সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
দেখতে দেখতে প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেল এই অতিমারীর তান্ডব আমরা দেখছি, অনুভব করছি, এই তান্ডবের বলি হচ্ছি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে।ভয়, আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তা পরতে পরতে জড়িয়ে রেখেছে আমাদের, বালিতে মুখ গুঁজে ঝড় সামলাচ্ছি আর মাঝে মাঝেই ভাবছি এই বুঝি ‘সে’ এলো- এই ঝড়ের হাত থেকে আমাদের সরিয়ে নিতে। চেতনে বা অবচেতনে আমরা কেউ এই ‘সে’র জায়গায় ভাবতে চাইছি ‘ঈশ্বর’ কে কেউ বা ‘রাষ্ট্র’-এর কথা ভাবছি। না, ভুল হল, রাষ্ট্র আমাদের কাছে বিমূর্ত ‘ইমেজ’; তাকে আমরা ধরতে পারি না, আমরা চিনি সরকার। আবার সরকারও অনেক বড়ো ব্যাপার, আমাদের কাছে সহজ হয়ে যায় নেতা বা নেত্রী। কখনও ভুল ভাঙ্গে, তখন সঁপে দিই ভাগ্যকে বিচারব্যবস্থার ওপর, কখনও বা মিডিয়ার কাছে ছুটে যাই - সত্যিটা সকলে জানুক! জানলে হয়ত সুবিচার আসবে!
সব আলাদা আলাদা ইমেজ নিয়ে আমাদের সামনে - সরকার, মিডিয়া, বিচারব্যবস্থা, ধর্ম, শিক্ষা। এগুলো দিয়ে কোলাজ বানাতে পারি না। কিন্তু ধাক্কা লাগে যখন দেখি এই ইমেজগুলোর মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগে যায়, কোন একটা যখন সর্বেসর্বা হয়ে বাকী কটাকে চোখ রাঙায়, রাজনীতির নিপুণ ছকে, সুতোর টানে সব ইমেজগুলো যখন পুতুলের মত নাচে, প্রমাদ গুনতে হয়। দিশেহারা আমরা আশ্রয় খুঁজি, তাত্ত্বিকেরা বলেন পলিটিক্যাল ইকনমির কথা।পলিটিক্যাল ইকনমির ছকে দেখতে চান রাষ্ট্রের স্বরূপ। রাষ্ট্র এমন একটা সেট যার অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে সরকার, মিডিয়া, বিচারব্যবস্থা, ধর্ম, শিক্ষা, জনগণ, ভৌগোলিক সীমানা এবং তার সার্বভৌমত্ব।
পলিটিক্যাল ইকনমি কী?
বিগত তিন’শ বছর ধরে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে চলেছে এই পলিটিক্যাল ইকনমি। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে চাহিদার প্রকৃতি এবং দ্রব্যের উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে সেই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে চলাটাই ছিল পলিটিক্যাল ইকনমির কাজ। অর্থনীতির ব্যুৎপত্তিগত অভিধায় যেখানে তাকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছিল পরিবারের ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞান হিসাবে, পলিটিক্যাল ইকনমি সেখানে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাজকর্মের ব্যবস্থাপনার দিকটা নিয়ে পড়ল। কিন্তু রাজনীতির বিষয়টা?
এই যে মানুষের চাহিদা মেটানোর কাজ, সেটা তো একাকী কারুর পক্ষে সম্ভব নয়, পরস্পর আদান-প্রদানের মাধ্যমেই তো তা সম্ভব। আবার সেই পারস্পরিক লেনদেনও ঘটে থাকে একটা রাজনৈতিক সীমানার চৌহদ্দিতে যেখানে চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব আর পরিবারের হাতে থাকে না তা ন্যস্ত হয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের ওপর আর সেটা হল রাষ্ট্রের আর এক শরিক-সরকার। একটা সময় ছিল যখন পলিটিক্যাল ইকনমির দায়িত্বর মধ্যে পড়ত রাষ্ট্রনায়কদের পরামর্শ দেওয়া, কী উপায়ে সুষ্ঠুভাবে সরকার তার নাগরিকদের প্রয়োজন মেটানোর কাজটা সম্পন্ন করতে পারে।
পরবর্তীকালে কোন সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের চরিত্র ও সেই বিন্যাস কীভাবে উন্নয়নের নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করে সেটাই পলিটিক্যাল ইকনমির বিষয় হয়ে ওঠে।
পুঁজিবাদকে সচল রাখার সাংগঠনিক প্রয়াস
কয়েক’শ বছর ধরে সামাজিক পর্বান্তর-এর বিভিন্ন্ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার জন্ম্।এর আস্ফালনের কাছে হার মেনেছে সমাজতন্ত্রের আশা। প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, তৃপ্তি, অতৃপ্তি, বৈভব, বঞ্চনা - সব নিয়ে পুঁজিবাদের যাত্রা, কখনও ঠোক্কর খেতে খেতে, কখনও বা অবাধ। নানান সময়ে নানান সঙ্কট কম নাজেহাল করে না। উৎপাদনের বিভিন্ন্ শাখায় অসম্পূর্ণতা (disproportionality in different lines of production), কখনো ভোগের ঘাটতি (under-consumption), মুনাফার হার কমে যাওয়ার প্রবণতা, মন্দা- এইরকম নানা সংকট ব্যতিব্যস্ত করে পুঁজিবাদকে, আর তাই কালানুক্রমে জন্ম নেয় ভিন্ন ভিন্ন প্রচেষ্টা পুঁজিবাদের গতিকে সচল রাখতে, যেমন উদারনীতিবাদ (Liberalism), Dirgiste রাষ্ট্র এবং নয়া-উদারনীতিবাদ বা Neo-liberalism.
উদারনীতিবাদ একরকমের ইউটোপীয় দর্শন যা দাঁড়িয়ে থাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার, স্ব-নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা এবং অবাধ বাণিজ্যের নীতির উপর; কারণ তাতেই ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মুক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের বিশ্ব দেখেছে উদারনীতির একচ্ছত্র আধিপত্য।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের আর একরকম ভাষ্য হল রাষ্ট্রের সদর্থক হস্তক্ষেপ বা dirgisme অর্থাৎ রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ। বাজার ব্যবস্থার ব্যর্থতা প্রতিরোধের উপায় হিসেবে এই ধারণার জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রান্সে এই মতবাদ গ্রহণ করা হয় শিল্পায়নের তাগিদে এবং বৈদেশিক প্রতিযোগিতার হাত থেকে বাঁচতে। পরবর্তী কালে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেও এর অনুকরণ করা হয়। রাষ্ট্রের এই ইতিবাচক ভূমিকার অংশ হিসেবে বিবেচ্য হয় কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা, রাষ্ট্র কর্তৃক বিনিয়োগের পরিচালনা, দাম ও মজুরীর নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমের বাজারের তত্ত্বাবধান।
নয়া-উদারনীতিবাদের জন্ম ১৯৭০ এর দশকে মার্গারেট থ্যাচার, রোনাল্ড রেগন এবং পিনোচেত-এর মস্তিষ্ক প্রসূত এবং প্রবর্তিত নীতির পরম্পরায়।এর প্রধান কথা হল বাজারের কাজকর্ম চলতে হবে দক্ষতার সঙ্গে যাতে দেশী-বিদেশী ব্যক্তিগত পুঁজির অনিয়ন্ত্রিত চলাচল ও কাজকর্মে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। এই মতবাদে রাষ্ট্রের উন্নয়নের ভাষ্য চাপা পড়ে যায় বরং তার কাছে বড় হয়ে ওঠে আদিম আহরণের (Primitive Accumulation) প্রচেষ্টাগুলো ঢেকে রাখা এবং আহরণের সেই রাজকে কায়েম করা যেখানে দেশীয় বাজার ও ঘাটতি-ব্যয়কারী রাষ্ট্রের পরিবর্তে আর্থিক বৃদ্ধির প্রধান উদ্দীপক হিসেবে রপ্তানী ও ঘাটতি ব্যয়কারী বেসরকারী ব্যয় মুখ্য হয়।
ভারতে কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তীকালে প্রায় দুই দশক ধরে ছিল dirgiste রাষ্ট্রের প্রভাব। দ্রুত শিল্পায়ণের তাগিদে নিয়ন্ত্রণের বজ্র আঁটুনির ঘেরাটোপে গজিয়ে ওঠে লাইসেন্স রাজ আর আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
১৯৬০-এর মাঝামাঝি থেকে এটা অনুভূত হতে থাকে যে নিয়ন্ত্রণের রূপায়ণ যেভাবে হওয়া উচিত ছিল তা হয় নি, অনেক লক্ষ্য-পূরণ অধুরা থেকে গেছে আর তখন থেকেই নিয়ন্ত্রণের দর্শন তার প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে।১৯৮০-র দশকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও ধীর গতিতে উদারীকরণের দিকে প্রবণতা সৃষ্টি হয়।
১৯৯০-এর দশক থেকে মূলত লেনদেন ব্যালেন্স-এর ঘাটতি সামলাতে সার্বিক উদারীকরণের জোয়ার আসে এবং রাষ্ট্রকে ছাপিয়ে উঠে সরকারের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নয়া-উদারনীতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে।স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনকল্যাণ, শ্রমিকের স্বার্থ, নাগরিকের নিরাপত্তা – কোন কিছুই আর রাষ্ট্রকে আলোড়িত করে না। উন্নয়নের নামে অগণিত মানুষ ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত হয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এর ভয়াল রূপ লুকিয়ে রাখতে জাতীয়তাবাদের জিগির খাড়া করা হয় আর এসবের অন্তরালে কখন থাবা বসায় অতিমারী।
দি ইকনমিস্ট ১৪ মে ২০২০-র সংখ্যায় জানান দিল এতদিন
পারস্পরিক আদান-প্রদান-এর ওপর নির্ভর করে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, জ্ঞান-এর যে অবাধ চলাচল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে চালু ছিল তার দিন শেষ হল বলে।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ১২ মে-র ঘোষণাকে উদ্ধৃত করে পত্রিকা আভাস দিল বিশ্বের দেশগুলো আবার Dirgiste রাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তনের কথা ভাবছে আর আত্মনির্ভর হওয়ার সেটাই প্রথম পদক্ষেপ।
এই দেশের প্রেক্ষিতে তো বটেই অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেও এটা বুঝতে না পারার কারণ নেই যে ইতিহাসের এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট। একদিকে এই মারণ ভাইরাস-এর সংক্রমণ থেকে নাগরিকদের বাঁচান অন্যদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমাজ কে সুস্থির রাখা।এর জন্য আইনের অনুশাসন কঠোর করার সাথে সাথে রাষ্ট্রের নজরদারী সার্বিক করে তোলার পাশাপাশি ‘আলোচনার দ্বারা সরকার’(government by discussion)-এর স্বরূপ উন্মোচিত হওয়ার কথা ছিল।অথচ এক্ষেত্রেও সেই সরকারের তর্জন গর্জনে রাষ্ট্র কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
কোন আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই পরিকল্পনা কমিশন বাতিল করে নীতি আয়োগের প্রতিষ্ঠা, রাতারাতি বিমুদ্রাকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, দ্রব্য ও সেবার ওপর করের প্রবর্তন, অতিমারীর প্রাদুর্ভাবের সময় রাজ্যগুলিকে প্রস্তুত হবার সু্যোগ ও সময় না দিয়ে লকডাউনের ঘোষণা এবং এই বিপর্যয়ের মুহূর্তেও ওপর থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা একটা বিষয়কে সুনিশ্চিত করে, সরকারের স্বশাসনের (Autonomy) ক্ষমতা উত্তরোত্তর বাড়ছে আর সেইদিন হয়ত বেশি দূরে নয় যখন আমরা বুঝতে শিখব সরকার মানেই রাষ্ট্র, রাষ্ট্র মানে সরকার বৈ আর কিছু নয়।
এইখানটায় দাঁড়িয়ে একটু দেখে নেওয়া যাক Dirgiste রাষ্ট্রের কথা ভাবার আগের ছবিটা।
প্রাক-অতিমারী রাষ্ট্র
সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রের প্রকৃতি এক একরকম এবং নিজ নিজ কাঠামোগত অবস্থানে থেকে তারা সেই ২০০০ সাল থেকে, SARS সংকটের সময় থেকেই নিজেদের প্রস্তুত করেছে।আবার চীন, ভারত, মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্র-এর ছবিটা আলাদা।
চীন সেই SARS সংকটের সময় থেকেই আগাম-সতর্কীকরণ এর সংকেত দেওয়ার যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তাতে কোন এক প্রান্তে কোভিদ-১৯ এর আক্রমণের কথা জানা গেলেও জনসমক্ষে তা আনতে চায় নি, ফলে জনগণের মধ্যেও সচেতনতা আসে নি। কিন্তু যখন অতিমারীর দুর্যোগ ঘনিয়ে এলো তখন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন, হাসপাতাল তৈরীর মধ্যে দিয়ে অবস্থা সামাল দিয়েছে।
ভারতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়লেও তা যথেষ্ট নয়, ২০১৭-১৮তে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপি-র ১.২৮ শতাংশ। সেন্টার ফর ডিজিজ, ডায়নামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিসি (CDDEP) ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যলয়ের যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায় যে ১৫ এপ্রিল,২০২০ পর্যন্ত এইদেশে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ, আই সি এউ ৯৫ হাজার এবং ভেন্টিলেটর এর সংখ্যা ৪৮,০০০। হাসপাতালের শয্যা ও ভেন্টিলেটারেরও বেশির ভাগ রয়েছে সাতটা রাজ্যে – উত্তরপ্রদেশ (১৪.৮%), কর্ণাটক (১৩.৮%), মহারাষ্ট্র (১২.২%), তামিলনাড়ু (৮.১%), পশ্চিমবঙ্গ (৫.৯%), তেলেঙ্গানা (৫.২%) এবং কেরালা (৫.২%)।
অতিমারীর মোকাবিলায় বিফলতার একটা বড়ো কারণ হল কিছু কিছু দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবায় সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা। ইতালীতে ২০০৯ থেকে ২০১৭ - এই সময়ে স্বাস্থ্যপরিষেবায় চাকরী কমেছে ৪৬৫০০, কমেছে ৭০০০০ হাসপাতালের শয্যা। ইতালীতে ১৯৭৫ সালে প্রতি হাজারে হাসপাতালের শয্যা ছিল ১০.৬, বর্তমানে তা হয়েছে ২.৬।ব্রিটেনে ১৯৬০ সালে সেটা ছিল ১০.7, ২০১৩ তে তা কমে হয়েছে ২.৮।পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলোতে অবস্থা প্রায় একইরকম।ফলে যত বেশি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় সমস্যা হয়েছে।সমাজের উচ্চবিত্ত এবং সরকারের উঁচু পদে থাকা মানুষের পক্ষে করোনার চিকিৎসায় যে-পরিষেবা লাভের সুযোগ হয়েছে, সাধারণ ও দুঃস্থদের সেটা না থাকায় তাঁরা যে অকূল পাথারে পড়বেন তাতে আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যবীমার অপ্রতুলতা একটা বড়ো কারণ যার জন্য এই অতিমারীর ঝড় সামলাতে সরকার নাজেহাল। তার ওপর আছে ওষুধ কোম্পানী গুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া, তাদের পকেট ভারী করার অক্লান্ত প্রয়াস (https://www.marxist.com/ coronavirus-pandemic-opens-a-new-stage-in-world-history.htm).
নিও-লিবারালিজম এর সবচেয়ে বড়ো সাফল্য এই যে পুঁজিবাদের এই নতুন প্রজাতির বীজটিকে সুচারু ভাবে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবনার চারণভূমিতে বপন করতে পেরেছে যার ফলে যেসব প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের পানসি চালাবার ঠিকে পেয়েছে সেগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হিসেবে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীকে পুঁজির আজ্ঞাবাহক করতে পেরেছে।এদের সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হল একটা বিরাট সংখ্যক সর্বহারা শ্রেণীকে শ্রমের রিজার্ভ আর্মিতে পরিণত করে পুঁজির বাজারের নিয়মশৃঙ্খলায় আবদ্ধ করতে পারা।
পুঁজিবাদের এই পর্যায়ে এসে বিশ্বে মোট ধনসম্পদের কিরকম পরিবর্তন ঘটেছে দেখা যাক। ২০১৫ সালে বিশ্বের ৬২ জনের মোট আয়ের পরিমাণ বিশ্বের ৩.৬ বিলিয়ন লোকের আয়ের সমান। ২০১০ থেকে ২০১৫- এই পাঁচ বছরে বিশ্বের ৬২ জন ধনীর আয় বেড়েছে ৪৪% আর বিশ্বের জনসংখ্যার একেবারে নীচের তলার ৫৫% মানুষের আয় কমেছে ৩৮%। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোতে জনসংখ্যার বিরাট অংশ কৃষির অধিকার হারিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে প্রায় ১০ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন সারা বিশ্বে। আবার অসংগঠিত ক্ষেত্রে ভিড় বাড়ছে শ্রমজীবী মানুষের তার কারণ সংগঠিত ক্ষেত্রে যত দিন যাচ্ছে কাজের সংকোচন ঘটছে আর যেখানে সুযোগ আছে সেখানে বাড়ছে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা। এতো একরকম; পুঁজিবাদের স্বয়ংক্রিয়তা চালু রাখতে নিও-লিবারালদের দাবী মেনে শ্রম-বাজারের নমনীয়তার রব উঠেছে যার মূল কথা হল শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার লড়াই আর সংগঠনের ছাতার তলায় হবে না কিন্তু উৎপাদনের বৃদ্ধি ঘটাতে শ্রম-ঘন্টার বৃদ্ধি অবশ্যই করতে হবে।
তবে প্রতিবাদের সুর চাপা নেই।১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রাজিলে আন্দোলনের ফলে জমির অধিকার হারানো শ্রমিকদের ৩,৫০,০০০ পরিবার ফিরে পায় জমির অধিকার। ভারতেও বিগত তিরিশ বছর ধরে বিহারে মহিলা কৃষি শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরীর, জমির পুনর্বন্টনের, জাত-পাতের ভেদাভেদ অবলুপ্তির দাবীতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। আর্জেন্টিনায় সহস্রাব্দের শুরুতে ছাঁটাই হওয়া এবং কাজ হারাবার হুমকিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া শ্রমিকের আন্দোলনের ফলে ২০০০ সালের মাঝামাঝি কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব অর্জন করেন ১৫০০০ শ্রমিক যাঁরা পরবর্তীকালে গোটা দেশ জুড়ে ২০০ টারও বেশি সংস্থা চালাচ্ছেন সফলভাবে। পুঁজিবাদের সমর্থকরা এগুলোকে মনে করেন মূলধন- আহরণ ব্যবস্থার ক্ষত। শ্রম নির্ভর উন্নয়নের প্রবক্তারা (Labour Led Development) একে দেখেন শ্রমজীবি মানুষের মুক্তির এবং সংহতির এক নতুন দিগন্তের সূচনা হিসেবে।তবে ২০১৮-র ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট এবং ২০২০-র গ্লোবাল সোশ্যাল মোবিলিটি রিপোর্ট জুড়ে নয়া-উদারতন্ত্রের হামলার ছবি ভয় দেখায়, মনে করায় একবিংশ শতাব্দী তে মূলধনের চরিত্র ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে থমাস পিকেটি-র পর্যবেক্ষণ - বিশ্ব জুড়ে মূলধন থেকে আয়ের পরিমাণ পেছনে ফেলছে শ্রমোদ্ভূত আয় কে; ফলে আগামীদিনে বাড়তে চলেছে আয়ের অসাম্য, সামাজিক সচলতা(social mobility) স্থবির হওয়ার আশংকা।
অতিমারী সভ্যতার কাছে রাখতে চলেছে এক বড়ো প্রশ্ন – অতিমারী কী নিয়ে আসবে সামাজিক পর্বান্তরের আর এক অধ্যায় যেখানে সব-হারানো মানুষ ফিরে পাবে বাঁচার অবলম্বন, দারিদ্রের করাল ছায়া মুছে গিয়ে দারিদ্র-মুক্ত নতুন জীবনের আশা সঞ্চারিত হবে, মুমূর্ষুপ্রায় সভ্যতা শুনবে সঞ্জীবনের গান?
আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে প্রথম আন্তর্জাতিক-এর উদ্বোধনী ভাষণে মার্ক্স ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে পাশ হওয়া শ্রমিকের ১০ ঘণ্টা কাজের আইনকে দেখেছিলেন শ্রমের পলিটিক্যাল ইকনমির কাছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পলিটিক্যাল ইকনমির আত্মসমর্পণ হিসেবে।
এই যে দুর্দশা ডেকে আনল এক ভাইরাস, বিপর্যস্ত হয়ে গেল মানবসমাজ, এইখানটায় পলিটিক্যাল ইকনমির দায় থেকে যায় নিও-লিবারাল অভ্যেস থেকে dirgiste ভূমিকায় রাষ্ট্রের উত্তরণের দিকটা বুঝে নেওয়ার। কিন্তু সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।