সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
দ্য গার্ডিয়ান আগস্ট ৫, ২০২০
নরেন্দ্র মোদী এখন রাম মন্দিরের শিলান্যাসের সংকল্প করলেন কেন?
২০১৪ সালের ৪ আগস্ট কাশ্মীরের সব ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেটে দেওয়া হয়েছিল অন্তর্জাল পরিষেবা। ঠিক এক বছর আগে এই দিনটিতে, অর্থাৎ ৫ আগস্ট দুর্ভেদ্য সামরিক কার্ফুতে নিজ গৃহে বন্দী হলেন ৭০ লক্ষ মানুষ (৭ মিলিয়ন)। শিশু ও কিশোর সমেত ১০,০০০ মানুষ পূর্বতন সব মুখ্যমন্ত্রী ও ভারত সমর্থনকারী প্রধান রাজনীতিকদের দিকে পাথর ছোঁড়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হলেন, তাঁদের হাজতে পাঠানো হল, এখনও তাঁরা অনেকেই সেখানেই আটক আছেন। ৬ আগস্ট লোকসভায় (পার্লামেন্টে) একটা বিশেষ বিল পাস হল। ছেঁটে ফেলা হল সংবিধান প্রদত্ত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন। খর্ব হ’ল এমনকি পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদাও। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ - এই দুই ইউনিয়ন টেরিটরি (কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে) ভাগ করে দেওয়া হল। লাদাখের জন্য কোন বিধানসভা রইল না। সোজা দিল্লি থেকেই চালানো হবে শাসন।
আমাদের বলা হল, কাশ্মীর সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হয়ে গেল। অন্য কথায় বলতে গেলে, কাশ্মীরে দশক ধরে চলা আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, যার জন্য প্রাণ গিয়েছে হাজার হাজার সেনার, মিলিটারি ও অসামরিক মানুষজনের, নিখোঁজ হয়েছেন, নিখোঁজ করে দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার মানুষ, নৃশংসভাবে অত্যাচারিত দেহের অগুনতি দৃশ্য - সব শেষ।
লকডাউন, বা না-লক ডাউন, যখন আমি লিখছি, নিশ্বাসে অনুভব করছি ঐতিহাসিক সেই মুহূর্তের পূর্বাভাস।
ভারতের লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আর একটু এগোলেন। তিনি বললেন, পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিটস্তানের সম্মুখবর্তী অঞ্চল উদ্ধারের জন্য তিনি জীবন দিতেও রাজী। আকসাই চিনের কথাও জানালেন তিনি। একসময় তা জম্মু কাশ্মীরেরই ছিল, এখন চিনের অন্তর্গত। আক্ষরিক ও প্রতীকী এই দুই অর্থেই, বিপজ্জনক অঞ্চল দিয়ে হাঁটছেন তিনি। যে সীমানাগুলির কথা তিনি বলছেন তা তিন পারমাণবিক শক্তির আওতার মধ্যে। কাশ্মীরের অসংখ্য মানুষের ওপর নামিয়ে আনা অমানবিক আচরণের মধ্যে ভারতের রাজপথে রাজপথে অবোধ্য অভূতপূর্ব উল্লাস, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইতিমধ্যেই লালিত ঈশ্বর সদৃশ ভাবমূর্তিকে আলাদা ঔজ্জ্বল্য দিয়েছে। প্ররোচিত হয়ে ভারতের আবহাওয়া দপ্তর দেশের আবহাওয়া বার্তায়, গিলগিট বালটিস্তানের আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যাদিও পেশ করতে শুরু করে দিয়েছে। ভারতে খুব কম সংখ্যক মানুষজনই গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করেছেন, সেই সময় চিন সরকার ভারতকে সীমানা সংক্রান্ত বিষয়ে কথাবার্তা ও কাজকর্মে সতর্ক থাকতে বলছে।
যে বছরটি চলে গেল, সেই বছরে কাশ্মীরের মানুষজনের লড়াই কোন অর্থেই শেষ হয়ে যায়নি। মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে গত কয়েক মাসে কাশ্মীরে ৩৪ জন সেনা, ১৫৪ জন জঙ্গী ও ১৭ জন অসামরিক (সাধারণ) মানুষ মারা গিয়েছেন। ‘করোনা ভাইরাস’ এই শব্দবন্ধের আতঙ্কে ভারত সরকার কাশ্মীরের মানুষজনকে কি করছেন তাতে কেউ মনোযোগ দিচ্ছেন না। কার্ফু ও যোগাযোগবিহীনতার সঙ্গে কয়েকমাস ধরে অবিচ্ছেদ্যভাবেই চলল বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগহীনতা - ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা, হাসপাতালে কাজকর্ম ব্যাহত হওয়া, ব্যবসা নেই, স্কুল কলেজ বন্ধ, প্রিয়জন, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই - সর্বত্রই অবরোধ। ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ও আমেরিকা এমন করেনি।
কোভিড লক ডাউনের কয়েক মাস, মিলিটারি কার্ফু ও যোগাযোগবিহীনতা ছাড়াই পৃথিবীকে প্রায় ধ্বসিয়ে দিয়েছে। শত শত, লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ তাঁদের সহ্যসীমা ও স্বাভাবিকতার প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছেন। এবার পৃথিবীর সব চাইতে বেশি মিলিটারি নিযুক্ত কাশ্মীরের কথা ভাবুন। করোনা ভাইরাস আপনার জীবনে যে যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে তার সঙ্গে যোগ করুন কাঁটাতারের গোলকধাঁধা, সেনারা আপনার ঘর ভাঙছে, লোকজনকে মারছে, মহিলাদের প্রতি অশালীন আচরণ করছে। নষ্ট করে দিচ্ছে আপনার মজুত করা খাবার, গণমাধ্যমের যাবতীয় কন্ঠ ব্যবহার করে অত্যাচারিত মানুষজনের আর্তনাদ শুনিয়ে যাচ্ছে, শুনিয়েই চলেছে।
এর সঙ্গে যোগ করুন বিচার ব্যবস্থাকে - ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সহ যারা সারা বছর ধরে এই অন্তর্জাল অবরোধ চলতে দিয়েছে, গ্রাহ্যই করেনি নিজেদের পরিবার পরিজনদের প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া ৬০০০ মানুষের ‘হেবিয়াস কর্পাসের’ আবেদন। আরও যোগ করুন বসবাসের আইনের কথা (domicile law), যার ফলে সমস্ত ভারতীয়দের জন্য কাশ্মীরের বসবাসের পথ উন্মুক্ত করা হল। কাশ্মীরের আদি বাসিন্দাদের অমূল্য শংসাপত্রগুলি এখন আইনগতভাবে মূল্যহীন। এখন নিজ মাতৃভূমিতে বসবাসের জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদনে এগুলো হয়তো কিছু প্রমাণ দেবে। এঁদের মধ্যে যাদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবে তাঁদের নিজের বাড়ি ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। আজ কাশ্মীর সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের সম্মুখীন।
কাশ্মীরে নতুন বসবাসের আইন (domicile law) ভারতের মুসলিম বিরোধী নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (CAA) নিকটাত্মীয়। ২০১৯ সালে এই বিলের সঙ্গে পাস হওয়া আরও আছে NRC (National Register for Citizens বা নাগরিক পঞ্জীকরণ) - যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের (অবশ্যই মুসলিম) ধরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় তারা ‘উইপোকা’। আসামে নাগরিক পঞ্জীকরণ চলাকালীন প্রভূত প্রতিহিংসা প্রতিফলিত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোকের নাম নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ গেছে। অনেক দেশই যেখানে ঊদ্বাস্তু সমস্যার সংকটে জেরবার, সেই সময়ে ভারতরাষ্ট্র তার নাগরিকদের উদ্বাস্তু বানাচ্ছে। অকল্পনীয়ভাবেই এক রাষ্ট্রহীনতার সমস্যায় ইন্ধন যোগাচ্ছে।
CAA, NRC ও কাশ্মীরের নতুন Domicile Law বৈধ নাগরিকদের কাছেও রাষ্ট্রের নির্দেশ ও সম্মতিপ্রদত্ত তথ্যাদি চাইছে। (১৯৩৫ সালে নাজি পার্টির ন্যুরেমবার্গ আইন ডিক্রী জারি করেছিল যাদের থার্ডরাইখের সম্মতি সহ আইনানুগ কাগজপত্র আছে একমাত্র তারাই জার্মান নাগরিক)। এসবকে কি বলা যায়? যুদ্ধ অপরাধ! না মনুষ্যত্বের প্রতি অপরাধ!
লুন্ঠিত হয়েছে আমাদের পরিচিতি ঃ এক বছর সমস্যার পর কাশ্মীরের জীবন
ষড়যন্ত্রে সহায়তা করা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও ভারতরােষ্ট্রর রাস্তায় রাস্তায় উল্লসিত সাড়ম্বর উদ্যাপনগুলিকে কি বলা যাবে? গণতন্ত্র?
এক বছর পর, কাশ্মীরের ওপর এই উদ্যাপনগুলি স্পষ্টতই নির্বাক। কারণটি অবশ্য অন্য। আমাদের সদর দরজায় ড্রাগন - তাই সে অসুখী। ২০২০ সালের ১৭ জুন আমরা চোখ খুললাম একটা ভয়ঙ্কর খবরে - চিনের সেনা, People Liberation Army-র হাতে একজন কর্নেল সহ ২০ জন ভারতীয় সৈনিক নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে দুর্গম তুষারাবৃত গালওয়ান উপত্যকায়। পরবর্তী কয়েকদিনে ভারতীয় কয়েকটি সংবাদ সংস্থার বার্তায় প্রবেশের বিষয়ে কতকগুলি জিনিস জানা গেল। অভিজ্ঞ সামরিক মানুষজন ও প্রতিরক্ষা সংবাদদাতারা জানালেন ভারত-ভূখণ্ডের একশ কিলোমিটার PLA অধিকার করেছে। ‘ভারতীয় মিডিয়ার প্রচারে’ এই ঘটনাকে যেভাবে নগ্ন আগ্রাসন বলে চিত্রিত করা এটা শুধুমাত্র কি তাই? না কি এই প্রবেশের সঙ্গে চিনের মূলগত কিছু স্বার্থ জড়িত – আকসাই চিনের সুউচ্চ পর্বতমালার উপর দিয়ে নির্মিত রাস্তা ও পাক অধিকৃত/আজাদ কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য সড়ক? দুটোই হুমকির মুখে, যদি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য গুরুত্বসহকারে বিচার করা হয়, এবং সেটা করা হবেই বা না কেন?
আমাদের মত ভয়ঙ্কর জাতীয়তাবাদী সরকারের কাছে সে যে সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা দুঃস্বপ্ন। এ বিষয়টি গোপন করা যাবে না, কিন্তু কি ই বা করা যাবে? একটা সাধারণ সমাধান পাওয়া গেছে। গালওয়ান ট্র্যাজেডির কয়েকদিন পর মোদী জনতার সামনে ভাষণ দিলেন, ‘কেউ এক ইঞ্চি জমিও আমাদের নিতে পারে নি।’ বললেন আমাদের সীমানায় কেউ ঢুকতে পারে নি ও কোন ঘাঁটিই দখল করতে পারে নি। মোদীর বিরোধীরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। চিন সরকার তাই বলছিল, তারা মোদীর ভাষণ কে স্বভাবতই স্বাগত জানাল। তবে মোদীর বক্তব্য যেমনটি মনে হচ্ছে, ততটা নির্বোধ নয়। যখন দুই দেশের সেনা নায়কেরা প্রত্যাহারের কথা বলছেন, বলছেন সেনাদলের ‘disengagement’ বা বিরত থাকার কথা, স্বাভাবিকভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনা যখন ঢোকেনি তখন প্রত্যাহার কি ভাবে হয় তা নিয়ে হাসি ঠাট্টা চলছে, যখন চিন নিজ সীমানার দাবী রাখছে, সেসময় ভারতের বিপুল অবিজ্ঞাত সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছে মোদীই জিতে গেছেন। দূরদর্শনে চলছে মোদীর জয়। কে বলবে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ - দূরদর্শন না রাষ্ট্র?
যেভাবেই এটাকে ভাবা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত ভারতের দুদিকেই, পশ্চিমে পাকিস্তান ও পূর্বে চিনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত সেনাদল থাকতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের ঔদ্ধত্যে প্রতিবেশী নেপাল ও বাংলাদেশের ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ। যুদ্ধের মুহূর্তে আমেরিকা এখন তার নিজের সংকটেই আবর্তিত হচ্ছে সে কি পারবে ভারত কে উদ্ধার করতে? সত্যি? আমেরিকা যেমন ভাবে সিরিয়া ও ইরাকে কুর্দদের রক্ষা করেছিল, সত্যি কি সেভাবে ভারত কে সাহায্য করতে পারবে? পারবে কি যেমন সোভিয়েতের থেকে আফগানদের রক্ষা করেছিল বা উত্তর ভিয়েতনামীদের থেকে দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের - সেভাবে ভারতকে বাঁচাতে?
কাল রাতে আমার এক কাশ্মীরি বন্ধু আমাকে মেসেজ করেছিলেন, ভারত, চিন ও পাকিস্তান কি কাশ্মীরের আকাশে আমাদের না দেখেই যুদ্ধ করবে? না হওয়ার মত কিছু নয়। এই তিনটি দেশের কোনটিই না নৈতিক না মানবিকভাবে একে অপরের থেকে ওপরে। এরা কেউই মনুষ্যত্বের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য ভাবিত নয়।
সরকারিভাবে যুদ্ধ ঘোষিত না হলেও ভারতকে লাদাখ সীমানায় উচ্চতায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ও সজ্জিত সেনাদল রাখতে হবে, দূরতম প্রান্তেও চিনের অস্ত্রভাণ্ডারের সঙ্গে খাপ খায় এমন কিছু সঙ্গে রাখতে হবে। স্বভাবতই ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় দুগুন কি তিনগুন বাড়বে। শুধুমাত্র এই নয়, ভারতের বর্তমান অর্থনীতি এখন ক্রমাগত নিম্নমুখী তার ওপর গভীর আঘাত নেমে আসবে, (৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারত্ব)। এই চিত্র, কোভিড-১৯ লক ডাউনের আগেই। আর এখন অর্থনীতি ৩.২ ও ৯.৫এ সঙ্কুচিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। চাইনিজ চেকারের প্রথম রাউন্ডগুলিতে মোদী খুব একটা ভাল ফল করছেন না।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আমরা দেখলাম আরো কিছু মাইল ফলক। পরিকল্পনাহীন, নির্মম, শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া লক ডাউন ছাড়াও, অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম পরীক্ষা সত্ত্বেও ভারতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য দেশগুলির তুলনায় সম্ভবত অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে আছেন আমাদের যুদ্ধপ্রিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনি বর্ষপূর্তি উদ্যাপন করছেন হাসপাতালের বিছানায়। তাঁর জন্য নিরাময়ের নিদান হাতুড়ে ডাক্তাররা দিচ্ছেন না, দলের লোকসভার সাংসদ বা ‘গুরু’রাও নয়, যাঁরা গোমূত্র পান করেছেন, ‘যাদুকরী’ ‘করোনিল’-এর কথা বলছেন তাঁরা নন, শাঁখ বা থালা বাজিয়ে ‘যাও করোনা যাও’ বলে সংস্কৃত ধাঁচে ‘হনুমান চালিশা’ পাঠ করে চলেছেন তাঁরাও নন। তাঁর জন্য বিলাসবহুল বেসরকারি ব্যবস্থা, সরকারি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা।
এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোথায় থাকবেন?
যদি কাশ্মীর সমস্যার চুড়ান্ত সমাধান হয়ে গিয়ে থাকে, সেখানে তিনি থাকতেন সামাজিক দূরত্ববিধি বজায় রাখা ভীড়ের সঙ্গে পর্ব উদ্যাপনে। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার মীমাংসা হয়নি। আবার সব আবদ্ধ। লাদাখ প্রায় যুদ্ধক্ষেত্র। বিজ্ঞজনোচিতভাবেই মোদী স্থির করলেন এ সমস্ত উপদ্রুত অঞ্চলগুলি থেকে সরে গিয়ে একেবারে নিরাপদ জায়গায় আর একটা দীর্ঘ মেয়াদী ভোট প্রতিশ্রুতি দিতে। এই লেখাটা আপনারা যখন পড়বেন তার মধ্যে মোদী পুরোহিত এমন কি সুপ্রীম কোর্টেরও আশীর্বাদধন্য হয়ে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষে ৪০ কেজি রূপোর ইঁট দিয়ে রাম মন্দির নির্মাণের ভূমি পূজন করেছেন – বাবরি মসজিদ যা ১৯৯২ সালে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্যদের নেতৃত্বে উগ্র হিন্দুত্ববাদী কিছু মানুষের হাতুড়ির ঘায়ে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে উঠবে এই মন্দির। দীর্ঘ যাত্রা নিঃসন্দেহে। আমরা বরং বলি, ‘ইচ্ছার জয়’।
কাশ্মীরে আবারো কার্ফু ফিরিয়ে আনতে হল কেন, বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের বছর পূর্ণ হওয়ার পরেও?
লক ডাউন বা না লক ডাউন যখন লিখছি, নিঃশ্বাসে তখন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকা বাতাসের কম্পন। এখনও কিছু সরল ও গোঁড়া আদর্শবাদীরা বিশ্বাস করেন ক্ষুধা ও কর্মহীনতা বিপ্লবের পথ প্রস্তুত করে - মন্দির বা মনুমেন্ট মানুষকে অন্ন দিতে পারে না।। রাম মন্দির লক্ষাধিক ক্ষুধার্ত হিন্দু আত্মার খাদ্য। ইতিমধ্যে লাঞ্ছিত মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ক্রমিক লাঞ্ছনা বিজয়ের রসনা আরো সুস্বাদু করে। রুটি কি তা দিতে পারে?
গত আগস্ট থেকে আজ অব্দি, এই ৩৬৫ দিন এখন ফিরে দেখাটা সহজ হবে - ভারতের কাশ্মীরের চূড়ান্ত অন্তর্ভূক্তি, CAA ও NRC বিল পাস ও রাম মন্দিরের শিলান্যাস – এইভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, এই সময়কালে মোদীর নেতৃত্বে ভারত হয়ে উঠেছে এক হিন্দুরাষ্ট্র, নতুন যুগের ভোর। এই আপাত ঘোষণার পিছনে আছে না-মেনে নেওয়া এক পরাজয়। এবং শুরুর ঔজ্জ্বল্যে সন্তুষ্ট অনাগত নিষ্পত্তি। মনে রাখা ভাল যে মোদীর জীবনের চেয়েও উজ্জ্বল উপস্থিতি ও বিজেপির লোকসভায় বিরাট জয় সত্ত্বেও ভারতের জনসংখ্যার মাত্র ১৭.২% তাঁদের ভোট দিয়েছিলেন।
মনে হয়, চিনের বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের সতর্কতা নিয়ে এগোতে হবে। এক মুহূর্ত ভেবে দেখুন। মোদী এখন কেন রাম মন্দিরের ভূমিপূজা করতে গেলেন? এখন অন্তত দশেরা বা দিওয়ালি নয়, তারিখটিরও রামায়ণ বা হিন্দু ক্যালেন্ডারে কোন অস্তিত্ব নেই। ভারতের বেশিরভাগ জায়গাতেই এখন আংশিক লক ডাউন, রামমন্দির ক্ষেত্র প্রস্তুত ও নিরাপত্তায় নিযুক্ত পুরোহিত ও পুলিশদের অনেকেই করোনাক্রান্ত। তা হলে এখন কেন? কাশ্মীরের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে? না ভারতের ক্ষতে মলম লাগাতে? দূরদর্শন অবশ্য আমাদের যা বলছে তাতে শুনছি এখন বর্ডার বা সীমানায় টেকটনিক (ভূত্বকীয়পাত) প্লেটের নড়াচড়া হবে, বড় বড় প্লেটগুলি বা ভূত্বকীয়পাতগুলি এখন নড়ছে। পৃথিবীর ধরন বদলে যাচ্ছে। মানুষকে এখন আর দাবিয়ে রাখা যাবে না, নিজে প্রভু না হয়েও প্রতিবেশীদের সঙ্গে প্রভুর মত আচরণ করা যায় না। এটা চিনা প্রবাদ নয় - সাধারণ জ্ঞান।
তা হলে কি এই আগস্টে বর্ষপূর্তি যা ভাবা হয়েছিল তা নয়? গৌরবের ক্রমবর্দ্ধমান চূড়ায় কি এই কলঙ্ক এঁটুলির মত লেগে থাকবে না?
কাশ্মীরের আকাশ নিয়ে যখন চিন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ চলে, আমরা, বাকিরা তখন যা করতে পারি তা হল কাশ্মীরের মানুষদের দিকে চোখ রাখা।