সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
এটা পার্থর কোনো স্মরণলেখ নয়। আমি পার্থকে যেভাবে দেখেছি, সেটাও একটা লেখায় শেষ করা অসম্ভব। প্রায় পঞ্চাশ বছরের একটা সম্পর্ক। আর এটা যে আমাকে কোনোদিন লিখতে হবে, সেটাও ভাবিনি কখনো। যেন আমরা চিরকাল থাকবো, চলে যাবার কথা বলা মানে সময় নষ্ট করা! অবশ্য এখন ভাবি, মিঠুকে, মানে পার্থকে যদি এইরকম পরিস্থিতিতে আমার জন্যে কিছু লিখতে হতো, সে-ও বোধহয় এমনভাবেই শুরু করতো। কিম্বা হয়তো অন্যভাবে। পার্থ, মানে মিঠু সব বিষয়ে আমার থেকে এগিয়ে। চলে যাওয়াতেও।
১৯৭৬ সাল। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে শিলচর জি সি কলেজে প্রি-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে দেখলাম, একটি ছেলে, ক্লাসে বসে পড়াও শুনছে, আবার প্র্যাক্টিক্যাল খাতায় জুলজি বোটানির ছবি আঁকছে, ফিজিক্স কেমেস্ট্রির খাতা কমপ্লিট করছে – ওই ক্লাসে বসেই। পরিচয় হতে জানলাম, ও বদরপুর থেকে এসেছে। সায়েন্স স্ট্রিমে ভর্তি হওয়া বদরপুরের আরও কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে, একদু’জন আর সিনিয়র দাদাও ছিলেন, ওই বদরপুরেরই, আমাদের এক মাস্টারমশায়ের বাড়িতে দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে মেস করে থাকে। সবাই বদরপুর রেল কলোনির ‘পোলা’। আজকে গোটা কাছাড় জেলাতেই বলা যায়, এন-আর-সি মুভমেন্ট নিয়ে প্রায় একা কাজ করে চলা কমল চক্রবর্তী, আমাদের কমলদা, কমলদাদের মেসেই মিঠু থাকতো। আমি যে গ্রাম থেকে আসা, আমাদের যখন ক্লাস এইট, তখন আমাদের গ্রামের রাস্তায় প্রথম ইলেক্ট্রিকের আলো জ্বলে, ঘরে ঘরে তখনো হেরিকেন, সেইরকম একটি গ্রাম। এমনকি, আমাদের ছোটোবেলায় খেলার মাঠে দু’পায়ের ফাঁকে একটা লম্বা বাঁশ নিয়ে খেলার সাথীরা পর পর দাঁড়িয়ে এগোতে এগোতে সবাই সুর করে বলতাম, চলছে গাড়ি বদরপুর। - অর্থাৎ বদরপুর আমাদের কাছে এতোটাই দূরের, এতোটাই অজানা। ফলে আমি এই শহরে যথেষ্ট গুটিয়ে থাকা। শিলচর শহরের যারা, কলেজের আশে পাশের স্কুল থেকে আসা, স্বাভাবিকভাবেই তাদের তখন ‘রাজ’ বলা যায়। কিন্তু মিঠু এসব সংকোচ, অমিত প্রকাশ– এসবের ঊর্ধ্বে। ওর একটা নিজের জগতে ও সদা আনন্দে জেগে থাকতো। ক্লাস শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই সব শিক্ষকদের কাছে মেধাবী ছাত্র হিসাবে ওর একটা স্বীকৃতি খুব সহজেই তৈরি হলো। কিন্তু ওই, ক্লাসেই তার সব পড়াশুনো। পরিচয় কিছুটা ঘনিষ্ঠ হবার পর একদিন সন্ধের পর ওদের মেসে গেছি। তখন আমাদের একটা পরীক্ষা চলছে। আমাদের সহপাঠী দীপঙ্কর, ওই মেসেই থাকে, সে-ও বদরপুর রেল কলোনির, একটা অদ্ভুত কায়দায় ও পড়ে চলেছে। পড়েই চলেছে। মিঠুও পড়ছে। ভেতরের ঘরে, মশারির ভেতর আধশোয়া হয়ে। মিঠু কিন্তু পড়ছে সিনেমা জগত। সম্ভবত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস। দারুণ ইন্টারেস্টিং, ফলে আজকেই শেষ করতে হবে। একটা সময় উপন্যাস শেষ হলো। ততক্ষণে এসে গেছে, বিশ্বরূপ। কাছাড় কলেজে নাইটে পড়ে। ব্যস্ , শুরু হলো মিঠু আর বিশ্বরূপের বিচিত্র সব আলোচনা, আর হাসি। কী যে বলে, আর কেন যে হাসে– একমাত্র ওরাই বলতে পারতো। অথচ সেই পরীক্ষায় দেখা গেল, দীপঙ্কর তীর্থঙ্কর থেকে অনেক এগিয়ে রইলো পার্থপ্রতিম মৈত্র। পরিচয়ের কিছুদিন পরে বদরপুরে ওদের বাড়িতে গিয়ে রেলওয়ে স্কুল দেখতে গিয়েছিলাম। দেখেছি, কৃতী ছাত্রদের নামের তালিকায় জেনারেল আর অ্যাডিশন্যাল – ম্যাথমেটিক্সের দুটোতেই লেটার নিয়ে দুর্দান্ত রেজাল্ট করা পার্থপ্রতিম মৈত্রের নাম। আমাদের সময় মেট্রিকে বা প্রি-ইউনিভার্সিটিতে প্রচুর পার্সেন্টেজ তোলা খুব কঠিন ছিল। অথচ টেস্টের পরে যে তিন মাস প্রস্তুতির সময় পাওয়া যেতো, মিঠু সেই সময়ের বেশিরভাগটাই রেলওয়ে ইন্সটিটিউটে টেবিল টেনিস খেলে কাটিয়েছে। স্কুলের প্রতি ওর একটা ভয়ঙ্কর অভিমান! তার একটা সঙ্গত কারণও ছিল।
সত্তরের দশকের গোড়ার সেই ভারতব্যাপী বিরাট রেল স্ট্রাইকে মেসো, মিঠুর বাবা প্রবীর কুমার মৈত্র, জেলে। রেল কর্মচারিদের মধ্যে বামপন্থী সংগঠন জোরদার করার জন্য অন্য একটি উচ্চপদের নিশ্চিত সরকারি চাকরি ছেড়ে রেলে যোগ দিয়েছিল মেসো। ফলে ওই সময়কার ধর-পাকড়ে প্রথমেই প্রবীর মৈত্রদের জেল হাজত। এদিকে সেই ধর্মঘট চালু রাখার কাজে গোপন সাহায্য করার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মিঠুও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তখন তার ক্লাস নাইন। জেল হয়। অবশ্য অল্প বয়স বলে ছাড়া পেয়ে যায় দ্রুতই। কিন্তু বদরপুর রেল হাইস্কুলের সরকারের কিছু বশংবদ শিক্ষক মিঠুকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। রেল স্ট্রাইকে সাহায্য করতে যাওয়া একজন জেল ফেরত ‘আসামি’-কে রেলের স্কুলে রাখাটাই না কি চরম বেঠিক কাজ হবে! মাসি, মীরা মৈত্র, ওই স্কুলেরই শিক্ষিকা, চুপ করে তখন শুধু ঘরে বাইরের অবস্থা সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে বৃদ্ধ বৃদ্ধা শ্বশুর- শাশুড়ি, স্বামী জেলে, বড় পুত্র ওইরকম ক্ষোভে দুঃখে প্রায় হা-বাউন্ডুলে! – সেই মাসির কথা আর তেমন করে কোনোদিন বলাই হলো না। অথচ ছবি আঁকতে এস্রাজ বাজাতে আবৃত্তি করতে মাসির আগ্রহ আর পরিশ্রম – সে মাঝে মাঝে ওই ইলা মিত্র-র কথা মনে করিয়ে দেয়। না, মাসি জেলে যায়নি, কিন্তু তখন গোটা সময়টাই তো একটা জেলখানার আদল পেয়ে গেছে!। মিঠুই তখন ক্লাস নাইন, পিকু বুড়ি পাপু – আরও ছোটো! সন্ধের মুখে সবাইকে গুছিয়ে নিয়ে ফিরে এসে মাসির আবার সংসার সামাল দেওয়া! – জানি, এইভাবে এগোলে এই লেখা বৃহৎ আখ্যান হয়ে যাবে। শুধু এইটুকু বোঝাতেই এইসব কথা বলা, মিঠু বড় হয়েছে এইভাবে, এই পরিবেশের মধ্যেই। প্রথাগত শিক্ষার প্রতি বরাবরই ওর এক প্রবল ক্ষোভ আর বিতৃষ্ণা। সেই নিয়ে হাজারো মজার অভিজ্ঞতা আছে ওর। একদিন, ওই মেট্রিকের আগে আগে, মেসো তখন সম্ভবত জোরাই রেল স্টেশনে পোস্টেড, বাড়ি এসেছেন। মাসি যথারীতি বলেছে, পড়াশুনোর প্রতি মিঠুর এমন ‘গভীর’ মনোযোগের কথা। তারপরের অংশটুকু মিঠুর বয়ানেই শোনা যাক। - ‘মা-র কথা শুইন্যা স্বাভাবিকভাবেই বাবা খুব রাইগ্যা গেছে, অনেকক্ষণ কিছু কইতে পারতাছে না। হঠাৎ বাবা খুব গম্ভীর গলায় আমারে জিগাইছে, মিঠু, তুমি কী ভাবছো কী, শেষ পর্যন্ত তুমি কী করতে চাইতেছো! হোয়াট ইজ ইয়োর এইম ইন লাইফ! - আর রে বাই, আমার না মুখ দিয়া ফস্ কইরা বাইরইয়া গেছে, আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা ডক্টর! –শুইন্যা বাবা যে চেত্ছে! আর কোনো কথা নাই।...‘ আসলে ক্লাস নাইন টেনে ইংরেজি রচনা আসতো আমাদের, ‘হোয়াট ইজ ইয়োর এইম ইন লাইফ’। তেড়ে মুখস্ত করতে হতো, আই ওয়ান্ট টু বি অ্যা ডক্টর। - অনেকের সেসব দিকে যাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই, অথচ সেই আমরাই নম্বরের জন্য প্রাণপণে সেসব মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখবো বলে তৈরি হচ্ছিলাম। মিঠু ওইসময়েই এইগুলো নিয়ে খুব হাসাহাসি করতো। - ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বিষয়ে রচনা কী শিখছছ! উত্তর অইলো, বাংলায় চাষী, ইংরেজিতে ডাক্তার। চিন্তা কর!” - মানে রচনা বই থেকে মুখস্থ করা তো, সেখানে যেমন যেমন লেখা!
ওই ছাত্রাবস্থাতেই মিঠু সেটা ধরে ফেলে হাসতে হাসতে সেই মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো, আর আমরা প্রায় সবাই সেই প্রথাবদ্ধতাকেই আঁকড়ে ধরে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইতাম। কলেজে প্রি-ইউনিভারসিটি পরীক্ষায় মিঠু যথেষ্ট ভালো ফল করলো। অবশ্যই চাইলে আরো ভালো করতে পারতো। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য চেষ্টাই করলো না। তখন কলেজের ক্রিম ছেলেরা ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথস্-এ অনার্স নেয়। আজকের কথা না, ’৭৭, প্রায় আটচল্লিশ বছর আগেকার স্কুল কলেজ। জি সি কলেজ গোটা রাজ্যে সমাদৃত সম্মানিত, গৌহাটির কটন কলেজের পরে আর একটা দুটোর সঙ্গে শিলচর জি সি কলেজ। মিঠু ফিজিক্স্ অনার্স নিল। ওর মেধা বোধবুদ্ধি তখন গোটা সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতেই স্বীকৃত! কিন্তু মিঠুকে ক্লাস করায় সাধ্য কার! ওই মেস বাড়িটায় অনেকগুলো ঘর। মিঠুর ছোটোভাই পিকু, সিদ্ধার্থপ্রতিম মৈত্র, সে-ও তখন মেসে চলে এসেছে প্রি-ইউনিভার্সিটির ছাত্র হিসাবে। অত্যন্ত সিরিয়াস, কলেজ কামাই করার চিন্তাও তার মাথায় আসে না। কিন্তু মিঠুর এই ক্রমাগত ক্লাসে না যাওয়ায় আমরা তো আমরা, টিচাররা পর্যন্ত সবাই উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন সবাই, বাদে মিঠু। আমাদের ফিজিক্সের টিচার শৈলেশ সিনহা, এখনো মনে আছে, আমাদের স্থানীয় বাজারে দেখা হতেই মিঠুর না যাওয়াতে খুবই চিন্তিত, সেই চিন্তার ক্ষোভের প্রকাশ ঘটলো আমার উপরে। অবশ্য মিঠুর তাতে কোনো হেলদোল নেই। ওই মেসের আমরা সবাই কলেজ যাচ্ছি, কী করতো মিঠু তখন! ততোদিনে ব্রুস লি-র ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ সিনেমা গেছে শিলচরে। দেখেছে মিঠু, আমরাও দেখেছি। তারপর আমরা যথারীতি কলেজ গেছি, আর পাঁচটা কাজ করেছি। মিঠু ততোক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, কিছু করতে হলে ওই মার্শাল আর্টই করবে। - আর একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যখন, তখন তো আর কথা নেই! শুরু করে দিল মার্শাল আর্টের জন্য শরীর তৈরির কাজ। আস্তে আস্তে কলকাতা থেকে মার্শাল আর্টের অনেকগুলো বেশ দামি দামি ইংরেজি ছবি দেওয়া বই এলো, এলো নান্চাকু। মিঠু যাঁর স্নেহের পুত্তলি, দোদুলদা বলে আমাদের একজন, ভালো নাম প্রিয়তোষ রায় চৌধুরি, মাঝাগ্রাম চা-বাগানের হেড্ ক্লার্কের ছেলে, আমাদের মেসে থেকে তখন বি এড্ করছে। সেই দোদুলদা মিঠুর আবদারে নিয়ে এলো গাদা খড়। অবশ্য আবদার করতে হয় না, মিঠুর মনোবাসনা পূরণে দোদোলদা তৈরি সদাই। সেই বিপুল পরিমাণ খড় দুজনে মিলেই আনলো। তারপর অনেকটা চট কিনে নিয়ে এসে তার মধ্যে ওই খড় পুরে সেলাই করে বড়ো বিছানা- ঘরের মেঝেতে ফেলা হলো, তৈরি হলো ম্যাট, জাজিম। এসবকিছুর ম্যানুয়াল পার্টটা দোদোলদার। মিঠু তখন মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে, ভল্ট্ খেতে হবে তো তাকে! শুরু হলো চর্চা। পুরো বাড়ির সবাই নিয়ম করে কলেজে যার যার ক্লাসে যাচ্ছে, অন্যান্য কাজ সারছে, মিঠু মেসে - কখনো ভল্ট্ খাচ্ছে, কখনো নান্চাকু ঘোরাচ্ছে, আর বাকি সময়টা টেনে ঘুমিয়ে এনার্জি স্টোর করছে বিকেলের প্র্যাক্টিসের জন্য! চললো বেশ কিছুদিন। তখন বাইরে সিনেমা দেখতে গেলেও ব্যাগে করে নান্চাকু, মার্শাল আর্টের দুচারটে বই সঙ্গে করে রাখতো মিঠু। অবশ্য কেউ জানতো না, জানাতে চাইতো না কাউকে। স্বাভাবিকভাবেই তখন কলেজ গিয়ে সময় নষ্ট করবার মতো সময় ওর নেই! এদিকে ব্যাক ভল্ট্টা যখন প্রায় আয়ত্বে, সামনের দিকে তো অনেক আগেই হয়ে গেছে, ঠোঁটে মুখে না লাগিয়ে নান্চাকুও বেদম ঘরছে ডাইনে বাঁয়ে, তখনই ওর আগ্রহ অন্যদিকে চলে গেল। গাদা গাদা বই, নান্চাকু – কোথায় পড়ে রইলো সব! এই পর্বের কিছুদিন আগেই কে একজন ঠাট্টা করে বলেছিল, মিঠুদা, সাইকেল চালাইতায় পারো না! – ব্যস্, পরদিনই দোদোলদাকে দিয়ে সাইকেল সারাইয়ের দোকান থেকে একটা পুরোনো সাইকেল ভাড়া করে এনে সকাল থেকে শুরু হলো সেই শিক্ষাপর্ব। বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে শুনি, আমাদের মেস থেকে ভেতর ভেতর দিয়ে শিলচর রেল স্টেশনে যাওয়ার একটা রাস্তা আছে, প্রায় দেড়- দু’ কিলোমিটার, একটা পুরো দিন সেই পথ ধরে সাইকেল চালানো চলেছে! একদিনে শিক্ষানবিশ তারপর মাস্টার, তারপর হাত ছেড়ে চালানোও শিখে গেল ওই একইদিনে। এবং এরপর ওতে তার আর কোনো আগ্রহ নেই। শেখা হয়ে গেছে তো! এরই কিছুদিন আগে পরে একবার ধর্মনগর থেকে আমাদের মেসবাড়ির মালিকের এক আত্মীয় এসেছিল। আমাদের থেকে সামান্য ছোটই ছিল বোধহয়। তবে ঘ্যাম্ একটু বেশি। আমরা ওর মেসোর বাড়ির ভাড়াটে কি না! তা সে যাই হোক, শোনা গেল, সে না কি হিপ্নোটাইজ করতে পারে! হিপ্নোটাইজ! স্বাভাবিকভাবেই মেসের ঘরে ঘরে সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে। দুয়েকজন পরখ করেও এলো সেটা। হ্যাঁ, সত্যিই। - মিঠূদা, যাও না একবার! – সবার কাতর অনুরোধ, মিঠুদা গেলে কিছু একটা হবে। ওর ক্ষমতার উপর ওদের অগাধ বিশ্বাস। গেল মিঠু। ফিরে এলো ততোধিক গম্ভীর হয়ে। মুখে কোনোকথা নেই। পরের দিন সকালে শোভনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললো সে। কারো সঙ্গে যেচে গিয়ে কথা বলা, ওর স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই যায় না। তবু গেল, দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। কলেজ বাদ পড়লো স্বাভাবিকভাবেই। আমরা বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখি, বড় একটা ড্রয়িং শিটে একটা বিশাল চোখ এঁকেছে মিঠু, দোদোলদার সাহায্যেই। তারপর ওই চোখটা দেয়ালে সাঁটিয়ে টেবিলের বইপত্র চৌকিতে নামিয়ে ওর উপর উঠে বসে মিঠু টানা তিনদিন – হ্যাঁ, টানা তিনদিন ওই চোখটার দিকে প্রায় নিষ্পলক তাকিয়ে বসে রইলো মিঠু। রাতে সামান্যক্ষণ ঘুমোনো, আর খাওয়া বাথরুম - চান করতো না এমনিতেই – এর বাইরে পুরোক্ষণ ওই আঁখির দিকে। চতুর্থ দিন মিঠু ওই শোভনকেই, শোনা যায়, হিপ্নোটাইজ করে বেরিয়ে এলো। শোনা যায় বলতে, মিঠু আর শোভন একটা ঘরে ছিল প্রায় দুই তিন ঘন্টা। এরপর ওরা যখন বেরিয়ে এলো, শোভনের কেমন কাহিল অবস্থা, আর মিঠু মিটি মিটি হেসে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। তারপর বোধহয় টানা দুদিন ঘুমোলো। শোভন একদিন পরেই গ্রীষ্মের ছুটি সংক্ষিপ্ত করে সসম্মানে ধর্মনগর ফেরৎ। সবার হাজার প্রশ্নেও মিঠু নির্বাক। আর তাছাড়া এর পর পরই অন্য একটা বিষয়ে গভীর আগ্রহ জন্মে গেছে না তার! - আজ এইসব কথার প্রমাণ দেওয়ার মতো পিকু, কমলদা, দোদোলদা, শান্তনু আর আমি ছাড়া কে যে কোথায় ছিট্কে পড়েছে, কে জানে। গল্প কথা বলে মনে হয়, কিন্তু এখনও বদরপুর শিলচরের মিঠুর পরিচিত প্রায় প্রতিজনের কাছে মিঠুর এইরকম প্রায় অবিশ্বাস্য বহু গল্প জমানো আছে।
স্বাভাবিকভাবেই ফিজিক্স অনার্স থাকলো না মিঠুর, মানে ও পড়লোই না, পরীক্ষাও আধা-খ্যাঁচড়া। কারণ ততোদিনে শুরু হয়েছে অন্য চর্চা। নতুন ভাবে রাজনীতি করা। কলেজে শুরুর দিকে আমরা এস এফ আই-ই করতাম। মেসো, মিঠুর বাবা, সি পি আই এম–এর কর্মী। এখনকার মতো এবং এখানকার মতো, অন্তত ক্ষমতায় থাকার সময় ‘আমি পার্টি মেম্বার’ বলে বারফট্টাই করার চল আসামে ছিল না। এখনও সেইভাবে নেই, অবশ্য ক্ষমতায় এলে কী হবে কে জানে! যাইহোক, হঠাৎ দেখলাম, মিঠু রোজ সন্ধেবেলায় মেস থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছে, ফিরছে বেশ রাত করে, সঙ্গে একটা দুটো বই। আর রাত জেগে পড়ছে সেসব। প্রায় সারারাত জেগে থাকা। তারপর সকালে ঘুম, ফলে কলেজ বাদ। তখন মিঠুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা অনেকের থেকেই একটু বেশি। কিন্তু আমি মিঠুর মতো অতো ক্ষমতাবান নই, হিসেবি মানুষ, পড়াশুনো করে বড় হতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় মিঠূর সঙ্গে ওর এই গোপন প্রস্তুতি নিয়ে কথা হতে লাগলো। তখন আসামে সন্তোষ রানা, ভাস্কর ব্যানার্জিদের গ্রুপ যথেষ্ট সক্রিয়। আগে থেকেই ছিল, আমরা খোঁজ রাখিনি। মিঠু সেই খোঁজটা বয়ে আনলো। আস্তে আস্তে আমরা একদু’জন যাতায়াত শুরু করলাম। পিকু, সি পি এম-এর কট্টর সমর্থক, এস এফ আই-এর কর্মী, জেলাস্তরেরে সব নেতা পিকুর খুব কাছের মানুষ। সন্ধের পর পিকুর কোথাও বেরোনো মানেই পার্টি অফিসে যাওয়া। অবশ্য খুব কমই ছিল সেটা। সি পি এম নকশাল নিয়ে মাঝে মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক হতো। সব তর্কের পরিণতি যে খুব একটা ভালো জায়গায় পৌঁছোয়নি, বলাই বাহুল্য।
যাইহোক, আমাদের বি এসসি প্রথম বছর শেষ হবে হবে তখন। সন্তোষ রানা, খোকন মজুমদার,কৌশিক ব্যানার্জি– শিলচরে এলেন। একটা প্রকাশ্য সমাবেশ হলো। রাতে কয়েকজন ছাত্রনেতাকে নিয়ে মিটিং। মিঠু আমাদের তাত্ত্বিক নেতা। ঠিক হলো, কলেজ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। নিজেদের রাজনীতির কথাটা বলার জন্য অংশগ্রহণ করতে হবে, কিন্তু কোনো দপ্তরের ভার নেওয়া চলবে না। তাহলে কী করে হবে! কলেজে তখন সমস্ত পোস্টে একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্রেটারি, সঙ্গে অ্যসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হতো। অ্যাসিস্টেন্ট পদগুলোতে আমাদের দাঁড়াতে হবে। হলো দাঁড়ানো। কলেজে আমরা পাঁচজন কর্মী, পাঁচজনই ক্যান্ডিডেট। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের সমর্থনে ভালোবাসায় পাঁচজনই জিতে গেল। মিঠু নিজে, পার্বতী পাল, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, যে ভাইস- প্রেসিডেন্ট পোস্টে জিতেছিল, আমি, আর আরেক বন্ধুর নাম এখন আর মনে করতে পারি না, কিন্তু ওর চেহারটা এখনও স্পষ্ট। আর এই কাজে মূল সাহসটা ছিল মিঠু আর পার্বতীর। আমরা রাতে দেয়াল লিখতে গেলাম। পার্বতী নিজে গেল না, সেরকমই কথা ছিল, ধরা পড়লে অন্য নানা ঝামেলায় জড়িয়ে দেওয়ার একটা আশঙ্কা। পার্বতী সব গুছিয়ে টুছিয়ে দিল, গেলাম আমরা - আমি, মিঠু, শান্তনু – শান্তনু বদরপুর রেল কলোনিরই একজন অনুজ বন্ধু। রাজনীতি সম্পর্কিত পড়াশুনো চিন্তা-ভাবনার চেয়েও শান্তনুর ছিল মিঠুর প্রতি প্রকাশহীন এক অদম্য ভালোবাসা। আমরা তিনজন আর বিশুদা বলে কোলকাতা থেকে আসা পার্টির একজন হোলটাইমার। নকশালবাড়ির আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বয়ে নিয়ে আমরা দেয়াল লিখতে যাচ্ছি, তখন আমাদের যতটা উত্তেজনা ততোটাই ভয়। শিলচরের ছাত্র আন্দোলনে নকশাল বাড়ি রাজনীতির এই প্রথম প্রকাশ। ফলে আমাদের প্রতিপক্ষ সবাই। আমাদের অস্ত্র কেবল সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব, আমাদের সুসম্পর্ক। ফলে যে ক’টি সিটে আমরা প্রার্থী দিয়েছিলাম, জিতে গেলাম সবগুলোতেই। অবশ্য নির্বাচনে জেতার চেয়েও আমাদের বড়ো চাওয়া ছিল, ওই রাজনীতির কথাটা প্রচার করা। সেটাতে সফল হয়েছিলাম আমরা কারণ নির্বাচনে জেতার জন্য যেসব প্রচলিত পথ-পদ্ধতি, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কাছে কোনোই প্রশ্রয় পায়নি। ছাত্র-ছাত্রীরাও আমাদের সমর্থন করেছিল। মিঠু আসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরি সেক্রেটারি। ইতিমধ্যে কাছে ধারের দুয়েকটা গ্রামে গঞ্জে গিয়ে যোগাযোগ গড়ে তোলা হচ্ছে। এই করতে করতে আমাদের বি এসসি পরীক্ষা হলো, মিঠুর না। ও তখন অনার্স ছেড়ে পাসে নাম লিখিয়েছে। কবে পরীক্ষা দেবে ঠিক নেই। গোটা মেস বাড়িটা তখন খালি। একদু’জন অনার্স দিয়ে পাস সাকব্জেক্টের প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা ইত্যাদির জন্য রয়ে গেছে। মিঠুর পরীক্ষা নেই, তবু ও মেসেই থাকে। ওই রাজনীতিতেও তখন ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিল।
আমাদের পরীক্ষা দিয়ে পরের ধাপের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শুরু হলো আসামে আসু-র আন্দোলন। আমার কোলকাতায় চলে আসা। রয়ে গেল মিঠুরা। এখানে বহুবচন বলতে মিঠু তখন লেখালেখিতে মন দিয়েছে বেশি। কবিতা লিখছে, পত্রিকা বার করার চেষ্টা করছে, ফলে শান্তনুসহ শিলচরের আরও কিছু তরুণ বন্ধু মিঠুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। এর কিছুদিন পর। আমি তখন কল্যাণীতে। মিঠুও কী কাজে এসেছে কোলকাতায়। দেখা সাক্ষাৎ মাঝে মধ্যে। একদিন ও আমার আমার কল্যাণীর হোস্টেলে চলে আসে। এর আগেও মিঠু একদু’বার এসেছে এখানে। সেই রাতে হোস্টেলের ঘরে গল্পগুজবের পাট শেষ করে সবাই যখন ঘরে চলে গেছে, শুধু মিঠু আর আমি, তখন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মিঠু যেটা বললো, সেটা ভয়ঙ্কর। কিছুদিন আগে তাহেরপুর বাদকুল্লা অঞ্চলে একজন চাষীর বাড়িতে সাতজন নকশালকে গ্রামের এবং রাজ্যের ‘শান্তি- শৃঙ্খলা রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ’ শাসক-কমরেডরা কুপিয়ে খুন করে। সেই খুন হয়ে যাওয়া চাষীদের মধ্যে বিশুদাও ছিল। মারা গেছে বিশুদা। মিঠুকে আমি কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি। সেইদিন হোস্টেলে বিশুদার কথা বলতে বলতে মিঠু, না কাঁদে নি, কিন্তু কাঁদলে বোধহয় ভালো ছিল - প্রায় পাগলের মতো করছিল, কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিল না। ততদিনে যদিও নিজে ওই দলীয় রাজনীতি থেকে সরে এসেছে , কিন্তু বিশুদা, এইখানে নাম ছিল সম্ভবত অজিত রায়, মিঠুর কাছে যে কতখানি ছিল! - এক অদ্ভুত কঠিন আর কোমল মন নিয়ে বেঁচেছিল মিঠূ।
কিন্তু এইভাবে এগোলে বোধহয় এ আখ্যান ক্রমেই বাড়তে থাকবে। আমি শুধু জানাতে চাইছিলাম মিঠুর বিচিত্র সব প্রবণতা আর প্রায় অবিশ্বাস্য সক্ষমতার কথা। একটা সময় বদরপুরে তৈরি হলো ‘ঝিনুক সাংস্কৃতিক সংস্থা’। যা হয়, রাজনীতিকে সহজে সবার কাছে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক সংগঠনের। কারা কারা সেদিন এই সংস্থা তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল, সেই নিয়ে একটা স্বাভাবিক বিতর্ক আছে বদরপুরে, শিলচরে। সেই বিতর্কে যাচ্ছি না, শুধু মিঠুর সঙ্গে ওর আবাল্যের আরেক নাটক পাগল বন্ধু রূপক রক্ষিত, সেই মেসের বিশ্বরূপ, কমলদা, আমিও আছি সঙ্গে, আরও অনেকে ছিলেন, এখন আর তাদের নাম মনে করতে পারি না। ‘শতাব্দীর পদাবলী’, ‘ডাইনোসেরাস’ – প্রথম পর্যায়ে এইগুলিই ছিল ঝিনুকের নাট্যচর্চায়। মিঠু যতবড় অভিনেতা তার চেয়েও বেশি হচ্ছে ওর নাটকের প্যাশন। সবকিছু বাদ দিয়ে কোনোকিছুতে ওর মতো লেগে পড়তে আমরা কেউ ছিলাম না মনে হয়। একসময় ‘ঝিনুক’ বলতে গেলে বদরপুরের সাংস্কৃতিক মুখ হয়ে উঠলো। আমি কোলকাতায় চলে আসার পর শুনতাম, ঝিনুক উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’, বাদল সরকারের ‘স্পার্টাকুস’ প্রযোজনা করছে। ‘স্পার্টাকুস’ করার সময় বদরপুর রেল কলোনির সাফাই কর্মীদের ছেলেদের নিয়ে এসে অভিনয় করানো হয়েছিল। পরে যখন বদরপুরে গিয়েছি, দেখতাম, ওদের সঙ্গে মিঠুর দেখা হলেই ওরা কেমন স্বজনের কাছে এসেছে বলে মনে হতো। এরপর ঝিনুকের যা কার্যকলাপ, সেসব শোনা, আমি তখন কোলকাতায় চলে এসেছি। তবে আমার প্রথম কোলকাতায় আসা কিন্তু মিঠুর বা মিঠুদের পরিবারের সঙ্গেই। মাসি চাকরির সুবাদে ফার্স্ট ক্লাস পাস পেতো। আর ফার্স্ট ক্লাস পাসের সঙ্গে একটা অ্যাটেন্ডেন্ট পাসও থাকতো। সেবার ওদের দিল্লি আগ্রা বেড়ানোর বাৎসরিক আয়োজনে আমাকেও নেওয়া হলো। অবশ্যই মিঠুর প্রস্তাবে। সেই প্রথম আমার আসামের বাইরে আসা। সেই বেড়ানোর মজার মজার সব ঘটনা পরে আমরা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি, কিন্তু ওঁরাই যে আমায় নিয়ে গেছেন, সেইটা যেন বলার মতো কথাই না। এমনকি, মেসো যে ওই রেল স্ট্রাইকে জেল খেটেছিলেন, মিঠু নিজে অ্যারেস্ট হয়েছিল, সেকথাও আমি জেনেছি অনেক অনেক পরে। দুয়েকজন বন্ধুর নিজেকে দেখানোর চেষ্টা, নিজেকে জাহির করার কথাতে আমাদের নিজেদের মধ্যে খুব হাসাহাসি করতাম। মিঠুর, বলা যায় মিঠুদের পারিবারিক এই যে অন্যকেও কাছে নেওয়ার ক্ষমতা, এ কেমন অবিশ্বাস্য। অনেক পরে, মিঠু পাপু মাসি মেসো তখন কোলকাতায়। বেলগাছিয়ার একটা এল আই জি কোয়ার্টারে ওরা সবাই। সেই কোয়ার্টারগুলো যে কী ছোটো ছোটো! এমন সময় বদরপুর থেকে একটু আগে পরে দুই ভাই এলো কোলকাতায়, একজন কাজের খোঁজে আর একজন চিত্রকর হবার বাসনায়। থাকবে কোথায়! কেন, মিঠুদের ওখানে। ছ’সাতজন লোক, ওইরকম ছোটো একটা শোবার আর একটা তার থেকেও ছোটো একটা বসার ঘর, দুজন লোক রান্নাঘরে দাঁড়াতে পারে না, একটা ছোট্টো বাথরুম – সানন্দে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। এ যেন চিন্তার বা জিজ্ঞাসারই কিছু নেই। মেসো মাসিও খুব সহজ স্বাভাবিক, ওরা তো থাকবেই! সেই কবেকার স্বপ্নের কমিউন জীবন যেন ওদের রক্তে। আমাদের প্রতিদিনকার স্বাভাবিক কিছু অভ্যাসের সামান্য এদিক সেদিক হলে একদু’দিন মানিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু দীর্ঘদিন মানিয়ে নেওয়া! অথচ মিঠু পাপু মাসি মেসোদের কাছে এ যেন কোনো বিষয়ই নয়।
একসময় শিলচর বদরপুর করিমগঞ্জে, গোটা কাছাড় জেলায় মিঠুকে কেন্দ্র করে যে চিন্তা-বৃত্ত গড়ে উঠেছিল, সে বিস্ময়কর। নিজের মেধা আর পরিশ্রমেই মিঠু সেটা গড়ে তুলতে পেরেছিল। মিঠু কবিতা আগেও লিখেছে কিন্তু এই পর্বে সেইটা যেন আস্তে আস্তে ওর প্রায় একটা স্বাভাবিক প্রকাশের মতোই হয়ে গেল। কাছাড়ের কৃতি সব মানুষেরা, কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারি, প্রাবন্ধিক সুজিত চৌধুরিসহ আরো অনেকের কাছে মিঠুর জন্য অবারিত দ্বার শুধু না, তাঁরা শিল্প-সংস্কৃতিগত আলোচনায় পার্থ-র মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। অন্য সব বন্ধুদের মতো গল্প উপন্যাস না লিখে, কবিতার রাজ্যে কোনো স্বাক্ষর না রেখেও সেই বদরপুরের শান্তনু হয়ে উঠলো মিঠুর ছায়াসঙ্গী। কাগজ বেরোচ্ছে, ছাপা হচ্ছে করিমগঞ্জে, শান্তনু মিঠুর সারাদিনের খাবার সস্তায় পেয়ে যাওয়া আনারস। হাসতে হাসতে মিঠু বলতো, খাইতে যে মিষ্টি রে বাই! – কিন্তু বাস্তব এটাই, ভাত খেয়ে ব্যয় করার মতো অর্থ সেদিন ওদের কাছে বিশেষ থাকতো না। ‘চিন্তা’ ‘প্রতিস্রোত’ পর পর সেই পরিশ্রমের ফসল। কাছাড়ের ইঁট ভাঁটা নিয়ে অনুসন্ধানমূলক প্রবন্ধ, শিলচরের সবচেয়ে বড়ো ব্যবসাকেন্দ্র ফাটকবাজারের হঠাৎ ‘দুর্ঘটনাজনিত কারণে আগুন লেগে’ পুড়ে যাওয়া নিয়ে একইরকম অনুসন্ধানমূলক সংখ্যাটি প্রশাসনের কাছে প্রবল অস্বস্তির হয়ে উঠেছিল। তখন মিঠুর চারপাশে সেই কমলদা, শুভঙ্কর, শান্তনু, পরম ভট্টাচার্যসহ আরও কেউ কেউ। ‘তখন ছিল আগুন খেলার দিন, তখন ছিল জলোৎসবের তোড়’। আসামের নৃশংসতম নেলীর গণহত্যা নিয়ে মিঠুর উদ্যোগে বেরোলো কবিতা সংকলন ‘ডেটলাইন আসাম’। না, কবিতা দিয়ে ধর্মান্ধদের ওই গণহত্যা ঠেকিয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু ওই পুস্তক প্রকাশকে কেন্দ্র করে গোটা বরাক উপত্যকার কবি সাহিত্যিকদের একটা বড়ো প্রতিবাদের জায়গায় নিয়ে আসা গিয়েছিল। একটা প্রতিবাদপত্র কতটা সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, তার একটা প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল সেইদিন।
প্রায় ওইসময়েই কোলকাতার সুপার এইট ফিল্ম মুভ্মেন্টের খবর মিঠুর কাছে পৌঁছয়। প্রায় অত্যাশ্চর্যভাবেই। একটা সস্তা কিন্তু বহুল প্রচারিত পাক্ষিক পত্রিকায় সৌমেনদা, সৌমেন গুহ-র একটা সাক্ষাৎকার বেরোয়। কোলকাতায় সৌমেন গুহ তখন প্রায় একক চেষ্টায় এই চিত্র-মাধ্যমটিকে সকলের কাছে নিয়ে যাবার কাজে অক্লান্ত। সত্তরের দশকে কুখ্যাত পুলিশ কর্তা রুণু গুহ নিয়োগির অকথ্য অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যাওয়া দিদি অর্চনা গুহ-র ধীরে ধীরে সেরে ওঠার পর্বগুলি সৌমেনদা ধরে রাখছিলেন ওই চিত্র-মাধ্যমে। তারপর কোলকাতায় আগ্রহী অনুজ কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে আরেকটু বড়ো পরিসরে সেই চেষ্টা চলছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সুপার এইটের উৎসব-প্রদর্শনী হলো। মিঠু চলে এলো আসাম থেকে। দেখা করলো সৌমেন গুহর সঙ্গে। কয়েকদিনের দীর্ঘ আলোচনার পর ঠিক হলো, কাছাড়ে ফিরে গিয়ে সেইখানে ছবি তৈরি করার চেষ্টা নেওয়া হবে। আসামে তখন বিদেশি বিতাড়নের ভয়াবহ পরিস্থিতি। মানুষকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা, তাদেরকে দেশের বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসার মর্মান্তিক কাজটি সুশাসনের নামেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন শাসকেরা। হাইলাকান্দির গল্পকার মলয়কান্তি দেব-এর গল্প ‘আসরাফ আলীর স্বদেশ’ - সেই বেদনারই চালচিত্র। মিঠু সিদ্ধান্ত নিল সেই গল্পটি নিয়েই সুপার এইট ফরম্যাটে ছবি করবে। সৌমেনদার সঙ্গে আলোচনা চললো। তৈরি হলো চিত্রনাট্য।
ছবি একটা হতেই পারে, সুপার এইটেই হতে পারে কিন্তু প্রধান যে দুটি বিষয়ের জন্য এই ছবি তৈরির আখ্যানটি বরাক উপত্যকায় একেবারে রিমারকেবল্ হয়ে থাকবে, সেটা হচ্ছে, এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য নেওয়া হলো শিলচর বদরপুর গ্রাম উধারবন্দের নাট্যশিল্পীদের। তাঁরা প্রায় কেউই আগে কখনো ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেননি। কিন্তু এর চেয়েও যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এবং যেটাকে ছবি তৈরির প্রধান বাধা বলে মনে হয়, সেটা হলো ছবি তৈরির জন্য অর্থ জোগাড় করা। একেবারে দর্শনগতভাবে সুপার এইট মুভমেন্ট চায়, এই কাজে বহু বহু মানুষের অংশগ্রহণ। যে বিষয় নিয়ে এই ছবি তৈরির উদ্যোগ, সেটা প্রধানত কাছাড় জেলার মানুষদের অস্ত্বিত্বের প্রশ্ন। তাদেরকে বেনাগরিক করে দেওয়ার একটা কুৎসিত অমানবিক প্রক্রিয়া। তাই কম বেশি গোটা জেলার মানুষকে এর সাথে যুক্ত করার একটা চেষ্টা নেওয়া হলো। ঠিক করা হলো, স্বল্প মূল্যের কুপন ছাপিয়ে সবার কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তৈরি হবে এই ছবি। সেই উদ্যোগটাই নেওয়া হলো। দেখা গেল, কাজ আর কাজের মানুষদের প্রতি আস্থা তৈরি করতে পারলে ফিরিয়ে দেন না মানুষেরা, দেননি সেদিনও। সম্ভব হয়েছিল সেই ছবি করা। আর শুধু অর্থ সাহায্যের মধ্য দিয়েই নয়, যখন আমাদের গ্রাম উধারবন্দ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে নদীর পাড়ের একটি গ্রাম বালিঘাটে ‘আসরাফ আলির স্বদেশ’-এর শ্যুটিং চলছে, তখন সেই গ্রামের মানুষজন কতোভাবেই না সাহায্য করেছেন! একটা ছবি কী করে সবার হয়ে ওঠে, সেইটা দেখা গেল তখন। তবে এই ছবির একটা বড় ভার নিয়েছিলেন সৌমেন গুহ স্বয়ং। মিঠু তার প্রবল আগ্রহ আর মেধার গভীরতায় সৌমেনদাকে বোঝাতে পেরেছিল, কাজটা কতো জেনুইন তার কাছে। জীবনের হাজারটা আক্রমণে আক্রান্ত হয়েও সৌমেনদার অফুরান প্রাণশক্তি বিস্মিত করেছিল সবাইকে। সেই অনুজ বন্ধু পার্থ-র টানে সৌমেনদা নিজের ক্যামেরা নিয়ে হাজির হলেন কাছাড়ে, ক্যামেরা চালাবেন তিনিই। মিঠুর আগে এইরকম প্রয়াস কাছাড় কেন, গোটা আসামে আর হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। হাজারটা বাধা, এইভাবে ছবি করার অনভিজ্ঞতা, এতোগুলো মানুষকে এক জায়গায় রেখে কাজ করার স্বাভাবিক সব সমস্যা – শান্তনু, শুভঙ্কর কমলদাসহ আরও অনেকে থাকলেও গোটা বিষয়টা মাথায় নিয়ে চলেছিল মিঠু। এবং আবারও বলা দরকার, এই কাজে মিঠুর পাশে পাশে সবসময় শরীর এবং মন – দুটো নিয়েই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলেন সৌমেনদা।
তৈরি হলো ছবি। দেখানো হলো কাছাড়ের বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু তখন সরকারের সব নিয়ম কানুন প্রবল হয়ে উঠলো – এতোজনের বেশি দর্শক হলে এই এই নিয়ম মেনে চলতে হবে। এই সবকিছুকে ফাঁকি দিয়ে নানা জায়গায় দেখানো হলো ছবিটি। পরে কোলকাতার ত্রিপুরা হিতসাধিনী হলে, এবং আর দুয়েকটা জায়গায় দেখান হয়। মানুষজন প্রবল প্রশংসা করেছেন ছবিটির। শুধু ছবি তৈরির কারিগরি দক্ষতা তো নয়, মিঠু যে বিষয়টি নির্বাচন করেছিল, সেটা দেশ কাল সম্পর্কে তার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিল সে। আর যে পদ্ধতিতে ছবিটি তৈরি হয়েছিল, সেটাই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। উত্তর কাছাড়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ ডিমাছা জনজাতিদের স্বপ্নের মানুষ সম্মুগমকে নিয়ে ওর ছবি, আশির দশকে আসাম সরকারের ভাষা সার্কুলারের প্রতিবাদে পুলিশের গুলিতে নিহত রামকৃষ্ণনগরে ছাত্র সাগর – দীপক–এর উপর তথ্যচিত্র, মিঠুর সেই শুরুর রাজনৈতিক দর্শন আর চর্চারই প্রতিফলন। বলা প্রয়োজন, মিঠুর বয়স তখন পঁচিশও পার হয়নি। অনেক পরে মিঠু লিখেছিল একটি পুস্তিকা ‘সহভাগী সিনেমা’ – সবাই মিলে, শুধু একজনের মেধা বা সক্ষমতা প্রকাশের জন্য নয়, সে তো থাকবেই, কিন্তু কীভাবে চলচ্চিত্রের মতো একটি মাধ্যমও সম্মিলিতভাবে গড়ে উঠতে পারে, আর সেটা কেনই বা একান্ত প্রয়োজন, লিখেছিল সেটাই।
একসময় কোলকাতায় চলে এলো মিঠু। এই পর্বটি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে। আমি তখন নিজের কাজে ব্যস্ত। কোলকাতায় গেলে, বা ও আমাদের এখানে এলে দেখা হতো। প্রায় কোনো আর্থিক স্থিরতাকে সঙ্গী না করেই ও চলে আসে কোলকাতায়। প্রথম কিছুদিন ও ওর ছোটোমাসি গীতা মৈত্র-র কাছে ছিল। ছোটোমেসো জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ছোটোভাই, সুধীন্দ্রনাথ মৈত্র, ভীষণ রাশভারি মানুষ, আবার একইসঙ্গে ছোটোদের মতো সহজ। যখন ‘নবজীবনের গান’ গাইছেন, বা ‘এসো মুক্ত করো’ শেখাচ্ছেন, যেন একেবারে এক অন্য মানুষ। পুরো শরীর দিয়ে যেন সেই গানের কথাগুলোকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাইছেন। কিন্তু মিঠূর ‘খ্যাপামি’ ছোটোমেসোর কাছে খুব একটা স্বীকৃতি পায়নি। আর কী করে কী করে যেন মিঠুর কাজকর্মও এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছোতো, সে অদ্ভুত! ছোটোমেসোর একটা প্রিয় ক্যাম্প খাট ছিল। মেসো অবসর সময়ে সেটাতে শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতেন। আমরা সেটাকে খুব মর্যাদা সহকারেই এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু সে তো মিঠু, সে অতসব মনে রাখবেই বা কেন! মেসো অফিসে। মিঠু একদিন কোথা থেকে এসে ছোটোমাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঝপাস্ করে সেই ক্যাম্পখাটেই গা ছেড়ে দিল, আর ব্যস্, পলকা হয়ে যাওয়া সেই খাট হঠাৎ ওইরকম ওজন মেনে নেবে কেন! সে-ও পপাত চ মমার চ! বিকেলে ছোটোমেসো আসার পর বাড়ির অবস্থা কী হবে সেই ভেবে ছোটোমাসির মুখটা তখন দেখার মতো! মেসোদের বাড়ির বাথরুমে সেই পুরোনো আমলের চেন ঝোলানো জলের ট্যাংক। চেন টানলে পাইপ দিয়ে জল নেমে এসে সব পরিষ্কার করে দেয়। মিঠু কী ভাবতে ভাবতে চেন ধরে এমন টান মেরেছে, জল পড়ছে তো পড়ছেই! ছোটোমাসি ভয়ে সারা, মিঠুর হাসি আর কমে না! অথচ মিঠুর ওই ছোটোমাসি বড়োমাসি, মীরা মৈত্র মেজ, সেই মাসিদের কাছে, রবিঠাকুরের ‘ছেলেটা’ কবিতার প্রসন্ন গয়লানির মতো অন্ধ স্নেহের প্রশ্রয় পেয়েছে বিস্তর। সবসময়। মিঠুর প্রথম ক্যামেরা ছোটোমাসিরই কিনে দেওয়া। ছোটোমেসোর নীরব সমর্থন ছাড়া সেটা সম্ভব হতো না। ওই বিরাট প্রাসাদের মতো বাড়িতে চিলে কোঠার যে ঘরে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের সব খাতা-পত্র বই ইত্যাদি ছিল, মিঠুর জায়গা হয়েছিল সেই বিখ্যাত ঘরটিতেই। কিন্তু একসময় নিজ বৈশিষ্টে্যই আবার কোলকাতার যাযাবর জীবন। এখানে ওখানে থেকেছে, পরিচয় হয়েছে বহু কৃতি মানুষের সঙ্গে। প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে ওর সান্ধ্য আড্ডা, নানারকম বন্ধুর সঙ্গে কথা-বার্তা তর্ক-বিতর্কে মিঠু নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিল, সম্ভ্রম আদায় করেছিল সবার। ঈর্ষা করার মতো ছিল ওর বন্ধু-বৃত্ত। একসময় সৌমেনদার সুবাদেই পরিচিত হওয়া দমদম সেন্ট্রাল জেলের কাছে থাকা বন্ধু কোরক ঘোষের বাড়িতে চলে আসে মিঠূ। এর আগে এমনও হয়েছে, নিজে থেকে তো কোনোদিনই কিছু বলেনি, পরে নানা কথায় হয়তো বেরিয়ে পড়েছে, কোনো কোনোদিন শিয়ালদা স্টেশনেও রাত কাটিয়েছে ও! কোন স্বপ্নের ঘোরে যে ও এই স্বেচ্ছা- কৃচ্ছসাধন নিয়েছিল! একসময় কোরকদের বাড়িটাই মিঠুর আবাস হয়ে উঠলো। কোরকের মা, মিষ্টি মা, তাঁর দুই ছেলের সঙ্গে মিঠুকেও খুব সহজেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কোনো ফারাকই বোঝা যেতো না যেন। একসময় বদরপুর থেকে চলে এলো পাপু। থাকার জায়গা ওই মিষ্টি মা-র কাছেই। যথেষ্ট ভালো ফুটবল প্লেয়ার ছিল পাপু, মিঠুর ইচ্ছে ছিল, পাপুরও, ময়দানেই নিজের জায়গা খুঁজে নেবে সে। ওরা তখন চলে গেছে আরেক জায়গায়, গল্ফ গ্রিনের কাছে, পাপুর খেলার সুবিধা, মিঠুও কাজের চেষ্টা করছে। মিঠুর ওই ছোটোবেলার অভ্যেস, যা ধরবে, তার একেবারে গোড়ায় গিয়ে জানবে, আর তারপর সেটা ছেড়ে দেবে। ক্যামেরার ক্ষেত্রেও তাই, কিন্তু ওইটা ভাগ্যিস ছাড়েনি। নিজের চাওয়া মতো ছবি বানাবে, আর বেঁচে থাকার জন্য লোকের বাড়ির অনুষ্ঠান ইত্যাদির ছবি তুলবে। গলফ্ গ্রিনে দাদাস্থানীয় বন্ধু দেবাশিস মৈত্রের বাড়িতে তখন আস্তানা, আর ছবি দিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন!
পাপুর ফুটবলটা হলো না, মাঠে দৌড়লেই পেটে একটা অসহ্য ব্যথা। আশ্চর্য মিঠু, পাপুকে সাহস জোগালো, কিচ্ছু চিন্তা করিস না, অন্তত ডিগ্রিটা পাশ করে নে, তারপর এই ক্যামেরার কাজেই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
- এর আগে মিঠু অভিনেতা দিলীপ রায়েদের ফিল্ম ইন্সটিউটে ভর্তি হয়েছিল। দুদিনেই সবাই বুঝতে পেরেছিল, খুব সাধারণ ছেলে তো নয়ই, প্রচুর সক্ষমতা নিয়ে এসেছে আসামের এই ছেলেটি। চললো পড়াশুনো। ওর পাঠক্রমের একেবারে শেষ পর্বে একটা ছবির চিত্রনাট্য জমা দিতে হয়। ও ‘হাকল্ বেরি ফিন’-কে নিয়ে তার চিত্রনাট্য তৈরি করবে বলে ঠিক করেছিল। প্রথমদিকের কিছুটা খসড়া ও ইনস্টিটিউটে দেখিয়েওছিল। কোর্সের একেবারে শেষ পর্বে সেটা। ক্লাসটাস শেষ, এইবার স্ক্রিপ্ট জমা দেওয়া। ওর লেখা আর শেষ হয় না, কারণ ও ততদিনে ওর স্বভাবমতো ওই কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। ও তো বুঝে গেছে, কীসে কী হয়! আমি নিজে দেখেছি, ওর ওই স্ক্রিপ্টের জন্য ইনস্টিটিউট থেকে বার বার ফোন করছে, মিঠু নির্বিকার। এমনকি, স্বয়ং দিলীপ রায় বোধহয় ওটা নিয়ে কিছু করবেন ভেবেছিলেন, কিম্বা মিঠুকে অন্য কোনো কাজে নেবেন, মিঠু আর গেলই না।
- আরে, স্ক্রিপ্টটা না দিলে তো ওরা সার্টিফিকেট দেবে না।
- ধোর ছাড়তো , বলে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। হয়ে গেল ওর পাঠ। এর বেশ পরের একটা ঘটনা। এখন যথেষ্ট বিখ্যাত হয়ে যাওয়া নাটকেরই এক খুব হিসেবি বুদ্ধিমান বন্ধু কয়েকটি পর্বের একটা টিভি প্রোগ্রাম করবে বলে মিঠুকে দিয়ে একটা চিত্রনাট্য লেখালো। প্রথমে চ্যানেল কর্তাদের কাছে একটা দুটো পর্ব নিয়ে যাবে, পছন্দ হলে গোটাটা স্যাংশন হবে। এসব আজকের বাংলা বাজারের টিভি সিরিয়াল শুরু হওয়ার অনেক আগের পর্ব। মিঠুকে দিয়ে দুটো পর্ব লিখিয়ে ওই বন্ধু গেছে ওখানে। মিঠুকে সঙ্গে নিয়েই গেছে। ওখানে পৌঁছে মিঠু বাইরের রিসেপ্শনে বসে থাকলো, সেই বন্ধু গেল ভেতরে। এইবার চ্যানেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত যিনি, তিনি স্ক্রিপ্টের দুটো এপিসোড পড়ে ওই বুদ্ধিমান বন্ধুকে বললেন,
- এটা আপনি লিখেছেন!
–বুদ্ধিমান বন্ধু এইবার একটূ ঘাবড়ে গিয়ে বললো, না, না, আমি না, যে লিখেছে, সে আমারই বন্ধু।
- সঙ্গে এসেছে! ডাকুন ওকে। আর আপনি একটু বাইরে অপেক্ষা করুন।
- কী বুঝে বন্ধু বাইরে গিয়ে মিঠুকে ভেতরে পাঠালো। এইবার চ্যানেলের ভদ্রলোক মিঠুকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি লিখেছেন!
– মিঠু বললো, হ্যাঁ, আমি।
- আরও সামান্যক্ষণ কথাবার্তা কথা বলার পর ভদ্রলোক বললেন, শুনুন, এটা আমি গ্রান্ট করে দেবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে। এটা আপনি স্ক্রিপ্ট করবেন, ডিরেকশনও আপনি দেবেন, উনি না।
- মিঠু তখন কী বলে!
–ঠিক আছে, ভেবে দেখি ইত্যাদি বলে চলে তো এলো। এইদিকে বেরিয়ে আসতেই বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, কী বললো লোকটা!
– মিঠু বললো, ওই, পরে জানাবে। তোমার ফোন নম্বর তো দেওয়া আছে।
- তখন তো এতো মোবাইল ফোন ছিল না, বন্ধুর যোগাযোগের নম্বর দেওয়া আছে সেখানে।
- মিঠু যখন আমাকে গল্পটা বলছে, তখন আমি বললাম, তারপর! ভদ্রলোক তোরে যাইতে কইলো, আর তুই গেলি না!
- মিঠু বলে, ধোর, অইসব আমার দ্বারা অইতো না।
- আমি বললাম, আর আমাদের ওই বন্ধু!
– মিঠু হো হো করে হেসে বললো, আমারে কই পাইবো! এই বাড়ির ল্যান্ড লাইন নম্বর তার কাছে দেওয়া আছে। দুই -তিনদিন ফোন করছিল। মিষ্টিমারে কইয়া দিছি, কও আমি খুব অসুস্থ, বদরপুর যাইমু গিয়া। কবে আইমু ঠিক নাই। ঠিক বুইঝা যাইবো, আমি আর ওই লাইনে নাই।
- মিঠু নিজে যে কোন লাইনে, তার খুব কাছে থেকেও আমাদের মতো মানুষেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। নাই। আর সেই বুদ্ধিমান বন্ধু এখনো কাজ করে চলেছেন, তবে থিয়েটারে, ফিল্মটা তার আর হলোনা!
মিঠুর কাকা কাকিমা, প্রশান্ত কুমার মৈত্র, জয়শ্রী মৈত্র মিঠুকে যে কী স্নেহ করতেন! কাকার স্নেহ বাইরে থেকে বোঝা যেতো না একেবারেই। একবার, তখন মিঠু নবাদর্শ কলোনীতে চলে গেছে, ওর জন্ডিস হয়। কাকা যে কীভাবে মিঠুকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন! কিন্তু মিঠুর ওই এক চিন্তা, আমার চলা তো সহজ না, তাদেরকে আবার ব্যতিব্যস্ত করা! যায়নি মিঠু। কাকা এই কষ্টটা কোনোদিন ভুলতে পারেননি। ভাবতেন, মিঠু যদি আসতো, ঠিকঠাক পথ্য চিকিৎসা পেতো, তাহলে ওর শরীরটা এতো সহজে ভেঙে যেতো না!
– কিন্তু সে তো মিঠু! কাকিমা মিঠুর শুধু অভিভাবক না, খুব কাছের আশ্রয়ও ছিল। কাকিমা গান গাইতো খুব ভালো, মিঠুর লেখা গানও সুর করে গেয়েছেন কাকিমা! আএ মাঝে মাঝে আক্ষেপ করতেন, মিঠু যদি একটু স্থির হতো..! মিঠু চলে এসেছিল একসময় বিরাটি নবাদর্শ কলোনিতে। সাংবাদিক বন্ধু সুদীপের সঙ্গে একই বাড়িতে। তখন ও কালিঘাটে একটা চ্যানেলে এডিটিং-এর কাজ করে। সবে প্রাইভেট চ্যানেলগুলো বাজারে আসছে। মিঠুর দিনলিপি তখন এইরকম। চ্যানেল থেকে ফেরে এই রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ। এসেই ঘুমিয়ে পড়ে। সুদীপ পত্রিকা অফিস থেকে ফেরে রাত সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ। এসে চা করে। মিঠুকে ডেকে তোলে। দুজনে চা খায় আর তার সঙ্গে চলে সারাদিনের জমে থাকা যত গল্পগুজব। এইবার সাড়ে বারোটায় সুদীপ রান্না চাপায়, মিঠু আবার ঘুমোয়। রাত দুটো আড়াইটে নাগাদ মিঠুকে ডেকে তুলে ওদের রাতের খাওয়া সারা হয়। তারপর আরেকপ্রস্থ আড্ডা। ওদের ঘুমোতে ঘুমোতে এই তিনটে সাড়ে তিনটে। সুদীপ প্রায় বেলা বারোটা অব্দি ঘুমোয়। মিঠু ততোক্ষণে বেরিয়ে গেছে। ওর দশটার মধ্যে ওর এডিটিং রুমে ঢুকে যেতে হবে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, তোর ঘুম পায় না!
– মিঠু বলে, শুন, আমি আমার ঘরো ঢুইক্যা আগেই বাইরের লাল আলোটা জ্বালাই দেই। তারপরে ঘরের মইধ্যে বেজান পত্রিকা আইন্যা রাখছি। ইটাইন দিয়া মেঝের উপরে বাক্কা মুটা একটা বিছনা করি। তারপরে টানাইয়া ঘুম। এইরকম ‘ঘন্টা দুইতিন’ জিরাইয়া বাইরে যাই। কালিঘাটে একটা দারুণ হোটেল আছে। মাটিত বয়াইয়া খাওয়ায়। ওই হোটেলের হেড ঠাকুরের লগে আমার হেভি দোস্তি। আমার লিগ্যা মাছের মাথাউথা রাখি দেয়। জমাইয়া খাই। তারপরে ফিরা আইয়া কাজো বই।’
আর ওই দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাজ করেই মিঠু যে কোয়ালিটি তৈরি করতো, তাতে চ্যানেল থেকে কোনোদিন ওর এই অপূর্ব কাজের পদ্ধতি নিয়ে কোনোদিন কোনো কমপ্লেইন আসেনি। বরং তার যখন প্রমোশন হবে প্রায় সব ঠিক, কাজ ছেড়ে দিল মিঠূ। সে পার্থপ্রতিম মৈত্র, সহজ স্বাচ্ছন্দে ওর তীব্র অস্বস্তি।
এরপর আবার অনিশ্চয়তা। কিন্তু টুকটাক কাজ কিছু পাচ্ছিল। চলে যাচ্ছিল কোনোমতে। আর ততদিনে ‘কালধ্বনি’ পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে ওর। বন্ধু তাপস দাসের ভাষায়, একজনকে প্রায় রোজই দেখতাম কালধ্বনি পত্রিকার অফিসে এসে ঘুমোয়। আর মাথার কাছে একটা বড় ব্যাগ। পরে দেখেছি, ওই ব্যাগেই ছিল ওর ক্যামেরা ইত্যাদি, ওর স্বপ্ন তৈরির আয়ুধ।
- কবিতা মিঠু আগেও লিখতো, কিন্তু এইবার যেন কবিতাকেই ও তার সঙ্গী করে নিল। ফেলে আসা কুশিয়ারা বরাকের স্মৃতি, আজীবন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা বলে ভাবা বদরপুর উঠে এলো সার বাঁধা শব্দ হয়ে। ও যে কবিতা লেখে, কোনোদিন কাউকে মুখ ফুটে বলা তো দূরের কথা, যখন উঠতি কবিরা নিজেদের কবিতা নিয়ে তড়পাচ্ছে, মিঠু নির্বিকার। খুব পরিচিত বৃত্ত ছাড়া মিঠু শুধু শ্রোতার ভূমিকায়। মিঠু তখন কিছুদিন পি-ইউ-সি-এল–এর সঙ্গে সিভিল রাইটস্ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। কালধ্বনি-র প্রশান্তদা, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নাটককার জ্যোৎস্নাময় ঘোষ এবং আরও সবাই এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সেইবার সম্ভবত নর্থ বেঙ্গলে, শিলিগুড়ি না জলপাইগুড়ি-তে সংগঠনের সম্মেলন। মিঠু-ও গেছে। ফিরে এসে খুব উত্তেজিত।
- তুই ভাবতে পারতস না, কার কার লগে মিছিলের সামনে ব্যানার ধইরা আমি!
– অনেক মানবাধিকার কর্মী, যাঁরা গোটা দেশে বিখ্যাত তাঁদের কাজের জন্য, আন্দোলনের জন্য, তাঁদের সঙ্গে মিঠু একসাথে! ওর গলায় সেই কলেজ জীবনের রাজনীতি করার উত্তেজনা! ফিরে এসে আবার ওর নানা কাজ, আবার কোনো কাজই নির্দিষ্ট না।
এইসময়কারই আরেকটি ঘটনা। মিঠু তখন নবাদর্শতে। এর আগে ‘কালধ্বনি’-তে সম্ভবত ‘বিশৃঙ্খলার অধিকার’ শিরোনামে ‘অর্ডার আউট অব ক্যাওস’ বিষয়ক মিঠুর একটা বড় প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। সেটা নব্বইয়ের দশকের প্রায় গোড়ার দিক। ওইসময়ে ওই বিষয়ে প্রথমত বাংলায় লেখাপত্র খুব কম, আর তার উপর মিঠুর এমন অনবদ্য বিশ্লেষণ। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত পড়েছিলেন সেই প্রবন্ধ। খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। আমি তখন নান্দীকারে। স্যার আমাকেই প্রশংসা করে বললেন, ‘অ্যা ম্যান ইজ নোন বাই হিজ্ ফ্রেন্ডস’।
- হায়রে, স্যার যদি জানতেন, আমি নিজে ওই লেখাটার প্রায় অনেকটাই বুঝিনি। অথচ ফিজিক্স ম্যাথমেটিক্সে অনায়াস দক্ষতা দিয়ে মিঠু এই বিষয়গুলো সহজেই আয়ত্ব করতে পেরেছিল। সেইসময় নান্দীকার ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ‘ইন সার্চ অব চিল্ড্রেন্স থিয়েটার’ প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিল। স্যারের তত্ত্বাবধানে ক্যলকাটা রেস্কিউ, পাতিপুকুর নিবেদিতা কলোনি, আর লেক টাউনের আদ্যনাথ হাইস্কুল – এই তিনটি জায়গায় চলছিল সেই কাজ। প্রশান্তদা সেই কাজের কো-অর্ডিনেটর। তো এক না দেড় বছরের মাথায় বাইরে থেকে সাহেবরা আসবেন, কাজ কী কী হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে এসব দেখতে। ফলে এইসব কাজের একটা ভিডিও রেকর্ডিং দরকার, যেটা ওরা প্রথমে দেখবেন।
- সেইটা এডিটিং-এর দায়িত্ব দেওয়া হলো মিঠুকে। প্রশান্তদা, কালধ্বনি-র, তিনিই সম্ভবত এই এডিটিং বিষয়ক বৃত্তান্তটা স্যারকে বলেছিলেন। যাই হোক, সেইসব কাজ চলছে। একদিন নান্দীকারে স্যার বললেন, কাল চারটে নাগাদ কলেজে আসতে পারবে (মানে স্যারের বিকেসি কলেজে, স্যার তখনও রিটায়ার করেননি)। একবার তোমার বন্ধুর ওখানে যাবো।
- আমি অবাক, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত যাবেন বিরাটি নবাদর্শতে, মিঠুর কাছে! আর মিঠু যে কাজটা করছে, তখন জানতামই না।
- হ্যাঁ, যাবো।
-পরেরদিন আমি আর নান্দীকারের পার্থ, (পার্থপ্রতিম দেব)একটা ট্যাক্সি নিয়ে প্রথমে গেলাম কলেজে, সেখান থেকে নবাদর্শ। পার্থ পথে কী একটা কাজে নেমে গেল। যেতে যেতে স্যার সবকিছু জানিয়ে বললেন, তোমার বন্ধু আজকে ওই ভিডিওটা দেবে।
- শুনে খুব ভালো লাগলো, মিঠু কাজটা করছে, আর আজই সেটা দেবে। কিন্তু পরবর্তী বিষয়টা যে এইদিকে যাবে, সেটা একেবারেই আমার ভাবনার বাইরে ছিল। অবশ্য আমারই অক্ষমতা। মিঠুর সঙ্গে এতদিনের চেনাজানা সত্ত্বেও...।
যাক্গে, গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকলাম। ভয় ছিল, ঘরটা কীভাবে থাকবে! মিঠু তো! কলেজ জীবনে মেসে আমরা তো নিজেরাই রান্নাবান্না করতাম, কিন্তু মিঠু জীবনে না। আর হয়তো রান্না করার কেউ নেই, আমরা কলেজে, বা অন্য কোনো কাজে বাইরে, মিঠু খিদে এড়ানোর জন্য সোজা ঘুমিয়ে পড়তো। আর মশা কামড়াবে বলে মশারি টাঙাবার পরিশ্রমও করতো না। মশারিটা দিয়ে আপাদমস্তক জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। সেই মিঠু, ফলে দুশ্চিন্তা। যাইহোক, ঢুকে দেখলাম বাইরের ঘরে, যেখানে ও কম্পিউটারে কাজ করছে, তার পেছনের চৌকিটা একটা নতুন চাদরে ঢাকা। বুঝলাম, একটু উন্নতি হয়েছে। এইবার স্যার ঢুকলেন, ঢুকে বললেন, কী পার্থ, কমপ্লিট!
-মিঠু ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে হেসে যেন খুবই লজ্জা পেয়ে বললো, না, স্যার, একটু বাকি!
– একটু মানে কতোটা!
– মিঠুর আবার সেই হাসি এবং লজ্জা, তারপর বললো, কাল বিকেল নাগাদ হয়ে যাবে স্যার!
– আমার তো ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা! স্যার কী বুঝলেন কে জানে। নির্বিকার গলায় বললেন, বেশ।
- ঠিকাছে, তুমি তোমার কাজ করো। তারপর যেটা করলেন সেইটা ভাবার বাইরে। এর আগে জেনে নিয়েছেন, এখানে কে কে থাকে ইত্যাদি। তারপর বললেন, তুমি কাজ করো, আমি ভেতরের ঘরে একটু ঘুমিয়ে নিই।
- বলে সুদীপের সেই ছ্যাত্রানো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। স্যারের এই যেখানে সেখানে মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ার অনেক কিংবদন্তিসম গল্প আছে। স্যার তো ঘুমিয়ে পড়লেন, আমি নিচু গলায় মিঠুকে বললাম, আজকে দেওয়ার কথা, তুই শেষ করলে না!
– মিঠুর সেই উত্তর, না বে, অইছে না!
– আরে, অইছে না যে ইটা তো আমিও জানি। অইছে না কেনে!
– কোনো উত্তর না দিয়ে একটা দীর্ঘ নীরবতা নিয়ে একমনে কম্পিউটারে কাজ করে যায় মিঠু। যেন কতো মনোযোগ! সেই কলেজের ক্লাসে এসে প্র্যাক্টিক্যালের ছবি আঁকার মতো। বুঝলাম, ওর প্রকৃতিটা প্রায় কিছুই বদলায়নি। হয়তো বদলালেই অবাক হতাম।
- যাইহোক, ঘণ্টাখানেক পরে স্যার ঘুম থেকে উঠলেন, তারপর যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে বললেন, নাও, একটু চা খাওয়াও।
- চা আমাকেই করতে হলো। মিঠু তো জানেই না, কোথায় চা কোথায় চিনি! চা খেয়ে স্যার বললেন, ঠিক আছে পার্থ, চলি। তুমি একটু তাড়াতাড়ি করে দিও। চলো তীর্থ।
- সন্ধেবেলায় নান্দীকারে রিহার্সাল। আমি ভাবছি, যে স্যারকে প্রায় বাঘের মতো ভয় পাই, বলে দেওয়া কোনো কাজ করতে পারবো না, ভাবতেই পারতাম না সেই কথা, মিঠু কাজটা নিয়ে কেমন নির্বিকারভাবে বলে দিল, হয়নি!
- আর স্যারও কিছু না বলে ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিয়ে চলে এলেন!
–এর উত্তর পেয়েছিলাম পরে। এর কদিন পরই ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাহেবরা এসেছেন তাজ বেঙ্গলে। সকাল সম্ভবত নটাতেই আমাদের পৌঁছোতে হবে। এরমধ্যে মিঠু ওটা দিয়েছে শুনেছি। স্যারের সঙ্গে গেছি আমি। একটা মাঝারি মাপের ঘরে সাহেবরা এলেন, আমরাও। হোটেল থেকে একটা ভিডিও প্লেয়ার দিয়ে গেল। সামান্য কথাবার্তার পরে হোটেলের লোকই চালিয়ে দিল ওই ভিডিও। আমি প্রথম দেখছি। স্যারের কমেট্রির সঙ্গে যাচ্ছে ছবি। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, মিঠু এমন অসামান্য কাজ করলো কী করে! আমাদেরই কাজ করার নানা জায়গা। ছবির পর ছবি, কাজের পর কাজ সাজিয়ে কী যে অসামান্য তার প্রেজেন্টেশন! শেষ শটটা এখনো মনে আছে। বন্ধু শুভাশিস গাঙ্গুলি কাজ করাতো ক্যালকাটা রেসকিউতে। সেখানকার শিশু অভিনেত্রী নাজমা ওই শেষ শটে গোটা স্ক্রিন জুড়ে, চোখ ভর্তি টলটল করছে জল, গড়িয়ে পড়ছে না, যেন এই পড়বে, অসহায় ভাবে তাকানো। আর সঙ্গে, এই সমস্ত শিশুরাই আমাদের অপেক্ষায়, আমরা ওদের কাছে আরো বেশি বেশি করে পৌঁছতে চাই, এইরকম কী একটা বলা ছিল। ওইদিন চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি আমি। এমনকি, স্যারও। ওই সাহেবরাও আবেগে ভেসে গিয়েছিল। আর সেদিন বুঝেছিলাম, রুদ্রবাবু কেন কিছু না বলে সেদিন নবাদর্শ থেকে চলে এসেছিলেন। মিঠুর শিল্পীসত্তা উনি বুঝেছিলেন, আর ওইজন্যে জানতেন, ওকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। সে আপন আনন্দে যা সৃষ্টি করবে সেটা অনবদ্য!
অথচ সেই মিঠুর ভেতরেই ছিল আরেকটা ছোট্টো মিঠু, ছেলেমানুষের মতো। মিঠু কলেজ পাশ করলো পাসে, তারপর বি এড করলো। এই গল্পটা না বললে মিঠূর ছেলেমানুষির সেই মনটা বোঝানো যাবে না। প্র্যাক্টিস টিচিং পড়েছে একটি স্কুলে। ওর পড়ানোর বিষয় বস্তু, ওজন সম্পর্কে ছোটোছোটো ছেলেদের সম্যক জ্ঞান দেওয়া। ও পরিমাপ যন্ত্র আর কিছু চিনি নিয়ে গেছে। ওই চিনি ওজন করে হাতে কলমে সেটা সে শেখাবে। প্র্যাক্টিস টিচিঙের সময় থেকেই ছাত্ররা ওর প্রাণের বন্ধু। যেদিন প্র্যাক্টিস টিচিং, সেদিনও গল্পগুজব চলছে,আর ছাত্রদের বলে দিয়েছিল, যখনই দূর থেকে এক্সটারনালকে আসতে দেখা যাবে, তখনই যেন ওরা মিঠুকে সতর্ক করে দেয়। তখন একটু সিরিয়াস। ছাত্ররাই মিঠুকে বুদ্ধি দিয়েছিল, স্যার, আমরা বালা ছাত্ররারে স্যার ছড়াইয়া ছিটাইয়া বয়াই দেইন। এরা স্যার পিছন দিক থিক্যা প্রশ্ন ধরে।
- সব অভিজ্ঞ ছাত্রসমাজ। যাইহোক, এইবার বারান্দার ওই ধারে হেডস্যারের ঘর থেকে যেই এক্সটারন্যালকে আসতে দেখা গেল, ওমনি সব ছাত্র একেবারে নিচু স্কেল থেকে ‘আইছে – আইছে – আইছে’, বলতে বলতে ক্রমশ স্কেল বাড়াতে শুরু করলো। যেন একটা সাসপেন্স তৈরি করা করছে। মিঠু বলছে, ‘আমি ইতারে থামাইতে পারি না রে বাই’। শেষে এক্সটারন্যাল যেই একেবারে ঘরের দরজার সামনে, ওমনি সেই সমস্বর একেবারে উচ্চগ্রামে গিয়ে ‘আইছে’ বলে এইবার ঘর পুরো নিস্তব্ধ। এক্সটারন্যালও অবাক! যাই হোক, ক্লাস নেওয়া তো হলো। এক্সটারন্যাল দেখলেন, দুয়েকটা প্রশ্নও করলেন। চলেও গেলেন, যেমন যান। ক্লাস শেষ। কিন্তু ওই চিনি কী হবে! মিঠু এইবার সেই চিনি সব ছাত্রদের মধ্যে একটু একটু করে ভাগ করে দিয়েছে। নিজের মুখেও বেশ কিছু পরিমাণ দিয়েছে। এইবার হঠাৎ ওই এক্সটারন্যাল কী একটা কাজে আবার ক্লাসে ফিরে এসেছেন। মিঠু বলে, চিন্তা কর, আমার মুখ ভর্তি চিনি, কেমনে কথার উত্তর দিতাম রে ভাই!
– এই হচ্ছে মিঠু। কিন্তু বি এড পাশ করেও ওই শিক্ষাজগতের দিকে ও আর গেলই না।
তারপর হঠাৎ কি মনে হলো, পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফে কাজ করবে বলে একটা ট্রেনিং নিতে চলে গেল দ্বারভাঙা। এতকিছুর পরে পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফের সিদ্ধান্ত! কিন্তু সে তো মিঠু! চলে গেল দ্বারভাঙা। আর যা হয়, সেখানেও ডিপার্টমেন্টের নানান গাফিলতি অন্যায় অবিচার নিয়ে সরব সে। সঙ্গে কোলকাতা থেকে যাওয়া ওর নতুন বন্ধুরা, দেবদূত, রবিজ্যোতি, ও আরও কয়েকজন। এইরকম আন্দোলন ওইখানে ওই ডিপার্টমেন্টে কেউ আগে কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। মিঠুদের বিরুদ্ধেও ড্রাস্টিক স্টেপ নেওয়া হতো, কিন্তু ততদিনে মিঠুর জনপ্রিয়তায় কিছুটা পিছু হটেছিল ম্যানেজমেন্ট। আর জনপ্রিয়তা শুধু ছাত্রবন্ধুদের মধ্যেই নয়, টিচাররাও ওর মেধা বিনয় তো বটেই, টেবিল টেনিস বোর্ডেও ওর অসামান্য দক্ষতা, ওর পক্ষেই কাজ করেছিল। ট্রেনিং শেষে ফিরে আসার সময় ছাত্ররা তো বটেই, টিচাররাও না কি মিঠুর জন্য চোখের জল ফেলেছিলেন। দেবদূতের কাছেই শোনা। রবি-র সঙ্গে আমার সরাসরি কোনোদিন কথা হয়নি। মিঠুর স্মরণসভায় রবিজ্যোতি নিজেও দ্বারভাঙায় মিঠূর ওইরকম জনপ্রিয়তার কথা বলেছিল। আশচর্য, অনেকদিন আগে মিঠুর লেখা একটা গল্পের নায়ক ছিল একজন ফুটবল প্লেয়ার, নাম রবি! সেই ডায়েরির পাতাটা এখনো স্পষ্ট আমার চোখে। একটা ছবিও এঁকেছিল মিঠু, গোলপোস্টের সামনে রবি যেন ঝাঁপিয়ে বলটা ধরতে যাচ্ছে। আমাদের শিলচরে, আশেপাশের মাঠে ফুটবল খেলার মাঠে প্রায় সব ম্যাচেই মিঠু আমার সঙ্গে গেছে। একবার বর্ষায় আমাদের ওখানে বড়জোরাই বলে একটা জায়গায় খেলা শেষে ফেরার সময় মাঝ নদীতে ছোটো ডিঙ্গি নৌকো প্রায় ডোবে ডোবে। কীভাবে যে ওপারে গিয়েছিলাম! মিঠু ছিল সেইদিনও। সাঁতারও জানতো না। মানুষ চলে গেলে কতো গল্প হারিয়ে যায়!
মাঝে কোলকাতার বেশ কয়েক বছর আমার সঙ্গেও শুধু আনুষ্ঠানিক দেখা। নানা কারণে আমার কিছুটা অভিমান থেকেই নিজেকে দূরে সরানো। কিন্তু তখন মিঠুর বন্ধুবৃত্তে বহু সক্ষম কৃতি মানুষজন। বহরমপুরের কৌশিক রায়চৌধুরি, এই কোলকাতাও জানে কৌশিকের সেই উজ্জ্বল আখ্যান- খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল মিঠু। এমনকি, কৌশিকের সেইসব প্রবল দুর্যোগের দিনে কৌশিকের মা মিঠুকেই ওর দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে মাঝে মাঝেই ফোন করতেন। কিন্তু একজন চাঁদের ঘোর লাগা মানুষ আরেকজনকে ধরে রাখবে কী করে!
ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বিয়ের পরেও বেশ কিছুদিন অনিশ্চিত জীবন কাটানোর পর সেই পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফের ট্রেনিঙের বন্ধু রবি, সে এখন বেশ হোমড়া-চোমড়া অফিসার, রবি মিঠুকে একটা কাজের খোঁজ দিল। বা বলা যায়, জোর করলো ওদের সাথে জুড়তে। রবি জানতো, কোনো ছাপ্পা দেওয়া শংসাপত্র না থাকলেও ওদের ওই কাজকে সবচেয়ে বেশি সফল করে তুলতে পারবে পার্থই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এস আর ডি সেল, পঞ্চায়েত অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, যা পরে হয়েছিল স্টারপার্ড, সেখানে যোগ দিল মিঠু অডিও ভিসুয়াল প্রোগ্রাম কন্সালটেন্ট হিসাবে। এইটাই দীর্ঘদিন লেগে থাকা মিঠুর একমাত্র কাজ। এই কাজটা সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানতাম না। ওর স্মরণসভায় গিয়ে রবিজ্যোতি আর ওদের বিভাগের প্রধানের মুখে ওর কাজের পরিধি আর দক্ষতা শুনে মনে হচ্ছিল, মিঠুর পক্ষেই সম্ভব এই বিভাগটাকে গোটা ভারতবর্ষের মানচিত্রে এমন উজ্জ্বল জায়গায় নিয়ে যাওয়া। প্রধান বলছিলেন, এই বিভাগের শুধু নান্দনিক দিকটা না, গোটা কাজের টেকনিক্যাল দিকগুলোতেও মিঠু এমন দক্ষ ছিল, ওনার সঙ্গে বার কতক বাইরের রাজ্যে গিয়েও সেইখানকার পঞ্চায়েত বিভাগকে সেই টেকনোলজি বুঝিয়ে শিখিয়ে এসেছে। গোটা ডিপার্টমেন্ট ওর কাজের সক্ষমতাকে যেমন নানাভাবে ব্যবহার করেছে, তেমনি স্বীকৃতিটা শুধু এই রাজ্যের না, এসেছে দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে। সেইদিন সেই স্মরণসভায় মিঠুর কাজের জায়গার মানুষেরা, যাঁদের কেউ কেউ অন্য বিভাগে চলে গিয়েছেন, রিটায়ার করেছেন তাঁরাও এসেছিলেন ওই পাগল জিনিয়াসকে নিজেদের শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা জানাতে। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, আজ জি সি কলেজের ফিজিক্সের মাস্টারমশাই শৈলেশ সিনহা কিম্বা কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারিও বেঁচে থাকলে, করিমগঞ্জের সুজিত চৌধুরি কিম্বা চলে যাওয়া বিশুদা – সবার সবটুকু আবেগ ভালোবাসা ওই বিস্ময় বালকের মাথাতেই ঝরে পড়তো!
অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত মিঠুর এইকাজে লেগে থাকার একটা কারণ হিসাবে ভেবেছি, পুত্র বিহানের পড়াশুনোশুদ্ধু সবটাই শিক্ষিকা স্ত্রী ইন্দ্রাণীর উপর যে অনেকটা চাপ তৈরি করছিল, সেটা বুঝতে পারছিল। একটা সময় চলে গেলেন মাসি মেসো। বেলগাছিয়াতেই এখন ভাই বোনসহ সবার আলাদা আলাদা আস্তানা, ফ্ল্যাট, কিন্তু সবাই মিঠুর কাছেই। সবার মধ্যে থাকলেও মিঠু এক আশ্চর্য উপায়ে নিজের মনটাকে সবসময় ওই মেঘের সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে রাখতো, এই দুনিয়ার বহু কিছু নিয়ে আমরা যখন বিচলিত, চোখ বন্ধ করে কোনো নিরাপত্তার পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছি, মিঠু অবলীলায় সেই নিরাপত্তার সুখকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কোনো স্থায়িত্ব এসে গেলে মিঠু যেন সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াতেই একটা আনন্দ পেতো, সার্থকতা যেন অন্য কোনোখানে! কিন্তু এই জীবন তার শরীরকে আস্তে আস্তে পেছন দিকে টানতে শুরু করেছে, ও বুঝতে পারেনি। হিসেবি মানুষেরা হয়তো পারে, কিন্তু মিঠুর কাছে সেটা প্রত্যাশা করাটাও বিস্ময়কর!
দু’হাজার পাঁচ সাত সাল থেকে ওর শরীরটা খারাপ হতে শুরু করে। লিভারের সমস্যাটাই আস্তে আস্তে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। কখনো ভালো, পুরো সুস্থ হয়তো না, কিন্তু বেশ কাজকর্ম করছে, আবার কিছুদিন পর আবার অসুস্থ। নানান হাসপাতাল ইত্যাদি। একসময় আরও দুয়েকটা অরগ্যান ফেল করতে শুরু করে। ওর যে মস্তিষ্ক নিয়ে আমাদের গর্ব, একসময় সেইটাই আর সাথ দিচ্ছিল না। অংকের হিসাবে, খারাপ ভালো মিলিয়ে সেই পাঁচ থেকে পঁচিশ, প্রায় কুড়ি বছরের একটু বেশিই ভুগলো মিঠু। এরমধ্যেই বেশ কিছু কবিতার বই বেরিয়েছে, অনবদ্য সেইসব কবিতা, কিছু কিছু লাইন ফিরতো কাছাড় আর কোলকাতার কবি বন্ধুদের মুখে মুখে। তার কবিতার মূল্যায়ন আমার পক্ষে সম্ভব না, কিন্তু পরিচিত কবি বন্ধুদের চোখে মুখে দেখেছি কবি পার্থপ্রতিম মৈত্র সম্পর্কে তাঁদের সম্ভ্রম আর প্রিয়তার ছবি। যখন তার লেখাগুলি সংকলিত হয়ে বার হবে, আমরা দেখতে পাবো, ওই রোগের তীব্র হয়ে ওঠার ফাঁকগুলোতেই কী ফলবান সব লেখা লিখে গেছে মিঠু। কিন্তু একসময় শরীর আরও বেশি বেশি করে ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করলো, আর ক্রমশ দ্রুততর হতে শুরু করলো তার আক্রমণ। শেষ অবস্থায় মনে হচ্ছিল, ওর চলে যাওয়াই ভালো। পার্থপ্রতিম মৈত্রের ওইরকম স্মৃতি হারিয়ে ফেলা, কথা বলার সময় শব্দ খুঁজে না পাওয়া, বন্ধুদের দেখলে এক অবোধ চাউনিতে তাকিয়ে থাকা, সহ্য করা যাচ্ছিল না। আসাম বা অন্য জায়গার দূরের বন্ধুরা প্রতিদিন ওর খবরাখবর নিচ্ছিলেন, এই ব্যয়বহুল চিকিৎসায় আর্থিক সাহায্যের জন্য একটা গ্রুপ তৈরি করা হলো, বোঝা যাচ্ছিল, সবার কাছে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে মিঠু/পার্থ। কিন্তু একটা সময় চলে যেতে হলো তাকে। যেন ‘ও সুরমা ও কুশিয়ারা যাচ্ছি’, যেন ‘ও বড়াইল ও বদরপুর যাচ্ছি’ বলতে বলতে চলে গেল সে! একটা পর্ব শেষ হলো। শুধু পোশাকি ভাষার উচ্চারণে না, আমরা সত্যিই একজন জিনিয়াসকে চলে যেতে দেখলাম। আমরা আমাদের জীবনের এইসময়টুকুর জন্যে যে ওর পাশে পাশে থাকতে পেরেছিলাম, সেই গর্ব আমাদের আজীবন থাকবে, অন্তত এরপরেও যতদিন বেঁচে থাকবো আমরা।
একজন মানুষ চলে গেলে, হারিয়ে যায় অসংখ্য গল্প কাহিনী! এইখানেও বাকি রয়ে গেল কতো! চেষ্টা নেওয়া যাক মিঠুর সেই বিরাট অনুভূতিপ্রবণ প্রেমিক-মনের কিছু কথা বলার। আমি এখনও ভাবি, যখন আমাদের প্রথম চেনাজানা, সেই প্রি-ইউনিভারসিটির ক্লাস থেকে এবং এর পরেও, বি এসসি পড়াকালীন মেসে থাকার প্রায় দুই বছর, আমাদের মধ্যে কোনোদিন মেয়েদের সম্পর্কে কোনো আলোচনা হয়নি। এটা এখন কেমন বিস্ময়ের মতো মনে হয়। কিন্তু তখন কি কাউকে ভালো লাগেনি আমাদের! অন্য আলোচনা তো নয়ই, সেই ভালোলাগার গল্পও তো করিনি কখনো! অথচ জেনেছিলাম অন্যভাবে, হয়তো জানানোর জন্যই ওর ডায়েরি আমাকে পড়তে দিত। পড়ার কথা বলেনি কোনোদিন, কিন্তু এমনভাবে ফেলে রেখে যেতো, বুঝতাম, আমি যেন জানি, সেটাই চাইতো ও। কথায় বললে যেন কবিতার মতোই সেই গহনতা, সেই রহস্যময়তা হারিয়ে যাবে- সেজন্যে লিখে রাখতো তার ডায়েরিতে! ক্লাস নাইন টেনেই মিঠু যাঁর প্রতি দুর্বল ছিল, তিনি মিঠুর থেকে বেশ বড়ো। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মিঠুদের মৈত্র পরিবার বদরপুরের বিশাল রেল কলোনিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। ওই মহিলাটিও সেইসব সাংস্কৃতিক আসরে উপস্থিত হতেন। ভালোলাগা সেইখানেই। মিঠু নিজে ছোটোবেলা থেকেই খুব ভালো আবৃত্তি করতো। বদরপুরে তো বটেই, শিলচরে এসে কিছুটা কমে যায়, মানে অনুষ্ঠানে পরিবেশনের কথা বলছি। তবু একবার আমাদের জি সি কলেজ থেকে কাছাড় কলেজের সোশ্যালে ওদের আমন্ত্রণে নানা অনুষ্ঠান নিয়ে যাওয়া হয়। মিঠু সেখানে নজরুলের ‘ফরিয়াদ’ আবৃত্তি করেছিল। সুকান্ত নজরুল তো বটেই, রবীন্দ্রনাথেরও কতো কতো দীর্ঘ কবিতা মুখস্থ ছিল ওর। অনায়াসে আবৃত্তি করে যেতো, কিন্তু ওই, মুড্ হলে। আমি তখন চলে এসেছি এখানে। আমাদের গ্রাম উধারবন্দে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ভাই শুভঙ্করের সঙ্গেই তখন মিঠুর যোগাযোগ, বন্ধুত্ব। সেবার আমাদের গ্রামের হাসপাতালের উঠোনে বেঞ্চ দিয়ে স্টেজ বানিয়ে নাচ গান নাটক। যেমন গ্রামে হতো তখন। সেখানেও মিঠু ওই ‘ফরিয়াদ’ আবৃত্তি করে। কবিতার শেষে আমাদের গ্রামের সেই একসময়কার একজন তেভাগা আন্দোলনের কর্মী, এখন হাটে হাটে ছাতা সারাইয়ের কাজ করেন, গর্বের দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গী, সেই কালিপদ চক্রবর্তী আবৃত্তি শেষ হয়ে গেলে মিঠুকে বুকে জড়িয়ে আট আনা না এক টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন। আজ থেকে চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর আগে। হয়তো তাঁর সেদিনের উপার্জনের অনেকটাই!
যাইহোক, সেই ভালোবাসার গল্পে ফেরা যাক। একটা সময় মিঠু চলে আসে শিলচর, তার সেই ভালোবাসার অগ্রজ মহিলাও স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মিঠুর ডায়েরির পাতায় সেই কষ্টের ছবি, সে ছবি তার গল্পে কবিতায়। কিন্তু বাইরের কারো কাছে সেই প্রকাশ ঘটতো না কখনো। বেশ কিছু পরে শিলচরে আমাদের দাদাস্থানীয় এক বন্ধুর বোন, দুর্বল হয়ে উঠেছিল মিঠু তার প্রতিও। গানের ভাণ্ডারি ছিল ওই মেয়েটি। কিন্তু ওই, সরে আসতে হলো একসময়। কারণ মিঠুর জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর মতো এক ভয়ঙ্কর দুঃসাহস ছিল না প্রায় কারো। কোলকাতায় এসে বেশ কিছুদিন পর আমারই এক খুব পরিচিতজনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল মিঠু। সেই প্রেম-পর্বের অন্যান্য কাহিনী বাদ দিলাম, শুধু একটা বলি। কী কারণে যেন ওদের দুজনের মধ্যে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘সোনার হরিণ নেই’ উপন্যাসটা নিয়ে কথা হয়। মিঠুর তখন ওটা পড়া ছিল না। সেইবার ও কোলকাতা থেকে বদরপুরে ফিরছে। তখন লামডিং-এ ট্রেন পাল্টাতে হতো। বোধহয় হুইলার থেকে বইটা কেনে। তারপর জেনারেল কোচে যাবে, আলো কম, পড়তে পারবে না, সেই ট্রেন ছেড়ে দিয়ে লামডিং স্টেশনে বসে গোটা রাত জুড়ে উপন্যাসটা শেষ করে ওইখান থেকেই মহিলাকে একটা দীর্ঘ চিঠি লেখে মিঠু। আরও ভয়ঙ্কর সব কাণ্ড করেছিল নির্দ্বিধায়, আর সেটা পেরেছিল সে পার্থপ্রতিম মৈত্র বলেই। ওর একটা ঘটনার সঙ্গে ভ্যান গগের সেই কান কেটে দেবার তুলনাটাই মনে হয়েছিল সেদিন।
ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যখন মিঠুর পরিচয় এবং পরিণয় পর্ব, তখন নানা কাজে আমি অনেকটা দূরে। বারাসাতে ওদের রেজিস্ট্রি পর্ব শেষ করে ফেরার পথে মনে মনে যথেষ্ট ভয়ই ছিল বলা যায়, মিঠু পারবে সংসারের অন্তত কিছু নিয়ম, কিছু বাধ্যতা মেনে চলতে! পরে দেখেছি, ইন্দ্রাণী আশ্রয় না দিলে মিঠু সেই পাগল-পারা হয়েই থাকতো। সংসারে এলেও মিঠু প্রায় কোনো বাধ্যতাই মেনে নিত না, কিন্তু ইন্দ্রাণী এর মধ্য দিয়েই চালাতো ওর সংসার। আজীবন বোহেমিয়ান মিঠু, বোহেমিয়ান শুধু ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়ানো না, কোনো কিছুতেই দীর্ঘক্ষণ ওর মনোযোগ ধরে রাখতে পারতো না – আসলে খুব সহজেই যে কোনো জিনিসের গভীরতম তল স্পর্শ ওর কাছে ছিল প্রবল আকাঙ্ক্ষার, দ্রুততম গতিতে সেটা পারতোও, আর তারপরেই সেই আকর্ষণ যেতো ফুরিয়ে। একটা সময় সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে। যে-কোনো বাঁধনেই হাঁসফাঁস করতো মিঠূ। ‘নিরাপত্তা পেলে তুমি বৃক্ষ হয়ে যাবে, কমলিকা’ কিম্বা, ওই কবিতারই ‘দ্রুম নয়, আমাদের দ্রুতির জীবন’ – এইসব লাইন আসলে মিঠু নিজেই নিজের সতর্কবাণী হিসেবে লিখেছিল। ভয় পেতো নিজেই, স্থায়িত্বে তার চিরদিনের অনীহা। আর আপাত বৃক্ষের মতো তাদের সংসার হলেও ইন্দ্রাণী কোনোদিন মিঠুর দ্রুতির জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ভালোবাসার প্রশ্রয়ের সঙ্গে মিঠুর একটা শাসনেরও প্রয়োজন ছিল। সেইখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ইন্দ্রাণী। মিঠু সামান্য স্থির হলো তখন, যখন বিহান বড়ো হচ্ছে। পুরো বদলে না গেলেও মিঠু নিজেই বোধহয় নিজেকে কিছুটা পাল্টে ফেলেছিল। আর এটা তো ঠিক, একসময় যখন ভাই বোন ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নিদের নিয়ে ওদের সংসারের ডালপালা বেশ ছড়ানো, তাদের সমস্ত নির্ভরতা ছিল মিঠুকে ঘিরেই। আর ধীরে ধীরে মিঠু তাদের কাছে বৃক্ষের আশ্রয়ই হয়ে উঠেছিল। আর একসময় সেইটাই বড়ো আদরের হয়ে উঠেছিল মিঠুর কাছে।
মিঠুর সঙ্গে কি মনমালিন্য মতবিরোধিতা হয়নি কখনো! অনেক হয়েছে। নানাবিষয়ে নানা সময়ে। সে কাছেই কোলকাতায় থাকলেও যাওয়া হয়নি বছরের পর বছর। সে-ও আসেনি। অথচ সেই কলেজ জীবনের মেসে থাকার সময় মনে হতো, একটা দিনও যেন আমরা দূরে না থাকি। বাস্তব আমাদের শিক্ষক হয়ে উঠেছিল ক্রমে ক্রমে। আমরা সাময়িকভাবে দূরে সরে গেছি, ওর চলার পথ নিয়ে আমার সমালোচনা ছিল, আমার পথে সন্দেহ ছিল ওর। তর্ক ছিল মিঠুর একটা প্রিয় উপভোগের বিষয়, আর আবেগসর্বস্ব নির্বোধ আমি তর্ক এড়িয়ে চলতাম প্রায় সমসময়। ফলে একটা সময় আমাদের দেখা হলেও দুজনেই খুব সাবধানে সেই অসমান জায়গাগুলোকে এড়িয়ে চলতাম । কিন্তু সেসব দূরত্বের গল্প, বিরোধিতার গল্প থাকুক আমার নিজের কাছে।
এ আখ্যান শেষ হবার নয়। এ এক অনন্ত ভাসানের চালচিত্র যেন। লোকগাথায় যেমন মানুষ কানে শুনে আবার পরিবেশনের সময় নিজের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে নিজের বোধকে আখ্যানে ধরে দেয়, মিঠুকে নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে, আলোচনা করতে গিয়ে, বদরপুর শিলচর উধারবন্দ মাঝারগ্রাম চা-বাগান করিমগঞ্জ হাইলাকান্দি হাফলং কোলকাতা – আরও কতো কতো জায়গার কতো মানুষ জুড়বেন কতো কথা - যা কেবল তাঁদের কাছেই সত্য আর আশ্চর্য বলে মনে হয়েছিল। সেই রসদ ছড়িয়ে রেখে গেছে মিঠু নিজেই, সেসব ছড়ানো বরাক কুশিয়ারার তীর ধরে, আছে গঙ্গা তীরবর্তী এই মহানগর কলিকাতাতেও। সেইসব জুড়ে জুড়ে এই আখ্যান আরও বড়ো হবে, সম্পূর্ণ হবার পথে এগোবে। কিন্তু জানি, একেবারে সম্পুর্ণ হবে না কখনো। দিগন্তকে ছুঁতে পারা শুধু অসম্ভব না, অবাস্তবও।