সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
(সেপ্টেম্বর ২০২৪, অষ্টবিংশ বর্ষ প্রথম-দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত অংশের পর)
বুদ্ধ বাবুর ‘শিল্পবিপ্লব’
সবচেয়ে সুপ্রযুক্ত বাংলা প্রবচনটি হল
‘খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে
কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে৷’
বুদ্ধবাবুর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম এঁড়ে গরুই বটে। দুধ বা বাছুর কিছুই দেয়নি। মাঝ থেকে সাড়ে চার দশকের এই মৌরসিপাট্টা উধাও। সে কাহিনী সবাই পুঙ্খানুপুঙ্খ জানেন। আমরা তা বর্ণনা করব না। শুধু আলোচনা করব ‘কেন এই মতিভ্রম?’
কিছুদিন আগেই যখন তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা শ্মশ্রু সম্বলিত অসহায় এক বৃদ্ধের ছবি দেখি, তখন ২০০৬ সালে দূরদর্শনে, চোখে ভাসে চরম উদ্ধত, ক্ষিপ্ত এবং আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ওই ব্যক্তিরই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, ‘কে কী করবে? আমরা ২৩৫ আর ওরা ৩৫৷ টাটার গা স্পর্শ করলে মাথা ভেঙে দেব।’ অথবা নন্দীগ্রামে ১৪ মার্চ পুলিশি গুলিচালনায় ১৩ জন কৃষকের মৃত্যু হলে ‘They have been paid back by same coin.’ হায়রে, সারাজীবন কাহারও সমান নাহি যায়।
প্রশ্ন হলো দিব্যি তো চলছিল। উন্নততর বামফ্রন্ট, আরও উন্নততর বামফ্রন্ট। এর মধ্যে মূলত টিকে ছিল চারটি দল। বাকীগুলির প্রায় সবারই গঙ্গাযাত্রা, থুড়ি ভোলগা যাত্রা হয়েছে। সিপিএম-এর সঙ্গে সঙ্গে যে তিনটি লেজুড় আছে, তাদের মধ্যে শরিকী সংঘর্ষ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ খুন তখন লেগেই ছিল, তা সত্ত্বেও ১৯৭৭ সালে সিপিএম-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বামফ্রন্ট বিপ্লব ভুলে ক্যাডার রাজ কায়েম করেছিল তিন দশকের বেশি সময় ধরে।
বৃহৎ শিল্প নেই। বুনিয়াদী শিল্পগুলি প্রায় লালবাতি জ্বেলেছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে রুখে দেওয়া গেছে। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ বলে একদিকে ২০-২৫ বছরের পুরোনো নামী বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি অন্তর্জলী যাত্রার পথে। কমরেডদের দুলালদের গলায় টাই, গায়ে ব্লেজার। ভবানীপ্রসাদের কবিতার ছন্দে
‘ছেলে আমার খুব সিরিয়াস কথায় কথায় হাসে না,
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটি ঠিক আসে না।
ইংলিশেও রাইমস বলে
ডিবেট করে পড়াও চলে
আমার ছেলে খুব পজিটিভ অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না।’
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্পোরেটের জয়রথ। মামলা মোকাদ্দমায় অপারেশন বর্গায় বিতরণ করা জমির বড় অংশই ফিরে গেছে পুরোনো মালিকের হাতে৷ পঞ্চায়েতি রাজের শুরুতেই হুড়হুড় করে টাকা এল ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের স্তরে স্তরে। কর্মাধ্যক্ষদের হাতে অবিশ্বাস্য পরিমাণ সরকারি টাকা, ঘুষের টাকা। কেশপুর, ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, গড়বেতা, মিনাখাঁ, সন্দেশখালি এক একটি স্তালিনগ্রাদ।
গ্রাম বাংলায় নতুন জমিদার শ্রেণি। পঞ্চায়েত প্রধান, ব্লক সমিতির সচিব, নয়া ভূমিদার শ্রেণি, বড় বড় ভেড়ি বা কোল্ড স্টোরেজের মালিক, ইটভাটা বা এলাকাভিত্তিক বাহুবলী, প্রমোটর হয়ে উঠলো শাসক দলের স্তম্ভ। আর দুটি স্তম্ভ সরকারি কেরানিকূল এবং শিক্ষকবাহিনী। আর ছিল বন্দুকের ঘোড়ায় আঙুল দেওয়া পুলিশবাহিনী, যাদের সম্পর্কে জ্যোতিবাবু একদা বলেছিলেন ‘বিপ্লব করে এলে, এদের অর্ধেককেই বাদ দিতাম।’ বিপ্লব করে আসেন নি বলে পুলিশবাহিনী পরিণত হল গণমিলিশিয়ায়।
এই অবস্থায় সপ্তম বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের নীতির পরিবর্তন ঘটল। মধ্যবিত্ত, মধ্যমেধা, শিল্প-অবান্ধব এই রাজ্যের শাসকরা স্থির করলেন শিল্পের বন্যা আনবেন। কৃষিতে সোনার বাঙলাকে পরিণত করবেন শিল্পে শীর্ষ বাঙলায়। বর্ধমান জেলা থেকে সংগঠনের স্তম্ভ নিরুপম সেনকে নিয়ে আসা হল শিল্পমন্ত্রী হিসাবে। মন্ত্রীসভায় দ্রুত পদোন্নতি ঘটল৷ সর্বোপরি বুদ্ধদেববাবু নয়া শ্লোগান দিলেন ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।’
ইতিমধ্যে ৯০ দশকের শেষে, জঙ্গলমহল এলাকার তিনটি জেলা, বাঁকুড়া পুরুলিয়া এবং মেদিনীপুরে মাওবাদীদের উত্থান ঘটে। শোনা যায়, জঙ্গলমহলকে যুক্ত করে উত্তর পূর্ব ভারত থেকে দাক্ষিণাত্য অব্দি ‘রেড করিডোর’ তৈরি করা নাকি এদের উদ্দেশ্য ছিল। নেতৃত্বে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আগত বেশ কিছু বিপ্লবী নেতা।
সিপিআইএম-এর মুঙ্গেরি নাইন এমএম, ওয়ান শর্টার, সেমি অটোমেটিক, গ্রেনেড, বোমার দাপটে প্রধান বিরোধীদল তৃণমূল কংগ্রেস মাথা তুলতে পারছিল না। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি পুরোনো কংগ্রেসের কিছু বিধায়ক ও সাংসদ এবং তলার স্তরের অধিকাংশ কর্মী (যারা সিপিআইএম বিরোধী ছিল) নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হয়। একমেবাদ্বিতীয়ম নেত্রী তিনবারের সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পুঁজি কী কী? প্রথমত হাজরা মোড়ে মাথায় লালু আলমের লাঠি খেয়ে দারুন ভাবে আহত হওয়ার বাঁধভাঙ্গা সহানুভূতি। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৮ সালের ২৯ জুলাই মহাকরণ অভিযানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুলিশের গুলিতে ১৩টি মৃতদেহ এবং তৃতীয়ত, সিপিএম বিরোধী কংগ্রেস কর্মীদের বিপুল সমর্থন ও মানুষের ঢল।
গড়বেতা শালবনী গোয়ালতোড় বেলপাহাড়ি কাষ্ঠগুড়া-নলপায় সোশ্যাল ফ্যাসিস্তদের অত্যাচার ও হত্যা লীলা তখন চরমে উঠেছে। সিপিএম-এর গণ মিলিশিয়াকে রুখতে তৃণমূলের অলিখিত চুক্তি হলো নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মায়াকাজল মাখা মাওবাদীদের সঙ্গে। মাওবাদীদের সর্বোচ্চ নেতা কিষানজী বা কোটেশ্বর রাও এক সাক্ষাতকারে সরাসরি বলেছিলেন যে তিনি সিপিএম-কে ঠেকাতে তৃণমূলের থেকে বন্দুকের গুলি নিয়েছিলেন। অবশ্য প্রায় আট বছর পরে নিজের জীবন দিয়ে তিনি এই অতলান্তিক ভ্রান্তির প্রায়শ্চিত্ত করেছেন।
এর আগে দিল্লির রাজনৈতিক মঞ্চে চূড়ান্ত ডামাডোল। দেবগৌড়া ও গুজরালের ক্ষণস্থায়ী সরকারের পরপর পতন, তার আগে জ্যোতিবাবুকে ছুরি মেরেছেন নিজের দলের তাত্ত্বিক এবং অপদার্থ নেতারা। কংগ্রেস ও সিপিএম-এর চাট মসলা সহ পাঁচকড়াই বিরোধীপক্ষে জায়গা না পেয়ে মমতা ঢুকেছেন অটল বাবুর মন্ত্রিসভায়। গুজরাট গণহত্যায় নীরব থেকে পরে দুর্নীতি ইস্যুতে বেরিয়ে এসেছেন। এই ক্রান্তিকালে ২০০১ সালের পর ২০০৬ সালে নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে মসনদে বসলেন অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধ।
মমতার উত্থানের সময় শাসক শ্রেণির সবচেয়ে প্রিয় পত্রিকা আনন্দবাজার হাত ধুয়ে তার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল ‘ষণ্ডস্ব শত্রু ব্যাঘ্রেন নিপতিত’ নীতি নিয়ে। মমতা যখন যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে সোমনাথ চ্যাটার্জির বিরোধিতায় দাঁড়ান, তখন ১৮ পয়েন্টে হেডলাইন হয়েছিল, ‘ধনকুবের আইনজীবীর বিরুদ্ধে নিবেদিতা এক নবীনা।’ সোমনাথ বাবুর তিনটি কুকুরের ছবি ও আনুমানিক দামও বেরিয়েছিল হলুদ সাংবাদিকতায়। সোমনাথ অবশ্য আর যাদবপুরে ফেরেন নি। গুরুদেবের আশ্রয় নিয়েছিলেন বোলপুরে।
বাংলার রাজনৈতিক জলবায়ুর হাওয়া মোড়ক সেই আনন্দবাজার পত্রিকা, বামফ্রন্টের সুদীর্ঘ সময় জুড়ে যার ছিল অহি নকুল সম্পর্ক, বুদ্ধদেব বাবুর প্রধান সমর্থক হয়ে দাঁড়ালো। প্রায় ‘ঐ মহামানব আসে।’ চোরেদের মন্ত্রিসভা থেকে একদা বেরিয়ে যাওয়া এবং পরে আবার ফিরে আসা এই বুদ্ধিজীবী মুখ্যমন্ত্রী অচিরেই বাংলার মিডিয়া তথা পরিশীলিত উচ্চ মধ্যবিত্ত তথা বণিক সমাজের চোখের কণিনীকা হয়ে উঠলেন। দুঃসময়-এর নাট্যকার, মায়াকোভস্কি-নেরুদা-রিল্কের একনিষ্ঠ পাঠক, আলিমুদ্দিনের পরিবর্তে নন্দনে বুদ্ধিজীবী পরিবৃত হয়ে কাব্য চর্চায় মগ্ন থাকা, ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির ফাঁসির পক্ষে সস্ত্রীক বক্তৃতা দিয়ে বাংলাস্থিত গুজরাটি বণিক সমাজকেও তুষ্ট করলেন (হেতাল পারেখের তথাকথিত ‘অনার কিলিং’কে দরিদ্র রক্ষীর উপর চাপিয়ে দেয়া হ’ল।) শ্রী হর্ষ নেওটিয়াকে শহর সৌন্দর্যায়নের নামে বহুমূল্য জমি প্রায় নিঃশুল্ক দান, তাঁকে মহামানব করে তুলল। তিনি বললেন ‘আমি একটি ভুল পার্টিতে আছি. যারা ধর্মঘটে বিশ্বাস করে।’
তিনি উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালেন, ‘উদ্বৃত্ত খেতমজুর ও কৃষি শ্রমিককে শিল্পে সরিয়ে আনতে হবে।’ ‘গুচ্চি’কে দিয়ে বানতলায় চর্মনগরী, ইন্দোনেশিয়ার কুখ্যাত সালেম গোষ্ঠীর পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে পেট্রোকেমিক্যাল হাব। তারা মেদিনীপুরের পাঁচ ফসলী উর্বর জমিতে (নন্দীগ্রামে) পশ্চিমী দেশ থেকে উচ্ছেদ হওয়া পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প স্থাপন করতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) গঠনে উদ্যোগী হল। তিনি কৃতার্থ ও গর্বিত কন্ঠে জানালেন মহামহোপাধ্যায় এবং ভারতীয় বণিক কুলের উষ্ণীষের রত্ন শ্রী রতন টাটা গরিবের ন্যানো গাড়ির কারখানা শস্য-শ্যামলা সিঙ্গুরে স্থাপন করতে রাজি হয়েছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হল সৈকত সংলগ্ন হরিপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এক ভয়ংকর শিল্পায়ন ঝাঁপিয়ে পড়ল বঙ্গবাসীর উপর।
এরপর বাকিটা ইতিহাস। এর আগে পর্যন্ত নীল পাড় সাদা শাড়ি ও হাওয়াই চপ্পল পরিহিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অপ্রাসঙ্গিক হতে হতে এক কমিক স্ট্রিপ বা হাস্যতামাসায় পরিণত হয়েছিল। কখনো মহাকরণ থেকে চুলের মুঠি ধরে বিতাড়ন (জ্যোতিবাবুর সময়), কখনো ভুয়ো ধর্ষণ নিয়ে অবস্থান (চপলা সর্দার), কখনো বামফ্রন্টের মৃত্যু ঘন্টা বাজানো আবার কখনো গোপালনগরের মোড়ে ‘আত্মহত্যা’। দু চারজন ছাড়া (যেমন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সবিতাব্রত, নারায়ণ সান্যাল) বুদ্ধিজীবী লেখক শিল্পী সাহিত্যিকরা কেউ তার মধ্যে কোন সম্ভাবনা দেখেন নি রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে। বর্তমান পত্রিকা ছাড়া মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের কাছে তিনি ছিলেন উপহাসের বিষয়। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শহরের মানুষের কাছে মূলত নাকবেঁকানো রসিকতার বস্তু। পরপর ধর্মঘট, গণ পরিবহণকে পুড়িয়ে ধ্বংস করা, বিধানসভায় ভাঙচুর - এক কথায় যাকে ইংরেজিতে বলে Rable Rouser। মূর্তিমান উপদ্রব এবং দিশাহীন এক রাজনীতিবিদ। ভুল কথাবার্তা, ভ্রান্ত ইতিহাস, একটি উদ্ধৃতিও সঠিকভাবে বলতে না পারা এক কার্টুন চরিত্র, যাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না।
শুধু তার পক্ষে ছিল আপাত সৎ ও সংবেদী ভাবমূর্তি - যে সততা ও সংবেদনশীলতা মার্কসবাদী পার্টিকে বহুদিন আগেই ছেড়ে গেছে। আর ছিল গ্রাম ও শহরের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, চরম দরিদ্র, অপরিশীলিত, অসংস্কৃত, শিল্প-সাহিত্য বর্জিত, লক্ষ লক্ষ মানুষ, বেকার যুবক-যুবতী। অর্থাৎ আর্থসামাজিক মইসিঁড়ির একদম নিচের ধাপগুলিতে ‘সবার পিছে, সবার নিচে, সবহারাদের মাঝে’ পড়ে থাকা জনতা জনার্দন।
১৯৭৭-এ ক্ষমতা দখলের সময়, এই আধা সর্বহারা জনগোষ্ঠী ছিল মার্কসবাদী পার্টির তহবিল। ৩৪ বছর শাসনকালে কখন সেই ফিক্সড ডিপোজিট তছরুপ হয়ে গেছে নেতারা বোঝেন নি। ব্যক্তিগতভাবে ও পার্টিগতভাবে সমৃদ্ধির আস্বাদনে শ্রেণিভিত্তি পাল্টে গেছে। ‘পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে।’
এই নব্য ধনিক শ্রেণির নতুন প্রজন্মের জন্য কৃষকদের উচ্ছেদ করে এবং পুরোনো শ্রমিকদের অবহেলা করে বুদ্ধদেব বাবুর গা জোয়ারি শিল্পায়নের ডাক, রাতারাতি বিরোধী নেত্রীকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এলো। বহু মানুষ মনে করতে লাগলেন মমতাই সঠিক বিকল্প।। প্রথমে সিঙ্গুর, পরে নন্দীগ্রাম। গুলি চালনা। ১৪ নভেম্বরের সূর্যোদয়। পাশাপাশি নেতাই। রিজওয়ানুর রহমানের হত্যা। জঙ্গলমহলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম-কে মাওবাদীদের রুখে দেয়া। নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের সমানে সমানে টক্কর।
এর মধ্যে ঘটে গেছে শালবনীতে জিন্দালের ইস্পাত কারখানা উদ্বোধন করে ফেরার পথে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির অল্পের জন্য বিস্ফোরণ এড়ানো। সেই সূত্রে গ্রামবাসীদের উপর পুলিশী তাণ্ডব ও ছত্রধর মাহাতোর নেতৃত্বে জনসাধারণের কমিটি গড়ে ওঠা।
এই পর্যায় নতুন করে বর্ণনার প্রয়োজন নেই। প্রায় ১৫ বছর আগে হলেও ঘটনাগুলি আজও স্পষ্ট। বুদ্ধিজীবীরা সিপিএমকে ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা’ পরিত্যাগ করলেন। কেউ ঘৃণায়, কেউ নতুন শাসকের গন্ধ পেয়ে, কেউ জল মাপতে।
অসংখ্য ছাত্র যুব, গণসংগঠন, লিটিল ম্যাগাজিন, নাটকের দল, অসরকারি সংগঠন সহ নকশালপন্থীদের নানা উপদল। এসইউসি-ও হাত মেলালো বিরোধী নেত্রীর সঙ্গে অতীতের তীব্র অপছন্দ সরিয়ে রেখে।
বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশের আহ্বান পরিবর্তন চাই। বহু গণসংগঠন একত্রে আওয়াজ তুলল, সিপিএমকে একটিও ভোট নয়। ফলে ২০০৮-এ পুর নির্বাচন ও ২০০৯-এ লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পেল তৃণমূল। সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ২ বছর ধরে একটি খোঁড়া হাঁসের (Lame Duck) সরকার চালিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল ২০১১ বিধানসভায়।
২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল-কংগ্রেস-এসইউসি পেল ২২৭টি আসন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন।
রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ আশা করলেন
১। বামফ্রন্টের অপশাসনের অবসান। ২। পার্টিতন্ত্রের অবসান। গণতন্ত্র ফিরে আসা। ৩। প্রতিটি সামাজিক ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের অবসান। ৪। দুর্নীতির অবসান। ৫। পার্টির নামে গ্রামে ও শহরে মানুষের উপর অত্যাচার ও তোলাবাজির অবসান। ৬। প্রোমোটার রাজ্যের অবসান। ৭। জোর করে জমি (কৃষি জমি) কেড়ে নেওয়া বন্ধ। ৮। পুলিশের দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যা (Extra Judicial Killing) এবং যে কোনো প্রতিবাদ আন্দোলনে গুলি চালাবার প্রথা বন্ধ হওয়া। ৯। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং চাকুরির উন্নতি, বেকারত্ব হ্রাস পাওয়া। ১০। বেসরকারিকরণ বন্ধ হওয়া। ১১। রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি এবং রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ হওয়া। ১২। রিগিং মুক্ত নির্বাচন।
এক দশক কেটে গেছে : কেউ কথা রাখেনি
বাংলার মানুষের প্রত্যাশা কতটুকু পূর্ণ হয়েছে এক দশকেৰ তৃণমূলী শাসনে? বাংলার মানুষ অবশ্যই একটি একমাত্রিক শিলাখণ্ড (Monolithic Block) নয়। মোটামুটি বারটি সূত্রে আমরা বিবৃত করছি প্রায় শতকরা ৮০ জন মানুষের কি প্রত্যাশা ছিল। তার মধ্যে কতটুকু পূর্ণ হয়েছে।
বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শাসনে তৃতীয় মন্ত্রিসভা চলছে। সিপিএমের জায়গায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে লোকসভা, বিধানসভায় উঠে এসেছে ভারতীয় জনতা পার্টি। মাত্র পনেরো বছর আগে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মার্কসবাদী পার্টি পরিণত হয়েছে দশমিকে। তৃণমূলকে যে কোন মূল্যে অপসারিত করার উদ্দাম অভিপ্সায় এবং সুতীব্র রাজনৈতিক অসূয়ায় মার্কসবাদী পার্টির নেতারা গোপনে ছড়িয়ে দিলেন ‘এবার রাম, পরে বাম।’ নিজেদের অনুগামীদের নির্দেশ দিলেন তাদের ভোট পদ্মফুলে দিতে। যেন এই ভোট আমানতী মূলধন। পরে দরকার হলেই ফেরত আনা যাবে। কী হাস্যকর ও অর্বাচীন নীতি! একেই বোধহয় প্রবাদে বলে, ‘বন্ধু ভাগ্যে পুত্র লাভ’-এর প্রচেষ্টা। ফল যা হবার তাই হলো। সিপিআইএমের ভোটের শতাংশ ১০ এর নিচে এবং আসন সংখ্যা শূন্যে পরিণত হলো।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএম-এর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। সেই অসবর্ণ বিবাহে কংগ্রেসের সামান্য লাভ হলেও সিপিএম শূন্য থেকে মহাশূন্যের পথে যাত্রা করল। সিপিএম তথা বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের মহাজোটকে কিছু মৌলবাদী সিপিআইএম কর্মী এবং উন্মার্গগামী সংবাদ মাধ্যম ছাড়া কোন স্থিরবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই কোন গুরুত্ব দেননি।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তৃণমূল নেত্রী তার বিশৃংখল, দুর্নীতিপরায়ণ (পরে আলোচনা করছি) কোনো রকম আদর্শরহিত সুবিধাবাদী, পরস্বপহারী এবং প্রাক্তন মার্কসবাদী পার্টি থেকে আসা ধান্দাবাজ কর্মী, যারা দিদির জয় ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না, তাদের বাদ দিলেও জনতার অন্যান্য নানা অংশ থেকে অযাচিত সাহায্য পেয়েছিলেন। কারণ জনগণের সেই প্রভাবশালী অংশ বিজেপি-আরএসএস-এর পাপচক্রকে রোখবার জন্য মনে করেছিলেন হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি - সারদা, রোজভ্যালি ও নারদের ভিডিও ক্লিপিং প্রদর্শিত দুর্নীতি এবং সাম্প্রতিক কালের চারটি মহা দুর্নীতি, যথা ক) স্কুল শিক্ষকদের চাকুরি বিক্রি খ) গরু এবং কয়লা পাচার গ) পৌরসভা ও অন্যান্য সরকারি চাকরি বিক্রি ঘ) রেশন দুর্নীতি সত্ত্বেও - তৃণমূল ‘লঘুপাপী’ বা Lesser evil। বাংলার বর্তমান অবস্থায় মমতা ‘দিদি’ব্যানার্জি হলেন TINA দি, অর্থাৎ There is no alternative। এই অবস্থাকেই বোধ হয় ইংরেজি প্রবচনে বলে, Between the Devil and Deep Blue Sea - অর্থাৎ আমাদের অবস্থান, একদিকে ভয়ঙ্কর দৈত্য ও অন্যদিকে গভীর নীল সমুদ্রের মাঝখানের অস্থির বালুকাবেলায়। ক্রমশ পায়ের নীচ থেকে বেলাভূমি সরে যাচ্ছে।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতবর্ষের সংসদীয় রাজনীতিতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রহসন হল দলবদল। একজন প্রাক্তন কংগ্রেসী পরে তৃণমূলী নেতা তথা কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিক সম্পর্কে একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হয়েছিল। সুযোগ সন্ধানী নেতা (সত্তরের দশকে যুবনেতা থাকাকালীন অসংখ্য খুন ও গুন্ডামির অভিযোগে ভূষিত) সকালে তাঁর স্ত্রীকে বলছেন ‘খবরের কাগজ খুলে দেখো তো, আমি আজ কোন দলে!’
বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আদর্শ ও কর্মসূচিগত পার্থক্য কাগজের চেয়ে পাতলা। ফলে সারাক্ষণ ধরেই দল পরিবর্তন চলতে থাকে। কেউ বলেন, ‘আগের দলে কাজ করতে পারছিলাম না দম বন্ধ হয়ে আসছিল।’ কেউ পূর্বের দলে বিরোধীদের দ্বারা দুর্নীতি ও কদাচারের জন্য ধিকৃত ছিলেন। নতুন দল তার কাছে ধোলাই যন্ত্র। কেউবা কুমিরডাঙা খেলার মত সঞ্চারমান। অথচ বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমগুলি সারাক্ষণ এইসব দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, চরিত্রহীন, তস্কর, হত্যাকারীদের পিছনে ক্যামেরার বুম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্নদামঙ্গলে দেবী অন্নদার ভাষায় বলতে গেলে, ‘গুনতে গেলে গুণের নাহি শেষ।’
বর্তমান অবস্থায় বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও শাসক দলের এই ধারাবাহিক সাফল্যের কারণ কী? শহরের উচ্চকোটি নাগরিকবৃন্দের প্রধান অংশের কাছে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হাস্যতামাশার বস্তু। তার অসাধারণ ইতিহাস জ্ঞান (১৯৪৮ সালে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক ফলের রস পান করিয়ে গান্ধীর অনশন ভঙ্গ বা ডহর বাবু), সাহিত্যে প্রগাঢ় অনুৎপত্তি (যেমন ঃ রবীন্দ্রনাথ বিরচিত আনন্দমঠ), সংগীত চর্চায় অসামান্য বুৎপত্তি (যেমন ঃ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কর্তৃক তাকে গান শোনাবার অনুরোধ ইত্যাদি) প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে হাসির ফোয়ারার ছবি। তার নীল পাড় সাদা শাড়ি বা হাওয়াই চটি বিরোধীদের আক্রমণের লক্ষ্য। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা ‘ভাইপো’ নামে সারা দেশেই খ্যাতিলাভ করেছেন। তিনি ‘লিপস এন্ড রাউন্ডস’ নামে চূড়ান্ত সফল একটি আর্থিক কোম্পানির মালিক - যদিও সেই কোম্পানির কিসের ব্যবসা তা অজানা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, ভারতবর্ষে আর এক ভাইপো আছেন। জয় শাহ। যাঁর সম্পদ ৫ বছরে ৮০০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সারা জীবন ডাণ্ডাগুলি খেলে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ডের হর্তাকর্তা।
আগে যেসব আর্থিক কেলেঙ্কারি উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে বিরোধীপক্ষ সমস্বরে পিসি ও ভাইপোকেই মূল চক্রী বলে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। ইডি ভাইপোকে ডেকে পাঠালে তারা বড় আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে পার্থ (অর্পিতা) চ্যাটার্জি, বালু মল্লিক, মানিক ভট্টাচার্য, বীরভূম কেশরী মন্ডল বা কালীঘাটের কাকুর মত ডায়মন্ডহারবারের সাংসদের শ্রীঘরে স্থান হবে। কিন্তু সে আশা পূরণ না হওয়ায়, সিপিএম ও অধীর-কংগ্রেস বাজারে নিয়ে এলেন ‘সেটিং তত্ত্ব’। কিন্তু তার ফল হল অচল আধুলির মত।
গ্রামের মানুষের কিন্তু এসব কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তারা জানেন লঙ্কায় রাবণ রাজাই সিংহাসনে বসেন। তারা আড়াই প্রজন্ম ধরে মার্কসবাদীদের শাসন দেখেছেন; পার্টির একাধিপত্য, লুঙ্গি বা গামছা পরা নেতাদের বিপুল বৈভব, বিরোধিতা করলে ধোপা-নাপিত বন্ধ, দুই জা বা ননদের ঝগড়াতেও লোকাল কমিটির অনুপ্রবেশ (একবার বসতে হবে), জমি বা ভেড়ি দখল, পাট ক্ষেতে পড়ে থাকা প্রতিবাদী বিরোধীদের গলাকাটা লাশ, সবই দেখেছেন।
মমতা ‘এলিট’নন, জন্মসূত্রে উচ্চবর্ণ হলেও দারুন শিক্ষা দীক্ষার পরিচয় তার কথাবার্তায় পাওয়া যায় না। গীতবিতান কবিগুরুর লেখা না জীবনানন্দ দাশের তাতে রহিম শেখ বা রামা কৈবর্তর কিছু যায় আসে না। গভর্নমেন্ট-কে গরমেন্ট বললেও সেই গর্মেন্ট যে বিনা পয়সায় চাল বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা দেয় মাসে মাসে - সেটাই প্রতিমা বাউরি বা আমিনা বিবির কাছে যথেষ্ট। এরাই এই দিদির সমর্থক। ক্রুপস্কায়া, ক্লারা, রোজা, ইলা মিত্র বা তোগলিয়াত্তি বা গ্রামশির বিতর্কের চেয়ে সবুজসাথীর সাইকেলের মূল্য এদের কাছে অনেক বেশি।
অতএব মমতাদিদির এই অপরিশীলিত তথ্যগত ভুলে ভরা Rustic কথাবার্তাই তারা বোঝেন, বুদ্ধদেবের উদ্ধৃত মায়াকভস্কি বা হিকমত বা সুকান্তের চেয়েও। ৩৪ বছর ধরে বাংলার ভোটদাতাদের সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নের জন্য এবং শুধু স্বাক্ষর নয় প্রকৃত শিক্ষিত করার জন্য ‘সর্বশিক্ষা অভিযানে’র নববিদ্যাসাগর বিমান বোসেরা কিছুই করেন নি। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পার্টি, হরেকরকম্বা গণসংগঠন, সরকারি অফিসের ডিএ-বিপ্লবী কেরানী বাবু, স্কুল ফাঁকি দিয়ে আলুর বণ্ডের ব্যবসা করা মাস্টার মশাই আর গায়ের জোরে ছাত্র সংগঠনগুলির দখল করা। ‘নতুন দিনের সূর্য’ ছাত্রযুবদের একমাত্র কাজ ছিল সারা বছর সরকারি সৌজন্যে নানা অনুষ্ঠান আর ভোট এলে নির্বাচনী তরণীটি ঠেলেঠুলে পাড়ে ভিড়িয়ে দেওয়া। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, একটি পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণের দিন এই বামফ্রন্ট সরকার নানা ধরনের ‘খারাপ রশ্মি’ থেকে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় গণপরিবহণ বন্ধের নিদান দিয়েছিল। প্রবচনে আছে, বিষবৃক্ষে অমৃত ফল ফলে না। প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছু ভালো ও জনহিতকর কাজ করার পর পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার নামে এক বিকৃত সমাজ চর্চার চাষ হয়েছে। আর্থিক অবস্থা শিক্ষা স্বাস্থ্য সবদিক থেকেই। ফলে ষাটের দশকের এগিয়ে থাকা খণ্ডবঙ্গ একটি মধ্য মেধা, মধ্য আর্থিক শক্তি, দরিদ্র গ্রামাঞ্চল, অপশিক্ষা এবং চেতনায় পিছিয়ে পড়া রাজ্যে পরিণত হয়েছে। আজ তার সুবিধা পাচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্ব।
তৃণমূল কোনো দল ছিল না। ছিল সিপিএম-বিরোধী এক গণমঞ্চ।। ‘সিপিএম হঠাও বাংলা বাঁচাও’ - এই ছিল তার মূল কর্মসূচি। সিপিআইএমের পতন এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর বিজেপি আজ প্রধান প্রতিপক্ষ। অথচ নিচের স্তরে তৃণমূল ও বিজেপির কর্মী বাহিনীর মধ্যে প্রায় কোন পার্থক্য নেই। উভয় পক্ষই হিন্দু ধর্মের বিষয়ে দারুন আগ্রহী, অনেক ক্ষেত্রেই মৌলবাদী, রাম-হনুমান ও শিব ঠাকুরের অনুগামী, অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিম বিরোধী, দুর্নীতিপরায়ণ, দেশের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ এবং কোন আদর্শ রহিত। মমতা ব্যানার্জির দলীয় নীতিও তাই, বিজেপির মত ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদী দলের উত্থান শুধু সময়ের অপেক্ষা।
তবু কেন তৃণমূল
প্রথমতঃ ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক, যাদের তৃণমূলের শরণাগত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দ্বিতীয়তঃ রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে মহিলাদের (বিশেষত গ্রামীণ দরিদ্র মহিলাদের) দিদির প্রতি চরম বিশ্বাস যার মূলে লক্ষ্মীর ভান্ডার, নিঃশুল্ক চাল-গম, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, বার্ধক্য ভাতা, সবুজ সাথী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি প্রকল্প। জগদীশ ভগবতীর তত্ত্বকে বিরোধিতা করে বহুদিন থেকেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে আসছিলেন Direct Cash Transfer গ্রামের দরিদ্র মানুষদের উপকার করবে। বিরোধীরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে যতই রসিকতা, রিল আর খিল্লি করুন - সেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সামান্য টাকা Game changer হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্যে ‘লাভলী বহিন’ প্রকল্প চালু করতে বাধ্য হয়েছে। নিজের নিজের থুতু নিজে চেটে সিপিএম ও বিজেপি বলেছে নির্বাচনে জিতলে তারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পে টাকা বাড়িয়ে দেবে। ডিম-ভাত নিয়ে যতই রসিকতা হোক পাঁচ টাকায় তার গুরুত্ব অপরিসীম তা প্রমাণ হয়েছে।
তৃতীয়তঃ মহিলা মুখী নানান কর্মসূচি। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী থেকে অনেক প্রকল্পেই টাকা বাড়ির মেয়েদের হাতে, কর্ত্রীর হাতে পৌঁছচ্ছে। মেয়েদের পরিবারের প্রধান বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
চতুর্থতঃ সমস্ত অন্যান্য কর্মসূচি, রূপশ্রী, যুবশ্রী, শিক্ষাশ্রী, জয় বাংলা, লোকপ্রসার, নিজ গৃহে নিজভূমি, গতিধারা (স্বনিযুক্তি), খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, শিশুসাথী, সবুজশ্রী (সাইকেল), সবলা, সুফল বাংলা, জয় জোহার (আদিবাসী মানুষজনের জন্য) এবং অবশ্যই দুয়ারে সরকার, যাতে পাড়ায় বহু দলিলপত্রের কাজ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আছে সমব্যথী (সৎকারের সময় আর্থিক সাহায্য)।
পঞ্চমতঃ গ্রামের ডাল ভাতটা জুটে যাচ্ছে। নানা কুটির শিল্পে যুক্ত হয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা। সেসব গভর্নমেন্ট কিনে নিচ্ছে। গ্রামের মেয়েরা শহরের রাত-দিনের কাজ করতে আসছেন কম। এটাও শহরের বাবু-বিবির কাতর হওয়ার কারণ বৈকি!
ষষ্ঠতঃ এটা অনেকেই মনে করেন মমতা ব্যানার্জির একটি সংবেদনশীল হৃদয় আছে। তাই দিদি নামটা তাদের কাছে রসিকতার নয় আদরের। প্রসঙ্গত জ্যোতিবাবু বা সদ্য প্রয়াত বুদ্ধদেব বাবুকে কেউ দাদা বলে ডাকার সাহস কোনোদিন পাননি।
পরিসমাপ্তি
তৃণমূল দল হিসেবে এবং সেই দলের কর্মীরা অধিকাংশই আর্থিক দুর্নীতি থেকে হাজার লক্ষ টাকা করেছেন। নিজেদের পুত্রকন্যা ভাই ভাতিজাদের পিছনের দরজা দিয়ে নানা উচ্চ পদে স্থাপন করেছেন। শাহজাহান, জেসিবি জয়ন্ত, আনোয়ার এনামুল বাকিবুর কুন্তল প্রভৃতি মহামানবদের জন্ম দিয়েছে শ’য়ে, শ’য়ে। কেউ কয়লা কেউ বালি কেউ প্রাথমিকের চাকরি আবার কেউ কেউ হাজার হাজার রেশন কার্ডের দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। এদের প্রত্যেকের মাথার উপর রয়েছে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত হেভিওয়েট মন্ত্রী বা বিধায়ক। ক্ষেত্র বিশেষে তাদের নর্ম সহচরীরা।
তা সত্ত্বেও তৃণমূলের এই নির্বাচনী সাফল্য। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ, পৌরসভা থেকে বিধানসভা হয়ে লোকসভা। এর রহস্য হল তৃণমূলে একটিই Post বাকি সব Lamp Post। সেই পোস্টের উপর ভরসা করেই পুরো দলটা চলছে। তার সঙ্গে রয়েছে সিপিআইএমের অতলান্তিক ঔদ্ধত্য আর অনুতাপহীনতা এবং বিজেপির হিন্দি বলয়ের সব বিদঘুটে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জোর করে বাংলায় চাপিয়ে দেয়া। বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞতা। যারা প্রতিটি নির্বাচনের পরে রিগিং বলে চিৎকার করেন তাদের জন্য করুণা হয়। এখন এই ডামাডোল বিশৃঙ্খলতা এবং অধোগতি চলবে।
বর্তমান শাসন গরিব-মানুষ-মুখী শাসন ব্যবস্থাও মনে হচ্ছে যুগের সঙ্গে তাল রেখে সিপিআইএমের মতোই কর্পোরেট বান্ধব হয়ে উঠছে। উদাহরণ - ভাঙ্গড় মালদায় আদানি স্বার্থে গুলি চালানো, দেউচা পাঁচামি কয়লা খনি, হকার উচ্ছেদ।
শেষে তথাকথিত বিদ্বৎসমাজ বা বিশিষ্টজন বা সুশীল সমাজ (যাকে মার্কসবাদীরা ব্যঙ্গ করে সুশীল বাবু বলেন) এর সম্পর্কের দু-চার কথা বলে এই অতি দীর্ঘ নিবন্ধে ইতি টানি।
বামফ্রন্ট যখন প্রথম ক্ষমতায় এলো তখন প্রাক্তন কংগ্রেস বুদ্ধিজীবীদের একাংশ শিক্ষার সংকোচন বিরোধী কমিটির নামে এবং স্কুলস্তরে ইংরেজি ভাষার শিক্ষা তুলে দেয়ার বিরুদ্ধে নতুন সরকারের সঙ্গে বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। বহু প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী স্কুল শিক্ষা থেকে ইংরেজি ভাষা তুলে দেবার বিরোধিতা করেন। তারপরেও মরিচঝাঁপির গণহত্যার সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পত্রিকার পাতায় সরকারি নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। ’৮৩ ও ’৮৫ সালে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের পক্ষে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী জানিয়েছিলেন যদিও তাদের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট কম।
বাস ট্রামে ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনে পুলিশের গুলি চালনায় মাধাই হালদারের মৃত্যু হলে বিশেষ কাউকে দেখা যায়নি। তারপর ত্রিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, নট ও নাট্যকার, লেখক, প্রায় সকলই ভয়, ভক্তি বা পারিতোষিকের জন্য বামফ্রন্টের দিকে চলে গেছেন। বামফ্রন্ট সম্ভবত প্রথম নিজেদের সমর্থনে এক বুদ্ধিজীবী ব্রিগেড তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল, যা আগে কখনো হয়নি।
২০১১ সালে পালাবদল হলে আরম্ভ হল বিশিষ্টজনদের উল্টো রথযাত্রা। প্রায় কুড়ি বছর ধরে যারা সিপিএমের খুন, জখম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ ছিলেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর সভা আলো করে নন্দন বা নজরুল মঞ্চে বিরাজ করতেন, শাসক দলের আশ্রয় নিলেন এবং যথাযোগ্য পারিতোষিক পেলেন। নামকরণে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর কোন জুড়ি নেই। এ যেন সুকুমার রায়ের হযবরল-র সেই ব্যক্তির মত যিনি সব কিছুরই একটি করে নাম দিতেন। শেষে বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেওয়ায় সেটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল। কেউ বঙ্গবিভূষণ (সৌভাগ্যবশত কেউ বঙ্গরাবন হননি) কেউ মহানায়ক, কেউ চিকিৎসকশ্রী, কেউ শিল্পশ্রী প্রভৃতি। নিরপেক্ষ সচেতন বিবেকবান কোন জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই। সিপিএম আমল থেকেই যে কোন গণ আন্দোলনকে গলা টিপে মারার বা ক্যাডার নামিয়ে ভেঙে দেওয়ার চূড়ান্ত মুন্সিয়ানা শাসক শ্রেণি আয়ত্ত করেছিল। সেই ট্র্যাডিশন অনেকটা হলেও এখনো চলছে। ফলে অন্য রাজ্যগুলিতে যেমন দলীয় রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে ছাত্র, যুব, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ট্রেড ইউনিয়ন, প্রভৃতির নেতৃত্বে গণ আন্দোলন মাঝে মাঝে গর্জে ওঠে এবং সরকার ঘাড় নোওয়াতে বাধ্য হয় - সেই আশা আপাতত পশ্চিমবঙ্গে বিলীন।
কেন এমন হলো? কবে থেকে হল!
আমি সমাজতাত্ত্বিক বা ইতিহাসবিদ নয়। নিতান্তই পাঠক। আমারো মনে বারবার এই প্রশ্ন এসেছে যে, মুঘল আমলে যে সুজলা সুফলা বাংলার মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন সারা বিশ্বের শতকরা ১৭ ভাগ ছিল, কার্পাস বস্ত্র, রেশম এবং লবণের জন্য অপরাপর বহু বহু দেশ বাংলার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতো তার আজ এই অবস্থা কেন? সেই সব দিনে বলা হ’ত বাংলার রাজধানীর বৈভব; সোনা, বস্ত্র, মণি-মাণিক্যের যা সমাহার তার তুলনায় লন্ডন বা পাশ্চাত্যের কোন রাজধানী নিতান্তই টিমটিমে একটি গ্রাম। পশ্চিমবাংলার আর্থিক অধঃপতনের কারণ যেভাবে ভাবি,
(১) ইংরেজ শাসনে বস্ত্র ও লবণ শিল্পের ধ্বংস; ভূসম্পত্তির খাজনার বিপুল বৃদ্ধি ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে বাংলার রায়তের সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া।
মধুশ্রী মুখার্জি তার বইয়ে (Churchill's Secret War : The British Empire and the Ravaging of India during World War II, 2010) দেখিয়েছেন, সিরাজের পতনের পর প্রায় তিন মাস ধরে প্রতিদিন ১০০টি বজরা সোনাদানা-মণি-মাণিক্য নিয়ে কলকাতা অভিমুখে এবং সেখান থেকে শ্বেতদ্বীপে গমন করত। বাংলার জন্য বরাদ্দ চাল চার্চিল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর জন্য চুরি করেছিলেন, ফলত দ্য গ্রেট বেঙ্গল ফেমিন। শশী থারুর-ও (An Era of Darkness: British Empire in India)-য় এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরীর কথায় পলাশীর আগের সোনার বাংলা অচিরেই দরিদ্র মরুভূমিতে পরিণত হলো।
(২) ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় যদিও বাঙ্গালীদের বিপুল অবদান ছিল কিন্তু ১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু এবং ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগের ফলে, ঠিক স্বাধীনতার সময় পুরো কংগ্রেস নেতৃত্ব যুক্তপ্রদেশ, গুজরাট, মুম্বাই এবং মাদ্রাজের বাংলা বিদ্বেষী নেতৃত্বের হাতে চলে যায়।
(৩) পাট শিল্প ছিল বাংলার একটি প্রধান অবলম্বন। জুট মিলের শ্রমিকদের অবস্থা তলানিতে থাকলো কারণ পাটের কাঁচামালের শতকরা ৭০ ভাগই চলে গেল পূর্ব পাকিস্তান পরে বাংলাদেশে।
(৪) পারমিট লাইসেন্স রাজ এবং মাশুল সমীকরণ নীতির ফলে এবং কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের বদমাইশির জন্যে কয়লার রয়ালটি থেকে রাজ্য বঞ্চিত হল। কেউ বৃহৎ শিল্প স্থাপন করতে চাইলে, অনুমতি পত্র না দিয়ে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা এবং ওই শিল্পকে অন্য রাজ্যে চালান করা দিল্লির নেতা ও আমলাদের নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়ালো।
(৫) দেশভাগের ফলে এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু এই রাজ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হলেন। এরা অনেকেই যথেষ্ট শিক্ষিত ও সম্পন্ন ছিলেন ওপারে। কিন্তু এপারে না ছিল চাষের জমি না চাকরি।
(৬) আগেই পশ্চিমবাংলার আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হয়েছিল। এখন হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার, ক্ষুধার্ত কর্মঠ মানুষ, সম্পন্ন পরিবারের গৃহবধূ বা সুস্থ সবল পরিবারের শিশুরা কলমের এক খোচায় পরিণত হলো ভিখারিতে। একদিকে তীব্র বেকারি, অন্যদিকে অতলান্টিক ক্ষুধা ও আধা মন্বন্তর; একদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনের অপমান ও ক্লীবতা ছাত্র-যুব কৃষককে বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
(৭) সংগঠিত অসংগঠিত শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে ঢেউ, খাদ্য আন্দোলনের ঢেউ ফেটে পড়লো নকশালবাড়ির সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবে। শুধু বাংলা নয় ভারতের অন্যান্য অনেক জায়গায়ও। শ্রমিক কৃষকের বিপ্লব হলেও মূল অংশ ছিলেন ছাত্র ও যুবশক্তি। তারা নিহত হলেন, বিকলাঙ্গ হলেন, অত্যাচারিত হলেন। ক্লাস এইট নাইন থেকে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিঙের মেধাবী ছাত্ররাও বিপ্লবের ডাকে বেরিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী, কংগ্রেস-সিপিআইএমের গুণ্ডাবাহিনী তাদের শেষ করে দিল। তবুও দুই একটা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেল কৃষি বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ।
রাজ্যে তখন সিদ্ধার্থশংকর রায়, সুব্রত-প্রিয়রঞ্জনের তৈরি করা হেমেন, ফাটাকেষ্ট, জীবনদের প্রাইভেট আর্মি। শ্রমিক কৃষক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-যুবর স্থানে রাজনীতির পাদপ্রদীপ দখল করলো অশিক্ষিত, হিংস্র, সংস্কৃতিবিহীন এক ঘাতক বাহিনী।
এই অবস্থায় জনতা পার্টির ঘাড়ে চেপে সিপিআইএম তথা বামফ্রন্টের আগমন। সিপিআইএম কিন্তু ওই গুন্ডাবাহিনীকে নিরস্ত্র না করে বিরোধী দমনের উপযুক্ত একটি রেডিমেড ফোর্স হিসেবে গ্রহণ করল।
মেধা নেই, শিক্ষা নেই, রাজ্যে বৃহৎ শিল্প নেই (যদিও বৃহৎ শিল্পে এখন কর্মসংস্থান হয় না)। বাহুতে শক্তি আছে হৃদয়ে পার্টির প্রতি ভক্তি আছে। এই লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত যুব বাহিনী ঠিক কী করবে? পার্টিই তাদের সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা হয়ে দাঁড়ালো। অর্থ আছে, প্রভাব আছে, সামাজিক ভক্তি না থাকুক ভয় আছে। যে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা শ্রমিক কৃষকদের বিপ্লবের তত্ত্ব দেন তারা পুরস্কার, পদ ও পদকের লোভে বিক্রি এবং বিকৃত হয়ে গেলেন।
সিপিএমের সেরা ছাত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চাকরিজীবীরা অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের তোয়াক্কা করেন না। হকার, ফুটপাতে সবজিওয়ালা, মিড ডে মিলে যোগানদার, অটোওয়ালা আর সিভিক পুলিশরা ১০০% সরকার থুড়ি পার্টি নির্ভর। ফলে তৃণমূলকে বিশেষ পরিশ্রম করতে হয়নি। শুধু লয়ালিটি চেঞ্জ। আর মমতাদির একটি বড় গুণ আগে কে কি করেছে বা বলেছে উনি মনে রাখেন না। সবাই স্বাগত।
একটা মজার জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম। যাতায়াতের পথে হাজরা মোড়ে একটি অটোস্ট্যান্ডে সিটুর পতাকা ঝুলত। অটোওয়ালাদের খামখেয়ালিপনা ও দুর্ব্যবহারে নিত্যযাত্রীরা অতিষ্ঠ। কিন্তু কিছু করার ছিল না। ২০১১-তে যেদিন বিধানসভার ফলাফল বের হল, পরের দিন সকালে দেখি ভোজবাজির মতো সব পরিবর্তিত। দিদির ছবিতে মালা ঝুলছে। সব গাড়িতে ঘাসফুলের পতাকা। সিটুর দু-চারটে ভাঙা ছেঁড়া নিশান নর্দমায় পড়ে আছে। অটোওয়ালাদের ব্যবহার এবং হুমকি একই আছে।