সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
“ইন্ডিয়া মে হো-না, হিন্দি নেহি আতা?”
গত নভেম্বর (২০২৪) মাসে খোদ কলকাতার মেট্রো রেলে একজন বাঙালিকে হিন্দির ব্যবহার নিয়ে রাজস্থানের তরুণীর আক্রমণের সেই ঘটনার পর অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক জন ছাত্রছাত্রীর ভারতের পতাকা মাড়ানোকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী তাস খেলে ফেলেছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি, বিস্ময়কর ভাবে ‘দেশ-দেশ’-এর টনিক গিলে সেই প্রায় একই সুরে প্রতিবেশি-বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন স্বঘোষিত বামপন্থী মধ্যবিত্ত, অপতথ্য প্রচারের ন্যাক্কারজনক খেলায় মেতে উঠেছে প্রত্যেকটি মূলধারার সংবাদমাধ্যম। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদের প্রেক্ষিতে এই বাংলাদেশ-বিদ্বেষ এক গভীর সংকটকে চিহ্নিত করে, তার মধ্যে মেট্রোয় কলকাতাবাসী বাঙালিকে হিন্দিভাষীর ‘বাংলাদেশি’ বলে আক্রমণের ঘটনার স্মৃতি ফিকে হয়ে আসাই স্বাভাবিক।
তবু মনে করানো ভালো, ওই তরুণী যেভাবে আক্রমণ করেছিলেন তাঁর বাঙালি সহযাত্রীকে, তাতে বাঙালি হিসেবে আমাদের ভাষিক অস্তিত্ব যে সার্বিকভাবে সংকটাপন্ন (ওই আক্রান্ত মহিলার সপাট প্রতিবাদ সত্ত্বেও, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার-কর্তৃক বাংলাকে ধ্রুপদি ভাষার স্বীকৃতি সত্ত্বেও), সেকথাও ভুলে থাকা অসম্ভব। কী আশ্চর্য ঔদ্ধত্যের মেজাজে ওই তরুণী একজন কলকাতাবাসীকে বলে দিয়েছিলেন – “ওয়েস্ট বেঙ্গল ইজ আ পার্ট অফ ইন্ডিয়া, ইউ মাস্ট বি লার্নিং হিন্দি! দ্য মেট্রো ইজ নট ইওরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইজ নট ইওরস।”১
সাংবিধানিক ভাষা নিয়ে তিনি কতখানি অজ্ঞ, তা তো প্রমাণিত। কিন্তু বয়োঃজ্যেষ্ঠো একজন অচেনা সহযাত্রীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেই মৌলিক সহবত-শিক্ষাও বোধহয় তিনি পাননি। পুরো সময় জুড়ে তিনি যে সুরে কথা বলেছিলেন, তাকে চলতি বাংলায় আমরা ‘গা-জ্বালানো’ বলে থাকি। পরভাষী মানুষের প্রতি অসীম বিদ্বেষ না থাকলে এমন উৎকট বহিঃপ্রকাশ সম্ভব নয়।
ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের গ্রাম্ভারি তত্ত্বের দিকে যদি আপাতত নাও যাই, এই অল্প বয়সেই ভিনরাজ্যের শহরে মেট্রো রেলের মতো সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য এক স্থানে যেভাবে বেশ কর্তৃত্ব নিয়ে এধরনের ঘৃণা ছড়ালেন এবং তাতে তিনি অনুতপ্ত হয়েছিলেন বলেও খবর আসেনি – এইটেই সবচেয়ে ভয়ের!
তবে এতে একটা সুবিধা হয়েছিল। গাঁ-মফসসলের প্রব্রজনকারী শ্রমিক, কাজের সূত্রে ভিনরাজ্যের শহরে গিয়ে বাংলা বলার কারণে ‘বাংলাদেশি’ শুনতে হয়েছে, কিংবা, কলকাতায় পড়তে আসা ছেলেমেয়েকে আঞ্চলিক টানের কারণে ‘গাঁইয়া’ টিটকিরি সইতে হয়েছে, এতদিন এসব ঘটনা আমাদের গা-সওয়া ছিল, কিন্তু কলকাতার মানুষকে কলকাতাতেই হিন্দি না-বলার জন্য ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে, এ আমাদের শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে সেদিন অবধিও কল্পনাতীত ছিল – সেই আত্মদম্ভের বুদবুদটা দুম করে ফেটে গিয়েছিল।
এমন নয় যে, কলকাতায় এরকম হিন্দি-আধিপত্যের কথা আগে শোনা যায়নি। যে ঘটনা নিয়ে আলোচনা, সেরকম ঘটনা ইদানীং যে আকছার ঘটে, ফেসবুকে এদিক-ওদিক চোখ পাতলেই দিব্যি জানা যায়। খানিক পিছিয়ে এই শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রাইভেট স্কুল বা টিউশনির পরিসরে বড়ো হওয়া কোনও বাংলা গান বা কবিতা-প্রেমী ছাত্র বা ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে, ‘বলিউড-স্মার্ট’ বন্ধুবান্ধবদের নাক-সিঁটকানো কোন পর্যায়ের ছিল! ইস্কুল-টিস্কুলে জিকে-র প্রশ্নেও ‘ভারতের রাষ্ট্রভাষা কী?’-র উত্তর ‘হিন্দি’ লিখতেইবা কেন শেখানো হয়েছিল, তার পিছনে সংঘ পরিবারের গোপন অ্যাজেন্ডা কিছু ছিল কিনা, এসব প্রশ্ন কেউ কখনও তোলেওনি। ভারতের যে আদৌ কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই, এই বিজেপি সরকার এসে হিন্দি নিয়ে ধুয়ো না তুললে এই ঠিকটা জানতে বোধহয় আরও কয়েকবছর লেগে যেত। বাংলা নিয়ে হীনম্মন্যতা আরও একরকমের ছিল – সেটার চেহারা, বাংলা মিডিয়মে পড়া ‘হতভাগ্য’ আমাদের সম্ভাব্য ইংরাজি-ব্যর্থতা নিয়ে গুষ্টিশুদ্ধ আত্মীয়স্বজনের অকারণ উদ্বেগের ধাঁচের। আরও কিছু সময় পিছিয়ে গেলে দেখব, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবি – কলকাতার ‘হিন্দি’ হালচালে হতভম্ব হয়ে যাওয়া তোতলা পুরুত, ভটচায মশাই (রবি ঘোষ) বলে ফেলছেন, এখানে তো কেউ বাংলায় কথা বলেই না।২ অর্থাৎ, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ বা হিন্দি আগ্রাসন, যে নামেই ডাকা হোক, এ ঘটনা হালের আমদানি নয়।
ইতিহাসের দিকে একবার তাকানো যাক
মোটামুটি ঔপনিবেশিক ইতিহাসই এখানে আলোচ্য। কারণ, কয়েক শতাব্দী ধরে চলা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী অনুশীলনের অন্যতম স্তম্ভই ছিল সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ। কত যে পরাজিত জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ধারাবাহিক ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে, নষ্ট হয়ে গিয়েছে কত যে ভাষা, কত যে সাহিত্য! রাজপাট জারি রাখার জন্য সে শূন্যস্থানের সুযোগে দিব্যি নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দিতে পেরেছে বিপুল ক্ষমতাধর, বহিরাগত শক্তি। ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার পরেও যে আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সরকারি ভাষার তালিকায় ইংরাজি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ বা ফরাসির নামই চোখে পড়ে, তার অবশ্যম্ভাবী শিকড় এই অন্ধকার অতীতেই। যদিও, হোর্হে লুইস বোর্হেস বা গাব্রিয়েল মার্কেজদের সাহিত্য ধারণ করেছে লাতিন আমেরিকারই আত্মা, তারপরেও, মনে রাখতে হবে, বোর্হেস-মার্কেজরাও সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন স্প্যানিশে। অবশ্যই তাঁদের স্বজাতীয় পিতৃপুরুষের ঐতিহাসিক অপরাধের দায় তাঁদের উপর চাপানো অপরাধ, তাও ওই সূচনা-অধ্যায়কে ভোলা সম্ভব নয়। রবার্ট ফিলিপসনের মতো ভাষাবিদরা একেই ‘লিঙ্গুইস্টিক এম্পিরিয়ালিজম’ বলেছেন।৩
পরীক্ষামূলক ব্যতিক্রম অবশ্য মধ্য আফ্রিকার একটি দেশ। সেখানকার দুই সরকারি ভাষা, ইংরাজি ও ফরাসির পাশাপাশি একাধিক দেশীয় ভাষাকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে গত তিরিশ বছর ধরে। সেসব ভাষায় প্রশাসনিক কাজ হচ্ছে, স্কুলে স্কুলে পড়াশোনা হচ্ছে, সুফলও আসছে ইতিউতি।৪ ৩ কোটি মানুষের সে ছোটো দেশটির ভাষার সংখ্যা নেহাত কম নয় – ২৭৩। দেশটির নাম ক্যামেরুন, অসামান্য বৈচিত্র্যের জন্য যাকে বলা হয় ‘মিনি আফ্রিকা’।
ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার মতো হয়নি। সেখানে অন্তত নাগরিক পরিসরে ভাষা বা ভাষাগোষ্ঠীর অমন বিস্তৃত ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেনি বটে, উলটে কাজের সুবিধার্থে বাংলা বা হিন্দির মতো দেশীয় ভাষা শেখার উৎসাহ দেখা দিত নবাগত ব্রিটিশদের মধ্যে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ‘ওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ’ হিসেবে যে ইংরাজিই প্রাধান্য পেল, সাহিত্যভারে কুলীন বাংলা, মারাঠি বা তামিলের ভাগ্যে সে শিকে ছিঁড়ল না, সে নিয়ে আম-ভারতবাসী খুব অখুশিও যে ছিল, তা নয়। পাশ্চাত্যের ভাষা শিক্ষিত ভারতীয়কে শেক্সপিয়ার চিনিয়েছিল, মিলটন পড়িয়েছিল। পরবর্তীকালে, উপনিবেশবাদের বিপ্রতীপেই গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিকতা, ইংরাজির সুবাদে বিশ্ব-রাজনীতির দুনিয়া উন্মুক্ত হয়েছে মুক্তিকামী যুবসমাজের কাছে। চার্লি চ্যাপলিনের ছবি জনপ্রিয় হয়েছে বিপ্লবী মহলে, সোভিয়েতের বিজয়গাথা উদ্বেলিত করেছে তরুণমানসকে। এমনকি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে উচ্চবর্ণের সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ নিম্নবর্ণের মানুষকে ভরসাও দিয়েছিল ইংরাজি-শিক্ষাই। একথা তো কোনোভাবেই আজ অনস্বীকার্য নয়, ইংরাজি ছিল বলেই ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের মতো দলিত সমাজের এক ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’কে রাজনীতি-বৃত্তে পেয়েছিল আধুনিক ভারত। উত্তরপ্রদেশের বাঙ্কা গ্রামে ইংরাজি দেবীর মূর্তি-প্রতিষ্ঠার মতো অভিনব ঘটনা তো আর অকারণে ঘটেনি।৫
বাঙালি সেসময়ে নিজেকে ব্রিটিশের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করেছিল, জাতি হিসেবে চোস্ত ইংরাজি বলায় তারাই প্রথম সারিতে থাকতে পেরেছিল বলে। কংগ্রেসের প্রথম কয়েক দশকের ইতিহাসে ইংরাজি বাদ দিয়ে অন্য কোনও ভাষায় বক্তৃতা করার কথা ভাবতেই পারেননি উমেশচন্দ্র বা সুরেন ব্যানার্জির মতো নেতারা। দেশের মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে দেশের মানুষের ভাষায় কথা বলতে হবে, এই দাবি তুলে এ নিয়মের প্রতিবাদ এসেছিল যাঁর তরফে, তিনি কোনও রাজনৈতিক হোমরা-চোমরা ছিলেন না, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাটোরে প্রাদেশিক কমিটির সভায় বাংলায় বক্তৃতা দেওয়া নিয়ে প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে তরুণ কর্মীদের কীরকম সংঘাত বেঁধেছিল, ‘ঘরোয়া’তে সে কাহিনি রানী চন্দকে বলে গিয়েছেন অবন ঠাকুর।
ভাষার প্রাধান্যের এই চিত্রটা খুব স্বাভাবিকভাবেই বদলাতে শুরু করেছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ পর্যায়ে এসে। ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামে সর্বভারতীয় ঐক্যের সেতু হিসেবে হিন্দি ভাষাকে ব্যবহার করার একটা উদ্যোগ কংগ্রেসি নেতাদের তরফেই ছিল। বিশেষত, দক্ষিণ ভারতের হিন্দি-অপ্রতুল অঞ্চলে হিন্দির প্রচারকে পাখির চোখ করেছিল কংগ্রেস। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ১৯১৮ সালে তৈরি করেছিলেন ‘দক্ষিণ ভারত হিন্দি প্রচার সভা’। তারপর, ১৯২৫ সালেই ডব্লিউ. সি. বোনার্জি-সুরেন বাঁড়ুজ্যের হাতে-গড়া ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরাজি থেকে হিন্দি হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে, যখন হিন্দু-মুসলমান অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে, প্রবল হয়ে উঠছে পৃথক পাকিস্তানের দাবি, ধর্মনিরপেক্ষতায় বাঁধতে হিন্দি-উর্দু দুই উত্তর ভারতীয় ভাষাকে পাশাপাশি রেখে গান্ধীজী তৈরি করলেন ‘হিন্দুস্তানী প্রচার সভা’।
তারও চারবছর পর, নখদন্তহীন ব্রিটিশ সিংহের মানে-মানে ঘরে ফেরা আর ভারত-ভাগ যখন একপ্রকার নিশ্চিত, গণপরিষদের উল্লেখযোগ্য সদস্য পণ্ডিত রঘুনাথ বিনায়ক ধুলেকর ১০ ডিসেম্বর সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন৬ – “যাঁরা হিন্দুস্তানী জানেন না, তাঁদের ভারতে থাকার কোনও অধিকার নেই। যাঁরা এখানে সংবিধান তৈরি করতে এসেছেন অথচ হিন্দুস্তানী জানেন না, তাঁরাও এই পরিষদে থাকার যোগ্য নন।”
আজ প্রায় আশি বছর পরে হিন্দি না-জানা নাগরিককে যখন হরবখত পরদেশি বলে কোণঠাসা করা চলছে, আর তাতে মদত দিয়ে চলেছে রাষ্ট্র, তখন এই প্রতিধ্বনির ইতিহাস ফিরে দেখার প্রয়োজন পড়ে বৈকি!
ইতিহাসচক্রের অদ্ভুত পরিহাসে, একসময়ে যে ইংরাজি ছিল পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের ভরসার খুঁটি, পরবর্তীকালে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অ-হিন্দিভাষীদের কার্যকরী অস্ত্র হয়ে উঠল সেই বিদেশি ভাষাই।
সংগ্রামী মাদ্রাজ
হিন্দি-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সচেতন প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার উত্তরাধিকার বলতে গেলে একটি রাজ্যেরই – মাদ্রাজ বা তামিলনাড়ু। এবং, সে প্রতিরোধের বয়সও খুব সাম্প্রতিক নয়।
১৯৩৭ সালে যখন বাংলা ও বোম্বাইয়ের মতো মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতেও কংগ্রেসের প্রাদেশিক সরকার হল, সেখানকার মাথা হয়ে বসলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি। মাদ্রাজেরই ভূমিপুত্র, অথচ দক্ষিণ প্রদেশে হিন্দি চালু করে দিলেন ক্ষমতায় বসেই। পরের বছর এপ্রিলেই প্রেসিডেন্সির ১২৫টি মাধ্যমিক স্কুলে হিন্দি পড়ানো বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। প্রতিবাদে নামলেন ‘আত্মমর্যাদা আন্দোলন’-এর অবিসংবাদী নেতা এরোডে ভেঙ্কটাপ্পা রামস্বামী ওরফে পেরিয়ার, একইসঙ্গে পেরিয়ারের দ্রাবিড় কাঝাঘামের প্রবল প্রতিপক্ষ জাস্টিস পার্টির আরোগ্যস্বামী পনিরসেলভমও। মুভালুর রামামিরথম, মুন্নাগার আজাগিয়ার, স্বামীনাথন ধরমমবলের মতো নেত্রীরা গ্রেপ্তার হলেন। এমনকি, কংগ্রেসি পুলিশের দমনপীড়নে ভাষা-শহিদের তালিকায় নামও উঠে গেল নটরাজন ও রাজামুথুর মতো দুই তরুণ প্রতিবাদীর। নেহাত ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের প্রশ্নে ব্রিটিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে কংগ্রেসি সরকার পদত্যাগ করার পর মাদ্রাজে গভর্নরের শাসন শুরু হল বলে, নয়তো প্রতিবাদের পাল্টা দমননীতি আরও কিছুদিনের জন্য পুরোদমে চলত। ১৯৪০-এর ২১ ফেব্রুয়ারি, ছোটোলাট লর্ড আরস্কাইন হিন্দি-শিক্ষাকে ঐচ্ছিক করে দেওয়ার পর স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী প্রতিবাদ-অধ্যায়ের ওখানেই ইতি।
নতুন করে আবার তা শুরু হল স্বাধীনতার পরপরই। ১৯৪৮ সালে, ভারতে তখনও প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়নি। মাদ্রাজের কংগ্রেসি প্রিমিয়ার তখন ওমানদুর রামস্বামী রেড্ডিয়ার, এক দশক আগের রাজাজির পথেই হাঁটার চেষ্টা করলেন। ১৯৪৮-’৪৯ শিক্ষাবর্ষে কেবল হিন্দি বাধ্যতামূলকই হল না, উঁচু ক্লাসে ওঠার জন্য অল্পস্বল্প হিন্দির দখলকেও মানদণ্ড করা হল। আবারও পথে নামলেন এদেশে ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধিতার অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব পেরিয়ার রামস্বামী, সঙ্গে তাঁর ভাবশিষ্য কোঞ্জিভরম নটরাজন আন্নাদুরাই। যদিও ততদিনে দলের অভ্যন্তরে গুরু-শিষ্যের খিটিমিটিতে দল ভাঙার জোগাড়, তাও হিন্দি-বিরোধিতার প্রশ্নে দুজনে এক ছিলেন। রাজাজি তখন গভর্নর-জেনারেল, ২৩ আগস্ট ১৯৪৮-এ মাদ্রাজে এলে তাঁকে কালো পতাকা দেখাল জনতা, চারদিন পরেই গুরু-শিষ্য একযোগে গ্রেপ্তার। অবশেষে, ১৯৫০ সালে হিন্দিকে ঐচ্ছিক করা হল।
এই ধারায় উল্লেখযোগ্য নাম হিসেবে আসবেন সুন্দরশাস্ত্রী সত্যমূর্তি বা সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনও। রাজাগোপালাচারির সময়ে কংগ্রেসের মধ্যেই হিন্দি-চাপানোর দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন এই দুই বিশিষ্ট মাদ্রাজী। ঠিক যেমন, এক দশক পরেই আমরা একই ভূমিকায় দেখব মাইলাই পন্নুস্বামী শিবাগননম বা তিরুভারুর বিরুত্তাচালা কল্যাণসুন্দরমকে, যাঁরা কিনা রাজাজির আমলে কংগ্রেসের পক্ষেই ছিলেন।
এরপর, যখন সংবিধান তৈরি হচ্ছে, গণপরিষদে রঘুনাথ ধুলেকর তো বটেই, বালকৃষ্ণ শর্মা, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, বাবুনাথ গুপ্তা, রবিশঙ্কর শুক্লা, শেঠ গোবিন্দ দাস, সম্পূর্ণানন্দ, কানহাইয়ালাল মানেকলাল মুন্সির মতো হিন্দি-বাদীদের আগ্রাসী উপস্থিতি সত্ত্বেও হিন্দি যে জাতীয় ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি, তার পিছনেও মাদ্রাজের সদস্যদের অনড় অবস্থানের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সে প্রদেশের তিরুভেলোর থাট্টাই কৃষ্ণমাচারি, জি. দুর্গাবাঈ, তিরুপ্পুর আঙ্গাপ্পা রামলিঙ্গম চেত্তিয়ার, আচার্য এন. জি. রাঙ্গা, এন. গোপালস্বামী আয়েঙ্গার ও মাইসোরের এস. ভি. কৃষ্ণমূর্তি রাও ছিলেন এই বিরোধী জোটের প্রধান মুখ। হিন্দির পরিবর্তে ইংরাজিকেই কর্মক্ষেত্রের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের সপক্ষে ছিলেন তাঁরা। প্রায় তিনবছরের তর্কাতর্কির পর অবশেষে যে সমঝোতার সিদ্ধান্ত হয়, (মুন্সি-আয়েঙ্গার সমঝোতা) সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সংবিধানের ১৭ নম্বর ভাগে ইংরাজির সঙ্গে দেবনাগরী লিপির হিন্দিকে কেবল ‘আরেকটি সরকারি ভাষা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, ‘একক জাতীয় ভাষা’ হিসেবে নয়।
তবে, এতরকম বাদ-প্রতিবাদের পরেও সাংবিধানিক পরিকাঠামো যে অ-হিন্দিভাষীদের প্রতি খুব সুবিচার করেছিল, ইতিহাস সেকথা বলে না। ১৭ নম্বর ভাগের ৩৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদেই যেমন বলা হয়েছিল, পাঁচবছর পর (১৯৫৫ সালে) একটি ভাষা কমিশন গঠন করতে হবে। সে সভার কাজ কী হবে? না, হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে তুলে ধরতে হরেক কিসিমের উপায় বাতলানো। ৩৫১ নম্বর অনুচ্ছেদের নির্দেশটি আরও গণ্ডগোলের, সেখানে আবার পরিষ্কার বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব হিন্দির যথাযথ প্রচার। সাদা ভাষায়, ‘বিবিধের মাঝে’ একটি ভাষার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা-কবচের সন্ধান ছিল বহু-প্রশংসিত সংবিধানেই।
তা মহামান্য সংবিধানের নিয়ম মেনেই, ১৯৫৫ সালে বালাসাহেব গঙ্গাধর খেরের কমিশন যখন ইংরাজিকে সরিয়ে হিন্দিকে একক সরকারি ভাষা করার পরামর্শ দিচ্ছে, তখনও যে দুজন কমিশন-সদস্য বিরোধিতা করছেন, তাঁদের একজন যদি হন পশ্চিমবঙ্গের ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আরেকজন মাদ্রাজের পরমশিবন সুব্বারায়ান। ১৯৫৭ সালের ১৩ অক্টোবর ‘হিন্দি-বিরোধী দিবস’ পালন করল আন্নাদুরাই-প্রতিষ্ঠিত দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাঘাম (পেরিয়ারের দ্রাবিড় কাঝাঘাম থেকে ভেঙে বেরিয়ে এসে ১৯৪৯ সালে এই দল আত্মপ্রকাশ করে)। তার আগের মাসেই খের কমিশনের রিপোর্ট খতিয়ে দেখতে গোবিন্দবল্লভ পন্থের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে ‘পার্লামেন্টারি কমিটি অফ অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ – কংগ্রেসি দক্ষিণপন্থী, উত্তর ভারতীয় জিবি পন্থ (এই নামেই বেশি পরিচিত তিনি) কী রায় দেবেন, খুব অজানা ছিল না। ১৯৫৯ সালে পন্থ কমিটি খের কমিশনের সুরেই সুর মেলাল। ইতিমধ্যে হিন্দি-আগ্রাসনের বিরোধিতায় নেমেছেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীর নেতা ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্টনি, এমনকি অতীত-অবস্থান আমূল বদলে আসরে নেমেছেন স্বয়ং রাজাজিও, ১৯৫৮ সালে সর্বভারতীয় ভাষাসভা আয়োজন করেছেন, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অ-হিন্দিভাষীদের কাছে হিন্দি বিদেশি ভাষার মতোই।
এ অবস্থায় জওহরলাল নেহরু, ৭ আগস্ট ১৯৫৯, ঘোষণা করলেন – “বিকল্প ভাষা হিসেবে ইংরাজিকে দেশবাসী ব্যবহার করতেই পারেন, তাঁরা সেটা ব্যবহার করবেন কিনা, সে সিদ্ধান্ত আমি অ-হিন্দিভাষীদের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি, হিন্দিভাষীরা সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।” পরিস্থিতির বিচারে একটি বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই ঘোষণাকে বিচক্ষণ বলেই ধরে নিতে হবে।
তবে, তাতেও যে পরিস্থিতির আদৌ উন্নতি ঘটল, তা নয়।
সাংবিধানিক একচোখামির আরও এক নমুনা ছিল অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৪৩(২)। সংবিধানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর দিন থেকে পরবর্তী পনেরো বছর অবধি ইংরাজি সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হবে, এই অনুচ্ছেদে তেমনই এক নির্দেশিকা ছিল। সেই হিসেবে, ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি অবধি ইংরাজির সরকারি ভাষা হিসেবে স্থায়িত্ব। সে কাঙ্খিত লক্ষ্যপূরণে কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টার কমতি রাখেনি। ১৯৬০ সালেই হিন্দি টাইপরাইটিং ও স্টেনোগ্রাফি-শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হল, রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ অতি-উৎসাহীর মতো সরকারি দপ্তরে হিন্দি-শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলেন, সরকারি পরিভাষার হিন্দি অনুবাদ শুরু হল। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এবারও অ-হিন্দিভাষীদের ভরসা দিলেন। কিন্তু একইসঙ্গে, রাষ্ট্রপতির কর্মকাণ্ড যে তাঁর ভরসাবাণীর পরিপন্থী নয়, সেকথাও দক্ষ কূটনীতিকের মতো জানিয়ে দিলেন।
দক্ষিণের রাজনীতিকরা অবশ্য গতিপ্রকৃতির দিকে ঠিকই নজর রেখেছিলেন। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে সংসদে আনা হল ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজেস বিল’। ইংরাজির ব্যবহার নিয়ে সেখানে লেখা হল – “Notwithstanding the expiration of the period of fifteen years from the commencement of the Constitution, the English language may, as from the appointed day, continue to be used, in addition to Hindi,- (a) for all the official purposes of the Union for which it was being used immediately before that day, and (b) for the transaction of business in Parliament.”
উপর-উপর দেখলে বেশ উদারবাদী আইন বলেই মনে হবে, কিন্তু গোলমাল বাঁধাল ওই ‘may’ শব্দটা। আন্নাদুরাই-সহ ডিএমকে নেতৃত্ব দাবি তুললেন, ‘may’-র (হতে পারে) বদলে ‘shall’ (হবেই) করা হোক। পোড়খাওয়া তাঁরা দিব্যি জানেন, আগামীতে ‘may’-টা ‘may not’ হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। জওহরলাল বলেছিলেন, তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। সেইমতো, ২৭ এপ্রিল ১৯৬৩, প্রস্তাবিত পরিবর্তন ছাড়াই পাশ হয়ে গেল আইন। নভেম্বরে ১৭ নম্বর ভাগ পোড়ানোর ‘অপরাধে’ মাদ্রাজে গ্রেপ্তার হলেন আন্নাদুরাই, আরও ৫০০ জন ডিএমকে নেতা-কর্মী। ১৯৬৪-র জানুয়ারিতে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলেন ডিএমকে কর্মী চিন্নাস্বামী।
সরকার-বিরোধী প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল ১৯৬৫ সালে। ততদিনে জওহরলাল প্রয়াত, নতুন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী, তাঁর মন্ত্রীসভার দুই বর্ষীয়ান সদস্য মোরারজি দেশাই আর গুলজারীলাল নন্দা, সকলেই হিন্দির পক্ষে। ১৯৬৫-র ২৬ জানুয়ারিকে শোকদিবস পালন করার ডাক দেওয়া নিয়ে সরকার-ডিএমকে সংঘর্ষ অন্য মাত্রা পেল। হপ্তা দুয়েকের সংঘর্ষে প্রায় ৫০০ জনের মৃত্যু, মাদ্রাজের বাইরেও তার আঁচ ছড়িয়ে পড়ল। ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতায় আগুন জ্বলল নতুন দিল্লিতে, ইংরাজিতে লেখা দিকনির্দেশ আলকাতরায় লেপে দিল হিন্দি-বাদী জনসংঘের সদস্যরা। ১৯৬৭ সালে মাদ্রাজের বিধানসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস যে শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ল, অভূতপূর্ব জয় ছিনিয়ে নিল তখনও কুড়ি পার না-করা ডিএমকে, মুখ্যমন্ত্রী হলেন আন্নাদুরাই, তার নেপথ্যে ছিল ভাষা-অধিকার রক্ষায় তাঁদের মাটি-কামড়ানো লড়াই।
সেবছরেই লোকসভা নির্বাচনেও আসন কমেছে কংগ্রেসের, ১৯৬২-তে জেতা ৩৬১ আসন নেমে গিয়েছে ২৮৩-তে। জওহরলাল-তনয়া ইন্দিরা গান্ধীর সরকার অবশেষে আইনের সংশোধনী আনলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এরপর থেকে, ১৯৬৮ সালে হিন্দির বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়ার নেপথ্যের আন্দোলনই হোক বা ১৯৮৬-তে রাজীব গান্ধী-সরকারের ‘জহর নবোদয় বিদ্যালয় প্রোগ্রাম’-এ হিন্দি-শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কিংবা, হালের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান একাকার করা ফ্যাসিবাদী নিয়মনীতির বিরুদ্ধে পথে নামা – কার্যকরী প্রতিরোধ এসেছে প্রায় একা কুম্ভের মতো লড়ে যাওয়া তামিল ভূমি থেকেই।৭
প্রসঙ্গত, হিন্দিকে জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে সোচ্চার সওয়ালকারীদের তালিকায় একজন উল্লেখযোগ্য বাঙালি রাজনীতিবিদও ছিলেন, বোধহয় খুব প্রত্যাশিতভাবেই তাঁর নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৮।
পিছিয়ে বাংলা: কেন?
ভাষা-অধিকার রক্ষার প্রতিরোধ-আন্দোলন যে বাঙালির একচেটিয়া নয়, তা এতক্ষণে পাঠক জেনে ফেলেছেন। বরাক উপত্যকার আন্দোলন বা মানভূমের আন্দোলন ছাড়া ধারাবাহিক ইতিহাস নেই (১৯৫২-র ‘ভাষা আন্দোলন’কে কোনোভাবেই এই আলোচনায় আনা যাবে না, কারণ, ওটা বাংলা ভাষার আন্দোলন হলেও রাজনৈতিকভাবে তা অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ঘটেছিল)।
বাংলায় হিন্দি-প্রভাবের পরিস্থিতিও অনেকটা আলাদা। ফলে, প্রতিবাদের ইতিহাসও তামিলনাড়ুর তুলনায় নবীন। আটের দশকে আনন্দমার্গী প্রভাতরঞ্জন সরকারের মতাদর্শ-অনুসারী ‘আমরা বাঙালি’ দলের কিছু কাজ নজর কেড়েছিল, রাজনৈতিক এ দলটি বেশ কিছু পঞ্চায়েত আসনও জিতেছিল। ‘আমরা বাঙালি’-র পরে এ ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধারায় দ্বিতীয় নাম বলতে এ শতাব্দীর ‘বাংলা পক্ষ’।
তামিলনাড়ুতে শুধু চেন্নাই কেন, মহাবলীপুরম বা কাঞ্চীপুরমের মতো ছোটো শহরেও ছোটো ব্যবসায়ী বা গাড়িচালকরা তামিল বাদ দিয়ে কেবল ইংরাজিই বলে থাকেন, হিন্দি জানলেও না-বলার জেদ তাঁদের অধিকাংশের মজ্জাগত, গ্রামীণ তামিলনাড়ুতে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিজাত মানুষের পক্ষে কথা চালাচালি আরও দুষ্কর হয়ে ওঠে (অবশ্যই মৌখিক ভাষার কারণে, ইশারার ভাষা দিয়েও যে মানুষের মন জয় করা সম্ভব, সেকথা বছর কয়েক আগে পাঝাভারাকাড়ু বা পুলিকটের এক নৌকাচালক আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন)। অন্য দিকে এরাজ্যে, কলকাতা তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নানা ধরনের কাজে লিপ্ত রয়েছেন বিপুল সংখ্যক হিন্দি ভাষাভাষীর মানুষ। তাঁদের এখানে চলে আসার ইতিহাসও বিচিত্র। একসময়ে যখন রেকর্ড হারে শিল্প-কারখানা তৈরি হয়েছে, বিহার-উত্তরপ্রদেশের খেটে-খাওয়া মানুষ চলে এসেছেন কাজের সন্ধানে। দক্ষিণবঙ্গীয় চশমাটা সরিয়ে উত্তরের দিকে তাকালে দেখা যাবে, প্রধান নাগরিক কেন্দ্র শিলিগুড়িতে বিপুল সংখ্যক অ-বাঙালি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ভিড়। রামনবমীর সময়ে সেখানে জাঁকজমকের যা হিড়িক পড়ে, দুর্বল হৃদযন্ত্রের কেউ উপস্থিত থাকলে তাঁর প্রাণভোমরার গ্যারান্টি দেওয়া মুস্কিল।
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে – এ সমস্যা যখন ঐতিহাসিক, এ রাজ্যে হিন্দিভাষীদের বাসও যখন শতাব্দীপ্রাচীন, এবং মেট্রোর ঘটনাও বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত নয়, তাহলে ভাষা সাম্রাজ্যবাদের পুরোনো চর্বিত-চর্বণ আউড়ে কী হবে?
আউড়ানোর কারণ এক নয়, একাধিক।
প্রথমত, হিন্দিবলয়ের যাঁরা এরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন, যাঁদের দেওয়া ভোট বিজেপি-তৃণমূল দ্বৈরথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় – শহরাঞ্চলের অভিজাত ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা থেকে শুরু করে ছোটো-বড়ো ব্যবসায়ী কি কারখানার শ্রমিক বা দৈনিক মজদুর – শ্রেণি-নির্বিশেষে প্রত্যেকেই এ বিষয়ে অবগত, রাজ্যটা নামে বাংলা হলেও এখানকার ভূমিসন্তানদের সঙ্গে হিন্দিতে বাক্যালাপ চালানোই যায়, তার জন্য কোনোরকম ‘ব্যাকল্যাশ’-এর মুখোমুখি হওয়ার ভয় অতটা নেই। না, হিন্দিবলয়ে গিয়ে বাঙালি শ্রমিককে ‘বাংলাদেশি’ শুনতে হচ্ছে বলে এখানেও হিন্দিভাষী শ্রমিককে আচ্ছা করে ‘সবক শেখানো’ হোক, এমন কোনও প্রতিশোধস্পৃহা-প্রচারের আমি ঘোর বিরোধী। ঠিক যেমন, হিন্দি-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে তুলসীদাস থেকে মুন্সি প্রেমচাঁদ কি মহম্মদ রফি থেকে আল্লারাখা রহমান, সকলকে বয়কট করতে হবে, এমন অর্থহীন ধুয়ো উঠলে তারও বিরোধিতা করা কর্তব্যের মধ্যে পড়বে। এমনকি, ‘বিহারি’ বা ‘খোট্টা’ সম্বোধনের মধ্যে যে ঘৃণ্য প্রাদেশিকতা ধরা পড়ে, সে আচরণেরও আমি নিন্দা করি। আমার বলার উদ্দেশ্য এই যে, যিনি হিন্দিভাষী, তিনি ভাষা-রাজনীতি না জানলেও, সংবিধান না পড়লেও, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় এটুকু বুঝে নিয়েছেন, এ ভূভারতে ভাষার দিক দিয়ে তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সে ভাষার সাংবিধানিক ক্ষমতাও অন্যান্য ভাষার চেয়ে বেশি। ফলে, দক্ষিণ ভারতের কিছু জায়গা আর উত্তর-পূর্ব ভারতের বড়ো অংশ বাদ দিয়ে মোটামুটি গোটা ভারতেই তাঁর হিন্দি বলাকে কেউ প্রশ্ন করার সাহস করবে না। খাতায়-কলমে অষ্টম তফসিলে ২২টি ভাষাকে সমান মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা যে আদৌ হয়নি, অন্য ভাষা-সম্পর্কে হিন্দিভাষীদের এ ধরনের উদাসীন মনোভাবই তার প্রমাণ।
দ্বিতীয় কারণটি প্রশাসনিক। বিশেষত, সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি তরফে যে ধরনের রাজনৈতিক হিন্দিভাষী-তোষণ শুরু হয়েছে, সেটা ছট পুজোয় দুদিন সরকারি ছুটি দেওয়াই হোক বা হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন, তাতে কলকাতা মেট্রোর মতো আক্রমণাত্মক ঘটনা বারবার ঘটতে থাকলেও আর অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেসব রাজ্যে এখনও বহু বাঙালি কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন, সেই বিহার, ঝাড়খণ্ড বা আন্দামানে দুর্গাপুজোয় পাঁচদিনের ছুটি তাঁদের কাছে সোনার পাথরবাটি। অসম বা ত্রিপুরায় তিনদিনের ছুটি এখনও দেওয়া হয়, তার কারণ, এই দুই রাজ্যের ভূমিসন্তানদেরও একটা বড়ো অংশ বাঙালি। বেশি খোঁজাখুঁজির প্রয়োজন নেই, সবকটি রাজ্যের সরকারি ওয়েবসাইটেই ছুটির তালিকা দেওয়া থাকে, যে-কেউ দেখে নিতে পারবেন।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের বড়ো পদগুলিতে হিন্দিভাষী কর্মীর সংখ্যা যে দিনকে দিন বাড়ছে, তার সঠিক তথ্যভাণ্ডার এখনও তৈরি হয়নি বটে, কিন্তু চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়। নিশ্চিতভাবেই, এর পিছনে সংঘ পরিবারের বৃহৎ পরিকল্পনা কাজ করছে। সংঘ পরিবার যে নিজেদের কায়েমি লক্ষ্যে স্থির থাকবে, এই একশো বছরের ইতিহাসে নিজেদের এই গুণটির প্রমাণ তারা বারবার দিয়েছে। কিন্তু, ঘোষিত বিজেপি-বিরোধী হিসেবে তৃণমূল সরকারের এই হিন্দি-তোষণ যে সংঘ পরিবারের অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণকে আরও সহজ করে দিচ্ছে, এবং দুই দলেরই ঘোষিত বিরোধী বাম-বৃত্তে এর বিরুদ্ধে কোনও জোরালো রাজনৈতিক প্রতিবাদ যে আসছে না, তাতেই বোঝা যায়, তামিলনাড়ু কেন পারে, আর আমরা কেন পারি না।
সচেতনভাবেই, ‘বাংলা পক্ষ’-এর প্রতিবাদী বক্তব্য এখানে বিবেচ্য নয়। প্রথমত, এটি কোনও রাজনৈতিক সংগঠন নয়। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের ঘটনাকে এড়িয়ে গিয়ে কেবল ভাষাগত আক্রমণকে ব্যাখ্যার চেষ্টা আসলে বাস্তবকে অস্বীকার করার প্রবণতা, এই সময়ে যার ফল হতে পারে মারাত্মক। এবং, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলা-রক্ষার নামে তাঁরা যা করে থাকেন, তা মৌলবাদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণটি সাংস্কৃতিক। দীর্ঘ সময় ধরে কেবল কলকাত্তাইয়া বাংলাকেই ‘মান্য বাংলা’ হিসেবে তুলে ধরার অসুস্থ অনুশীলন আমাদের আঞ্চলিক শক্তিকে নষ্ট করেছে, যা আসলে গোটা ভাষা-পরিকাঠামোকেই নড়বড়ে করে দিয়েছে। খুব নির্মম ভাষায় বলতে গেলে, ‘চ্যাটার্জি-ব্যানার্জির বাংলার পাশে সোরেন-মাহাতর বাংলা জায়গা পায়নি।’ পুরুল্যা-বাঁকুড়া তো তাও খানিক দূরের জেলা, গ্রামীণ হাওড়ার বাংলার সঙ্গেই শহুরে হাওড়ার বাংলার আলংকারিক পার্থক্য কানে বাজে। ভাষার বিবর্তনগত বা ব্যুৎপত্তিগত অনেক বৈশিষ্ট্যই আসলে ধরা থাকে এই উপভাষার আধারে। মাথামুণ্ডুহীন মেগা-সিরিয়ালে অনেক সময়ে উপভাষার নামে যেটা চালানো হয়, সেই আধসেদ্ধ খিচূড়ি ভাষাটা একটা বাণিজ্যিক ধ্যাষ্টামো ছাড়া কিছু নয়। আমরা, কলকাত্তাইয়া বাবুসমাজ, ‘খাব না’-র জায়গায় ‘খাবুনি’ শুনেই আঁতকে উঠেছি, আর সেই ছিদ্র দিয়ে মারকুট্টা ভঙ্গিতে দিব্যি ঢুকে পড়েছে ‘নেহি খায়ুঙ্গা’।
এর সঙ্গে তো ফুটনোট হিসেবে আসতে পারে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দৌর্বল্য, ব্যবসায়িক ভাষা হিসেবে বাংলার গুরুত্ব না-থাকা, এমন বেশ কিছু তর্কবিতর্ক।
ভরসা থাকুক
শেষ করি বছর তিনেক আগের এক অভিজ্ঞতা দিয়ে। কালীপুজো, থুড়ি দিওয়ালির আগে দিল্লি গিয়েছি। মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্রের কাজের সূত্রে দেখা করতে গেলাম এক অধ্যাপকের সঙ্গে, বিশেষ কারণে তাঁর নামটা উহ্য রাখছি। বিজেপি-আরএসএস-বিরোধিতায় তিনি বেশ পরিচিত মুখ, নিয়মিত পত্রপত্রিকায় লিখে থাকেন। ২০২০-র দিল্লি গণহত্যায় তাঁকেও ফাঁসিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। আমাদের সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, তখনও তিনি আত্মগোপন করে আছেন। বাঙালি শুনে মুখে ভরাট হাসি, সঙ্গে আমাদের চমকে দিয়ে নিজস্ব বাংলায় সাদর অভ্যর্থনা – “আসুন। আপনারা কলকাতা থেকে আসছেন?” তারপর, আমাদের জিজ্ঞাসু চোখ দেখে বললেন – “বাংলা অল্প অল্প জানি।” কীভাবে জানা হল? লাজুক উত্তর এল, ছোটোবেলা কেটেছিল দেওঘরে। দেওঘরে প্রচুর বাঙালি প্রতিবেশির বাড়ি, বাংলা শিখে নিতে অসুবিধা হয়নি।
এরপর, যতক্ষণ ছিলাম, গান্ধীকে নিয়েই বেশি কথা, কিছুটা কলকাতা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতায় হিন্দি সংস্কৃতি কতখানি সমৃদ্ধ ছিল, সে প্রসঙ্গও এল। আমাদের বাক্যালাপের বেশিরভাগটাই হল ইংরাজি ও বাংলায়। অনেকদিন পরে বাংলা বলতে পেরে চোখেমুখে তাঁর শিশুর মতো ঔজ্জ্বল্য। আশ্চর্যের বিষয়, দিল্লি শহরে বসে যা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল, সেই হিন্দিতে কথা আদৌ হয়েছিল বলে মনে পড়ে না।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, ভদ্রলোক স্বয়ং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি সাহিত্যের অধ্যাপক।
তথ্যসূত্র:
১. NDTV News Desk. “This is Not Bangladesh”: Bengali Passenger Confronted on Kolkata Metro For Speaking Native Tongue,” NDTV, published November 24, 2024.
২. সোহম দাস। “সত্তরের দশকেও হিন্দি-আধিপত্যে জর্জরিত ছিল কলকাতা, জানান দেয় ‘ধন্যি মেয়ে’র দৃশ্য,” প্রহর.ইন, প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর ২০১৯।
৩. Linguistic Imperialism - Robert Phillipson - Google Books
৪. Seraphin Kamdem. “Decolonizing Cameroon’s language policies: a critical assessment,” De Gruyter, published July 21, 2024.
৫. Geeta Pandey. “An ‘English goddess’ for India’s down-trodden,” BBC, published February 15, 2011.
৬. Ramchandra Guha. “Hindi Chauvinism,” The Hindu, published January 18, 2004.
৭. Anti-Hindi agitations of Tamil Nadu – Wikipedia, the free Encyclopedia
৮. Anonymous. “No Imposition of Hindi,” People’s Democracy, published September 22, 2019.
(এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ই-কাগজ ‘নাগরিক’-এ। শিরোনাম ছিল, ‘হিন্দি বনাম বাংলা: নিজের ভাষাকে কোণঠাসা করেছে বাঙালিও’। মূল লেখাটির সিংহভাগ অপরিবর্তিত রেখে, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করে বর্তমান লেখাটি তৈরি হল। - লেখক)