সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
পণ্ডিতজী,
আসসালাকু আলেকুম।
আপনাকে আমি এই প্রথম চিঠি লিখছি। ঈশ্বরের দয়ায় আমেরিকার মানুষজনের কাছে আপনি সুদর্শন। আমার চেহারাও খুব একটা খারাপ নয়। আমি আমেরিকায় গেলে হয়ত, একই কদরের অধিকারী হ’ব। কিন্তু আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, আর আমি পাকিস্তানের খ্যাতনামা গল্প-লেখক। ব্যবধান দুস্তর। মিল একটাই, আমরা দুজনেই কাশ্মীরি। কাশ্মীরি মানেই সুদর্শন, আর সুদর্শন মানে … … আমি জানি না।
আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা আমি বহুদিনের। (আমাদের জীবিত কালে এখনও দেখা হতেই পারে)। আমাদের এদিকের বয়স্ক মানুষজনের অনেকেই হয়’ত আপনাদের ওদিকের মানুষজনদের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমার, আপনার সঙ্গে দেখা করার কোন সুযোগ হয়নি। বড়ো পরিতাপের বিষয়, আপনার সঙ্গে আমার কখনই দেখা হয়নি। আমি একবার রেডিওতে আপনার ভাষণ শুনেছি মাত্র।
যেমন বলছিলাম, আমি অনেক দিন ধরেই আপনার সঙ্গে দেখা করার সুতীব্র ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করেছি। আমরা দু'জনেই কাশ্মীরি, তাই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
তবে এখন ভাবছি দরকারটা কোথায়। কোন গলি বা রাস্তার মোড়ে একজন কাশ্মীরির সঙ্গে আরেকজনের হঠাৎ দেখা হয়ে যেতেই পারে।
নদীর ধারে স্থায়িভাবে বসবাস করার জন্যে (নেহ্র) আপনারা পরিচিত হয়েছিলেন 'নেহেরু' বলে। আমি ভাবি আমি কি করে 'মান্টো' হলাম। মনে হয় আপনি লক্ষ লক্ষ বার কাশ্মীর গিয়েছেন, আমি শুধুমাত্র বানিহাল পর্যন্ত যেতে পেরেছি। আমার কাশ্মীরি বন্ধুরা, যাঁরা কাশ্মীরি ভাষা জানেন, আমাকে বলেছেন 'মান্টো' শব্দটি এসেছে দেড় সের ওজনের পাথরের বাটখারা থেকে। আমি নিশ্চিত আপনি কাশ্মীরি ভাষা জানেন। যদি আপনি কষ্ট করে এই চিঠির উত্তর দেন তবে কি আমাকে 'মান্টো' শব্দটির উৎস সম্পর্কে একটু বলবেন?
আমি যদি দেড় সের হই, তবে আমাদের দুজনের মধ্যে কোন তুলনা আসতে পারে না। আপনি পুরো নদী, আর আমি মাত্র দেড় সের, আমি কি করে আপনার দায়িত্ব নিই? কিন্তু আমরা দুজনেই সেই বিখ্যাত কাশ্মীরি প্রবাদের বন্দুক, যা অন্ধকারেও লক্ষ্যভেদ করতে পারে। অনুরোধ করি, আমার কথার ভুল অর্থ করবেন না। আমি যখন এই প্রবাদটা শুনেছিলাম, আমার সাংঘাতিক লেগেছিল, কিন্তু এখন এটা বেশ আকর্ষণীয় লাগছে বলে হাল্কাভাবেই এর উল্লেখ করলাম। না হলে, আমরা দুজনেই জানি, কাশ্মীরিরা কোনো ক্ষেত্রেই হার মেনে নেবে না।
রাজনীতিতে আমি আপনার নাম গর্বের সঙ্গেই উচ্চারণ করতে পারি, কেননা আপনি ভালো ভাবেই স্ববিরোধিতার কৌশলটি জানেন। আজ পর্যন্ত, আমাদের, অর্থাৎ কাশ্মীরিদের, কেউ কখনো কুস্তিতে হারাতে পেরেছে? আমাদের চেয়ে ভালো কবিতা কেউ লিখেছে? কিন্তু আমি জেনে অবাক হলাম আপনি আমাদের দেশের ওপর দিয়ে নদীর প্রবাহকে বন্ধ করে দিতে চাইছেন। পণ্ডিতজী, আপনি শুধুমাত্র একজন নেহেরু। আমার দুঃখ এই যে আমি দেড়সের ওজনের পাথর মাত্র। যদি আমি ত্রিশ চল্লিশ হাজার পাথরের স্তুূপ হতাম, তাহলে আমি নদীতে ঝাপ দিয়ে পড়তাম। তাতে আমাকে তোলার জন্যে আপনাকে আপনার প্রযুক্তিবিদদের সাথে আলোচনায় আরো কিছুটা সময় ব্যয় করতে হত।
পণ্ডিতজী, আপনি যে একজন অসামান্য ব্যক্তিত্ব এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আপনি সেই দেশের শাসক, যা আগে আমারও স্বদেশ ছিল। আপনি সব কিছু। কিন্তু আমি যদি বলি এই নিরহঙ্কারী মানুষটির কোন খোঁজ খবরই আপনি রাখেননি তবে আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি আপনাকে একটা আকর্ষক গল্প বলতে চাই। যখনই আমার প্রয়াত পিতা, স্বাভাবিকভাবেই, যিনিও ছিলেন কাশ্মীরি, রাস্তায় হঠাৎ কারো সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে, তাকে বাড়িতে এনে সদর দালানে বসাতেন, কাশ্মীরি নুন চা ও কুলচায় তাঁকে আপ্যায়িত করতেন। তারপর তাঁকে গর্বের সঙ্গে বলতেন, আমিও 'কাশের'। পণ্ডিতজী, আপনিও তো একজন 'কাশের'। এই প্রশ্নের জন্য, আল্লার দোহাই, যদি আপনি আমার জান নিতে চান তো নিন। আমি জানি, আমি বিশ্বাস করি আপনি কাশ্মীরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন, কারণ কাশ্মীরি হয়ে আপনি আপনার স্বদেশের প্রতি গভীর টান অনুভব করেন। প্রত্যেক কাশ্মীরিই, সে কাশ্মীরে থাক বা না থাক, এ ভাবেই ভাবা উচিৎ।
যেমনটি আমি বলেছিলাম - আমি শুধুমাত্র বানিহালে গিয়েছি। আমি কুদ, বাতাউত ও কাশটোয়ারের মত জায়গাগুলি দেখেছি। তাদের সৌন্দর্যের পাশাপাশি আমি দারিদ্র্যও দেখেছি। যদি এই দারিদ্র্য দূর করতে পারেন, তবে আপনি কাশ্মীরকে আপনার কাছে রেখে দিন। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, আপনি তা পারবেন না, কেন না আপনার সময় নেই।
পণ্ডিত ভাইয়েরা, আমাদের মধ্যে এটা করুন - আমাকে ভারতে ডেকে নিন। প্রথমে আমি 'শালিজান সাবদেগ' নেব, তারপর কাশ্মীরের বিষয়গুলি দেখব। বকশি ও বাকি যারা আছেন তাঁদের বরখাস্ত করতে হবে। এরা প্রথম সারির ঠগ, এদের আপনার এত মর্যাদা দেওয়ার কোন কারণই নেই। তবু এইজন্যে কি দিয়েছেন যে এটা আপনাকে মানায় বলে? আমি জানি আপনি একজন রাজনীতিক, আর আমি তা নই। তবে তার মানে এই নয় যে আমি কিছুই বুঝতে পারি না।
দেশ ভাগ হল। রাডক্লিফ আর প্যাটেলকে দিলেন এই নোংরা কাজটির ভার। আপনি অনৈতিকভাবে জুনাগড় অধিগ্রহণ করলেন, যা একজন কাশ্মীরি করতে পারে শুধুমাত্র মারাঠা প্রভাবে। আমি প্যাটেলের কথাই বলছি (আল্লা তাঁকে মার্জনা করুন)।
আপনি ইংরেজি সাহিত্যের সাহিত্যিক। এখানে এসে পর্যন্ত আমি উর্দুতেই ছোটগল্প লিখছি, যে ভাষাটি আপনার দেশে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। পণ্ডিতজী, আমি প্রায়ই আপনার ভাষণগুলো পড়ি যাতে বোঝা যায় আপনি উর্দুকেও ধরে রেখেছেন। দেশ ভাগের সময় আমি রেডিওতে আপনার একটি ভাষণ শুনেছি। প্রত্যেকে আপনার ইংরেজি ভাষার প্রশংসা করেন। কিন্তু যখন আপনি উর্দুতে বলতে শুরু করলেন, মনে হল যেন কোন রাগী হিন্দু মহাসভার সদস্য আপনার ইংরেজি বক্তৃতার অনুবাদ করে দিয়েছেন, যা স্পষ্টতই আপনার পছন্দ নয়। প্রতিটি শব্দেই আপনি হোঁচট খাচ্ছিলেন, আমি ভাবতেই পারছি না কেন আপনি এটা পড়তে সম্মত হয়েছিলেন।
এটা সেই সময় যখন রাডক্লিফ ভারতকে পাঁউরুটির দুটো টুকরোর মত দুভাগ করে দিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় একটা পিঠ তখনও সেঁকা হয় নি। আপনারা একদিকে সেঁকছেন, আমরা আরেক দিক, কিন্তু আমাদের চুল্লীর তাপ আসছে বাইরে থেকে।
পণ্ডিতজী, এই সময় 'বাব্বোগোসা'র। আমি 'গোসা' খেয়েছি, কিতু 'বাব্বোগোসা' খেতে চাই। কি অন্যায়, আপনি ওখানে বকশিদের সমস্ত অধিকার দিয়েছেন আর তারা আমাকে উপহার হিসেবেও সেগুলো কিছু পাঠায়নি। আচ্ছা, উপহার জাহান্নামে থাক। আসলে, আমি আপনার কাছে জানতে চাই, আপনি আমার বইগুলো পড়েন না কেন? যদি আপনি পড়তেনও, তাহলেও, আমি জানি, আপনি কখনোই ওগুলোর প্রশংসা করতেন না। যাইহোক, যদি আপনি নাই পড়ে থাকেন তাহলে আরো দুঃখের বিষয় কেননা, আপনি নিজেও একজন লেখক।
আপনার বিরুদ্ধে আমার আরো একটি অভিযোগ আছে। আপনি আমাদের নদীগুলিতে জলের প্রবাহ বন্ধ করে দিতে চাইছেন, আর আপনার ইশারায় আপনার রাজধানীতে প্রকাশকেরা আমার সম্মতি না নিয়েই আমার বইয়ের পুনর্মুদ্রণ করে চলেছেন। এটা কি ঠিক? আমি ভেবেছিলাম এরকম অনুচিত কাজ অন্তত আপনার রাজত্বে হবে না। আপনি নিজেই খবর নিয়ে দেখতে পারেন দিল্লি, লক্ষ্ণৌ ও জলন্ধরের কতজন প্রকাশক আমার বই ছেপেছেন। ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগে আদালতে কিছু অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু দেখুন, একেবারে আপনার নাকের ডগায় দিল্লিতে কি অন্যায় হয়ে চলেছে। একজন প্রকাশক আমার গল্প সংকলন নিয়ে তার নাম দিয়েছেন 'মান্টোর অশ্লীল গল্পগুলি'। আমি লিখেছিলাম 'গাঞ্জে ফরিস্ততে'। বইটি একজন ভারতীয় প্রকাশক তা প্রকাশ করলেন 'পর্দার অন্তরালে.....'। এখন আমাকে বলুন, আমি কি করব?
আমি একটা নতুন বই লিখেছি। এই বইটির মুখবন্ধ হিসেবেই আপনাকে এই চিঠি লেখা। এই বইটিরও যদি গ্রন্থস্বত্ব অপহৃত হয়, তা হলে আল্লার নামে বলছি, আমি দিল্লি পৌঁছে যাবো, আপনার গলা চেপে ধরব, আপনাকে যেতে দেব না। আমি এমনভাবে আপনাকে চেপে ধরব যে আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন। প্রতিদিন সকালে আপনার আমাকে নুন চা ও কুলচা দিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে। যেভাবেই হোক, প্রতি সপ্তাহেই 'শালিজান সাবদেগ' দিতে হবে।
বইটি প্রকাশিত হলেই, আমি আপনাকে একটি কপি পাঠিয়ে দেব। আশা করি প্রাপ্তি স্বীকার করবেন ও বইটি সম্পর্কে আপনার মতামত জানাবেন।
আমার চিঠিতে আপনি পোড়া মাংসের গন্ধ পেতে পারেন। আপনি জানেন, কাশ্মীরে 'ঘানি' নামে একজন কবি ছিলেন। লোকে তাঁকে 'ঘানি কাশ্মীরি' নামেই চিনত। ইরান থেকে এক কবি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকত। তিনি বলতেন, আমার বাড়িতে এমন কি আছে যে দরজা বন্ধ করতে হবে? আমি যখন বাড়ি থাকি তখন বন্ধ করতে পারি, কেন না আমিই তো একমাত্র সম্পদ। ইরানের কবি তাঁর কবিতার খাতা শূন্য বাড়িতে রেখে গেলেন। একটি স্তবক একটি কবিতায় অসম্পূর্ণ ছিল। সেটির দ্বিতীয় লাইনটি তিনি লিখেছিলেন কিন্তু প্রথম লাইনটি লিখতে পারেন নি। দ্বিতীয় লাইনটি ছিল 'তোমার পোষাক থেকে আসছে কাবাবের গন্ধ'। যখন ইরানের কবি ফিরে এলেন দেখলেন প্রথম লাইনটি লেখা আছে, তোমার জামাটি কি ছুঁয়েছে কোন ক্ষয়কারী আত্মার হাত?
পণ্ডিতজী, আমিও ক্ষয়কারী আত্মা। আমি কথাটি আপনাকে বললাম কেননা বইটি আপনাকেই উৎসর্গ করেছি।
সাদাৎ মান্টো
২৭ আগস্ট, ১৯৫৪
মূল উর্দু থেকে হিন্দিতে তর্জমা করেছেন ম. আসাউদ্দিন।
'শালিজান সাবদেগ' - রান্না মাংসের জনপ্রিয় কাশ্মীরি পদ। ভেড়ার মাংস ও টারনিপ (মাটির ওপর হওয়া শিকড়যুক্ত গোলাকার সবজি) মশলা সহ সারারাত অল্প আঁচে ফুটিয়ে তৈরি করা হয়।