সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
(সেপ্টেম্বর ২০২৪, অষ্টবিংশ বর্ষ প্রথম-দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত অংশের পর)
৫
মেহেরপুরে হিন্দুদের মন ভেঙে পড়ল। ভয়ের ভাব জেগে উঠল আবার। কিন্তু শহরের ভিতর সাধারণ মানুষের ভিতর তার প্রকাশ কম। সদাব্যস্ত জীবন। সংসার চালাবার চিন্তাতেই দিন যায়। মেহেরপুরের পরিবেশ গ্রামীণ। এখানে পাড়াগুলো বৃত্তিভিত্তিক। তাঁতিপাড়া, বারুইপাড়া, তিলিপাড়া, বামুনপাড়া। পাড়াতে ওইসব সম্প্রদায়ের মানুষের জোটবদ্ধভাবে বসবাস। ফলে তারা অন্যদের কথা খুব একটা ভাবে না। আর কলকাতা নোয়াখালি-তাদের কাছ থেকে কত যে দূর। তাছাড়া দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ইত্যাদি চিন্তা-ভাবনা প্রধানত শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানদের মাথাব্যাথার ব্যাপার।
আমাদের পাড়ার কাছেই ছিল কলুপাড়া। তাদের পাড়ার পথ দিয়ে ছিল আমাদের চলাচল। কলকাতা কি নোয়াখালিতে যাই ঘটুক-অনুকূল গড়াই-এর বারান্দায় একই দৃশ্য। অনুকূল বসে গরুর জন্য বিচালি কাটছে, কজন মুসলমান চাষী বিড়ি টানছে আর হাসাহাসি করছে সবাই মিলে। ঘরের ভিতরে চোখ বাঁধা বলদ ঘানি টেনে চলেছে। শব্দ উঠছে-কো-ও-ও।
কিন্তু হোটেলপাড়ার রূপ ভিন্ন। মেহেরপুর মহকুমা শহর হলো, আদালত বসল। তখন উকীল এলেন, মোক্তার এলেন। মুহুরী এলেন, তাঁরা আদালতের কাছে একটা স্থানে বাড়ি ঘর তুলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। গড়ে উঠল একটি নতুন পল্লী। নাম হলো হোটেলপাড়া। সেখানে ব্রাহ্মণ, শূদ্র, হিন্দু-মুসলমান-পাশাপাশি বাস। এঁরা শিক্ষিত সম্প্রদায়। ফলে দেশের পরিস্থিতি বিষয়ে প্রতিক্রিয়া এখানেই প্রকট। হোটেলপাড়ার বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন নলিনাক্ষ ভট্টাচার্য। তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত উকীল। তাঁর বড় ছেলে কার্ত্তিক ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন আমার অগ্রজপ্রতিম সুহৃদ। তিনি তাঁদের পাড়ায় একটি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন গড়েছিলেন। সেই সংগঠন বিষয়ে আলোচনাসভায় এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। এই যুবক-এর বাড়ি পূর্ববঙ্গে--কুমিল্লার ব্রাহ্মণবেড়িয়ায়। যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ইতিহাসে এম.এ. এবং আইন পাশ। তখন তিনি বেকার। বাবার কাছে থাকেন। অমন একজন উচ্চশিক্ষিত যুবকের সঙ্গে মেলামেশা করতাম। এই যুবক ব্রাহ্মণ। বুঝলাম, জাতপাত বিষয়ে তিনি বেশ সচেতন। তাঁর ব্রাহ্মণত্ব নিয়ে গরিমা প্রকাশ করতেন। কলকাতায় দাঙ্গার পর তিনি মুসলমান বিদ্বেষ প্রকাশ করতে থাকলেন। এবং স্থানীয় মুসলমান সম্পর্কে সকলকে সতর্ক হতে বলতে থাকলেন। তিনি বলতে থাকলেন, দুর্গাপুজোর সময় ওরা আক্রমণ করতে পারে। আরেকটা সময় হচ্ছে ঈদ পরব। ওই সময় ওরা আক্রমণ করে এটা অনেক স্থানে দেখা গিয়েছে। সে সময় দেশের যা পরিস্থিতি--তাতে তাঁর এই সব বক্তব্যের প্রতিবাদ করতেন না কেউ, বরং মেনে নিতেন এবং ভীত হয়ে পড়তেন। আমি দেখতাম, ভদ্রলোক সর্বদাই এই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। তাঁর মুখে তখন অন্য কোন কথা ছিল না আর। ভদ্রলোক কপট ছিলেন না। ভীত হয়ে পড়েছিলেন। শুধু এক কথা--সতর্ক থাকুন, অবহেলা করবেন না, উদাসীন হবেন না, প্রস্তুত থাকুন।
একদিন সন্ধ্যায় আমাকে বললেন, আমার সঙ্গে একটু যাবেন?
-কোথায়?
-পাশের গোয়ালাপাড়ায়।
-ওখানে কেন?
-চলুন। ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি আলোচনা করেছি পরিস্থিতি সম্পর্কে। জানেন তো উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আত্মরক্ষা করে এসেছে ওদেরই সাহায্যে।
আমি বললাম, হ্যাঁ ব্রাহ্মণ তো চিরকালই ক্ষত্রিয় নির্ভর। তাই কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণরা রক্ষক ক্ষত্রিয়দের অবতার বানিয়েছেন। আমাদের সংস্কৃতির এটাই তো পরিচয়। তিনি হেসে গেয়ে উঠলেন- “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম।" গান থামিয়ে বললেন, যাই বলুন, এটা বাস্তব সত্য। চলুন। গোয়ালাপাড়ায় যাই। আমি তাঁর সঙ্গী হলাম।
হোটেলপাড়ার সংলগ্ন গোয়ালাপাড়া। চাষী পরিবার। সন্ধ্যায় তারা মাঠ থেকে ফিরেছে। গরুর গাড়ি পড়ে আছে। গরুগুলো খাওয়া দাওয়া করছে। কয়েকজন গরুর গাড়ির পাশে বসে বিড়ি টানছে--গল্প করছে।
আমার সঙ্গী তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, কিগো—সব ঠিক তো? পাড়ার সকলকে বলা আছে তো। তাদের ভিতর একজন বলল, আমরা ঠিকই আছি, এখনও আপনারা ঠিক থাকলে হয়। কাজের সময় তখন দেখা যাবে--আমরা মরলাম আর বাবুদের ডেকেও পাওয়া যাবে না। আপনাদের নিয়েই তো আমাদের ভাবনা। আমরা তো মুসলমানদের সঙ্গে এক সঙ্গে চাষবাস করি-ওঠাবসা-ভাব ভালোবাসা সবই। তারা কেমন আমরা তো জানি। এখন আপনারা অন্যরকম বলছেন-আমরা হিন্দু যখন তখন আপনাদের সঙ্গে থাকতেই হবে।
হ্যাঁ, আমরা শঙ্খ বাজালে তোমরা ছুটে যাবে। তোমরাও শঙ্খ তৈরী রাখবে। বিপদ বুঝলেই বাজাবে--আমরা ছুটে আসব।
-আসবেন তো? সেই লোকটি বলল।
এইসব কথাবার্তা শুনে আর ব্যবস্থার কথা জেনে আমি হতবাক। এঁরা এতোদূর পৌঁছেছেন?
তিনি পথে এসে আমাকে বললেন, আপনারা প্রস্তুত হচ্ছেন তো? পাড়ার সকলকে বলেছেন?
আমি বললাম, কি প্রস্তুত হবো?
তিনি বললেন, দা, শাবল, লাঠি ঘরে রাখবেন। আর ছাদে কিছু ইঁট জড়ো করে রাখবেন। পাড়ার সকলকে বলবেন।
আমি বললাম, আপনি মেহেরপুরের সব পাড়া কি দেখেছেন, আমার বাড়ি দেখেছেন?
-কেন?
-তাহলে এসব কথা বলতেন না।
-কেন?
-অধিকাংশই তো মাটির ঘর। খড়ের, নয়তো টিনের চাল--বাড়ির চৌহদ্দি ঘেরা কচার বেড়া দিয়ে। অনেকের বাড়িতেই ইটের বালাই নেই, ইট কেনার পয়সা কোথায়? আর ইট চালাবে কে? কখনো কি ওই যুদ্ধ করেছে তারা? হিন্দু-মুসলমান সব পাড়াই ওই রকম-চালে চাল ঠেকিয়ে বাস। শেখপাড়া আর তাঁতিপাড়ার মধ্যে ব্যবধান একটি ছোট রাস্তা, কয়েক হাত চওড়া। যদি হিন্দুরা আক্রমণ করে মুসলমান পল্লী কতোক্ষণ ছাই হয়ে যেতে? হিন্দু পল্লীর দশাও তাই। শেখপাড়ার গৃহস্থের মুরগী চরে তাঁতি বাড়ির উঠোনে। পরম বৈষ্ণব কন্ঠীধারী তাঁতি আর তার বউ হাতে তালি দিয়ে উড়িয়ে দেয় মুরগীদের। তারা উড়ে যায় উঠানের পাশের বাঁশ বনে। তাঁতিরা তা নিয়ে ঝগড়া করতে যায় না শেখবাড়িতে। শেখপাড়ার মানুষের চলাচল তাঁতিপাড়ার ভিতর দিয়ে। সব পল্লীই অরক্ষিত। সহাবস্থান এখানে সুরক্ষার ব্যবস্থা। পুরুষানুক্রমে এভাবেই চলতে ওরা অভ্যস্ত। আর সহসা ভিন্নরূপ ধারণ করতে বললে তা পারবে কেন?
তিনি বললেন, নোয়াখালি হয়ে যাবে সব নোয়াখালি হয়ে যাবে।
৬
ইদ উৎসব এসে গেল।
সেই শঙ্কা হিন্দুদের মনে। ভয়টা সময়ের। সত্যিই মানুষ বেশ ভয়ে ভয়ে ছিল। শিক্ষিত মুসলমানের বসবাস হোটেলপাড়াতেই সবচেয়ে বেশি। রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে শোরগোল এখানেই বেশি। শুনলাম এবার ওরা ঈদে খুব জাঁক করবে। ওসব কথা শুনেটুনে আমারও মনে কিছু চিন্তা জেগেছিল। কে জানে কোন অঘটন ঘটে।
বিকালে হোটেলপাড়ায় গেলাম। কার্তিকদা বললেন, ভাই খুব সতর্ক হয়েই ছিলাম। ওঁরা ঈদের নামাজ পড়তে গেলেন দল বেঁধে। বেশ তাজা ভাব। তারপর বাড়ি বসে শুনতে থাকলাম, বাজি পটকার শব্দ। খুব বাজি পোড়াচ্ছে ওরা।
ওই সময়েই পাড়ায় একটা হৈচৈ শোনা গেল। তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বার হলাম--সব হিন্দু ছেলেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
কী হয়েছে?
প্রাক্তন এম.এল.এ. মহসীন আলির বাড়িতে চীৎকার, কান্নাকাটি হচ্ছে। আমরা দরজার কাছে গেলাম। বাড়ির পরিচারিকা শোনাল মহসীন আলির স্ত্রী দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছেন। উঠতে পারছেন না।
পরিচারিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওধারে সব ঘরে গেল।
-কে ঘরে গেল?
-ওই বাড়ির মানুষরা মল্লিক বাবুরা বাড়িতে গোর্খা এনে রেখেছে। তারা গুলি করে সব মেরে ফেলল।
ওই কথা বলতে বলতেই তো উনি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। মহসীন আলির স্ত্রী তখনও কেঁদে ভাসাচ্ছেন।
--আমার কী হবে গো-
আমরা তাঁকে বোঝাতে লাগলাম। মিথ্যা কথা-কিছু হয়নি ওসব। একজন ডাক্তার ডাকতে গেল। আরেকজন সাইকেল নিয়ে ছুটল নামাজের ওখানে। নামাজ তখন শেষ হয়েছে। খবর পেয়ে সব ছুটতে লাগলেন পাড়ার দিকে।
মহসীন আলি তো আমাদের জ্যাঠামশাই। তিনি সব শুনে বললেন, কী লজ্জার কথা। পাড়ার ছেলেরা এসেছিল তাই। ঈদে পটকা ফুটিয়ে ফুর্তি করতে গিয়েছে। বললাম, বাজি ফুটাল কে?
কার্তিকদা বললেন, ভাই শুধু আমরাই ওদের ভয়ে ভীত ছিলাম না। ওরাও আমাদের ভয়ে কতো ভীত ছিল। ওদের ভিতর কেমন প্রচার ছিল যে মল্লিক বাবুরা গোর্খা সৈন্য এনে রেখেছে। মুসলমানদের মারবার জন্য। আর মারবে ঈদের নামাজের সময়।
-কিন্তু কার্তিকদা খুব বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
-কী রকম?
-এমনও হতে পারত-ওদের কাছে খবর গেল যে বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। এই সময় হিন্দুরা বাড়ি আক্রমণ করেছে। তাহলে?
কার্তিকদা আমার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যিই তো-এটা ভাবিনি, সত্যিই। তাহলে কী হতো?
হোটেল পাড়ায় সেদিন হিন্দু-মুসলমানের একটা সম্প্রীতির ভাব এসে গিয়েছিল বলে শুনেছিলাম।
আমাদের স্কুলের মৌলবী সাহেবের বাড়ি নোয়াখালি। পরনে চেক লুঙি, গায়ে ঢিলে হাতা পাঞ্জাবি, মাথায় ফেজ টুপি, পায়ে নিউকাট জুতো। যখন স্কুলে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীতে পরতাম--তখন তিনি আমাদের হাতের লেখার ক্লাশ নিতেন। তিনি ক্লাশে ঢুকলেই আমরা হাসতাম।
তিনি ক্লাশে ঢুকলে আমরা উঠে দাঁড়াতাম। তিনি এসে চেয়ারে বসে বলতেন, চিট ডাউন, চিট ডাউন। যেন আমরা পূর্ববঙ্গের ভাষা শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম না। আমরা হাসলে তিনি চটে যেতেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে হাতের নাগালে পাওয়া ছেলের চুলের মুঠি ধরে বলতেন, হাসলিস ক্যান?
ক্লাস শুদ্ধু ছেলে হেসে উঠত। সেই ছেলেটিও হাসছে। তখন তার পিঠে বাঁ হাত দিয়ে কিল মেরে বলতেন, প্যাখম মেইলা হাসলিস ক্যান? হাসি বেড়ে যেত আরও। এখন তিনি আমার সহকর্মী।
নোয়াখালিতে দাঙ্গা বাধল। সংবাদ প্রচারিত হলো।
খবরের কাগজের মাধ্যমে দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। মৌলবী সাহেব স্কুলে আসা বন্ধ করলেন। চিঠি পাঠালেন ছেলেকে দিয়ে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
স্কুলে হিন্দু শিক্ষকদের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে নানা প্রকার কথা উঠতে থাকল। নোয়াখালির লোক। এটাতো নোয়াখালি নয়। পথে বার হলে মার খেতে পারেন এই ভয়ে বাড়ি থেকে বার হচ্ছেন না।
এরপর নোয়াখালির মুসলমান কত সাংঘাতিক রক্ষণশীল, উগ্রপ্রকৃতির সে বিষয়ে আলোচনা হতে থাকল। নোয়াখালির ঘটনায় কার পক্ষেই বা চুপ করে থাকা সম্ভব?
এক সপ্তাহ পর মৌলবী সাহেব স্কুলে এলেন। সহকর্মীরা সকলেই গম্ভীর। তাঁকে এড়িয়ে চলছেন। এক সময়ে দেখলাম, সব শিক্ষকই ক্লাশে গিয়েছেন। শিক্ষকদের বিশ্রাম ঘরে আমি আর মৌলবী সাহেব বসে আছি। তার পরনে সেই লুঙি, পাঞ্জাবী। মাথায় ফেজ টুপি, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। একটু বিষণ্ণভাব।
আমি বললাম, স্যার আপনার জ্বর হয়েছিল? তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, না বাবা, জ্বর হয়নি। আমি লজ্জায় আসতে পারিনি। আমি নোয়াখালির মুসলমান। যে কাণ্ড ঘটছে--তাতে আমার কি মুখ দেখানোর জো আছে? তোমরা আমার সম্পর্কেও কত কি ভাবছ সেটা অন্যায়ও নয়। কিন্তু বাবা বিশ বছর আমি দেশ ছাড়া। এখানে আছি। এর মধ্যে নোয়াখালি এমন হয়েছে ভাবতে পারছিনে। কী বলব বল-আমি এখনও ভাবতে পারছিনে।
কলকাতায় দাঙ্গা হল, তার পর নোয়াখালি। এই পরিস্থিতিতে নির্বিকার থাকা সম্ভব নয়। মেহেরপুরে ফিরে আসার পরই রাজনীতি বহির্ভূত নানা সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম। একটি সাংস্কৃতিক মঞ্চ গড়া হয়েছিল। তাতে মেহেরপুরের যুব সমাজকে একত্রিত করা হয়েছিল। সেই যুবসংঘের যুবকদের নিয়ে নোয়াখালির দুর্গতদের ত্রাণের জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পথে বার হলাম। তখন এই বিষয়ই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে মনের ভারসাম্য বজায় রেখে নিরপেক্ষ থাকা কঠিন। নানা বিরূপ চিন্তায় মন অবসন্ন। এটা প্রায় ধরেই নেওয়া হয়েছে যে হিন্দু-মুসলমান আজ দ্বিধাবিভক্ত। ধরে বেঁধে এক রেখে আর লাভ নেই। গতানুগতিক ধারায় সমাজ চলছে। বাহ্যিক শৃংখলা বজায় আছে।
সতীশ শেখ একজন দিন মজুর। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। বাড়ি মেহেরপুর সংলগ্ন কালাচাঁদপুর গ্রামে। সতীশদাদা আমাদের বাড়িতে কাজ করে আসছে অনেককাল থেকে। বালক বয়স থেকে তাকে দেখছি। সে শহরে এসে গৃহস্থ বাড়িতে কাজ খোঁজে। কাজ করে। কাজ জুটাতে পারলে চলে। কাজ জুটাতে না পারলে চলে আসে আমাদের বাড়ি। উঠোনে দাঁড়িয়ে বলে বউদিদি, কাজে লাগলাম। মা বলেন, কাজ কোথায়? সতীশদাদা বলে, আজ কাজ পেলাম না। কি করব সংসারতো শুনবে না। আয় করে পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। একটু আগুন দেন বিড়িটা ধরাই, দুটান দিয়ে কাজে লাগব।
মা হাতা ভরে আগুন এনে উঠানে নামিয়ে দেন। সতীশ শেখ বিড়ি টেনে ধোঁয়া ছেড়ে বলে, কাজ আছে বৈকী, খুঁজে নিতে পারলে বাড়িতে কত কাজ। বেড়ার কচা-ভিতের ডালগুলো ছাঁটতেই একবেলা কাবার হয়ে যাবে।
মা বলেন, তাহলে আজ একবেলা করো।
-না বউদি, একবেলায় তো তিন গণ্ডা পয়সা, তাতেতো হবেনা। সাড়ে চার গণ্ডা পয়সা দরকার। দেড়ারোজ করতেই হবে। সেই বিহানবেলা এইডি, দুপরে জলখাবারটা না হলে-
বিড়িটানা শেষ হলে সতীশ শেখ কাজ খুঁজে নিতে চলে যায় সবজি বাগানে। সতীশ শেখ একবেলা করতে চায় না কিছুতেই। করেও না।
কিন্তু সেদিন কাজে এসে বলল, বউদিদি আজ একবেলা কাজ করব। মা বললেন, যেদিন কাজ থাকে না সেদিন একবেলা করতে চাও না। আজ অনেক কাজ আছে সে সব ফেলে একবেলা করবে বলছ কেন? তাতে তোমার পোষাবে? সতীশ শেখ বলল, কি করব, মোড়ল বলেছে সকাল করে যেতে, যেতেই হবে।
সতীশ শেখের কথাগুলো আমার কানে বাজল। মোড়ল বলেছে, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া জারি হবে। আমি উৎকর্ণ হলাম, এরপর সে কি বলে।
সতীশ শেখ বলল, আমাদের গাঁয়ে আজ ঘোষেদের মেয়ের বিয়ে। সেখানে থাকতে হবে। মা বললেন, ঘোষেদের মেয়ের বিয়েতে তোমাকে থাকতে হবে কেন?
-আমি একা থাকব কেন, গাঁয়ের লোক সবাই থাকবে। আর খাটাখাটির লোক তো দরকার। আমাদের গাঁয়ে ওই এক ঘর গুয়াল- ওই একঘরই হিঁদু। আমরাই ওদের বল ভরসা। নইলে ওরা একা কি করবে? ওদের মেয়েকে দেখতে এলো। মেয়ের বাবা আমাদের ডাকল। আমরা গিয়ে বসলাম। ছেলের বাবাকে মোড়ল বলল, আমাদের গাঁয়ের মেয়েটাকে আপনারা নিন। খুব ভালো মেয়ে, নিলে আপনাদের সংসারে খুব সুখ হবে। আমাদের মেয়ে খুব ভালো- আমরা বলছি। একদিনের কাজ তো নয়।
মোড়লের কথাতেই বিয়ের ঠিক হয়ে গেল। মোড়লই তো গাঁয়ের অভিভাবক। সেই বিয়ে আজ। বিয়ের আসরে মেয়ের বাড়ির কুটুম্বরা আসবে। তাদের সামাল দেওয়ার কাজ আমাদের। গিয়ে উঠবে মোড়লের ঘরে। মেয়ের বাড়ির কুটুম্বরা উঠবে আশপাশের বাড়িতে। তাদের দেখতে হবে। তাদের আদর যত্ন করতে হবে। আরও কতো রকম কাজ আছে। গাঁয়ের মান বজায় রাখতে হবে।
সতীশ শেখ সত্যিই সেদিন একরোজ কাজ করে চলে গেল।
সেই দুঃসময়ে আমার মনে হতে লাগল, কালাচাঁদপুর ভারতবর্ষের সেরা আদর্শ গ্রাম। ওই গ্রামে অধিবাসী দিনমজুর সতীশ সেখ ও তার গ্রামের মানুষজন ভারতবর্ষের সেরা আদর্শ মানুষ। যদি আমরা সকলে ওই রকম হতে পারতাম, যদি ওই রকম একজন মোড়ল পেতাম- ওই রকম অভিভাবক!
আমার বাল্যকালে ঠাকুরমার মুখে একটা গল্প শুনতাম। ঠাকুরমা বলতেন, আমাদের মেহেরপুরে একজন পীর সাহেব ছিলেন। সাধক, সিদ্ধ পুরুষ। দিনের বেলা তিনি সাধন ভজন করতেন। রাত্রিবেলা যখন মানুষজন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত তখন তিনি ভ্রমণে বার হতেন। তাঁর একটা দেওয়াল ছিল। তিনি সেই দেওয়ালে চড়তেন। আর দেওয়াল তাঁকে নিয়ে আকাশে উড়ত। তিনি আকাশ পথে ঘুরে ঘুরে দেখতেন তাঁর ভক্তরা কে কেমন আছে। যারা দুঃখী মানুষ তাদের মঙ্গল করতেন। সকলের কষ্ট দূর করতেন। দেওয়াল উড়ত পীর সাহেবকে নিয়ে এটা আমাকে অবাক করত, ভাবিয়ে তুলত।
কিশোর বয়সে একদিন সেই পীর সাহেবের মাজারে গিয়েছিলাম। পৌষমাসে তাঁর মৃত্যুদিনে মাজারে উৎসব হয়। সেদিন মানুষের ঢল নামে সকালে। শ্রমজীবী হিন্দু পল্লীগুলো থেকে বাড়ির কর্ত্রী, বউ, ঝি ছোট ছোট নাতি-নাতনিরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে পীরের মাজারের উদ্দেশ্যে। দুপুরে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো চলে ওই তীর্থযাত্রীর দল। আমি অনুসরণ করেছিলাম তাদের। শেখপাড়া পেরিয়ে কালাচাঁদপুরের দিকে যেতে, পথের ধারেই একটি ছোট বাগান তার ভিতর পীরের সমাধি, খানিক দূরে দরগা, দেওয়ালের মত দেখতে। তার সামনে বসে সাধন ভজন করতেন পীর সাহেব। ঠাকুরমার গল্পটা মনে পড়ছিল। দেওয়ালে চড়েছেন পীর সাহেব। দেওয়াল উড়ছে তাঁকে নিয়ে। কী আশ্চর্য তাৎপর্যময় গল্প!
মাজারের সামনে প্রচণ্ড ভীড় মহিলাদের। সমাধিবেদীর পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন মোনাজাত দাদা। শেখ পাড়ায় বাড়ি। মাজারে মোড়ের পাশেই ছোট একটা মসজিদ আছে। তার সামনের চাতালে বসে মোনাজাতদাদা ছেঁড়া ছাতা মেরামত করেন। ফর্সা, বেঁটেখাটো মানুষ, দাড়ি গোঁফহীন মানুষ।
এখন তাঁর পরনে লুঙির মতো করে পরা ধুতি, গায়ে আর্দির পাঞ্জাবি, মাথায় সুতীর জালি টুপি। ভক্ত মহিলারা তাদের মানতের জিনিসপত্র দিচ্ছে। সমাধিবেদীর পিছনে দাঁড়িয়ে একজন ধাবার ভিতর সেসব জিনিস নিচ্ছেন। মোনাজাতদাদা টাকা পয়সাগুলো নিচ্ছেন। আর বাতি বিক্রি করছেন। ভক্তরা বাতি কিনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বেদীর পাশে।
ভিড় একটু পাতলা হতেই মোনাজাতদাদা আমাকে ডাকলেন। কাছে যেতেই একগাল হেসে বললেন ভাই, তুমি এসেছ? মাজারে একটা বাতি জ্বেলে দাও।
-আমার কাছে তো বাতি নেই।
-বাতি আমি দিচ্ছি।
-পয়সা আনিনি তো।
-তোমার পয়সা লাগবে না। এই নাও।
বাতিটা জ্বালিয়ে দাও মাজারের। আমি বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে প্রণাম করলাম মাজারের বেদীতে। মোনাজাতদাদা মাজারের বাতি নিয়ে আমার কপালে তিলক এঁকে দিতে দিতে বললেন, পীরসাহেবের আশীর্বাদে তুমি ভালো হবে, বুদ্ধিমান হবে, মানুষ হবে।
সেসব কথা শুনে সেসময় মনটা কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। খুব ভালো লাগতে লাগল। বললাম, মোনাজাতদাদা, আপনি এখানে কেন?
তিনি বললেন, আমরাই তো পীর সাহেবের মাজারের সেবাইত বংশ। সারা বছর মাজার দেখাশোনা করি। আজ যে আয় হয় তাই দিয়ে মাজারের সারা বছরের খরচ চলে। আমাদের সংসারেরও কিছু সুবিধা হয়। পীর সাহেবের নির্দেশেই আমরা সেবাইত বংশ।
বাগানের বাইরে দুপাশের পতিত মাঠে তখন মেলা বসেছে যেন। ভক্তদল পরিবারের সকলকে নিয়ে বসে আছে। সঙ্গে আনা খাবার, চিঁড়ে, মুড়কি, দই-গুড় ইত্যাদি যারা যা এনেছে সেগুলো বার করে ভোজনে বসে গিয়েছে। কোন দল বিশ্রাম নিচ্ছে, গল্প হাসাহাসি চলছে। বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে চলছে আলাপ, আলোচনা, কথাবার্তা, মেলামেশা, সুন্দর বনভোজনের রূপ। একে বলে মাঠপালনী। কোন মুসলমান পরিবার নেই কিন্তু এর মধ্যে। অথচ পীরের উৎসব।
বিকাল সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে গেলে ওই পুন্যার্থীদের ঘরে ফেরার পালা। আমাদের প্রতিবেশী ঘোষ পরিবারের সঙ্গে আমি বাড়ি ফিরলাম। মাঠ ছাড়বার সময় থেকে সমানে উলু দিতে দিতে পথ চলছে সকলেই।
ঘোষ পরিবার তাদের বড়ির দরজা পর্যন্ত উলু দিতে দিতে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কর্ত্রী বলল, বাড়ির সব ভালো?
গাড়ির ভিতর থেকে ওদের বড় বউ বলল, ভালো।
-গরুবাছুর, গাছগাছালি ভালো?
-ভালো।
-ছেলেবউ মানুষজন ভালো?
-ভালো।
এবার কর্ত্রী চেঁচিয়ে ঘোষণার মতো করে বলল, পীর সাহেবের দয়ায় বাড়ির সবাই ভালো আছে।
তারপর উলু দিতে দিতে সকলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।
১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাস। দেখছি আমাদের বাড়ির পথ দিয়ে পুণ্যার্থীর দল সারি বেঁধে চলেছে পীর সাহেবের মাজারের দিকে। সেই একই ভাবে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবে উলু দিতে দিতে। বাড়িতে প্রবেশ করবে পীর সাহেবের দয়া নির্ভরতা নিয়ে। সহবস্থানের ফলে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার উজ্জ্বল এই নিদর্শন আজও অনাহতভাবে বর্তমান জনজীবনে।
অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। মুখোপাধ্যায় জমিদারদের বাড়ির দেউড়ির পাশে ছোট ছোট অনেকগুলি কুঠুরি ছিল। এককালে জমিদার বাবুদের বাড়িতে অনেক দারোয়ান, লাঠিয়াল থাকত। ভোজপুরী পালোয়ান থাকত। তারা সকাল বিকাল মুগুর ভাঁজতো। কুস্তির আখড়া ছিল, সেখানে কুস্তি চর্চা চলত। সেই ঘরগুলো এখন অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। শহরের যাত্রা ক্লাব, থিয়েটার ক্লাব, সংস্কৃতি সংঘ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু ঘর দখল করেছে। ভাড়া লাগেনা। চৌকীর ওপর সতরঞ্চি পেতে রেখেছেন জমিদারবাবুরা। সন্ধ্যায় ওই সব প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা সেখানে সমবেত হন। রাত দশটা পর্যন্ত আসর চলে। পাশে জমিদারবাবুর হল ঘর। সেখানে চৌকির ওপর বড় ফরাস পাতা।
দাবার আসর চলে সেখানে শহরের বিশিষ্ট বৃদ্ধ ও প্রৌঢ়দের। মাথার ওপর টানা পাখা। আগে নোকরে টানত। এখন নিজেরেই টানতে হয় প্রয়োজন মত। জমিদারবাড়ি দুর্গের মতন। এই বাড়ি নিয়েই একটা পাড়া। দেউড়ির পাশের কুঠুরিগুলোর দক্ষিণে বাড়ির মাঝখানে একটা চৌহদ্দি টানা। সেখানেই যাত্রার আসর বসে। বাঁশ দিয়ে মঞ্চ তৈরী ক’রে থিয়েটার হয়। দেউড়ির দরজা বন্ধ করে দিলেই বড় নিরাপদ স্থান।
এইখানে একটি ঘরে সংস্কৃতি সংঘ। সেখানে আবৃত্তি ও গানের চর্চা হয়। এখানকার সদস্যদের নিয়েই সাহিত্য সভা, সাংস্কৃতিক সভা করা হয় মাঝে মাঝে। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা আমরা ক’জন বন্ধু। বন্ধুরা যাত্রা ও থিয়েটার দলেরও সদস্য। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে এই দুটি সংস্থার মধ্যেও ওঠা বসা করতে হয়। থিয়েটার ক্লাব একটা থিয়েটার মঞ্চস্থ করে বছরে একবার কিম্বা তাও নয়। থিয়েটারে সমস্যা অনেক। যাত্রাভিনয় সহজ। বছরে কয়েকটা পালা নামানো হয়। এই যাত্রা পালায় যা গান থাকে, তাতে গায়কদের মন ওঠে না। আরও গান চাই। সেই সব গান লিখে দিতে হয়। পালায় কিছু রদবদলও করতে হয়। থিয়েটারের জন্য নাটক রচনার বায়না হয়। তার চেষ্টাও চলে। রাত দশটা পর্যন্ত ওই সব আসরে বসে সময় কাটে। ছোট শহর। এখানে লেখক দীনেন্দ্র কুমার রায়ের বাসস্থান হলেও সাহিত্য চর্চার কোন ব্যবস্থা ছিল না। তেমন কোনও সংস্থাও ছিল না।
শহরে রাজনৈতিক সভা অনেক হলেও সাহিত্য সভা হতো না। সেটা ১৯৪৫ সাল। মেহেরপুরের টাউনহলের নাম কালাচাঁদ মেমোরিয়াল হল। সেখানে একটা সাহিত্য সভার আয়োজন করা হলো। তখন মহকুমা শাসক ছিলেন অবনীমোহন কুমারী (লেখিকা কেতকী কুমারী ডাইসনের পিতৃদেব)। তখন দুর্ভিক্ষের কাল। অক্লান্ত পরিশ্রমী কুমারী বাবু। আকালের হাত থেকে, মজুতদারীর হাত থেকে, মহকুমাবাসীকে রক্ষা করতে দিন রাত্রি পরিশ্রম করে চলেছেন। তবু তিনি সেই সাহিত্য সভায় উপস্থিত হলেন বিকালে। বললেন, সকালে করিমপুর গিয়েছিলাম ধানের গোলা সিল করতে। খানিক আগে ফিরে আপনাদের চিঠি দেখলাম। একটু অবাক হলাম- এখানে তো ওসব কিছু হয় না। তাই চলে এলাম। তিনিই সভাপতি হয়েছিলেন সে সভায়। তারপর থেকে সাহিত্য অধিবেশন করা হচ্ছে মাঝে মাঝে। আবৃত্তি শেখানো হচ্ছে। যুবকদের মধ্যে আবৃত্তি ও পড়াশোনার চর্চা বাড়ছে। যাঁরা এসব চর্চার কথা কোনদিন ভাবেননি তারাও আসছেন - আমাদের শেখানো দেখতে। গায়করা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখছে। এখানেও নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে।
দীনেন্দ্রকুমার রায়ের খুড়তুতো ভাই প্রবোধচন্দ্র রায় স্কুলের শিক্ষক। আমাদের মাষ্টারমশাই। তাঁর একটি ছাপাখানা ছিল – কমলা প্রেস। শহরে একমাত্র ছাপাখানা। সেখান থেকে তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন-'পল্লীশ্রী' নামে। পত্রিকাটিতে সরকারি ইস্তাহার ছাপা হত। তার সঙ্গে থাকত কয়েকটি পৃষ্ঠা, সাহিত্য চর্চার জন্য। মেহেরপুরের একজন কবি ছিলেন শরৎ দত্ত। তিনি ওই পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। আরেক জন ছিলেন কুমার মুখোপাধ্যায়। তিনিও ওই পত্রিকায় লিখতেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ওই পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলাম মেহেরপুর বিষয়ে। মেহেরপুরের ইতিহাস, তার গৌরবময় অধ্যায় ইত্যাদি। উদ্দেশ্য ছিল মেহেরপুরকে নতুন পরিচয়ে তুলে ধরার।
মেহেরপুরের পাবলিক লাইব্রেরী ছিল শহরের প্রায় বাইরে। আদালত এবং এস.ডি.ও.- মুন্সেফদের বাসস্থানের কাছে। লাইব্রেরীটির প্রায় অচল দশা ছিল। সন্ধ্যাবেলা সরকারি অফিসাররা বসে তাস খেলতেন হ্যাজাকের আলো জ্বালিয়ে। বই-পত্র যা ছিল চুরি হয়ে গিয়েছে কবে।
লাইব্রেরীর সেক্রেটারী ছিলেন কালিপদ বিশ্বাস নামে এক মোক্তারবাবু। তিনি একদিন পথে আমাকে বললেন, কুমারী সাহেব বলছেন, লাইব্রেরীটাকে ব্যবহারযোগ্য করা দরকার। তিনি টাকাপত্র দেবেন বইপত্র কিনতে। কিন্তু আমার পক্ষেতো ওসব করা সম্ভব নয়। তুমি যদি একটু সাহায্য করতে?
আমি রাজি হলাম। যুক্ত হয়ে গেলাম লাইব্রেরীর সংস্কারে। শুধু নতুন বই আনলেই তো হবে না- পাঠক চাই। পাঠক সংগ্রহ করা, চোরাই বই উদ্ধার- সব কিছু করে লাইব্রেরীকে নতুন ভাবে চালু করা হলো। যাঁরা তাস খেলতেন- সাবডেপুটি, সার্কেল অফিসার, সাব কমিশনার- এঁরা সব বললেন, আপনি আমাদের পথে বসালেন। তাস খেলা এখানে চলবে না বলছেন। আমরা বহিরাগত, এখানে আমাদের মেশবার কিম্বা বসবার কোন জায়গা নেই। এখানে একটু বসি। এখন-
শেষ অবধি ঠিক হলো তাঁরা বারান্দার একপাশে বসে ক্যারাম খেলবেন, তাস নয়। যে যুবকরা লাইব্রেরীর বই চুরি করে নিজেদের লাইব্রেবী গড়েছিল- তাদের সেই বই এবং তাদের সসম্মানে লাইব্রেরীতে ফিরিয়ে আনা হলো। শুরু হলো লাইব্রেরীর নতুন জীবন। অবনীমোহন কুমারী বদলি হয়ে গিয়েছেন। এসেছেন অনিল রঞ্জন বিশ্বাস- নতুন মহকুমা শাসক। অনিল রঞ্জন বিশ্বাস একজন কবি। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন থেকে তাঁর এক ফর্মার কাব্যগ্রন্থ বার হয়েছে যেন খানকয়। সন্ধ্যাবেলা ধুতি-পাঞ্জাবী পরে লাঠি হাতে নিয়ে বিশিষ্ট ভদ্রলোকদের সাথে লাইব্রেরীতে আসেন। বারান্দায় অন্য প্রান্তে তিনি একটি চেয়ারে বসেন আমার সম্মুখে। বলেন, কবিতার কথা, পরামর্শ দেন কবিতার বই ছাপতে হলে চলে যাবেন সঞ্জয়দার (ভট্টাচার্য) কাছে। পরম বিশ্বাসী। অতি সজ্জন ব্যক্তি তিনি সাহায্য করবেন।
এরপর শুরু হয় দেশের কথা। সমাজের কথা। মেহেরপুরের কথা- মেহেরপুরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কথা। সব মিলিয়ে তখন আমাদের মনে মেহেরপুরকে উন্নত এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে আনার স্বপ্ন।
স্কুলের শিক্ষকতার ক্ষেত্রেও ছিল নতুন কিছু করার চেষ্টা। স্কুলের আলমারিতে কিছু বই ছিল। বলা হতো লাইব্রেরী। কিন্তু সেসব বন্ধই থাকত। একদিন খুলে দেখলাম সে সব বেদ, উপনিষদ, এনসাইক্লোপিডিয়া ইত্যাদি। শিক্ষকরা ওসব পরেন না। সেকালে এই সব গ্রামাঞ্চলে স্কুল পাঠ্য বই ছাড়া অন্য কিছু পড়া বিশেষত গল্প গ্রন্থ পড়া প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। আমি হেড মাষ্টার মহাশয় সরোজ কুমার মুখোপাধ্যায়কে বললাম, স্যার, লাইব্রেরীটা ব্যবহারযোগ্য করা যায় না?
-কিভাবে?
-ছাত্রদের পড়ার যোগ্য কিছু বই আনিয়ে ওদের বই পড়ার অভ্যাস তৈরী করলে ভালো হয়। আর মাষ্টার মশাইরাও পড়বেন। সরোজকুমার ছিলেন আমার শিক্ষক।
অতি সুযোগ্য শিক্ষক এবং স্নেহপ্রবণ ব্যক্তি। তিনি হেসে বললেন, ছাত্রদের গল্প, উপন্যাস পড়াবে? তা পড়াতে পারো কিন্তু লাইব্রেরী চালাবার দায়িত্ব নেবে তো? তার জন্য পারিশ্রমিক পাবে না কিন্তু। বেগার দিতে হবে। আমি রাজী হলাম।
লাইব্রেরী খোলা হল ছাত্রদের জন্য। কিন্তু মুসলমান ছাত্র কেউ বই নিতে আসে না। উচ্চ শ্রেণীর দু'একজন ছাত্রকে বললাম, বই নিতে। তারা চুপ করে থাকল। নবম শ্রেণীর দুটি ছাত্রকে বলায় তারা এসে একবার বই নিল। তারপর সেই বই ফেরত দিতে এসে বলল, আর বই নেবে না।
-কেন?
-আমরা বই পড়ি।
-কোথায়?
-আমাদের পাড়ায় লাইব্রেরী হয়েছে ক্লাব হয়েছে। মুসলিম ক্লাব এণ্ড লাইব্রেরী। আমাদের পাড়ার সব ছেলে তার মেম্বার। সেখানে আমরা ক্যারাম খেলি, ব্যাডমিন্টন খেলি, আমাদের পাড়ায় সব বই আসে, সেই সব বই পড়ি।
এসব কথা শুনে আমি হতবাক। বিচ্ছিন্নতাবাদের গতি চলেছে কোন পথে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেই ছেলেটি আরও বলল বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে ওই সব হিন্দু পাড়ায়, হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে যেও না- কখন মারামারি করবে- মারবে ধরবে তার ঠিক নেই।
প্রমোদচন্দ্র রায় মাষ্টার মহাশয় অতি সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু ইংরেজ ভক্ত। এখন মুসলিম লীগের পাকিস্তানি দাবীর সমর্থক। তিনি শুনে বললেন, এতে অবাক হবার কি আছে? ওটাই তো স্বাভাবিক। ভারতবর্ষ অনৈক্যের চোরাবালির দেশ। এটাই এদেশে ঐতিহ্য। এটা বারো জাতপাতের ইণ্ডিয়া দেশ। মুসলমান, খৃষ্টান তো দূরের কথা, হিন্দুদের মধ্যেই দেখ ব্রাহ্মণ, শূদ্র, সৎ শূদ্র, অসৎ শূদ্র, স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য। ঐক্য কোথায়? সবই তো অনৈক্য, ভেদ, অস্পৃশ্যতা- কোন সামাজিক সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার? না আহার বিহার-না বৈবাহিক সম্পর্ক।
তাহলে? তপশীলভুক্ত হিন্দুরা মুসলিম লীগের দলে চলে গেল। আমরা ধরে রাখতে পারলাম না কেন? ওরা আমাদের ছেড়ে চলে গেল কেন? রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 'ভারততীর্থ' কবিতা। কেন লিখলেন? আর আমরা কে তাঁকে মেনেছি?
নজরুল লিখলেন-“একই বৃন্তে দুটি কুসুম/ হিন্দু মুসলমান।"
ওটা তো কবিকল্পনা। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কবিতা, মহৎ বাসনা। কিন্তু বাস্তব তো ভিন্ন গতির। আমরা আত্মসমালোচনা করিনে। করলেও তাকে মানিনে। নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি এবং আনন্দ যেখানে নেই, মানুষ সেখানে আসবে কেন? মিলন? সমান উদ্দেশ্য এবং সমস্বার্থ ছাড়া কি তা হয়? ভেবে লাভ নেই বুঝলে- এ সব তোমার আমার হাতের বাইরে।
ড: ভবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মেহেরপুর শহরের বিশিষ্টজন। ভারতের অসামরিক বিমান চলাচল দপ্তরের আবহাওয়া বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন কিছুকাল। সি.ভি. রমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শাস্তিস্বরূপ ভাটনগর প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা তাঁর বন্ধু। মাঝে মাঝে বিকালে তাঁর কাছে গিয়ে বসি। তিনি স্মৃতিচারণ করেন- ভারতের কথা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও সমাজের কথা, ব্যক্তির কথা। শুনতে কী ভালো যে লাগে। তিনি বলেন কেমব্রিজে গেলাম পদার্থ বিদ্যায় পি.এইচ.ডি. করতে। আমার গাইড হলেন স্যার জে.জে.টমসন। তিনি তখন বৃদ্ধ। লাঠি ঠুকে চলেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কিসের ওপর গবেষণা করবে? আমি বললাম, আপনার বিষয়ের ওপর। তিনি বললেন, পারবে? তাহলে ছমাস ধরে কাঁচের নল জোড়া দেওয়া অভ্যাস কর- তারপর- কঠিন বড় কঠিন কাজ।
ড: ব্যানার্জী বলেন, সত্যি, কাঁচের দুটো নল জোড়া দেওয়া সত্যিই কঠিন কাজ। দুটো নল যদি সমান উত্তপ্ত না হয়, যদি উত্তাপের তারতম্য ঘটে- তাহলেই কাঁচ ফেটে যাবে।
প্রমোদ স্যারের কথা শোনার পর ড: ব্যানার্জীর ওই কাঁচের নল জোড়া দেওয়ার কথাই মনে পড়তে লাগল। দুটো কাঁচ উত্তপ্ত না হলেও ফেটে যাবে। মেলানো যাবে না। সত্যিই তো কে এই মিলনের রাখী বাঁধবে। এই সংঘাত, এই বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা থেকে বাঙালি সমাজকে আজ কে মিলনের পথে ফেরাবে?
বাবা ছাত্রদের মনোভাবের কথা শুনে বললেন, ওদের কিছু বলতে যেও না। স্কুলে দেখ না- ওরা আর আগের মতো নেই। ওরা পৃথকভাবে দল বেঁধে ঘোরে। আর শুনছি- মুসলমান ছাত্রদের ভিতর গোমাংস খাওয়ার প্রবণতা খুব বেড়ে গিয়েছে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে কলকাতায় ডিরোজিও'র শিষ্যদের মধ্যে এভাবেই মদ্যপান ও গোমাংস ভক্ষণের প্রবণতা প্রবল হয়েছিল। তাঁরা ভাবতেন, এটা করলেই হিন্দুর কুসংস্কারের প্রভাব থেকে মুক্তি মিলবে। তাঁরা সুস্থ চিন্তাবাদী হয়ে উঠবেন। এখন মুসলমানদের মধ্যেও সেই প্রবণতা। তারাও হয়তো ভাবছে এটা করলেই হিন্দু প্রভাব থেকে দূরে সরে যাওয়া গেল।
ওদের কি বলব- হিন্দুরাই কি কম যায়?
নবদ্বীপের কাছে জামালপুর গ্রাম- বাবার স্থান- বুদ্ধদেবের জন্ম, সিদ্ধিলাভ আর মৃত্যু একই তিথিতে। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন। ওই দিন জামালপুরে ছাগল কাটার ধুম পড়ে যায়। জীবের রক্তস্রোত বইয়ে দেওয়া হয়। হয়তো এখানে একটা বৌদ্ধ তীর্থস্থান ছিল। বৌদ্ধ মন্দির ছিল, বুদ্ধ মূর্তি ছিল। এবং ওই অঞ্চল জুড়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বসবাস ছিল। মনে হয় বৌদ্ধদের কাছে স্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
হিন্দুরা একদিন বৌদ্ধ উচ্ছেদ অভিযানে নাামল। সেদিন আক্রান্ত হলো ওই স্থান। ধুয়ে মুছে সব সাফ। বৌদ্ধ দর্শনের চিহ্নমাত্র নেই। ধূ ধূ মাঠ- এক স্থানে একটি গর্ত- দেবস্থান- বাবার স্থান- গর্তের ভিতরে আছেন বাবা। সেইখানে ওই বিশেষ দিনে ছাগ বলির ধূম। অহিংসাবাদীদের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে, শুরু হয়েছিল হিংসার তাণ্ডব। আজও তা চলেছে এবং সেটা ধর্ম বিশ্বাসে পরিণত। আমাদের দেশে, সমাজে- যুগে যুগে এটাই তো প্রধানরূপে দেখা যাচ্ছে। একদিন বৌদ্ধরা আক্রান্ত হয়েছিল, আজ আমরা- করার তো কিছু নেই। যে ঢেউ উঠেছে তাকে সামাল দেবে কে? একটা পরিণতি আসবেই। দেখ কি হয়।
প্রমোদ স্যারেরও সাফ কথা। ভেবে কোন লাভ নেই। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়/ উলু খাগড়ার প্রাণ যায়।
তুমি আমি তো সেই উলু খাগড়া। যা হবার তা হবেই। আমাদের হাতে কিছুই নেই শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া। সেই যে শ্যামা সংগীত আছে-
"ইচ্ছাময়ী তারা তুমি-
তোমার কর্ম তুমি করো মা
লোকে বলে করি আমি।"
ব্যাপারটা ঘটে যাচ্ছে কিন্তু তাই। ইচ্ছাময় ব্রিটিশ শাসক- যা করবে, তাই হবে- এখনও যা ঘটছে সবই তারই কীর্তি। লোকে ভাবছে আমি করাচ্ছি- আমরা করাচ্ছি, আমাদের দল করছে। মোটেও না- সব ওই ব্রিটিশের হাতের পুতুল- সব তাদের খেলা, পুতুল নিয়ে খেলা।
৭
প্রমোদস্যার ইংরাজ ভক্ত। তিনি পাকিস্তান দাবীর সমর্থক।
-কেন স্যার?
-পাকিস্তান হবে বলে।
-পাকিস্তান হবেই কেন?
-ব্রিটিশ সরকার দেবে বলে।
-ব্রিটিশ কেন পাকিস্তান দেবে?
-বদলা নেবে।
-কিসের বদলা?
-বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের।
-সে তো বঙ্গদেশে। বাঙালিদের জব্দ করতে। পাকিস্তান যে ভারতের ব্যাপার।
-ব্রিটিশ তার স্বার্থরূপে কাজ করছে।
-তাহলে পাকিস্তান হবেই?
-হ্যাঁ হবেই। ওটাতে ব্রিটিশেরই চাওয়া।
স্যারের কথাবার্তা অনেক সময় হজম করা কঠিন হয়। কিন্তু অবাক লাগে যখন সেটা বাস্তবে পরিণত হয়। মানুষটা কতো যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।
আবদুল ওয়াহেদ স্যার সরস ব্যক্তি। কপট গাম্ভীর্যে কথা বলে আসর জমাতে পারেন ভালো। টিফিনের ঘন্টায় শিক্ষকদের বিশ্রাম কক্ষে বসে আসর জমিয়ে তুলেছিলেন। মুসলমানদের নেড়ে বলা হয় কেন তার ব্যাখ্যা শোনাচ্ছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা হচ্ছে মুসলমানরা হচ্ছে নড়াকু, লড়িয়ে। চলতি কথায় সেটা হয়েছে লেড়ে। তার থেকে হয়েছে নেড়ে।
আমি বললাম, স্যার ইতিহাস তো অন্য কথা বলে। ওয়াহেদ স্যার বলে উঠলেন, তুমি আবার ইতিহাস টানলে এর ভিতর? নষ্ট হয়ে গেল। ইতিহাস টানলে তো অনেকেরই জারিজুরি ভেঙে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
"কবি তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো। ইহজগতে যা ঘটে তা সব সত্য নয়।"
ওয়াহেদ স্যার বললেন, কবি তো আমরা সকলেই। আমাদের মনোভূমিটাই আসল। মন যা ভাবে আর বলে, সেটাই আসল।
ওয়াহেদ স্যারের সেইসব কথাই সত্য হয়ে উঠল।
'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' স্লোগান নিয়ে এল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। কলকাতা, নোয়াখালি, বিহার- দাঙ্গার পর দাঙ্গা- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লড়াই- এর পর লড়াই। প্রতি পক্ষ পরাজিত। পাকিস্তান দাবী স্বীকৃত। ভারতবর্ষ ভাগ হোক। পাকিস্তান দেওয়া হোক মুসলিম লীগকে।
মানতেই হবে নৈতিক পরাজয় ঘটল আমাদের। যারা ভারতবর্ষের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু সেসব কথা চিন্তা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না যেন। এমন একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল যাতে মনে হয়েছিল যা হোক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাওয়াই ভালো। দাঙ্গা, খুনোখুনি, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা, আর সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু মন ভাঙল। কিছুই তো করার নেই আমাদের। প্রমোদ স্যার বললেন, দেখলে তো গান্ধীজীর মুখেও আর কথা নেই। বলেছিলাম- ব্রিটিশ যা চাইবে তাই হবে। পাকিস্তান স্বীকৃত হলো। তারপর ঘটনাবলী দ্রুত এগিয়ে চলল, পাকিস্তানকে বাস্তবায়িত করতে। শেষে ঠিক হলো বাঙলা দেশও বিভক্ত হবে।
প্রমোদস্যার বললেন, দেখলে তো ব্রিটিশ কেমন বদলা নিল। লর্ড কার্জনের বাঙলা ভাগ তোমরা মানো নি। এখন ওস্তাদের মার শেষ রাতে। তোমরা এখন বলছ ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। ব্রিটিশ হাসছে। বলছে- সেই তো মল খসালি, তবে কেন লোক হাসালি? পাকিস্তান হবে। বাঙলা দেশও ভাগ হবে। পাকিস্তান হবে এক অংশ।
মানুষের মন এদিকেই ঘুরে গেল। সকলেই এবার ভাবতে শুরু করল- ভাগ হবে কিভাবে- কোন খান দিয়ে? কার্জনের বিভাজনের কথাই মনে পড়েছিল সকলের। পাকিস্তান হবে। মুসলমানদেরই জয়। এখন হিন্দুরাই পরাজিত দল।
কালাচাঁদপুরের দিনমজুর সতীশ শেখ কাজে আসে এখনও। একদিন সকালে কাজে এলো। উঠানে বসে আগুন দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁগো- আমরা বলে আবার রাজা হবো?
-কে বলল?
-গাঁয়ে সব বলাবলি হচ্ছে। আমরা তো আগে এদেশে রাজাই ছিলাম। আমরা হলাম রাজার জাত। আবার রাজা হবো। সত্যি?
সহবত সেখের গরুর গাড়ি আছে। সেই গাড়িতে সে ইট, কাঠ বহন করে। ইট ভাঁটা থেকে ইট নিয়ে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিত। অন্য সময় গাড়ি বোঝাই জ্বালানি কাঠ নিয়ে বিক্রী করে বেড়ায়। সেদিন গাড়ি বোঝাই বাবলা কাঠ নিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে দিল। কাঠ নামিয়ে গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, তোমাদের বাড়িটা আমিই নেব।
-তার মানে?
সহবত একগাল হেসে বলল, এদেশ তো আমাদের পাকিস্তান হবে। তখনতো হিদুরা কেউ এখানে থাকতে পারবে না। সব ফেলে রেখে চলে যেতে হবে।
-কে বলল?
-জানি গো, আমরা সব জানি।
-এদেশ সব পাকিস্তান হয়ে যাবে।
মেহেরপুর হাসপাতাল আমাদের স্কুলের সামনেই। বিকালে দেখি হাসপাতালের সামনে উত্তেজিত মুসলমান যুবকদের ভীড়। চেঁচাচ্ছে- হৈ চৈ করছে, আস্ফালন করছে। মেহেরপুরে এমন দৃশ্য কিছুটা অভিনব। কৌতূহলী হয়ে কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইলাম। শুনলাম, কাছেই গ্রামের পথে একজন পথচারী একটি মটর লরির ধাক্কা খেয়ে আহত হয়েছে গুরুতরভাবে। আহত ব্যক্তি একজন মুসলমান এবং লরি চালক একজন হিন্দু। অতএব এই ক্ষুব্ধ জনতার বক্তব্য হিন্দু লরি চালক, পথচারী মুসলমান বলেই তাকে চাপা দিয়েছে। লরি চালককে ধরা যায়নি।
আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারবাবু একজন হিন্দু। অতএব তাকে বিশ্বাস করা যায় না। আহত ব্যক্তিকে মেরে ফেলবে। অতএব মুসলমান ডাক্তার চাই। হিন্দু ডাক্তারকে রোগী দেখতে দেবে না।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে এবং স্বরূপ দেখে শিউরে উঠলাম। কি হতে পারে এর পরিণতি- কি না হতে পারে? হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক কোথায় এসে পৌঁছেছে!
হাসপাতালের দক্ষিণে মিউনিসিপ্যালিটির অফিস বাড়ি। সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন ভাইস চেয়ারম্যান রহিম সেখ- আমার রহিম কাকা। জনতা তাঁকে ঘিরে ধরল। তিনি দাঁড়িয়ে একটা ছোট বক্তৃতা দিলেন। কিছুটা ওদের স্বপক্ষে। তারপর বললেন, এখনই মুসলমান ডাক্তার কোথায় মিলবে? হিন্দু ডাক্তারই দেখুন- আমরা তো সামনে থাকছি। ডাক্তার বলুন রোগীর কি অবস্থা- তারপর দেখা যাবে- মেহেরপুরে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের অবনতির আর কি বাকী থাকল?
এই সময়েই স্কুলের প্রয়োজনে সিরাজগঞ্জ যেতে হলো। অনেকে ভয় দেখালেন, সিরাজগঞ্জে মৈমনসিংহ প্রভৃতি এলাকা এখন অগ্নিগর্ভ। এখন ওদিকে যাওয়া অপরিচিতের পক্ষে উচিত নয়। না যাওয়াই ভালো।
কিন্তু আমার মনে ভিন্ন চিন্তা। ওই সব অঞ্চল দেখিনি। দেখার ইচ্ছা। ওই পূর্ববঙ্গ অবশ্যই পাকিস্তানভুক্ত হবে। আর যাওয়া যাবেনা। এই বোধহয় শেষ সুযোগ। আমি চলে গেলাম। পথে কোন অসুবিধাই হলো না। বিকালে সিরাজগঞ্জ স্টেশনে এসে ট্রেন থামল। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। প্রচুর যাত্রী- নারী পুরুষের ভিড়। প্লাটফর্ম ভর্তি। আমি দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে থাকলাম। প্লাটফর্মের বাইরে এক ঘোড়ার টাঙ্গার সারি। চালক সবই মুসলমান। বিকালে সেই অচেনা স্থানে দাঁড়িয়ে সেই প্রথম আমার মনে কেমন এক আতঙ্ক ভাব জন্মাল। মন কখন যে বিভাজিত হয়ে হিন্দু পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মুসলমানের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ, ভীতির সৃষ্টি করেছে।
এই অচেনা স্থান- ওরা সব মুসলমান- এখানকার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ- এসব ভাবনা মনকে আড়ষ্ট করে তুলেছে। ভাবছিলাম এখন করণীয় কী?
সহসা সামনে যেন এক দেবদূতের দর্শন মিলে গেল। ডাকলাম, দুর্গাদা- মেহেরপুরের জমিদার ভূপতিভূষণ (বুদুবাবু) মুখোপাধ্যায়ের পুত্র দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গায়ে কালো কোট- রেলকর্মী।
তুই এখানে? দুর্গাদা কাছে এগিয়ে এলেন। কোথায় এসেছিস? আমি তাঁকে সব বললাম।
তিনি বললেন, আমিও তো এই ট্রেনে এলাম। এখন এখানকার পরিস্থিতি ভালো নয়। একা অচেনা জায়গায় যাসনে। আমাদের রেলের রানিং রুমে চল। ওখানে বিশ্রাম করে দু'জনে একসঙ্গে যাব।
রেলের রানিং রুম থেকে আমার গন্তব্য স্থান খুব দূরে নয়। কিন্তু পথ নির্জন এবং ঝোপ জঙ্গলে ভরা। আমরা দু'জনে সেই বাড়িতে গেলাম। গৃহকর্তা হেডমাস্টার মশাই- এর চিঠিতে আমার খবর জেনেছেন। আহারের বিশেষ আয়োজন ছিল। সন্ধ্যার সময় যেতেই জলখাবার এলো। লুচি, মাংস, মিষ্টি। রাতে ভাত, ইলিশ মাছের ঝোল এবং আরও কিছু। দুর্গাদা বললেন, এখানেই খাব- রানিং রুমে রাতে খাব না।
কিন্তু গৃহকর্তা বসে বসে সেখানকার পরিস্থিতি বিষয়ে যে সব বিবরণ দিতে থাকলেন, তাতে আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার দশা। নিরাপত্তা নেই, বিপদের হাতছানি পদে পদে। খুব ভয়ে ভয়ে থাকা। কে জানে থাকা যাবে কিনা। আমি বললাম রাতে কোথায় থাকব?
গৃহকর্তা বললেন, ওই যে বৈঠক খানা ঘর। অসুবিধা হবে না। সব ভালো ব্যবস্থা আছে।
দুর্গাদা বললেন, কিন্তু ওটাতো আপনাদের বাড়ির বাইরে-
-হ্যাঁ তা-
-রাতে একা থাকবে- ভয়ডর কিছু নেইতো?
গৃহকর্তা বললেন- এখানে তো কিছু হয়নি। তবে কিছু হবে না তাও বলা যায় না।
-তাহলে? বাইরের মানুষ থাকবে।
-না অসুবিধা কিছু হবে না। আমরা তো আছি। যাঁরা আসেন, ওই বৈঠকখানাতেই থাকেন। আমি কাতর স্বরে দুর্গাদাকে বললাম, এখানে থাকব না। আপনার সঙ্গে রানিং রুমেই থাকব।
-হ্যাঁ সেই ভালো। তাহলে রাতেই এখানকার কাজকর্ম সেরে ফেল।
তাই করা হলো। আমরা আবার রানিং রুমে ফিরে এলাম। মনে স্বস্তি ফিরে এলো। অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম, আমাদের সমাজটা আজ কোথায় এসে ঠেকেছে। মানুষ কতো ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে! মোটে বিশ্বাস নেই কারও প্রতি কারও।
দেশ স্বাধীন হচ্ছে এবং দেশ বিভক্ত হচ্ছে। সবই তো হচ্ছে আপোষে।
পিতৃসম্পত্তি ভাগের মতো- পিতার উপস্থিতিতে। এমন স্বাধীনতা লাভ ভারতের ইতিহাসে তো আর নেই। এমন বিভাজনও আর হয়নি ইতিপূর্বে। শাসক ব্রিটিশ নিজে উপস্থিত থেকে সব ভাগ বাটোয়ারা করে দিচ্ছে। সব দিক বজায় রেখে কাজ হচ্ছে। বঙ্গ দেশ বিভক্ত হচ্ছে। প্রাদেশিক সরকারের কর্মচারীদের কি হবে? এদের ক্ষেত্রেও ভাগাভাগি হবে। কিন্তু জোর জবরদস্তি তো করা যাবে না। অতএব তাদের মতামত যাচাই করো। কারা কোন সরকারের অধীনে থাকবে ইচ্ছা জানাও।
সরকারী কর্মচারীদের চিঠি এলো, এই মতামত জানাবার জন্য।
হিড়িক পড়ে গেল মতামত জানাবার।
এখনতো বিষয়টা স্পষ্ট। বঙ্গদেশ বিভক্ত হচ্ছে দুভাগে পাকিস্তান আর হিন্দুস্থান। এতো জানা কথা হিন্দুরা যাবে হিন্দুস্থানে, মুসলমানরা যাবে পাকিস্তানে।
আমাদের প্রতিবাদী মোহিনীমোহন বসাক ছিলেন মেহেরপুর মুন্সেফ কোর্টের পেশকার। তিনি লিখে দিয়েছেন মেহেরপুর যে দিকে পড়বে, আমি সেই দিকে থাকব।
হৈ চৈ পড়ে গেল বাড়িতে। এটা কি করলে তুমি? তোমার দাদা ডাকঘরের পোষ্টমাষ্টার। তিনি লিখে দিলেন, হিন্দুস্থানের কর্মী হবো। আর তুমি শিক্ষিত মানুষ, প্রবীন মানুষ হয়ে এটা কি করলে?
মোহিনীমোহন বললেন, আমি ঠিকই করেছি।
-কি ঠিক করেছ?
-আমি বাড়ি বসে চাকরী করব।
-এটা যদি পাকিস্তান হয়?
-অসম্ভব। মেহেরপুর, পাকিস্তান হতেই পারে না।
-তা কি বলা যায়?
-বলা যাবে না কেন? সবকিছুর একটা বিচার আছে তো। ভাগ হবে পদ্মা দিয়ে। কার্জনের সময় যেমন হয়েছিল। দেশ তো পদ্মা দিয়ে ভাগ হয়েই আছে। ওপারে পূর্ববঙ্গ, এপারে রাঢ়। বাঙাল আর ঘটি। আর যদি মেহেরপুর পাকিস্তান হয়, তাতেই বা কি? হিন্দুস্থানে যাব লিখলে তখন বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে কোথায় কে জানে? কোন লাভ হবে তখন? দেশে মুসলমান রাজা কি আগে ছিল না? সুলতান, নবাব তখন কি হিন্দু বাস করেনি এখানে?
-তাদের সঙ্গে এদের যে তফাৎ আছে। তারা দেশ জয় করেছে, রাজা হয়েছে। তারা তো এদেশকে মুসলমানের দেশ করেনি। এরা যে মুসলমান রাজ্য করছে।
মোহিনীমোহন বললেন, তাতে দেশ চলে? অরাজকতা এসে যাবে যে। যতই বলুক, কাজে সেই আগের মতই হবে। তাঁর স্ত্রী সকলকে বলতে লাগলেন, আর কিছু বলো না। যা হবার হবে। মানুষটা মন মরা হয়ে যাচ্ছে।
বাবা বলতে লাগলেন, আমরাই মরলাম। সরকারি কর্মচারীরা বেঁচে গেল। তাদের চাকরী বজায় থাকবে, নিরাপদ স্থানে চলে যাবে। আমরা বেসরকারি চাকুরে। আমাদের গতি হবে না। যাবই বা কোথায়? দেখা যাক। জীবনে স্বাধীনতা তো দেখিনি। সেটা কেমন, কি জিনিস তাও জানিনে বুঝিনি। সবাই চেঁচায় স্বাধীনতা- স্বাধীনতা- শুনি এই মাত্র। এবার দেখা যাক। আর দেশ ভাগাভাগিও দেখিনি। এবার তাও দেখব। যদি বেঁচে থাকি। আমাদের কালেই এতো বড় ঘটনাটা ঘটছে। সবাইতো বলছে, মেহেরপুর হিন্দুস্থানে পড়বে। নাহলে এক পক্ষে ভালো হবে- ওই লীগের হামলা থেকে বাঁচা যাবে। একে মানুষের ঘরে অভাব অনটন- তার ওপরে ওই পাকিস্তানি হুমকি। মানুষ যায় কোন দিকে।
ভারতবর্ষ ভাগ হবে। বঙ্গদেশ ভাগ হবে। দিন ক্ষণ ঘোষিত হয়ে গেল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট অর্থাৎ ১৪ আগষ্ট রাত্রি বারোটার পর ঘোষিত হবে ভারতের স্বাধীনতা লাভের বার্তা। ওই সঙ্গে খণ্ডিত হবে দেশ।
ধরনী কাকা এলেন বিকালে, বাবার সঙ্গে দেখা করতে। ধরনীকুমার মল্লিক। মল্লিক জমিদার পরিবারের একজন। বাবার স্কুল জীবনের সহপাঠী। ধরনীকাকা ইউরোপে ছিলেন অনেকদিন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাট (জুট) বিষয়ে গবেষণা করে ডিপ্লোমা পেয়েছিলেন। এখন তিনি কলকাতায় থাকেন। ব্যবসা-বাণিজ্য জগতের মানুষ। মেহেরপুরে এলে তিনি আমার বাবার কাছে আসেন। এই রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে একাধিক জন একত্র হলেই বর্তমান পরিস্থিতি আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক।
বাবাই তুললেন প্রসঙ্গটা। বললেন দেশ তো স্বাধীন হচ্ছে কি রকম হবে? আমার তো অভিজ্ঞতা নেই স্বাধীন দেশ বিষয়ে। তুই ইউরোপে স্বাধীন দেশে কাটিয়েছিস অনেক দিন- কেমন হবে?
ধরনী কাকা থাকতেন জার্মানীর হ্যামারসেটে। তিনি বললেন, হ্যাঁ স্বাধীন দেশ জার্মানীতেই ছিলাম। ক্ষমতায় এলে তিনি ইংলণ্ডে চলে আসেন। এখন তিনি ইউরোপের দেশগুলো অবস্থা সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। তারপর চলে এলেন আমাদের স্বাধীনতা লাভ ও দেশভাগ প্রসঙ্গে।
বললেন, ভাই, এই দেশভাগ একটা বিপর্যয় আনবে। মানুষের নাকালের শেষ থাকবে না। চোদ্দপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবে মানুষ- ভাবা যায় না কি অবস্থা দাঁড়াবে।
বাবা বললেন, কিন্তু উপায় তো নেই।
-না আর কোন উপায় নেই। আমরা মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।
কি সেটা?
-আমাদের বিষয় সম্পত্তি, জমিদারি বেশিরভাগই তো রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর অঞ্চলে। ওই দিকটা পাকিস্তান হবেই। তখন আমাদের হিন্দু প্রজাদের এখানে এনে আমাদের জমিজমাতে বসাব- যতগুলো পরিবার সম্ভব। আর অন্যদেরও এদিকে চলে আসতে সাহায্য করব।
-যদি মেহেরপুর পাকিস্তান ভুক্ত হয়?
-তা হবে না বলেই ধারণা। তবে সবইতো একটা ষড়যন্ত্রের ব্যাপার। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ আসছেন ইংলণ্ড থেকে। তিনি বাঁদরের পিঠে ভাগ করবেন দিল্লিতে বসে। এদেশের ব্যারিস্টাররা যে যতটুকু ম্যানেজ করতে পারে। তবে মেহেরপুর যদি পাকিস্তান ভুক্ত হয়, তবে সে বিষয়েও ভেবে রেখেছি।
-কি করবে?
-মেহেরপুর পাকিস্তান ভুক্ত হলে, ঘোষণার পরদিনই মেহেরপুর ছাড়ব চিরতরে। একদিনও আর পাকিস্তানে থাকব না। জার্মানীতে হিন্ডেলবার্গ ক্ষমতায় এলেই বুঝলাম হাওয়া খারাপ- তখনই জার্মানী ছেড়েছিলাম। এখানেও তো সেই অবস্থাই হবে। শত্রুপুরী নিরাপত্তার, স্বাধীনতার বালাই থাকবে না। যে কোনও মুহূর্তে চরম লাঞ্ছনা জুটবে কপালে। প্রতিকারের উপায় থাকবে না। সেখানে কি থাকা যাবে? মানুষ যদি বিপন্ন হয়- বাড়ি ঘর বিষয় সম্পত্তির কোন মূল্য? সব পড়ে থাকবে যেমন আছে। না হলে তো লুট হবে চোখের সামনে।
বাবা বললেন, সতুরা কি করবে?
(সতু হচ্ছেন সত্যেন্দ্রভূষণ মল্লিক, মল্লিকদের পরের শরিক। ইনি আইনজীবী এবং মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান।)
ধরনী কাকা বললেন, ওরা তো আগে যাবে। কলকাতায় ওদের বাড়ি আছে, ব্যবস্থা আছে- ছাপাখানা (বানী প্রেস) আছে। অন্য ভাইরা সেখানে থাকে, কেউ চাকরী করে। ওদের অনেক সুবিধে। মল্লিক গোষ্ঠির কেউ পড়ে থাকবে না এখানে।
-হ্যাঁ, বড় তরফ রামবাবু তো জামাই- এর মৃত্যু শোক সইতে পারলেন না। চলেই গেলেন পৃথিবী ছেড়ে।
-বেঁচেছেন। বেঁচে থাকলে ভুগতেন।
ছোট মেয়ের ছেলেকে বললেন, এখানে এসে থাক, সম্পত্তি বুঝে নে। নাতি বলল, ওসব পাঁচজনকে বিলিয়ে দাও। আমাদের ব্যবসা বানিজ্য দেখার জন্যই লোক খুঁজছি। জমিদারি মানে তো সেকেলে ব্যাপার। আর ওই সব জমিজমা ও প্রজা নিয়ে কাজ আর লোকের গালমন্দ, অভিসম্পাত কুড়ান। আবার কলকাতা ছেড়ে এই গ্রামে পড়ে থাকা। দাদামশায়ের মুখের ওপর বলে দিল।
বাবা বললেন, তোমাদের সুযোগ আছে, তোমরা চলে যেতে পারবে, চলে যাবে। আমরা কি করব?
-ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। তুমি একা তো নও। দেশের হাজার হাজার পরিবার বিপন্ন হবে। দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্র বিপ্লবে, ক্ষয় ক্ষতি হয় সে তো জানা কথা। এটাতো রাষ্ট্র বিপ্লব। আমাদের স্মরণ কালের মধ্যে এমন আর ঘটেনি এ দেশে। পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ভাই, ভয় হওয়া স্বাভাবিক। তবে কি জানিস মেহেরপুর পাকিস্তান ভুক্ত হবে না।
-কিন্তু কেউ কেউ বলছে পদ্মা দিয়ে নয়, ভাগীরথী দিয়ে ভাগ হবে। লীগের দাবীও নাকি তাই।
-ওসব ভেবে কি লাভ আছে? আমাদের হাতের মধ্যে কি?
বাবা অসহায় ভাবে শ্লোক আওড়ালেন-
যাবৎ ভয়ং অনাগতম
তাবৎ ভয়ং ভেতব্যম
আগতুমত ভয়ং বীক্ষ্য
প্রতিকু্যৎ যথোউচিতম।
ধরনী কাকা হাসলেন। -হ্যাঁ এটাই সার কথা।
(ক্রমশ)