সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
উঠোনে শুধু একটি নৌকো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। আজই তো তোমার ফিরে যাবার কথা ছিল।
মাঝি কিন্তু এখনো মাঠ ভেঙে ফিরে আসতে পারেনি। তার নাকি কয়েক বছরও দেরি হতে পারে। কথাটা তুমি জানোনা বলেই মাঝরাতে এই তারাজ্বলা নিঃসীম আকাশের নিচে আবছা উঠোনে নেমে দাঁড়িয়ে রয়েছ। মাঝি ফিরে আসার অপেক্ষায়। ভূতাবিষ্ট একা। শাদা কুয়াশায়।
কোথা থেকে যে গান ভেসে আসছে মাঠের হাওয়ায়। ঝিমধরানো সুরে। একটানা। ভারী অবাক হয়েছ তুমি। কতোদিন আগে কোনো এক জনপদবধূর গলায় শোনা গান আজ এই মাঝিশূন্য নৌকোর রাতে কীভাবেই-বা ফিরে আসবে। অনেকদূরে টিমটিমে লন্ঠনের আলো একমাঠ অন্ধকার দোলাতে দোলাতে বাড়ি ফিরছে আলপথ ধরে।
এইসময় নিজের মুখোমুখি সম্পূর্ণ অনাবৃত তুমি। খুব শীত করছে তোমার। গানটাও থেমে গেছে অনেকক্ষণ। প্রান্তরে জঙ্গলে শুধু তারা ঝরে পড়ার টুপটাপ।
জীবনে আজ এই প্রথম তুমি প্রবল নৈঃশব্দ্য আর প্রগাঢ় সন্মোহনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছ। যেখানে কিছুটা দূরেই একটি নৌকো, অপেক্ষারতা, শুধু তোমার জন্যেই, অল্প অল্প দুলে উঠেছে মাঠের হাওয়ায়।
হাইওয়ের দিক থেকে হঠাৎ বৃষ্টি এসে বাসস্টপে প্রতীক্ষারত যাত্রীদের ভিজিয়ে বলখেলার মাঠে নির্বিকার নেমে চলে যায়। জুনমাসের দীর্ঘ বিকেল বৃষ্টির এই বালখিল্যতায় ভারি খুশি। চোখ টিপে অফুরন্ত আমের বাগানে তাকে নিয়ে নিমেষে উধাও।
হাইওয়ের ওপারেই পৃথিবীর শেষ টার্মিনাস। সেখানে বৃষ্টি নেই। বিকেলও নেই। সেখানে দমবন্ধ হয়ে পড়ে আছে কবেকার পরিত্যক্ত একটা নিঃঝুম ডাবলডেকার। সেই বাসের দোতলা থেকে নেমে আসছে কলেজ ফেরত এক তরুণী। যাকে দেখতে অবিকল ‘রাজা’ নাটকের ‘সুরঙ্গমার’ মতো।
বোধনের সময় হলো। এসো, আলপনাআঁকা এই দরদালানের একধারে শান্ত হয়ে দাঁড়াই। খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে একটা বিকেল।
গ্রাম ঝেঁটিয়ে লোক আসছে। ঢাকের শব্দ। কাঁসি। কোলাহল। দালানের একপাশে উঁচু বেদি। ডাকের সাজের প্রতিমা। দ্যূতিময়ী। দশপ্রহরণধারিণী। মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত, তবু বেশ হাসিহাসি মুখ। জ্বলজ্বল করছে চোখদুটো। জমকালো শাড়ি-জামায়, খোলাচুলে মানিয়েছেও বেশ। আর কী আশ্চর্য! মুখটাও যেন খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে, এই মেয়ের সঙ্গে না হোক, এর যমজ বোনের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলাপ হয়েছিল আগে কখনো। কিন্তু কোথায়? সেইটাই তো মনে করতে পারছি না কিছুতেই।
গাঁয়েরই এক পটুয়া, কুমোরটুলির মাতব্বর নয় মোটেও, নেহাতই মামুলি একজন, প্রতিমা গড়েছে এবছর। বরাবরই উত্তেজওনায় তার খুব ঘাম হয়। তারপর শীত করে। আজও তেমনই। আবার নিজের সৃষ্টি থেকে নিরপেক্ষ দূরত্বে দাঁড়িয়ে স্রষ্টা হিসেবে একটু গর্বও যে হয় না, এমন নয়। যেমন এইসময়।
তার গড়া মূর্তির মতোই হাসিখুশি অল্পবয়সী পটুয়াটি। বেশ মিশুকেও বটে। নিজেই এসে আলাপ করলো আমাদের সঙ্গে। আবার আলাপ একটু গাঢ় হতে-না-হতেই জামার নিচে লুকোনো ডানা মেলে পলকে উধাও। বেশ চমৎকার কাটল সন্ধেটা।
ওই যাঃ! ছেলেটির নামটাই তো জানা হলো না শেষ পর্যন্ত।