সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
নন্দীগ্রামের ঘটনা যখন ঘটছিল তখন আমার এক প্রিয় আমেরিকাবাসী বাঙালি অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্বাধীন দেশে এসব কী ঘটছে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, শিশুরাষ্ট্র তো। তাঁর কথা আমি বুঝতে পারিনি। ভুরু কুঁচকে বলেছিলাম, শিশুরাষ্ট্রেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে এর বয়স হলে কী হবে! তিনি হেসে বলেছিলেন, রাগ কোরোনা, আসলে উপনিবেশিক শাসকরা আমাদের ছেড়ে গেছে, উপনিবেশিকতা এখনো খোঁয়াড়ি কাটছে। কথাটা যে কতটা সত্যি প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করি। আমরা যতই ভাবি আমরা খুব স্বাধীনভাবে ভাবছি, আসলে সেসব ভাবনার সিংহভাগ জুড়ে আছে আমাদের উপনিবেশিক শাসকদের শেখানো ভাবনার বিন্যাস, আমাদের চেতনার গভীরে চারিয়ে যাওয়া তার শেকড়। যেমন সিঙ্গুর খুঁড়তে খুঁড়তে বেরিয়ে পড়েছিল ব্রিটিশের তৈরি ১৮৯৪ সালের জমি আইন, ষাট বছরেও যা নিয়ে বিব্রত বোধ করেননি এমনকি কৃষক-শ্রমিকের বন্ধুরাও। উল্টে সেই আইনকেই ব্যবহার করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন শিল্পপ্রসারের স্বার্থে। তাও আবার শিল্পটি কি, না, মোটরগাড়ি শিল্প, তার জন্যে হাজার একর চাষের জমি নষ্ট করতেও কুছ পরোয়া নেই।
উপনিবেশিকতা কী? নেলসন ম্যালডোনাল্ডো-টোরেস১ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের লোক। ২০০৭ সালে উপনিবেশিকতার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, উপনিবেশবাদ (Colonialism) আর উপনিবেশিকতা (Coloniality) দুটো আলাদা জিনিস। উপনিবেশবাদ হচ্ছে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কে যখন একটা দেশের সার্বভৌমত্ব আর একটা দেশের ক্ষমতার কাছে বাঁধা পড়ে, তখন তাকে বলে উপনিবেশবাদ। এই বন্ধকটাই হয়ে দাঁড়ায় সার্বভৌমত্ব হরণকারী সেই দেশটার সাম্রাজ্যে পরিণত হবার চাবিকাঠি। আর উপনিবেশিকতা হচ্ছে ঐসব দেশ তাদের উপনিবেশগুলোতে দীর্ঘ দিনের শাসনের মাধ্যমে শুধু ক্ষমতার নয়, ধ্যানধারণার যে বিন্যাস তৈরি করে তার বহমানতার নাম। বাঁধা পড়া দেশগুলো হয়ত একদিন মোটের ওপর সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়, চলতি অর্থে যাকে আমরা বলি স্বাধীন হয়ে যাওয়া, কিন্তু উপনিবেশিক শাসকের তৈরি সেই ক্ষমতার সেই ধ্যানধারণার বিন্যাসের বহমানতা সহজে নষ্ট হয় না। সেগুলো সে দেশের লোক বহন করে চলে প্রতিদিনকার অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রনৈতিক রাজনৈতিক যাপনে। শুধু শাসক গোষ্ঠী নয়, সবাই। তাই সাধারণ মানুষকেও আমরা কখনো কখনো বলতে শুনি, এর থেকে ব্রিটিশ আমল ভালো ছিল।
স্বাধীন ভারতে আজ আমরা সর্বক্ষেত্রে যে ক্ষমতার এবং ধ্যানধারণার বাহুবিস্তার দেখছি তার মূলে আছে সেই উপনিবেশিকতা, যে উপনিবেশিকতা ইংরেজরা আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। তার কিছু কিছুর যেমন আমরা প্রতিরোধ করতে পেরেছি, তেমনি বহু কিছুর আবার শিকারও হয়েছি। এই দুটো নিয়েই আমাদের ইতিহাস। যেসব উপনিবেশিকতা আমাদের রক্তের মধ্যে এখনো থেকে গেছে সেসবের মাশুলই আমরা এখনো গুনছি। শুধু যে এই স্বাধীন ভারতেই গুনছি তা নয়, যখন থেকে আমরা বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্তির লড়াই লড়ছিলাম, তখন থেকেই গুনছি। তার পরিণামেই দেশভাগ, তার পরিণামেই প্রকৃতির ধ্বংস, তার পরিণামেই ক্ষমতার এই খেয়োখেয়ি, তার পরিণামেই আজকের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, তার পরিণামেই সাধারণ মানুষের প্রতি এই নিদারুণ অবহেলা। অতএব উপনিবেশিকতাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত এবং অনুধাবন করতে না পারলে এবং ঠিকঠাক বিচার করে তার বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের সমস্ত লড়াই সমস্ত প্রগতিশীলতা শেষপর্যন্ত পরিণত হবে লম্ফঝম্ফে, কিংবা আমার আর এক প্রিয় অধ্যাপক তথা প্রশাসকের ভাষায় ‘হল্লা’য় এবং তার গুণাগার দিতে হচ্ছে এবং হবে সাধারণ মানুষকে।
এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে বাংলাকেই উপনিবেশিকতার সমীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ধরার কারণ হল বাংলা দিয়েই ব্রিটিশের ভারত জয়ের শুরু। সে হিসেবে বাংলাতেই উপনিবেশিকতার প্রথম শেকড় গাড়তে শুরু করার কথা। কিন্তু বাংলায় উপনিবেশিকতার আলোচনাকালে জায়গাটার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলোকেও খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বাঙালি চরিত্রের গঠন ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার তুলনায় বেজায় আলাদা। ভৌগোলিক কারণে তার চরিত্রে যে মানসিক সংস্কারমুক্ততা, মানসিক স্বাধীনতা, বিচারশীলতা ইত্যাদি দেখা যায় সেগুলো আবার অন্য জায়গায় সেভাবে দেখা যায় না। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবিষয়ে নাতিবিস্তর আলোচনা করেছেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের গোড়ার দিককার কথা’ প্রবন্ধে। নদীর নিত্য ভাঙাগড়ার খেলাই বাংলার মানুষকে মানসিকভাবে সংস্কারমুক্ত ও স্বাধীন করে তুলেছে। প্রকৃতির হাতে মানব কীর্তির অহরহ ধ্বংস দেখে বাঙালির ভাবজগতেও পরিবর্তন সম্বন্ধে একটা সহনশীলতা এসে গেছে। তাই সে “ধর্ম চিন্তা বা সামাজিক জগতে পরিবর্তনের বিরোধী নয়, tradition বা চিরাচরিত রীতির চাপ থেকে তার মন অনেকটা মুক্ত।”২ ধর্মের দিক থেকে অনার্য বাংলা প্রধানত তন্ত্র ও মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের দেশও। এখানকার উচ্চতর শ্রেণিটির সঙ্গে আর্য-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আত্মিক সম্পর্কও অতি ক্ষীণ। এসব কারণেই বাংলার যে সংস্কৃতি তা আসলে অনেকটাই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধের সংস্কৃতি। সেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধের সংস্কৃতির সঙ্গে পরে ইসলামি সাম্যবাদের ধারণাও যুক্ত হয়ে যায় এবং সমন্বয় ও আত্মীকরণের ফলে উদ্ভব হয় উচ্চতর এক সংস্কৃতির। প্রশ্ন হল বাঙালির সমন্বয় ও আত্মীকরণের সেই সংস্কৃতি উপনিবেশিকতার কতটা প্রতিরোধ করতে পেরেছে অথবা সেই সংস্কৃতি কতটা উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছে।
আসা যাক উপনিবেশিকতার আলোচনায়। পুরোনো জানা কথাগুলোই একবার ঝালাই করে দেখা যাক প্রাক-উপনিবেশিক পর্বে আমরা কেমন ছিলাম এবং উপনিবেশিক শাসন পর্বে আমরা কেমন দাঁড়ালাম।
ভারতবর্ষে উপনিবেশিক শাসকের অর্থাৎ ব্রিটিশের প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্যের সূত্রপাত হয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলার ক্ষেত্রে লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত ধরে। জমি পণ্য হয়ে গেল। মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ব মুঘল যুগেও ছিল, তাদের কিছু কিছু অত্যাচারও ছিল, কিন্তু ছিল না জমির মালিকানা। জমির মালিকানা থাকত কৃষকের হাতেই, যদিও সীমাবদ্ধ। রাজার ক্ষমতা ছিল না কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করার, কৃষকের ক্ষমতা ছিল না জমি হস্তান্তর করার। অনেকে একে দ্বৈত মালিকানা বলেছেন।
সত্যের খাতিরে বলতে হবে ব্রিটিশ আমলে যেসব মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎপত্তি হল, তাদের সিংহভাগই ছিল হিন্দু। কেন সেকথায় পরে আসছি। এই মধ্যস্বত্বভোগী স্তরটি হলুম আমরা, ভদ্রলোকরা। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে ‘ভদ্রলোক’ শব্দটার কোনো অস্তিত্ব নেই। আগে আমরা ছিলাম কেউ বামুন, কেউ কায়েত, কেউ বদ্যি--উঁচু জাত, কিন্তু কেউ ভদ্রলোক ছিলাম না। আমরা ভদ্রলোক হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা, আগে যারা নিচু জাত হিসেবে অভিহিত হত, তারা হয়ে গেল ছোটলোক। এ এক নতুন অভিধা।
সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজকে ভদ্রলোক-ছোটলোকে এবং হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে দিতে পারাটা ছিল ব্রিটিশের দিক থেকে দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। জাত কী? মার্কসীয় দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত বন্টনের অসাম্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে যে সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রচলিত ছিল, তাকে আমরা জাত বলি। সমাজ যখন পুঁজিবাদের পথে হাঁটা দিল, তখন সেই পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার প্রয়োজনে প্রচলিত নিয়ন্ত্রণ ভেঙে ওপরের স্তরের জাতগুলো নতুন সংহত রূপ ধারণ করে ‘ভদ্রলোক’ হয়ে উঠল (নিচের স্তরের কেউ কেউ যে সে সৌভাগ্য অর্জন করেনি তাও নয়। রামপ্রসাদের গানে আছে—‘পান বেচে খায় কৃষ্ণপান্তি, তারেও দিলি জমিদারি’। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম)। জে এচ ব্রুমফিল্ড (১৯৬৩)৩ বঙ্গ বিধানসভার ১৯২১ থেকে ১৯২৬ সালের রাজনীতির ইতিহাস লিখতে বসে সবিস্ময়ে লক্ষ করেছিলেন, বাংলার প্রতিটি ক্ষেত্রের নেতৃত্বে একটি বিশেষ স্তরের লোকজনের সর্বগ্রাসী উপস্থিতি, যাদের ‘ভদ্রলোক’ বলা হয়। জনসংখ্যার তারা মাত্র ৫ শতাংশ এবং তাদের প্রায় সকলেই ছোটবড় জমিদার।
এ গেল জাত থেকে আমাদের যথাক্রমে একদলের ভদ্রলোকে উন্নীত এবং বাকিদের ছোটলোকে অবনত হয়ে যাবার গল্প। এই গল্পেরই আর এক পিঠে আছে আমাদের হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে যাবার গল্প। এই গল্পের ধরতাইটাও ইংরেজরাই সঙ্গে করে এনেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত ইয়োরোপের ইতিহাস ছিল মূলত খ্রিস্টানদের ইতিহাস। অটোমান সাম্রাজ্যের বাহুবিস্তারের পর থেকে ইয়োরোপীয় খ্রিস্টানদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে, যে বিষবাষ্প তারা উপনিবেশগুলোতেও ছড়িয়ে দিয়েছিল।
পলাশী যুদ্ধের আগে পর্যন্ত সামরিক এবং অসামরিক চাকরির ক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের একটা প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ১৭৬৫ সালে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি পাবার পরপরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুসলমান সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়। এর ফলে শুধু ওপরতলার কিছু কর্মচারীই বেকার হয়ে যায়নি, প্রচুর নিচুতলার কর্মচারীও বেকার হয়ে দারিদ্রের মধ্যে গিয়ে পড়ে। এর পর রাজস্ব বিভাগকেও তারা নিজেদের ধ্যানধারণা অনুযায়ী ঢেলে সাজানোর সময় প্রচুর মুসলমান কর্মচারীর কাজ যায়। সবথেকে বড় আঘাত আসে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে। বহু মুসলমান জমিদার তাদের জমিদারি থেকে উচ্ছেদ হয়। বলা বাহুল্য এই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল হিন্দুরা। ইংরেজরা এদেশে আসার প্রায় শুরু থেকেই মুসলমানদের অনুপস্থিতিতে একদল হিন্দু তাদের গোমস্তাগিরির দেওয়ানিগিরির মুৎসুদ্দিগিরির সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে যথেষ্ট অর্থের মালিক হয়ে গিয়েছিল। সেই অর্থই তারা জমিতে ঢালে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এই বাংলায় শুধু আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে ধ্বংস করেনি, হিন্দু মুসলমানে বিভেদের বীজও প্রথম বপন করেছিল। ঐ বছরই গ্রাম্য পুলিশ প্রথা তুলে দেওয়ার কারণে ঐ পেশায় বহাল থাকা প্রচুর মুসলমান আরো এক দফা বেকার হয়। মুসলমানদের আয়ের উৎস এবং সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেওয়াই ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ নীতি। আর, নিচু তলার লোকজনের যে দুটো প্রধান সম্বল ছিল অর্থাৎ কৃষি ও তাঁত, সেগুলো ইংরেজরা কীভাবে ধ্বংস করেছিল সে গল্প আমাদের সকলেরই জানা, তাই তার পুনরুক্তি এখানে করছি না। শুধু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে এইসব কৃষক ও তাঁতিদের বড় অংশটাই ছিল মুসলমান। খেয়াল করলে দেখা যাবে মুঘল শাসনের বিরোধিতা করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অছিলায় মুসলমানদের বিরোধী হয়ে উঠতে গোড়ার দিকে হিন্দুদের তারা যথেষ্ট তাতিয়েও ছিল, যার পরিণামে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের পাশাপাশি আমাদের একদল জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকও আমাদের ইতিহাসের মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করেন। ১৮৭০ সালের আগে পর্যন্ত ইংরেজরা মুসলমানদের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব টানা বজায় রেখেছিল, তার পর তাদের গুরুত্ব দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, সে কেবল তাদের ভাগ কর শাসন কর নীতির স্বার্থে, হিন্দুদের অপ্রতিহত গতিকে রোখার জন্যে, যেহেতু তা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের পক্ষে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল।
সামাজিক ক্ষেত্রে আরো দুটো বড় পরিবর্তন ঘটল। এক, বৃহত্তর সমাজের থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে থাকায় এবং পশ্চিমী ধারার প্রাবল্যে আমরা ভুলে গেলাম যে আমাদের দেশে সমাজ আগে, ব্যক্তি পরে। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র বর্ণাশ্রম প্রথা তৈরি করার সময় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জায়গাও তৈরি করেছিল, সে জায়গাটা হল সন্ন্যাস। কিন্তু আমাদের সামাজিক ভাবনাচিন্তায় এবং কাজেকর্মে যে উগ্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, তার চেহারাটা সন্ন্যাসীর নয়। দুই, আমরা ভুলে গেলাম যে আমাদের দেশে ‘সমাজকে যা ধারণ করে তাহাই ধর্ম’, মূলত সমাজপদ্ধতি বা জীবনধারা। খ্রিস্টধর্মের মত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয় যে ব্যবহারিক জীবন ও ধর্মীয় জীবন দুটো আলাদা খাতে বয়ে যাবে। এবং যদিও ইসলাম বাদে বাকি সব ধর্মেরই জন্ম বৈদিক ধর্মের বিরোধিতা থেকে এবং তাদের প্রতিষ্ঠাতা আছে, এদেশে তাদের পুষ্টি কিন্তু সমাজপদ্ধতি হিসেবেই। এমনকি প্রতিষ্ঠাতা থাকলেও ইসলামও এদেশে সমাজপদ্ধতি হিসেবেই বিকশিত হয়েছিল। ধর্মগুলির পারস্পরিক সমন্বয় ও আত্মীকরণের ওপর দাঁড়িয়েই এই সমাজপদ্ধতিগুলি গড়ে ওঠে। আরো বড় কথা, এইসব ধর্মের সমন্বয় ও আত্মীকরণের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় জনজীবন ও সংস্কৃতি। পশ্চিমী ভাবধারার অনুকরণে ধর্মনিরপেক্ষতা যে আমাদের দেশে অচল, আশিস নন্দী (২০০৭)৪ সেটা যথেষ্ট যুক্তিসহকারে প্রমাণ করেছেন।
ধর্ম নিয়ে কোনো আলোচনার ক্ষেত্র সাম্প্রতিক বাংলায় খুবই সংকীর্ণ। বেশির ভাগ পাঠকই এ ধরনের আলোচনা শুনতে চান না বা এসব বিষয়ে বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারেন না। আনুষ্ঠানিক ধর্মের ক্রিয়াকলাপ এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিকৃতি দেখে তাঁরা এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন যে ধর্মকেই তাঁরা জীবন থেকে বাদ দিয়ে ভাবতে চান। তাঁরা ঢাকিশুদ্ধু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। তাঁদের পশ্চিম-জারিত ধারণা হল ধর্ম অশিক্ষিত মূর্খ বোধবুদ্ধিহীন গেঁয়ো লোকেদের ব্যাপার। তাঁদের মধ্যে এ বোধ তৈরি হয়নি যে “নানা ব্যবহারিক কারণে আমাদের সামাজিক জীবনে যে জিনিসটি একটি বহুমূল্য লাভ করে তাহা আস্তে আস্তে একটা ধর্মমূল্য অর্জন করিয়া বসে। দেখা যায়, যাহাকে অবলম্বন করিয়া আমাদের সমাজচিত্তের কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবন তাহারই ধীরে ধীরে আমাদের ধর্মবস্তু বা ধর্মানুষ্ঠানে রূপান্তর।” (শশীভূষণ দাশগুপ্ত; ১৩৯৯ বাং)৫ কোটি কোটি মানুষের ধর্মপ্রাণতাকে এই যে কতিপয় লোক মিলে নস্যাৎ করে দিতে চান এই প্রতিক্রিয়াটা অনেকটা ঊনবিংশ শতাব্দীর ইয়ং বেঙ্গলি প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ। কায়েমি স্বার্থের হাতিয়ার ধর্মের বিপরীতে জনগণের লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবেও যে ধর্মের বড় ভূমিকা ছিল সে ইতিহাসে তাই তাঁরা কখনো মনোনিবেশ করেননি। এলিট শ্রেণির মধ্যে এই বীতশ্রদ্ধা ছড়িয়ে দেবার ব্যাপারে উপনিবেশিকতার কি কোনো ভূমিকা আছে? বোধহয় আছে। বাপকাকাদের কাছে শুনেছি স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে ছেলেদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে ব্রিটিশরাই সেই সময় জেলের মধ্যে বামপন্থী ভাবধারার বই চালান করেছিল। এবং অনেকেই জেল থেকেই বামপন্থী হয়ে ওঠেন। নিপীড়িত জনগণের হাতিয়ার হিসেবে বামপন্থার তুলনা নেই, কিন্তু বদহজম হওয়া সেই বামপন্থা থেকেই নিজের দেশ ও তার ধর্ম-সংস্কৃতি সম্বন্ধে এই বীতশ্রদ্ধার ও অজ্ঞতার যে উৎপত্তি তাও অস্বীকার করার নয়।
ব্রিটিশের তৃতীয় তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য হল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মধ্য বা এই ভদ্রলোক শ্রেণিটির পোষণ। এই ভদ্রলোক শ্রেণিটিকে অতঃপর নিজেদের প্রয়োজনমত গড়েপিটে নেওয়ার কৌশলের রূপরেখা তৈরি করলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, যিনি বলেছিলেন যে ইয়োরোপের লাইব্রেরির একটা তাক গোটা ভারতবর্ষ ও আরব দেশের মোট সাহিত্যের সমান আর যাঁর সম্পর্কে কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, “systematic falsifier of history”৬। তিনি আমাদের বশংবদ শ্রেণি হিসেবে গড়ে তোলার উপায়স্বরূপ প্রথমত ইংরেজি ভাষা শেখানোর ওপর জোর দিলেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজদের অন্যান্য আদতগুলোও আমাদের গ্রাস করতে শুরু করল। পরিণামস্বরূপ সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আমরা দেশের বাকি লোকজনের থেকে আলাদা হতে শুরু করলাম। বাংলা সাহিত্যের দাদামশাই কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৭) লিখেছিলেন, “কেরাণীদের নিত্য কলিকাতায় যাতায়াতের সঙ্গে সঙ্গে, পল্লীগ্রামে নব নব ভাবের অভ্যুদয় আরম্ভ হইয়া,--অশিক্ষিত ইতর সাধারণের সখ্য-বন্ধন হইতে ক্রমেই আমাদের স্বতন্ত্র করিয়া দিতেছিল, এবং তাহারা ‘ছোটলোক’ আখ্যা পাইতেছিল।”৭ আমাদের চোখে মুসলমানরাও গিয়ে পড়ল ছোটলোকদেরই দলে, কারণ ইংরেজ শাসনের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষের কারণে তখন তারা ইংরেজের সমস্ত কিছুকেই এড়িয়ে চলত, এমনকি ইংরেজি ভাষা শিখতে চাওয়াটাও। আর ভদ্রলোক মানেই ইংরেজনবিশী।
সমাজ-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইংরেজরা বাঙালিদের আরো একটা বড় ক্ষতি করে দিয়ে গেছে। বিশেষ করে ১৮৬০ সালের পর থেকে ইংরেজদের নজরে বিষ হয়ে উঠতে শুরু করে বাঙালিরা। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে তারা ক্রমশই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে চলেছিল এবং সিভিল সার্ভিসে তাদের যোগদানকে ঠেকানোটা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছিল। অতএব এই সময় থেকে তারা এ কথা প্রচারে আনতে শুরু করল যে “পরীক্ষা পাশ করার ব্যাপারে খুবই দক্ষ ও মেধাবী হলেও সুশাসক হবার কোনও গুণই তাদের নেই। সাহস, ক্ষিপ্রতা, কর্মনৈপুণ্য ও আত্মনির্ভরতা ইত্যাদি যে সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য অসংখ্য ইংরেজ সুদক্ষ প্রশাসক হতে পেরেছেন, বাঙালীদের মধ্যে তার একান্ত অভাব।”—লিখেছেন স্বয়ং বড়লাট জন লরেন্স। এই উদ্ধৃতি তুলে দিয়ে অমলেশ ত্রিপাঠী (১৯৮০) লিখেছেন, “....যথেষ্ট যত্ন সহকারে পঞ্জাবী ও পাঠানদের মতো ‘বলিষ্ঠ জাতি’, ‘পরিশ্রমী জাতিগুলিকে’ ‘রমণী-সুলভ কোমল-স্বভাব’ বাঙালীদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছিল, এমন কি বুদ্ধিমান বাঙালীদের ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে বিদেশী বলে বর্ণনা করা হচ্ছিল। বাঙালীর গুণগ্রাহী চার্লস ট্রেভেলিয়ানের পুত্র জি. ও. ট্রেভেলিয়ান বাঙালীদের মিথ্যুক বলতেও দ্বিধা করলেন না।”৮ বুঝতে অসুবিধে হয় না স্বাধীন ভারতে সর্বভারতীয় স্তরে এই যে বাঙালি-বিদ্বেষ বা বাঙালিকে অবহেলা করার একটা প্রবণতা আমরা দেখছি, তার উৎস কোথায়।
তবে এই সঙ্গে এটাও বলতে হয় যে বাঙালি হিন্দুরাও খুব ধোয়া তুলসিপাতা নয়। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের উন্নাসিকতার অনুকরণ করে তাদের সঙ্গে সমমর্যাদার আসন পাবার লোভে অন্যান্য জাত বা ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের মনোভাব থেকে আমরাও নিজেদের মুক্ত করতে পারিনি। আমাদের শব্দভাণ্ডারে ‘উড়ে-মেরো-খোট্টা’ বা মুসলমানদের সম্পর্কে ‘কাটা বা কাটুয়া’ শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার তার প্রমাণ। সাহেবদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচারেও আমরা কিছু কম যাইনি। এই তাচ্ছিল্য ও অত্যাচারের ফল হয়েছিল এই যে একটা সময় বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি সত্তা থেকে নিজেদের আলাদা করে নিয়েছিল। জীবনতারা হালদার ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা’য় (১৯৮৯)৯ অভিযোগ করেছিলেন যে তখন মুসলমানরা বাঙালি বলতে শুধুমাত্র হিন্দুদের বুঝত এবং নিজেদের পরিচয় দিত মুসলমান হিসেবে। আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে ভাগের এই ষড়যন্ত্র শেকড়ে পৌঁছতে পারেনি। গত পঞ্চাশ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় ঐতিহাসিক দিক থেকে যদি কোনো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে থাকে তা হল বাংলাদেশের স্বাধীন হয়ে যাওয়া--হিন্দু-মুসলমান ভিত্তিতে নয়, বাঙালি সত্তার পরিচয়ে। এর জন্যে অবশ্যই আমাদের ওপার বাংলার মানুষগুলোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
সাধারণভাবে দেখলে প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে প্রদেশগুলোর অধিবাসীদের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে পারস্পরিক অসম্মানসূচক কিছু শব্দের চল ছিল, যেমন উত্তর ভারতে খুব প্রচলিত ছিল একটা কথা—‘বঙ্গালি জেঞ্জালি, কাশ্মিরী বিপীরী’ অর্থাৎ বাঙালিরা হল ঝঞ্ঝাটে জাত আর কাশ্মিরীরা বিধর্মী। কিন্তু সেসব বাচালতার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না। এসব মনোভাবকে ইংরেজরাই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।
রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা হয়ে গেলাম ইন্ডিয়ার অধিবাসী এবং প্রায় ভুলতেই বসলাম যে আমরা আসলে যে দেশটার লোক ছিলাম, তার নাম ছিল ভারতবর্ষ, ব্রিটিশের হাতে গড়া ইন্ডিয়া নয়। তার আদলটা যেরকম ব্রিটিশের তৈরি আদলের থেকে আমূল আলাদা ছিল, তেমনি তার ইতিহাসের চলনটাও ব্রিটিশের তৈরি ইতিহাসের চলনের থেকে আমূল আলাদা ছিল। ভারতবর্ষ কোনো দেশ ছিল না, এটা ছিল একটা ধারণা, একটা সংস্কৃতির ধারা, কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে সেই ধারণার সেই সংস্কৃতির ধারার বশবর্তী হয়ে পথ চলতে আমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামে পাই—“জেই জন চন্দনে করে হরিসঙ্কীর্তন/ভারথমণ্ডলে তার সফল জীবন।”১০
ভারতবর্ষ অন্তত তিনটি বিষয়ে পশ্চিমী দেশগুলোর থেকে আলাদা ছিল। এক, এটা ছিল একটা মূল্যবোধকেন্দ্রিক সভ্যতা, ক্ষমতা ও বিত্তকেন্দ্রিক নয়। দুই, এটা ছিল একটা সমাজকেন্দ্রিক সভ্যতা, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়। তিন, এটা ছিল একটা কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতা, শিল্পকেন্দ্রিক নয়। ইংরেজদের হাতে পড়ে এই তিনটে বৈশিষ্ট্যই চুলোয় গেল। আমরা ক্রমশ ভোগবাদে ঢুকে পড়লাম। সমাজকে কমজোরি করে ক্রমশ রাষ্ট্রনির্ভর হয়ে উঠতে লাগলাম। এবং যদিও সভ্যতাটা এখনো কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতা, তথাপি এটাকে শিল্পকেন্দ্রিক করতে উঠে পড়ে লাগলাম। ১৯২১ সালের জনগণনা অনুযায়ী অবিভক্ত ভারতে গ্রাম ছিল ৬,৮৫,৬৬৫ ১১ যখন নাকি বাংলা ও পঞ্জাব দুইই অখণ্ড ছিল। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী খণ্ডিত বাংলা ও পঞ্জাব সমেত স্বাধীন ভারতের গ্রাম ৬,০০,০০০ ১২ যেসব গ্রামের মূল নির্ভর এখনো কৃষি এবং শিল্প এখনো কৃষির সঙ্গে হাত মিলিয়েই পথ চলা দাবি করে। অর্থাৎ গত পৌনে একশ বছরে সেই কাঠামোর বিশেষ বদল ঘটেনি। বদলে গেছে আমাদের এলিট শ্রেণির চাওয়াটা।
তার ওপর ইংরেজরা ভারতবর্ষকে একটা নির্দিষ্ট পরিধির গণ্ডিতে বেঁধে দেশটাকে রাজনৈতিকভাবে একটা রাষ্ট্রে পরিণত করল, আর আমরা তাকে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করতে উঠে পড়ে লাগলাম। অথচ যে দেশে বহু ভাষা বহু ধর্ম বহু জাতের লোকের বাস, জাতিরাষ্ট্রের ধারণা সে দেশে খাটে না। রাষ্ট্র বলতে যদি রাজ্যশাসন প্রণালী বোঝায়, সেটা ভারতবর্ষে সবসময়ই ছিল, ছিল না গণ্ডিবদ্ধ রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ধারণা। দেশটা যখন গণ্ডিবদ্ধ রাজনৈতিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেল, তখন পশ্চিমী ধারণার অনুবর্তন করে আমরা জাতীয়তাবাদের যাঁতাকলে পা দিলাম। এবং জাতিরাষ্ট্র গঠনের অভীপ্সায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম হল। বিজ্ঞরা জানেন জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা মোটেই ভালো ছিল না। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “এক মস্ত বড় আপদ।”১৩ গান্ধীজির স্বরাজের সঙ্গেও জাতীয়তাবাদের ধারণার মৌলিক পার্থক্য আছে।১৪
আমরা কখনো খুঁটিয়ে দেখিনি পশ্চিমের সঙ্গে প্রাচ্যের আমাদের মূল তফাতগুলো কী কী? ভারতীয় সমাজসাধনার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা, সহজ সরল জীবন, নির্লোভিতা, শান্তিপ্রিয়তা, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর পশ্চিমের রাষ্ট্রসাধনার ভিত্তি ছিল প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব, ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ, মুনাফা, যুদ্ধের প্রবণতা, জাতীয়তাবাদ। আমাদের দেশে যেসব চিন্তানায়করা নিয়ত পূব-পশ্চিমকে মেলানোর সাধনা করে গেছেন, উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার কারণে তাঁরা অনেক সময়ই এই তফাতগুলোর দিকে সম্যক দৃষ্টি রাখতে পারেন নি।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিলিতি হুইগ ধারার রাজনীতিই হয়ে উঠল আমাদের আদর্শ, যে কারণে বিখ্যাত হুইগ এডমন্ড বার্ক ভারতীয় রাজনীতিতে অভাবিতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির ‘A Nation in Making’ পড়লেই এ কথার সত্যতা বোঝা যাবে। মনে রাখতে হবে লর্ড কর্ণওয়ালিশ, লর্ড মেকলে, লর্ড বেন্টিংক এঁরা সবাই ছিলেন হুইগ।
বিশেষ করে তরুণ পাঠকের জন্যে এখানে ছোট্ট করে বলে নেওয়া উচিত হুইগ কি। এককথায় হুইগ হচ্ছে নরমপন্থী উদারতাবাদ। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে এটা ছিল রাজার সর্বময় কর্তৃত্বের জায়গায় সংসদের সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, নিজেরাও যেহেতু প্রোটেস্টান্ট, তাই বিরোধী প্রোটেস্টান্টদের প্রতি নরম মনোভাব গ্রহণ দেখানো এবং পোপতন্ত্রবাদী পৌত্তলিক রোমান ক্যাথলিকদের বিরোধিতা করা। পোপতন্ত্রবাদীদের বিরোধিতা করার বড় কারণ ছিল পোপতন্ত্র মানেই ছিল সৈন্যশাসন ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা। আমাদের দেশে হুইগ আদর্শ এসে পৌঁছেছিল এডমন্ড বার্কের লেখালেখির মাধ্যমে। বার্ক ছিলেন হুইগ ধারার এক রক্ষণশীল উদারতাবাদী চিন্তাবিদ। তিনি এলিটদের স্বাভাবিক নেতৃত্বের পক্ষে জোর ওকালতি করেছিলেন, জনগণের রাজনৈতিক অক্ষমতার কথা বলেছিলেন, বাসিন্দাদের যে এলিট অংশটিকে নাগরিক সমাজ বোঝায় সেই নাগরিক সমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এবং সর্বোপরি সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আদর্শ রাষ্ট্রের ছাঁচে ঢেলে সামাজিক প্রগতির লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন।
দুটো কারণে বার্ক ভদ্রলোকদের বিশেষ প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের কাজকর্ম (Speeches of Edmund Burke on the Impeachment of Warren Hastings) নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি আগেই ভদ্রলোকদের মন জয় করেছিলেন। বিজেতাদের (মানে শাসক ইংরেজদের) সমালোচক আমাদের বন্ধু--এই ছিল বার্কপ্রিয়তার যুক্তি। তার ওপর এলিটদের স্বাভাবিক নেতৃত্বের পক্ষে বার্কের ওকালতি বার্কপ্রিয়তাকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ১৮৯৫ সালের কংগ্রেস অধিবেশনে জনগণের নয়, শিক্ষিত শ্রেণির একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে তাতে সেইসব শিক্ষিতদের নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন, “who by reason of their culture and enlightenment, their association with English ideas and their familiarity with the English model of government might be presumed to be qualified for such a boon.”১৫
মূলগতভাবে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিশ্বস্ত আবেদন নিবেদনের এই নরমপন্থী রাজনীতি কিন্তু বাংলায় বেশিদিন ধোপে টেঁকেনি। বাংলায় আগাগোড়াই প্রচ্ছন্নভাবে একটা চরমপন্থী আবহাওয়া ছিল। এই চরমপন্থী আবহাওয়ার ধারকবাহক ছিল রাজনীতি নয়, ধর্ম--শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্ম। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আমাদের মনন ধর্মকে আশ্রয় করেই ক্রিয়াশীল ছিল। ‘প্রবুদ্ধ ভারত’এ বিবেকানন্দ স্মৃতিচারণে কামাখ্যানাথ মিত্র লিখেছিলেন, “এখন যেমন সবাই খুব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়, আমাদের সময় সবাই খুব ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাত।”১৬
তন্ত্রচর্চা দেবীকেন্দ্রিক। তন্ত্রচর্চার উদ্ভব সম্ভবত হিমালয়ের পাদদেশ জুড়ে যেসব দেশ সেইসব দেশে—কাশ্মীর থেকে বাংলার প্রাগার্য সমাজের মধ্যে, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। শাক্ত ধর্মের উত্থান খুব সম্ভবত মধ্যযুগে, অন্তত এ এল ব্যাসাম (১৯৮৬)১৭ সেরকমই অনুমান করেছেন। ভারতেতিহাসের গোড়া থেকেই দেবীরা ছিলেন, কিন্তু ছিলেন প্রধানত পুরুষ দেবতাদের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে। কিন্তু মধ্যযুগে যখন বড় বড় সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করল এবং তাদের জায়গায় সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হল, তখন থেকেই সম্ভবত শক্তির দেবী হিসেবে আলাদা করে তাঁদের অর্চনা গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এই শক্তিসাধনায় সন্তান ভাবের মধ্যে বীরভাবে সাধনাও ক্রমশ মিলেমিশে যেতে শুরু করে। সন্তানভাবে সাধনার মূল লক্ষ্য ছিল বিপদের রক্ষয়িত্রী হিসেবে দেবীর সাধনা, বীরভাবে সাধনায় লক্ষ্য হয়ে উঠল বলদায়িনী রূপে দেবীর সাধনা।
শশীভূষণ দাশগুপ্তের (ঐ)১৮ মতে, শক্তিসাধনা বাংলায় অনেক আগে থেকে প্রচলিত থাকলেও সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই নবরূপ লাভ করেছে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। তার আগে অব্দি এখানে ছিল চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য। সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ বাংলায় মূল ধারার বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব কমতে শুরু করে এবং এর সারবস্তু বাংলার তন্ত্র এবং ইসলামের সঙ্গে মিলেমিশে লৌকিক সমাজে নানা ধারায় ছড়িয়ে পড়ে নিজেকে রক্ষে করার চেষ্টা করে। মুঘল আমলের পতন এবং ইংরেজ শক্তির উত্থানের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধিক্ষণে মূল বৈষ্ণব ধর্মের অনুপস্থিতিতে শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্ম আবার মাথা চাড়া দেয় এবং সম্ভবত এসময় থেকেই সন্তানভাবে শক্তিসাধনার পাশাপাশি বীরভাবে শক্তিসাধনাও সমধিক গুরুত্ব পেতে শুরু করে। এখানে একটা কথা অবশ্যই বলা দরকার। বৈষ্ণব ধর্মের সারবস্তু লোকসমাজে নানা সমন্বয় ও আত্মীকরণের মধ্যে দিয়ে বিচিত্র বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ করে নিজেকে রক্ষে করার যেসব চেষ্টা করছিল সেসব চেষ্টার মধ্যে অনেক পথের খোঁজ ছিল, কিন্তু একথা ঠিক যে দীন ও দাস্যভাবের সেই সাধনা মানুষে মানুষে ঐক্যের ভিত মজবুত করলেও সমাজটা যেন কিছুটা এলিয়ে পড়েছিল বা বলা যায় প্রাণশক্তির একটা অভাব ঘটেছিল। সম্ভবত সমাজে প্রাণশক্তির সঞ্চারে বীরভাবে শক্তিসাধনা একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। তাই দেখি একদিকে ইংরেজদের স্তাবক রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর প্রজাদের কালীর আরাধনায় উৎসাহ যোগান, অপরদিকে চুয়াড় বিদ্রোহীরাও সেই একই কালীর আরাধনা করে।১৯
বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের ইতিহাসে নিবিষ্টভাবে চোখ রাখলে দেখব ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তার ইতিহাস টানা ধর্মের মাধ্যমে লড়াইয়ের ইতিহাস। এই উপাদান সম্পূর্ণ দেশজ উপাদান। শুরু থেকে মহাযানী বৌদ্ধ ধর্ম ও পরে তারই উপজ সহজযানের হাত ধরে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধকল্পে, তারপর শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে বৈষ্ণব ধর্মের মাধ্যমে—সেও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতিরোধকল্পে, এবং শেষে শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্মের মাধ্যমে একাধারে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও বিদেশী শাসনের প্রতিরোধকল্পে। এই শাক্ত-তান্ত্রিক ধর্ম থেকে কিভাবে ‘মা’ শব্দটাকে গ্রহণ করা হল এবং দেশের সঙ্গে তাঁকে একাকার করে দিয়ে দেশমাতৃকার মূর্তি বানানো হল তার ইতিহাসে যথাসময়ে আসা যাবে। আপাতত ‘বিদেশী’ শব্দটা নিয়ে দুচার কথা বলে আমরা রামমোহন প্রসঙ্গে ঢুকি।
সম্প্রতি ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়২০ দেখিয়েছেন, যে প্রাক-ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ‘স্বদেশী-বিদেশী’ বলে কিছু ছিল না। কথাটা ঠিকই। এই ভাগগুলো এসেছে জাতীয়তাবাদের সূত্র ধরে। অর্থাৎ এটাও উপনিবেশিকতার অবদান। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতবর্ষে মানুষে মানুষে ভাগের বিচার হত চতুর্বর্ণের ভিত্তিতে, স্বদেশী-বিদেশী নয়। স্বদেশী-বিদেশী হিসেবে দেখলে তো বাংলাও বিদেশ, কারণ যেসব দেশ আর্যাবর্তের চতুর্বর্ণের অনুসারী নয়, তারাই ছিল ম্নেচ্ছদেশ। ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দের হরিচরণ-কৃত অর্থ হল—“অব্যক্তভাষী, যে সংস্কৃতে কথা বলে না; অনার্যজাতি, বৈদেশিকজাতি।”২১ তবে মধ্যযুগে বিদেশী শব্দটা আমাদের এখানে যে চালু ছিল, স্বদেশী-বিদেশী অর্থে নয়, নিতান্তই বাণিজ্যসূত্রে যাতায়াতের অর্থে, কেননা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামে পাই—“দিসী সাধু হইল বধূ/না আইল বৈদিসী সাধু/দেখিতে দুর্লভ হইল গুয়া।”২২ সাধু এখানে সওদাগর অর্থে। এক জনপদের লোকের কাছে তার নিজের জনপদটা ছিল দেশ (‘স্বদেশ’ নয় কিন্তু), অন্য জনপদ ছিল বিদেশ। সহজেই অনুমেয় কেন বাঙালি বণিকের মানদণ্ডের মধ্যে অন্যায় কিছু দেখেনি।
অতএব বণিকের মানদণ্ডের মধ্যে রামমোহনও যে অন্যায় দেখেন নি তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু রামমোহন চোখের সামনে বণিকের সেই মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হতে দেখেছিলেন। এবং সে শাসনের চেহারা তাঁর ভালো লাগে নি। তাঁর স্বলিখিত সংক্ষিপ্ত জীবনীতেই আছে, “পরিশেষে বৃটিস্ শাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাবশতঃ আমি ভারতবর্ষের বহির্ভূত কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করিয়াছিলাম।”২৩ তবু তাকে তিনি স্বাগত জানালেন কেন? ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে রামমোহনের মত বিতর্কিত চিন্তানায়ক বোধহয় দুটি নেই। গত দেড়শ বছর ধরে তাঁকে ডান-বাম সব ধরনের কঠোর সমালোচনার সামনে পড়তে হয়েছে। একদিকে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৯৮৪)২৪ রামমোহন নামক কিংবদন্তীর গোড়ায় আঘাত করে বলেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীকে যেসব কারণে নবযুগ বা নবজাগরণের কাল বলা হয়, সেই রাজনৈতিক নবজন্ম, জাতীয় চেতনার উন্মেষ এবং দেশাত্মবোধের পুষ্টি, কোনোটারই উৎসমুখ হিসেবে রামমোহনকে গণ্য করা যায় না, বরঞ্চ সে সম্মান অনেক বেশি প্রাপ্য ডিরোজিওর। যে লোক ফরাসি বিপ্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন, যে লোক দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশগুলির মুক্তিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন, সেই একই লোক কী করে নিজের দেশের উপনিবেশ থাকা আন্তরিকভাবে চাইতে পারেন, এ প্রশ্ন তিনি তুলেছেন। অপরদিকে গত শতাব্দীর সত্তরের ধারার একদল বামপন্থী ঐতিহাসিকের অভিমত এই যে “ব্রিটিশ-শক্তিনির্ভর দেশীয় বণিক-জমিদারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে রাজার চিন্তায় ও কর্মে। সামন্ত-স্বার্থ ও বণিক-স্বার্থের প্রতিনিধি রাজা রামমোহনের চিন্তাধারায় ও কর্মকাণ্ডে ছিল স্ববিরোধিতা এবং সে কারণেই উনিশ শতকের হিন্দুসমাজ-সংস্কার আন্দোলন সার্বিক পরিবর্তনের জন্য বাংলার গ্রামগুলিকে উদ্দীপিত করতে পারেনি।” (কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, ১৯৮৬)২৫।
রামমোহনকে ঘিরে ইতিহাসে যে জট পাকিয়ে আছে সেই জট খোলা এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নয়। আমরা বরং উপনিবেশিকতার দিক থেকে রামমোহনের কাজকর্মের অসংগতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করে দেখতে পারি।
আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের রচনায়২৬ পাই, রামমোহন ছিলেন তুলনামূলক ধর্মের এক অতুলনীয় ছাত্র। ইসলাম, আর্য–ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মের তুলনামূলক গভীর অধ্যয়ন এবং ভ্রমণকালে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সঙ্গে সম্যক পরিচিতির মধ্যে দিয়েই তিনি বিশ্বজনীনবাদে পৌঁছেছিলেন। তাঁর ছিল এক সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গি। আচার্য শীলের মতে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি এই সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেছিলেন। কী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, কী সামাজিক ক্ষেত্রে, কী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, কী রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে, কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। দিলীপ কুমার বিশ্বাসের২৭ মতে, একমাত্র ব্রজেন্দ্রনাথ শীলই তাঁকে ঠিকঠাক ধরতে পেরেছিলেন। তিনি আফশোষ করেছেন যে আচার্য শীল এ নিয়ে বিস্তৃতভাবে কিছু লেখেননি। সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থই ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি। অতএব আচার্য শীলের ইঙ্গিতকে শিরোধার্য করে আমরা বিশ্লেষণের পথে এগিয়ে দেখতে পারি কোথায় পৌঁছই। কিন্তু রামমোহনের দৃষ্টিভঙ্গি কি শুধুই সমন্বয়মূলক ছিল? প্রশ্ন হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে এবং কিসের কিসের সমন্বয়? আচার্য শীল অবশ্য তার উত্তরও দেবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বিশ্লেষণে রামমোহন নিছক তত্ত্ববিদ ছিলেন না, ছিলেন একাধারে তত্ত্ববিদ এবং প্রখর বাস্তববাদীও। তাই জন ডিগবিকে তিনি লিখতে পারেন, হিন্দু ধর্ম বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তা দিয়ে জনগণের পক্ষে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষে করা সম্ভব নয় এবং তাদের সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য আসাও সম্ভব নয়। অরবিন্দ পোদ্দার২৮ দেখিয়েছেন যে রামমোহন শুধু সমন্বয়বাদী ছিলেন না, ছিলেন উপযোগবাদী এবং শ্রেয়োবাদীও। ঘটনা হচ্ছে ভারতীয় জীবনধারায় উপযোগবাদ বা শ্রেয়োবাদের অস্তিত্ব (চার্বাক) ছিল না তা নয়, কিন্তু তা কখনো জীবনের আদর্শ লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়নি। চার্বাক দর্শন সম্ভবত মূলগতরূপে খুবই উজ্জ্বল ছিল, এবং সেই অবিকৃত মূল দর্শনের সঙ্গে আমাদের সম্যক পরিচয় না থাকার ফলে এ নিয়ে কেউই খুব বেশি কিছু বলতে পারেন না, তবে মোটামুটিভাবে আন্দাজ করা হয় সমাজ শৃঙ্খলা এবং নৈতিক দায়িত্বকে খাটো করে দেখার কারণেই চার্বাক দর্শন গৃহীত হয়নি।২৯ চার্বাক দর্শন সম্ভবত দর্শনের সেই প্রারম্ভিক যুগেই ব্যক্তিকে সমাজের ওপরে ঠাঁই দেবার চেষ্টা।
প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে সবাই রামমোহন নন। কুমুদ কুমার ভট্টাচার্যের কথার খেই ধরে বলা যায় যে সামন্ত-স্বার্থ বা বণিক-স্বার্থ সেসময় আরো অনেকের ছিল, কিন্তু তাঁরা কেউ রামমোহন হয়ে ওঠেননি। একটা বৃহত্তর কিছুর প্রেরণাই রামমোহনকে রামমোহন করেছিল। হতে পারে সামন্ত-স্বার্থ বা বণিক-স্বার্থ তাঁর দৃষ্টিকে কিছুটা আচ্ছন্ন করেছিল, কিন্তু তাঁর স্ববিরোধিতাগুলির বিচারের ক্ষেত্রে সেগুলিকে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
একটা আধটা উদাহরণ নেওয়া যাক। যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। রামমোহন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে ছিলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল এতে করে রাজ্যের উপকার হয়েছে। এক, পতিত, জংলা, অনাবাদী জমিগুলোতেও চাষবাস আরম্ভ হয়েছে। জমির উন্নতির ফলে যে আয়বৃদ্ধি হবে তার জন্যে রাজস্ব বাড়বে না বলেই চাষীরা জমির উন্নতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যেসব জায়গায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছে সেসব জায়গায় জমির আয় অনেক বেড়েছে। তার ফলে পণ্যদ্রব্যের ওপর আমদানি রপ্তানি শুল্কও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। তাতে সরকারেরও আয় বৃদ্ধি হয়েছে। রাজস্ব নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, প্রাচীন ভারতে জমি ব্যক্তিগত, পরিবারগত বা গ্রাম্য সম্পত্তি ছিল, রাজা স্বত্বাধিকারী ছিলেন না। মুসলমান আমলে তাঁরা বিজয়ী বলে জমির ওপর স্বত্ব স্থাপন করেছিলেন। তখন জমির ওপর চাষী এবং রাজা উভয়েরই স্বত্ব ছিল। এবং মোঘল আমলে জমির ওপর চাষী, জমিদার এবং রাজা তিনেরই স্বত্ব ছিল। চাষীদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্যে জমিদাররা শতকরা দশ কিংবা এগারো টাকা পেতেন। ইংরেজ আমল সম্পর্কে রামমোহনের অভিমত এই যে, তাঁরাও যেহেতু বিজয়ী, জমির ওপর তাঁদের স্বত্বাধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। তাঁর মতে, লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেকটাই মুঘল আমলের সদৃশ। তফাতের মধ্যে শুধু এই যে রাজার স্বত্ব আরো স্পষ্ট হয়েছে এবং জমিদারদের স্বত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয়, প্রজাদের জমিদারদের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়। জমির ওপর তাদের স্বত্ব নেই। এটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যাপারে রামমোহন চেয়েছিলেন, এক, জমির ওপর প্রজার দখলীস্বত্ব থাকা দরকার (বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন তাঁর এই চাওয়া খানিকটা পূরণ করেছিল)। দুই, শুধু সরকারের সঙ্গে জমিদারদের নয়, কৃষকের সঙ্গেও জমিদারদের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থাকা দরকার। অর্থাৎ খাজনার ঊর্ধ্বসীমাটা চিরস্থায়ী হওয়া দরকার। এইজন্যে দরকার যে জমির বা চাষের উন্নতি করলেই জমিদার যদি খাজনা বাড়িয়ে চলেন, তাহলে জমির বা চাষের উন্নতিতে চাষীর কোনো আগ্রহ থাকবে না। ৩০
আগে রামমোহনের ইতিহাসপাঠের ভুলগুলো দেখে নেওয়া যাক। ইংরেজ আমলেই প্রথম পতিত, জংলা এবং অনাবাদী জমিতে চাষবাস আরম্ভ হয়েছে রামমোহনের এ বক্তব্য অনৈতিহাসিক। ইটন ৩১ (১৯৯৭) দেখিয়েছেন, ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল আমলে গঙ্গার মূল স্রোতের পদ্মার দিকে চলে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশের দিকের জমি অনেক বেশি উর্বরতা পায় এবং ক্রমে জঙ্গলে ভরে ওঠে। সেইসব পতিত, জংলা ও অনাবাদী জমিকে আবাদী করতে স্থানীয় মানুষদের উৎসাহিত করেছিলেন একদল পিরগাজী। তাঁদের অনুগামী হয়ে যাওয়া ঐসব জায়গার লৌকিক সমাজই পরবর্তীকালে বাঙালির মুসলমান অংশের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। স্বত্বের ব্যাপারেও রামমোহনের বক্তব্য ঠিক নয়। প্রাচীন থেকে মধ্যযুগে কোনো একটা সময় চাষী এবং রাজার দ্বৈতস্বত্বের উদ্ভব হলেও মুঘল আমল পর্যন্ত সেটা ছিল মালিকানা-স্বত্ব। দুপক্ষের দিক থেকেই সীমায়িত সেই মালিকানা-স্বত্বের বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে রাজা যেমন চাষীকে কখনো জমি থেকে উৎখাত করতে পারবেন না, তেমনি চাষীও কখনো জমি হস্তান্তর করতে পারবে না। জমিদারদের কোনো স্বত্ব ছিল না। রামমোহন নিজেই বলেছেন, তারা কর আদায়ের জন্যে শতকরা দশ কিংবা এগারো টাকা পেত। সেটা কোনো স্বত্বের ব্যাপার নয়। তাঁর নিজেরই বক্তব্য অনুযায়ী, ইংরেজ আমলে জমিদারদের স্বত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই স্বীকৃতি আগে ছিল না। এবং তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে চাষীদের কোনো স্বত্ব অবশিষ্ট নেই, তাই তিনি তাদের দখলী-স্বত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রামমোহনের বক্তব্যে প্রথমেই যেটা পীড়া দেয় সেটা হল রামমোহনের ভাবনায় কৃষকের ঠাঁই সবার নিচে। আরো একটা কথা পীড়া দেয়, বিজয়ী রাজার স্বত্বাধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। এখানে যে তাঁর ভাবনা সামন্ততান্ত্রিক যুগের ভাবনা দ্বারা সীমায়িত তা অস্বীকার করার নয়। আরো বেশি সীমায়িত এই কারণে যে তিনি নিজে এবং তাঁর পরিবার ছিল সেই সামন্ততন্ত্রেরই অংশ। কিন্তু তিনি যেমন সামন্ত যুগের অন্তিম লগ্নের লোক, তেমনি ইংরেজ যুগের প্রারম্ভিক লগ্নের লোকও। ইংরেজ আমলকে তিনি খোয়াতে চান না, আবার দেশের লোককে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতেও চান। অতএব তিনি সেইমত সমাধানসূত্র খুঁজেছেন। সেই সমাধানসূত্র হল তাঁর বিবেচনায় কৃষকদের দখলীস্বত্ব এবং কৃষক ও জমিদারদের মধ্যে অনুরূপ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এটা হতে পারে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কথিত রামমোহনের সমন্বয়মূলক দৃষ্টিভঙ্গির একটা নমুনা। একটু খেয়াল করলেই দেখব সামন্ত-স্বার্থ এবং বণিক-স্বার্থ দ্বারা রামমোহনের দৃষ্টি আচ্ছন্ন থাকার কারণে একেবারে নিচের তলার মানুষদের ব্যাপারে রামমোহনের ভাবনাচিন্তা খানিকটা ওষ্ঠ-সেবা বা মৌখিক সহানুভূতির স্তরে থেকে গেছে। কিন্তু মূল ব্যাপারটা হচ্ছে মালিকানা-স্বত্ব আর দখলী-স্বত্বে যে মৌলিক তফাত আছে এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এই প্রথম যে আমাদের দেশের জমি পণ্য হয়ে গেল, উপনিবেশিকতার শিকার হয়ে যাবার ফলেই তিনি তা বুঝতে পারলেন না।
রামমোহন ইংরেজ শাসনের সম্পূর্ণ পক্ষে ছিলেন। পশ্চিমী সভ্যতাকে তিনি মনে করতেন আমাদের থেকেও উন্নতমানের এক সভ্যতা এবং আমাদের বহু দিন তার অধীনে থাকার দরকার আছে। অস্পষ্টভাবে জাতীয় চেতনার বিকাশ তাঁর সময়েই ঘটতে শুরু করেছিল। এই প্রশ্নে তিনি ভিক্টর জাকমোঁকে বলেছিলেন, “এই যে জাতীয় চেতনার তীব্র আকাঙ্খা একি লাগামছাড়া কল্পনা নয়? বিজিতের থেকে বিজয়ীরা যখন বেশি সভ্য হয়, বিজয়টা তখন আর খুব মন্দ জিনিস থাকে না, কারণ বিজয়ীরা বিজিতদের জন্যে নিয়ে আসে সভ্যতার নানা সুফল। ভারতের এখনো অনেক অনেক দিন ইংরেজদের অধীনে থাকা দরকার যাতে সে যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে চাইবে তখন তাকে বহু কিছু হারাতে না হয়।”৩২ (স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের) তাঁর মতে, “ভারতীয় জাতীয়তাবাদ একমাত্র তখনই উন্নতি করবে যখন পশ্চিমী জগতের দেশগুলো মুক্ত হয়ে যাবে। তখন বিশ্বের সেইসব মুক্ত দেশ সর্বত্র একই নীতিগত সরকারের ব্যাপারে একটা সার্বিক মতৈক্যে পৌঁছবে।”৩৩ (বিমানবিহারী মজুমদার, ১৯৯৬;স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের) অধীনতা-স্বাধীনতা শব্দ দুটির তফাত বোঝাতে অতঃপর তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় স্বাধীনতা পরম কল্যাণকর কিছু নয়। যদি সমাজের লক্ষ্য হয় সবচাইতে বেশি লোককে ভালো রাখা এবং যখন একটা দেশ একা একা সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর অবস্থায় থাকে না, তখন ভবিষ্যৎ প্রগতির স্বার্থে তার উচিত হচ্ছে অধিকতর সভ্য কোনো দেশের অধীনে থাকা, যদি সেটা বিজয়ী কোনো দেশ হয়ও।”৩৪ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, সমাজে একজন লোক যখন আর একজন লোকের সাহায্য চায় তখন সেটা সে চায় এই জন্যেই যে সাহায্যকারী লোকটি তার থেকে বেশি শক্তিশালী। দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এই সাধারণ সত্যটা প্রযোজ্য হবে না কেন? ‘মুক্তি’ শব্দটা রামমোহনের লেখায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, অতএব এটা জেনে নেওয়া দরকার যে মুক্তি বলতে রামমোহন বুঝতেন ‘সাংবিধানিক সরকার’। যদিও তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না, তাঁর বিশ্বাস ছিল সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে। নেপলসে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যখন বৃথা যায়, তখন রামমোহন খুব দুঃখ পেয়েছিলেন এবং বাকিংহামকে একটা চিঠিতে তিনি তা জানিয়েওছিলেন।
তাঁর এসব কথায় যে যথেষ্ট যুক্তি আছে তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যদি তাই হয়, ১৮২০ সাল নাগাদ যখন তিনি দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় কলোনিগুলির মুক্তির খবর পান, তখন অত খুশি হয়ে উঠেছিলেন কেন? সেকি এইজন্যে যে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিকে তিনি মনে করতেন পশ্চিমী সভ্যতার অংশ, যে সভ্যতাকে তিনি আমাদের তুলনায় উন্নতমানের সভ্যতা বলে মনে করতেন? কিন্তু তখনকার দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে কি পশ্চিমী সভ্যতার অংশ হিসেবে গণ্য করা যেত? তাদের কি সম্পূর্ণ নিজস্ব এক সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারা বহমান ছিল না? নাকি রামমোহনের ধারণায় এইসব স্পেনীয় উপনিবেশের লোকজন অন্তত আমাদের থেকে বেশি সভ্য ছিল? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। প্রচ্ছন্নভাবে যে ধারণাটা আমাদের মধ্যে থেকে যায় সেটা হল তাঁর ও তাঁর সময়কার আরো বহু ভদ্রলোকের সামন্ত-স্বার্থ এবং বণিক-স্বার্থই ব্রিটিশ শাসনকে আঁকড়ে থাকতে তদনুযায়ী যুক্তির হেরফের করতে বাধ্য করেছিল। তবে রামমোহন-গবেষকদের জন্যে কৌতুহলজনক একটা তথ্য এ প্রসঙ্গে যোগ করা যায়। ঐ ১৮২০ সালেই রামমোহনের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু জেরেমি বেন্থাম স্পেনীয়দের তাদের উপনিবেশগুলোকে মুক্ত করার ডাক দিয়ে কিছু চটজলদি নোট তৈরি করেছিলেন, যার থেকে তিনি পরে ১৮২১-২২ সাল নাগাদ Rid Yourselves of Ultramaria নামে একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন, যদিও সে পাণ্ডুলিপি শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল বা ছেপে বেরিয়েছিল কিনা ঠিক জানা যায় না। (R. N. Ghosh, 1963)৩৫
এহো বাহ্য। রামমোহনের মধ্যে বেশি সভ্য-কম সভ্য সম্পর্কে এসব ধারণা এল কোত্থেকে? সেকি নিজের দেশের সামান্য কিছু বর্ণ হিন্দুর চেহারা দেখেই? অথচ এই রামমোহনই তো ভারতের অবস্থার ওপর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের দেশের মানুষের সহজ সরল চরিত্রের উচ্চ নৈতিকতার ধর্মপ্রাণতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ধর্মদর্শনের এবং পৃথিবীর ইতিহাসের অত একনিষ্ঠ ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখানে উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে ব্রিটিশরা যে আমাদের থেকে অনেক বেশি সভ্য এই বিশ্বাস তাঁর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন তাঁর ইংরেজ গুরুরা। রামমোহনের দুই গুরু– এক, ফ্রান্সিস বেকন, দুই, জেরেমি বেন্থাম। বেকনের কাছ থেকে তিনি নিয়েছিলেন শ্রেয়োবাদ বা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যবাদ, ইংরেজিতে যাকে বলে Hedonism। এই শ্রেয়োবাদই তাঁকে বিজ্ঞানকে খোলা মনে আহ্বান করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বেন্থাম মনে করতেন উপনিবেশ স্থাপনের সুফল শুধু যে উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশই পেয়েছে তা নয়, কম মাত্রায় হলেও উপনিবেশের লোকজনও পেয়েছে। ব্রিটেনের হাতে নিজেদের সমর্পণ করে তারা নিশ্চিত করেছে তাদের রাজনৈতিক সুস্থিরতা, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতি। এটা উপনিবেশের লোকজনের দিক থেকে সর্বদাই লাভ যে তারা ব্রিটেনের মত রাজনৈতিকভাবে উদার এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রগতিশীল একটি দেশের শাসনে আছে। (R. N. Ghosh, ঐ)৩৬ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ধারণাও তিনি নিয়েছিলেন বেন্থামের কাছ থেকেই। শুধু তাই নয়, উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার ফলে মুসলমান আমলকে তিনিও স্বৈরতান্ত্রিক আমল বলে চিহ্নিত করে দিলেন। অথচ এই রামমোহনই Appeal to the King in Councilএ ৩৭ লেখেন যে মুসলমান আমলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এদেশের লোক সবরকম রাজনৈতিক সুবিধা পেত, যা ব্রিটিশ আমলে পাওয়া যাচ্ছে না।
রামমোহনকে পেরিয়ে যাবার আগে যে কথাগুলো অবশ্যই বলা দরকার সেটা হল উপরের কোনো কারণই সামাজিক ক্ষেত্রে বা ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকাকে নস্যাৎ করে না। আর শিক্ষাক্ষেত্রে তো নয় বটেই। তিনি যদি ইংরেজি ভাষার সিংহদুয়ারটি না খুলে দিতেন, এই বিশ্বদৃষ্টি আমাদের স্বপ্নের অগোচর থেকে যেত। নস্যাৎ করে না রামমোহনের বিশ্বজনীনবাদ বা আন্তর্জাতিকতাবাদকেও। সেই সঙ্গে আমরা টেরেল কার্ভারের কথাগুলোকেও স্মরণে রাখতে পারি, “এমন কোনো বর্তমানের জ্ঞানই নেই যা অতীতে উদ্ভূত ধ্যানধারণা থেকে গড়ে ওঠেনি। উপরন্তু সেগুলি বিশেষভাবে কোনো এক ব্যক্তিবিশেষের অতীতে উদ্ভূত নয়, আমাদের সমাজজীবনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ধ্যানধারণার পারস্পরিক আদানপ্রদান থেকে গড়ে ওঠা এবং [আমাদের ভাবনার মধ্যে] ঠাঁই পাওয়া।”৩৮ (স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের)
কিন্তু বিশ্বজনীনতা বা আন্তর্জাতিকতা একমাত্র তখনই সত্য হয়ে উঠবে যখন বিশ্বের প্রতিটি দেশ পরস্পরের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে শ্রদ্ধা সহকারে বিবেচনা করতে শিখবে এবং তার সারবস্তু গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। কিন্তু অবশ্যই তা বেশি সভ্য-কম সভ্যের ভিত্তিতে নয়। পশ্চিমী সভ্যতায় এখনো বেশি সভ্য-কম সভ্যের মাপকাঠি হচ্ছে বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেশিকম। বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেশিকম কোনো সভ্যতা-সংস্কৃতির মানের মাপকাঠি হয়ে উঠতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আদানপ্রদানযোগ্য হতেই পারে, কিন্তু সেটা সেইসব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের শিক্ষাদাতা বা গ্রহীতা দেশকে এককে অপরের থেকে বড় ছোট করে ফেলার কথা নয়। এখনো পর্যন্ত আমরা যে আন্তর্জাতিকতার চর্চা করি তা প্রধানত বস্তুগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যজারিত আন্তর্জাতিকতার একপেশে পশ্চিমী ধারণা। এই ধারণাকে আঁকড়ে থাকাটাও উপনিবেশিকতার শিকার হওয়ার ফল।
রামমোহন মুক্তির প্রশ্নে খুবই ভাবালু ছিলেন। ফরাসি বিপ্লব নিয়ে তিনি এতটাই উদ্বেলিত বোধ করেছিলেন যে ইংল্যান্ডে যাবার পথে অসুস্থ অবস্থায় ফরাসি ফ্রিগেটে উঠে গিয়ে তিনি তাঁদের আনন্দের ভাগ নিয়েছিলেন। ‘মুক্তি’ শব্দটা প্রথম দানা বাঁধতে শুরু করে ইংল্যান্ডে। মহাকবি মিল্টনের লেখায় প্রথম মুক্তির আকুতি স্পষ্ট করে ফুটে উঠতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে অভূতপূর্ব এক আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয় যে আত্মবিশ্বাস তাদের মধ্যে অস্পষ্টভাবে জাতীয় চেতনার জন্ম দেয়। তারা নিজেদের জাতি হিসেবে মুক্ত অনুভব করতে শুরু করে এবং আশা করতে শুরু করে যে সব দেশের মানুষই একদিন এইভাবে নিজেদের মুক্ত অনুভব করবে। তাদের এই মুক্তির অনুভবের চালিকাশক্তি ছিল প্রোটেস্টান্ট ধর্ম এবং মনে রাখতে হবে এই জাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে উত্থান ঘটে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যপ্রয়াসী মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও, যাদের কাজকর্মের থেকেই পুঁজিবাদের জন্ম হয়। মুক্তির এই ধারণা যখন ফ্রান্সে গিয়ে পৌঁছয়, তখন তিনটি প্রধান পরিবর্তন ঘটে। এক, ‘মুক্তি’ শব্দটার সঙ্গে যোগ হয় আরো দুটি শব্দ—‘সাম্য’ ও ‘ভ্রাতৃত্ব’। দুই, এই ফরাসি জাতীয়তাবাদ নিজেকে ধর্মের অধীনতা থেকে মুক্ত করে হয়ে দাঁড়ায় ধর্মনিরপেক্ষ। তিন, ফরাসি বিপ্লবের ফলে কৃষক–মজদুররাও এই জাতীয়তাবাদের অংশীদার হয়ে যায়। বিপ্লবের পরে নেপোলিয়ন প্রজাতন্ত্রের পতাকা নিয়ে দেশে দেশে যান এবং যুদ্ধ করে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন থেকে সেসব দেশকে মুক্ত করেন এবং গণভোটের মাধ্যমে তাদের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে পরিণত করেন। আদর্শগত দিক থেকে নেপোলিয়ন নাকি এরকমই চেয়েছিলেন, তাঁর বাসনা ছিল দেশে দেশে প্রজাতন্ত্র সৃষ্টির মাধ্যমে গোটা ইয়োরোপকে এক জাতিতে পরিণত করার। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বিপ্লবের আগেকার ফ্রান্সের যেসব উপনিবেশ ছিল এবং বিপ্লবের পরে নেপোলিয়ন যেসব দেশ জয় করে সেসব দেশে প্রজাতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবেছিলেন, সেসব দেশে সত্যিই কী মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? ইতিহাস বলছে হয়নি।
The nationalist rhetoric of assimilation and integration was also brutally contradicted by the actual treatment of the newly annexed territories. In theory, after all, the former Jacobins were promising to Italians, Germans, Dutch and Belgians precisely what they were promising to Gascons and Bretons and Alsatians: namely, in return for integration, the full benefits of French citizenship and civilisation. But in practice, the French regime was far more concerned with extracting resources from these territories to feed the war effort, and with crushing all possible resistance. Certainly Napoleon himself, on the evidence of his correspondence, paid far more attention to questions of resources and resistance than to questions of cultural integration. For this reason, many historians are still ready to endorse Paul Schroeder’s view of the Napoleonic Empire as an enterprise driven almost entirely by practical military considerations – Schroeder himself called it a ‘criminal enterprise’ – because of its supposed violations of international norms.৩৯
মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের ধারণা থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে নেপোলিয়ন নতুনভাবে এক সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করে বসেন। ফরাসি উপনিবেশগুলিতে তা নিয়ে তেমন সমস্যা না হলেও উপনিবেশের বাইরের দেশগুলোর কারো কারো এই অভিপ্রায় পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে জার্মানি নেপোলিয়নের আদর্শের বিরোধিতায় এমন এক আদর্শ গড়ে তোলে শেষপর্যন্ত যার ফলশ্রুতি হয় বিসমার্ক হয়ে হিটলার।
ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এইসব আদর্শগুলো ফ্রান্সের নিজের লোকজনের জন্যে অনুসরণীয়, কিন্তু উপনিবেশ বা সদস্য হওয়া নতুন দেশগুলির জন্যে নয়। ফ্রান্সের অবস্থাই যেখানে এই, ব্রিটেনের কথা সেখানে না তোলাই ভালো। তারা ফ্রান্সের আদর্শের অনুসরণও করেনি। অতএব উপনিবেশের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান সহজেই অনুমেয়। এর পরের জাতীয়তাবাদের ইতিহাস আরো মারাত্মক। যার যার ভূখণ্ডের অধিকারকে কেন্দ্র করে এবং প্রত্যেকের নিজেকে অপরের তুলনায় অধিক বলশালী প্রমাণ করতে গিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেল। অবশ্যই নেপথ্যের কারণটা ছিল বাজার দখলের প্রতিযোগিতা। এই প্রেক্ষিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।
এই জাতীয়তাবাদের কারণেই নিজেদের বেলায় যারা স্বাধীনতাপ্রিয়, বিশ্বের বড় অংশে দাসত্বকে চিরস্থায়ী করতে তারা দ্বিধা করে না এবং সে কাজ তারা করে কর্তব্যসাধনের গর্বের সঙ্গে। যারা এমনিতে ন্যায়পরায়ণ, নিষ্ঠুর অন্যায় করতে তারা দ্বিধা করে না এবং মনে করে কুকর্মের প্রতিফল দিয়েছে। যারা এমনিতে সৎ, নিজেদের শক্তি বাড়াতে অন্যদের মানবিক অধিকার ছিনিয়ে নিতে তারা দ্বিধা করে না এবং মনে করে সেইসব হতভাগ্যরা এর বেশি অধিকার পাওয়ার উপযুক্ত নয়। ৪০ (স্বচ্ছন্দ অনুবাদ বর্তমান লেখকের)
রবীন্দ্রনাথের এই ব্যাখ্যায় আরো একটা বিপজ্জনক ইঙ্গিত উপ্ত আছে। জাতীয়তাবাদের মধ্যে উপনিবেশ তৈরির একটা ঝোঁক থেকে যায়। অন্তত নাম কে ওয়াস্তে নিজের দেশকে আরো ভালো রাখার জন্যে বা বলা যায় আরো বেশি মুক্ত করার নামে জাতীয়তাবাদীরা উপনিবেশ বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। নয়া-উপনিবেশবাদের আলোচনায় বেশ কিছুদিন ধরে এই কথাগুলো উঠে আসছে। চে গ্যেভারা বলেছিলেন, উন্নয়নশীল দেশ কথাটা ভদ্রভাবে দেওয়া একটা নাম। আসলে এটা আধা উপনিবেশ বানিয়ে রাখার একটা কৌশল।৪১ নয়া-উপনিবেশবাদ হল আগেকার মত সাম্রাজ্যবাদী পদ্ধতিতে কোনো একটা দেশের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ না রেখে বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না রেখে অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদিকে ব্যবহার করে বা শর্তসাপেক্ষ অনুদানের মাধ্যমে সেই দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এবং এক্ষেত্রে এই পদ্ধতির ব্যবহারকারী হিসেবে যেসব দেশের নাম উঠে আসে তারা সবাই এককালের প্রসিদ্ধ জাতীয়তাবাদী দেশ।
উপনিবেশের ব্যাপারটাকে বাদ দিলেও জাতীয়তাবাদের সবথেকে বড় সমস্যা হল এর মূল ভিত দাঁড়িয়ে আছে এক ধর্ম, এক ভাষা, এক জাতির ধারণার ওপরে। এই সমস্যার কারণেই বহু ধর্মের বহু ভাষার বহু জাতের দেশ ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের ধারণার শেকড় গাড়া সম্ভব নয়।
(পরের অধ্যায় আগামী সংখ্যায়)
তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যেকার শব্দগুচ্ছ সর্বদাই লেখকের সংযোজন।
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. Nelson Maldonaldo-Torres quoted from Colonialism: Why Write Back?, George Sefa Dei & Chizoba Imoka, 2018. p. 3. https.//www.e-ir.info/...
২. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নির্বাচিত রচনা সংকলন, ১৪১৭ বাং., সংকলন ও সম্পাদনা. বারিদবরণ ঘোষ, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, প্রবন্ধ ‘বাঙলা সাহিত্যের গোড়ার দিককার কথা’, পৃ. ১১৬
৩. J. H. Broomfield, Politics and the Bengal Legislative Council 1912-1926, Thesis, 1963. p. V, openresearch-repository.anu.edu.au.
৪. Ashis Nandy, The Romance of the State and the Fate of Dissent in the Tropics, 2007, Oxford University Press, New Delhi, ‘An Anti-Secularist Manifesto’, p. 34-60.,
৫. শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, ১৩৯৯ বাং, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, পৃ. ৯
৬. Karl Marx, Capital vol 1. 1986 সংস্করণ, Progress Publishers, Moscow, p. 260
৭. কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেদার রচনাবলী ১ম খণ্ড, ১৯৮৭, বিহার বাঙলা আকাডেমি, পাটনা. ১ম সংস্করণ, প্রবন্ধ ‘আমরা কি ও কে’, পৃ. ৮৫
৮. অমলেশ ত্রিপাঠী, ভারতের মুক্তিসংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, ১৩৮৭ বাং, লেখাপড়া, কলকাতা, পৃ. ৯৬
৯. জীবনতারা হালদার, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুশীলন সমিতির ভূমিকা, ১৯৮৯, প্রকাশক, কলকাতা, পৃ. ১০১
১০. কবিকঙ্কণ মুকুন্দ বিরচিত চণ্ডীমঙ্গল, সম্পাদনা সুকুমার সেন, ১৩৯২ বাং, সাহিত্য অকাদেমি, পৃ. ১৯১
১১. Census of India 1921, General Report
১২. Census of India 2011, General Report
১৩. Rabindranath Tagore, Nationalism, rptd edn 1918, Macmillan & Co., London, p. 111, ‘Nationalism in India’
১৪. পড়ুন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ‘হিন্দ স্বরাজ’
১৫. Ganesh Prasad, Whiggism in India, published in Political Science Quarterly, vol 81, no. 3 (Sep 1966), pp. 412-431, Academy of Political Science, https://www.jstor.org/stable/2147642
১৬.Kamakshyanath Mitra, Reminiscences of Swami Vivekananda, https://www.ramakrishnavivekananda.info/reminsciences/333_knm.htm
১৭. A. L. Basham, The Wonder that was India, 1986, Rupa & Co., Calcutta, p. 313
১৮. শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ঐ, পৃ. ৮
১৯. Narendranath Bhattacharya, History of the Sakta Religion, 1974, Munishiram Monoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, p. 153
২০. Brajadulal Chattopadhyaya, The Concept of Bharatavarsha and Other Essays, 2017, Permanent Black, Ranikhet, p. 22
২১. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ ২য় খণ্ড, ১৯৮৮, সাহিত্য অকাদেমি, পৃ. ১৮৩৯
২২. কবিকঙ্কণ মুকুন্দ বিরচিত চণ্ডীমঙ্গল, ঐ, পৃ. ১৯২
২৩. নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, ১৩৯৭ বাং, পৃ. ৪
২৪. Ramesh Chandra Majumdar, On Rammohan Roy, 1984, The Asiatic Society, pp. 47-49
২৫. কুমুদকুমার ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন রায়ঃ বঙ্গদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি, ১৯৮৬, বর্ণপরিচয়, কলকাতা, পৃ. ২০১
২৬. Brajendranath Seal, Rammohun Roy– The Universal Man, pp. 93-112, published in ‘Rammohun Roy – The Man and His Work’, Centenary Publicity Booklet No. 1, June 1933, compiled and edited by Amal Home, Editor The Calcutta Municipal Gazette
২৭. দিলীপ কুমার বিশ্বাস, সম্পাদনা রামমোহন সমীক্ষা, ১৯৭৩, সারস্বত লাইব্রেরী, কলকাতা, পৃ. ১১
২৮. Arabinda Poddar, Renaissance in Bengal– Quests and Confrontations 1800-1860, 1970, Indian Institute of Advanced Study, Simla, pp. 47-74
২৯. পড়ুন Mysore Hiriyanna, Outlines of Indian Philosophy, 2005, Motilal Banarasidass Publishers Pvt. Ltd., Delhi, Part 2, Chapter VIII, Materialism, pp. 187-195
৩০. নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কৃত মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, ঐ, থেকে ঊনবিংশ অধ্যায়ের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রসঙ্গে রামমোহনের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত রূপ
৩১. পড়ুন Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760, 1997, Oxford University Press, Delhi, Part 2, Bengal under the Mughals, pp. 137-304
৩২. Arabinda Poddar, ঐ, p. 62
৩৩. Biman Behari Majumdar, History of Indian Social and Political Ideas, 1996, Firma KLM, Calcutta, p. 43
৩৪. Arabinda Poddar, ঐ, p. 61
৩৫. R. N. Ghosh, Bentham on Colonies and Colonization, published in Indian Economic Review, vol 6, no. 4, (August 1963), pp. 64-80, Department of Economics, Delhi School of Economics, University of Delhi; Springer, https://www.jstor.org/stable/42656474
৩৬. R. N. Ghosh, ঐ, p. 76
৩৭. English Works of Raja Rammohun Roy, ed. Jogendra Chunder Ghose, 1906, Panini Office, Allahabad, p. Xxi
৩৮. Terrell Carver, The Cambridge Companion to Marx, 1999, Cambridge University Press, UK, p. 1-2
৩৯. Lotte Jensen, ed. Roots of Nationalism, 2016, Amsterdam University Press, Amsterdam, দেখুন ‘Revolutionary France and Origins of Nationalism – An Old Problem Revisited’, David A Bell, p. 77
৪০. Rabindranath Tagore, Nationalism, rptd edn 1918, Macmillan & Co., London, p. 111, ‘Nationalism in India’, p. 110-111
৪১. Che Guevara, Cuba: Historical exception or vanguard in the anticolonial struggle? 1961 সালের April 9 তারিখে দেওয়া একটি বক্তৃতা, www.marxists.org