সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে দশ ক্রোশ দক্ষিণে ভাগীরথী নদীর পূর্বপাড়ে বেলডাঙ্গা জনপদ। অদূরেই মজুলা গ্রামে বিবেকানন্দের গুরুভাই স্বামী অখন্ডানন্দজী মহারাজের অনাথ আশ্রম। এখানের সারগাছি গ্রামে 'যতমত ততপথ'-বহুত্ববাদের ভারতীয় ভাবধারায় পরিচালিত সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম ও বিদ্যালয় অবস্থিত। বেলডাঙ্গার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মেধাবী ছাত্ররা এই আশ্রম-বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করে।
উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের সংযোগী ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ও পূর্বরেল পথ সমান্তরালে বেলডাঙ্গার উপর দিয়ে গেছে। এই জাতীয় সড়কের পাশেই বেলডাঙ্গার হাট। মালদা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশপরগনার লক্ষাধিক ক্রেতা-বিক্রেতার সাপ্তাহিক সমাগম ঘটে এই হাটে। এখানে কাপড়, গবাদিপশু ও আনাজের ঝোঁ-কেনা হয়। বর্তমানে এই হাটের মালিক দেবকুন্ডুর জমিদারের উত্তর প্রজন্ম, যাঁদের পারিবারিক মসজিদের মুসাফিরখানায় কিছুদিন আগে পর্যন্ত অতিথি আপ্যায়ন করা হতো।
শহর বেলডাঙ্গার মানুষের প্রধান জীবিকা ব্যবসা। এখানের স্বর্ণালঙ্কারের ব্যবসা দীর্ঘদিনের। সোনাপট্টির ঘরে ঘরে গহণা তৈরির কারখানা। কয়েকশত তরুণ যুবক কারখানায় নিযুক্ত। বহিরাগত মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের পাট-সর্ষের গুদামজাত ব্যবসাও বহুদিনের। বেনে, ময়রা, গোয়ালা, শাহা, ভাণ্ডারীদের ছোট-বড় প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক ব্যবসা রয়েছে।
শহর বেলডাঙ্গাকে বৃত্তাকার ঘিরে আছে গ্রামীণ বেলডাঙ্গা। এখানকার মানুষের জীবন জীবিকা কৃষিভিত্তিক। ভাগীরথীর পলি সমৃদ্ধ উর্বর মাটিতে ধান, গম, পাট, সর্ষে, আলু, কপি, লঙ্কার চাষ সহজেই হয়। বেলডাঙ্গার কপি ও লঙ্কার পরিচিতি পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে উড়িষ্যা বিহারেও বিস্তৃত। স্বাধীনতার সময়কাল থেকেই কৃষিজীবী মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। নির্বাচনে চিরকাল তাঁরা জাতীয় রাজনীতিতেই সংযুক্ত থেকেছে। মুসলিম লীগ অবশ্য প্রতি বিধানসভা ও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। কিন্তু কখনো মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থন পায়নি। বেলডাঙ্গা রাজনীতিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও জাতীয় বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (আর এস পি)। পরিমল ঘোষ, দেবশরণ ঘোষ, আব্দুল লতিফ, নুরুল চৌধুরী, তিমিরবরণ ভাদুড়ী হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত ভোটে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। তখনও ধর্মীয় বিভাজন বা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ মানুষে মানুষে ঘটেনি। এমনকি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেও তিমির বরণ ভাদুড়ী বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়।
১৯৮১ সালে বেলডাঙ্গা পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু জনবহুল এলাকা নিয়ে পৌরসভার মানচিত্র তৈরি করে আর-এস-পি নেতৃত্ব। তাতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর হাতে পৌরসভা পরিচালনার ক্ষমতা নিশ্চিত হয়। পার্শ্বস্থ বর্ধিষ্ণু দেবকুন্ডু অঞ্চল পৌরসভায় অর্ন্তভুক্তির দীর্ঘ আন্দোলন চললেও ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মুসলিম মহলে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়। এই পৌরসভার ক্ষমতা দখল নিয়ে নয়ের দশকে বামফ্রন্টের দুই শরিক আর-এস -পি ও সি-পি-আই (এম)’র মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। দুটি দল পৌরসভা, পঞ্চায়েত, কলেজ ও সমবায় সংস্থার নির্বাচনে মুখোমুখি এসে পড়ে। সিপিআইএমের আগ্রাসনে আরএসপি দল অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। তাতে সামগ্রিকভাবে বামপন্থী আন্দোলন ব্যহত হয় এবং উভয় সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই সময়েই ভারতের আকাশে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্ক ঘণীভূত হয়। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস ও ক্রমে ঘৃণা-বিদ্বেষের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। বামপন্থী আন্দোলন স্তিমিত হওয়ায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন শিথিল হয়ে পড়ে। মানুষে মানুষে দীর্ঘদিনের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দূর্বল হয়ে যায়।
ইতিপূর্বে বেলডাঙ্গার খোদাবক্স সাহেব (সাংসদ) কয়েক বিঘা জমি ভুদান আন্দোলনের নেতা বিনোবা ভাবেকে দান করেছিলেন। পরে হাতবদল হয়ে এই জমিতে ভারত সেবাশ্রম সংঘ, বেলডাঙ্গা শাখা, প্রতিষ্ঠিত হয়। বাবরি-মসজিদ- রাম-জন্মভূমি আন্দোলন নানা ঘটনায় তীব্রতর হলে বেলডাঙ্গা এলাকার হিন্দু-মুসলমান পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনীত করে। জাতীয় কংগ্রেস থেকে গোলাম কিবরিয়া, মহঃ সফিউজ্জামান বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়। বেলডাঙ্গার হিন্দু সম্প্রদায় ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রধান প্রদীপ্তনন্দজী মহারাজের প্রতি অধিকমাত্রায় মুখাপেক্ষি হয়ে পড়ে।
প্রদীপ্তনন্দজী মহারাজ একজন হিন্দু সন্ন্যাসী ও ধর্মগুরু। তিনি হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবল সমর্থক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনায় কঠোর বিরোধী। তাঁর ভাবনা হিন্দু সমাজে সঞ্চারিত হয়। নতুন নতুন পূজা অর্চনা, শোভাযাত্রা, ধর্মীয় মেলা শুরু হয়। নানা জাতপাতে বিভক্ত হিন্দু সমাজ সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। হিন্দুরাষ্ট্রের আশা-আকাঙ্ক্ষায় তাঁরা আবিষ্ট হয়ে পড়েন।
২০০০ সালে ভাগীরথী নদীর পাড় ভেঙে আকস্মিক বন্যায় বেলডাঙ্গায় বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যায়। শহরের পাট সর্ষের গুদাম, মনোহরী, মুদিখানা, কাপড়ের দোকান তিনদিন যাবৎ ডুবে থাকে। তাতে শহর বেলডাঙ্গায় ব্যবসায়ীরা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এই আর্থিক দূরাবস্থা কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০০১ সালে বেলডাঙ্গার মাঝপাড়ায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি হয় ভারত সেবাশ্রম সংঘ পরিচালিত জগদ্ধাত্রী পুজোয় শোভাযাত্রা নিয়ে। এই অশান্তিতে একজন মুসলমান নিহত হয়। অশান্তির পরে দিনে দিনে বেলডাঙ্গায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র বদলে যায়। অনেক বড় বড় মুসলমান ব্যবসায়ী আত্মপ্রকাশ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রেতার সুবাদে তাঁরা ব্যববা-বাণিজ্যে অগ্রণী হয়ে ওঠে।
শহর বেলডাঙ্গায় চারিপাশের অধিকাংশ গ্রাম মুসলমান প্রধান। তাঁরা মুখ্যত কৃষিজীবী। কয়েকটি গ্রামে চুলের ব্যবসাও আছে। অশিক্ষা ও কুসংস্কার তাঁদের নিত্যসঙ্গী। ২০০১ সালে সারা দেশে সর্বশিক্ষা অভিযান চালু হলে ঘরে ঘরে শিক্ষার আলোড়ন ওঠে। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় অভিমুখী হয়। মুসলমান সমাজে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায়। এমনকি সরকারি চাকরিতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্কের ঢেউ গ্রাম জীবনেও আছড়ে পড়ে। মুসলমান সমাজে ধর্মীয় সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। গ্রামে নতুন নতুন মসজিদ গড়ে ওঠে। পুরানো মসজিদের ব্যয়বহুল সংস্কার হয়। দুটি বৃহৎ খারিজি মাদ্রাসা সত্ত্বেও নতুন নতুন মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। সারা রাত্রি ব্যাপী ব্যয়বহুল ধর্মসভা, বিপুল সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। বিবাহের মতো অনুষ্ঠান মসজিদ কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। ইসলামের বিশুদ্ধবাদী গোষ্ঠী সুফি সাধকের ভাবনায় কুঠারাঘাত করে। হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিত মুক্ত সাধনার ক্ষেত্রগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। এক সময়ে ধান, পাট, গম, কপি, লঙ্কার চাষ লাভজনক ছিল। বিগত একদশকে বীজ, সার ও বিষের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ কৃষকের উৎপাদিত ফসলের দাম নাই। একারণে লোকসানের কৃষিকাজে কৃষকের আর উৎসাহ নাই। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে নির্মাণ কাজে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়। উচ্চহারে পারিশ্রমিক মেলায় গ্রামগঞ্জে স্রোতের আকার নেয়। মুসলমান সমাজে অষ্টম শ্রেণির পর বিদ্যালয় ছুট হওয়ার হার সর্বাধিক। ফলে দিনে দিনে অশিক্ষার হার পুনরায় বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে সরকারি বিদ্যালয়ে লকডাউন ঘোষণা হলে মুসলমান সমাজ শিক্ষায় চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু কিছু ছাত্রদের খারিজি মাদ্রাসায় চলে যাওয়ার ঘটনা নজরে আসে।
বর্তমানে মুসলমান সমাজের ১৪-১৯ বছরের কিশোর যুবকদের বৃহদাংশের শিক্ষার সঙ্গে কোনো প্রকার সংস্রব নাই। এই বয়সকালে তাঁদের স্কুল-কলেজে পাঠ্যরত থাকার কথা ছিল। এঁদের অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিক, নির্দিষ্ট উপার্জন করে ও উৎচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর বেলডাঙ্গা স্টেশনে অগ্নিসংযোগে এঁদেরই দেখা গিয়েছিল।
বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি আন্দোলনের তিন দশকে দেশের আর পাঁচটি স্থানের মতো বেলডাঙ্গায় হিন্দু অধিক হিন্দু ও মুসলমান অধিক মুসলমান হয়েছে। হিন্দু সমাজ হিন্দুরাষ্ট্রের ভাবনায় ও মুসলমান সমাজ কবর-কিয়ামত-জান্নাত-জাহান্নামের চিন্তায় বিভোর হয়েছে। এখানের হিন্দু সারাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও স্থানীয়ভাবে সংখ্যালঘু।
অন্যদিকে মুসলমান স্থানীয়ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এদেশে সংখ্যালঘু। এই সহজ হিসাব সম্পর্কে উভয় সম্প্রদায়ই অবগত। একারণে বিস্তর মানবিক ব্যবধান সত্ত্বেও বেলডাঙ্গার হিন্দু-মুসলমান পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতায় সহবস্থান করে চলেছে।
গত ১৬ নভেম্বর বেলডাঙ্গা শহরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। একটি পূজা মণ্ডপের আলোক ডিসপ্লেতে মুসলমান ধর্মের ভাবাবেগে আঘাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। সমাজ মাধ্যমের কল্যাণে দ্রুত গ্রাম-শহরে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ প্রশাসন তৎপর হলে সেদিনের মতো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কয়েকজন আহত হয়। পূজা মন্ডপ থেকে বাড়িঘর ভাঙচুর হয়। গুজব থামাতে সরকার সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।
সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এই অশান্তি সৃষ্টিতে হিন্দু বা মুসলমান কোনো সম্প্রদায়ের সংযোগ দেখা যায় না। বিষয়টি ধর্মীয় আকারে প্রকাশ পেলেও আদতে রাজনৈতিক বলেই অনুমেয়। পশ্চাতে হয়ত কোনো ষড়যন্ত্রী সক্রিয়। ভারতবর্ষের রাজনীতির মুখ্য উপাদান ধর্মীয় মেরুকরণ।
এদেশে মন্দির মসজিদ বিতর্ক, দাঙ্গা হাঙ্গামা অশান্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বহুল পরীক্ষিত পদ্ধতি। পদ্ধতির মূলে রয়েছে গণিতের 80 : 20 অনুপাত। সস্তা ও সহজ উপায়। মানুষকে ধর্মের নামে বিভক্ত করে দিলেই ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যাওয়ার নিশ্চিত সিঁড়ি। তাই বাবরি মসজিদ রাম জন্মভূমি বিতর্কে বিজেপির পর্বত তুল্য সাফল্য দেখে ছোট বড়ো অনেক নেতানেত্রী এখন অনুপ্রাণিত।
সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের বাস মুর্শিদাবাদ জেলা ইতিমধ্যেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। গত লোকসভা নির্বাচনে তার অনুশীলন গঙ্গাপারে সকলে দেখেছে। "এক ঘন্টায় জেলার 30 শতাংশ হিন্দুকে কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারি" বলে একজন বিধায়কের হুঙ্কারে বহরমপুর সংসদীয় কেন্দ্রের ভোটের হিসাব কতখানি উলোট পালোট হয়ে যায়, কংগ্রেস প্রার্থী অধীর রঞ্জন চৌধুরী সবচেয়ে বেশি জানে।
এটাই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বাস্তবতা। কত সস্তা ও সহজ উপায়। সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নাই। কৃষি শিল্প স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও বিকাশের কোনো উদ্যোগ নাই। দ্রব্যমূল্য, বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত সমস্যার কোনো সমাধান নাই। বড় কথা কোনো প্রয়োজন নাই। ধর্মের নামে একটি কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই ব্যস! বিরোধীরা সব সাফ।
"বেলডাঙ্গায় বাবরি মসজিদ হবে"-এমন উলঙ্গ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চিন্তা চেতনাহীন নেতানেত্রীদের পক্ষেই সম্ভব। বেলডাঙ্গার অদূরেই শিল্পতালুকের জন্য নির্দিষ্ট প্রাচীর ঘেরা কয়েক শত একর জমি হাহাকার করছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা শিল্প কারখানার অপেক্ষায়। না, নেতানেত্রীদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। তাঁদের চায় সস্তা ও সহজ উপায়।
মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলমান সমাজে নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও ভূমিহীন পরিবারে আর শিক্ষা নাই। ধর্মীয় উন্মাদনার কানাগলিতে পথ হারিয়েছে তারা। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকদের এটাই উর্বর ক্ষেত্র। তাই তো ধর্মীয় জলসা মঞ্চে যখন ঘোষণা হয়, "বেলডাঙ্গায় বাবরি মসজিদ হবে", লক্ষ কন্ঠে ধ্বনি উঠে "আল্লাহু আকবার"।
বর্তমানের এইসব কুটিল ও জটিল অবস্থানের পরিণতি কী হতে পারে, ভারতীয় রাজনীতির বিন্দুবিসর্গ জ্ঞানহীন মানুষেরা জানে না বা তোয়াক্কা না করায় এর বিপরীতে এই জেলায় ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক এক রাজনীতি দানা বেঁধেছে। বিজেপি ও আর-এস -এস মুর্শিদাবাদ জেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেছে।
গতবছর সংসদে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে, মুসলমান জনবহুল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলা এবং ঝাড়খণ্ডের আরারিয়া, কাটিহার ও কিষানগঞ্জ, পাঁচটি জেলা নিয়ে পৃথক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল গঠনের ও এন-আর-সি করার দাবি জানায়।
নিছক একটা দাবিই নয়। মুর্শিদাবাদের বিজেপি বিধায়ক গৌরি শঙ্কর ঘোষের নেতৃত্বে বহরমপুর শহরে এই দাবির সমর্থনে দুটি বৃহৎ মিছিল হয়। ভাষণে বলা হয়, পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ থেকে জেলায় অজস্র ধারায় অনুপ্রবেশ ঘটছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। জেলার জন বিন্যাসে ভারসাম্য হারিয়ে গেছে যা ভারতবর্ষের সার্বভৌম ও নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক। অবিলম্বে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে কেন্দ্র সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা যে আগামী নির্বাচনে বিষয়টি বিজেপির দলীয় এজেন্ডা হতে পারে।
ভারতের গোদী মিডিয়া বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবেদনের পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ জেলার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে চলেছে। তাদের বিশ্লেষণ, বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। এবং বর্তমানে বাংলাদেশে চীনের আধিপত্য বাড়ছে। ফলে চীন বাংলাদেশ হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় পৌঁছে যাবে যা ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য বিপজ্জনক।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলাম ও হেফাজতে ইসলামের মতো মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ইতিমধ্যে ইউনুস সরকার বহু জঙ্গিকে মুক্তি দিয়েছে। জঙ্গি সন্ত্রাস বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনুমান করে মুর্শিদাবাদ জেলাকে পাখির চোখ করেছে বিজেপি ও আর-এস-এস।
ফলে অনুমান করা যায়, আগামী দিনে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগ্যাকাশে দূর্যোগের ঘন কালো মেঘ ক্রমে ঘনীভূত হতে যাচ্ছে। তারই মধ্যে বাবরি মসজিদ নির্মাণের সস্তা রাজনীতি জেলাবাসীর বিপন্নতা বৃদ্ধি করবে। যত বেশি ধর্মীয় উন্মাদনা বাড়বে, কেন্দ্রীয় সরকারের কশাঘাত তত বেশি নেমে আসবে। এই সহজ কথাটি জেলার মুসলমান সমাজকে বুঝতে হবে।
আগত বিপন্নতা থেকে মুক্তি একটিই পথ, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জেলাবাসীর মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ, পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহবস্থান। এই উদ্যোগ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে। সাংস্কৃতিক চর্চাই পারে মানুষের সঙ্গে মানুষকে মেলাতে। আমাদের সাংস্কৃতিক পথেই হাঁটতে হবে, অন্তত আগামী প্রজন্মের জন্য।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারিগরদের সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে হবে আমরা শান্তিপূর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলায় আর একটি মণিপুর চাই না। আমাদের জেলার ঐতিহ্য ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভালোবাসার। আমরা জেলাবাসী মিলেমিশে এক হয়ে থাকতে চাই।