সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মোদের জায়গা উদের ইস্টেজে না হলো
উহা বসবার লাগি কেউ না বুলালো,
মোদের বসার জায়গা হল লিচে
সারি সারি বসল বাবুর দল ইস্টেজে,
উরা কইল কত মোদের দুখের কথা
তবু মোদের জীবন ছায়ে রইল সে ব্যথা,
ক্যানে জানি কখনো তা বাবুদের হলো না।
আদিবাসী কবি ওয়াহারু সনাভানের কবিতার অনুপ্রেরনায়।
এক
পুরুলিয়ার শালহুরা গ্রামের দক্ষিণে সবুজ জঙ্গলে ঢাকা পঞ্চকোট পাহাড়, উল্টোদিকে উত্তরে দামোদর বয়ে চলেছে গ্রামের বেশ কিছুটা নীচে। বিষাণ মুরমু বাড়ির পিছনের পরিপাটি করে নিকনো দাওয়ায় শালের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে। সামনের মাঠের মকাইয়ের লম্বা গাছগুলোর সবুজ পাতা আর সাদাটে হলদে ভুট্টার শিষের দিকে অলস ভাবে তাকিয়ে থাকে। মকাই ক্ষেতের উত্তরে রামফলের গাছের ঝোপের পর ধাপে ধাপে ধানের জমি উত্তরে নেমে গেছে দূরের দামোদরের চর পর্যন্ত। ওর বাড়ির দক্ষিণ দিকে গ্রামের চওড়া রাস্তা তার ওপাশে কয়েকটা বাড়ি, তারপর ঝোপে ঢাকা কাঁকুরে জমি ধাপে ধাপে উঠে গ্রামের জাহের থানের বড় বড় শাল মহুয়া গাছের দিকে চলে গেছে। ওইদিকে গ্রামের ছেলেরা গাই, কাঁড়া (মোষ), মেরোম (ছাগল) চরাতে নিয়ে যায়। দু একটা ছেলে তেঁতুল গাছের গায়ে হেলান দিয়ে তিরিয়াওতে (বাঁশের বাঁশি) সুর তোলে। বয়স চল্লিশের বিষাণের কালো পেটানো তেলমাখা চেহারা সকালের রোদে চকচক করে। মালঞ্চ, বাঘমারা, আখুনবানি অঞ্চলে ওর থেকে ভালো চাষি খুব কম আছে।
ওর বাবা যখন কুড়ি বছর বয়েসে মারা যায় তখন দুই ভাইকে নিয়ে সে সংসার সামলাতে শুরু করে, তখন ওদের বারো বিঘা মতো জমি ছিলো। বিষাণ চাষ ভালোবাসে, এক এক করে সে দুই ভাইকে সঙ্গে করে ২৫ বিঘা জমি করেছিল। তারপর ভাইদের সংসার হলে ওদের আলাদা করে দিয়েছে, ওর বাড়ির দুই পাশে দুই ভাই তাদের পরিবার নিয়ে থাকে, ওদের চাষও আলাদা। সেই ভাগের পর আবার ও পনেরো বিঘা জমি করেছে। বছর চারেক আগে দামোদরের পাড়ের কাছে ছয় বিঘা সোনা ফলানো জমি সে জারা কিস্কুর কাছ থেকে কিনেছিল। ও সোনামণির সব গয়না, গলার হার, চুড়ি এমনকি ওর পায়ের পায়গন পর্যন্ত ভুরকুন্দবাড়ির লক্ষ্মী সাউয়ের দোকানে বন্ধক রেখে, আর বাকী টাকা জমিনি হেমব্রমের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেই জমি কেনে। কেবল সোনামণির হাতের বালা সেরকমটা রয়ে গিয়েছিল, গতবছর সে সব ধার শোধ করেছে তার চাষ থেকে।
বাড়ির পাশের বড় শিমুল গাছটায় কটা টিয়াপাখি ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকছে। ওর তিন ছেলে আর এক মেয়ে। বড় ছেলে জোলো, জোয়ান হয়েছে,খুব খাটিয়ে, ওর সাথে মাঠের কাজে হাত লাগায়। ছেলেটা চাষ ভালোবাসে ওর মতো, ঠিক সময়ে আল বেঁধে জল ধরে রাখে, ভোররাতে মাঠে গিয়ে দেখে আলে যদি কোন ভুলুক হয়ে থাকে কোদাল দিয়ে সে গুলোকে ঠিক করে। বাপ বেটার বড় সময় কাটে মাঠেই। মেজ ছেলে বুধুটা একটু ডানপিটে, ওর ঝোঁক গাই আর কাঁড়ার উপর। এই সময় সে কাড়া চারটেকে নিয়ে সামনে দামোদরের চরে চরাতে নিয়ে যায়। এক একদিন বড় কাঁড়াটার পিঠে শুয়ে দামোদরের ওপারে চলে যায় তিরিয়াও বাজাতে বাজাতে। মোষগুলো ওর প্রাণ, ওদের খাওয়ানো থেকে গোয়াল কাঢ়া সব এমন মন দিয়ে করে যেন ওগুলো ওর ভাই। কাড়াগুলোর গা একেবারে কালো চকচকে, শুধু মেজটার জন্য। ছোট জগদীশ আবার বুধুর ন্যাওটা, ও ছাগলগুলো নিয়ে দাদার সঙ্গে যায় তারপর গোটা পনেরো ছাগলকে নদীর পাড়ে চরাতে দিয়ে মেজোর সঙ্গে দামদরে নেমে খেলা করে।
কোলের মেয়েটা চার বছরের ভানু, তাকে নিয়ে সোনামণির ঘরের কাজে সময় কাটে। ওর ভিতরে একটা বেশ ভরাট ভাব, চুপ করে ও সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। গেলবার তো মোষের পিঠে চড়ে ছোট আর মেজটা দামোদর ধরে তেলকুপির ভৈরবথানের মন্দির দেখতে চলে গেছিল। বেলা পড়ে এলে, সোনামণি ব্যাটাদুটোর জন্য কেবল ঘর বার করছিল চিন্তায়, সাঁঝের বেলা ফিরে মায়ের কাছে খুব পিটুনি খেয়েছিল। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ও ভাবল বেলা হোল এবার পুকুরে ডুব দিয়ে আসবে।
সামনের রাস্তায় বেরিয়ে দেখল রাসিটোলার ভূষণ যাচ্ছে, দুজনা মিলে দুটো চুট্টা ধরিয়ে টান দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলো। ওরও চাষবাস ভালো, ওর ব্যাটা দুটোও খুব খাটে। দামোদরের পাশে ওদের এই গ্রামে সারা বছরই জলের কোন অভাব নেই তাই ওদের মাঠগুলোয় সারা বছরই কিছু-না-কিছু হচ্ছে। গ্রামের প্রত্যেকটা সাঁওতাল বাড়ি ঝকঝকে করে নিকোনো আর বাইরের দেওয়ালে খুব সুন্দর করে রং করা নানা রকমের ফুল গাছ আর নকশা করা। ভূষণ বলল হ্যাঁরে সামনের পূর্ণিমাতে পঞ্চকোটের জঙ্গলে শিকার করতে যাবি নাকি? শুনছি কটা ধাড়ী বড়া নেমেছে। ভূষণ বলল হাঁ যাব, সে বার বেশী মহুয়া খেয়ে এত্ত বড় জিলটাকে (হরিণ) মাইরতে পারলাম নাই, আমার তুইন (তীর) ফস্কে গেল আর পাশ দিয়ে পাইলে গেল। ভূষণ বিষাণের কথায় মুচকে মুচকে হাসতে হাসতে বলল ইবার ধান মকাই দুটোই খুব হবে, ভয় হচ্ছে ধানে পুকা না লাগে।
দুই
আষাঢ় মাসের পনেরো তারিখ হয়ে গেল অথচ বৃষ্টির তেমন দেখা নেই, বেলা অনেক হোল, সনাতন মণ্ডল বার বাড়ির দাওয়ায় বসে হুঁকো টানতে টানতে হিসাব করছিলো ‘ধুলোর লাঙল দেওয়া হয়ে গেছে মাসখানেক আগেই বীজতলাও তৈরি এবার যদি তাড়াতাড়ি বৃষ্টি না আসে তা হলে এ বছরের চাষটাও মার খাবে’। বলদ দুটো বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় বড় কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে একমনে জাবর কেটে চলেছে। ভিতরে সনাতনের বউ বিলাসী বারন্দার কোণে রান্নার জায়গায় উনুনে ভাত চাপিয়েছে, চার বছরের কোলের মেয়ে কুমুদ বারন্দার কোণে একমনে খেলাপাতিনি খেলছে। ফোটা ভাতের গন্ধ বাইরে ভেসে আসছে। বড় ছেলে স্বপন বীজতলায় গেছে, জল টান হয়েছে কিনা দেখতে। ছোট ছেলে নন্দকে এবছর ইস্কুলে ভর্তি করেছে, সে সকাল সকাল পাড়ার ছেলেদের সাথে সেখানে গেছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একটা জীপ গাড়ী ধুলো উড়িয়ে গুসকরার দিকে চলে গেল, আওয়াজে রাস্তার পাশের বাবলা গাছ থেকে দুটো শালিক উড়ে গেল। বৃষ্টি না হওয়ায় রাস্তায় এখনো পোষ মাসের মতো ধুলো উড়ছে। সনাতন সেই চলন্ত ধুলোর মেঘের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এই এক হয়েছে, দেশ স্বাধীন হোল বছর দশেক হয়েছে কিন্তু চারিদিকে সব সাহেবদের মতো গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, ছেলে ছোকরাদের পরনে চোঙা প্যান্টালুন উঠছে ধুতি ছেড়ে। সে আপন মনে ভাবে ‘সত্যিই কিছু হবে? চারিদিকে এই যে এতো কথা শুনছে সেগুলো কি সত্যি?’ তার বয়স এক কুড়ি পনেরোর বেশী হোল কিন্তু এই কবছরে হঠাৎ সব কেমন বদলে যাচ্ছে কত কিছুই সে দেখছে আর কত কথাই সে শুনছে। পশ্চিমে দুগগাপুরের পাথুরে উঁচু জমিতে নাকি বড় বড় কারখানা হচ্ছে, কি জানি কি হবে।
দেশ স্বাধীন হোল, ১৩৫৪ সালের ৩১শে শ্রাবণ, তখন ওর বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে সাহেবরা চলে গেছে শুনে কি আনন্দ! গ্রামের মিহির,বিভূতি, মানিকদের সঙ্গে ও গিয়েছিল বর্ধমান পায়ে হেঁটে, সে কি আমোদ। বর্ধমানে করজন গেটের সামনে রানিগঞ্জ বাজারের বড় রাস্তায় সবাই হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়েছে, ওরা একটা চায়ের দোকানের কাছে ভিড় করে একটা যন্ত্র থেকে ভেসে আসা কথা শুনছে, কে বলেছিল ওটাকে রেডিও বলে। ভালো করে দেখতেও পায়নি যন্ত্রটা, শুনেছিল ওতে দিল্লী কলকাতা থেকে জহরলাল নেহেরুর কথা শোনা যায়। ওরা জানে না কি হবে, কিন্তু লালমুখো সাহেবদের তাড়িয়ে দেশ তাদের স্বাধীন হয়েছে, অকারণে ওরা সবাই হিহি করে হেসেছিল। ওর বাবা অবশ্য তখন বলেছিল দেশের লোক কি সাহেবদের মতো দেশ শাসন করতে পারবে? ও খুব রেগে বাবাকে বলেছিল ওরা ওদের দেশ শাসন করুক, এখানে ক্যানে।
বাবা মারা গেছে বছর দুয়েক আগে। ওদের গাঁ সুয়াতা আর আশেপাশের ভাল্কি, অভিরামপুর, জামতারা সব গাঁয়ের অবস্থা একই আছে এখনো। বর্ষার বৃষ্টির উপর ভরসা করে আর কতো ভালো চাষ হয়? গাঁয়ের ২০ মাইল উত্তরে গেছে অজয় নদী আর আট মাইল দক্ষিণে দামোদর, তবুও ওদের গাঁয়ের এই অবস্থা। মাঝের এই জায়গাটা কাছিমের পিঠের মতো উঁচু, শক্ত কাঁকুরে জমির। গাঁয়ের পশ্চিমে মাইল দুয়েক গেলেই ডোমবান্দীর জঙ্গল শুরু হয়ে যায়, উত্তরে জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম ভাল্কি। পুকুরের জলও ফি বছর শুকিয়ে যায় দখিনের শীতলাতলার দিঘিটা ছাড়া। ঐ জলের উপর ভরসা করে পুরো গ্রাম চলে। তার উপর বছর বছর শীতে ধান পাকার সময় বিহারের থেকে হাতির দল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে এসে ধান নষ্ট করে। এই দু বছর ওদের আসা কমেছে বোধহয় দুগগাপুরের কারখানা তৈরির জন্য। এখন ওর ষোল বিঘে জমি, ওর বাবার জমি ভাইয়ে ভাইয়ে ভাগ হবার পর ও পেয়েছিল আট বিঘে মতো। সেখান থেকে ও নিজে দিন রাত মাঠে খেটে খেটে বাড়িয়েছে। তবুও জলের অভাবে চাষ ঠিক জুতের হয় না।
ওর শ্বশুরবাড়ি ভেদিয়ার কাছে, গ্রামের উত্তরে মাইল দুয়েকের মধ্যেই অজয় নদী। শ্বশুরের চাষ খুব ভালো, জমি বেশী নয় কিন্তু সারা বছর মাঠে চাষ হচ্ছে, তাইতো বিলাসী কথায় কথায় ওর বাপের বাড়ির চাষ, পুকুরের মাছের বড়াই করে। হবে নাইবা কেনো, ফি বছর নদীতে বান এলেও সালভর জলের অভাব নাই, একটা মাঠের পুকুরও খরায় শুকোয় না। কিন্তু ওর এতো খাটনির পরেও বছরে একটার বেশী চাষ দেওয়া মুশকিল। উত্তরের কলাপুকুর পাড়ের বিঘে তিনেক দো জমিতে ও যেটুকু সর্ষে চাষ করতে পারে, বর্ষার যা ছিরি তাতে মনে হচ্ছে এবছরও গেলো বছরের মতো আবার ধান মার খাবে।
তিন
দ্রিম দ্রিম দম দম করে কতকগুলো ঢাক আর দমকের আওয়াজ গ্ৰামের বাইরের জাহের থানের দিক থেকে ভেসে আসছে। পরবের ঢাক দমকের মতো এতে কোন তাল বা ছন্দ নাই, বিপদে লোক জড়ো করার আওয়াজ যেন। বেলা তিনটে হবে, গ্রামের লোকেরা আর মাঠে গরু চরানো কম বয়সী ছেলেছোকরার দল সেই আওয়াজ শুনে গ্রামের উঁচুতে জাহের থানের বড় বড় শাল আর মহুয়া গাছ লক্ষ করে চলতে লাগালো। মাঠে অনেক লোক জড়ো হয়েছে আরও আশপাশের জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে আসছে। বিষাণ খালি গায়ের উপর গামছাটা কাঁধে ফেলে ভূষণকে নিয়ে তাড়াতাড়ি মাঠে পৌঁছে গেছে, দুজনের মুখে চিন্তার আর ভয়ের ছাপ? পাঁচ গ্রামের মাঝি এই ডাক দিয়েছে আর পাঁচ গ্রামের সব মরদ জড়ো হচ্ছে সেখানে। ঢাক আর দমকের আওয়াজে ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে জোয়ান বুড়ো জড়ো হতে লাগলো, মাঠে তিল ধারণের জায়গা নেই। অনেকেই বেলায় হাঁড়িয়া, মহুয়া খেয়েছে কিন্তু চিন্তায় যেন সেই মৌতাত জমেনি, ওরই মধ্যে দু একজন মহুয়া আর হাঁড়িয়া খেয়ে চূর, ঢাকের আওয়াজের তালে তালে দুলছে।
শালহুরা গাঁয়ের মাঝি কিনু হাসদার বয়েস হবে তিন কুড়ির মতো, সে উঠে দাঁড়িয়ে হাট তুলতেই ঢাক আর দমকের আওয়াজের সাথে সাথে ভিড়ের আওয়াজও কম হতে লাগলো। সবার চোখে মুখে গভীর উৎকন্ঠার ছাপ, শান্ত কিনু মাঝির কপালের ভাঁজে আর চোখে গভীর চিন্তার ছাপ। উঁচু পাথরের চাতালের উপর দাঁড়িয়ে সে ভিড়ের উদ্দেশে বলতে লাগলো, ঠাকুরদার বাপেরও আগের সময় থেকে আমরা এই গ্রামে পরিবার লিয়ে রইছি। সিং বোঙ্গা আমাদের আলো দিছে, বসুমাতা আমাদের দিছে ধান মকাই, দামোদর দিছে জল, রঙ্গো বোঙ্গার আশীর্বাদে জঙ্গলে আমরা বছর বছর শিকার করি। এই দামোদর নদে আমাদের পূর্বপুরুষদের সৎকার হইছে, এখানে তাদের আত্মা আছে। এই জাহের থান এর থেকে মারাং বুরু, গসাই এরা আর গাঁয়ের মাঝি থানের মাঝি হারাম বোঙ্গা, ভালো মন্দ সকল সময় আমাদের গ্রামকে, পরিবারকে রক্ষা করে চলেছে। ঐ মাঠে আমাদের বাপ ঠাকুরদারা আমাদের মতো ধান লাগানোর আগে এরকসিম পরব করেছে, তবে মাঠে এতো ধান, মকাই, মাড়ুয়া হয় যা খেয়ে আমাদের ছেলেরা আর তাদের ছেলেরা এখানে বড় হবে।
আজ কুতা থেকে ডিভিসি আর গোরমেন এসে আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলছে। আমাদের বউ, ব্যাটা, বিটি নিয়ে ঘর ছেড়ে, জমি ছেড়ে, জঙ্গল ছেড়ে, এই জাহের থান আর দামোদর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে বলছে। যদি আমরা না যাই তাহলে আমাদের সবার জমি ঘর বাড়ি নাকি বাঁধের জলে ডুইবে যাবে। খালি আমরা কুতায় যাবো উরা সেকথাটা বলছে লাই, বলছে ছেইড়ে দিতে, এসব ছেইড়ে আমরা যাবো কুতায়? কুতায় আমরা এমন দেশ পাবো যেখানে ব্যাটা বিটি লিয়ে এমন ভালো থাকবো? কুতায় আমাদের কাঁড়া, গাই আর ছাগল চরবে? কুতায় এমন সোনার জমি পাবো? বলতে বলতে কিনু মাঝির গলা ধরে এলো। আমার বাবা জঙ্গলে ঢাকা পঞ্চকোটের পাহাড়ের উপর থেকে দূরে নীচে দামোদরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছিলে ই দেশ মারাং বুরুর দেশ, ই দেশ বুরু বোঙ্গার দেশ, আমাদের দামোদরের দেশ, আজ সে সব ছেড়ে আমরা কেমন করে যাবো? গভীর যন্ত্রণায় তার গলার আওয়াজ তীক্ষ্ণ হয়ে এলো।
চারিদিকে সহসা গভীর নীরবতা নেমে এলো, সোঁ সোঁ করে জাহের থানের শাল মহুয়ার গাছ কাঁপিয়ে একটা দমকা বাতাস সেই নীরবতাকে ছেয়ে গেল। মনে হলো জাহের থানের বোঙ্গারা সব যেন সভার উপর উড়ে এল, হাঁড়িয়ায় চুর ঢাকের তালে দুলতে থাকা বিরেন মুরমুও চুপ করে কেমন থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল। ক মাস ধরেই একথা আশে পাশের গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাঞ্চেতে বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ক বছর আগেই, ডিভিসির লোকেরা এখন গ্রামে ঘুরে ঘুরে আদিবাসীদের বোঝাচ্ছে যে তারা যদি গ্রাম ছেড়ে না যায় তাহলে বাঁধ হলে তাদের গ্রাম, বাড়ি, জমি বাঁধের জলে ডুবে যাবে। এরই মধ্যে খবর আসছে তাঁতলোই আর বাঁশঝোরের চাষের জমি ডুবছে।
বেলা পড়ার এই সময় অসংখ্য পাখীর আওয়াজে জাহের থান ভরে থাকে কিন্তু আজ মানুষদের মতো তারাও নীরব। হঠাৎ সেই নীরবতাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে গর্জে উঠল বিষাণের আওয়াজ ‘মোরা মরে গেলেও গাঁ ছারবক লাই, মোদের জমিন ছাড়বোক লাই। উরা আমাদের কি ভেবেছে কুথায় জল যাবে বুলে আমাদের জমি ছেড়ে যেতে হবে বটেক’। এরপর চারিদিক থেকে নানা রাগ, ভয়, অসহায় কথার আওয়াজ উঠতে লাগল। কেউ বলতে লাগল গোরমেন জকন বলছে তখন আমাদের ছাড়তে হবেক, তার দিকে রুখে এলো একজন, বুল্লেই ছাড়তে হবেক, ক্যানে ছাড়ব? যাবেটা কুতায় বটে’। উপরের ভাসমান বোঙ্গারা যেন দুলতে থাকল নীচের মানুষদের এই অসহায় দীর্ঘ নিশ্বাসের আওয়াজে।
চার
সুয়াতার ধম্মোরাজ তলায় বাবার থানের সামনের ফাঁকা মাঠে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সামনের বড় ঝাঁকড়া শ্যাওড়া গাছেটার ছায়ায় একটা পুরনো হুডখোলা জীপ দাঁড়িয়ে, তার ওপর থেকে মাইকে কেউ চেঁচিয়ে চলেছে মাইক টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি, মাইক টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি,,,,,। সনাতন আওয়াজটা শুনে গায়ে ফতুয়াটা চড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখল শীতলা পাড়ার গোপাল হাজরা খালি গায়ে কাঁধে গামছা নিয়ে হেঁটে চলেছে ধম্মোতলার দিকে। সনাতনকে দেখে সে দাঁড়ালো, তারপর দুজনে একসঙ্গে হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে সনাতন জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার বলো তো? সত্যি সত্যি গাঁয়ের পাশ দিয়ে খরার সময় জল যাবে? গোপাল বলল শুনছি রন্ডিয়ার সাত আট মাইল পিছনে দুগগাপুরে গোরমেন্ট নাকি দামোদরে বাঁধ দিচ্ছে। বাঁধের সেই জল নাকি দখিন মাঠে বড় খাল হবে তা দিয়ে বয়ে যাবে। সনাতন বলল শুনছি তো আমিও অনেকদিন ধরে, সত্যি করে তা হবে? দামোদরের জল এই উঁচু জমিতে আসবে? দিনু মাস্টার তো কবে থেকে বলছে দুগগাপুরে গরমেন নাকি বড় কারখানা বানাচ্ছে। সে গেল রাবিবার সাইকেল নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে দেখে এয়েচে দামোদরের উপর বিরাট বাঁধের কাজ চলছে। তার চোখে মুখে অবিশ্বাস মাখানো আশার আলো জ্বল জ্বল করে। গোপাল বলল সাহেব গুলো গেছে এখন দেশের লোকের সরকার, ঠিক হবে দেখে নিও। জহরলাল যে সে লোক লয় সাহেবদের তারিয়েছে দেখবে ঠিক নিয়ে আসবে জল। সনাতন মনে মনে বলে ঠাকুর তাই যেন হয়, ধম্মোরাজ তোমার কাছে জোড়া পাঁঠা মানত রইল।
বেলা এগারোটা হবে কথা বলতে বলতে দুজনায় ধম্মোরাজ তলায় এসে দেখে মাঠে অনেক লোক এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সবারই মুখে খুশীর ছাপ, কোন ভালো খবরের আশায়। জীপে সদর থেকে আসা কজন সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা আর গান্ধী টুপি পড়ে মাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে আরো লোক জমার জন্য। আধঘন্টা পর আশেপাশের গ্রাম থেকে লোক এসে ভিড় বেশ বড় হলে ওদের মধ্যে একজন বয়স্ক গান্ধীটুপি, বলা শুরু করলো, 'আপনারা সকল গ্ৰামবাসী, কৃষকবন্ধুরা জানেন যে বাংলার দুঃখ দামোদর নদ। বর্ষায় বছর বছর দামোদরের বন্যায় বর্ধমানের মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না, বর্ধমান শহর পর্যন্ত জলে ডুবে যায়। আমাদের স্বাধীন দেশের সরকার সেই ভয়াবহ বন্যাকে আটকানোর ব্যবস্থা করছে যাতে সেই জল চাষের কাজে ব্যবহার করা যায়। এর ফলে বাংলার চাষিভাইরা সারা বছর মাঠে সোনা ফলাতে পারবে।
বাঁধের এই জল থেকে বিদ্যুৎও তৈরি হবে যা দিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে রাতে আলো জ্বলবে। প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার দামদেরের জলের সুষম বন্টন ও ব্যবহারের কথা ভেবে ডিভিসি তৈরি করেছে। তারা দামোদরের বর্ষার জল আটকাবে যাতে বছর বছর বর্ধমান, বাঁকুড়া হুগলী হাওড়ায় বানভাসি না হয়। সেই জলকে ধরে রাখার জন্য সরকার বিহারের মালভূমিতে বাঁধ তৈরি করছে, দুর্গাপুরেও বাঁধ হচ্ছে। সেই জল খরার সময় ক্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছে যাবে আপনাদের মাঠে।
একটু থেমে গান্ধীটুপি বলে চলে ‘ডিভিসির লোকেরা আসবে আপনাদের গ্রামে ক্যানেল তৈরির জন্য, তার জন্য দরকার হবে জমির, না হলে মাঠে জল যাবে না। আপনাদের মতো চাষী ভাইদের সহযোগিতা ছাড়া এই বিশাল কাজ সম্ভব নয়, আপনারা অবশ্য সেই জমির জন্য পয়সা পাবেন সরকারের থেকে। কি আপনারা সকলেই সহযোগিতা করবেন তো?' সবার আগে সনাতন হাত তুলল তার যে অনেক জমি দখিন মাঠে, যেখানে গেলবার ফুলুনোর আগে ধানগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুকিয়ে গেল। ওর কিছু জমি ছেড়ে দিতে দুঃখ নেই, তাহলে ওর সব জমিতে গেলোবারের মত ধান আর মরবে না। গাঁয়ের সবাই জানে এ মাঠে জলের কত দরকার আর এও জানে সনাতন বুদ্ধিমান গা গতরে খাটিয়ে চাষী, ওর দেখাদেখি অনেকেই হাত তুলল, চারিদিকে খুশির হাওয়া। সত্যি ওদের এই কাঁকুরে জমিতে জল আসবে! চারিদিকে নানা আলোচনা শুরু হয়ে গেল এই উঁচু এলাকায় জল আসবে বলে। কেবল পেছন থেকে দিনু বাউরি বলে উঠলো, 'কতটা জমি দিতে হবে? আমার তো বেশি জমি লাই'। ভিড়ের আওয়াজে তার কথাটা চাপা পড়ে গেল। সাদা গান্ধী টুপি পরা লোকটা হাতজোড় করে সবাইকে নমস্কার করে গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল গোঁ গোঁ আওয়াজ করে তারপর ধুলো উড়িয়ে চলে গেল পাশের গাঁয়ের দিকে। সনাতন খুশী আটকাতে না পেরে গোপালকে একমুখ হেসে বলল কাল দিনু মাষ্টারকে বলে মানকর থেকে আড়াই কেজি কদমা আনাবো বুঝলি।
পাঁচ
সারাদিন ভানু তার ভালোবাসার পুতুলটা বগলে নিয়ে সোনামণির পিছনে ঘুরে বেড়াতো আজ দুজনে দু জায়গায়। মেয়েটার লাল নীল কাপড়ের পুতুলটা মকাই ক্ষতের মাঝে আটকে আছে আধ ডোবা একটা মকাই গাছের পাতায় আর জলে দুলে দুলে ভাসছে। জলে ফুলে বেঢপ চেহারা হয়েছে, পুঁতির কালো চোখ একটা নাই। মেয়েটার জন্য পুতুলটা বিষাণ বছর তিনেক আগে মালঞ্চর মেলা থেকে কিনে এনেছিল। পুতুলটার পিছনে মকাই খেত পেরিয়ে ডুবে যাওয়া ধান খেতে একটা খালি মাটির সরা আর কটা শাল পাতার সঙ্গে গৃহস্থালির ছোটখাটো জিনিষ লাইন দিয়ে ভেসে ভেসে চলেছে। ভালবেসে বসানো ঘরে কত ছোটখাটো জিনিসই লাগে, ঘর ছাড়ার সময় তারই বোঝা, তাদের আর কোন মূল্য নেই। কদিন আগে এসব জিনিষের মতোই এদের ভালোবাসার মানুষজনের একটা দুটো পরিবার মাথায় বাক্স পুঁটুলি নিয়ে ভেসে গেছে কোন অজানায়।
কেউ গেছে ঝরিয়া, রানিগঞ্জ আসানসোলের কয়লা খাদানে, কেউ গেছে সিন্ধ্রি, চিত্তরঞ্জন দুরগাপুরের মাটি কাটার কাজে আবার কেউ কেউ পাঞ্চেত মাইথনে বাঁধের কাজে পাথর ভাঙ্গার কাজ খুঁজছে। চাষ গেছে, বাড়ি গেছে, গ্রাম গেছে কিন্তু পেট আছে, পরিবার আছে আর আছে অকারণ বাঁচার অদম্য ইচ্ছা। বিষাণ গ্রাম ছেড়েছিল সবার শেষে, সে বিশ্বাস করতে পারেনি এমনি করে তার সাজানো সংসার দামোদরে ডুবে যাবে। জলের মধ্যে বিষাণের বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে দেওয়াল এখনো ভেঙ্গে পড়ে নাই, কেবল বাড়ির ভিতর বুক সমান জলে খেজুরের ছেঁড়া চাটাই, ভাঙ্গা এলুমিনিয়ামের বাটি, কিছু সুতলি দড়ি, কিছু বাবুই ঘাসের ঝাঁটার সঙ্গে ওদের হাসি কান্নার স্মৃতি এদিক ওদিক ভাসছে। সামনের রাস্তা পেরিয়ে ওপারের বাড়ির দাওয়ায় জল উঠেছে। জাহের থানে যেতে এখনো দেরি। বিষাণের বাড়ির থেকে একটু নীচে মকাই ক্ষেতের পাশে বিরেন মুরমু বাড়ির মাটির দেওয়াল ভেঙ্গে খ্যাপলার চালটা জলের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছে।
এখনো বাড়ির পিছনের মকাই গাছ কটার সবুজ পাতা জলের উপর জেগে আছে, পাশে রাম ফলের গাছের মাথা জলের উপর জেগে। তারও পিছনে কেবল জল আর জল, অনেক দূরে দামোদরের পাড়ের প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের কটা শুকনো ডাল এখনো বেড়িয়ে আছে। কতো বন্যা হয়েছে কিন্তু এ গাছ এই গ্রামের মতোই কখনো মরে নাই, আজ সেই জীবন্ত অশ্বত্থের জলসমাধি হয়েছে গ্রামের সঙ্গে। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে তাদের ভালোবাসার দামোদর আগে কখনো এমন করেনি, বন্যা নেই বর্ষা নেই, জল বাড়তে লাগল চুপে চুপে, নীরবে, নিঃশব্দে, প্রথমে নদীর পাড়ের জমি তারপর জল ঢুকতে লাগল গাঁয়ের বাড়িতে। এ কোন দামোদর? এ তার কেমন ব্যবহার? সে চিরকাল কুলুকুলু করে বয়েছে আর কখনো কখনো বর্ষায় প্রবল গর্জনে দুপাড় ভাসিয়ে দিয়ে গেছে, তাতেই গ্রামের লোকেরা অভ্যস্ত। আজ সহসা সে নিঃশব্দে নীরবে গ্রামের পর গ্রামকে ডুবিয়ে, কত মানুষের কত দিনের সঞ্চিত সম্পদ, ভালোবাসার ধন, সম্পর্ক আর স্মৃতি চুরি করে তার বিশাল জলরাশি নিয়ে শক্তিমান নির্দয় তস্করের মতো তৃপ্ত হয়ে শুয়ে আছে। তার জলের উপর দিয়ে বিষাণের দীর্ঘশ্বাসের মতো হাওয়া বইছে, মাঝে মাঝে ঘর ছাড়ার আগে সোনামণির মুখচেপে কান্নার মতো গোঁ গোঁ আওয়াজ, দামোদরের আটকে পড়া জল কাঁপছে।
চারিদিকে যখন কোন আশা নাই তখন একদিন কে যেন পড়ন্ত বেলায় হেঁকে হেঁকে বলে গেল তেলকুপির মন্দির ডুবছে। একটা একটা করে গ্রাম, জমি, রাস্তা ডুবে গেল, তেলকুপির এতো বড় উঁচু কত বছরের পুরানো মন্দিরটাও জলের তলায় চলে গেল। যতদূর চোখ যায় জল আর জল সব ধান ভর্তি মাঠ জলের তলায়। গ্রামটাকে বাঁচানোর জন্য বিষাণের মতো গাঁয়ের মরদরা দৌড়াদৌড়ি করেছে কদিন।সবাই মিলে পাঞ্চেতের ডিভিসির অফিস গিয়েছিল, বাবুটা বলেছিল কিছু করার লাই, গরমেনট যখন বলেছে বাঁধ তখন হবেই। যার চোখে কেউ কখনো জল দেখে লাই সেই বুড়ো কিনু মাঝি কেঁদে ফেলেছিল বললে আমাদের যে সব চলে যাবে গো, কুথায় যাবো আমরা ব্যাটা বিটি পরিবার লিয়ে, আমরা খাবো কি? ডিভিসির বাবু বুললে ইখানে তো কত কাজ হছে বাঁধ তৈরি হচ্ছে, কারখানা তৈরি হচ্ছে, এস কাজ কর। বিষাণ কাতর হয়ে বলে, আমরা কাজ চাইনি গো, আমরা তো তোমাদের কাছে কিছুই চাই নাই, গাঁ ডুবে গেলে আমরা থাকবো কুথায়? । নীরবে সেই প্রশ্ন ডিভিসির বাবুর অফিসে ঝুলে থাকে।
ছয়
বাবলা গাছটার হলুদ ফুল আর পাতা সকালের হালকা হাওয়ায় জিরি ঝিরি করে কাঁপছে। তার পাশে সনাতন চুপ করে দাঁড়াল। মাঠের উঁচু আলের পাশের খাল দিয়ে কুলকুল করে জল বয়ে যাচ্ছে। সকালের সূর্যের আলোয় রুপোর মতো চকচকে জলের দিকে সে তাকিয়ে থাকল। দুরে মাঠে মাঠে লোক কাজ করছে , জল আসায় সব চাষিরা ব্যাস্ত, কেউ জমির আল ঠিক করছে, কেউ নিড়েন করছে, কেউ দেখছে পোকা লেগেছে কিনা। সনাতনের বুকে একটা হালকা নরম সুখ ছড়িয়ে পড়ছে, একটা হালকা আরাম। ওর মাঠ ভরে আছে সবুজ গর্ভবতী ধানে, সব ফুলুনোর অপেক্ষায়। এবার ধানগাছগুলো খুব পুরুষ্টু হয়েছে, অনেকগুলো করে পাশকাঠি ছেড়েছে, এই সময় চারিদিকের সবুজ মাঠ আশ্বিনের রোদে ঝলমল করছে, তদের মধ্যে দিয়ে হালকা হাওয়া বিলি কেটে যাচ্ছে। ও মুখতুলে দেখতে লাগল দুরে উঁচু বড় সরকারী ক্যনেলের পাড়, যেন পেটমোটা অজগর সাপ, মাঠের মধ্যে দিয়ে কতদুর চলে গেছে। শুরু হয়েছে সেই দুগগাপুরের বাঁধে আর ওদের গ্রাম ছাড়িয়ে গলসী, খানা পেরিয়ে কত দূর গেছে কে জানে।
যেদিন প্রথম এই ক্যানেলে জল এলো গ্রামে কি আনন্দ! মাঠ ভর্তি গ্রামের লোক দাঁড়িয়ে আছে, ছেলে ছোকরাগুলো ক্যানেলের পাড়ে দৌড়াদৌড়ী করছে। ও চুপ করে দারিয়েছিল, বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছিল আর ভাবছিল এবার আর কেউ ওকে আটকাতে পারবে না ও দেখাবে চাষ কাকে বলে, কবে থেকে ও ভাবছে সময়ে জলটা পাই তারপর দেখবো। আজ ওর সেই স্বপ্ন সফল হোল। ওর মা বলত তুই চাষ চাষ করেই ক্ষেপে যাবি, ও হাসতে হাসতে বলত আমি চাষার ব্যাটা মাঠে কাদায় না দাঁড়ালে আমার ভাত হজম হয় না।
ভাবছিল উত্তরের কলাবাগানের মাঠের আউস ধানটাও দেখে আসবে, ঐ ধান কাটা হলেই এবার কেবল সর্ষে দেবে না একটু বড় করে আলুর চাষ করবে। কলাবাগানের পুকুর পাড়ে সাঁওতাল মুনিষদের থাকার একটা পুরানো ঘর আছে, ক বছর ঘরটা ব্যবহার হয়নি এবার সারাতে হবে। গাঁয়ের বড় রাস্তায় ওঠার আগে দেখল রাস্তা দিয়ে ভাল্কির বিমল সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল, সে সনাতনকে দেখে দাঁড়াল বলল কি কাকা এখনো মাঠে? এবারে ধান কেমন? সনাতন এক মুখে হেসে বলল খেজুরছড়িটা খুব ভাল হয়েছে, কলমকাঠী লঘুটা মনে হচ্ছে একটু কম হয়ে যাবে। তারপর জিজ্ঞাসা করল কোথায় গেছিলি? সে বলল গলসী গেছিলুম মায়ের ওষুধ আনতে গো।বিমল সাইকেলে উঠতে উঠতে একমুখ হেসে বললে যবে থেকে জল এলো তোমার ধানের মরাইয়ের তো আদ গাদ নাই গো কাকা। সনাতন হেসে বলে তোদেরই বা কম কি? যাই বল কাকা এ তল্লাটে তোমার মতো চাষি কেউ নেই, এবারে কাকা তোমায় ছাড়বো না বর্ধমানের মিহিদানা কাওয়াতে হবে। সনাতন মুচকি হেসে কাঁধে গামছটা চেপে বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করল, ভাবল খেয়ে দেয়ে বেলা পড়লে কলাবাগান যাবে, রোজ রোজ দেরি হচ্ছে, স্বপনের মা না খেয়ে বসে থাকে।
ও পুকুর থেকে চান করে ফিরলে দাওয়ায় ওকে ভাত দিতে দিতে বিলাসী বলবে মাঠে তো এখন কাজ নাই কি কর বল দেখি? ছেলেটা তো সকালে আল বেঁধে, জল দেখে এলো। তারপর ওর খাওয়া হলে থালা তুলে নিজে বসে। সনাতন তখন আপন মনে হুঁকো টানে, আর খানিকক্ষণ পর ওর মন ছটফট করে মাঠে যাবার জন্য। কিন্তু এখুনি উঠলেই বউটা বলবে ঘরে তোমার মন টেকেনা। মনে পড়লো বিলাসী অনেকদিন ধরেই গয়না নিয়ে খোঁটা দেয়, বলে ‘আমার সব গয়নাই তো বিয়েতে বাবা দিল, তার থেকে সে বছর দু গাছা চুড়ি বন্ধক দিয়ে সে বছর চাষ করলে’। ভাবছিল এবারের পোষ মাসের ধান কাটা হলেই চুড়িগুলো ছাড়িয়ে আনবে আর সামনের বছর বিলাসীর হাতের দুটো বাউটি গড়িয়ে দেবে, মেয়েটাও তো বড় হচ্ছে। উপরের চালে বাসা বাঁধা নন্দর পোষা পায়রাগুলো এক এক করে বাসায় ফিরছে ।
সাত
পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় উঠোনটা ভাসছে, বারন্দার হ্যারিকেনটা নিবিয়ে বিলাসী রান্নাঘর গোছাতে গেল। সনাতন আরাম করে দাওয়ায় হুঁকো টেনে ঘরে শুতে গেছে খানিকক্ষণ আগে। আজ সে গলসী গিয়েছিল, ছেলে মেয়েগুলোর জন্য ষ্টেশনের নিতাই ময়রার দোকান থেকে মণ্ডা আর রসগোল্লা কিনে এনেছে। এখন সে গলসী গেলে আর তার বাবার মতো ফতুয়া পরে যায় না ধুতির সঙ্গে শার্ট পড়ে। রোজকার মতো বড় ঘরটায় স্বপন আর নন্দ বড় তক্তায় শুয়েছে, কুমুদ ওদের ঘরের খাটে সনাতনের পাশে ঘুমে কাদা। একটু আগে ছেলে মেয়ে দুটো মিষ্টি নিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো, বিলাসী কুমুদকে দু ঘা দিতে সনাতন বললে ‘আহা মারছো কেনো, একটা মিষ্টি দাওই না’। বিলাসী রান্নাঘর গোছাতে গোছাতে গজগজ করছিল লোকটা মেয়েটাকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছে, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সংসার করতে হবে না? কে দেখবে তখন শুনি, মেয়েছেলে একটু মানিয়ে চলবে তা না বাপের আদরে মাথায় উঠছে।
সনাতন ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল বছর দুই আগে মানকর থেকে বাড়ি ফেরার কথা। সেবার পোষ মাসের ধান ঝাড়ার পরই ও বিলাসীকে মনোরঞ্জনের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল আর বিলাসীর মনোমত নকশার আড়াই ভরি সোনার বাউটি গড়ানোর আগাম দিয়ে এসেছিল। সেদিন মনোরঞ্জন স্যকরার দোকান থেকে বিলাসীর বাউটিদুটো নিয়ে সে রেল গাড়িতে বাড়ি ফিরছিল। ভাবছিল বউটার হাতে মানাবে, বাউটি দুগাছ ধুতির কোমরের কোঁচায় বাঁধা ছিল। এমন সময় তার চোখে পড়ে রেলের কামরার দরজার কাছে বসা এক বুড়ো সাঁওতাল আর কামিন। শুকনো কালো পাকা সর্ষে ফলের মতো বিষাণ কামরার দরজার কাছের মেঝেয় দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে, খালি গা পরনে হলদে হয়ে আসা একটা ধুতি। তার গায়ে গা লাগিয়ে দুই হাটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসেছিল সোনামানি, পরনে একটা ছেঁড়া ময়লা সবুজ সাড়ি। দেখলে বোঝা যায় দুজনেই অনেকদিন খায়নি, সনাতনের মায়া হয়েছিল। ও ভেবেছিল সাঁওতালগুলোর এই এক দোষ খালি মদ খায়, না হলে ওদের মতো কাজের কে আছে? মাঠের কাজে ওদের তুলনা হয় না। উঠে গিয়ে ও মাঝিটাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো কোথায় যাবে? সে কোন সারা দেয় নাই কেবল ওর মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, চোখে না কোন ভয়, না কোন রাগ কেবল সীমাহীন শূন্যতা, সনাতন বেশিক্ষন সেই চোখের দিকে তাকাতে পারেনি। ও জিজ্ঞাসা করে কাজ করবে কিনা? কিছু বলে নাই কেবল ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে ছিল। সনাতনের সঙ্গে সেদিন ওরাও নেমেছিল গলসী স্টেশনে।
সে ওদের দুজনকে ওদের কলাবাগানের মুনিষদের থাকার যে ছোট ভাঙ্গা ঘর ছিল সেই ঘরে থাকতে দিয়েছিল। বিষাণ সেটা কোন রকমে সারিয়ে থাকার মত করেছিল। এখন ওরা সনাতনের চাষ দেখে, সারা দিন পরিশ্রম করে দুজনে, কোন কিছু চায় না। কিন্তু সূর্য ডুবলেই বুড়ো বুড়ি প্রচুর হাঁড়িয়া খেয়ে চুপ করে বসে থাকে কলাবাগানের ঘরের সামনে। কতবার সনাতন আর বিলাসী জিজ্ঞাসা করেছে ওদের বাড়ির কথা ছেলে মেয়ের কথা কিন্তু দুজনে নীরবে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে। সনাতন ভাবে আদিবাসীরা এমনিতেই কম কথা বলে।
মাঠের মাঝে সাদা জ্যোৎস্নার চাদরে মোড়া কলা বাগানে ঘরের বাইরে একা বসে আছে বিষাণ। কে জানে রাত কত হবে। ভাবছিল সর্ষেগুলো এবার কাটার সময় হয়ে গেছে, মাথার মধ্যে ভেসে এলো মাঠ ভরা হলুদ সর্ষে ফুল আর সবুজ গাছ, হঠাৎ সেগুলো হয়ে গেল শুধু শুকনো শুকনো কাঠি তাতে লম্বা লম্বা শুকনো কালো ফলের মধ্যে সর্ষের দানা। ও দেখতে পাচ্ছিল গাছ কেটে মাড়িয়ে সর্ষে বার করে নিয়ে যাচ্ছে, ছিবড়ে গাছগুলো জ্বালানী হয়ে জ্বলছে।
চোখে ঘুম আসে না ও ঝিমোয়, শিমুলগাছটাকে দূর থেকে এক প্রেতের মতো লাগে। মাঠের দমকা হাওয়ায় তার ডালগুলো দুলছে দেখে সে দিকে তাকিয়ে বিষাণ দেখে সোনামণি আকাশের দিকে হাত তুলে বুক চাপড়ে কাঁদছে। সে কতদিন আগের কথা, দিন কাল সব হারিয়ে যায়, এখন ঘরের মেঝেয় কাঁথার উপর হাঁড়িয়া খেয়ে সোনামণি গুটিয়ে শুয়ে আছে, সেই লম্বা চওড়া সাঁওতাল মেয়েটা এইটকুন হোয়ে গেলো। বিষাণ প্রতিদিন অনেক অনেক হাঁড়িয়া খায় কিন্তু নেশা ওর হয় না। ও ঝিমোয় আর দেখে মাইথনে ওরা পাথর ভাঙ্গছে সার বেঁধে, ঘর বলতে একটা ছিটেবেড়ার ঝুপড়ি, তাতে পাঁচটা লোক হয় না, তবু সব এক সঙ্গে ছিল। চারিদিকে শুধু ধুলো আর ধুলো, সারাদিন পাথর ভাঙ্গা, সোনামণির অমন সুন্দর হাতে বড় বড় ফোস্কা পড়েছিল। একদিন ওরা পাথর ভেঙ্গে ঘরে ফিরে দেখে সব টাকাপয়সা সোনামণির গয়না যা গ্রাম থেকে এনেছিল কারা সব নিয়ে চলে গেছে। ওরা কখনো গাঁয়ে চুরির কথা শোনে নাই। ও এদিক ওদিক দৌড়েছিল, গলা ছেড়ে সোনামণি কেঁদেছিল ও কি করবে তাই বুঝতে পারেনি। চারটে ছেলেমেয়ে ঘরের মেঝেয় ভয়ে চুপ করে বসে ছিল।
সারাদিনে সবাই যা টাকা পেতো কোন রকমে ভাত ডাল খেয়ে পেট ভরত না। না খেয়ে খেয়ে ছেলেগুলো রোগা হয়ে গেল। অভাবের ঘরে রোগের অভাব হয় না তিন দিনের তড়কা জ্বরে কোলের মেয়ে ভানু চলে গেল, যাবার আগে মেয়েটা চারিদিকে ওর সেই পুতুলটা খুজছিল। সোনামণি কাঠের মতো মরা মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো। চোখে জল নাই কেবল আগুন বেরচ্ছিল, আশেপাশের ঝুপড়ীর লোকে বলেছিল ডাক্তার ডাকতে, ডিভিসির হাসপাতালে নিয়ে যেতে। বিষাণ হাঁ করে শুনেছিল ডাক্তার কি হাসপাতাল কি সে জানে নাই কখনো, ওর চোখে দামোদরের থেকেও বেশি জল ছিল সেদিন।
একদিন জোলোকে ঠিকাদারের লোক কাজের লোভ দেখিয়ে কুথায় নিয়ে গেল, ও আর মনেও করতে পাড়ে না, বলেছিল তিন মাস পরে অনেক টাকা নিয়ে আসবে। সোনামণি কেঁদেছিল ছাড়তে চায় নাই, সেই যে গেল আর ফিরে এল না। হুহু করে হওয়া দিচ্ছে শিমুল গাছটা দুলছে দানার মতো। বুধুটা বসতির বাজে ছেলেদের সাথে মিশে নেশা ধরলে তারপর একদিন কোথায় চলে গেল। পাগলের মতো দুজনে বুধুকে খুঁজেছিল, শুনেছিল ও ঝরিয়ার কয়লা খাদানে গেছে। যেটুকু টাকা ছিল আর লোকের হাতে পায়ে ধরে ঝরিয়া পৌঁছায়। সেখানে মাটির নীচে আগুন জ্বলছে দিনরাত, তারি মাঝে কালো কালো কয়লার ধুলো মাখা ছেলে বুড়ো দিনরাত কয়লা তুলছে, চুরি করছে। দুজনে অনেক খুঁজেছিল কিন্তু বুধুকে আর পেল না, কে বলেছিল ঐ নীচের আগুন যার খিদে মেটা না সে নাকি বুধুকে খেয়ে নিয়েছে।
সোনামণি ছোট ছেলেটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখত। খালি ভয় ছিল এটাও না চলে যায়। এক বছর ঝরিয়ায় কয়লার খাদানে দুজনে বাঁচার চেষ্টা করে কিন্তু এই কয়লার ধুলোয়, উপোষে আর দেশী মদে ওরা দুজনে শেষ হয়ে আসছিল। আর এরই মধ্যে একদিন ভেদ বমি করতে করতে জগদীশও হেঁচকি তুলে চুপ হোয়ে গেল। সেদিন এই শিমুল গাছটার মতো আকাশ হাত তুলে বুক চাপড়ে সোনামনি কেদেছিল।
শক্ত হয়ে বিষাণ বসে আছে কলাবাগানে ওর ঘরের সামনে। চারিদিকের চাঁদের আলোয় মাঠ ভাসছে, শিমুল গাছটা দুহাত তুলে মারাং বুরুর কাছে বিচার চাইছে আর পিছনে ঝাঁকাল আমগাছের ছায়াটা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকছে, দুই একটা জোনাকির আলো জ্বলে উঠল অন্ধকারে নাকি বিষাণের চোখ।
(পাঞ্চেত বাঁধ ১৯৫৯ সালে তৈরি হয়, সেই বাঁধের জলে ১০০ গ্রামের ৭৩৬৫০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেই সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দেবার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবার বিষাণের পরিবারের মতো হারিয়ে যায়। ডিভিসির কর্মকর্তারা জানান যে ১৯৫০এর দশকে ৪৮৬২ জনকে ডিভিসিতে চাকরি দেওয়া হয়। এর পর ১৯৭৭ সালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আরো ১০২ জনকে চাকরি দেওয়া হয়। ডিভিসির কর্মকর্তারা এও জানান যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকেরা সঠিক কাগজ দেখায় তাহলে তাদের চাকরির কথা বিবেচনা করা হবে। সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচার্য ২০০৯ সাল পর্যন্ত বারবার পাঞ্চেতের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণ দেবার কথা সংসদে তোলেন)
(সূত্রঃ
১)https://ejatlas.org/conflict/panchet-dam-and-the-damodar-valley-project-jharkhand-india,
২)https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/panchet-dam-land-protest-after-56/articleshow/5110960.cms)