সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
২০১৭ সালের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক দুই দিন পরে, উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছিল? পাঠকের মনে আছে কি? সবার নিশ্চয়ই মনে নেই? ও, আপনার মনে আছে? হ্যাঁ, সেই কে যেন একজন মুসলমান ডাক্তার হাসপাতালে শিশুমৃত্যু নিয়ে কি একটা ঝামেলায় পড়েছিলেন? আমরা মশাই ছাপোষা লোক, ভূভারতে প্রতিদিন কত কি ঘটনা ঘটে চলেছে, সবকিছুর হিসেব কি আর রাখা যায়?
রাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র ছিল জনসাধারণকে নানাভাবে রাজনৈতিক জ্ঞান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। প্রজাদের ঘাম ঝরিয়ে উৎপাদন করা ফসল এবং অন্যান্য পণ্য রাজারা অন্যায়ভাবে নিয়ে যাবার ফলেই যে তাদের দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়, এই সত্যকে আড়াল করার জন্য আইন আদালত, ধর্ম পুরোহিত, পূর্বজন্মের কর্মফল, স্বর্গ নরক ইত্যাদির অবতারণা করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, রাজার প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য তৈরি করা। ভারতবর্ষে আজ আমরা এমন একটা যুগে বাস করছি, যেসময়ে রাজতন্ত্র চলে যাওয়ার মুখে বর্তমান শাসকশ্রেণীর মধ্যে তার চরিত্রের ছাপ রেখে যাচ্ছে। আমরা ভারতবর্ষের মানুষ, যারা যুগ যুগ ধরে আনুগত্যের শিক্ষায় মাথা নিচু করে বাঁচতে বাঁচতে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছি, তাদের শাসন ও শোষণ করার ক্ষেত্রে আজকের ভারতের শাসকশ্রেণীর এটাই মস্ত সুবিধে। নইলে ২০১৭ সালের ১৭ই আগস্ট রাতে গোরখপুরের হাসপাতালে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ার পর চোখের সামনে একের পর এক এনকেফালাইটিসে আক্রান্ত শিশুকে নীল হয়ে মারা যেতে দেখে সেখানকার যে কনিষ্ঠতম ডাক্তারটি সিনিয়ারদের ২৬ বার ফোন করে না পেয়ে নিজে দৌড়োদৌড়ি করে নিজের পয়সা দিয়ে একরাতের মধ্যে ৫০০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করে আনেন, এবং রাতারাতি হিরোতে পরিণত হন, মিডিয়ায় এই খবর প্রচারিত হওয়ার পরে পরেই প্রশাসনের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং মাঠে নেমে পড়ে সেই ডাক্তারকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের দলের আই টি সেলকে কাজে লাগিয়ে চরম কুৎসা রটনা করে তাঁকে কয়েক দিনের মধ্যে খলনায়কে পরিণত করেন। দেশের জনসাধারণ কতখানি নিষ্ক্রিয় আর রাজভক্ত হলে এরকম ঘটনা সম্ভব হয়, তা উন্নত কোনো দেশের মানুষ ভাবতেও পারবে না।
ডাঃ কাফিল খানের 'গোরখপুর হসপিটাল ট্র্যাজেডি’ বইয়ের রিভিউ লিখতে গিয়ে পাঠকদের প্রতি আমার প্রথম বক্তব্য হল, বইখানি পড়ে কেউ আহা উহু করবেন না কিম্বা হা-হুতাশ করবেন না কারণ এটি পাঠকের কাছে সহানুভূতি দাবি করে না, বরং পাঠকের মধ্যে সংগ্রামী মানসিকতা গড়ে ওঠার আশা রাখে, যে মানসিকতা আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষেরা কয়েক দশক ধরে হারিয়ে বসে আছি। এই বই এমন একজন মানুষের দিনলিপি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যাঁকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে একজন সাধারণ ধর্মপ্রাণ যুবক থেকে সংগ্রামী মানুষে পরিণত করেছে, সমাজের উঁচুতলার ডাক্তারের বিলাসবহুল জীবন থেকে ছাড়িয়ে এনে সাধারণ মানুষের পথের লড়াইয়ে শামিল করেছে। এই অগ্নিশুদ্ধির মধ্যে দিয়ে যাওয়া, নিজেকে সেই জীবনের তপ্তপ্রদাহের মধ্যে সততায় অবিচল রাখা সহজ কথা নয়। আসুন আমরা এই সংগ্রামী ডাক্তারের কাঁচা লোহা থেকে ইস্পাত হয়ে ওঠার গল্প শুনে নিই তাঁর এই দিনলিপি থেকে।
আমরা যারা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা নিয়ে, এমনকি বিপ্লবী নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে গরম বক্তব্য লিখে আত্মতুষ্টি লাভ করি, নিজেদের অক্ষমতা আর কাপুরুষতা ঢাকতে মোবাইলের স্ক্রীনে হৃদয়ের জ্বালা উগরে দিয়ে শান্তিতে ঘুমোতে যাই এই ভেবে যে নিষ্ক্রিয়তাই হল নিজেকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখার সবচেয়ে নিরাপদ উপায়, এই বই তাদের শান্তির নিদ্রাভঙ্গ করে একটা অস্বস্তির জন্ম দেয়। দেখিয়ে দেয়, রাষ্ট্রশক্তির কোপ কিভাবে যে কোনদিন আমাদের যে কোনও কারুর ওপরে নেমে এসে আমাদের সুখের জগতকে তছনছ করে দিতে পারে। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় একটা সংলাপ ছিল, “পলাইয়া বাঁচতে চাও বাপজান? পারবা না।” আমরা যারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই, তাদের মনে ডাঃ খানের এই বই আতঙ্ক তৈরি করতে পারে।
গান্ধীজী নিহত হওয়ার প্রসঙ্গে বার্নার্ড শ একটা কথা বলেছিলেন, “It is dangerous to be too good”. ডাঃ কাফিল খানের বইখানি শুরু করে প্রাথমিকভাবে সেই কথাটাই মনে পড়তে পারে। কিন্তু তার পর মনে হবে, too good মানে কতটা good? চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে কেউ না পারলে আমরা তার হাতটা ধরে টেনে তুলি। অথর্ব মানুষকে হাত ধরে রাস্তা পার করাই। আমাদের বেশিরভাগের মধ্যেই কিছু না কিছুমাত্রায় সংবেদনশীলতা, মানবপ্রেম থাকে, যাকে philanthropy বলে। কিন্তু আপনার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এই সামান্য philanthropyই যে রাষ্ট্রশক্তির উষ্মার কারণ হয়ে আপনার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, ডাঃ কাফিল খান কিম্বা স্ট্যান স্বামীর জীবন তার এক একটি উদাহরণ। এই বই আমাদের ভয় দেখাবে, “মানবদরদী হতে যেয়ো না, আগ বাড়িয়ে কারুর উপকার করতে যেয়ো না।
হাসপাতালে দুষ্টচক্রের পেছনে সরকারের কতখানি মদত থাকে, তার উদাহরণ হল গোরখপুরে বিনা দোষে কাফিল খানের কারাবাস আর কলকাতায় তিলোত্তমার হত্যাকান্ডের পর রাজ্য সরকারের নির্লজ্জভাবে দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা। অথচ দুই রাজ্যে দুটি ভিন্ন দল ক্ষমতায় আসীন। তিলোত্তমার হত্যার বিচার চেয়ে যে দল কলকাতায় সভা করছে, তারাই আবার উত্তরপ্রদেশে কাফিল খানের ভাইকে গুলি করেছে। এর পরেও আমরা হয় এই দল নয়তো ঐ দলের হয়ে ওকালতি করি।
আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থা যে কতখানি সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তা বোঝা যায় যখন গোরখপুরে অক্সিজেন জোগাড় করে মুমূর্ষু শিশুদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করার অপরাধে গ্রেফতার হওয়া কাফিল খানকে দিনের পর দিন শুনানির তারিখ পিছিয়ে দিয়ে কারাবাস ভোগ করানো হয়, আবার অন্যদিকে কলকাতায় তিলোত্তমার হত্যার মূল অপরাধীদের চার্জশিট না দিয়ে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, যেন এই হত্যার পেছনে কারুর কোনো স্বার্থ ছিল না, কোনো মদত ছিল না, যেন সঞ্জয় রায় একাই হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়ে অকারণে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে হত্যা করে ফেলেছে। সি বি আইয়ের এই চার্জশিট না দেওয়াটা কি রাজ্য সরকারের সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের যোগসাজশের ইঙ্গিত করে না? অথচ আমরা ন্যায়বিচারের আশায় রাজ্যের কিম্বা কেন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কেন্দ্রের কিম্বা রাজ্যের পুলিশী ব্যবস্থার প্রতি অগাধ আশা আর আস্থা নিয়ে বসে থাকি।
রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে, মুখ বন্ধ রাখলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এই আশায় কাফিল খান ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত উকিলদের পরামর্শে মুখ বন্ধ রেখে সাত মাস সময় নষ্ট করে কারাগারে আটক থেকেছেন। এপ্রিল মাসে তাঁর স্ত্রী শাবিস্তা এবং তাঁর মা নুজাত পরভীন সরকারকে প্রতিআক্রমণ করে মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই চাকা ঘুরতে শুরু করে। ২০১৮ সালের ১০ই এপ্রিল ‘আউটলুক' পত্রিকায় ভারতের চিকিৎসকদের সংগঠন আই এম এ-র সাংবাদিক সম্মেলনের প্রতিবেদন বের হয়, যাতে ডাঃ খানের নির্দোষ হওয়ার কথা প্রকাশ করা হয়, এবং দ্য সিটিজেন নামে একটি ডিজিটাল নিউজ প্ল্যাটফর্মে ডাঃ খানের স্ত্রী এবং মায়ের বয়ানে জানা যায় কিভাবে দিনের পর দিন পুলিশ তাঁদের বাড়িতে এসে মহিলা এবং শিশুদের সন্ত্রস্ত করে গেছে যাতে তাঁরা মুখ না খোলেন। পত্রিকাগুলি এভাবে সমর্থনে এগিয়ে আসার পর ডাঃ খান জেল থেকে চিঠি লিখে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করে দেন, যার ফলে সংবাদমাধ্যমগুলি সোচ্চার হয়ে ওঠে, বিচারকদের রায় তাঁর দিকে ঘুরে যেতে থাকে এবং অবশেষে তিনি ২৫শে এপ্রিল জামিনে মুক্তি পান। এর থেকে আমাদের শিক্ষা হওয়া উচিত যে চুপ করে থেকে নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েই সরকারী দমনপীড়নের মোকাবিলা করা যায়।
মুক্তির অবশ্য আর একটা উপায়ও ছিল। টাকা খরচ করা। কিন্তু ডাঃ খান দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমি কোনও অন্যায় করি নি, অতএব টাকা দিয়ে মুক্তি কিনব না, এই ছিল তাঁর যুক্তি। বিলাসবহুল জীবন থেকে কয়েদীর কঠোর জীবনে গিয়ে পড়লে আমাদের কজন এরকম দৃঢ়তা দেখাতে পারবে, সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
লেনিন বলেছিলেন, “জেলখানা হল বিপ্লবীদের বিশ্ববিদ্যালয়।” সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাঃ খান বিপ্লবী হবার কারণে ঢোকেন নি, সাধারণ একজন কর্তব্যপরায়ণ ডাক্তার হবার কারণে ঢুকেছিলেন, কিন্তু জেলখানা তাঁকে বিপ্লবী না করুক, সুখী বুদ্ধিজীবীর ভীরুতার খোলস ভেঙে বের করে একজন প্রকৃত স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে মানুষের দরজায় পৌঁছে দিয়েছে, সমাজের ওপর সরকারি দমনের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচ নামে একটা জায়গায় শিশুদের মধ্যে এনকেফালাইটিস হবার খবর পেয়ে ২১শে সেপ্টেম্বর তিনি সেখানে চিকিৎসা করতে যান এবং দ্বিতীয়বার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে সম্পূর্ণ পোড়খাওয়া সংগ্রামী না তৈরি করতে পারলে বোধহয় সরকারের ঘুম হচ্ছিল না। যাইহোক, এইভাবে সরকার দেশের গরীব মানুষকে এক দরদী চিকিৎসক উপহার দিয়েছে, তার জন্য যোগী আদিত্যনাথের সরকারকে ধন্যবাদ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, “Even the Devil must be given his due.”
দমনমূলক কালাকানুন সি এ এ-র বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি তৃতীয়বার জেলে যেতে তিনি আর ভয় পান নি। এমনকি তাঁর ভাইকে গুলি করে, পরবর্তী টার্গেট তিনি একথা বলে হুমকি দিয়েও আর সরকারি গুণ্ডারা তাঁকে তাঁর পথ থেকে সরিয়ে আনতে পারে নি। এক উচ্চবিত্ত ঘরের ডাক্তার, এক শপিং প্লাজার মালিকের ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারের নাতি, ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে, যিনি এ সি ছাড়া ঘুমোতেন না, এ সি গাড়ি ছাড়া বেরোতেন না, ক্লাসরুমে, কর্মস্থলে চিরকাল এ সিতে কাটিয়েছেন, সেই ডাঃ কাফিল খানকে জেলখানা একজন সংগ্রামী ডাক্তারে পরিণত করেছে যিনি আজ মুম্বাই থেকে আসাম সর্বত্র দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য ছুটে যাচ্ছেন, কোভিড মহামারীর সময়ে যিনি জীবনের পরোয়া না করে দিল্লির শহরতলিতে ‘''ডক্টরস অন রোড” নামের সংগঠন তৈরি করে কোভিডএর মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
এই ব্যাপারে আর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হল তাঁর পরিবারের, তাঁর মা, তাঁর স্ত্রী, তাঁর ভাইয়েদের, যা কখনওই সেভাবে প্রচারের আলোতে আসবে না। প্রতিবেশীদের কাছে একঘরে হয়ে যাওয়া, সরকারের মদতপুষ্ট গুণ্ডাদের আর পুলিশের হুমকি, তাঁর ভাই কাশিফ খানের গুলিবিদ্ধ হওয়া, পারিবারিক ব্যবসা শেষ হয়ে যাওয়া, সর্বস্ব বিক্রি হয়ে যাওয়া কিছুই এই পরিবারকে ন্যায়ের পথ থেকে সরিয়ে আনতে পারে নি। আমরা আর কিছু না করতে পারি, এরকম একটি পরিবারের দেশের মানুষ হিসেবে গর্ববোধ করতেই পারি।
ডাঃ খানের কারাবাসের ফলে আমাদের দেশের জেলখানা সম্পর্কে আমাদের একটা সম্যক ধারণা তৈরি হয়, বইখানি থেকে এটা একটা উপরি লাভ। জেলের মধ্যে কিভাবে কয়েদিদের নিজস্ব প্রশাসন চলে, তার সাথে বাইরের অর্ধ-সামন্ততান্ত্রিক এই দেশের সমাজব্যবস্থার সাদৃশ্য কি, এই সব কিছুই নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। জেলের জীবন কিভাবে তাঁর ভয় ভাঙিয়ে দিয়েছে, লজ্জা কাটিয়ে দিয়েছে, কিভাবে অকারণে পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে তিনি শক্তি অর্জন করেছেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা এতে পাওয়া যায়। দুনিয়ার সমস্ত জেলখানাই নরকের ইহজাগতিক রূপ, কিন্তু ভারতের মতন একটা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে, যেখানে মিড ডে মিলের টাকা মেরে দিয়ে স্কুলের শিশুদের অখাদ্য খাওয়ানো হয়, হাসপাতালের এক একটা বেডে একাধিক রোগী রেখে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সেখানে জেলখানায় কি হয় তা অনুমান করাই যায়। ডাঃ খান হেপাটাইটিস বি কিম্বা এইডস হবার ভয়ে কারাবাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে চুল দাড়ি কাটেন নি, যার ফলে মুক্তি পাওয়ার পরে তাঁকে বিছানায় দেখে ঘুম থেকে উঠে তাঁর শিশুকন্যা ভয়ে কেঁদে উঠেছে।
যে দেশে ঘুষ খাওয়া হল স্বাভাবিক আর কর্তব্যপরায়ণতা হল অপরাধ, যে দেশে চুরি ডাকাতি করে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা খরচ করে গুণ্ডা বদমাশ ভোটে জিতে এম এল এ, এম পি হয় আর লেখাপড়া শিখে মানুষ চাকরির আশায় দরজায় দরজায় ঘোরে, সেই দেশে আগ বাড়িয়ে শিশুমৃত্যু আটকাতে যাওয়া যে কতখানি বিপজ্জনক, তা ডাঃ খানের কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত। আমরা পয়সা খরচা করে ভোটে দাঁড়াব, ভোটে জেতার জন্য হাসপাতাল খুলে রেখে জনসেবার নাটক করব, যাতে পরের বার আরও বেশি ভোট পেতে পারি, আর হাজার হাজার কোটি টাকা লুঠ করতে পারি, সেখানে তুমি বাবা শিশুদের জন্য দরদ দেখাতে গিয়ে আমাদের বাড়া ভাতে ছাই দেবে, এ কি হতে দেওয়া যায়? অতএব ফেসবুকে যত ইচ্ছে লিখুন, খবরদার সরকারি কাজ করতে গিয়ে এমন কিছু করবেন না, যাতে সরকারের মুখোশ খুলে যায়। হাসপাতালের সরকারি মদতপুষ্ট দুষ্টচক্রের লেজে পা দিতে গিয়ে আর জি করের মেয়েটি তাদের ছোবলে জীবন দিয়েছে। আমরা জানি, তার এই মৃত্যুর কোন কিনারা হবে না, দুষ্টচক্রের কাজকর্ম আবার কিছুদিন পরেই যথারীতি শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু কাফিল খানের ক্ষেত্রে আমরা এটুকু ভাগ্যবান যে সরকার এবং তার ছত্রছায়ায় থাকা দুষ্টচক্র তাঁকে মেরে ফেলে নি, তাই সেই চক্রের অনেক গভীরের খবর আমরা তাঁর লেখা বই থেকে জানতে পারছি এবং বুঝতে পারছি যে নামমাত্র যেটুকু টাকা সরকারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হয়, সেটুকুও কিভাবে রাঘব বোয়ালেরা হজম করে ফেলে। সাধারণ মানুষের করের টাকায় চলা এই রাষ্ট্র তাঁদের জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থাটুকুও করতে পারে না। একথা অবশ্য আমরা বাইরে থেকেও আন্দাজ করতে পারি, কিন্তু ভেতর থেকে উঠে আসা একজন মানবদরদী ডাক্তারের মুখ থেকে শোনা অবশ্যই একেবারের ঘোড়ার মুখের খবর।
২০২১-২২ সালে ভারতের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ছিল ৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, যা ছিল ঐ বছরে দেশের মোট আভ্যন্তরীরণ উপার্জনের ১.৮৪ শতাংশ। এর চেয়ে সরকারি কর্মচারিদের মাইনে দিতে সরকারের বেশি খরচ হয়, যা ঐ বছরে ছিল ৭ লক্ষ ৮৯ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। অতএব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার অবস্থা কি হবে তা সহজেই বোঝা যায়। ডাঃ খান মুসলমান হওয়ার সুবাদে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সরকারের ঔদাসীন্য ঢাকতে তাঁকে বলির পাঁঠা বানানোর সুবিধা হয়েছে, কিন্তু এটা তো শুধু বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের সমস্যা নয়, পরবর্তীতে মুজফ্ফরপুরে শিশু হাসপাতালের ডরমিটরির অবস্থা দেখে তাঁর মনে হয়েছে, এর থেকে গোরখপুর জেলের হলঘরের অবস্থাও ভালো ছিল।
এই রিভিউ লেখা শেষ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, কেন লিখছি? কাদের জন্যই বা লিখছি? এরকম ঘটনা কি এর আগে ঘটে নি? শুধুমাত্র ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার জন্য বাবরি মসজিদ ভেঙে দাঙ্গা লাগিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে কি মেরে ফেলা হয় নি? হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করা আদিবাসীদের হঠাৎ উচ্ছেদ করে দিয়ে তাদের জমি খনি মালিকদের দিয়ে দেওয়া হয় নি? আইন করে বলা হয় নি যে সেই জমির মালিক সেই আদিবাসীরা নন, জমির মালিক হল সরকার? ঠিক যেভাবে বিদেশী ইউরোপীয়রা গিয়ে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের জমি থেকে উৎখাত করেছিল, এখানকার দেশি সরকার কি ঠিক তাই করছে না? আর এই ব্যবস্থার প্রতিকার করতে গিয়ে কি স্ট্যান স্বামীকে কারাগারে প্রাণ দিতে হয় নি? এই প্রতিটি স্ফুলিঙ্গই তো একটা করে দাবানল সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কই, কিছুই তো হয়নি? আমি আপনি তো তেমনি সকাল সন্ধ্যে দাড়ি কামাচ্ছি, দাঁত মেজে খেয়েদেয়ে কাজে যাচ্ছি, বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে ঢেঁকুর তুলছি, আর ফেসবুকে কখনো রঙ্গ রসিকতা করছি আবার কখনো বিল্পবী কথা লিখে লাইকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছি। তাহলে এই সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে বইটি কিনবে কে, পড়বেই বা কে, আর পড়ে হবেটাই বা কি? সত্যিই কি আমি বা আমরা এই বইখানি অন্ততঃ একবার পড়বার হিম্মত রাখি?
বইটা পড়তে পড়তে নিজে যে কতবার কেঁদেছি, কতবার নিজের অক্ষমতার কারণে সংগ্রাম থেকে দূরে সরে আসার জন্য নিজেকে দোষারোপ করেছি, কতবার চোখের জলে লেখাগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে, তা যদি ডাঃ কাফিল খান জানতেন! প্রশান্তদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এই বইয়ের রিভিউ লিখতে বলার জন্য। সারাজীবন ধরে চারিপাশের নিষ্ক্রিয়তার নেগেটিভ উদাহরণের মাঝে এরকম দুই একটি আশার কুঁড়িই তো ভবিষ্যতের পৃথিবীকে ফুলে ফলে ভরিয়ে তোলার সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রাখে। এই বই যদি আমাদের নিরুত্তাপ মধ্যবিত্ত জীবনে অন্যায়ের পৃথিবী ভেঙে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাবার শপথ আবার করে জাগিয়ে তুলতে পারে, তাহলেই এই নবীন প্রজন্মের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের আত্মত্যাগ সার্থক হয়ে উঠবে।
সবশেষে ধন্যবাদ জানাই শ্রী অসীম চট্টোপাধ্যায়কে, যাঁর ভাষার ওপর দখল এবং ঝরঝরে অনুবাদ বইটির বক্তব্যকে যথাযথভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে। সেইসঙ্গে ধন্যবাদার্হ সেতু প্রকাশনীর শ্রীমতী অর্চনা দাস এবং শ্রী সুব্রত দাস, যাঁরা ডাঃ কাফিল খানের ইংরেজি বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে বাংলার পাঠকদের সুবিধা করে দিয়েছেন।
পুস্তক পরিচয়ঃ
মূল গ্রন্থ — The Gorakhpur Hospital Tragedy: A Doctor’s Memoir of a Deadly Medical Crisis — Kafeel Khan. অনুবাদ — অসীম চট্যোপাধ্যায়। প্রচ্ছদ — দিলীপ ঘোষ প্রকাশক — সেতু প্রকাশনী, ১২/ এ শঙ্কর ঘোষ লেন, কলকাতা — ৭০০০০৬ Phone: 94330 74548 e-mail : setuprakashani@gmail.com
বিক্রয়কেন্দ্র:
২, শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা — ৭০০০৭৩
বুকমার্ক’, ৬ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট, কলকাতা — ৭০০০৭৩