সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
NATIONALISM – Sir Rabindranath Tagore, San Francisco, The Book Club of California, MDCCCCXVII. গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত Nationalism in India শীর্ষক ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত রচনার বঙ্গানুবাদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকায় থাকাকালীন Nationalism বিষয়ে তার বক্তৃতামালার পরিপূরক হিসাবে এটি রচনা করেন।
(সেপ্টেম্বর ২০২৪, অষ্টবিংশ বর্ষ প্রথম-দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত অংশের পর)
যে সামাজিক রীতিনীতি ও আদর্শ উপরতলার উপর সম্পূর্ন নির্ভর করবার প্রথা তৈরি করেছে ও আত্মসম্মান লাভের আকাঙ্খা তৈরি করেছে ভারত বর্ষের ক্ষেত্রে আমাদের তা অপসারণ করার বিষয়ে ভাবতে হবে। ভারতে আমাদের জাতি-বর্ণ প্রথার সম্পূর্ণ আধিপত্য, বর্তমান সময়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সেকেলে প্রকাশভঙ্গি বা রীতিনীতি ও তার ধারক বাহকদের উপর নির্ভর করার অন্ধ অলস অভ্যাস ত্যাগ করার বিষয়ে ভাবতে হবে।
আবারও আমি সেই সমস্ত কঠিন বাধার প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, ভারতকে যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে সেই বাধা অতিক্রম করার জন্য। সারা বিশ্বের সমস্ত সমস্যার সামগ্রিক চেহারার ক্ষুদ্র আকার যেন সেই সমস্যাগুলি। ভারত দেশ হিসাবে আকারে সুবিশাল এবং তার অসংখ্য জাতিগুলির বিভিন্নতায় তা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এটি যেন একই ভৌগোলিক আধারে অনেকগুলি দেশ। আর ইউরোপ প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের ঠিক বিপরীত, তা যেন বহুভাগে বিভক্ত একটিই দেশ। ফলতঃ ইউরোপ তার সংস্কৃতি এবং সম্পদ বৃদ্ধিতে যেন একই দেশে বহু শক্তির সুবিধা পেয়েছে, অর্থ্যাত্ যেন সেই একই সঙ্গে একত্রিত একক শক্তির সাহায্য লাভ করেছে। এর বিপরীতে, ভারত প্রাকৃতিকভাবে বহুধা তথাপি আশ্চর্যজনক ভাবে এক হয়েও, তার বৈচিত্র্যের শিথিলতা ও নিজেদের মধ্যে ঐক্যের দুর্বলতায় ভুগছে। সত্যিকারের ঐক্য অনেকটা পৃথিবীর মতো বৃত্তাকার, এটি গড়িয়ে যায় এবং সহজেই তার নিজের বোঝা বহন করে; কিন্তু বৈচিত্র্য একটি বহুকৌণিক জিনিস যা সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হবে; যতই বলা হোক, বর্তমান ভারতের এই যে বৈচিত্র্য তা তার নিজস্ব সৃষ্টি নয়; ভারতকে তার ইতিহাসের শুরু থেকেই বৈচিত্র্যকে প্রাপ্ত সত্য হিসেবে মেনে নিতে হয়েছে।
আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায় এবং ইউরোপে শাসকেরা মূল আদিতম জনসংখ্যাকে প্রায় নির্মূল করে দিয়ে তারা তাদের বৈচিত্রের সমস্যাকে সরল করেছে। আতিথেয়তাহীন আচরণে অন্যদেশীয়দের আগমন বন্ধ করে দিয়ে তারা এমনকি বর্তমান যুগেও এই নির্মূলকরণের চেতনার ঘেরাটোপে আবদ্ধতায় নিজেদের প্রকাশ করছে। জোর করে দখল করা ভূমিতে যারা নিজেরাই আসলে বিদেশী ছিল তাদের মাধ্যমে। কিন্তু উল্টোদিকে ভারত প্রথম থেকেই জাতিগত পার্থক্য সহ্য করেছে এবং সহনশীলতার সেই চেতনা তার পুরো ইতিহাস জুড়ে কাজ করেছে।
ভারতের জাতি প্রথা পারস্পরিক সহনশীলতার চেতনার ফলশ্রুতি। কারণ ভারত বরাবরই একটি সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছে যার মধ্যে তার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করা যেতে পারে, এবং একই সঙ্গে তাদের নিজস্ব পার্থক্য বজায় রাখার স্বাধীনতা পুরোপুরি উপভোগ করা যায়। তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বাঁধন যতটা সম্ভব ঢিলেঢালা করা হয়েছে, তবুও পরিস্থিতি অনুযায়ী যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকা যায় তার প্রচেষ্টা আছে। এই ব্যবস্থায়, অনেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এর ধাঁচে সামাজিক যৌথশক্তির (সোশাল ফেডারেশন) মতো একটা কাঠামো তৈরি হয়েছে, যার সাধারণ নাম হিন্দুধর্ম।
ভারত অনুভব করেছিল যে তার ভূমিতে বর্ণের বৈচিত্র্য রাখতে হবে এবং তা থাকা উচিত, সেই ব্যবস্থার ত্রুটি যাই হয়ে থাক না কেন, সেখানে কেউ কখনোই প্রকৃতিকে আপনার সুবিধার সংকীর্ণ সীমাতে আবদ্ধ করতে পারবেন না। তার জন্য কোন না কোন দিন বিরাট মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এই বিষয়ে ভারতবর্ষ ঠিক ছিল; কিন্তু ভারত যা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল তা হল মানুষের মধ্যে পার্থক্যগুলি শিলাময় পাহাড়ের অলঙ্ঘ্য বাধার মতো চিরস্থায়ী নয় - বরং সেই পার্থক্যগুলি জীবনের প্রবাহের সঙ্গে বয়ে যাওয়া তরলের মতো, তারা তাদের গতিপথ এবং তাদের প্রভাব ও পরিব্যাপ্তি পরিবর্তন করে।
তাই ভারত তার জাতি বর্ণ বিধির মধ্যে পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু জীবনের পরিবর্তনশীলতার নিয়মকে তার প্রাপ্ত অধিকার দেয় নি। নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ এড়ানোর পদ্ধতি হিসাবে ভারতবর্ষ অনড় সামাজিক সীমানার প্রাচীরের ব্যবস্থা করেছে, যে পদ্ধতি তার অসংখ্য জাতিকে শান্তি ও শৃঙ্খলার নেতিবাচক সুবিধা দিয়েছে কিন্তু সামগ্রিক সম্প্রসারণ ও অগ্রগতির ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি হতে দেয় নি। ভারত বৈচিত্র্য সৃষ্টি হবার প্রকৃতিকে গ্রহণ করেছে, কিন্তু যেখানে প্রকৃতির সেই বৈচিত্র্যকে তার অসীম পরিবর্তন এবং সংমিশ্রণের আবিশ্ব সুযোগের জন্য ব্যবহৃত হয় সেখানে তাকে উপেক্ষা করেছে। ভারত বহু ধারায় বিরাজিত জীবনকে অপরিসীম সত্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছে, কিন্তু যেখানে সেই জীবন সর্বদা চলমান সেখানে সেই জীবনকেই অপমান করেছে। তাই জীবন তার সমাজ ব্যবস্থা থেকে বিদায় নিয়েছে এবং তার জায়গায় ভারত তার নিজের তৈরি করা অগণিত দুর্দান্ত সব খাঁচার মতো বাধ্যবাধকতাকে সমস্ত রকমের আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে পূজা করছে।
ভারত যখন বাণিজ্য স্বার্থের সংঘর্ষ এড়াতে চেষ্টা করেছে সেখানেও একই জিনিস ঘটেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় বর্ণের সাথে বিভিন্ন ব্যবসা এবং পেশাকে যুক্ত করেছে। যে পেশাদারী প্রতিযোগিতা নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয় এবং পরিবেশকে মিথ্যা ও প্রতারণা দিয়ে ভ’রে তোলে, সেই প্রতিযোগিতার অন্তহীন ঈর্ষা ও ঘৃণাকে চিরতরে কমানোর ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিশ্চয় ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভারত পরিবর্তন বা পরিব্যক্তির ধারাকে উপেক্ষা করে বংশগতির ভিত্তির উপর তার সমস্ত জোর দিয়েছে এবং এভাবে ধীরে ধীরে শিল্পকে কারুশিল্পে এবং প্রতিভাকে দক্ষতায় পরিণত করেছে।
যাইহোক, পাশ্চাত্যের পর্যবেক্ষকরা বুঝতে ব্যর্থ হন যে, ভারত তার বর্ণ ব্যবস্থায় জাতি সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব সর্বোচ্চ গুরূত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে যাতে সমস্ত ধরণের সামাজিক সঙ্ঘর্ষ এড়ানো যায় এবং একই সঙ্গে প্রতিটি জাতি তার সীমানার মধ্যে নিজস্ব স্বাধীনতা পেতে পারে। আমরা স্বীকার করি যে এই ক্ষেত্রে ভারত সফলতার উদ্দেশ্যিত লক্ষ্য সম্পূর্ণ অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু আপনাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, পাশ্চাত্য তার জাতিগুলির প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্নতা কম বা সম-প্রকৃতির হওয়া সত্বেও, সমস্যাটির এই দিকে কখনও মনোযোগ দেয়নি এবং সেইজন্য যখনই তাদের এই জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তারা এই সমস্যাটিকে গভীরতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। এবং ফলত তাদের ভূমিতে সৎ জীবনযাপনের অধিকার থেকে অন্য-দেশীয়দের বঞ্চিত করার লক্ষ্যেই পাশ্চাত্যের এশিয়া বিরোধী আন্দোলনের উদ্ভব। আপনাদের বেশির ভাগ উপনিবেশে আপনারা শুধুমাত্র ভৃত্য শ্রেণীর কাজ, যেমন কাঠ কাটা বা জল তোলার মত সামান্য বৃত্তি গ্রহণ করার শর্তে তাদের নিয়োগ করেন। হয় আপনারা অন্য দেশীয়দের বিরুদ্ধে আপনার দরজা বন্ধ করে দেন বা তাদের দাস বৃত্তিতে নামিয়ে আনেন। এবং এভাবেই আপনারা আপনাদের জাতি-দ্বন্দ্বের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন। এর গুণাগুণ যাই হোক না কেন আপনাদের স্বীকার করতে হবে যে এই পদ্ধতি সভ্যতার উচ্চতর চেতনা থেকে নয়, বরং লোভ ও ঘৃণার নিম্নতর আবেগ থেকে উদ্ভূত হয়। আপনারা বলছেন এটিই আসল মানব প্রকৃতি। যখন ভারত তার জাতিগত পার্থক্যগুলিকে সামাজিক স্তর বিন্যাসের নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ দিয়ে দৃঢ়ভাবে বাধা দিয়েছিল তখন ভারতও ভেবেছিল যে সে মানব প্রকৃতিকে প্রকৃত ভাবে জানে । কিন্তু আমরা আমাদের সামাজিক মূল্য চুকিয়ে বুঝতে পেরেছি যে মানুষের প্রকৃতি যা বাইরে থেকে মনে হয় তা নয়, বরং যা সত্য তার মধ্যেই তার অবস্থান; যা তার গহণ অন্তরের অসীম সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে। যখন আমরা আমাদের দৃষ্টিহীন অন্ধত্বের জন্য মানবতাকে তার ছিন্নভিন্ন চেহারায় দেখে তাকে অপমান করি, তখন আসলে মানবতা তার ছদ্মবেশ সরিয়ে ফেলে আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আমরা আমাদের মানব ঈশ্বরকে অপমান করেছি। আমাদের অহংকার বা স্বার্থে আমরা অন্যদের যখন ছোট করি তা তখন আমাদের নিজেদের মনুষ্যত্বকে অবনমিত করে - এবং সেটাই আমাদের সবচেয়ে ভয়ানক শাস্তি কারণ এই অবনমিত অবস্থা অনেক দেরি না হওয়া পর্যন্ত আমরা শনাক্ত করতে পারি না।
শুধু বিদেশীদের সঙ্গেই নয়, নিজের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর সঙ্গেও আপনারা মিলনের সম্প্রীতি আনেননি। দ্বন্দ্ব এবং প্রতিযোগিতার চেতনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তার বেপরোয়া কর্মজীবন গঠন করবার জন্য। আর সম্পদ ও ক্ষমতার লোভই এই চেতনার উৎপত্তির কারণ হওয়াতে এটি সহিংস মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো প্রান্তে পৌঁছতে পারে না। ভারতে পণ্যের উৎপাদনের পরিকাঠামো সামাজিক সামঞ্জস্য ব্যবস্থার রীতির অধীনে তৈরি করা হয়েছিল। এর ভিত্তি ছিল সামাজিক চাহিদার নিখুঁত সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সহযোগিতার পরিকাঠামো গঠন। কিন্তু পশ্চিমে এটি প্রতিযোগিতার প্রবণতা দ্বারা পরিচালিত হয় যার শেষ লক্ষ্য ব্যক্তির জন্য সম্পদ অর্জন। কিন্তু ব্যক্তি জ্যামিতিক রেখার মতো; এবং তা প্রস্থ ছাড়া শুধু দৈর্ঘ্যর মতো। স্থায়ীভাবে কিছু ধারণ করতে সক্ষম হওয়ার গভীরতা তা পায়নি। তাই এই প্রক্রিয়ায় লোভ বা লাভ কখনই শেষ হয় না। এই ব্যবস্থার বৃদ্ধির দৈর্ঘ্য-অন্তিম প্রক্রিয়ায় এটি অন্যান্য সমস্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক রেখা অতিক্রম করতে পারে ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, ফলত তার বিচ্ছিন্নতার শীর্ণ কৃশ অস্তিত্ব নিয়ে সম্পূর্ণতার আদর্শকে হারিয়ে ফেলে তা চলতে থাকবে।
আমাদের সমস্ত জৈবিক চাহিদায় আমরা একটা সীমা উপলব্ধি করতে পারি। আমরা এও জানি যে এই সীমা অতিক্রম করার অর্থ স্বাস্থ্যের সীমা অতিক্রম করা। কিন্তু স্বাস্থ্য ও ক্ষমতার এই লোভের কি কোন সীমা নেই যার বাইরে শুধু মৃত্যুর আধিপত্য? বস্তুবাদের এই জাতীয় কার্নিভালে পাশ্চাত্যের মানুষেরা কি তাদের প্রাণশক্তির অধিকাংশ ব্যয় করে নিছক বস্তু উৎপাদনে এবং আদর্শ সৃষ্টিকে অবহেলা করে? এবং কোন সভ্যতা কি নৈতিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা ক’রে শুধুমাত্র বস্তুগত জিনিসের উৎপাদনের ও তা ভোগের সীমাহীন প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারে? মানুষ তার সামাজিক আদর্শের ধারণায় স্বাভাবিকভাবেই তার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে এবং তা নিয়ন্ত্রণ ক’রে নিজস্ব চরিত্রকে উচ্চতর অবস্থানের অনুবর্তী করবার চেষ্টা করে। কিন্তু অর্থশাস্ত্রের বিশ্বে আমাদের স্পৃহা; সরবরাহ এবং চাহিদার দুনিয়ার রীতিনীতি ছাড়া অন্য কোনো বিধিনিষেধ মানে না। যে দুনিয়া কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা যায়, যে দুনিয়া মানুষকে স্থূলতার অন্তহীন ভোজসভায় ভোগ-স্পৃহা নিবৃত্ত করার সুযোগ দেয়। ভারতে আমাদের সামাজিক প্রবৃত্তি চাহিদার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, - হতে পারে কোন ক্ষেত্রে এটি নিপীড়নের চরম পর্যায়ে চলে গেছে, - কিন্তু পাশ্চাত্যে, অর্থনৈতিক সংস্থাগুলির চেতনায় এমন কোন নৈতিক উদ্দেশ্য নেই, যার ফলে তারা মানুষকে বস্তু সম্পদের চিরন্তন অন্বেষণে প্ররোচিত করে; - কিন্তু এর কি কোনো স্বাস্থ্যকর সীমা নেই?
যে আদর্শগুলি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রূপ নেওয়ার চেষ্টা করে তার দুটি উদ্দেশ্য বস্তু রয়েছে। একটি হল মানুষের সমন্বয়পূর্ণ বিকাশের জন্য আমাদের আবেগ এবং চাহিদা নিয়ন্ত্রিত করা, এবং অন্যটি হল তার সহনাগরিকদের প্রতি স্বার্থহীন ভালবাসা গড়ে তুলতে তাকে সাহায্য করা। তাই সমাজ হল মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ যা তার চরিত্রের উচ্চ প্রকৃতির অন্তর্গত।
খাদ্য সৃষ্টিশীলতার গুণসম্পন্ন, এটি আমাদের শরীর গঠন করে; কিন্তু মদ্য জাতীয় উত্তেজক পানীয় তা নয়, মদ্য উত্তেজনা তৈরি করে। সামাজিক আদর্শ আমাদের মানব জগৎ তৈরি করে, কিন্তু যখন আমাদের মন ক্ষমতার লোভে সামাজিক আদর্শ থেকে দূরে সরে যায় তখন সেই নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় আমরা অস্বাভাবিকতার জগতে বাস করি, তখন আমাদের শক্তি আর স্বাস্থ্যের পরিচয় নয় এবং আমাদের মুক্তিও স্বাধীনতা নয়। তাই রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের স্বাধীনতা দেয় না যদি না আমাদের মন মুক্ত হয়। একটি মোটরগাড়ী চলাচলের স্বাধীনতা তৈরি করে না, কেননা তা একটি নিছক যন্ত্র মাত্র। আমি নিজে যখন স্বাধীন থাকি তখন আমি আমার স্বাধীন উদ্দেশ্যে মোটরগাড়ী ব্যবহার করতে পারি।
বর্তমান সময়ে আমাদের কখনই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, কোন দেশের মানুষ তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলে তারা নিছক ক্ষমতাবান হতে পারে কিন্তু তারা প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হয় না। তাদের মধ্যেকার লাগামহীন আবেগ, তাদের মধ্যে স্বাধীনতার ছদ্মবেশে দাসত্বের বিপুল সংগঠন তৈরি করে। যারা অর্থ সম্পদ লাভকে তাদের সর্বোচ্চ কৃত্যে পরিণত করেছে তারা অবচেতনভাবে তাদের জীবন এবং আত্মা ধনী ব্যক্তিদের কাছে বা অর্থের প্রতিনিধিত্বকারী বিষয়ের কাছে বিক্রি করছে। যারা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট এবং বিদেশী জাতিগুলির উপর তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য গর্বিত তারা ধীরে ধীরে তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা এবং মানবতাকে অন্যান্য জনগণকে দাসত্বে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠনগুলির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে। তথাকথিত মুক্ত দেশগুলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুক্ত নয়, তারা সংখ্যালঘুদের দ্বারা এমন কোন একটি লক্ষ্যে চালিত হয় যা তারা বুঝতেও পারে না। মানুষ যখন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতাকে কোনও প্রয়োজন হিসেবেই স্বীকার করে না, তখনই শুধুমাত্র এটা সম্ভব হয় । তারা তাদের প্রচন্ড আবেগে বিপুল এক ঘূর্ণিপাক তৈরি করে এবং সেই ঘূর্ণায়মান আন্দোলনের নিছক বেগে তাদের নিজেদের মাথা ঘুরতে থাকে; তারা এই অবস্থাকেই স্বাধীনতা বলে মনে করে। কিন্তু যে নিয়তি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে তা মৃত্যুর মতোই নিশ্চিত - কারণ মানুষের সত্য হল নৈতিক সত্য এবং তার মুক্তি আধ্যাত্মিক জীবনে।
ভারতের বর্তমান জাতীয়তাবাদীদের অধিকাংশের সাধারণ মতামত হল যে আমরা আমাদের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শের চূড়ান্ত পূর্ণতায় পৌঁছেছি; সমাজের গঠনমূলক কাজের দায়িত্বটি আমাদের জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে সম্পন্ন করা হয়েছিল এবং সেইজন্য এখন আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের সকল কর্মকান্ডকে রাজনৈতিক দিকনির্দেশের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি। আমরা কখনই সামাজিক অপ্রতুলতাকে আমাদের বর্তমান অসহায়ত্বের উৎস হিসাবে চিহ্নিত করে দোষারোপ করার স্বপ্ন দেখি না, কারণ আমরা আমাদের জাতীয়তাবোধের ধর্মমত হিসাবে মেনে নিয়েছি যে এই সমাজ ব্যবস্থাটি আমাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা সর্বকালের জন্য নিখুঁত ভাবে তৈরি হয়েছে। সেই পূর্বপুরুষ যাদের অনন্ত কালের অতিমানবীয় দৃষ্টি ছিল এবং ভবিষ্যত যুগের বিধান নির্দিষ্ট করার জন্য অতিপ্রাকৃত শক্তি ছিল। তাই আমাদের সকল দুঃখ-দুর্দশা ও ত্রুটির জন্য আমরা বাইরে থেকে আমাদের উপর বর্ষিত হওয়া এই ঐতিহাসিক বিস্ময়কে দায়ী করি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা মনে করি যে আমাদের একটি কাজ হল সামাজিক দাসত্বের চোরাবালির উপর স্বাধীনতার রাজনৈতিক বিস্ময় সৃষ্টি করা। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের নিজস্ব স্বাভাবিক ঐতিহাসিক স্রোতের প্রকৃত গতিপথ বন্ধ করতে চাই এবং শুধুমাত্র অন্যান্য জনগণের ইতিহাসের উৎস থেকে শক্তি ধার করতে চাই।
ভারতে আমরা যারা এই ভ্রান্তিতে পড়েছি যে নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমাদের মুক্ত করবে তারা পাশ্চাত্য থেকে তাদের আহরিত জ্ঞান-কে সুসমাচারের সত্য হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং মানবতার প্রতি তারা বিশ্বাস হারিয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সমাজে আমাদের লালিত দুর্বলতাগুলি, রাজনীতিতে আমাদের বিপদের উৎস হয়ে দাঁড়াবে। একই জাড্য যা আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানে মৃত রূপের মূর্তিপূজার দিকে নিয়ে যায় তা আমাদের রাজনীতিতে অনড় দেয়াল সহ কারাগার তৈরি করবে। সহানুভূতির সংকীর্ণতা - যার সাহায্যে আমাদের পক্ষে মানব সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের উপর হীনমন্যতার জোয়াল চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, তা আমাদের রাজনীতিতে অন্যায়ের স্বেচ্ছাচারতন্ত্র সৃষ্টি করে নিজেকে জাহির করবে।
আমাদের জাতীয়তাবাদীরা তাদের আদর্শের কথা বলতে গিয়ে ভুলে যান যে, জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ত্রুটিপূর্ণ। যে লোকেরা এই আদর্শগুলিকে সমর্থন করে তারা নিজেরাই তাদের সামাজিক অনুশীলনে সবচেয়ে রক্ষণশীল। জাতীয়তাবাদীরা উদাহরণ স্বরূপ বলেন যে, আপনারা সুইজারল্যান্ডের দিকে তাকান, যেখানে জাতিগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন জনগোষ্ঠী একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারা মনে রাখেন না যে, সুইজারল্যান্ডে জনগণ জাতিতে মিশে যেতে পেরেছে কারণ তারা তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ করতে করতে পারে এবং তারা একই রক্তধারার বাহক। ভারতে সেরকম কোন সাধারণ জন্মগত অধিকার নেই। যখন আমরা পাশ্চাত্য জাতীয়তার কথা বলি তখন আমরা ভুলে যায় যে সেখানকার জাতিগুলির মধ্যে একে অপরের প্রতি সেই শারীরিক বিকর্ষণ নেই, যা আমাদের বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে রয়েছে। যে জনগোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক মিলিত হবার বা বৈবাহিক সম্পর্কের সুযোগ নেই, তাদের অন্তর্ভুক্ত মানুষেরা কেউ, ভাড়াটে উদ্দেশ্য বা অন্যতর বাধ্যবাধকতা ছাড়া, অপর গোষ্ঠীর কারোর জন্য নিজের প্রাণ বাজী রাখছে এমন দৃষ্টান্ত কি আমরা সারা পৃথিবীতে একটাও পেয়েছি? এবং আমাদের জাতি একীকরণের বিরুদ্ধে এই নৈতিক বাধাগুলি আমাদের রাজনৈতিক ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, তা কি আমরা কি কখনও আশা করতে পারি?
আমাদের সামাজিক বিধিনিষেধ এখনও অত্যাচারী, জনগণকে কাপুরুষ করে তোলার মতো, আবারও আমাদের এই সত্যের পূর্ণ স্বীকৃতি দিতে হবে। যদি একজন মানুষ আমাকে বলে যে তার ভিন্নধর্মী ধারণা আছে, কিন্তু সে সেগুলি অনুসরণ করতে পারে না কারণ সেক্ষেত্রে সে সামাজিকভাবে বঞ্চিত হবে, আমি তাকে ক্ষমা করি, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য তাকে অসত্যের জীবনযাপন করে যেতে হবে। মনোজগতের সামাজিক অভ্যাস যা আমাদের সহ-নাগরিকদের জীবনকে তাদের কাছে বোঝা করে তোলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র উপলক্ষে। হয়তো খাদ্যাভ্যাসে তারা আমাদের থেকে আলাদা, সেক্ষেত্রেও সেই বিষয়টি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কারে টিকে থাকবে এবং এর ফলে নিগ্রহের সচল যন্ত্র তৈরি হবে যা প্রতিটি যৌক্তিক পার্থক্য তথা জীবনের লক্ষণকে চূর্ণ করার জন্য হাজির থাকবে। আর সেই অত্যাচার আমাদের রাজনৈতিক জীবনে অনিবার্য মিথ্যা ও ভণ্ডামিকে বাড়িয়ে দেবে। নিছক স্বাধীনতা কি এতই মূল্যবান যে এর জন্য আমাদের নৈতিক স্বাধীনতাও বলি দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে?
যখন আমরা আমাদের যৌবনের প্রাণবন্ত উচ্ছ্বল অবস্থায় থাকি তখন আমাদের অভ্যাসের অমিতাচার অবিলম্বেই তার প্রভাব দেখায় না। কিন্তু সেই অমিতাচার ধীরে ধীরে শক্তিকে গ্রাস করে এবং যখন পতনের সময়সীমা শুরু হয় তখন আমাদের ফিরে দেখা শুরু হয় ও তার ঋণ পরিশোধ করতে হয়, যা আমাদের দেউলিয়া অবস্থার দিকে নিয়ে যায়। পাশ্চাত্যে যদিও তখনও আপনার মানবতা প্রতি মুহূর্তে সংগঠন-শক্তির নেশায় চূড়ান্ত আসক্ত থেকে যাবে এবনহ সেখানে আপনি তখনও আপনার মাথা উঁচু রাখতে সক্ষম হবেন। ভারতও তার পূর্ণ বিকশিত যৌবন শক্তিতে, অনমনীয় কঠোর উত্কর্ষতায় পৌঁছে যাওয়া সামাজিক সংগঠন বা সংস্কারের মৃত ওজন বহন করতে পারে কিন্তু তা তার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়েছে এবং তার চিন্ময় প্রকৃতির ক্রমশ পক্ষাঘাত সৃষ্টি করেছে। আর এই কারণেই ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায় ভারতের সামাজিক প্রয়োজনীয়তার প্রতি অসংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। তারা আমাদের সামাজিক কাঠামোর নিশ্চল গতিহীনতাকে তাদের পরিপূর্ণতার চিহ্ন হিসাবে গ্রহণ করছে এবং যেহেতু আমাদের সামাজিক জীবনের শাখা প্রশাখায় ব্যথা বহন করার সুস্থ অনুভূতির মৃত্যু হয়েছে, তারা এই ভেবে নিজেদের প্রতারিত করে যে কোন রকম পরামর্শ বা মন্ত্রণার প্রয়োজন নেই। তাই তারা মনে করে যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই তাদের সমস্ত শক্তি নিয়োজন করা প্রয়োজন। এটা যেন সেই রকম হল, যেখানে একজন ব্যক্তি যার পা কুঁচকে গেছে এবং অকেজো হয়ে গেছে, সে নিজেকে ভোলানোর চেষ্টা করছে এই বলে যে তার অঙ্গগুলি এখনও বাড়ন্ত অবস্থায় আছে এবং আসলে যেটা ঠিক নেই সেটা হল তার সাহায্যকারী প্রয়োজনীয় যষ্টির মাপ।
ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্জন্মের জন্য অনেক কিছু বলা হলো। এখন আমরা তার শিল্পগুলির বিষয়ে আসি। আমাকে প্রায়শই জিজ্ঞাসা করা হয় যে ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা দখলের পর থেকে ভারতে কোনও শিল্পের পুনরুত্থান হয়েছে কিনা। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে আমাদের নিজস্ব শিল্পগুলিকে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং তারপর থেকে বিশ্বের দানবিক ক্ষমতা সম্পন্ন বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সক্ষম হয়ে ওঠার জন্য কোনও প্রকৃত সাহায্য বা উৎসাহ আমরা পাইনি। ক্ষমতাশালী জাতিগুলি স্থির করে দিয়েছে যে আমাদেরকে আবশ্যিক ভাবে কৃষিপ্রধান সমাজ হয়ে থাকতে হবে, এমনকি ভবিষ্যতের জন্য অস্ত্রের ব্যবহার ভুলে যেতে হবে। এইভাবে ভারতকে এমন সহজ-ভোগ্য পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে যে কোনো জাতি যারা খুব সাম্প্রতিক কালেও ক্ষমতা অর্জন করেছে তারাও যে কোনো আমাদের দেশকে মুহূর্তে গিলে ফেলতে পারবে।
তাই বর্তমানে শিল্পে মৌলিকতার জন্য ভারতের খুব কম বাজার আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান সময়ের অসাধু সংগঠনে বিশ্বাস করি না। সমগ্র সৃষ্টির সাথে তাদের কদর্যতা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রকৃতির বিপুল শক্তি তার সত্য হিংস্রতায় প্রকাশ করে না, বরং সৌন্দর্যে করে। সৌন্দর্য হল সেই স্বাক্ষর যা স্রষ্টা যখন বিভিন্ন কাজে সন্তুষ্ট হন তখন তার উপর সেই সিলমোহর দেন। যে সমস্ত পণ্য নিখুঁত হবার প্রকরণ গুলিকে উদ্ধতভাবে উপেক্ষা করে এবং তাদের প্রদর্শনে নির্লজ্জ হয় সেগুলি ঈশ্বরের অসন্তুষ্টির চিরন্তন ভার বহন করে। তোমার বাণিজ্য যতক্ষণ পর্যন্ত স্বাভাবিক চারু-মাধুর্যের মর্যাদার অভাবে আক্রান্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত তা অসত্য। ‘সৌন্দর্য’ এবং তার যমজ ভাই ‘সত্য’ র প্রসারের জন্য অবসর, এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কিন্তু লাভের প্রতি লোভ এর পরিমাণের কোন সময় বা সীমা নেই। এর একটাই উদ্দেশ্য হল উৎপাদন করা এবং ভোগ করা। লাভের লোভ আমাদের এই সুন্দর প্রকৃতির জন্য বা জীবিত মানুষের জন্য কোন করুণা করে না। এক মুহূর্ত দ্বিধা ছাড়াই সৌন্দর্য এবং জীবনকে পিষে, টাকাতে রূপান্তরিত করতে এই লোভ নির্মমভাবে প্রস্তুত থাকে। আমাদের প্রাচীনকালে যখন মানুষ পরিপূর্ণ মানবতার একটি নির্ঝঞ্ঝাট দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট অবকাশ পেত, তখন বাণিজ্যের এই কুৎসিত অশ্লীলতা তাকে অবজ্ঞার তিরস্কারে ভূষিত করতো। সেই সময়ে পুরুষরা নিছক অর্থ উপার্জনের প্রবৃত্তির জন্য লজ্জিত ছিল। কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক যুগে অর্থ সম্পদ, খুবই অস্বাভাবিক বিস্তৃতিতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। অথচ যখন এই স্তূপীকৃত সম্পদের বিকিরিত বিশিষ্টতার দম্ভ যখন মানুষের উচ্চ প্রবৃত্তিকে অপমান করে, তার চারপাশ থেকে সৌন্দর্য এবং মহৎ অনুভূতিকে বিলুপ্ত করে, তখন আমরা নতি স্বীকার করি। কেননা আমরা আমাদের নীচ প্রবৃত্তির জন্য তাদের কাছ থেকেই ঘুষ নিয়েছি এবং আমাদের কল্পনা তার সম্পদের বিশালতার সামনে মাথা হেঁট করে ধুলোয় মিশে গেছে।
কিন্তু বাণিজ্য সভ্যতার পরিপাট্যহীনতা এবং এর অন্তহীন জটিলতাই এর ব্যর্থতার প্রকৃত লক্ষণ। একজন বিশেষজ্ঞ সাঁতারু তাঁর ভয়ংকর শরীর প্রক্ষেপণের মাধ্যমে তার পেশী শক্তি প্রদর্শন করেন না, তবে এমন কিছু শক্তি প্রদর্শন করেন যা অদৃশ্য এবং যার ফলে তাকে নিখুঁত মাধুর্যে আন্দোলনহীন দেখায়। পশুদের থেকে মানুষের প্রকৃত পার্থক্য তার ক্ষমতা এবং নৈতিক যোগ্যতা, যা অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং অদৃশ্য। কিন্তু বর্তমান সময়ের মানুষের বাণিজ্যিক সভ্যতা শুধু অত্যধিক সময় ও স্থানের দখল নিচ্ছে না, সময় ও স্থানকে হত্যাও করছে। এই সভ্যতার গতিবিধি হিংস্র, এর কোলাহল অস্বাভাবিকভাবে প্রবল। এই সভ্যতা তার নিজস্ব অভিশাপ বহন করছে কারণ তা মানবতাকে পদদলিত করে বিকৃত করছে এবং সেই বিকারের উপর এটি দাঁড়িয়ে আছে। এই সভ্যতা প্রচন্ড আয়াসে, সুখের বিনিময়ে অর্থ সম্পদ সংগ্রহ করছে। মানুষ তার প্রতিষ্ঠানের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি করার লক্ষ্যে নিজেকে তার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনছে। সে তার মানবিক অনুভূতিগুলোকে উপহাস করে লজ্জায় অবসিত করছে কারণ সেই অনুভূতিগুলি যান্ত্রিক সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য উপযুক্ত।
আমাদের পৌরাণিক কাহিনীতে কিংবদন্তি রয়েছে যে, যে ব্যক্তি অমরত্ব অর্জনের জন্য তপস্যা শুরু করেন তাকে অমর দেবতাদের প্রভু ইন্দ্রের প্রেরিত প্রলোভন জয় করা প্রয়োজন। সে যদি সেই প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয় তবে সে হারিয়ে যায়। পাশাত্য তার অমরত্বের লক্ষ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। ইন্দ্র তাকে পরীক্ষা করার জন্য প্রলোভন পাঠিয়েছে। সেটি হলো অর্থ সম্পদের চমৎকার প্রলোভন। পাশ্চাত্য সেই প্রলোভন গ্রহণ করেছে এবং তাদের সভ্যতা যন্ত্র সভ্যতার উষর প্রান্তরে মানবতা ভিত্তিক সভ্যতার পথ হারিয়েছে।
কুৎসিত সাজসজ্জার বর্বরতা সহ এই বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য সমগ্র মানবতার জন্য একটি ভয়ঙ্কর হুমকি। কারণ তা পরিপূর্ণতার আদর্শের উপর ক্ষমতার আদর্শকে প্রতিস্থাপন করেছে। এই বাণিজ্য ব্যবস্থা স্বার্থান্বেষীর পরমোল্লাসকে নগ্ন নির্লজ্জতায় পরিণত করছে। আমাদের স্নায়ুগুলি আমাদের পেশীগুলির চেয়ে বেশি সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল। যদি আমরা আমরা আমাদের যত্নশীল সুরক্ষা তাদের থেকে সরিয়ে নিই যা সেই অত্যন্ত দামী জিনিসগুলির জন্য আমাদের দেওয়ার কথা, তখন আমাদের ভিতরের সবচেয়ে দামী জিনিসগুলি শিশুর মতো অসহায় হয়ে পড়ে। তাই ক্ষমতার নির্মম অভদ্রতা যখন মানবতার বিস্তৃত পথে ছুটে যায়, তখন তার স্থূলতার ভয়ে আদর্শগুলো সরে যায়, যে আদর্শগুলির জন্য আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শহীদ হয়েছি।
শক্তিশালীদের জন্য যে প্রলোভন মারাত্মক, তা দুর্বলদের জন্য আরও বেশি মারাত্মক। আমি আমাদের ভারতীয় জীবনে সেই প্রলোভনকে স্বাগত জানাবো না, এমনকি অমর প্রভুরা তা পাঠালেও। আমাদের জীবন তার বাহ্যিক দিক থেকে সহজ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদে সমৃদ্ধ হোক। আমাদের সভ্যতাকে তার সামাজিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দৃঢ় অবস্থান নিতে দিন, অর্থনৈতিক শোষণ ও সংঘাতের ভিত্তিতে নয়। অর্থনৈতিক ড্রাগনদের দ্বারা আমাদের জীবন-শোণিত নিষ্কাশনের দন্তের বিরুদ্ধে কীভাবে এটি করা যায় তা মানব আত্মায় বিশ্বাসী সমস্ত প্রাচ্য জাতির চিন্তাবিদদের সামনে নির্ধারিত কাজ। আমাদের নিজস্ব আদর্শ ছাড়া অন্য আদর্শের প্রবক্তা এমন চিন্তাবিদদের আরোপিত শর্তগুলি মেনে নেওয়া অলসতা এবং পুরুষত্বহীনতার লক্ষণ। আমাদের ইতিহাসকে তার নিজের যথাযথ লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করার জন্য বিশ্বশক্তিগুলিকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করা উচিত।
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে আপনি বুঝতে পারবেন যে আমি অর্থনীতিবিদ নই। আমি অবশ্যই স্বীকার করতে চাই যে চাহিদা এবং যোগানের একটি সূত্র রয়েছে এবং মানুষের তার নিজের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুর চেয়ে আরো বেশি কিছু পাওয়ার প্রতি মোহ রয়েছে। তবুও আমি এই বিশ্বাসে অটল থাকব যে মানবতার মধ্যে সুসমঞ্জস সম্পূর্ণতার মতো একটি ধারণা রয়েছে, যেখানে দারিদ্র্য তার সম্পদ কেড়ে নেয় না, যেখানে পরাজয় তাকে জয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে, মৃত্যু তাকে অমরত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং চিরন্তন ন্যায়বিচারের ক্ষতিপূরণস্বরূপ যারা একেবারে পশ্চাদবর্তী তারাও তাদের অপমান একটি সোনালী বিজয়ে রূপান্তরিত করতে পারে।