সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মানুষ তো চিরকালই নিজেকে অতিক্রম করতে চায়-
সেটুকু ্সেভাবে তার কোনো হয়ে ওঠারই নামান্তর।
এখন তো চতুর্দিকে আত্মতন্ত্রের এক বিকট বিস্তার
সর্বাত্মক দূষণ আর সামাজিক হিংস্রতা কি অঢেল।
তাতে মানুষের কোন ধর্মের দিকে মানুষেরই ইতিহাস এগোবে?
পৃথিবী কি আপনা থেকেই সত্যি ভাল হয়ে উঠতে পারে-
উঠবেই তবে!
রক্তকরবীতে ফাগুলালকে ডেকে শুনছি-এটা তো এখন:
'কাছের পাওনা নিয়ে বাসনার দুঃখ তো পশুর,
দূরের পাওনা নিয়ে আকাঙ্ক্ষার যে দুঃখ তো মানুষের'
তাতে পৃথিবীর সাথে আমাদের হয়ে ওঠার কথাও যে কত-
সুন্দর সে-কথা জানে, চোখে পৌঁছে দেয় তাতে জল।
চোখের জলের দিকে আকাঙ্ক্ষা এগোলেই তো
সুন্দরের সঙ্গে ঠিক দেখা।
দুঃখকে আত্মস্থ করা, সৃষ্টিক্ষম করা
সে-তো এক মহা আয়োজনই। শুধু ব্যক্তি কেন
সে তবে সমষ্টিরই এক মস্ত নির্বচন-
সেখানেই মানুষের চিত্ত উদ্ঘাটন -- আনন্দের গতি
যেন ধীরোদাত্ত --- জানলা খোলা, দরজা খোলা
এক অশেষ প্রহর ধেয়ে আসে তাতে বহুবর্ণলিপি।
পরে হওয়া বা না-হওয়ার মধ্যে অসমাপ্তই তো কত!
যেমন 'মানুষ তো সমাপ্ত নয়' সেভাবেই শোনা হোক
তার না-হওয়াও যে অনন্ত'-একথা কেমন করে
শেষ অবধি চিনবে মানুষ!
তার চতুঃস্পার্শ প্রহর জুড়ে দিনরাত যে বাজছে ত্রিতাল।
দুখজাগানিয়া গানটি বিশুই তো শোনালো নন্দিনীকে।
অথচ '... চোখের জলে লাগলো জোয়ার' শেষে
নন্দিনী সে-জানার হিসেব কষে কি নিজের প্রাণে-
দুঃখের সঙ্গে জানাশোনাই তবে
জীবনকে জানারই পথে টানে।
আমাদের জীবন কোনো পূর্ণ না কি? সে-তো তবে
পূর্ণতার দিকেই এক চলা। তখন তো একক, এক অন্তর্গত আমি।
পরে, 'মুখের গ্লানি সয়না যে আর'-
রবিঠাকুরকে ছুঁয়ে গান-কথা নিজের দিকেই-
সে-এক অন্তঃস্থ পথ-প্রান্তর, প্রান্তর...
তখন তো নিজের সঙ্গে মুখোমুখি-
দুঃখেরও কি মহিমা থাকে কোন?
সে-কি নিজের কাছেই নিজেকে ফিরিয়ে দেয় শুধু!
এই যে আমাদের আকাঙ্ক্ষার চাওয়া, পাওয়াও-
তাতে ব্যক্তিগণ্ডি ছাড়াবার অবকাশ -- চোখে পড়লো না তো!
তাতে পাওয়াটুকু খণ্ডিত হতেই তো পারে।
কি করে যে বড় আকাঙ্ক্ষাকে চাইতে হয়- সেই সত্যে
না কি ধ্রুব সত্যে -- একটি অনন্ত ইচ্ছা
অবশ্যই জুড়ে নিতে হয়
তখন তো গণ্ডিমুক্ত আকাঙ্ক্ষার কাছে সুন্দরের দেখা!
আবার এই যে বড়োটার শিখা জ্বলছে কি তুমুল-
তাতে 'ছোটোগুলি হতে থাকছে ছাই' তাকে তবে
কে মনে রেখেছে বলো?
আমার স্বার্থের অংশ যত মরে ততই তো আমি বাঁচি বেশি।
সে-ভাবনাও তো বেশ।
কিন্তু এই মরার যে দুঃখ-সে চিন্তার সম্বলটুকু
তবে কি সার্থক বেঁচে ওঠা!
তখনো একবার কাফকার প্রার্থনার কাছে:
অখণ্ড নীরবতা সে-তো
নিজেকে নিজের কাছে উদ্ঘাটন শুধু।
একটা অন্ধকার ঘর। সে তবে মাটির আবরণ ভেদ করে
পৃথিবীর বুকের মাঝখানে ...
চারপাশ জোড়া যে অন্ধকার-
সে সীমায় সে বুঝি নিতান্ত নতুন
সে-কথা সুরঙ্গমাই জানে।
ওই আলোর ঘর -- তাতে সকলের আনাগোনা
তবু এক অন্ধকার ঘরটুকুতেই
সুদর্শনার সঙ্গে রাজার মিলন শুধু, একলার-
হাজারজন থেকেই তো একমাত্র আলাদা হবার
এক অদ্ভুত আঁধার
যেন তাতে অনন্ত আকাশের মত অন্ধকার আজ আনন্দের টানে-
আকাশের আবেগ থেকে জড়ো করছে নক্ষত্রের আলো
নিতান্ত গোপনে...
আঁধার রাতের একলা পাগল...
কি এক বিস্ময়, ততক্ষণে কাছেই তো দেখি-
অন্ধকারের দ্বার কি অবাক -- সত্যি গেল খুলে
তাতে বাইরে যাবার এক অনুপম পথ...
প্রহর পূর্ণ হোল।
আজ বাইরের খোলা পথে যাবার আগেই
সুদর্শনা প্রণাম করছে এক নিষ্ঠুরকে ---তার
ভয়ানককে, প্রিয়তমকে...
এই যে আধুনিক আমলের বরোয়ারিতলা, তারা চাইছে
নতুন, নতুন শুধু
ওদিকে রসবেদনায় কারা কানে কানে বললেন যে তখুনি-
নতুন চাইনে রে, এখন তো নবীনকে চাই।
তখন তো অন্তহীন পাওয়া আর অন্তহীন দেওয়ার কাছে
কি এক অবিচ্ছিন্ন আবর্তনই....
এরই মধ্যে শিরীষ বীথিকায়,
যৌবনের অপরিসীম মাধুর্যের জোয়ারের ঘাটে ঘাটে
কিভাবে ভেসেছে তরী
সর্বনাশের যত ভয় ভাঙাতে-শুনি, গান জেগেছে আজ।
দেখি-পথও দূরের দিকে।
আবার কি কাণ্ড বলো -- যে, পথকে নিয়ে এল কাছে
সে-ই তাকে ফেরাচ্ছে দূরে।
এসব ভাবনার ফাঁকে কারা যেন নবীনকে পরিয়ে দিল
সন্ন্যাসীর বেশ।
আজ যে দূরের ডাক এসেছে। পথিককে কে ফেরায় আজ!
অথচ ফেরার পথ সে-তো অজানাই-
যে নিয়ে এসেছিল পথ
সেই তবে ফিরিয়ে নিচ্ছে পথ রেখা।
পাশে বেলা শেষের উত্তরীয়, তাতে কি চঞ্চল, নবীনের ভঙ্গীটি রইলো আঁকা।
শঙ্খিনী নদী, পাশে নিরিবিলি আর্দ্র পংক্তি এমন দুঃখ আছে যাকে ভোলার মত দুঃখ আর নেই
তখন আড়াল থেকে কেউ তো বলবেই, না কি
ধ্বনির উত্তর: দূরের পাওনাতে আশংকার যে দুঃখ
কসে শুধু মানুষেরই
সাথে কি অবাক কথাটুকু জেগে: মানুষের দুঃখ সে তো
মানুষেরই নাগাল খুঁজছে অবিরত।
পাশে মূর্ত দেখি ঈশানি পাড়ার নন্দিন --
আজ রক্তকরবীর গুচ্ছে যেন প্রলয় গোধূলির মেঘ
তাতে কি সহজ সুখ ও সুন্দরটুকু লেগে
যক্ষপুরীতে এখন কি ঘোরবর্ণ, ভয়ের কুহক
আজ অন্ধকার ডালাটা খুলে
কেউ তাতে আলো ঢালবে বুঝি।
এ-সত্য কেউ কি শুনেছো?
আজ মহল্লায় সে- কথা কি সত্যি রটে গেছে?
(উৎসমুখঃ রবীন্দ্রনাথের নাটক)