সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
দু'হাজার চার'শ শ্লোকে রচিত রামায়ণ মহাকাব্য সমগ্র ভারতবাসীর কাছে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রভাবের অধিকারী। দেশবাসী একে ভারতাত্মার প্রতীক হিসাবে সবকালেই গ্রহণ করেছে। পৃথিবীর সাহিত্যপ্রেমী মানুষও এর কাব্যিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছেন। সেই আকর্ষণের ফলে সুদূর অতীত কাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালু হয়েছে রামকথা। সেই বিষয়ে এ.কে রামানুজন তাঁর বই Three Hundred Ramayanas! Five Examples And Three Thoughts on Translation-এ যথাযথ প্রশ্ন তুলেছেন দেশ বিদেশে প্রচলিত নানা ধরনের রামায়ণের মোট সংখ্যা কত। কারণ এইসব প্রচলিত কোন কোনও রামায়ণের শেষে প্রশ্নও রয়েছে রামায়ণের মোট সংখ্যা কত হতে পারে?
এইসব প্রশ্নের উত্তর হিসাবে অনেক গল্পের মধ্যে রামানুজনের উদ্ধৃত একটি গল্প হলো -- রাম একদিন সিংহাসনে বসে থাকার সময়ে তাঁর আংটিটা খুলে পড়ে গিয়ে মেঝেতে একটা ফুটো করে ঢুকে হারিয়ে গেল। হনুমানকে আংটিটা খুঁজে আনতে বললে হনুমান খুব ছোট হয়ে সেই ফুটো দিয়ে গলে গিয়ে পাতালপুরীতে পড়ে গেল। হনুমানকে দেখে সেখানকার কয়েকজন মহিলা তাকে ধরে পাতালপুরীর ভূতের রাজার কাছে নিয়ে গেল খাবারের থালার ওপর তাকে বসিয়ে। রাজার রাতের খাবার হিসাবে। হনুমান রামের নাম জপ করতে লাগল।
ভূতের রাজা হনুমানের পরিচয় এবং পাতালপুরীতে তার আসার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে হনুমান আংটি নিয়ে ফেরৎ যাওয়ার কথা জানালো। ভূতের রাজা হনুমানকে একটা থালা দেখালো যার ওপর হুবহু একই রকম দেখতে হাজার হাজার আংটি রাখা ছিল। ভূতের রাজা তার ভেতর থেকে হনুমানকে তার রামের আংটি খুঁজে নিতে বলায় হনুমান পারল না। নিজের অক্ষমতার কথা জানালে হনুমানকে ভূতের রাজা বললো থালায় যতগুলো আংটি রয়েছে ততজন রাম আছেন। হনুমান আর মর্ত্যে ফিরে গিয়ে তার রামকে দেখতে পাবে না, যেহেতু রামের এই জন্ম শেষ হয়েছে। রামের জন্ম শেষ হলে আংটিটা নিচে পড়ে যায়। ভূতের রাজা সেগুলো জমিয়ে রাখে।
হনুমান যখন পাতালপুরীতে রয়েছে সেই সময় বশিষ্ট মুনি আর ব্রহ্মা রামের সঙ্গে দেখা করে জানিয়ে গেছেন যে মানুষের পৃথিবীতে রামের কাজ শেষ হয়ে গেছে। রামজন্ম শেষ করে তাকে আবার ফিরে যেতে হবে দেবলোকে। রাম লবকুশকে সিংহাসনে বসিয়ে সরযূ নদীতে বিলীন হয়ে গেলেন।
এই হিন্দি লোককাহিনী আমাদের বুঝিয়ে দেয় প্রত্যেক রামের জন্য আলাদা আলাদা রামায়ণ রয়েছে। গত প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে গোটা দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রামায়ণের প্রভাব পড়েছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ইন্দোচীনে রামায়ণের (ও মহাভারতের) প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন - "রামায়ণ ও মহাভারত ভারতীয় সভ্যতার উপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে তাহা আমরা সকলেই জানি। ভারতবাসীগণ যখন সুদূর প্রাচ্যে উপনিবেশ স্থাপন ও ভারতীয় সভ্যতার প্রতিষ্ঠা করেন তখন যে এই দুইখানি মহাকাব্যও ওই সমুদয় দেশে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিবে এই অনুমান অত্যন্ত সঙ্গত ও স্বাভাবিক। যবদ্বীপ ও বালিদ্বীপে যে রামায়ণ ও মহাভারতের বিশেষ আদর ছিল তাহার বহু প্রমাণ আছে। এই দুইখানি মহাকাব্যই ওই দেশীয় ভাষায় অনুদিত হইয়াছিল এবং ইহাদের বিশেষ বিশেষ আখ্যান অবলম্বন করিয়া বহু গ্রন্থ ওই ভাষায় রচিত হইয়াছিল। মন্দিরে মন্দিরে এই দুই গ্রন্থের ঘটনাবলী খোদিত হইত এবং যাত্রা নাটক প্রভৃতির আখ্যানভাগও প্রধানত এই দুই গ্রন্থ অবলম্বনেই রচিত হইত। যবদ্বীপ ও বালিদ্বীপ ব্যতীত অন্যান্য আরও অনেক স্থানে রামায়ণ ও মহাভারতের যথেষ্ট পঠন পাঠন ছিল। প্রাচীন কম্বোজ দেশ (কম্বোডিয়া) ও চম্পাদেশে (বর্তমান আনাম) এ বিষয়ে যে কয়েকটি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাহাই এই প্রবন্ধে আলোচনা করিব।" (ইন্দো-চীনে রামায়ণ ও মহাভারত)। রামায়ণ, মহাভারত এই সব দেশে যাওয়ার পরে সেদেশের লোকমুখে লোককাহিনীর মাধ্যমে পরিবেশনের সময় তা নানা রূপে সামনে এসেছে। এমনকি স্বতন্ত্র এক একটি রামায়ণ বা মহাভারতও নির্মিত হয়েছে। আসলে কয়েক শতক ধরে প্রচলিত এই মহাকাব্যের নানা রূপ পরিবর্তিত হয়েছে নানাভাবে। শুধু সংস্কৃত ভাষাতেই পঁচিশটা বা তারও বেশি রামায়ণের কথা আছে বলে রামানুজন জানিয়েছেন। রামানুজন এও জানিয়েছেন যে কন্নড় ভাষায় এক হাজারের বেশি রামায়ণ আছে, তেলেগু ভাষাতেও রামায়ণের সংখ্যা এক হাজারের মত।
রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর উল্লিখিত প্রবন্ধে তো বটেই অন্যত্রও রামায়ণ ও মহাভারতকে 'মহাকাব্য' বলে উল্লেখ করেছেন। রূপক বা পুরাণ নয়। ড. গৌরীনাথ শাস্ত্রীও "রামায়ণের মত প্রথম শ্রেণির কাব্যশিল্পকে রূপক বা পুরাণ রূপে কল্পনা" করার কোন যুক্তি খুঁজে পাননি। এমন কোনও কল্পনা বা আদর্শ নেই কিংবা এমন কোন ভাব বা অভিব্যক্তি নেই যা অত্যন্ত নিপুণভাবে অত্যন্ত সুমধুর ভাষায় রামায়ণে লেখা হয়নি। সেকারণেই রবীন্দ্রনাথের কথায়, "মুদির দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত সর্বত্রই তাহার সমান সমাদর।"
অসংখ্য জাতি-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, বিচিত্র মানসিকতা ও ভৌগোলিক প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা এই দেশে মহাকবি বাল্মীকি ভারতীয় ধর্ম ও আর্যসমাজকে সুদৃঢ় আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং এক ঐক্যবদ্ধ ভারত চেতনা গড়ে তুলতে রচনা করেছিলেন আর্য-অনার্য যুদ্ধ ও রামের বিজয় গৌরব কাহিনী নিয়ে রামায়ণ মহাকাব্য। তিনি যে রামচন্দ্রের কথা বলেছেন সেই রামচন্দ্র সম্পূর্ণভাবে রক্তমাংসের শরীরে একজন আদর্শ পুরুষ। বাঙালী কবি কৃত্তিবাস আদিকাণ্ডেই রাম ও তাঁর ভাইদের নারায়ণের অবতার হিসাবে চিত্রিত করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ সাংকালিয়ার মতে পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দ থেকেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম রামের অবতারত্ব মেনে নিয়েছে।
রামায়ণের নানা রূপ ও ভাষ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটতে শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন নয়। এইসব নানা ভাষ্য থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে রামায়ণের ব্যাপ্তি সীমাহীন। নানা কালে নানা দেশে বিভিন্ন রচয়িতার হাতে রামায়ণ নানা রূপ নিয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রামকাহিনীকে নতুনভাবে রূপান্তরিত করা হয়েছে। রামকথার প্রচলিত যে রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয়, যা বাল্মীকির রচনা বলে আমাদের জানা। কোনও কোনও রামায়ণ গবেষকের মতে, বাল্মীকির সেই রামায়ণ রচিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই রামকে নিয়ে নানা ধরনের কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁদের মতে ভারতের সর্বত্র রামচন্দ্র তখনই নানা জনের কাছে কিংবদন্তির নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি বিভিন্ন চলাচলের সূত্রে ভারতের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলেও তা প্রচারিত হয়েছিল।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শ্যাম কম্বোজ চম্পা বালি সুমাত্রা যবদ্বীপে রামকাহিনী নতুন রূপ পেয়েছিল। বাল্মীকির রামায়ণের সাথে সম্পর্কহীন এমন অনেক অলৌকিক কাহিনীও বিভিন্ন রামকথার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
বৌদ্ধ জাতকে যে দশরথের কাহিনী সেখানে রাম ও সীতা পরস্পর ভাইবোন। পরে তাকে চিত্রিত করা হয়েছে স্বামী স্ত্রী রূপে। প্রাচীন তামিল কথায় সীতা মন্দোদরীর গর্ভজাত কন্যা। নিঃসন্দেহে বলা যায় এসব প্রাচীন লোকবিশ্বাসজাত কল্পনার ফসল। অর্থাৎ রামকথা সুসংহত সামগ্রিক রূপ পাওয়ার আগেই রামকে নিয়ে নানা ধরনের কিংবদন্তি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর রামায়ণের জনপ্রিয়তা একথা প্রমাণ করে যে রাজা হিসাবে রামচন্দ্র একজন উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন।
রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকিকে আমরা শুধুমাত্র মহাকবি বলি না। আদি কবি হিসাবেও তিনি পরিচিত। রামকাহিনী ত্রেতা যুগের (পুরাণ কথিত)। তার বৈশিষ্ট্য হল এই যে প্রাচীন কাল থেকে তা শুধু ভারতবর্ষে নয়, ভারতের বাইরেও তার প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রাচীন কালের তিনটি সভ্যতার ধারাকে বাল্মীকি তাঁর রামায়ণের মধ্যে এমনভাবে প্রতিফলিত করেছেন যার ফলে ভারতবর্ষের একটি সামগ্রিক রূপ সেখানে ফুটে উঠেছে। প্রাচীন ভারতের আর্যসভ্যতা, বনবাসী বানর সভ্যতা এবং ভোগবাদী রাক্ষস সভ্যতার কোনটিকেই তিনি ছোট করে দেখাননি। বলা যেতেই পারে উত্তর ভারতের আর্যসভ্যতা, দক্ষিণ ভারতের বনবাসী সভ্যতা ও রাক্ষস সভ্যতার ত্রিধারার মধ্যে দিয়ে রামায়ণ বিস্তার লাভ করেছে। আর বাল্মীকি রামায়ণের বড় বৈশিষ্ট্য হল এর মাধ্যমেই উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের প্রথম পরিচয়। রামকাহিনী ভারতবর্ষের মধ্যে যেমন নানা ভাষায় নতুন নতুন ভাষ্য সহ রামায়ণ তৈরি করেছে তেমনি ভারতের বাইরেও রামকাহিনী নতুন ভাবে নিজস্ব আঙ্গিকে রামায়ণ সৃষ্টির দিকে কবিদের আগ্রহী করেছে।
ঐতিহাসিক সত্য হল রামকাহিনী শুধু ভারতবর্ষের নানা ভাষায় নয়, ভারতের বাইরেও নানা ভাষাতে রচিত হয়েছিল। অত্যন্ত প্রাচীন কাল থেকে ভারতের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিস, মিশর, পারস্য, আসিরিয়া প্রভৃতি দেশের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে যাতায়াত করতেন। তাঁদের মাধ্যমে ভারতবর্ষের বহু কাহিনী, ভাবনা এইসব দেশে পৌঁছেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণেও ভারতবর্ষের মানুষ সুমাত্রা, কম্বোজ, যবদ্বীপ এসব জায়গায় গেছে এবং পরবর্তী কালে বসতি করেছে। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তারের বহু পরিচয় রয়েছে এইসব দেশে। কোনও কোনও প্রাচীন মন্দিরের গায়ে সেখানকার শিল্পীদের খোদাই করা রামায়ণের কাহিনী আজও দেখা যায়।
জাতকের রামকাহিনীর/রামকথার সঙ্গে বাল্মিকীর রামায়ণের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। যদিও একথা সত্য যে জাতকের কাহিনীর মাধ্যমেই রামকাহিনীর অংশ বিশেষ ভারতের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। জাভা, বালি, সুমাত্রা এমনকি চীনেও রামকথা ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে অধাপক সিলভাঁ লেভি রামায়ণের চীনা সংস্করণের কথা জানিয়েছিলেন। সেই সংস্করণের মধ্যে রামায়ণের নামগুলো যদিও ছিল না কিন্তু বিষয়বস্তু একই ছিল। চীনা তুর্কিস্তানেও রামায়ণের একটি সংস্করণ পাওয়া গেছে।
গবেষকদের মতে অবশ্য রামবাহিনী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল দ্বীপময় ভারত বলে পরিচিত সব দেশগুলোয় এবং শ্যামদেশে। এমনকি ওই সমস্ত দেশে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী শাসনের প্রভাব বাড়লেও সেখানে ভারতীয় সংস্কৃতি লোপ পায়নি। সেইসব দেশে এখন রামায়ণ কাহিনী জাতীয় কাহিনী হিসাবেই গৃহীত হয়েছে। রামায়ণ উৎসব এখনও এইসব দেশের জাতীয় উৎসব। রাময়ণ কাহিনী ইন্দোনেশিয়ার জীবনকে এমন প্রভাবিত করেছে যে সেই দেশের মুসলমান সমাজ রাম কাহিনীকে সেই দেশেরই জাতীয় কাহিনী মনে করে।
কোনও কোনও দেশে যেমন শ্যামদেশে মূল রামায়ণ কাহিনীর সঙ্গে সেই দেশীয় কাহিনীর যোগে রচিত হয়েছে 'রামকীর' বা 'রামকিয়েন'। যার অর্থ 'রামকীর্তি'। সেই কাহিনীতে দেখা যায় রামের নাম রাম থাকলেও লক্ষ্মণের নাম লব, ভরতের নাম প্রত্, সীতা - সীদা। এই রামকাহিনী সম্পূর্ণভাবে বাল্মীকি অনুসারী নয়। সেখানে অদ্ভুত রামায়ণ থেকে সীতার জন্মের কাহিনী নেওয়া হয়েছে। যেখানে সীতা রাবণের কন্যা। আর মন্দোদরী সীতার জননী।
অদ্ভুত রামায়ণে সীতা রাবণ মন্দোদরীর কন্যা। অদ্ভুত রামায়ণের রচয়িতা হিসাবে যদিও বাল্মীকির নাম প্রচলিত আছে তবে সেখানে সীতার মহিমাই বেশি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে অলৌকিকতার প্রভাবও বেশি। অবশ্য অনেকে মনে করেন সতা জন্মের কাহিনীটি খুব পুরনো এবং আর্য প্রভাব থেকে মুক্ত। দ্বীপ দেশ থেকে এই কাহিনী ভারতে এসেছে। এখানে অবশ্য রামের বন গমনের কাহিনীটি বাল্মীকির কাহিনীর মত। শ্যামদেশের রামায়ণের হনুমান কাহিনীর সঙ্গে বাল্মীকির রামায়ণের হনুমান কাহিনীর কিছু পার্থক্য রয়েছে। সেখানে হনুমান নিজেই নিজের লেজে আগুন দিতে চাওয়ায় তার ইচ্ছানুসারে রাবণ তার লেজে আগুন ধরিয়েছিল। লঙ্কাপুরী ধ্বংস করার জন্য শ্যামদেশের রামায়ণের রাম হনুমানকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। আর বাল্মীকির রামায়ণের রাম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন হনুমানকে লঙ্কাপুরী ধ্বংসের জন্য।
বাল্মীকির হনুমান রূপগুণ সমন্বিত। বাল্মীকি রামায়ণে সে বিরাট মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাল্মীকি তাকে প্রেমের রাজ্যে উপেক্ষিত রেখেছেন। শ্যামদেশীয় রামায়ণে বলবান হনুমান বিয়ে করে সুন্দরী মৎস্যরানিকে। তাদের এক ছেলেও হয়েছিল যে পরবর্তীকালে ভরত ও শত্রুঘ্নের অনুগামী হয়ে দানবদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের চোখে যথার্থ ধরা পড়েছিল, হনুমান আমাদের দেশের চেয়ে ওদেশে অনেক বেশি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। বাল্মীকি রামায়ণে বর্ণিত লবকুশের রামায়ণ গান শ্যামদেশীয় রামায়ণে নেই। সেখানে রাম-সীতার বিচ্ছেদও বর্ণিত হয়নি। শুধু শ্যামদেশের রামায়ণে নয়, এইসব দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সর্বত্র রামকাহিনীতে রাবণ বধের পর রাম-সীতার মিলন দেখানো হয়েছে। বিচ্ছেদের কোনও ঘটনা সেখানে নেই। এখানে প্রচলিত রামায়ণের শেষ কাণ্ডটিকে অর্থাৎ উত্তরাকাণ্ডকে প্রায় সকলেই পরবর্তীকালের প্রক্ষিপ্ত অংশ বলেছেন।
বাল্মীকি রামকে পূর্ণাঙ্গ এক মানুষ হিসাবে চিত্রিত করায় সেই রামচন্দ্র ক্রমে বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন এবং মূলত সেই কারণে পৃথিবীর সর্বত্র রামকাহিনীকে এত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে রামায়ণ মানুষেরই কথা বলেছে। দোষেগুণে মেলানো অথচ সর্বোত্তম মানুষের কথা, দেবতার কথা নয়। 'রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।' (ভাষা ও ছন্দ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
রামায়ণের পারিবারিক ছবি যা ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, পারিবারিক নানা মূল্যবোধের সংঘাত, যার সঙ্গে একজন ব্যক্তিমানুষকে প্রায় প্রতিদিন মুখোমুখি হতে হয় - সেই সব কিছু যেহেতু রামায়ণে নানা ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে হাজির করা হয়েছে, ফলে তার মধ্যে সাধারণ মানুষ তার সমস্যার প্রতিফলন দেখেছে ও সমাধানও খুঁজে পেয়েছে। সেকারণে ভারতবর্ষের সমাজ নিজের ছোট পরিসরে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে চলার পথপ্রদর্শক হিসেবে রামায়ণকে গ্রহণ করেছে। রবীন্দ্রনাথের কথায় - ''রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে, তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতা-পুত্রে, ভ্রাতায়-ভ্রাতায়, স্বামী-স্ত্রীতে যে ধরনের বন্ধন, যে প্রীতিভক্তি সম্বন্ধ রামায়ণ তাহাকেই এতো মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে।... আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের যে অত্যন্ত উচ্চস্থান ছিল - এই কাব্য তাহা সপ্রমাণ করিতেছে। গৃহাশ্রম আমাদের নিজের সুখের জন্য, সুবিধার জন্য ছিল না - গৃহশ্রম সমস্ত সমাজকে ধারণ করিয়া রাখিত ও মানুষকে যথার্থভাবে মানুষ করিয়া তুলিত। গৃহাশ্রম ভারতীয় আর্যসমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহাশ্রমের মহাকাব্য।" (প্রাচীন সাহিত্য ঃ রামায়ণ) এই অভিমত বাল্মীকি রামায়ণের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি বিভিন্ন ভাষার রামায়ণ ও জীবনচর্যার পক্ষেও।
ভারতবর্ষে মানুষ পৃথিবীর সর্বত্র কোনও না কোনও ভাবে রামকাহিনীকে ছড়িয়ে দিয়েছে। রামকথার কাহিনী হিসাবে কিংবা লোককথা হিসাবে যেমন তা ছড়িয়ে পড়েছে, শিল্পকলা স্থাপত্যে তার রূপ প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি অনুবাদের মাধ্যমে তা পৌঁছেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বা লাতিন আমেরিকায়। আরব পারস্য তুরস্কেও। আরবি, ফারসি ও উর্দুভাষায় যে সব সংস্কৃত গ্রন্থ অনুদিত হয়েছে রামায়ণ তার মধ্যে অন্যতম। ১৭৬৬ খৃষ্টাব্দে উর্দুভাষায় 'নোথি রামায়ণ' নামে প্রথম উর্দু রামায়ণের প্রকাশ। অনেকের মতে বারাণসীর মহারাজা এর প্রথম প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকজন লেখক অনুবাদক উর্দু রামায়ণ অনুবাদের পাশাপাশি 'জানকী বিজয়' ও 'অদ্ভুত রামায়ণ' কাব্য রচনা করেন।
বিভিন্ন ভাষায় এসব অনুবাদের মধ্যে কবিদের নিজস্বতা লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে অনেকেই মূল বাল্মীকি রামায়ণকে পুরোপুরি অনুসরণ না করে স্থানীয় বহু উপাখ্যান ও কিংবদন্তি যোগ করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য মূল রামায়ণকে বিকৃত করা নয়। কবি/অনুবাদকেরা আপন আপন ভৌগলিক এলাকা ও সামাজিক আচার আচরণকে যোগ করে নিজেদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কাহিনীকে বড় করার আকাঙ্ক্ষা থেকেও রামকাহিনীর মধ্যে অনেক অংশ যোগ করা হয়েছে। তামিল কবি কম্বন-এর 'রামকথা' কাব্যে তার প্রমাণ আছে। আর বাল্মীকির রামকাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় কিংবদন্তি যোগ করে সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র রামায়ণের কার্যত নবায়ন ঘটে গিয়েছে।
এমন পরিবর্তন শুধু যে বাইরের দ্বীপ রাষ্ট্রগুলিতে আনা হয়েছে তা নয়, এদেশেও কন্নড় ভাষায় নাগাচার্যের রচিত 'পম্প-রামায়ণ' কম্বন-এর রামায়ণকেই অনুসরণ করেছে, বাল্মীকির রামায়ণকে নয়। সারলা দাস বলে একজন কবি সীতাকে শক্তির প্রতীক হিসাবে চিত্রিত করে বলেছেন রাম-লক্ষণ যখন রাবণকে বধ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন তখন শক্তিরূপিনী সীতাই রাবণকে বধ করেন। আবার অধ্যাত্ম রামায়ণে রাম বিষ্ণুর অবতার। তুলসীদাসের রামচরিত মানসেও তাই রয়েছে।
শ্যামদেশের রামায়ণ রামকীর্তির উদ্ভব কম্বোজের রামায়ণ রামকীর্তি থেকে। শ্যামদেশের রাজারা নিজেদের রামের বংশজাত মনে করতেন। সে দেশের রামায়ণে রামবংশের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার পাশাপাশি শ্যামদেশের রাজধানী অযোধ্যায় প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন লোককথায় এবং লিখিত রামায়ণ 'হিকায়েৎ সেরিরাম' ইসলামী পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেছে। রামায়ণের নৈতিকতা ও সত্যপরায়ণতা এমন দৃঢ়ভাবে মালয়ী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ইসলামী সমাজেও রামায়ণের গভীর মর্যাদা রয়েছে। মালয়েশিয়া রামায়ণে রয়েছে রাবণ আল্লার বর পেয়ে শক্তিশালী হয়েছিল। দশরথকে আদি পুরুষ আদমের প্রপৌত্র হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। বিভীষণ এখানে রাবণের উপদেষ্টা জ্যোতিষী। রাবণ বিভীষণের উপদেশ অগ্রাহ্য করার কারণে বিভীষণ রামের পক্ষে যোগ দিয়েছে।
ফিলিপাইনের প্রচলিত রামকথার নাম 'মহারাজা লবণ'। সেখানে রাবণ নিজেই সোনার হরিণের রূপ ধরে রাম-লক্ষ্মণকে প্ররোচিত করার পাশাপাশি অন্যরূপে সীতাকে হরণ করেছিল। এখানে হনুমানই লক্ষ্মণ নামে অভিহিত। ব্রহ্মদেশের রামায়ণ রচিত হয় আঠারো শতকে। তার নাম 'রাম থাস্যিন'। সেখানে রাজা জনক রাজা দশগিরিতে হরধনু ভাঙার জন্য আমন্ত্রণ জানান সীতার স্বয়ম্ভর সভায় এসে। দশগিরি -- দশগ্রীব-রাবণ। রাবণ হরধনু তুললেও তির ছুঁড়তে পারেননি। এই রামকাহিনীতে মায়াবী ইন্দ্রজিৎ অদৃশ্য থেকে যুদ্ধ করলেও একমাত্র লক্ষ্মণই তাকে দেখতে পেয়েছিল। লক্ষ্মণ এই বিশেষ দৃষ্টি অর্জন করেছিল যেহেতু সে বারো বছর কোনও নারীর মুখ দর্শন করেনি। চীন ও জাপানের রামকাহিনীও নেওয়া হয়েছে দশরথ জাতক থেকে।
বাংলার ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্যাপক প্রচলিত বিখ্যাত মহিলা কবি 'চন্দ্রাবতী বিরচিত রামায়ণ'। বিবাহবাসর কিংবা অন্যান্য ধরনের মেয়েলি অনুষ্ঠানে এই রামায়ণ সর্বদা গীত হয়। মেয়েরাই গায়ক, স্ত্রীলোক কবির রচনা এই রামায়ণের শ্রোতা ও গায়কেরা বেশির ভাগ সময় স্ত্রীলোক। 'চন্দ্রাবতী বিরচিত রামায়ণ' প্রসঙ্গে ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন - "চন্দ্রাবতীর রামায়ণের কবিত্বই ইহার প্রধান গুণ নহে। এই রামায়ণে আমরা এমন অনেক জিনিস পাইতেছি যাহাতে রামায়ণ-সাহিত্যের কতকগুলি আঁধার দিক আলোকিত হইয়া যাইতেছে। বৌদ্ধ জাতকের সঙ্গে রামায়ণের এতটা অধিক সাদৃশ্য রহিয়াছে যে একথা আমাদের স্পষ্টই ধারণা হইয়াছে উভয়েই হয়ত কোন অজ্ঞাত মূল হইতে গৃহীত হইয়াছে নতুবা ইহারা পরস্পরের নিকট ঋণী।" সেই ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র আরও লিখেছেন - "আশ্চর্যের বিষয় চন্দ্রাবতীর রামায়ণে বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের বৃত্তান্তের অনুরূপ কাহিনী আমরা পাই না। তিব্বত, মালয়, কাশ্মীর, জাভা প্রভৃতি স্থানে সীতার জন্ম সম্বন্ধে যেসব প্রবাদ প্রচলিত আছে, চন্দ্রাবতী সেই সকল কথাই আমাদিগকে শুনাইয়াছেন।... চন্দ্রাবতীর রামায়ণেও তদবর্ণিত কুকুয়া চন্দ্রাবতীর সৃষ্টি নহে। এই চরিত্রটি কাশ্মীরি, মালয়, জাভা, কম্বোজ এবং তিব্বতী রামায়ণেও পরিদৃষ্ট হয়। মোট কথা চন্দ্রাবতী মূল রামায়ণ পাঠ করিলেও তাঁহার জন্মভূমির নিকটবর্তী প্রদেশে রাম-সীতা সম্বন্ধে যে সমস্ত কাহিনী প্রচলিত ছিল, তাহা হইতেই অধিকতর উপাদান সংগ্রহ করিয়াছেন।" চন্দ্রাবতীর রামায়ণ শুরু হয়েছে রাবণের কথা দিয়ে। রাবণ সম্বন্ধে যে সব কাহিনী সেখানে রয়েছে তা বাল্মীকি রামায়ণে নেই। আবার সেখানে এক ধীবর পত্নীর নাম নিয়ে, ডিম থেকে জন্ম নিয়েছেন সীতা। জনক রাজার সেখানে কোনও ভূমিকা নেই। নবনীতা দেবসেন চন্দ্রাবতী রামায়ণ প্রসঙ্গে বলেছেন, "যেন পূর্বাহ্নেই বলে রেখেছেন চন্দ্রাবতী বাংলার দুই শ্রেষ্ঠ কবি মধুসুদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনের কথা। রাবণের অশোক কাননে সরমাকে সীতার একমাত্র সখী বলে উল্লেখ করেছেন। ('সান্তনা করিয়া রাখে এক সরমা সুন্দরী')। যে বিষয়টি মাইকেলের হাতে 'মেঘনাদবধ কাব্যে' বিস্তৃতি লাভ করে। চন্দ্রাবতী নারীদের মধ্যে ভগ্নীত্ববোধকেই তুলে ধরেন। তিনি লক্ষ্মণকে তাঁর উপেক্ষিত স্ত্রী ঊর্মিলার দুঃখ নিরসনের জন্য মিনতি করেন। "ঊর্মিলার দুঃখ তুমি গো, কইরো সমাধান"।... বস্তুত, রামকাহিনীর সমস্ত পুরুষ বিবৃতিকার কর্তৃক লক্ষ্মণ-পত্নী ঊর্মিলা উপেক্ষিত হযেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে ষোড়শ শতকের বাংলার নারী বিবৃতিকারের কাছে।" আর এখানে চন্দ্রাবতীর স্বাতন্ত্র্য।
এদেশে বৌদ্ধ ও জৈনদেরও রামায়ণ ছিল। বাল্মীকির রামায়ণের সঙ্গে এইসব রামায়ণের অনেক পার্থক্য ছিল। বৌদ্ধ ও জৈনরা রাবণের পক্ষপাতী ছিলেন। মহাযান সম্প্রদায়ের বিশ্বাস রাবণ বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন। লঙ্কাবতার সূত্র নামে সংস্কৃত গ্রন্থে বুদ্ধের সঙ্গে রাবণের অনেক তর্কবিতর্কের বর্ণনা রয়েছে।
বাল্মীকি রামায়ণকে জৈন কবি বিমলসুরীই প্রথম জৈন রামায়ণে রূপ দেন। জৈনধর্মের পাঁচটি মহান ব্রতের ওপর ভিত্তি করে তিনি বাল্মীকির রামায়ণের পুননির্মাণ করেন। মহাবীরের নির্বাণলাভের ৫৩০ বছর পরে জৈন কবি বিমলসুরী প্রথম জৈন রামায়ণ 'পউম চরিতাম' (পদ্মচরিত) রচনা করেন। সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস প্রাকৃতেই তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বিমলসুরী মহারাষ্ট্র প্রাকৃতে ১১৮টি সর্গে ৯০০০ হাজার শ্লোকের মাধ্যমে পউম (পদ্ম) অর্থাৎ রামের কাহিনী বর্ণনা করেন। এরপর খ্রিষ্টিয় তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দী থেকে শুরু করে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বহু জৈন কবি জৈন রামায়ণ রচনা করেছেন। এখানে জৈন কবিরা বাল্মীকি রামায়ণের বহু উপাখ্যান ঘটনাকে উদ্ভট অবিশ্বাস্য মনে করে বাদ দিয়েছেন। জৈন কবি হেমচন্দ্রের কাব্যে রাবণ সিদ্ধপুরুষ। আবার জৈন রামায়ণের কবির নিজস্ব কল্পনানুযায়ী এমন ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে যার সঙ্গে বাল্মীকি রামায়ণের কোন সংগতি নেই। এমন একটি কাহিনীতে রয়েছে - রাম-লক্ষ্ণণের পরস্পরের স্নেহ ভালবাসার পরীক্ষা করার জন্য একজন দেবতা মায়া বলে রামকে অজ্ঞান করে প্রচার করলেন রামের মৃত্যু হয়েছে। তা শুনেই লক্ষ্ণণ সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছিত হলেন এবং তাঁর মৃত্যু হল। রাম লক্ষ্ণণের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শোকে পাগলের মত হয়ে লক্ষ্ণণের মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে ছয় মাস দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। পরে দেবতারা রামকে বুঝিয়ে নিরস্ত করলেন।
বৌদ্ধ জাতকে রামকাহিনীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে সূত্তপিটকের পুষ্পকালিকায় অংশে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধ পণ্ডিত ধর্মকীর্তি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন হিন্দুরা রাবণের রচিত্র কলঙ্কিত করেছে। বিভিন্ন জাতকের কাহিনী এবং রামায়ণের পাঠ মিলিয়ে পড়লে পরস্পরের মধ্যে মিলও অনেক নজরে আসে। একটা বিষয়ে পণ্ডিতেরা মোটামুটি একমত হয়েছেন যে রামায়ণের অদিকাণ্ড ও উত্তরাকাণ্ড বাল্মীকির রচনা নয়। অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত বাল্মীকির রচনা। তামিল কবি কম্বন রচিত রামায়ণ তামিল সাহিত্যের সম্পদ। তামিল রামায়ণের পরের দিকের সংস্করণে রয়েছে বনবাসে যাওয়ার সময় রাম সীতাকে সঙ্গে নিতে চাইছেন না। সীতা পতির প্রতি তার কর্তব্যের কথা বললেও রাম ভীষণ ক্রুদ্ধ হলে সীতা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সীতা বনবাসী হয়েছেন। বাল্মীকির রামায়ণ রচনার হাজার বছরের বেশি সময় পরে কম্বনের কাব্য রচিত হয়। বাল্মীকির রাম তখন জনমানসে অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। বাল্মীকির রাম শ্রেষ্ঠ মানুষ। মানসিক দ্বন্দ্ব দুর্বলতায় ভরা। অর্থাৎ চরিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। সীতাহরণের আখ্যানে বাল্মীকি রাবণ কর্তৃক সীতাকে হরণের সময় যেভাবে বলপ্রয়োগ করেছিলেন কম্বনের রামায়ণে তা নেই। সেখানে রাবণ সীতাকে স্পর্শ না করে পর্ণশালা সমেত তাকে তুলে নিয়ে গেছে।
জাভায় প্রচলিত রামায়ণে রয়েছে সীতা রাবণ ও মন্দোদরীর কন্যা। এবং কাহিনীর বিস্তৃতিতে রয়েছে গণকদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল সীতা অত্যন্ত দুর্ভাগিনী হবেন। সুতরাং রাবণ সীতার জন্মমাত্র একটা কৌটোয় শিশুটিকে ভরে সেই কৌটোটি সমুদ্রে ভাসিয়ে দিল। জনকরাজা সেই কৌটাটি উদ্ধার করেন। মালয়ী রামায়ণেও সীতাকে মন্দোদরীর কন্যা এবং তিব্বতী রামায়ণে সীতাকে রাবণের মেয়ে বলেই বলা হয়েছে। কাশ্মীরি রামায়ণেও সীতাকে রাবণের মেয়ে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায় সব কবিরাই কাব্য রচনাকালে সমসময়ের কোন কিছুকে উপেক্ষা করতে পারেননি। রামায়ণের কাহিনীতেও বিভিন্ন দেশে প্রচলিত নানা উপাখ্যান, কিংবদন্তি এমনকি গুজব পর্যন্ত জায়গা পেয়েছে। আমাদের বাংলা রামায়ণেও সীতার জন্ম নিয়ে নানা ধরনের গল্পকথা রয়েছে। সীতা পৃথিবীর কন্যা, জনকের হলাগ্রে তিনি উত্থিত হন - এ ধরনের নানা কথা।
নেপালের রামায়ণ কথার প্রচলন মোটামুটি ১৮০০ বছর আগে। সেদেশে ভারতীয় হিন্দু রাজাদের শাসনব্যবস্থা প্রচলনের সময় থেকে। নেপালী ভাষায় প্রথম রামায়ণ কাহিনী 'রামাশ্বমেধ'। লেখকের নাম জানা যায়নি। ভাষাবিদদের মতে এটি ১৮৩৩ সালের আগে লেখা। এটি রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের কাহিনী বর্ণনা। দ্বিতীয় গ্রন্থটি সুন্দরানন্দ বরার 'অধ্যাত্ম রামায়ণ'। নেপালী ঐতিহাসিকের মতে এই রামায়ণই নেপালী ভাষায় প্রথম সম্পূর্ণ রামায়ণ কাহিনী। সংস্কৃত অধ্যাত্ম রামায়ণের ষষ্ঠ কাণ্ডকে ভিত্তি করে পদমশর্মা 'অধ্যাত্ম রামায়ণ লঙ্কাকাণ্ড' ১৮৩৯ সালের মধ্যে অনুবাদ করেন। 'রামচরিত মানস'ও অনুদিত হয়েছে নেপালি ভাষায় পণ্ডিল কুলচন্দ্র গৌতমের হাতে। তবে নেপালী ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি আচার্য ভানুভক্ত রামায়ণ রচনা করেছিলেন অধ্যাত্ম রামায়ণকে মূল ভিত্তি হিসাবে ধরে। কিন্তু তিনি সংস্কৃতের আনুগত্য অস্বীকার করে প্রাচীন রীতির অচলায়তন ভেঙে সহজবোধ্য নেপালী ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে রামায়ণের প্রথম পর্ব 'বালকাণ্ড' শেষ করেছিলেন।
হিন্দি সাহিত্যে তুলসীদাসের 'রামচরিত মানস'-এ প্রতিফলিত হয়েছে ভারতীয় লোকজীবনের চিরন্তন আদর্শ ও কামনা-বাসনা। ভারতবাসী সেখানে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে। নিজের সমাজ-সংস্কৃতিকে। পরিবেশ পরিস্থিতিকে, জীবনের সংকট ও সমস্যাকে। তুলসীদাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন - "তুলসীদাস তাঁর রামচরিতের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন বাল্মীকির রচনা থেকে, কিন্তু সেই উপকরণকে তিনি সম্পূর্ণ নিজের ভক্তিতে রসসমৃদ্ধ করে নতুন করে দান করেছেন। সেইটেই তার নিজস্ব দান - পুরাতনের আবৃত্তি নয়, তাতে তাঁর যথার্থ প্রতিভার প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নতুন দৃষ্টি নিয়ে সেই পুরাতন উপকরণকে নতুন রূপ দান করে পরিবেশন করেছেন সমস্ত দেশকে। ভক্তিদ্বারা যে ব্যাখ্যায় তিনি রামায়ণকে নতুন পরিণতি দিয়েছেন সেটা সাহিত্যে অসাধারণ দান।"... "তুলসীদাসের দান যুগকে সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে আছে। এই যে সমস্তকালকে অধিকার করা - এ সৌভাগ্য অল্প লোকেরই হয়। হিন্দী সাহিত্যে তুলসীদাসের দানকে সকলের চেয়ে বড় বলে গণ্য করা হয়েছে এবং চিরকাল তাঁর সে গৌরব অক্ষুণ্ণ থাকবে।" রামের ভক্ত হিসাবে তুলসীদাস তাঁর কাব্যের মাধ্যমে নিজের স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। অসমীয়া ভাষায় রামায়ণ কথার উল্লেখযোগ্য রচয়িতা শঙ্করদেব ও মাধব কন্দলী। বাংলার কবি কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণ যুগ যুগ ধরে বাঙালীর ঘরে ঘরে পঠিত, যা রামায়ণের জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
রামায়ণ কাহিনী কেবলমাত্র ভারতবর্ষের আর্য ভাষাভাষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, তিব্বতী, বর্মী ইত্যাদি জনজাতির ওপর রামায়ণের প্রভাব রয়েছে। আজও ভারতীয় জনজাতি এবং গ্রামীণ শ্রমজীবী সমাজ রামসীতার কাহিনীকে সত্য বলে মনে করে। এইসব মানুষদের মধ্যে রামসীতার কাহিনী কখনও কিংবদন্তি হিসাবে, কখনও লোককথায় লোকমানসে আজও সজীব। বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে রামসীতা আজও দেবতার আসনে রয়েছে। নানাভাবে বৈচিত্র্যও সেইসব কাহিনীর মাধ্যমে ধরা পড়ে।
সাঁওতাল সমাজে কিংবদন্তি রয়েছে দশরথের রাণীরা আম খেয়ে গর্ভবতী হন। সীতাহরণের পর সীতার খোঁজ করার পথে রাম কাঠবিড়ালিকে ও খেজুর গাছকে আশীর্বাদ করেন এবং বককে অভিশাপ দেন। হনুমানের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সময় হনুমান ও লক্ষ্ণণের যুদ্ধ হয়, পরে রামের আদেশে রামের তিরের ওপর চড়ে হনুমান সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় যায় ও রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার পথে রাম সাঁওতালদের শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে শিবকে পুজো করেন।
বিরহড় জনজাতির কাহিনীতে দশরথের সাত রাণী। সীতাকে হরণ করার কালে ছদ্মবেশী রাবণের মুখে সীতা লক্ষ্ণণের দেয়া একমুঠো বীজ রাবণের দিকে ছুঁড়ে মারলে রাবণ ভস্ম হয়ে যায়। এই কাহিনীতে সীতার খোঁজে হনুমান টিয়া পাখির রূপ ধরে লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করেছিল। এরকমভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে রামকথা নানা রূপে চালু আছে।
এ.কে. রামানুজন তাঁর প্রবন্ধে সন্তোষ দেশাইয়ের মত উদ্ধৃত করেছেন। "স্থলপথে, উত্তরের রাস্তা পাঞ্জাব আর কাশ্মীর থেকে গল্পগুলো নিয়ে গেছে চীন, তিব্বত আর পূর্ব তুর্কিস্তানে; জলপথে দক্ষিণের রাস্তায় গুজরাট আর দক্ষিণ ভারতের গল্প গেছে জাভা, সুমাত্রা আর মালয়; আরেকটা স্থলপথে পূর্বের রাস্তা বাংলার গল্পগুলোকে পৌঁছে দিয়েছে বার্মা, থাইল্যান্ড আর লাওসে। ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়া তাদের গল্পগুলো পেয়েছে খানিকটা জাভা থেকে আর খানিকটা ভারত থেকে পূর্বের রাস্তা ধরে।"
স্থানকালের সীমারেখা পেরিয়ে রামকথা এভাবে নানা সময়ে, নানা দেশে নতুন নতুন কাহিনীর রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার সময় পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়া চালু থাকে সেখানে কাহিনীর ভেতর বারবার ঢুকে পড়েছে এক একটি দেশের নিজস্ব লোকবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান-সংস্কার। সে দেশের জনমানস ও জনসমাজের চেহারা ধরা পড়েছে। কখনও কখনও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যেও কাহিনীতে পরিবর্তন অানা হয়েছে। আর এসব মিলে রামকাহিনী নানাভাবে মানুষের নান্দনিক বোধকে তৃপ্ত করেছে। তার বহুমুখী গ্রহণযোগ্যতার কারণে তা ছড়িয়ে পড়েছে নানা স্থানে। শুধুমাত্র চিরায়ত সাহিত্যের গণ্ডিতে তা কখনোই এত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠত না। এ কারণেই তা বহু বৈচিত্র্যময় হয়েছে। এই বহু বৈচিত্র্য এক অর্থে আমাদের ভারতীয় আত্মারই প্রতিফলন।
সহায়ক গ্রন্থ:
১। রামকথার প্রাক্ ইতিহাস - সুকুমার সেন
২। রামায়ণের বিশ্বায়ন - সুধীর কুমার করণ
৩। তিনশো রামায়ণ - এ.কে. রামানুজন (অনুবাদ স্বাগতা দাশগুপ্ত)
৪। অগ্রন্থিত রচনা সংগ্রহ - রমেশ চন্দ্র মজুমদার
৫। রামায়ণ চর্চা : ভারতে ও বহির্ভারতে - কোরক সংকলন
৬। বিশ্ব মহাকাব্য প্রসঙ্গে - বীরেশ্বর মিত্র
৭। রচনা সংগ্রহ (প্রথম ও দ্বিতীয়) - সুকুমারী ভট্টাচার্য
৮। জীবনানন্দ পত্রিকা - রামায়ণ সংখ্যা
৯। চন্দ্রাবতী বিরচিত রামায়ণ
১০। Ramayana : Myth or Reality - H.D. Shankalia