সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মুখগুলো যেমন ভাঙাচোরা। অনেকটা ফুটিফাটা, ভাঙা কাচের আয়নার ওপর মানুষের প্রতিফলন পড়লে যেমন মানুষের ভঙাচোরা অস্তিত্ব তৈরি হয়, ঠিক তেমনই অদ্ভুত ছায়াময় সব অস্তিত্ব আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গোটা একটা মানুষ আমি আর দেখি না। মানুষের বদলে ছোট ছোট কালো বিন্দু যেন চোখের সামনে ঘোরাফেরা করে। আমার দেখা যেন অনেকটা ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখা। এমনকি জোরালো আলো ফেললেও আমার চোখের তারায় কোন অনুভূতি হয় না আজকাল। আমি বুঝতে পারছি, আস্তে আস্তে একটা অন্ধকার টানেলের মধ্যে ক্রমশ ঢুকে পড়ছি। পেছনে ধেয়ে আসছে অনেক সম্মিলিত বুটের শব্দ। আমার চেনা জগৎ, মানুষ, পরিচিত মুখ সবই হারিয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য ছোটবেলা থেকেই আমি ক্ষীণ-দৃষ্টি। দূর আমার কাছে কোনদিনই খুব স্পষ্ট ছিল না। খুব কসরৎ করে আমাকে দেখতে হয়। জোর দিয়ে কোন কিছু দেখা ডাক্তারের নিষেধ। আর এই ডাক্তারের নিষেধ মেনেই আমি আমার পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত এলাম। লোকে বলে গ্লোরিয়াস ফিফটি।
বোধ হয় ছেচল্লিশ সাল-ই হবে। বাড়িতে একটু ঝাড়পৌঁছ চলছে। খুশিদির বিয়ে, কথাবার্তা পাকা। আমি এন্ট্রান্সের জন্য জোর কদমে প্রস্তুতি চালাচ্ছি। একটু রাত জেগে পড়াশুনা করছি। আমার পড়ার ঘরের সামনে ঝাড়ালো গন্ধরাজ লেবুর গাছ থেকে পাখির ডাকে ভোর আসছে পা টিপে টিপে। আমি চোখের পাতা খুলে চোখ মেলে জেগে উঠলাম। কোন কিছুর নজরে এল না আমার। এরকম হয় মাঝে মাঝে। বেশ কিছুটা সময় পরে কানে এল মা'র গলা, নিলয়, নিলয় উঠে পড়। এবার আমি চোখ মেললাম। না, একদম অন্ধকার। কে যেন! একটা ভারী কালো রঙের পর্দা আমার চোখের সামনে টাঙিয়ে রেখেছে। আচমকা আমার ভীষণ ভয় লাগলো। অজানা একটা শঙ্কায় দেহটা কেঁপে উঠলো। দিশেহারা অবস্থায় আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি জেগে না ঘুমিয়ে, না ঘুম-ঘোরের মধ্যে আছি। ভয়ে ককিয়ে উঠলাম। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না আমি। চোখের সামনে ঝুলে রয়েছে অন্ধকার।
অনেকেই ছুটে এসেছিল। তাদের কণ্ঠস্বর কানে ঢুকছিল কিন্তু মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। মা প্রথমে হতবাক, তারপর আমাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। মার চোখের জলে আমার পরনের জামা ভিজে যাচ্ছিল। আমার বুকের ভেতরটা কেমন ভিজে উঠছিল। তবে দাদু মনে হয় অতটা বিচলিত হয় নি। আমাকে নিয়ে সোজা চোখের ডাক্তারের কাছ ছুটেছিল। এই ডাক্তার নিরঞ্জন গুহরায়ের কাছে আগেও আমি এসেছি। লম্বা, ইস্পাতরঙের দেহে এটা সাহেবি বেশে থাকেন। গলার টাইতে একটা উড়ন্ত ঈগলের পিন আছে। আজও বোধহয় সেটাই আছে-আমি অনুমান করলাম।
ট্রেনের ঝাঁকুনি, ফেরিওয়ালার বিচিত্র গলার স্বর, রকমারি শব্দের মধ্যে দিয়ে আমরা সীতারামপুর এসে পৌঁছলাম। এটা নাকি একটা প্রান্তিক শহর। চেঞ্জাররা আসে। অনেক বড় বড় বাগানবাড়ি সারা বছর খালি পড়ে থাকে। আমরা এরকম একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম। ডাক্তাররা আমাকে নিয়ে একটা মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছে। আমার এখন এখানেই থাকতে হবে।
অভিজ্ঞতার প্রথমটা সবাইয়ের কাছে কিছুটা ভয়ের, আমারও তাই। চোখের দৃষ্টি চলে যাওয়ার প্রাথমিক এই ভয়টা ক্রমশ কেটে যাচ্ছিল, সরে যাচ্ছিল। অসহায়তা টের পেলেও নিজের কাজ নিজেই করতে চেষ্টা করতাম। আমি পা গুনে গুনে বাড়ির দরজা পর্যন্ত যেতাম। আমার মতো অভিজ্ঞতা সবার হয় না। আমি ভোর-সকাল, দুপুর-বিকেল, ঋতু পরিবর্তন সব আস্তে আস্তে অনুভূতির মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারতাম। এমনকি বিকেল নাগাদ যে ফুলওয়ালা একটা লাঠির মধ্যে ফুলের মালা সাজিয়ে আসতো তার সুবাসে ভরে যেত বাতাস। তার আনা ফুলের মধ্যেই যেন লুকিয়ে থাকতো ঋতুর বার্তা, রজনীগন্ধার গন্ধে বুঝতাম শীত আসছে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের একটা যদি আচমকা নষ্ট অথবা অকেজো হয়ে যায় তবে কি বাকী ইন্দ্রিয়গুলি অনেক বেশী সজাগ হয়!
এক বর্ষার দিনে কিন্তু ভুল হল। আমি জুঁই ফুলের গন্ধ পেলাম, ঘন করে শ্বাস টানলাম। তারপর ফুলওয়ালা ছটকুলালকে বললাম, 'ছটকুলাল, আজ তুই জুঁই ফুল এনেছিস?'
আমার কথা শুনে খিল খিল করে হেসে উঠলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম মেয়ের গলা শুনে। আমার অবস্থাটা বোধহয় বুঝতে পারলো সে। তারপর মেয়েলি গলায় বলল, আমি সিতারা, ছটকুলাল নই। এসো, আমার হাত ধরো। আমি তোমাকে বড়ির বাইরে নিয়ে যাবো।
আমার সঙ্কোচ হচ্ছিল, তবু হাতটা বাড়িয়ে দিলাম সিতারার দিকে।
নামটা আমি ছোট করে নিয়ে সিতারাকে তারা বলেই ডাকতাম। আমার ডাকা নামেই সিতারা উত্তর দিত। বলতো সে, খুব ভোর বেলায় জন্ম হয়েছিল বলে ওর আব্বু ওকে এই নাম দিয়েছে।
সীতারামপুরের উত্তরের দিকে একটা ছোট টিলা আছে। সেই টিলার পিছনেই সিতারা থাকে। দাদুই খোঁজ-খবর নিয়ে তাকে আর তার বাবাকে এনেছিল কাজের জন্য।
'তোমাকে নাকি জিনে ধরেছে?' সিতারার প্রশ্নে আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, 'জিন কি?'
সে বলল, 'এটাও জানো না! সাদা ঘোড়া আর কালো ঘোড়ায় সওয়ারি হয়ে তারা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়। যখন যাকে একটু দুবলা দেখে অমনি তাকে চেপে ধরে। আমি তোমায় বড় বাবার কাছে নিয়ে যাবো। সে ঝাড়ফুঁক করে দেবে। তুমি একদম ভলো হয়ে যাবে।
'বড় বাবা থাকে কোথায়?' আমার প্রশ্ন।
সিতারা বলল, ওই টিলার মাথায় এক ঝোরা আছে। সেই ঝোরা পেরিয়ে যেতে হবে।
হাওয়ার দাপটে বড় বড় সাপুই ঘাসের জঙ্গলে যেন কেউ উঠছিল। তার মধ্যে পথ করে আমি চলছিলাম সিতারার পেছন পেছন। সূর্যের আলোয় দিনটা পরিষ্কার। সেই রুক্ষ, শক্ত, ঢেউ তোলা প্রান্তরের ওপর দিয়ে হেঁটে চলছিলাম। বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম। মাথার ওপরে আকাশ আর দেখা যাচ্ছিল না। ডুমুর অশথ্থ , ভুরুকুন্ডার নিবিড় বনপথ। বুনো লতাপাতায় ঠাসা বনপথের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তারপর পৌঁছলাম সেই নড়বড়ে কাঠের ব্রীজ পেরিয়ে বড় বাবার কাছে।
আমি সব খুলে বললাম তাকে। সেই সৌমদর্শন বড়বাবা আমার সব কথা শুনলো। তাঁর শীতল হাত আমার কপালে, চোখে, মাথায় বুলিয়ে ছিল। এমন হিমশীতল হাতের পরশ পেয়ে আমার ভেতর জেগে উঠলো। আমি চোখের সামনে সব কিছু আগের মতো দেখতে পাচ্ছি। বড়বাবা, সিতারা, চারপাশের বন, কেউ তোলা প্রান্তর-সব চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে।
এত স্পষ্ট তাজা যেন সদ্য ডিম ফুটে বেরনো বনের পাখির চোখ কেউ আমায় দয়া করে ধরে দিয়েছে। ফিরে আসছিলাম আমরা। ফেরার পথে আঁধার নামলো। ভীষণ জোরে হাওয়া দিচ্ছিল যেন কালো ঘোড়ায় চেপে, কালো আলখাল্লায় মুড়ে এক সওয়ারি নামছিল উঁচু আকাশ থেকে।
সিতারা চিৎকার করে বলছিল, 'কালো জিন, কালো জিন, দৌড়াও, দৌড়াও'।
আমি দৌড়াতে দৌড়াতে সেই নড়বড়ে কাঠের ব্রীজ পেরিয়ে এসে পাশে তাকিয়ে দেখি সিতারা নেই। ঝোরাটা হিসহিস করে ফুলে উঠলো। আমি চিৎকার করলাম। হাত-পা ছুঁড়ে হাতে কাছে যাচ্ছিল তাই ছুঁড়ে মারলাম কালো আলখাল্লা পরা, কালো ঘোড়ার সওয়ারির দিকে। আমার আক্রোশ, রাগ, কিছু করতে না পারার আক্ষেপ ওই ঝোরার মতো ফুলে ফুলে উঠছিল বুকে।
হাসপাতালের বেডে আমার জ্ঞান ফিরে এল। আমি না'কি গতকালও সম্পূর্ণ চেতনাহীন ছিলাম, অজ্ঞান করা হয়েছিল আমায়। এমনিতেই আমার নেত্রানালী, টিয়ার গ্ল্যান্ডের ফ্লাইড শুকিয়ে আসছে। এবারে অপারেশন করা হল। গত কয়েকদিন একটা ঘুম ঘোরের মধ্যে রয়েছি। এবার আস্তে আস্তে আমি ঘর, জানালা, রোদ্দুর, গাছপালা,
দাদু, মা, সিতারা কে দেখতে পাবো।
সিতারা আর আসেনি। ওদের গাঁ নাকি পুড়ে গেছে। ঘর-বাড়ি তছনছ। সীতারামপুরের পরিবেশও বেশ উত্তপ্ত। সবসময়ই একটা থমথমে ভাব। কেমন চাপা গলায় সবাই কথা বলে। আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে বারণ করতো। সীতারামপুরের চেঞ্জাররাও বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। আমি সেই বিষণ্ণ শীতের সন্ধ্যায় ঝরা পাতা মাড়িয়ে তালাবন্ধ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে টিলার দিকে তাকিয়ে সিতারার প্রতীক্ষা করতাম। টুপটুপ করে হিম ঝরতো, কুয়াশার চাদরে ঢাকা চাঁদ উঠতো আকাশে। অগুন্তি তারা ফুটতো আকাশে। আমার মনে হতো সিতারা বড় বাবার কাছে নিয়ে গেছিল বলেই আমার চোখের অন্ধত্ব কেটে গেছিল।
ক্রমেই সীতারামপুরে অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। যে কোনদিন জ্বলে উঠতে পারে আগুন। মা আর দাদুর চোখে ভয় দেখা দিল। শেষে ডাক্তারদের পরামর্শে আমারও সীতারমপুরের মেয়াদ ফুরালো।
অন্ধকার থাকতেই আমি উঠে পড়লাম। ভোরবেলায় ট্রেন। আমি ঝোপের রাস্তা পেরিয়ে সিতারাদের যেখানে থাকতে দেওয়া হয়েছিল সেই বন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়ালাম। সমস্ত শরীরে শীতের হাওয়া হায়নার মতো দাঁত বসিয়ে দিল। আমি সেই বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। শীতের তারায় ভরা আকাশ, বন্ধ দরজা সবাই আমার সেই পরাজয়ের সাক্ষী রইলো।
আমি, মা, দাদু যখন স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে জলপাই রঙের মিলিটারি ট্রাক ঢুকছিল শহরে সার বেঁধে। নিশাচর প্রাণীর চোখের মতো সেই গাড়ির হেডলাইটগুলো জ্বলজ্বল করছিল।
এরপর আজ পর্যন্ত আমি কোনদিন সীতারামপুর আর যাইনি। শহরটা নাকি জেলখানার গরদের মতো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। অনেকটা দুর্গের মতো। সেখানে সর্বক্ষণ সেন্ট্রিরা পাহারা দেয়। মানুষজন বিশেষ থাকে না।
দাদু মারা গেছে বহুদিন। মা'ও বয়সের বারে জবুথবু। আমার ভয় লাগে। আজ আমার পাশে কেউ নেই। সত্যিই যদি যে কোন সকালে উঠে আমার চারপাশে আঁধার ঘনিয়ে আসে তবে কেউ-ই আর সীতারামপুর পেরিয়ে সেই টিলা, বড় বাবার কাছে পৌঁছে দেবে না। সিতারা কোথায় হারিয়ে গেছে আমি তা জানি না। সেই বড় বাবার কাছে যাবার রাস্তাটাই আমি ভুলে গেছি। একমাত্র সিতারাই চিনতো। হয়তো আজও চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হবে কিভাবে আমি জানি না। আমিও আর ভালো হতে পারবো না। কারণ সিতারার কাছে পৌঁছানোর রাস্তাটাই আমি ভুলে গেছি এই পঞ্চাশ বছর বাদে। লোকে যাই বলুক, এই পঞ্চাশেই নেমে আসছে আমার একান্ত নিজস্ব অন্ধকার।