সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মাস খানেক আগে করণপুরা গ্রামের জাহির থানে বসে গ্রামের অবস্থা নিয়ে গল্প করছিলাম, সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার জয়রামজি আর ওনার পরিচিত গ্রামের জনা পাঁচেক মানুষ, বেশিরভাগই মধ্যবয়স্ক। করণপুরা ঝাড়খণ্ডের গিরিডি জেলায় কিউল নদীর উৎসের কাছে, চারিদিকে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা এই গ্রামে চল্লিশ ঘর মতো সাঁওতাল পরিবারের বাস। কথায় কথায় জানা গেল গ্রামের প্রায় সব পরিবারের কম বয়সি জওয়ান ছেলেই কাজের জন্য বাইরে যায়। ফেরে বর্ষায় ধান চাষের সময় আর শীতে ফসল কাটার সময়। মোট মাস চার পাঁচের জন্য। কৌতূহলে বসে থাকা সব থেকে কম বয়েসি ২৪-২৫ বছরের সুকেশ মারাণ্ডিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে কেন যায়নি? সে জানায় সাম্প্রতিক ওর বিয়ে হয়েছে তাই। কথায় কথায় বলে ওদের গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেই নাকি ব্যাঙ্গালোরের দিকে কাজ করে, ও সেখানে হোটেলে কাজ করে। আমি ভেবেছিলাম হয়ত হোটেলে ফাইফরমাশ খাটার কাজ করে, তবু জিজ্ঞাসা করি কি কাজ? সে গর্বের সঙ্গে জানায় সে রান্নার কাজ করে। জেনে অবাকই হয়েছিলাম যে ঝাড়খণ্ডের এক প্রান্তিক গ্রামের আদিবাসী ছেলে কিনা দক্ষিণ ভারতের এক আধুনিক শহরের মানুষের জন্য খাবার বানাচ্ছে, যে খাবার কিনা তাদের খাদ্যাভ্যাসের সংস্কৃতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, বুঝলাম সে শিখে নিয়েছে।
গত বছর শীতের শেষে বিহারের জামুইয়ের জঙ্গল ঘেরা কোড়া আদিবাসী গ্রামে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম তাদের এক বড় অংশ মুম্বাইতে কাজ করে, মূলত নির্মাণ শিল্পে। সেখানে ৩৫-৪০ বছরের বিধু কোড়া জানিয়েছিল সে রাজমিস্ত্রির কাজ করে দিন প্রতি হাজার থেকে বারো'শ টাকা পায়। পাশে বসা লছমন কোড়া বলেছিল, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে সে পায় দিন প্রতি পাঁচ'শ থেকে ছশো টাকা, দুজনেই বলেছিল মাসে তারা খুব বেশি হলে ২০ থেকে ২২ দিন কাজ পায়। ধান লাগানোর সময় আর কাটার সময় তারা গ্রামে ফিরে আসে। খরচ খরচা বাদ দিয়ে বছরে তারা বাড়ি নিয়ে আসে হাজার ষাটেক থেকে এক লাখ। জিজ্ঞাসা করেছিলাম গ্রামে কত টাকা পেলে তারা মুম্বাই যাবে না! বলেছিল ধানের আমদানির উপর তাদের খাওয়াটা হয়ে যায় কিন্তু সংসারের অন্যান্য খরচা বাবদ যদি তারা ষাট থেকে আশি হাজার টাকা পায় তাহলে তারা আর মুম্বাই যাবে না। শহরে থাকা খাওয়ার খুবই কষ্ট। উপায় নেই বলেই তাদের যেতে হয়।
গত কুড়ি বছরে পশ্চিমবাংলা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিম ওড়িশা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে লক্ষ করেছি যে গ্রামের পর গ্রামে কম বয়সি যুবকদের রোজগারের জন্য ঘর পরিবার গ্রাম ছেড়ে যাওয়া। কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ করে দেখেছি শুধু আদিবাসী প্রধান নয়, এই অস্থায়ী মাইগ্রেশন কম বেশি প্রায় সব গ্রামেই হচ্ছে। মাস তিনেক আগে দক্ষিণ ভারতের মহাবলীপুরম বেড়াতে গিয়েছিলাম, চেন্নাইয়ের কাছে ছোট পর্যটন কেন্দ্র। সেখানে এক বড় দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের দোকানে আলাপ হল মালদার গ্রাম থেকে আসা এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে। দোকানে বেয়ারার কাজ করে, একটু অবাক হয়েছিলাম। আমরা বাংলায় কথা বলছি দেখে সে অর্ডার নিতে এসে ভাব জমাল। কথায় কথায় বলেছিল ঐ দোকানে সে প্রায় পাঁচ বছরের বেশি কাজ করছে এবং ভালো আছে, রোজগারপাতি ভালোই; মাসে পনেরো হাজার টাকা মাইনে পায়, এর উপর আছে খদ্দেরদের টিপস। তার থাকা হোটেলেই এবং খাওয়া দাওয়া কার্যত রেস্টুরেন্টেই হয়ে যায়। মাঝে মাঝে অবশ্য তার বাড়ির জন্য খারাপ লাগে। বছরে দুবার ছুটি পায়। কিন্তু উপায় নেই, গ্রামে চাকরি কই, জমিও অল্প।
এর কিছুদিন পর আমরা জঙ্গল ঘেরা অন্ধ্রের ছোট মন্দির-শহর শ্রীশৈলমে দেখলাম আর এক বড় দক্ষিণের খাবারের দোকানে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামের জনা ছয়েক বিভিন্ন বয়সি ছেলে ও মানুষ, ম্যানেজার থেকে হোটেল বয়ের কাজ করছে। সেখানেও আমরা বাঙালি দেখে এরা আমাদের আলাদা খাতির করছিল। শ্রীশৈলমের কম বয়েসি বাঙালি ম্যানেজার ছেলেটি জানিয়েছিল, আগে সে মুম্বাইয়ের কোন রেস্টুরেন্ট চেনে কাজ করত, সেখানে কোন কারণে বনিবনা না হওয়ায় সে সেখানকার চাকরি ছেড়ে এই চাকরিতে যোগ দিয়েছে। আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এরকম প্রত্যন্ত জায়গায় চাকরির খবর পেলে কি করে? সে বলেছিল চেনা জানার মধ্যে থেকেই খবর এসে যায়। এবং বুঝতে পারি নিজেদের গ্রামের পরিচিতদের নিয়ে এলে সবারই সুবিধা তাই এই মাইগ্রেশনে একটা চেনা জানার নেটওয়ার্ক কাজ করে যা সহসা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
ফেরার পথে বিজয়ওয়াড়াতে ট্রেনের এসি কামরায় দেখা হল তিন জন বাইশ পঁচিশ বছরের যুবকের সঙ্গে, তারাও ছুটিতে মেদিনীপুরের গ্রামের বাড়ি ফিরছে। তাদের ট্রেনে তুলতে এসেছিল এক দক্ষিণ ভারতীয় বয়স্ক মানুষ, জল খাবার সব কিনে স্টেশন থেকে তুলে দিলেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম তাদের সুপারভাইজার, এরা হায়দ্রাবাদে কোন বড় গয়নার দোকানের কারিগর। সেখানে থেকে খড়গপুরের টিকিট পায়নি বলে এখান থেকে ট্রেন ধরছে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম; এদের মাইনে অনেক, গয়না শিল্পে বাঙালি কারিগরদের চাহিদা খুব বেশি, সুক্ষ্ম গয়নার কাজে নাকি এরা খুব দক্ষ। সুরাটেও শুনেছি অনেক বাঙালি কারিগর হীরা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এরা গ্রামের ছেলে হলেও পারিবারিক বা পরিচিত সূত্রে পরম্পরাগত এক দক্ষতা অর্জন করেছে এবং এখানেও সেই নেটওয়ার্ক কাজ করছে।
অন্যদিকে লক্ষ করেছি কলকাতার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে এমনকি দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের দোকানেও কার্যত অবাঙালি কাজের ছেলে বা বেয়ারাদের বেশিরভাগই বিহারি বা কিছু কিছু দক্ষিণ ভারতীয়। এদিকে কলকাতার টানা রিকশার সঙ্গে, ফুচকাওয়ালা, ইস্ত্রিওয়ালা, ট্যাক্সি ড্রাইভার, রেস্টুরেন্টে রান্নার কাজের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বিহার ওড়িশা থেকে আসেন। ভাবার মতো ব্যাপার যে এই অসংগঠিত শিল্প বা ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা প্রদেশের মানুষ দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে হাজির হচ্ছে। তাদের কারা কোথায় যাবে এটা বলা বেশ কঠিন কিন্তু এটা সত্যি যে বেশির ভাগ দক্ষ, অর্ধদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের দল গ্রাম থেকে ধারবাহিক ভাবে শহরে বা যেসব জায়গায় বড় পরিকাঠামো তৈরির কাজ চলছে সেখানে যাচ্ছেন। অন্যদিকে গ্রামে কম বয়সি মানুষের অভাবে চাষের কাজে বা অন্যান্য কায়িক শ্রমের প্রয়োজনে লোকের অভাব দেখা যাচ্ছে। মুর্শিদাবাদ থেকে কোডারমা, বোলাঙ্গির থেকে বিলাসপুর সব জায়গায় দেখছি গ্রামে পুকুর কাটার কাজে লোক নেই, কারণ বেশিরভাগ সময় যখন মাঠে চাষের কাজ হয় না তখন এই কাজ করা হয়। এবং এইসব কাজে ভীষণ ভাবে জেসিবির ব্যবহার হচ্ছে যাদের মালিক কোন ঠিকাদার।
ঝাড়খণ্ডের পাকুড়, দুমকা ইত্যাদি নানা জেলার যেসব আদিবাসী বহু দশক ধরে ধান রোপার সময় ও কাটার সময় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর ইত্যাদি জেলায় যায়। কিন্তু বর্তমানে দেশের সড়ক ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যমের পরিকাঠামোর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অদক্ষ মাইগ্র্যান্ট আদিবাসীদের কাজ ও গন্তব্য দ্রুত বদলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র রাস্তা তৈরির কাজে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের দেখা যাবে উত্তরে কাশ্মীর বা উত্তরপূর্বের নাগাল্যাণ্ড থেকে, দক্ষিণের কেরালা বা আন্দামান পর্যন্ত। এরা বেশিরভাগই কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মাইগ্র্যান্ট, কম দক্ষতার কায়িক কাজের শ্রমিক হিসাবে এদের প্রয়োজন হয়। মূলত শ্রমিক ঠিকাদাররাই এদের গ্রাম থেকে নিয়ে যায়। একবার পাকুড়ে পাহাড়ের উপরের এক পাহাড়িয়া গ্রামে শুনেছিলাম সেই গ্রামের বেশিরভাগ কিশোর আর যুবকরা কাজ করতে যায় মিরাট মুজাফফরনগরের চিনি কলে।
এনএসএসও-র ২০০৭-০৮এর ৬৪তম রাউন্ড রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ১.২৫ কোটি গ্রামের মানুষ সল্পমেয়াদি মাইগ্র্যান্ট যা সেই সময়ের মোট গ্রামীণ পরিবারের প্রায় ৬%। এই গ্রামীণ মাইগ্রেশনের হার প্রতি ১০০০ জনে ২৬১ জন, ১৯৮৩-তে এই সংখ্যা ছিল ২০৯ জন। এই রিপোর্ট অনুযায়ী এই অস্থায়ী গ্রামীণ মাইগ্রেশনে ২০.১% আদিবাসী, ২৩.৭% তপশীলী জাতির এবং ৩৯.৫% হচ্ছে ওবিসি1। অর্থাৎ গ্রামীণ মাইগ্রেশনে মূলত পিছিয়ে পড়া মানুষদের সংখ্যাই সব থেকে বেশি। বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতির প্রভূত পরিবর্তন হলেও সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে এই মাইগ্রেশনের প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়েবসাইটেও ২০০৭-০৮ এর পরিসংখ্যানই দেখানো আছে।
করোনার সময় সহসা লকডাউনে বোঝা গিয়েছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন গ্রাম থেকে এইসব অস্থায়ী মাইগ্রেশন করা মানুষের সংখ্যা কত বিশাল এবং কি ভয়ঙ্কর অবস্থায় তারা বিভিন্ন শহরে, কর্মস্থলে কাজ করে। কেবল ঝাড়খণ্ডেই ২০২০-র মার্চ থেকে অক্টোবরে ১০ লক্ষ শ্রমিক ঘরে ফেরেন। গিরিডি, পালামৌ, গারওয়া, কোডারমা, হাজারিবাগ, গোড্ডার মতো পিছিয়ে পড়া জেলাগুলিতে সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ ফিরে আসেন। সেই সময় এইসব অস্থায়ী মাইগ্রেশনের মানুষদের ফিরিয়ে আনার কাজে অল্প জড়িয়ে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম পাকুড়ের আদিবাসী রমণীর দল নাগাল্যাণ্ডে রাস্তা বানাতে গিয়ে আটকে পড়ছে। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের যুবক কেরলে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে, দ্রুত ফেরার বাধ্যতায় আটকে পড়ছে উত্তর কর্ণাটকে। আবার ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও ওড়িশার আদিবাসী গ্রামে লক্ষ করেছি কাজের অভাবে এইসব অঞ্চলের মানুষদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কায়িক শ্রমিক হিসাবে যেতে। তাদের অনেকেই ফিরেও আসে না, আর সরকারি কোন হিসাব বা তথ্য তো নেইই যা করোনা কালে পরিষ্কার দেখা যায়।
২
ঝাড়খণ্ডের বেশিরভাগ গ্রাম সংলগ্ন সব বৈধ অবৈধ পাথর, কয়লা বা খনিজের খাদানে আদিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। সরকারি বা বেসরকারি সংগঠিত খনিতে উচ্চপদে উচ্চশিক্ষিত বাঙালি বা অন্য প্রদেশের শহরের ছেলে দেখা গেলেও উচ্চ শিক্ষিত, ইঞ্জিনিয়ার আদিবাসী মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এতদসত্ত্বেও এইসব খনিতে শ্রমিক আইন মেনে শ্রমিকরা পারিশ্রমিক ও অন্যান্য সুবিধা পেতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, তামা বা কয়লার মতো বড় বড় সংগঠিত খনিতে অতি উৎপাদনশীল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এইসব খনিতে কায়িক শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ায় আদিবাসীরা নিজের রাজ্যেই সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ হারিয়েছে। অনেকে পুরানো বন্ধ হয়ে যাওয়া বা অবৈধ খনি থেকে বিপদজনক ভাবে কয়লা বা অন্য খনিজ বার করে এবং এই কাজে প্রায়শই প্রাণ হারায়। এছাড়া ঝাড়খণ্ড থেকে নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিত, অদক্ষ শ্রমিকদের বড় অংশ এখন অস্থায়ী মাইগ্রেশন করে শহরে কাজের আশায়। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৭ সালের অর্থনৈতিক সার্ভেতে বলা হয়েছে কেবল ঝাড়খণ্ড থেকে ৫০ লক্ষ শ্রমিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজে যায়।
এ ছাড়া কালো অর্থনীতির জগতে এইসব মানুষদের হারিয়ে যাওয়া চোখে পড়ার মতো। ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী অঞ্চল থেকে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা খুবই সাধারণ ঘটনা। গিরিডির তিসরিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া অভ্রের খনি অঞ্চলের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তখন তারা জড়িত ছিল সরকারের Child Line-এর সঙ্গে শিশু এবং নারী পাচার আটকানোর কাজে। নারী বিশেষ করে আদিবাসী কিশোরী মেয়েদের ও শিশুদের পাচার আটকানোর নানা কথা বলছিল। বলেছিল প্রতি মাসে গড়ে আট থেকে দশ জন কিশোরী বা শিশু পাচারের ঘটনা তাদের সামনে আসে। দুঃখ করছিল যে এর সঙ্গে জড়িত থাকে অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি কিন্তু একবার পুলিশের কাছে কেস চলে গেলে সব চাপা পড়ে যায়।
পশ্চিম ওড়িশার বড়গড় জেলার পাইকামালে তার অফিসে বসে বিরিঞ্চি ভাই বলছিলেন সেই অঞ্চলের বন্ডেড শ্রমিকদের কথা। অন্ধ্রের ইটভাটায় এই অঞ্চলের আদিবাসী ও তপশীলী জাতের মানুষদের বন্ডেড লেবার হিসাবে কি ভয়ানক অত্যাচার করা হয়। একবার এরকম ১৮ জন বন্ডেড লেবারের খবর পেয়ে অন্ধ্রের বিজয়নগরমের এক গ্রাম থেকে তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে দেখেন সেখানে প্রায় ১৩২ জন গরীব পশ্চিম ওড়িশার আদিবাসী ও দলিত মানুষ বন্ডেড লেবার বন্দীর জীবন যাপন করছিল। পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্যে তাদের মুক্ত ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও দেশের প্রান্তিক গ্রামের মানুষের দারিদ্রের সুযোগ নিতে দেশ বিদেশের অঙ্গ পাচার চক্র বিশেষ করে কিডনি পাচার চক্রও অতি সক্রিয়। এই বছরই কেরালায় এই রকম বিদেশি অঙ্গ পাচার চক্র ধরা পড়ে যারা ঋণে জর্জরিত যুবকদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে পয়সার বিনিময়ে কিডনি বিক্রির ব্যবস্থা করত2। দেশের বহু কর্পোরেট হাসপাতালে এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন চক্র লুকিয়ে কাজ করে চলেছে।
কলকাতায় কিছুদিন আগেই কথা হচ্ছিল এক বন্ধুর সঙ্গে, সে দুঃখ করছিল যে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কোন ভবিষ্যৎ নেই, সাম্প্রতিক তার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে ব্যাঙ্গালোরে কাজ পেয়েছে। আগে কাজ করত গাজিয়াবাদে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেরকম কোন কাজের সুযোগ নেই। লক্ষ করেছি আমার আত্মীয় পরিজন ও বন্ধু বান্ধবদের উচ্চশিক্ষিত, ইঞ্জিনিয়ার, ছেলেমেয়েদের অনেকেই ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, গুরুগ্রাম, গাজিয়াবাদ, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি দেশের নানা শহরে, তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও নানা কর্মসূত্রে প্রতিষ্ঠিত (বিদেশের কথা না হয় এখানে আর আনলাম না)। কিন্তু শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ থেকেই তো যাচ্ছে না, কলকাতার বিভিন্ন আধুনিক শপিং মলে, দামী রেস্টুরেন্টে এখন অবাঙ্গালিদের সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো। আমার বাড়ির কাছে অনেকগুলি বড় বেসরকারি হাসপাতাল আছে, যেতে আসতে লক্ষ করেছি সেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবায় বিশেষ করে নার্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের বড় অংশ দক্ষিণ ভারত ও উত্তরপূর্বের রাজ্য থেকে আসেন। এখন বাঙালি মহিলাদের সংখ্যাও বাড়ছে বলে মনে হয়।
পেটের দায় বড় দায়, কিন্তু সব মাইগ্রেশনই কি পেটের দায় নাকি তার থেকেও বেশী কিছু? মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বা দিনমজুর মানুষ সম্পন্ন জীবন ও জীবিকার আশায় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু সব যাওয়াই একই রকম নয়, আমার বন্ধুর ছেলের মতো উচ্চবর্ণের মধ্যবিত্ত পরিবারের লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েরা সংগঠিত শিল্প, বড় প্রতিষ্ঠান বা গবেষণার কারণে দেশান্তরে যাচ্ছে, এদের বড় অংশই শহরের ছেলেমেয়ে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের বড় অংশই তাই দেশের যেসব জায়গায় সংগঠিত বড় বড় কল কারখানা বা তথ্য প্রযুক্তির মতো পরিষেবার কেন্দ্র গড়ে উঠেছে সেইসব জায়গায় চলে যাচ্ছে। তাই বাংলায় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার এখানে বড় সংগঠিত শিল্পের অভাব বোধ করে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে রাজনৈতিক মঞ্চে যখন বেকার শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের পশ্চিমবঙ্গে সংগঠিত ক্ষত্রে কাজের অভাব নিয়ে নিয়ে প্রভূত আলোচনা হয় অথচ অসংগঠিত কাজের ক্ষেত্রে গ্রামীণ অস্থায়ী শ্রমিকের মাইগ্রেশনের সংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু তাদের নিয়ে সাধারণ জনমানসে শিক্ষিত মহলে বা সংবাদ মাধ্যমে খুব একটা চিন্তা ভাবনা দেখা যায় না।
এনএসএসও-র তথ্য অনুযায়ী কর্মক্ষমদের তিন ধরনের কর্ম সংস্থানের কথা বলা হয়েছে ১) স্ব-নিযুক্ত, ২) নৈমিত্তিক শ্রম, ৩) নিয়মিত বেতনের কাজ। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিতদের মধ্যে নিয়মিত বেতনভুক কম দেখা যায় এদের বেশিরভাগই দেখা যায় নৈমিত্তিক শ্রমিক হিসাবে বা ছোট খাটো স্বনিযুক্ত কর্ম সংস্থানের সঙ্গে জড়িত3। কাজের খোঁজে ঘুরতে থাকা এই বিভিন্ন মানুষদের গন্তব্য ও কাজের প্রকৃতি থেকে এটা দেখা যায় প্রাথমিক ভাবে শিক্ষা ও দক্ষতার উপর কাজ, রোজগারের পরিমাণ ও গন্তব্য নির্ভর করে। আর গন্তব্য নির্ধারিত হয় বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন জায়গার অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর ও স্থানান্তরে যাওয়া মানুষদের উৎসস্থলের সাথে কর্মক্ষেত্রের যোগাযোগের উপর। যেখানে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ থেকে মূলত অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত অদক্ষ বা অর্ধ দক্ষ শ্রমিকদের প্রাধান্য দেখা যায়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত, দক্ষ, অর্ধ দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিক সবই দেখা যায়। কিন্তু দক্ষিণের রাজ্য থেকে মূলত শিক্ষিত দক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সঙ্গে যেহেতু কর্মসংস্থান এবং বর্তমান বাজার অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার অবস্থানের নিকট যোগাযোগ আছে কাজেই শ্রমিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা জড়িয়ে আছে তারা কাজের জন্য তাদের গন্তব্য কোথায় হবে। কাজেই রাজ্যগুলির শিক্ষা ব্যবস্থার পরিমাণ ও গুণগত মানের উপর সেই প্রদেশের বেশিরভাগ কর্মক্ষম মানুষের কি ধরনের কাজ হবে তা নির্ভর করে।
যেমন বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের স্কুল শিক্ষার অবস্থা ভয়ানক, কাজেই এই জায়গার গ্রাম থেকে অর্ধদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমনির্ভর মানুষজন নির্মাণ শিল্পে বা রাস্তা তৈরির মতো বড় পরিকাঠামো যেসব জায়গায় হচ্ছে সেদিকে যাচ্ছে বা রাজমিস্ত্রি, জোগাড়ে, কাঠের কাজের মানুষ, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান হিসাবে নির্মাণ শিল্পে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলার শহরাঞ্চলে শিক্ষার মান বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার মান তুলনামূলক ভালো হওয়ায় কলকাতা, দুর্গাপুর, আসানসোল, শিলিগুড়ির শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, ম্যানেজমেন্ট পাশ ছেলেমেয়েদের বড় অংশ সংগঠিত ক্ষেত্রে ভাল মাইনের কাজের জন্য মুম্বাই, দিল্লী, গাজিয়াবাদ, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, বাঙ্গালোর যাচ্ছে। কিন্তু গ্রামে ও মফফসলে শিক্ষার মান অত্যন্ত কম হওয়ার কারণে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়ার গ্রামের ছেলেরা তাদের পরম্পরাগত বৃত্তিমূলক কাজের দক্ষতা ও ইস্কুল শিক্ষার যোগ্যতা অনুযায়ী হোটেলে, সোনার গয়নার কাজে, জরির কাজে, রাজমিস্ত্রির কাজে বা কাঠের মিস্ত্রি বা কেবলমাত্র কায়িক শ্রমিক হিসাবে কেরালা থেকে কাশ্মীর চলে যাচ্ছে। অল্প শিক্ষিত কিন্তু ভালো পরম্পরাগত বৃত্তিমূলক কাজে দক্ষ বাঙ্গালি শ্রমিকদের চাহিদা দেশের নানা প্রদেশে এবং মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশগুলোতেও যথেষ্ট। লোকসভায় ২০২৩ সালে সরকার জানায় পৃথিবীর নানা দেশে প্রায় ১.৫ কোটি দক্ষ, অর্ধ দক্ষ ও অদক্ষ ভারতীয় শ্রমিক কাজ করছে। এদের মধ্যে ১৮টি Emigration Check Required (ECR) দেশের বাইরে যাওয়া কম শিক্ষিত শ্রমিকদের তথ্য রাখে এবং সব থেকে বেশি ECR শ্রমিক গেছে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের গ্রামীণ অঞ্চল থেকে4।
বর্তমান সময়ের উন্নত যোগাযোগ এবং পরিবহণ ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষের এই সল্পমেয়াদী মাইগ্রেশন বহুগুণ বেড়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকা থেকে এই অস্থায়ী অভিবাসনে গ্রামের একদম দুর্বল মানুষ (শারীরিকভাবে অক্ষম, বৃদ্ধ ও অসুস্থ) এবং সব থেকে ধনী পরিবার ছাড়া বাকি সব ধরনের মানুষই এই মাইগ্রেশনে জড়িত। এইসব প্রত্যন্ত গ্রামে যাদের অল্প সম্পদ আছে, অল্প পড়াশোনা জানে বা সামাজিক যোগাযোগ ভালো সেইসব পরিবারে স্বল্পস্থায়ী মাইগ্রেশন বেঁচে থাকার একটা রাস্তা, এতে তাদের খরচের জন্য রোজগার এবং ঋণ শোধ করার ক্ষমতা বাড়ে। যে সব মানুষের দক্ষতা আছে, ভালো সামাজিক সংযোগ ও সম্পদ আছে তাদের ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের পথ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বেড়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা দারিদ্রের কবল থেকে বেরিয়ে আসে5।
বছর দশ আগে হাজারিবাগ অঞ্চলের তিলাইয়া জলাধারের পাশে বারহি অঞ্চলের কিছু গ্রামে দেখেছিলাম অনেক পাকা দোতলা বাড়ি, চার চাকার গাড়ি ও ট্রাকটার, জেনেছিলাম তখন এই অঞ্চল থেকে প্রচুর ছেলে ভারী যানবাহন যেমন বড় বড় ট্রেলার, এক্সকেভেটার, বুলডোজার ইত্যাদি চালানোয় দক্ষ বেশিরভাগই মহারাষ্ট্র, গুজরাটে কাজ করে। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে এটা বলা খুব অসুবিধা যে অস্থায়ী অভিবাসনের থেকে রোজগারের টাকা সঞ্চয় মূলত কিসে ব্যবহার হয়। এই রোজগারের সঞ্চয় কখনো ধার শোধ করতে, কখনো বিয়ের নতো পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য আবার কখনো জমি কিনতে বা বাড়ি সারানোর জন্য, জমিতে সেচের ব্যবস্থার জন্য, রোগের চিকিৎসার জন্য বা দৈনন্দিন খাওয়া পরার উন্নতির জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে6।
৩
বর্তমানে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ গ্রাম ২০০০ সালের পর থেকে সরকারি রাস্তার দ্বারা কাছের বড় শহরের সাথে যুক্ত এবং বেশিরভাগ গ্রামই মোবাইল পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। কাজেই শহরে তৈরি ভোগ্যপণ্য সহজেই গ্রামের গৃহস্থালিতে পৌঁছে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ডের বেশিরভাগ প্রান্তিক আদিবাসী গ্রামেই স্নানের পুকুরের বা ঝর্নার পাশে প্রচুর সস্তা শ্যাম্পু, কাপড় কাচার সাবান বা গায়ে মাখার সাবানের প্লাস্টিকের প্যাকেট ছড়িয়ে থাকতে দেখেছি। এছাড়া আলুর চিপস বা কুড়কুড়ের প্যাকেটের তো কথাই নেই। কিন্তু এই যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যত সহজে গ্রামে ভোগ্যপণ্য পৌঁছায় তত সহজে শিক্ষা আর স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছায় না। ২০২৩ সালের এক সার্ভেতে দেখা যাচ্ছে যে আরারিয়া ও কাটিহারের ৮১টি সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুলের কোন স্কুলই সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার আইনের নিয়ম মেনে চলে না। ছাত্রদের স্কুলে উপস্থিতি অসম্ভব রকমের কম, গড়পড়তা ছাত্র উপস্থিতি ২০% মাত্র। এইসব স্কুলে শিক্ষকের অভাব সাংঘাতিক। ৩৫% শতাংশ প্রাথমিক স্কুলে এবং মাত্র ৫% শতাংশ উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক ছাত্র অনুপাত সরকারি আইন মেনে রয়েছে, সেটা প্রতি ৩০ জন ছাত্রে ১ জন শিক্ষক। এমনকি ৯ শতাংশ স্কুল চলে কোন স্কুল বাড়ি ছাড়াই7। ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেও শিক্ষার মান অত্যন্ত খারাপ। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই অশিক্ষিত, অদক্ষ শ্রমিক দল এইসব জায়গা থেকে কাজের খোঁজে ঐ পরিবহণ ব্যবস্থা আর মোবাইলের দৌলতে পৌঁছে যাচ্ছে সস্তার শ্রমিক হিসাবে দেশের নানা অঞ্চলে। তাদের পাঠানো টাকার একটা বড় অংশ চলে যায় শহর থেকে আসা শ্যাম্পু, সাবান, চিপস, বোতলের ঠাণ্ডা পানীয়, কুড়কুড়ে ইত্যাদি ভোগ্যপণ্য কিনতে। একদিকে গ্রাম থেকে সুস্থ সবল মানুষরা রোজগারের জন্য গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র যাচ্ছে অন্যদিকে ভারতবর্ষে শস্যশ্যামল গ্রাম ক্রমশ ঊষর হয়ে পড়ছে।
পাকুড়ের আমড়াপাড়ার মতো জায়গায় কম বয়েসি যুবকদের দামি মোটর সাইকেল চড়তে দেখে একবার আমার কম বয়েসি এক সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এক একটা মোটর সাইকেলের তো আশি হাজার থেকে দু লাখ টাকা। এই সব ছেলেদের পরিবারের কেনার সামর্থ্য আছে? সে আমার কথা শুনে হেসেছিল, বলেছিল এত টাকার প্রয়োজন নেই সবাই তো কেনে ইএমআইতে। আমি ভাবলাম সেটাই তো স্বাভাবিক তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু এখানে মাসে মাসে এতো ইএমআই দেবার মতো রোজগার করে ছেলেরা? সে হেসে আমাকে বোঝাল যে ব্যাঙ্কের মোটর সাইকেলের লোনের টার্গেট মেটাতে এইসব ছেলেদের ধরা হয় মোটর বাইক কেনার জন্য, অনেকেরই সামর্থ্য নেই কিন্তু নতুন ঝকঝকে মোটর সাইকেলের লোভ আছে, তারা বাবা মাকে কোন রকমে রাজি করিয়ে সহজ ধারে কিনে নেয়।
অনেকেরই ধার মেটাতে পারে না, কিছুদিন নতুন মোটরবাইক চাপে। যদি কেউ বাবা মাকে বলে বা অন্য কোন উপায়ে দু একটা ইএমআই-এর কিস্তি মেটাতে পারে তাহলে তারা বেশি দিন চড়ে। তারপর যখন কিস্তি মেটাতে পারে না ব্যাঙ্ক চিঠি পাঠায় তারপর মোটর সাইকেল বাজেয়াপ্ত করে। আমি বললাম তাহলে তো অনেক মোটর সাইকেল বাজেয়াপ্ত হয় সেগুলোর কি হয়। ও হেসে বলেছিল তার আলাদা দোকান আছে, ব্যাঙ্ক সেখানে বিক্রি করে কিছুটা টাকা ফেরত পায়। আমি বললাম তারপর? ও বলল ঐ ছেলে অন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে আর একটা মোটর সাইকেল কিনে আবার চাপে। আমি ভেবে দেখলাম সত্যি তো লোনের টার্গেট মেটানোর জন্য তো কিছু লোক দিনরাত এক করে দৌড়াচ্ছে আর দেশে ব্যাঙ্কের অভাবও নেই। জানি না এই অদ্ভুত চক্র কখন শেষ হবে, তবে বুঝেছিলাম এই সহজ টাকার জোগান অনেক মানুষকে তাদের সাধ্যাতীত জিনিসের প্রতি লোভের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অন্যদিকে এটা দেখেছি ছোটচাষি, গরীব মানুষ ঠেলাওলা বা ছোট দোকানদার ৪০-৫০ হাজার টাকা পেলে চাষ বা ব্যবসা বড় করে করতে পারে। কিন্তু এদের ব্যাঙ্ক লোন পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ৪০ হাজার টাকা ঋণ পেতে তাকে যত কাগজপত্র দেখাতে হবে সে জোগাড় করার সামর্থ্য তার নেই তার উপর আজকাল সব অনলাইন। অনলাইনে ব্যাঙ্কের অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করে ঋণ নেওয়ার মতো ক্ষমতা বা শিক্ষা কোনটাই এদের অনেকেরই নেই। আর ব্যাঙ্কে এই সব ঋণের বোধ হয় কমিশন আর টার্গেট দুটোই কম। কাজেই কেউ এই ঋণ দেবার জন্য এইসব দিন আনি দিন খাই মানুষদের ধরে না। গ্রামের দিকে এই ঋণ দেওয়ার পরিমাণ আরো কম। এই ঋণে লাভ কম জেনে সাম্প্রতিক বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি MSME ঋণের সম্ভাব্য চাপের বিষয়ে উদ্বেগ উল্লেখ করে মুদ্রা ঋণের সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জন্য জোর দিচ্ছে। যদিও সরকারি ডেটা মুদ্রা ঋণ বিভাগে কম এনপিএ দেখায়8। তারা যদিও কারণ দেখায় যে ভবিষ্যতে এনপিএ MSME ঋণে বেড়ে যাবে।
৪
আমরা যদি দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখব আমেরিকার নিউইয়র্কের কোর্টে গৌতম আদানি ও তার ভাইপো সাগর আদানি সহ আদানি কোম্পানির আরো ছয় জন উচ্চ আধিকারিক অভিযুক্ত হয়েছে ভারতের সরকারি আধিকারিকদের ২০২৯ কোটি টাকা ঘুষ দেবার দায়ে। আর বছরের প্রথমে দেশের এক নম্বর ধনী ব্যাক্তি মুকেশ আম্বানি তার ছেলের বিয়েতে ৫০০০ কোটি টাকা খরচ করে বিশ্বের এপর্যন্ত সবথেকে ব্যয়বহুল বিয়ের রেকর্ড করলেন। বছরের প্রথম ছয় মাস ধরে চলা এই বিয়েতে শুধু ভারতবর্ষ নয় সারা বিশ্বের তাবড় তাবড় মানুষ উপস্থিত ছিল। কংগ্রেসের গান্ধী পরিবার ছাড়া ভারতের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতি দেখার মতো ছিল। কর্পোরেট চালিত সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে এই বিয়ের অনুষ্ঠান বড় করে দেখানো হলেও একবারের জন্যও দেখানো হল না যে এই ছয় মাসেই কেবল মহারাষ্ট্রে ৫৫০এর বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। হিন্দু পত্রিকার মতে এই আত্মহত্যার অন্যতম মূল কারণ না শোধ করতে পারা ঋণের বোঝা9। বিগত দশ বছরে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৪.৫৬ লাখ কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছে যার মধ্যে বড় ব্যবসার বা শিল্পের ঋণ মকুব হয়েছে ৭.৪১ লাখ কোটি টাকা10।
আর হয়ত বর্তমান সময়ে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা, এই মুহূর্তে ভারতের গরীব ও ধনীর মধ্যে আয়ের বৈষম্য ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেও খারাপ। এই বছরের বৈশ্বিক ধনী তালিকা অনুসারে, ভারতে বর্তমান মোট বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ২৭১ এবং এই তালিকায় শুধুমাত্র ২০২৩ সালে ৯৪ জন নতুন বিলিয়নেয়ার যুক্ত হয়েছে। এই নতুন সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত অন্য যেকোন দেশের তুলনায় বেশি। এই দেশীয় বিলিয়নেয়ারদের সমষ্টিগত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বিশ্বের মোট সম্পদের ৭ শতাংশ11। ভারতবর্ষে ১৯৮১ সালে ১% সব থেকে ধনীর হাতে ছিল দেশের ১২.৫% সম্পদ, ২০২২-এ সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪০%। অন্যদিকে ১৯৮১ সালে দেশের সম্পদে নিচের ৫০% মানুষের ভাগ ছিল ১১% সেটা কমে ২০২২ সালে হয়েছে ৬.৪%12। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্থম্ভ সংবাদ মাধ্যম এখন কেবল ব্যবসা বা বৃহৎ পুঁজির হাতে প্রচার মাধ্যমের যন্ত্রমাত্র।
এদিকে প্রবল গরমের পর বর্ষাতে মুম্বাই, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উত্তরবঙ্গে ও আসামে বন্যার প্রকোপে বড় সংখ্যার মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, প্রবল বর্ষণে উত্তারাখণ্ড, সিকিম, কেরালায় বিশাল ভূমিধ্বসে জনজীবন বিপর্যস্ত। এরই সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্নীতি, বিহারে ১২টা নদীর ব্রিজ ভেঙ্গে পড়েছে, ছয় মাস আগে অযোধ্যায় তৈরি রেলস্টেশন, রামপথ নামের আধুনিক রাজপথ ভীষণ ক্ষতিগস্ত, দিল্লী সহ নানান বিমান বন্দরের ছাদের অংশ ভেঙে পড়েছে, এছাড়াও আরো অগণিত না জানা সরকারি পরিকাঠামোর অবস্থা। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। অন্যদিকে ভারতবর্ষের বিশাল অংশে বর্ষার অভাবে খরার সূচনা হয়েছে।
এই মুহূর্তে আমাদের দেশের বিভিন্ন অংশে ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতিমধ্যে ভারতকে সাবধান করেছে এই জলের ব্যবহার কমানোর জন্য13। শহরাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে শব্দ ও বায়ু দূষণের মাত্রা মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৩-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ু দূষণে ভারত বিশ্বের সব থেকে দূষিত দেশের অন্যতম। প্রতিদিন দেশের ৯৬% মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত বায়ু দূষণের নির্ধারিত মাত্রার থেকে সাত গুণ বেশী দূষিত বায়ু গ্রহণ করে থাকে14। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই গভীর জল সঙ্কটে অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন কিন্তু বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ সকলে জানে তাতে সরকার ও মানুষের টনক নড়বে না তাই তারা বলছে ভূগর্ভস্থ জলের অতি নিষ্কাশনে দেশের জিডিপি কমবে। এতে নাকি দেশের গণতান্ত্রিক সরকার ভয় পাবে, জলের ব্যবহার নিয়ে দেশের নীতি পরিবর্তিত হলেও হতে পারে।
অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের সীমাহীন ব্যবহারে দেশজুড়ে বর্জ্য পদার্থের পাহাড় জমছে, সমুদ্র থেকে আরম্ভ করে নদী নালা হ্রদ জলাশয় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক, জৈবিক ও অন্যান্য দূষণে অতি দূষিত হয়ে পড়ছে। বর্তমান বাজার নির্ভর আধুনিক উদার অর্থনীতির কল্যাণে ভারতবর্ষের সবুজ অরণ্য, সুউচ্চ পর্বতমালা, প্রাণদায়ী নদী, ভূগর্ভস্থ জল সম্পদ, উর্বর জমি, নানাবিধ জীববৈচিত্র্য সব আজ ধ্বংসের মুখে, এরই সঙ্গে অগণিত জল জঙ্গল মাটির উপর নির্ভরশীল গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন।
আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন সংস্থার (International Organization for Migration) সংজ্ঞা অনুযায়ী জলবায়ু মাইগ্রেশন হচ্ছে মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য পরিবেশের হঠাৎ দ্রুত পরিবর্তনের কারণে স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে তার বাসভূমি ত্যাগ করে15। গ্রাম থেকে শহরে যে অস্থায়ী মাইগ্রেশন আমরা লক্ষ করছি তার একটা বড় অংশই এই জলবায়ু মাইগ্রেশন। কিউল নদীর উৎসস্থল অঞ্চলে লক্ষ করেছি যে বিগত ৫০ বছরে সেখানকার ৪০% জঙ্গল সাফ হয়ে গেছে এবং দ্রুত বাকি জঙ্গল শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে ঘোরার সময় দেখেছি ভয়ানক রকমের ভূমিক্ষয়ে নষ্ট হয়ে পড়েছে উর্বর জমি, জায়গায় জায়গায় নিচের শক্ত পাথরের চাটান বেরিয়ে এসেছে। করণপুরা গ্রামের যুবকদের মতো এই অঞ্চলের প্রায় ৭১টা গ্রামেই যুবকরা এই মাইগ্রেশন করে।
সাম্প্রতিক রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে মানুষের বিভিন্ন কাজের পরিণামে পৃথিবীর প্রায় ৪০% জমির উর্বরা শক্তি কমে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী জমির এই ক্ষতির ফলে সব থেকে বেশি ধাক্কা খাবে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। আধুনিক কৃষি পদ্ধতি এবং বিশ্বের খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিশ্বের ৮০% জঙ্গল ধ্বংসের, ৭০% মিষ্টি জলের অতি ব্যবহারের, বাতাসে ২৯% গ্রিনহাউস গ্যাস ছাড়ার এবং বিশ্বজুড়ে ভয়ঙ্কর জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মূল কারণ16। বর্তমান সময়ে সমগ্র বিশ্বে জমির মানের পতন, মরুকরণ, খরার কারণে বিশ্বের কৃষিজাত খাদ্য ব্যবস্থা বড় ধরনে ব্যাহত হতে চলেছে। ভারতবর্ষের প্রায় ৩২% জমির মানের অবনমন হয়েছে এবং প্রায় ২৫% জমির মরুকরণ শুরু হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের বিশাল কৃষিজমির পরিমাণ, ভৌগলিক ও ইকোসিস্টেমের বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও ভূমিক্ষয় ও উর্বরা শক্তি হ্রাসের কারণে দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। জমির অবনমন সরাসরি মাটির স্বাস্থ্য, জলের মান ও প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করে যা কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করে। জঙ্গলের ধ্বংস, অত্যধিক পশুচারণ, স্বল্পস্থায়ী কৃষি পদ্ধতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ চাষি বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ও মহিলা চাষির জীবনকে বিপন্ন করবে17 এবং তারই পরিণামে হয়ত গ্রাম থেকে শহরে প্রান্তিক মানুষের মাইগ্রেশন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
সাল ২০১৫ নাগাদ একবার ঝাড়খণ্ডের সীমানায় অবস্থিত আদিবাসী গ্রাম আমলাশোলের স্কুলে বসে কথা হচ্ছিল লক্ষ্মী মুড়ার সাথে। আমরা যখন কথা বলছি তখন আমলাশোল ২০০৪-এর শবর অনাহার মৃত্যুর সময় থেকে অনেকটা পেরিয়ে এসেছে। যদিও তা আমার মতো শহরের মানুষের দৃষ্টিতে। আপেক্ষিক উন্নতির নিরিখে সমস্ত দিক থেকেই আমলাশোল এক অতি পিছিয়ে পড়া আদিবাসী গ্রাম। লক্ষ্মী তখন নিয়মিত কোলকাতা, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর যাতায়াত করে। আমার ধারণা হয়েছিল সে এই তফাৎটা অন্যদের থেকে বেশি বুঝবে। তাই গল্প করতে করতে তাকে জিজ্ঞাসা কারেছিলাম আমলাশোল গ্রামের কি এতো বছরে কোন উন্নতি হয়েছে? আমাকে অবাক করে তার উত্তরে লক্ষ্মী হাসি মুখে বলেছিল আমলাশোল অনেক উন্নতি করেছে। আমি বলেছিলাম কিন্তু উন্নতি কই? সে বলেছিল এখন গ্রামের সব মানুষ দুবেলা খেতে পায়, শুধু খেতে পায় না ভাত খেতে পায়, সে জোর দিয়েছিল ‘ভাত খেতে’ পাওয়ার উপর। বলেছিল সব পাড়াতেই পানীয় জল পাওয়া যায় যা আগে পাওয়া যেত না। পাড়ায় টিউবকল বসেছে, গ্রামের রাস্তা অনেক ভালো হয়েছে, গ্রামের অনেকে মোটরসাইকেলও কিনেছে। ও বলেছিল আগে গ্রামে লোকে এক বেলা খেত, দুবেলা ভাত খেতে পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। কলের জল, মোটরসাইকেল ছিল আমলাশোলের মানুষের কাছে স্বপ্ন।
সেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল পাকুড়ে। একই উত্তর দিয়েছিল ২০১৯ নাগাদ আমড়াপাড়ার সুভাষিণী সোরেন, তাকে চিনতাম ২০০৪ সাল থেকে। রাজমহল পাহাড়ের উপর পাহাড়িয়া গ্রাম থেকে ফেরার পথে সেও বলেছিল দাদা আগে এই সব গ্রামে সব বাড়িতে দুবেলা খেতে পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যপার, এখন কোন বাড়িতে কেউ না খেয়ে থাকে না। এখন অনেক বাড়িতেই মোটর সাইকেল আছে আমলাশোলের মতো। সব গ্রামেই রাস্তা আছে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি ও কলের জলও এসে গেছে। যদিও এই সব কলের জল আসছে মাটির নিচের জলকে সৌরশক্তির বলে পাম্পের মাধ্যমে। যদিও শহরের তুলনায় অভাব অনেক কিন্তু আগের তুলনায় আমড়াপাড়ার আশেপাশের গ্রামের মানুষের অবস্থা অনেক ভালো। রেশন ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের নানা সাহায্য গ্রামের লোকেরা অল্প বিস্তর পেয়েই থাকে, এর সঙ্গে ১০০ দিনের কাজের অল্প যোগও আছে।
সত্যি করেই বেশিরভাগ গ্রামেই শহর থেকে পাঠানো রেশনের দৌলতে ও গ্রাম থেকে সহজ মাইগ্রেশনের পথে গ্রামে টাকা ঢুকছে, একটা বড় অংশের গ্রামের মানুষ আগের তুলনায় হয়ত ভালো আছে, মানে খেতে পাচ্ছে। কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে জল জঙ্গল জমির মতো গ্রামের স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদ। মানুষ শহর নির্ভর হয়ে পড়ছে। না জেনে মানুষের বাঁচার জন্য সব থেকে প্রয়োজনীয় যে খাদ্যসামগ্রী তা গ্রাম ও তার প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। আর হয়তো সেদিন সুদূর নয় যখন গ্রাম ও শহর একই বাঁচার তাগিদে পয়সা নয় সেই হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতিকে নিয়ে লড়াইয়ে মাতবে।
৫
বিশাল বড় একটা বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে কিউলের নদীর ধারে, এদিকে কিছুটা জঙ্গল এখনো বেঁচে আছে। পড়ন্ত বেলায় সূর্যের হলুদ আলোয় কিউলে প্রবাহমান অল্প জল চিকচিক করে বয়ে চলেছে। দলছুট আমি একা দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম; পৃথিবীতে সব শিশুই মাতৃজঠর থেকে একভাবেই তো ভূমিষ্ঠ হয়, নিরাবরণ উলঙ্গ কিন্তু এক আশ্চর্য মন্ত্রবলে জন্মগ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যেই কিছু শিশু সেজে ওঠে প্রয়োজনাতিরিক্ত দামি পোষাকে আর কিছু শিশুর বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় সাধারণ পোশাকও জোটে না। শিশু বয়েসেই কোন বাচ্চা পেয়ে যায় দামী খেলনা বই আর অত্যাধুনিক শিক্ষা আর কিছু বাচ্চা অতি সাধারণ পোশাকে অবাক চোখে দেখে দামি পোষাকে সেজে যাওয়া তার বয়েসি অন্য শিশুদের। কেন? কে নির্ধারণ করে এই সব শিশুর ভাগ্য? ঈশ্বর, সমাজ, রাষ্ট্র নাকি এক নিষ্ঠুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা? বংশ পরম্পরায় যার শিকার এইসব শিশুদের পরিবার।
বর্তমান বাজার অর্থনীতিতে এদের জন্মের ঠিকানা নির্ধারণ করে দিয়েছে এই সব শিশুদের ভাগ্য; বড় শহরের বড়লোক আর মধ্যবিত্ত পরিবারের দামি পোশাকের শিশুটি বড়ে হয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে আর কিউলের দুই পাশের গ্রামের অসংখ্য শিশুরা বড় হয়ে আলের পাশে বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকবে বা হাতবদল হয়ে যাওয়া মোটর সাইকেলে অন্যের মাল বা খাবার বইবে। ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল করে যখন কিছু যুবকের বুকের ছাতি ফুলে উঠবে তাদের কৃৎ সাফল্যে তখন তারই সাফল্যের অনুষ্ঠানে দেরিতে খাবার আনার জন্য খাবার সরবরাহকারী কোম্পানির গ্রাম থেকে আসা ছেলেটি অপমানিত হবে। একজনের স্বপ্ন উচ্চ শিক্ষায় আমেরিকা যাবার আর অন্যজনের স্বপ্ন পয়সা বাচিয়ে তার ভাইবোনকে স্কুলে পাঠানো যাতে তারাও একদিন এদের মতো হয়। কিন্তু সেদিন আর আসে না, যুগ যুগ ধরে আসেনি, আগামী কোনো দিনে আসবে কী?
1. The New Indian Express, 21st June 2024.
2. Higher Education in West Bengal – An Overview by Jana, Sebak, MPRA Paper No. 121212, posted 22 Jun 2024.
3. GOVERNMENT OF INDIA MINISTRY OF EXTERNAL AFFAIRS LOK SABHA UNSTARRED QUESTION NO-990 ANSWERED ON- 08/12/2023
4. Migration, remote rural areas and chronic poverty in India by Priya Deshingkar, Overseas Development Institute, London.
5. Migration, remote rural areas and chronic poverty in India by Priya Deshingkar, Overseas Development Institute, London.
6. Frontline 04.08.23
7. The Economics Times, 24. 11. 2024
8. The Hindu 13 July 2024
9. Wire 8.8.2023
10. Time 27 March 2024
11. Income and Wealth Inequality in India, 1922-2023: The Rise of the Billionaire Raj ; Nitin Kumar Bharti, Lucas Chancel, Thomas Piketty and Anmol Somanchi
12. World Bank Report 25 May 2022
13. CNN Report 26 April 2024,
14. Context Newsletters- 18.12.2024
15. Earth. ORG link https://earth.org/human-activities-have-degraded-40-of-land-on-earth-un-reports/
16. Strengthening India's Agrifood Systems: Tackling Land Degradation and Desertification, by Takayuki Hagiwara, FAO Representative in India, , FAO in India report.