সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
“In an industrialised India the destruction of the aboriginal’s life is as inevitable as the submergence of the Egyptian temples caused by the dams of the Nile……. As things are going there can be no grandeur in the primitive’s end. It will not be even simple extinction, which is not the worst of human destinies. It is to be feared that the aboriginal’s last act will be squalid, instead of being tragic. What will be seen with most regret will be, not his disappearance, but his enslavement and degradation .” - Nirad C Chaudhuri’s prophetic statement in 1965১
গল্পের শুরু অষ্টাদশ শতাব্দীর ঘন জঙ্গলে ঢাকা রাজমহল পাহাড় থেকে, যে পাহাড়ে বাধা পেয়েই বিপদতারিণী গঙ্গা বাংলায় ঢোকার আগে হঠাৎ উত্তর-দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে। ঘন জঙ্গলে ঢাকা, হাতি, বাঘ ও বন্য জন্তুতে ভরা দুর্গম রাজমহল পাহাড় কোনদিন কোনো রাজার অধীনে ছিল না। হাজার হাজার বছর ধরে এ ছিল সাহসী ও দুর্দম পাহাড়িয়া আদিবাসীদের বাসস্থান। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, এই অঞ্চলে সিধু ও কানু, দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে যে সাঁওতাল হুল বা বিদ্রোহ হয়েছিল তা পৃথিবীর প্রথম পুঁজিবাদী, কর্পোরেট সাম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা বিহার ওড়িশার দেওয়ানি পাওয়ার পর, জমির খাজনা থেকে মুনাফা বাড়ানোর উদ্দেশে্য দেশীয় জমিদারদের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করে। কেবল রাজমহল ও তার চারপাশ ইংরেজরা এক বিশেষ অঞ্চল ‘দামিন ই খো’ (ফার্সি শব্দ, বাংলায় এর মানে পাহাড়ের আঁচল) বলে ঘোষণা করে এই অঞ্চলের শাসন ও খাজনা আদায়, সরাসরি কোম্পানির হাতে রাখে।
পাহাড়িয়ারা বাস করে রাজমহল পাহাড়ের উপর সমতল ভুমিতে। মূলত শিকার, পশুপালন আর পাহাড়ের ঢালে ঝুম চাষ। তারা কখনোই কাউকে খাজনা দেয়নি। এদিকে দামিন থেকে আয় বাড়ানোর প্রয়োজনে সাহেবদের চোখ পড়ে রাজমহল পাহাড়ের উপত্যকার জমির উপর। পাহাড়ের নীচের এইসব উর্বর জঙ্গল ঢাকা উপত্যকায় চাষের জলের কোন অভাব নেই, এখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গুমানি, মোরেল, বানশলোইের মতো নদীরা। এদিকে পাহাড়িয়ারা এই সব জমিতে চাষ করতে আগ্রহী নয়। তারা সন্তুষ্ট ছিল তাদের পাহাড়ের উপরের ছোট ছোট গ্রামসমাজ ও জীবন যাত্রায়। তাই ১৮০০ সালের পর থেকে সাহেবরা এই সব উপত্যকার জমিকে উৎপাদনশীল করতে, রাজমহলের আশেপাশের অঞ্চলের সাঁওতাল আদিবাসীদের এই অঞ্চলে বসাতে লাগল, যাতে তারা জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ করে এবং তাদের খাজনা দেয়।
সাঁওতালেরাও সহজেই আশেপাশের অঞ্চল ছেড়ে এখানে চলে আসে, ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের স্মৃতি ও দেশীয় জমিদারের শোষণ ও অত্যাচার তাদের এই জঙ্গল অঞ্চলে নিয়ে আসে, কারণ এই অঞ্চল সরাসরি কোম্পানির অধীনে ছিল। কর্মঠ, শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা বন্য জন্তু ভরা ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে সেই সব অঞ্চলে তাদের গ্রাম বসায়, চাষ শুরু করে। অল্প দিনেই সাঁওতালরা রাজমহল উপত্যকার নিচু জমিতে সোনার ফসল ফলাতে শুরু করে এবং তাদের গোষ্ঠীবদ্ধ আদিবাসী সামাজিক রীতিনীতি ধীরে ধীরে তাদের বসানো গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। সাহেবরাও তাদের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ শুরু করে, ক্রমশ দামিন অঞ্চলে সাঁওতালদের সংখ্যা ও কোম্পানির রাজস্ব দুই-ই বাড়তে থাকে। কোম্পানি খাজনার হার সরাসরি সাঁওতালদের চাষের সঙ্গে জুড়ে দেয়।
গল্পটা ভালোই এগোচ্ছিল ১৮২০-২৫ সাল পর্যন্ত, সমস্যা শুরু হয় তারপর থেকে। সাঁওতালদের পিছু পিছু পয়সার লোভে এসে হাজির হয় দামিনের বাইরের বাঙ্গালা ও বিহারের উচ্চবর্ণের কিছু মহাজন ও সাহুকার যারা আদিবাসীদের, সমাজ-অছ্যুত নিম্নবর্গের জাতিদের থেকেও নিচু ভাবত। কোম্পানি, খাজনা আদায়ের জন্য মুর্শিদাবাদ ও ভাগলপুর অঞ্চলের অল্প পড়াশোনা, হিসাব জানা হিন্দু ও মুসলমান পেয়াদা, খাজনা আদায়কারী নিয়োগ করে। এদের সঙ্গে এইসব উঁচু জাতের ধূর্ত মহাজন ও ব্যবসায়িদের সম্পর্ক ছিল। কোম্পানির দামিনের বাইরের কিছু দারোগার উপর দায়িত্ত্ব ছিল দামিনের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা, তারাও সব মূলত উচ্চবর্ণের। সবার উপরে কোম্পানির সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট ভাগলপুর থেকে দামিনের দেখাশোনা করত। সাধারণত কোম্পানি থেকে এই সব দারোগা পেয়াদা বা খাজনা সংগ্রহকারীদের কোন বাঁধা মাইনে ছিল না, তারা তাদের ক্ষমতা বলে জনসাধারণের কাছ থেকে ইচ্ছেমত খাজনা আদায়ের নামে শোষণ করত।
সাঁওতালরা এই সব আদিবাসী সমাজের বাইরের উঁচু জাতির ও অন্যান্য মানুষদের দিখু বলত। এই দিখু মহাজন, দারোগা, সাহুকাররা সহজ সরল সাঁওতালদের দুর্বলতা বুঝে তাদের উৎপাদিত অতিরিক্ত পণ্যের লোভে তাদের উপর নানা ভাবে শোষণ ও অত্যাচার শুরু করে। সাঁওতালদের হিসাব না জানার সুযোগে, টাকা ধার দিয়ে মহাজনরা অস্বাভাবিক হারে সুদ নিতে থাকে, হিসাব জালিয়াতি করে অন্যায়ভাবে তাদের জমি বেদখল করে এবং তাদেরই বিনা মজুরির শ্রমিক বানিয়ে কাজ করাতে থাকে।
কোম্পানি খাজনা নিতো লাঙ্গল ও গরু বা মোষের সংখ্যার উপর। গরুর লাঙ্গল প্রতি খাজনা ছিল ১ আনা আর মোষের লাঙ্গল প্রতি খাজনা ছিল ২ আনা এবং বাৎসরিক ঊর্ধ্বসীমা ছিল সুদ সমেত ১ টাকা,২ (যখন কিনা ১৯ টাকায় ১০ গ্রাম সোনা পাওয়া যেত)।খাজনা আদায়কারীরা ও পেয়াদারাও কোম্পানি নির্ধারিত খাজনার থেকে অনেক বেশি হারে খাজনা আদায় করতে থাকে, কোম্পানির খাজনা দু আনা হলে তারা ছয় আনা হারে খাজনা আদায় করে, অতিরিক্ত পয়সা নিজেদের জন্য রাখত। শান্তিপ্রিয় সরল সাঁওতালরা কোম্পানির জটিল শাসন ব্যবস্থায় এই অন্যায়ের কোন প্রতিকার পায় না। অচিরেই সাঁওতালরা যে এক সুন্দর সাঁওতাল দেশ ও জীবনের স্বপ্ন নিয়ে সরাসরি কোম্পানির অধীন দামিনে এসেছিল তা দিখুদের অত্যাচারে দুঃস্বপ্নে পরিণত হল।
অর্থনৈতিক শোষণ, নিজেদের তৈরি জমি হারানো এবং নিপীড়নমূলক খাজনার ভয়ানক অত্যাচারের পরিণতিতে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিধু কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল হুলের সুচনা হয়। ধীরে ধীরে আগুনের মতো এই বিদ্রোহ রাজমহলের আশেপাশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, সাঁওতালদের হাতে অনেক দিখু মহাজন, সাহুকার ও সাহেব মারা যায়। এই হুল কোম্পানির শাসনের ভিত নড়িয়ে দেয়। ভয়ে কোম্পানি, বিশাল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মূলত দেশীয় সৈন্য বাহিনী দিয়ে অবর্ণনীয় নিপীড়ন চালিয়ে হুল দমন করে, বিদ্রোহে দশ হাজারের বেশি সাঁওতাল প্রাণ হারায়।
দুই
এখন এই কাহিনীকে যদি অন্য ভাবে দেখি, তাহলে দেখবো ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে দুর্গম রাজমহল পাহাড় অঞ্চলে সমান্তরালভাবে বহিরাগত তিনটি ভিন্নধর্মী সমাজের উপস্থিতি ও তাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে কিন্তু গল্পের যেখানে শুরু সেই দামিন বা এখানকার প্রকৃত আদিবাসী পাহাড়িয়াদের সরাসরি কোন যোগ ছিল না। গাঙ্গেয় উপত্যকার ধারে, ট্রাপ ব্যাসাল্ট পাথরের তৈরি রাজমহল পাহাড়ে বর্ষায় চিরকালই প্রচুর বৃষ্টি হয়। ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশের কল্যাণে হাজার হাজার বছর ধরে ঘন জঙ্গলে ঢাকা রাজমহল পাহাড় ছিল বন্য জীব জন্তুতে ও নানা জীব বৈচিত্র্যে এক প্রাকৃতিক সম্পদ পূর্ণ অঞ্চল। আজকের দিনে হলে হয়তো একে রাজমহল বায়োস্ফিয়ার জোন অভয়ারণ্য বলে ঘোষণা করা হতো, যা আয়তনে গ্রেট নিকবর দ্বীপের থেকে প্রায় দেড়গুণ বড়। কেউ জানেনা কত হাজার বছর আগে পাহাড়িয়া জাতি এসে এখানকার ভূপ্রকৃতির গঠন ও বিভিন্ন বন্য জন্তুর হাত থেকে বাঁচার জন্য চ্যাটালো ব্যাসাল্ট পাহাড়ের মাথার সমতলে বসবাস শুরু করে। ভারত ইতিহাসের কোন সম্রাট বা নবাব রাজমহল পাহাড় ও পাহাড়িয়াদের তাদের অধীনে আনার সাহস করেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথম কর্পোরেট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের লাভের লোভে প্রথম ও এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন শুরু করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চরিত্রগত দিক থেকে একটি পুঁজিবাদী ইউরোপীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মাত্র, যাকে আধুনিক কর্পোরেট সভ্যতার পথিকৃৎ বলা যায়। আজ পৃথিবী জুড়ে যে বড় বড় পুঁজিপতি ও কর্পোরেট সংস্থাদের আধিপত্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরা। ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমাংশে যৌথ-স্টক কোম্পানি হিসাবে তাদের যাত্রা শুরু করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া ইংল্যান্ডে আধুনিক শেয়ার মার্কেট ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ মানুষজনকে মোটা মুনাফার লোভ দেখিয়ে শেয়ারে বিনিয়োগ করতে প্রলুব্ধ করে। তারপর সেই পুঞ্জিভূত বিশাল পুঁজি তারা সফলভাবে তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রাধান্য স্থাপনে ব্যবহার করে বিশ্বজোড়া উপনিবেশ তৈরিতে সক্ষম হয়।
কোম্পানির মালিকানা ছিল ইংল্যান্ডের অনেক শেয়ারহোল্ডার বা বিনিয়োগকারীর হাতে, কিন্তু এই সব শেয়ারহোল্ডার বা মালিকরা কোম্পানি চালাত না, কোম্পানি চালাতো তাদের দ্বারা নিয়োজিত পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ড অফ গভর্নরস। বর্তমান সময়ের বিনিয়োগকারীদের মতোই, কোম্পানির শেয়ারে তাদের বিনিয়োগের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির লাভের ভাগ, তাদের সঙ্গে ভারতবর্ষের ও এখানকার সাধারণ মানুষের কোন যোগ ছিল না। কোম্পানির লন্ডনের মুখ্য কার্যালয় থেকে সরাসরি নিয়োগ করা সাহেব কর্মচারিরা কোম্পানির ব্যবসার স্বার্থে ভারতবর্ষে এসে এ দেশ শাসনের অধিকার পায়। কাজেই এদের সঙ্গে ভারতবর্ষের আগের সামন্ততান্ত্রিক শাসক শ্রেণির এক চরিত্রগত পার্থক্য ছিল। গভর্নর জেনারেল থেকে সাধারণ কেরানি সকলেই ছিল কোম্পানির কর্মচারিমাত্র। লর্ড ক্লাইভ, বা ওয়ারেন হেস্টিংসের মতো ভারতবর্ষের ক্ষমতাবান শাসকরা তাদের কর্মজীবন শুরু করে কোম্পানির কেরানি হিসাবে এবং কর্মদক্ষতা বলে এরা গভর্নর জেনারেল হয়ে ওঠে। এই কর্মদক্ষতার নিরূপণ হতো কোম্পানির লাভ কে কত বাড়াতে পারে। এদের দায়বদ্ধতা ছিল কেবলমাত্র কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ড অফ গভর্নরসের কাছে, ব্রিটেনের জনগণ বা ভারতের জনগণের কাছে নয়।
দামিনে আদিবাসী সমাজের বাইরের দিখু মহাজন, ব্যবসাদার, বা দারোগাদের সাঁওতালদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের কথা কোম্পানির সাহেবদের অজানা ছিল না। কিন্তু তাদের খাজনা ও মুনাফা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় কলকাতা ও ভাগলপুরে কোম্পানির সাহেবরা নীরব ও নির্বিকার ছিল। বরং তারা দিখু দেশীয় কর্মচারিদের কোম্পানির মুনাফা তৈরির ইকোসিস্টমের অংশ বলে মনে করত। ঠিক এর আগে আগে সাহেবদের সঙ্গে দেশীয় উচ্চশ্রেণির মানুষের সীমাহীন লোভের ভয়ানক পরিণতি ছিল ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ। এই সব সাহেবদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কোম্পানির মুনাফাবৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগকারিদের স্বার্থরক্ষা, যা ন্যায়, সাম্য ও মানবিক ভাবে দেশ শাসনের পরিপন্থী ছিল।
যুগ যুগ ধরে দিখু বা তথাকথিত মূল ভারতীয় সমাজের চরিত্র ছিল সামন্ততান্ত্রিক, সমাজ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল, সমাজের খেটে খাওয়া, নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা তাদের পরিশ্রমে ফসল ও নানা পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকত এবং তাদের উৎপাদনের উদ্বৃত্ত সবসময়েই সমাজের উচ্চ শ্রেণি শোষণ বা ভোগ করত এবং দেশীয় শাসন ব্যবস্থা তাতে মদত দিত। এইসব দেশীয় উচ্চ শ্রেণির মহাজন ও সাহুকাররা ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব বুঝত, জানত কি করে খেটে খাওয়া নিম্ন শ্রেণির মানুষদের শোষণ করতে হয়। ভারতীয় রাজনীতিতে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে মোগল সাম্রজ্যের পতন ও প্রাদেশিক দেশীয় রাজা, নবাবদের খেয়োখেয়ি, তারই সাথে ইংরেজ কোম্পানির প্রবেশ ও দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করে।
এই অস্থির অবস্থার সুযোগে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ব্যবস্থায় উদ্ভুত এই সব ধূর্ত দেশীয় মহাজন, সাহুকাররা, যাদের অনেকেই হয়ত নিজেরাও সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের শোষণের শিকার ছিল। কিন্তু এরাই রাজমহল অঞ্চলে, কোম্পানির ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের পরিচিত করে, শান্তিপ্রিয়, সরল সাঁওতালদের উপর শোষণ ও জুলুম শুরু করে। কোম্পানির রাজস্ব সংগ্রহ ও মুনাফার লক্ষ্য পূরণের জন্য এই সব উচ্চ শ্রেণির মানুষ সাহেবদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এরা একদিকে উদ্বৃত্ত সম্পদের শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত ছিল আবার অন্যদিকে রাজকীয় ব্যবস্থার ন্যায় বিচারের সঙ্গেও পরিচিত ছিল, যে ন্যায় রাজারা ব্যবহার করত প্রজা বিক্ষোভ কম করার জন্য যা তাদের দীর্ঘ মেয়াদী রাজ্য শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু বিদেশি কোম্পানির কাছে দামিনে ন্যায়ের কোন প্রয়োজন ছিল না, তাই ন্যায় বিচারের পরিবর্তে মানুষের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিক্ষোভকে পাশবিক শক্তি ও হিংসার ব্যবহারে দমন ছিল তাদের স্বাভাবিক নীতি।
যুগযুগ ধরে ভারতীয় উপদ্বীপের মালভুমি অঞ্চলের আদিবাসীদের সমাজ ও সংস্কৃতি, ভারতের গঙ্গা নদী উপত্যকার তথাকথিত মূলস্রোত সামন্ততান্ত্রিক হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে একদম আলাদা। কোম্পানির সাহেবরা জানত দিখু মধ্যস্বত্বভোগী উচ্চশ্রেণির মানুষরা প্রকৃত সম্পদ উৎপাদনে অক্ষম তাই তারা রাজমহল পাহাড় অঞ্চলকে উৎপাদনশীল করার জন্য পরিশ্রমী, সাহসী সাঁওতালদের সাহায্য নেয়, যারা মালভুমি অঞ্চলে চাষবাসে অভ্যস্ত এবং একই সঙ্গে দামিনের বাইরের জমিদারদের অত্যাচারে তটস্থ। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ভারতীয় রাজা ও জমিদাররা ক্রমাগত জঙ্গলে ঢাকা মালভুমি অঞ্চলে গায়ের জোরে সৈন্যবলে আদিবাসীদের জায়গা দখল করে শান্তিপ্রিয় আদিবাসীদের থেকে কর আদায় শুরু করে যা কোম্পানি আমলে চরম আকার ধারণ করে। এই সময় থেকেই মধ্য ভারতের বহু আদিবাসী সমাজে তথাকথিত মূলস্রোত হিন্দু সমাজের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
সাঁওতালরাও মালভুমির জঙ্গল অঞ্চলে ছোট ছোট গ্রামে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করত, তাদের জীবিকা মূলত কৃষি নির্ভর হলেও, তা ছিল পরিবেশ নির্ভর বৈচিত্রে্য পূর্ণ, যেমন শিকার, বনজ সম্পদের আহরণ, পশুপালন, বিভিন্ন ধরনের চাষবাস ইত্যাদি। শারীরিক পরিশ্রমে তারা যা উৎপাদন করত তা নিজেদের উপভোগ বা ব্যবহারের জন্য, কোন ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যক মুনাফা করার জন্য নয়। তাদের অতিরিক্ত উৎপাদনের আদান প্রদানের জন্য ছিল তাদের বাজার বা হাট যেখানে কেবল জিনিস পত্রের আদানপ্রদান নয় তাদের সামাজিক মেলামেশাও প্রাধান্য পেত। হাটে মূলত যে সব প্রয়োজনীয় জিনিস যা কোন বিশেষ পরিবার উৎপাদন করত না তা তাদের উৎপাদিত অতিরিক্ত জিনিসের বিনিময়ে সংগ্রহ করত।
আদিবাসী সমাজে অন্যের উদ্বৃত্ত উৎপাদনে বাণিজ্য করে মুনাফা ও অতিরিক্ত পুঁজির সঞ্চয় করার মতো কোন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ছিল না। কাজেই বাজার ও বাণিজ্য সংক্রান্ত হিসাব নিকাশ ও অঙ্কের কোন প্রয়োজন সাঁওতালরা অনুভব করে নি। দৈনন্দিন আদিবাসী জীবনে পরিবারের প্রয়োজনের জন্য উৎপাদন, তার উপভোগ বা ব্যবহার এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খোলামেলা স্বাধীন পরস্পর নির্ভরশীল সামাজিক জীবন যাপন ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য অতিরিক্ত উৎপাদন ও প্রয়োজন অতিরিক্ত ধন ও সম্পত্তির দ্বারা পুঁজির সঞ্চয় ও পরিশেষে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ ছিল না। এদের সমাজ ছিল মূলত সামাজিক পুঁজি নির্ভর যেখানে একই মূল্যবোধ, নীতি এবং বোঝাপড়ার ভাগীদারিত্বের নেটওয়ার্ক, গোষ্ঠীকে একত্রিত করে এবং গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে সহযোগিতাকে সহজতর ও দৃঢ় করে। এই কারণে সাঁওতাল ও পাহাড়িয়া সমাজ পরিচালিত হত স্বাধীন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, সমাজের মানুষের সম্মতিতে, সর্বশক্তিমান সবার থেকে আলাদা কোন রাজা বা সম্রাট এই সমাজে দেখা যায় না। সমাজে প্রয়োজনাতিরিক্ত ভোগের কোন ধারণা ছিল না, সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলেও তার উপর সমাজের যৌথ অধিকার ছিল। সম্পদ সমবন্টনের প্রচলন ছিল, প্রাচুর্য্য বা দারিদ্র্য দুটোর কোনটাই স্বাভাবিক ভাবে আদিবাসী বা সাঁওতাল সমাজের অংশ ছিল না। আর এই কারণেই পুঁজির অতিরিক্ত সঞ্চয়ের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাহীন শোষণের কোন ধারণা ছিল না। কাজেই এখানে Sustainability বা স্থায়িত্ব ছিল এক স্বাভাবিক ঘটনা যা সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক দিকগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে বর্তমান সময়ের জাতিসঙ্ঘের স্থায়িত্বের সংজ্ঞা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের ক্ষমতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে বর্তমানের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো।
তিন
আমরা যদি এই কাহিনীকে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখি তাহলে দেখবো, প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরানো বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ভারতীয় সভ্যতার নাভিশ্বাস উঠেছে মাত্র পাঁচশ বছরের পুরানো ইউরোপীয় পুঁজিবাদী কর্পোরেট সভ্যতার নিচে। ভারতীয় কৃষি নির্ভর মূলস্রোত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের জায়গায় উঠে এসেছে ইউরোপীয় পুঁজিবাদী শিল্প নির্ভর নগর সভ্যতা। এই নগর সভ্যতা স্বাধীন গণতান্ত্রিক, সমবণ্টনে বিশ্বাসী আদিবাসী সমাজ যা ধারাবাহিকভাবে স্থায়িত্ব বা sustainability কে প্রাধান্য দিয়েছে, তাকে আদিম, বর্বর, অসভ্যতার মোড়কে মুড়ে শোষণ করে চলেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শিল্প বিপ্লবে উঠে আসা পুঁজিবাদের অতিরিক্ত সম্পদের লোভকে মান্যতা দেওয়া অর্থনীতি নামক এক বিশেষ বিষয়ের জোরে।
বর্তমান সময়ের অনেক বিশ্ববিখ্যাত চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞান পণ্ডিতেরাও এ বিষয়ে সহমত। নাম করা অর্থনীতিবিদ ও গ্রিসের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভেরুফাকিসের মতে ‘আলুর চাহিদা থেকে শুরু করে মুদ্রাস্ফীতি এবং বিনিয়োগের উপর সুদের হারের প্রভাব পর্যন্ত যেকোনো কিছুর অর্থনৈতিক মডেল Homo economicus (যা সাধারণ মানুষ বা Homo Sapiens এর থেকে আলাদা) ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত; একজন কাল্পনিক, রবিনসন ক্রুসোর মতো, অতি-যুক্তিবাদী বোকা যে সর্বদা যা পছন্দ করে তা পায় এবং যা পায় তা পছন্দ করে (সমস্ত সম্ভাব্য বিকল্পের মধ্যে)’৩। নোয়ামচমস্কির মতো পণ্ডিতের সন্দেহ যে ‘অর্থনীতি বাজার, দক্ষতা, মুনাফা, ভোগ এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সম্পর্কে সমস্যার উত্তর দিতে সক্ষম। কিন্তু অর্থনীতি কি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৃহত্তর পরিবেশ, সমাজে প্রযুক্তির ভূমিকা, জাতি ও শ্রেণির সমস্যা, মহামারী ইত্যাদি মোকাবেলায় ভালো কাজ করে?” এই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ জুলি নেলসনের বক্তব্য অত্যন্ত চিন্তার বিষয়; ‘সমসাময়িক মূলধারার অর্থনীতি ব্যাপকভাবে "সেই কুয়োটাকে বিষাক্ত" করে তুলেছে যেখান থেকে মানুষ অর্থনীতি এবং নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা পায়। অর্থনীতির এই ধারণায় জীবনের ছবিটা, স্বভাবতই স্বার্থ, উপযোগিতা এবং মুনাফার-সর্বোচ্চীকরণ এবং যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ দিয়ে তৈরি, যা বহু ব্যবসায়ী, বিচারক, সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক, নীতিনির্ধারক, অর্থনীতির সমালোচক এবং বৃহত্তর জনসাধারণকে লোভ এবং সুবিদাবাদকে মেনে নিতে সাহায্য করে এমনকি তাদের এই পথে চলতে উৎসাহিত বা বাধ্য করে’। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে তাঁর লেখা ২০১২ সালের মুল্যবান প্রবন্ধ ‘Poisoning the Well, or How Economic Theory Damages Moral Imagination’ পড়া যেতে পারে।
আধুনিক গণতান্ত্রিক ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাও চলে গেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেখানো বাজার অর্থনীতির পুঁজিবাদী কর্পোরেটদের দখলে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজমহল পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদকে, প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের নামে ধংস করেছিল জীব বৈচিত্র্য পূর্ণ সবুজ গহন বনরাজি। সেই বৃক্ষরাজিকে কাঠের মতো পণ্যে পরিণত করে ইংরেজ কোম্পানির হাজার হাজার কোটি টাকার মুনাফাকে যেমন উন্নয়ন বলা যাবে না, একই ভাবে বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করে দেশীয় কোম্পানিরা বৃক্ষহীন রাজমহল পাহাড়ের ব্যাসল্ট পাথর ও কয়লাকে পণ্যে পরিবর্তিত করে সম্পূর্ণ পাহাড়কেই পাথর খাদানে পরিণত করে ধংস করাকেও দেশের উন্নয়ন বলা যায় না। একদিন যে রাজমহলের সবুজ বনানী একসময় পৃথিবীর বিশুদ্ধ অক্সিজেনের উৎস ছিল তাই এখন জীবাশ্ম জ্বালানি ও পরিবেশ দূষণের উৎস।
রাজমহলের গহন বনানী হারিয়ে যাবার সাথে সাথে পরিকল্পনা বিহীন খাদানের উপস্থিতিতে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ, জল সম্পদ ও উর্বর মাটি শেষ হতে চলেছে। যার ফলে এখানকার পাহাড়িয়া ও সাঁওতাল গ্রামে জলের অভাব ও ভুমিক্ষয় কেবল তাদের জীবন ও জীবিকার সঙ্কট তৈরি করেনি তাদের উত্তর পুরুষদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। এখন দামিনের চারিদিকে কেবল সিধু কানুর উত্তর পুরুষদের প্রবল দারিদ্রে্যর মাঝে চোখে পরবে এখানকার বড় বড় গঞ্জে, যেখানে সেই সব দিখু মহাজন ও সাহুকারদের উত্তর পুরুষদের প্রাসাদোপম অট্টালিকা, তারাই বর্তমানে এই অঞ্চলের পাথর খাদান ও সকল ব্যবসার মালিক।
আজ গ্রেট নিকবর থেকে বস্তার, কেরালার সাইলেন্ট ভ্যালি থেকে অরুণাচলের রেইন ফরেস্ট- সকল প্রাকৃতিক সম্পদই আধুনিক বাজার অর্থনীতিতে কর্পোরেটের পণ্যে পরিণত হয়েছে যার উপর কেবল বাজারের অধিকার, সমাজের নয়। এই আধুনিক কর্পোরেট নির্ভর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সুবিধা ভোগ করছে কেবলমাত্র অতি ধনী পুঁজিপতিদের সাথে মধ্যস্বত্বভোগী ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। এরাই ইংরেজদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ঠিক সেই কোম্পানির খাজনা আদায়কারী পেয়াদা, দারোগাদের মতো কর্পোরেটদের হয়ে কাজ করে চলেছে। ধীরে ধীরে আদিবাসী জনজাতি বা ভারতীয় গ্রামীণ সমাজ, শহরের মতো আধুনিক বাজার সমাজে পরিণত হয়েছে যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে মানুষ সবই পণ্যে পরিণত হয়েছে।
সম্পদ বন্টনের এই অসাম্য কেবল রাজমহল নয় সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ২০২২-২৩ সালে, ভারতের শীর্ষ ১% ধনীর আয় এবং সম্পদের ভাগ যথাক্রমে ২২.৬% এবং ৪০.১%। এবং ভারতের শীর্ষ ১% ধনীর এই আয়ের ভাগ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৪ । একদিকে পরিবেশ দূষণ, নদী, পাহাড়, জল, জমি জঙ্গলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ধংস হচ্ছে অন্য দিকে অসম সম্পদের বন্টনের ফলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে অল্প সংখ্যক ধনী মানুষের হাতে। এই অবস্থায় এক বিশাল সংখ্যক গরীব গ্রামীণ মানুষ অসহায় শক্তিহীন অবস্থায় শুধুমাত্র তাদের ভোটদানের অধিকার বলে এই শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনে অক্ষম।
রাজমহলের আদিবাসীদের মতো মধ্য ভারতের বিভিন্ন জঙ্গল নির্ভর আদিবাসী সমাজ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণ ও পরিবেশ দূষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজে হাজার হাজার বছর বসবাস করেছে। আজ বহু মানুষ এমনকি জাতিসঙ্ঘও এরকম সমাজের কথাই বলছে। এখানে হয়তো পাঠকের মনে হতে পারে যে জঙ্গল ঘেরা আদিম আদিবাসী জনজাতির মানুষেরা তো সুসভ্য নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় এসে আধুনিক হচ্ছে, সবার উপরে আধুনিক ভারতে দারিদ্র্য কমেছে, তাহলে প্রশ্ন কেন? সত্যিই কি আদিম ভারতীয় দরিদ্র জনজাতির থেকে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির নগর সভ্যতার মানুষদের কিছু শেখার আছে?
প্রথমে আমরা দারিদ্রে্যর কথায় আসি। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সংজ্ঞায় দারিদ্র্য কেবলমাত্র আয়ের অভাব নয়, দারিদ্র্য হলো অসহায়ত্ব, শক্তিহীনতা এবং বাকশক্তিহীনতার উপস্থিতি। বর্তমান ভারতবর্ষে বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সম্পদের অসম বণ্টনে অল্প সংখ্যক পুঁজিপতির হাতে বিশাল সম্পদ ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ের থেকে বেশী। সমগ্র ভারতবর্ষের জন সংখ্যার ৮% যে আদিবাসী জনসাধারণ তারা এর আগে কখনো এতো অসহায়, শক্তিহীন ও অভাবের মধ্যে ছিল না।
এবার আসা যাক আদিম ও আধুনিক সভ্যতার কথায়। আদিবাসী মানেই আদিম জঙ্গলে থাকা মানুষজন, আধুনিক সভ্যতার থেকে অনেক পিছনে, এই ধারণার শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে অ্যাডাম স্মিতের সময়ে ইউরোপে, যা আজও প্রচলিত। একমাত্রিক সামাজিক বিবর্তনের তত্ত্বে বলা হয়েছিল মানব সমাজ ধীরে ধীরে প্রথমে জঙ্গলে শিকার তারপর পশুপালন থেকে কৃষি হয়ে নগর সভ্যতায় উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ জঙ্গলের পরিবেশে বসবাসকারী পৃথিবীর সকল আদিবাসী সমাজই সমাজ বিবর্তনের আদিম অবস্থায় আছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের অগণিত নৃতত্ত্ব ও সমাজ বিজ্ঞান গবেষণা আর এই তত্ত্বকে মান্যতা দেয় না।
আধুনিক মানুষের মস্তিস্কের গঠন বিগত ৭৫ হাজার বছর ধরে একই আছে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে দশ হাজার বছর আগের কৃষি বিপ্লবের পূর্বের অনেক মানব সমাজই আজকের অনেক জনজাতি-সমাজের থেকে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে তাদের সমাজ পরিচালনা করতে সক্ষম, যেখানে বর্তমান সময়ের সভ্য সমাজের থেকে অনেক বেশি সাম্য ছিল, স্বাধীনতা ছিল, অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ছিল, সর্বোপরি স্থায়িত্ব বা sustainability ছিল যা বিশ্বজুড়ে বর্তমান মানব সমাজের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের গভীর সঙ্কটের সময় জাতিসঙ্ঘের সাত দফা স্থায়ী উন্নয়ন লক্ষমাত্রাই (sustainability development goal) সভ্যতার এই ব্যাপক সমস্যাকে নির্দেশ করে।
এখন এই স্থায়িত্ব বা sustainability র কথা ধরলে দেখা যাবে দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পাহাড়িয়া সমাজ রাজমহল পাহাড়ে প্রদূষণ মুক্ত বিশুদ্ধ জল বাতাসে ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য সামগ্রীতে তাদের সুস্থ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক সমাজ জীবন যাপন করছিল ভারতবর্ষের সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাদী সমাজের মতই। তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা তাদের সুস্থ স্বাধীন জীবন কেড়ে নিয়ে এই পুঁজিবাদী কর্পোরেট সভ্যতার বন্দী সমাজহীন দরিদ্র দাসে পরিণত করেছে।
তথ্যসূত্র
১. Nirad C Chaudhuri, The Continent of Circe, 1965
২. Hul! Hul! The Suppression of the Santal Rebellion in Bengal, 1855; By Peter Stanley
৩. Economics Is Irredeemably Sexist by Yanis Varoufakis, Mar 6, 2024, (https://www.project-syndicate.org/commentary/philosophical-sexism-deters-women-from-economics-by-yanis-varoufakis-2024-03)
৪. Income and Wealth Inequality in India, 1922-2023: The Rise of the Billionaire Raj by Nitin Kumar Bharti, Lucas Chancel, Thomas Piketty, and Anmol Somanchi - World Inequality Lab Working Paper