ে যায়। সিমিকা আরও মিনিট দশেক পর বেরিয়ে আসে। হালকা গোলাপি একটা জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে, সাথে ছোটো একটা ব্যাগ। ঘরে যে কুর্তা পাজামা পরে ছিল সেটা আর বদলায়নি। নীরজ নিঃশব্দে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। ওর পাশে বসে সিমিকা। গোটা পথে কেউ কোনো কথা বলেনা। জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়েই নীরজদের বাড়ি। দু মিনিটও লাগে না গাড়িতে। আলো থাকলে সিমিকা হেঁটেই আসত। মাঝারি সাইজের কাঠের বাড়ি। খুব সুন্দর করে সাজানো। বাইরে টুনি বাল্ব জ্বলছে। বিস্মিত সিমিকা। গাড়ি থেকে নামার আগে জিজ্ঞাসা করে, আজ বাড়িতে কিসের দাওয়াত নীরজ? কোনো কথা না বলে গাড়ি বন্ধ করে লাফিয়ে নামে, দ্রুত এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সিমিকা একটু অস্বস্তি অনুভব করে। দরজায় টকটক করতেই ওর মা দরজা খুলে দেন। ১৯৯৯ সালে বর্ডারে হত লবসেং ভুটিয়ার বিধবা স্ত্রী। হাত বাড়িয়ে ভিতরে ডাকে। ভিতরে কেউ নেই। তাহলে বাড়িটা সাজানো কেন?
-আজ নীরজের জন্মদিন বেটি। ও শুধু তোমাকেই ডাকতে বলেছিল। এসো বসো।
সিমিকা নীরজের দিকে তাকায়। তার কোনোদিকে নজর নেই। অতিথি সেবায় ব্যস্ত সে। ওদের বসার ঘরের দুদিকে দুটি ঘর, একটু পাশে রান্নাঘর সেখানেই খাবারের ব্যবস্থা। ওর মা সেদিকে যেতে যেতে বললেন, তোমরা গল্প করো, আমি খাবার হলেই ডাকছি। ততক্ষণে কফি, কেক, কুকিজ, কাজুবাদাম ট্রেতে করে নিয়ে এসেছে নীরজ। সিমিকার সামনের টেবিলটাতে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।
-তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বোসো।
নীরজ একটা মোড়া এনে সামনে বসে। সিমিকা হাতটা বাড়িয়ে দেয়, হ্যাপি বার্থ ডে নীরজ, তুমি খুব ভালো থাকো ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি। ফিসফিস করে নীরজ, আমার বার্থ ডে ম্যাম, কোনো গিফট নেই। সিমিকা ধীরে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। আলতো হেসে বলে, কী চাও বলো? নীরজ কথা বলে না চেয়ে থাকে কেবল। অস্বস্তি হয় সিমিকার। চোখ সরিয়ে ওদের ঘর দেখতে থাকে। ওর বাবার ছবি ঘর জুড়ে। বাবার মতো চোখ ছেলেটার। গঠনটাও। নীরজের স্কুলের ছবি, ফুটবল ম্যাচ জেতার ছবি দেখতে দেখতে মুখটায় কখন যে হাসি এসেছে সিমিকা লক্ষ্য করেনি। সংগ্রহশালা উদ্বোধনের দিনের একটা ছবি, সিমিকার ঠিক পাশে নীরজ। একটা উত্তাল হাওয়ার মতো ঢেউ বুকের ভিতর আছড়াতে থাকে। এমন লাগে তাদের দুজনকে পাশাপাশি। নাহ্! ভাবতে চায় না এসব। ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হয় দুজনে।
-আপনি কেন সব ছেড়ে এই পাহাড়ে আছেন? আমায় বলবেন? এটাই আমার উপহার। আর কিছু চাই না।
সিমিকা গম্ভীর হয়ে যায়। ঘরে আসে নীরজের মা। বলে, চলো বেটি খাবে চলো। রান্নাঘরটাতে হালকা পাইন পোড়া গন্ধ। টেবিলে জাসা মারো, ব্যাম্বু শ্যূট কারি আর ভাত। জাসা মারোতে শ্রেডেড চিকেন ঠাসা। নীরজকেও ওর সাথে খেতে অনুরোধ করে সিমিকা। একটু আগে প্রতিরোধের মুখে পড়ে খেই হারিয়েছে নীরজ তবু উপেক্ষা করল না ডাক। খেতে খেতে বহু গল্প হল নীরজের মায়ের সাথে। উনি এক সময় সিমিকার বাঁহাতটা আলতো করে স্পর্শ করলেন।
-বেটি আমি তোমায় মাঝেমাঝে একা হেঁটে যেতে দেখেছি। দেখো জানিনা তোমার দুঃখ কতটা, একা একা কোন সাগরে ভেসে পড়েছ তুমি? নীরজের বাবার মৃত্যু আমায় শিখিয়েছে কারো করুণা পাওয়া ভীষণ অপমানের। আমি নিজের সব আঁশু হজম করে নিয়েছি। আমায় ভুল বুঝো না। তবে মনে রেখো যা তোমার ব্যক্তিগত তাকে বাইরে না আনাই ভালো।
সিমিকা ভদ্রমহিলার হাতটা জড়িয়ে ধরল। বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর অজান্তেই বলে ফেলল, বাবার মৃত্যুর পর আমি আশ্রয় হারিয়েছি আন্টি কিন্তু আঘাত দিয়েছে সবচে বেশি কাছের মানুষেরা। আমি বুঝতে পারিনি তার কারণ কী? কোনো এক প্রিয়জন আমার বিপক্ষে আমার দাদাদের বিষিয়ে তুলেছে এমন ভাবে যে তারা আমায় মানতে পারেনি। আমার মা ভয় পেয়ে সরে গিয়েছে আমার থেকে। জানিনা মা কী করে ভাবল, আমি তাদের পথে বসানোর পরিকল্পনা করছি। আমি চেষ্টা করেও নিজেকে প্রমাণ করতে পারিনি। টপটপ করে জল পড়ছে সিমিকার চোখ দিয়ে। নীরজের বুকের ভিতর দিয়ে রোলার চলছে যেন। সিমিকাকে থামাতে চেয়েছিলেন নীরজের মা।
-না আন্টি আমি একটু বলি, বুকের ভিতর জমাট বরফটা গলিয়ে দিতে চাই। একজন মানুষ আমায় ভালোবেসেছিল আন্টি। অন্ততঃ সে তাই বুঝিয়েছিল আমায়। আমি তাকে বিশ্বাস করেছিলাম, ভরসাও, সেই মানুষটা আমায় প্রবল ঝড়ের মুখে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। মাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম কিন্তু...
থেমে যায় সিমিকা। চোখের জল মুছে বলে, সরি আন্টি নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে কতগুলো বিভ্রান্তকর কথা বলে চলেছি, সরি। নীরজ বোঝে আর একটি কথাও সিমিকা বলবে না। ওর মা হাত ধরে চুপ করে বসে থাকেন। তারপর নিজেই চামচে করে মুখে খাবার তুলে দেন সিমিকার। সে খেয়েও নেয়। দৃশ্যটা নীরজের মনে একটা টলটলে পাহাড়ি সরোবরের জন্ম দেয়। খাওয়া শেষে ব্যাগ থেকে একটা লম্বাটে ভেলভেটের বাক্স বের করে সিমিকা। নীরজের মায়ের হাতে দিয়ে বলে, নীরজের মতো এত ভালো, সংবেদনশীল মানুষ আপনি পৃথিবীকে দিয়েছেন আন্টি। তাই এই উপহার আপনার জন্য। ভদ্রমহিলা খুলে দেখেন রূপোর তিনছড়ার মালা। ভারী চমৎকার কারুকাজ। কোনো ভনিতা না করেই তিনি গলায় পরে নেন।
-বলো কেমন লাগছে?
সিমিকা জড়িয়ে ধরে মহিলাকে। তিনিও পরম মমতায় মাথায় হাত রাখেন ওর পিঠে। জিপে উঠে অন্ধকারে চোখ রাখে সিমিকা। কী আছে ওই গভীর কালোতে? কোন রহস্য লুকিয়ে রেখেছে সে? ঘরের দরজা খোলা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে নীরজ। আলো জ্বালতেই কিছু না বলে চলে যেতে নেয়। সিমিকা ডাকে, একটু সময় আছে? কফি খাবে?
-আপনি বসুন আমি করছি।
সিমিকার ঘরের কোণা খামচি সব তার চেনা। কেমন কফি খায় সিমিকা সেটাও। নিঃশব্দে দু কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে আসে। চেয়ারে বসে।
-পাহাড়ে ছেলেমেয়েরা একটু তাড়াতাড়ি বিয়ে করে তাই না!
-হ্যাঁ তা করে। পড়াও ছেড়ে দেয় আগে আগেই। টাকার নেশায় কাজ শুরু করে দ্রুত।
-তোমার বয়স তো একত্রিশ হল। তুমি বিয়ে করোনি কেন?
নীরজ থতমত খেয়ে যায়। একটু ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে তোতলায়। তারপর বলে, আমার একটি মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল। আমাদের কমিউনিটির। কিন্তু বিষয়টা এগোয়নি। আমিও আর দ্বিতীয় বার ভাববার সময় পাইনি। তাছাড়া আপনি তো জানেন মায়ের অসুখ নিয়ে বছর তিন চারেক আমি খুব লড়েছি। তখন শিলিগুড়ি তে বেশির ভাগ সময় কেটে যেত। মাসে তিন চারবার যেতাম।
-কেন মেয়েটির সাথে এগোওনি নীরজ?
নীরজ তাকায় সিমিকার দিকে। ঘরের আলো চুঁইয়ে নামছে তার গাল, ঠোঁট, চিবুক দিয়ে। কী জানতে চায় সে? নীরজ তাকিয়েই থাকে, বলে, দেখে ভালো লাগা আর মন জেগে ওঠা যে এক নয় ম্যাডাম। সে তার মতো করে ভালো, আমার অক্ষমতা যে আমি তাকে ভালোবাসতে পারিনি। তাই দ্বিতীয় বার ভাবিনি। বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক বাড়তে থাকে। কফির গন্ধ ছড়ায় চারিদিকে।
-নীরজ আগামীকাল আমি বাইরে যাব। রোহনজি শিলিগুড়ি যাচ্ছেন আমায় পৌঁছে দেবেন। আমার ফিরতে কয়েকদিন লাগবে। তুমি সকালে একফাঁকে এসে আমার ঘরের চাবিটা নিয়ে যেও। ইচ্ছে হলে এসো আমি যখন থাকব না।
-কোথায় যাবেন জানতে চাইলে বিরক্ত হবেন?
-এভাবে বলছ কেন? কালিম্পং এর কথাটা তুমি ধরে রেখেছ। দিল্লি যাচ্ছি। একটা লিটারারি মিট আছে। ফিরে আসব তাড়াতাড়ি।
নীরজ জিপে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। ঠোঁট চেপে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে সিমিকা। মিশিগানের রাত্তিরটা বুকের উপর চেপে বসে আছে আজ চার বছর। ছ'বছর আগে সূর্যেন্দু যেদিন মিশিগান যাবে, তার আগের দিন রাতে কৌশিকদের বাড়ি পার্টি ছিল। সবার থেকে সরিয়ে ছাদে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। চেয়ারে বসিয়ে ওর পায়ের কাছে বসে পড়েছিল। হাত দুটো ধরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
-আমি তোকে ছাড়া বাঁচব কী করে? আমায় পাঠাস না সিমি। আমি পারব না তোকে ছেড়ে থাকতে।
চোখের জল আদর সবকিছুতে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল সিমিকাকে। চরম মুহূর্তে সিমিকা ওকে থামিয়ে দেয়। হাতদুটো ধরে বলে, এরপর আরও অসম্ভব হবে সব। সূর্যেন্দু বাচ্চাদের মতো আবদার করেছে, সিমিকা ওকে আগলে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত লীনা বাঁচিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ উপরে উঠে এসেছিল, সাথে কৌশিক। সিমিকার আঁচল তখনও নামানো, ব্লাউজের বোতাম খোলা।
-কী রে আজই ফুলশয্যা হয়ে গেল?
কৌশিক উল্টো দিক করে দাঁড়িয়েছিল। লীনা হাজার কথায় ভরে দিচ্ছিল সময়কে। সেই অবসরটুকুতে সামলে গেল সিমিকা। সূর্যেন্দু শক্ত করে ধরে রেখেছিল সিমিকার হাত। সেই সূর্যেন্দু মিশিগানে সিমিকার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল বহুদূর। অন্ধকারটা থেকে থেকে বুকের ভিতর ঢুকে পড়ে। বাবার গলার স্বর ভেসে আসে, সিমি আলো দেখাতে হলে অন্ধকারকে মেনে নিতে হবেই। দেখ আমরা মানুষ, ভুল ঠিক দিয়ে প্রকৃতি আমাদের গড়েছে। তবে কি জানিস, ভালোবাসা থাকলে মানুষ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সম্পর্ক বাঁচাতে পারে। এটা মনে রাখিস। প্রতিদিন বলবি, ভালোবাসি আমি সবাইকে ভালোবাসি। সিমিকা খুব কৌতূহলে বলেছিল, সবাইকে কি ভালোবাসা যায় বাবা? ওর বাবা বলেছিল, আমার আর তোমার উত্তর এক হতে পারে না। জীবনে চলতে চলতে তুমি তোমার উত্তর পেয়ে যাবে। সিমিকা শুতে যাবার আগে বহুদিন পর বলে ওঠে, ভালোবাসি, আমি তোমায় ভালোবাসি।
তিন
এই লভিনু সঙ্গ তব
ট্রেনটা স্টেশনে ঢুকছে। কাঁটায় কাঁটায় আটটা। স্নিগ্ধ মানুষ এক নেমে এল। ক্লান্ত অবসন্ন ধস্ত। কতরাত ঘুমায়নি কে জানে? দৌড়ে গিয়ে লাগেজগুলো হাত থেকে নিতে চায় নীরজ। স্যাকটা দিলেও আরেকটি মাঝারি ব্যাগ দেয় না।
-তুমি আমার বন্ধু, ড্রাইভার না। কেন জেদ করছ? চলো।
বন্ধু! নীরজ ঘুরে তাকায়। সিমিকা দেখে অল্প বয়েসী বেশ কতগুলো মেয়ে পাশ দিয়ে যাবার সময় নীরজকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে চলে গেল। টুরিস্টদের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে জায়গাটা ভরে আছে। একটু দ্রুত হাঁটে দুজনাই। একটা দল থেকে আওয়াজ ভেসে এল, এ্যাই সিমিকাদি, এ্যাই সিমিকাদিইইইই। দাঁড়িয়ে গেল দুজনেই। ছুটতে ছুটতে এল বিবাহিতা।
-পপি! কেমন আছিস?
মেয়েটা জড়িয়ে ধরেছে সিমিকাকে। নীরজের অস্বস্তি হয়। ইচ্ছে করে ছাড়িয়ে দিতে। মেয়েটা জড়িয়ে ধরেই বলে, তুই সব ছেড়ে পালিয়ে এলি দি! তোর বাড়ির সবাইকে যে তোর বিপক্ষে নিয়ে গেল তাকে তুই ছেড়ে দিলি। কেন দি, কেন তুই কিছু করলি না। সিমিকা চুপ।
-কোথায় বেড়াতে যাচ্ছিস রে?
-তুই কথা ঘোরাচ্ছিস দি?
-না, তোকে বলতে চাইছি আমি এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নই।
-তবু শোন, তোর ছোড়দার সাথে আমি আর কাজ করিনা। ছেড়ে দিয়েছি। ওর মতো গাম্বাট, যে লীনার মতো শয়তানকে...
-পপি, ও শিল্পী মানুষ ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। তুই ভালো থাকিস। যা তোর দলের লোকেরা উশখুশ্ করছে।
-ফোন নম্বর দিবি?
-হ্যাঁ কেন দেব না? নে লিখে নে।
নীরজ দেখে ফোন নম্বর নিয়ে মেয়েটা আবার জড়িয়ে ধরল সিমিকাকে। তারপর চলে গেল বোধহয় চোখে জল। গাড়ি সেবকে আসার আগে পর্যন্ত সিমিকা একটা কথাও বলেনি। সেবক আসতেই জানলার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিল।
-আমার বাবা বলতেন সারা শরীর দিয়ে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। আর আমি চিরকাল সবটুকু দিয়ে পাহাড় ভালোবেসেছি। এত শান্তি আমি আর কোথাও পাইনা।
-ফোন নম্বর তো সবাইকে দিয়ে দেন কেন? যে কেউ চাইলে আপনাকে ট্রেস করতেই পারবে।
-আমি অপরাধী নই নীরজ। আমার আশেপাশের মানুষরা আমায় চায়নি তাই আমি চলে এসেছি। ব্যাস্।
-আপনার মতো প্যায়ারী মানুষকে চায় না, এমন মানুষ হয়? এটা ভাবতেই আমার অবিশ্বাস্য লাগে।
সিমিকা নীরজকে একবার দেখে নেয়। ওর মুখটা কঠিন হয়ে আছে। এই দশদিনে ও একটু রোগা হয়েছে সম্ভবত। চোখের কোণে কম ঘুমের ছাপ। সিমিকার উৎকন্ঠা হয়। ভুরুটা সামান্য কুঁচকে আছে নীরজ। রাস্তা ধীরে ধীরে পাহাড়ের বুকের ভিতর ঢুকে পড়ছে। ফুলে ফুলে ভরে থাকা ছোটো ছোটো বাড়ি। আরও দূরে পাহাড়ের ঢালে ধাপ চাষ। চোখ ভরে পাহাড় দেখতে দেখতেই পৃথিবীর সব ঘুম এসে চোখে আশ্রয় নেয়। নীরজ গাড়ি চালালে বড্ড নিশ্চিন্ত লাগে। ঘুম কেমন সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়। হালকা পালকের মতো ভেসে যায় মন। যদিও ঘাতক চুপিসাড়ে হানা দেয় সেখানেও। টরেন্টোর সাহিত্য বাসর সফল ভাবে শেষ হতেই, সিমিকা মিশিগানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল। সূর্যেন্দুর সাথে গত ছমাসে কথা খুব কম হয়েছে। একটা প্রচ্ছন্ন ব্যস্ততা সব সময়। যদিও সিমিকা আসছে শুনে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। ও যেখানে থাকে তার কাছেই। সূর্যেন্দু বদলেছে চেহারায়, আচরণে। সেই অস্থিরতা হারিয়ে গিয়েছে পুরোপুরি। সিমিকা ওর সাথে ঠিক করে রাখা বাড়িটায় এল। কমন বসার জায়গা। সোফায় দুতিনটে ছেলে মেয়ে গল্প করছিল। ঘরটার চারদিকে চারটে ঘর। প্রতি ঘরে দুজন থাকার ব্যবস্থা। সিমিকা ফ্রেশ হলে, ওরা দুজন বেরিয়ে পড়ল। সামনের রাস্তার ধারের চেয়ারে বসল। কুশল বিনিময়ের পর দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। সূর্যেন্দু হাসল।
-তুই তাহলে এখন পুরোপুরি সাহিত্যিক।
-নাহ্ তা ঠিক নয়। পেট চালানোর জন্য ফ্রি লান্সিং করি। এডিটিং, প্রুফ এইসবের কাজ। স্ক্রিপ্টও লিখছি।
-হুম্, বাড়িতে ভাড়াটে বসানোর ব্যবসাও নাকি শুরু করেছিস?
সিমিকা হঠাৎ থতমত খেয়ে যায়। সামলে নেয়। বলে, হ্যাঁ রে, ওটাও করতে হয়। মায়ের জীবনটা তো চালাতে হবে। জানিস তো বাবার বেড়ানোর নেশা ছিল তাই অর্থ সে রকম নেই। সূর্যেন্দু হঠাৎ প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে।
-লীনার বোন এখানে পড়ে জানিস তো।
-হ্যাঁ জানি তো। ও তোর কথা খুব বলে। জবামাসিকে লীনা বলেছে, ইরিনা নামে তোর নাকি ফর্সা টুকটুকে লম্বা সুন্দরী গার্লফ্রেণ্ড আছে।
-এসব বলেছে!
-ইরিনার কথা সত্যি সূর্যেন্দু!
-তুই কি এটা জানতে এতদূর এসেছিস?
-না, আমি জানতে এসেছি তোর জীবনে আমি আছি না নেই।
সিমিকার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে। নীরজ রাস্তার এক ধারে গাড়িটা দাঁড় করায়। বাঁ হাত দিয়ে সিমিকার ডান হাতটা আলতো করে ছোঁয়, ম্যাডাম। খুব ক্লান্ত স্বরে উত্তর দেয় সিমিকা, নীরজ আমাকে আরও দূরে কোথাও নিয়ে যেও একদিন। যেখান থেকে কোনো যন্ত্রণা আমায় আর ছুঁতে পারবে না। প্লিজ একদিন তুমি নিয়ে যেও। নীরজ বুঝে পায় না কী বলছে এসব সিমিকা।
-ম্যাডাম, ম্যাডাম!
ধচমচ করে উঠে বসে সিমিকা। নীরজের গরম শ্বাস ওর মুখে আছড়ে পড়ছে। উদ্বিগ্ন এক মুখ কাতর ভাবে ডাকছে। ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সিমিকা। এই চোখ তার ভীষণ চেনা। বহুবার দেখেছে স্বপ্নে অথবা জেগেই।
-চলুন কিছু খেয়ে নেবেন।
জায়গাটা ভারী চমৎকার। গরমের দাপট নেই আবার ঠাণ্ডাও মারাত্মক নয়। কালিম্পং শহরটা নীরজের এত ভালো করে চেনা। এমন এমন জায়গা দিয়ে নিয়ে আসে খুব ভালো লাগে। একটা স্কার্ফ সিমিকার দিকে এগিয়ে দেয় নীরজ। কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে তাকাতেই বলে, মা দিয়ে দিয়েছিল। বলল ফেরার সময় যদি আপনার লাগে। মৃদু হাসে সিমিকা। মিথ্যে বললে নীরজের কান লাল হয়ে যায়। ওকে দেখতে তখন খুব মিষ্টি লাগে।
-আন্টিকে বলো আমি ভালোবাসা জানিয়েছি।
নীরজ একটু কঠিন চোখে তাকায়। সিমিকা কৌতূহল নিয়ে চেয়ে থাকে। থুপকার সুবাস চারিদিকে।
-আপনি আমাকে বন্ধু বললেন কিন্তু সত্যিই আমি তাই!
-সেকি তোমার সন্দেহ আছে?
-আপনি সিকিম যাবার কথা ভাবছেন আমায় জানিয়েছেন?
সিমিকা চোখ নামায়। না নীরজকে সে এখনই কিছু বলতে চায়নি। রোহনজির হোমস্টে করার পরিকল্পনা এবং সংগ্রহশালা নিয়ে সিদ্ধান্ত তাকে বিব্রত করেছে। নতুন কিছু করতে চেয়েছিল সে। সেখানে বাইরের কারো অনুপ্রবেশ সঠিক হবে না বলে বিশ্বাস তার। কী বলত সে নীরজকে? তান্নুর ভাই সোনমকেই যা বলার বলে এসেছিল।
-তোমায় আমি জানাতাম নীরজ।
-কবে ম্যাডাম! চলে যাবার দিন?
-দেখ আসলে এখানে আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
-কার কাছে আপনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে? আপনি জানেন রোহনজি ডিল ক্যানসেল করেছেন? তান্নু আমার মা কেঁদেকেটে একসা। আমার আঙ্কেল পর্যন্ত আপনাকে যেতে দেবে না বলে পণ করেছেন। তাহলে কার কাছে প্রয়োজন ফুরাল?
-নীরজ একবার যখন হোমস্টের কথা উঠেছে তখন আজ না হোক কাল হবেই। তুমি বুঝতে পারছ না এটা আটকানো যাবে না। এই পরিবেশ নিরিবিলি থাকবে না।
-ম্যাডাম পাহাড়ের সমস্যা আপনি জানেন। পর্যটন ছাড়া আমরা প্রায় শূন্য। তাই বলে আপনি চলে যাবেন। কোথায় যাবেন? সর্বত্র এক অবস্থা।
সিমিকা কথা বাড়ায়না। খাওয়া শেষে গাড়িতে উঠে ঘুমিয়ে পড়ে আবার। আরও ঘন্টা দেড়েক পর বাড়িতে এসে ঘুম ভাঙে। ওর ব্যাগপত্র ঘরে নামিয়ে দেয় নীরজ।
-আমি খাবার দিয়ে যাব আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।
ও চলে যেতে গেলে সিমিকা হঠাৎ ওর হাতটা ধরে। নীরজের ভিতরটা কেঁপে ওঠে, রাগ করেছো? সরি, ভুল হয়েছে তোমায় না জানানো। আসলে আমি নিজেকে নিয়ে খুব বিব্রত। নিজেকে বুঝতে পারিনি কোনোদিন। আমার মনে হয় আমি সবার সাথে মিলেমিশে বোধহয় থাকতে পারিনা। অসামাজিক আমি। কাউকে কখনও না বলতে পারিনা অথচ নিজের অবস্থান থেকে সরতেও পারিনা। প্রায় সমবয়েসী দুজন মানুষ দুজনকে বোঝার চেষ্টা করে চলেছে। কুয়াশা ঘিরে ধরছে চারিদিকে।
-ম্যাডাম আমার বাড়ির ঠিক পাশের যে জায়গাটুকু ফাঁকা আছে ওখানে আপনাকে ঘর বানিয়ে দিই। এখানকার থেকেও নির্জন এবং রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। এখানে সংগ্রহশালা বড় হলে লোকের আনাগোনা বাড়বে সেটাও সত্যি।
সিমিকা কিছু বলে না। কেন নেবে সে এত সুযোগ? দেখতে দেখতে চারিদিক সাদা হয়ে ওঠে। খানিকপর ফোন আসতেই নীরজ বেরিয়ে যায় সিমিকাও ফ্রেশ হতে ঢোকে। ঠাণ্ডা জল শরীর দিয়ে ঝরতে থাকে। মাথার ভিতর হাজার সূঁচ ফুটিয়ে দিচ্ছে কেউ। তবু জল ঢালতেই থাকে সিমিকা। গতরাতে ছোড়দা মেসেজ করেছে।
-সিমি, কৌশিক এর আগেও লীনার উদ্দেশ্য বোঝানোর চেষ্টা করেছে। আমি মানতে পারিনি। এত সুন্দর ব্যবহার, আমায় এত সাহায্য করত যে আমি কিচ্ছু ভাবতে পারেনি। তাছাড়া কৌশিকের তোর প্রতি অনুরক্ততা এবং ওর একাকীত্ব এমন ভাবে আমার কাছে তুলে ধরেছে যে এই কারণেই আমার সাথে ওর সম্পর্কটা গভীর হয়েছিল। মানছি আমার ভুল হয়েছে ওর কথা বিশ্বাস করা। আমেরিকা যাবার টাকা তুই কোথা থেকে পেয়েছিস আমাদের কোনদিন বলিসনি, আমরাও হয়ত সুযোগ দিইনি। কিন্তু সিমি এভাবে চলে গিয়ে তুই কি ওকেই সঠিক প্রমাণ করলি না? আমার দলটা ও ভেঙে দিয়েছে। পপি, উমাকান্ত, নীলেশ, রুকু কেউ নেই দলে। জানিস সিমি ও আসলে তোর সব ভালো থাকা নষ্ট করে দিতে চায়। ফিরে আয়না বোন। মা তোর কথা বলে আর কাঁদে। বড়দাও বারবার তোর কথা জিজ্ঞাসা করে। সিমি একবার ক্ষমা করে দে।
সিমিকার চোখে ভাসতে থাকে ছোটবেলার স্মৃতি। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর বড়দা কাঁধে তুলে নিয়েছিল। সারাবাড়ি ঘুরছিল আর চিৎকার করছিল। আমার বোন নাইনটি পারসেন্ট পেয়ে জেলায় চতুর্থ ওরে আয়রে তোরা দেখে যা। ছোড়দা পিছন পিছন থালা বাজাচ্ছে। মা আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে। বাবা ছলছল চোখে কেমনকরে যেন তাকিয়ে আছে। এরপর থেকে যে বাড়িতে আসত বড়দা তাকেই রেজাল্ট বার করে দেখাত। সারাজীবন বোনকে নিয়ে ডগমগ।
ডগমগ ছিল কৌশিকের বাড়ির সবাইও। লীনা বড্ড সুন্দর, অসাধারণ গান গায়, খুবই কর্তব্য পরায়ন, পড়াশোনাতেও যথেষ্ট ভালো। সেখানে নেহাত সাধারণ সিমিকা বরাবর বড্ড বেশি ভালোবাসা পেয়েছে ও বাড়ি থেকে। কৌশিকদের বাড়িতে কথায় কথায় সিমিকার সাথে ওর তুলনা করা হত। সিমি দারুণ খাসির মাংস রান্না করে। সিমি এত বুঝদার ওকে নিয়ে যে কেউ সুখি হবে। লীনার মরিয়া হয়ে ওঠাকে সিমিকা অস্বীকার করেনা। আর যেদিন থেকে জেনেছে কৌশিক তাকে ভালোবাসত, সেদিন থেকে সব পরিস্কার হয়েছিল। স্নান সেরে কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল সিমিকা। বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে শরীর। কানের দুপাশ গরম। অস্পষ্ট চোখের দৃষ্টি। ওর মনে হয় সূর্যেন্দু হঠাৎ যদি মিশিগানে সে রাতে নেশা করে না আসত। যদি জোর না করত, তাহলে কী নিজের মনের কথা বুঝতে পারত কোনোদিন? সূর্যেন্দুর কথাগুলো বুকের ভিতরটা ফালাফালা করে দিয়েছিল।
-সতীপনা কিসের এত? কী এমন লিখিস যে টরেন্টোতে তোকে ডাকে, হ্যাঁ! কার কার সাথে শুয়েছিস? আর কৌশিক তোর নাগর। ছোটো থেকে কতবার ফুলশয্যা হয়েছে হ্যাঁ! আমার বেলায় আপত্তি? এতদূর এসেছিস কেন তাহলে?
সিমিকার চিৎকারে পাশের ঘর থেকে ছেলেমেয়েগুলো ছুটে এসেছিল। একটি দিনের চেনা মানুষগুলো তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বহু বছরের চেনা মানুষটির থেকে। যাবার আগে আঙুল তুলে বলেছিল, তোর এই ভালো মুখোশের আড়ালে যে কদর্য চেহারাটা আছে সেটা আমি চিনে গেছি। সবাইকে ঠকিয়েছিস তুই এই ভালো মানুষের মুখোশ দিয়ে। চলে গিয়েছে রাতের আলোর ভিতর সূর্যেন্দু। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভীষণ অচেনা লেগেছে সিমিকার। এত খারাপ সে। সূর্যেন্দু তাকে এমন ভাবে?
ফিরে এসে আর কখনও যায়নি কৌশিকদের বাড়ি। কৌশিক এসেছে, জবামাসিও। লীনা এসে শাসিয়েছে, তার বরের সাথে অবৈধ সম্পর্ক না রাখার জন্য। ছোড়দা যেদিন বাজারের মেয়ে বলল আর মা, বড়দা কোনো প্রতিবাদ করল না, সেদিন সিমি বুঝেছিল তাকে সব ছাড়তে হবে, সব। মরতে চায়নি সে। তার স্বপ্নের ভিতর যে এসে দাঁড়ায়, বারবার বলে, বাঁচতে হবে সিমি, জীবন অনেক বড়। এসব তুচ্ছ ঘটনা, এরচেয়েও বড় সমস্যার সাথে লড়াই করে কত মানুষ। কে সে? বাবা! নাকি আর কেউ? ঘোরের ভিতর সিমিকা বলতে থাকে, কে? কে তুমি? আর কবে আমি তোমায় দেখব? আর কবে আমি শান্তি পাব? কেউ তার দু কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়। খুব কষ্টে চোখ মেলে সিমিকা। ঝাপসা দেখে একটা ফর্সা মুখ। তার গায়ে পাইনের গন্ধ।
-নীরজ! আমি খারাপ। খুব খারাপ। সবাইকে শুধু ব্যবহার করি। তোমাকেও।
নীরজ কপালে হাত ঠেকায়। গা পুড়ে যাচ্ছে। ঘন্টা খানেক আগেও সুস্থ ছিল। কী হল তাহলে? মাকে ফোন করে, আসার সময় তান্নুকে খবর দিতে বলে। সন্ধ্যে পর্যন্ত জলপট্টি ওষুধ দিতে দিতে ছটা নাগাদ সিমিকার চোখ কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এর মাঝে জল ছাড়া কিছু খায়নি। নীরজ গ্যাস জ্বালিয়ে একটু ডাল বসিয়ে দেয়। স্যূপের মতো চামচে করে খাইয়ে দেয়। উঠে বসে সিমিকা। তান্নু নীরজের মা বাড়ি ফেরে কিছুক্ষণের জন্য। নীরজ লিকার কফি আর দুটো বিস্কুট নিয়ে আসে। সিমিকা মুখ ফেরায়। খেতে ইচ্ছে করে না। নীরজ নাছোড়বান্দা। বিস্কুট ভেঙে কফিতে ডুবিয়ে মুখের কাছে ধরে, বাধ্য হয়ে খায় সিমিকা। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে। মুখ ফিরিয়ে নেয়। দ্রুত কফি কাপ নামিয়ে রুমালে চোখ মুছিয়ে দেয় নীরজ। হাতটা ধরে সিমিকা।
-কী চাও তুমি?
নীরজের মঙ্গোলীয়ান মুখে যন্ত্রণা স্পষ্ট। শান্ত স্বরে বলে, কিছু চাইনা। আপনি ভালো থাকুন। আমি আর আসব না বিরক্ত করতে। সিমিকা বোঝে নীরজ আঘাত পেয়েছে। কফির কাপটা পাশের টেবিলে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলে, সিমিক দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। পেটের উপর মাথা রেখে মুখটা কাত করে রাখে। অস্ফুটে বলে, যেও না প্লিজ, যেও না। নীরজের সারা শরীর কেঁপে ওঠে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। নীচু স্বরে বলে, কোথাও যাচ্ছি না, কোথাও না।
-আমার কথা তোমায় বলব, সবটা।
-আমি জানতে চাইনা। আপনি শুধু বলবেন আমি কী করলে আপনি ভালো থাকবেন।
সিমিকা মুখ তোলে নীরজের হাত ধরে বসতে বলে। লাল হয়ে আছে ওর মুখ। সেদিকে তাকিয়ে সিমিকার খুব হাসি পায়। ছেলেটা ভয় পেয়েছে। ও কি কখনো কোনো মেয়েকে ছোঁয়নি। চেয়ারে বসে মাথাটা নামিয়ে রাখে, বিছানার চাদরটা খুঁটতে থাকে। সিমিকার চোখের ঝাপসা কেটে গেলে চারিদিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘুম পায় খুব। নীরজ দেখে মুখে আলতো হাসি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সিমিকা। একটু আগে যা ঘটেছে মাথার ভিতর সেটাই কেবল ঘুরপাক খেতে থাকে। আটটা নাগাদ তান্নু পাতলা দুটো রুটি আর চিকেন স্টু নিয়ে এল। ঘুম ভাঙলে ওই চিকেন স্টু টুকু খেয়ে নিল সিমিকা, রুটি ছুঁয়ে দেখল না। রাতে তান্নুই থাকবে সিমিকার কাছে। নীরজ এবার চলে যাবে বুঝতে পারে সিমিকা।
-নীরজ, আমায় একটু ধরো, আমি বাইরে দাঁড়াব, দু মিনিট।
ভালো করে ওকে চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে দেয় তান্নু, রাগ রাগ গলায় বলে দু মিনিট মানে দু মিনিট। একাই আস্তে আস্তে হেঁটে ব্যালকনিতে আসে। শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠেছে অথবা মন। সামনের পাহাড় জুড়ে আলোর মেলা। নীরজ জানে এই আলো কী ভীষণ পছন্দ সিমিকার। কিছু একটা বলতে চায় দুজনেই কিন্তু কিছুতেই বলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত নীরজ বলে, ম্যাডাম কাল একটু রেস্ট নেবেন। ঘুমালে শরীর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। আমার কাল ট্রিপ আছে, যাবার আগে দেখা করে যাব। এখন আসি। সিমিকা বুঝতে পারে না, ওর ভিতরে এত উথাল পাতাল হচ্ছে কেন? নীরজের যাওয়া ও মানতে পারছে না কেন? কেন মনে হচ্ছে নীরজ ওর সাথে থাকুক।
-নীরজ তোমার আর কিছু বলার নেই? আমার মন বহুকাল কিছু শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, বলবে তুমি তেমন কিছু!
নীরজ পিছন ঘুরে তাকায়। বুকের ডিবডিব শব্দটা যেন ফেটে পড়ছে। দু মুহূর্ত কী যেন ভাবে তারপর একটু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সিমিকাকে আলতো করে জড়িয়ে নেয় বুকে। অস্ফূটে বলে থ্যাঙ্ক ইউ। সিমিকা ওর বুকের মধ্যে নিশ্চিন্তে মাথা রাখে। নীরজ আরও একটু সাহসী হতে চায়, ওর মুখটা দুহাতের মধ্যে নিয়ে বলে, মে আই! সিমিকা সম্মতি দিলে ঠোঁট ছুঁয়ে যায় ঠোঁট। নীরজ ভীষণ ভীষণ খুশি হয়ে ওঠে, গেটের দিকে এগোতে গিয়ে একপাক গোল করে ঘুরে নেয়, লাফিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে বলে, ম্যাডাম আপনার কাছে থাকতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সারাজীবন আমি থাকতে চাই আপনার সাথে, আপনার ড্রাইভার হয়ে। সিমিকা হেসে ফেলে। নীচু স্বরে বলে, পাগল।