সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
দক্ষিণের বারন্দার সামনে একটা বড় ঝাঁকড়া নিম গাছ, তারপর চওড়া রাস্তা। রাস্তার ওপাশের জমি এখনো ফাঁকা। বারান্দাটা সুদীপ্ত আর নীলিমার খুব প্রিয় জায়গা। বেতের চেয়ার টেবিল কিনে সাজিয়েছিল এখানে গুছিয়ে সকালের চা খাবে বলে। এমনি দিনে একজনের অফিস আর অন্যজনার স্কুলের তাড়ায় তা আর হয়ে ওঠে না। এখন অবসরই, অবসর। এমনকি বাজার বা সামজিকতাও বন্ধ। ভোরে দুজনের অনেকটা সময়ই, এই বারান্দায় কাটে। বিকালের চা’ও। মাঝেমধ্যে চায়ের ফাঁকে দুচারটে কথা আর বাকিটা নীরবতা।
এদিন সকালে নীলিমা চায়ের ট্রে-টা টেবিলের কাঁচের উপর রাখতে রাখতে শুনতে পেল, সুদীপ্ত চেয়ারে বসে সামনে তাকিয়ে আপন মনে গুনগুন করছে। কাপে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞাসা করে কি বলছ? সুদীপ্ত বলে একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। নীলিমা নিজের চায়ের কাপটা তুলে বলে আমাকেও শোনাও। সুদীপ্ত ওর গরম চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে ওর ভারি গলায় আবৃত্তি করে;
ওরে চিরভিক্ষু, তোর আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি
চরিতার্থ হোক আজি, মরণের প্রসাদবহ্নিতে
কামনার আবর্জনা যত, ক্ষুধিত অহমিকার
উঞ্ছবৃত্তি-সঞ্চিত জঞ্জালরাশি দগ্ধ হয়ে গিয়ে
ধন্য হোক আলোকের দানে, এ মর্ত্যের প্রান্ত-পথ
দীপ্ত করে দিক, অবশেষে নিঃশেষে মিলায়ে যাক
পূর্ব সমুদ্রের পাড়ে অপূর্ব উদয়াচল চূড়ে
অরুণ কিরণ তলে একদিন অমর্ত্য প্রভাতে।
নীলিমা একাগ্রে কবিতার প্রত্যেকটা শব্দকে অনুভব করতে থাকে। কবিতা শেষ হতে চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে সুদীপ্ত বলে - জীবনে মৃত্যুই একমাত্র নিশ্চিত, অবধারিত, তাই না? নীলিমা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল, সে থমকে বলে ওঠে – তা ঠিক, কিন্তু এত সুন্দর কবিতার পর হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে পড়লে কেন? সুদীপ্ত সামনে তাকিয়ে বলে – আসলে কবিতাটা তো মৃত্যুরই কবিতা, তাই না? নীলিমা কিছুটা বিস্ময় মিশ্রিত গলায় জিজ্ঞাসা করে রবীন্দ্রনাথের? সুদীপ্ত অল্প হেসে জানায়, হ্যাঁ, সেই এক এবং অদ্বিতীয় রবি ঠাকুর। নীলিমা হেসে বলে - আমি রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ‘মরণরে তুহুঁ মম শ্যামও সমান’কেই মৃত্যুর গান বলে জানতাম কিন্তু তার মৃত্যুকে নিয়ে এরকম কবিতা আছে জানতাম না তো। সুদীপ্ত একটু অবাক হয়ে বলে ওঠে, তা কেন পুরো একটা কবিতার বই ‘প্রান্তিক’ই লিখেছেন মৃত্যুকে নিয়ে। যে কবিতাটা আবৃত্তি করলাম এটাতো প্রান্তিকেরই কবিতা। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে নিয়ে গভীর ভাবে ভেবেছিলেন এবং অনেকে মনে করেন যে তিনি খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছিলেন।
নীলিমা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে কিরকম? সে বলে - ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখন তাঁর বয়স সাতাত্তর। প্রায় ষাট ঘণ্টার মতো কোমায় ছিলেন। শান্তিনিকেতনে তখন টেলিফোন ছিল না। কাজেই সেখান থেকে কলকাতায় খবর পাঠিয়ে মেডিকেল টিম আসতে এতোটাই সময় লেগে যায় এবং চিকিৎসায় ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসার পর, যখন তিনি প্রথম বালিশে ভর দিয়ে বসেন তখন প্রথমে তুলি আর কিছু রং নিয়ে, ঘরে থাকা একটা প্লাইউডের উপর এক নিসর্গ দৃশ্য আঁকেন; আঁধারঘন বনানীর বিষাদের মধ্যে এক চিলতে হলুদ আলোর রশ্মি। এরই কিছুদিন পর মৃত্যু নিয়ে তার কবিতা সঙ্কলন ‘প্রান্তিক’ বেরোয়, মৃত্যুকে নিয়ে কোন ভাষাতেই এত অপূর্ব কবিতা খুব কম দেখা যায়।
তারপর সুদীপ্ত একটু ভেবে বলে - এই একটা ব্যাপার, মানে মৃত্যুটা, জন্ম থেকেই নিশ্চিত অথচ কি আশ্চর্য দেখ আমরা তাকে নিয়ে কখনো ভাবতে চাই না। সারা জীবন এমন ভান করি যেন তার কোন অস্তিত্বই নেই।
—তোমার কি হয়েছে বল তো? শুধু শুধু লোকে মরার কথা ভাবতে যাবে কেন?
—দেখ আজ চার মাস আমরা ঘরে বসে আছি করোনার ভয়ে, আর সারা বিশ্বের মানুষও আমাদের মতো মৃত্যুর ভয়ে কত কি করছে অথচ তাকে নিয়ে কোথাও কোন পরিষ্কার চিন্তা ভাবনা বা আলোচনা নেই, তাই না।
—মোটেই না, চারিদিকে মানুষ করোনার হাত থেকে কি করে বাঁচা যায় তার কথা ভাবছে।
সুদীপ্ত শান্ত গলায় বলে – না মৃত্যুর হাত থেকে কি করে বাঁচা যায় সেই কথা ভাবছে। কিন্তু এক অদ্ভুত কারণে সে মৃত্যুকে সামনে আনে না, করোনাকে সামনে আনে। দেখ করোনা হলেই মৃত্যু আসবে এমন কথা নেই, কিন্তু মৃত্যু একদিন আসবেই। তারপর একটু নীরব থেকে, হেসে বলে - কবি যতই বলুন “মরণ রে তুহুঁ মম শ্যামও সমান...”, আমরা কিন্তু প্রাণপণে চেষ্টা করি সেই শ্যামের থেকে দূরে থাকতে, মৃত্যুর চিন্তাকে দূরে রাখতে। আমার এই বাহান্ন বছরের জীবনে কখনো এই নিয়ে কোন স্বাভাবিক কথা, আলোচনা বা আড্ডা শুনিনি।
—কি যে বলো! এই তো ফেব্রুয়ারি মাসে বড় জ্যেঠিমার মারা যাওয়ার আগে দু মাস তো বাড়ির লোকে সেই নিয়েই সারাক্ষণ কথা বলে গেল, মাঝে মাঝে আমার বিরক্ত লাগছিল। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি বাড়িতে বয়স্ক, খুব অসুস্থ কোন মানুষ থাকলে তো বারবার সেই আলোচনাই হয়।
সুদীপ্ত বারন্দার সামনের নিম গাছটার ডালে বসে থাকা কাকটার দিকে তাকিয়ে বলে - তখনো কি সত্যি করে মৃত্যুকে নিয়ে আলোচনা হয়? যিনি মারা যাচ্ছেন তার অবস্থা কেমন, তিনি কেমন ছিলেন, তিনি গেলে কি হবে? এই সব নিয়েই লোকে কথা বলে। সে সব কথা নয়, সাধারণ অবস্থায় তো আমরা কত গল্প, আলোচনাই করে থাকি এমনকি সম্পূর্ণ উড়ো গল্প আর নানা রকম বাজে ব্যাপার নিয়েও আমরা আলোচনা করি, কিন্তু কখনো কাউকে বলতে শুনেছ চল আজ আমরা মৃত্যু কেমন তাই নিয়ে আলোচনা করি। অথচ আমাদের জীবনে এটা তো অবশ্যম্ভাবী, অথচ তাকে নিয়ে মানুষ কি অদ্ভুত রকমের উদাসীন থাকার চেষ্টা করে। তাই না?
নীলিমা হাল ছেড়ে দিয়ে সুদীপ্তর কথা শুনতে থাকে, তার কৌতূহল হয়, শান্ত, কম কথা বলা সুদীপ্ত কি বলতে চাইছে আজ!
সুদীপ্ত চায়ের কাপে আর একটা চুমুক দিয়ে বলে চলে - দেখ যে সব জিনিস আমাদের জীবনে জন্মের পর থেকে আসবেই আসবে আমরা সেই সব নিয়ে কত অনুষ্ঠান, কত চিন্তা, ভাবনা, আলোচনা করে থাকি। বিয়ে নিয়েই ভাবো মানুষের কত স্বপ্ন, চিন্তা, লোকজন নানা রকমের সাজসজ্জা। বাচ্চা হবে তাই নিয়ে কত কল্পনা, এমনকি দুর্গা পুজো আসছে তাই নিয়েও মানুষের কত ভাবনা অথচ মৃত্যু যা এই সবের থেকেও নিশ্চিত, যা সবার জীবনে একদিন আসবেই তাকে যেন জীবন থেকে আমরা কিছুটা জোর করে দূরে সরিয়ে রাখি। তাই না?
নীলিমা একটু অস্থির হয়ে বলে – তার কারণ অন্য সব অনুষ্ঠান মিলনের, কিন্তু মৃত্যু, সে তো কেবল বিচ্ছেদের কথা বলে, তাই আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। তার থেকে দূরে থাকতে চাই তাই।
দুজনের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে, সুদীপ্ত তার চায়ের কাপটা আবার তুলে শেষ চুমুক দিয়ে চুপ করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। তারপর ধীরে সুদীপ্ত বলে – সেটা ঠিক, কিন্তু কেন? আর তাকে দূরে সরিয়ে রাখলেই কি সে দূরে থাকে?
—কারণ আমরা তার সম্পর্কে কিছু জানিনা, যেখান থেকে কখনো এই জীবনে আর ফিরে আসা যায় না তাই।
—কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানিনা বলেই কি তাকে এত ভয়? জন্মের আগে তো এই জীবন সম্পর্কেও কেউ কিছু জানত না। অর্থাৎ একটা সীমিত অস্তিত্ব যার শুরু আর শেষ আছে তার শেষটা ভাবলেই ভয় হচ্ছে, যা অবধারিত যার হাত থেকে পালানোর কোন রাস্তা নেই তাকে চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এই মিথ্যা চেষ্টা কেন? এবং এটা একজন বা দুজন ভীতু মানুষের কথা নয়, এটার থেকে বেশিরভাগ মানুষ বা পুরো মানবসমাজই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার থেকে দূরে রাখতে চায়। একটু চুপ থেকে বলে - এই দুর্গা পুজোর কথাই ভাবো দশমীতে মায়ের বিসর্জন, দুঃখের অনুষ্ঠান কিন্তু তা নিয়ে কি আমরা ভাবি না? সিঁদুর খেলা, কোলাকুলি, বিজয়ার শুভেচ্ছা সবই তো দেবীর বিসর্জনকে ঘিরে এবং আশ্চর্যজনকভাবে তা আমাদের কাছে মিলনের উৎসবও। অথচ নিজেদের জীবনে সেই বিসর্জন নিয়ে এতো ভয় কেন? নীলিমা গম্ভীর হয়ে বসে থাকে, এই আলোচনাটা সে যে খুব উপভোগ করছে তা নয়, কিন্তু এই দিনের পর দিন লকডাউনে বাড়িতে এরকম বসে থাকতে থাকতে একটা বিরক্তি, তার মধ্যে এটা যেন নতুন কিছু কথা।
সুদীপ্ত একটু আনমনা হয়ে বলে - অথচ মৃত্যু যতটা নিশ্চিত ততই অনিশ্চিত মৃত্যুর আসার সময়, সে যে কখন আসবে কেউ জানেনা। মিঃ দেশাই এর কথাই ধরো, সুস্থ্ মানুষ অফিসে বসে বসে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে সব শেষ, দুদিন আগেই প্রমোশনের দিন প্ল্যান করছিলেন ইউরোপ যাবার। তাই মনে হয় জীবনের সব থেকে নিশ্চিত ঘটনা মৃত্যু একটা চূড়ান্ত অনিশ্চিত সময়ে প্রবেশ করে।
সুদীপ্তর শেষের কথাটা শুনে নীলিমা আস্তে বলে ওঠে - তা ঠিক, আহা বিহারীদার বাইশ বছরের অমন জোয়ান তরতাজা ছেলেটা হঠাৎ চলে গেল বাপু। অত ভালো ছেলে কেন যে সেদিন বন্ধুদের সাথে মরতে মোটরসাইকেলে গেল ভগবান জানে। সীমাদির দিকে তাকানো যায় না। অন্যদিকে শ্যাওড়াফুলির মাসীমাকে দেখো, আজ দেড় বছর হল ডাক্তার বলে গেছে আশা ছেড়ে দিতে কিন্তু তিনি কোমার মধ্যেও এখনো বেঁচে। ছেলেগুলো ওদের এই অবস্থাতেও ডাক্তার, আয়া, ওষুধ এসব করছে, অথচ মায়ের কোন সাড়া নেই কিন্তু তিনি এখনো রয়েছেন।
—আর মৃত্যুর আসার সময় অনিশ্চিত বলেই আমরা এমন ভান করি যে সে যেন কখনোই আসবে না। ভাবি হয়ত এই সময় নয় অন্য কোন সময় কিন্তু ভাবটা এমন, যেন কখনই নয়।
তারপর নীলিমা একটু থমকে রেগে গিয়ে সুদীপ্তকে একটু ধমকে জিজ্ঞাসা করে তুমি কি বলতে চাইছ বলতো? সকালবেলায় চা খেতে খেতে হঠাৎ মরা নিয়ে পড়লে কেন?
সুদীপ্ত দেখে নিম গাছে বসা কাকটা কখন উড়ে গেছে, সে নীরবে ভেবে চলে। নীলিমা তার চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ আর টি-পট নিয়ে উঠে যায়। সে বসে বসে ভাবে জীবনে কত মৃত্যুই সে দেখল, বুক চাপড়ে কান্না, হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস এবং শ্মশানে কিছু মৃত্যু নিয়ে টুকরো কথা যা চিতার আগুন নেবার আগেই হারিয়ে যায়। সুদীপ্ত সামনের ঝাঁকড়া নিম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে, মুখে এক টুকরো হাসি আর ওর পায়ের কাছে গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে সকালের সূর্যের এক চিলতে আলো। নীলিমা রান্নাঘর থেকে ফের ঘুরে এসে সুদীপ্তর পাশের বেতের চেয়ারে বসে।
সুদীপ্ত বলে - সত্যি করে দেখলে আমাদের চিন্তায় ভাবনায় মৃত্যু যেন এক বিপদ, এক অস্বাভাবিক ঘটনা, কোন রকমে আমাদের এর থেকে বাঁচতে হবে। টাকা পয়সা, ডাক্তার, হসপিটাল সমস্ত কিছুর বিনিময়ে এর হাত থেকে পালাতে হবে, অথচ তা অসম্ভব। আর এই দূরে সরিয়ে রেখে, তার থেকে পালাতে গিয়ে আমরা আমাদের জীবনের সব থেকে স্বাভাবিক ঘটনাকে অস্বাভাবিক ভয়াবহ করে তুলেছি।
—তা বলে মৃত্যু আসছে বলে তো হাত গুটিয়ে মানুষ বসে থাকবে না। তাকে তো বাঁচার চেষ্টা করতেই হবে।
—নিশ্চয় আমাদের মধ্যে বাঁচার যে জৈবিক তাগিদ আছে তাকে অস্বীকার করার কোন কারণ নেই, মৃত্যু আছে বলেই বাঁচার চেষ্টা থাকবে। কিন্তু মানুষের মতো উন্নত চিন্তাশীল প্রাণী, যা অবধারিত, স্বাভাবিক তাকে এরকম অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক ভাবে ভয় পেতে থাকবে? যত আধুনিক মানব সভ্যতা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির রথে দ্রুত এগিয়ে চলেছে তত যেন আমাদের মৃত্যুর প্রতি ভয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
নীলিমা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করার দৃষ্টিতে সুদীপ্তর দিকে তাকায়। এই বিষয়ের প্রতি সব মানুষের মতো তার স্বাভাবিক বিরাগ থাকলেও, ধীর, স্থির সুদীপ্তর খুব স্বাভাবিক কথাগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে তাতে তার অভিজ্ঞ শিক্ষিকার দৃষ্টি এড়ায় না। সেও কিছুটা যেন কৌতূহল অনুভব করে।
—যত অত্যাধুনিক চিকিৎসা আসছে, নতুন নতুন ওষুধ আর যন্ত্র বেরোচ্ছে মানুষ যেন তত বেশি মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে। ভিতরে হয়ত একটা আশা যে বোধহয় মৃত্যুকে এড়িয়ে বেঁচে গেলেও যেতে পারি। কিছু দিন আগেও মানুষ বাঁচার জন্য এতটাও বোধহয় হ্যাংলামো করতো না, তখন বোধহয় মৃত্যু অনেক স্বাভাবিক ছিল। অনেক মানুষের মধ্যেই মৃত্যুর বিষয়ে কিছুটা যেন আত্মসম্মান দেখা যেত। তাই না?
নীলিমা ভুরু কুঁচকে একটু হেসে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, কি রকম?
—জানো আমার বাবার ঠাকুমা শেষ বয়েসে মারা যাবেন বলে সব কিছু গুছিয়ে কাশী চলে যান। আগে অনেক সময় লোকে গঙ্গার ধারে অন্তর্জলী যাত্রা করত, অর্থাৎ কিনা নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য ভয়ে পালানো নয় অপেক্ষা করা। আগে বাড়িতেও শেষ সময়ে লোকে হরিনাম করত, মুখে গঙ্গাজল দিত, এখনকার মতো ভেন্টিলেটারের নল গুঁজে দিত না।
—তুমি বলতে কি চাইছ? যে মানুষের শেষ সময়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে হরিনাম করবে, সে যাতে মারা গেলে স্বর্গে যায়।
সুদীপ্ত জানায়, সে তেমন কিছু বলতে চাইছে না। বলে, কিন্তু এটা মানাও কষ্টকর যে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি আর নল লাগিয়ে ভাবা যে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা যাবে। বহুক্ষত্রে তো বাড়ির লোক বুঝতে পারে আর কোন আশা নেই তবুও ভেন্টিলেটারে মানুষটাকে দেওয়া হয়, এই ভয়ে যে লোকে বা আত্মীয়স্বজনে কি বলবে। আর সেই সুযোগ নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে তো শেষ সময়ের বয়স্ক মানুষদের ভেন্টিলেটারে দেওয়াটা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর একটু নীরব থেকে বলে, আমেরিকার এক সার্ভেতে দেখা গেছে ৭৫% মানুষ নিজের ঘরে মারা যেতে চান কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয় মাত্র ২৫% মানুষের। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও শেষ মুহূর্তে মানুষকে তার প্রকৃত জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চনা করে এক মরীচিকার মধ্যে দিয়ে অহেতুক আরো মৃত্যুভয়ে ঠেলে দেওয়া কি ঠিক?
—তা সত্যি, নার্সিং হোমে শেষ সাতটা দিন মা মারা যাবার আগে কতবার বলেছিল আমায় ‘আমায় ঘরে নিয়ে চ, আমি বাড়ি যাব’। কিন্তু বেঁচে ফিরবে এই মিথ্যা আশায় মা সেই আইসিইউতেই মারা গেল। একটু চুপ থেকে বলে কেন জানি আমার মনও বলছিল যে মায়ের আর বেশিদিন নেই কিন্তু মনে হচ্ছিল হয়ত আমি ভুল, ডাক্তার যখন বলছে তখন মা বেঁচে যেতেও পারে। সত্যিই তো মা তো চিরকাল বাঁচত না কিন্তু শেষের কটা দিন বাড়িতে থাকলে মার শেষ সময়টা শান্তিতে কাটত। এটা একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি।
তারপর সে বলে - বয়স্ক মানুষদের কথা ছেড়ে দাও কিন্তু বড়দার মতো মানুষের কথা ভাবো, মাত্র ৪৪ বছর বয়েসে হার্ট অ্যাটাক হ’ল, কিংবা বিহারীদার ছেলে দীপ্তেন্দুর অ্যাকসিডেন্ট। এদের জন্যও কি তুমি একই কথা বলবে? শেষ মুহূর্ত ভেবে এদের মতো তরতাজা প্রাণকে বাঁচানোর চেষ্টা হবে না, এইসব হাসপাতালে এদের মতো কত প্রাণ বেঁচে ফিরে আসে। তুমি তো জানো আমাদের স্কুলের বড়বাবুর মেয়ের বুকে ক্যান্সার হয়েছিল, সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু এখন তো সে সম্পূর্ণ সুস্থ।
—আমি কিন্তু একবারও বলিনি যে মানুষকে বাঁচানোর জন্য আইসিইউ, ভেন্টিলেটার বা আধুনিক চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। কিংবা বড়দা বা দীপ্তেন্দুকে বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। কিন্তু তার সঙ্গে মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ না করার তো কোন সম্বন্ধ নেই। মৃত্যু তো জীবনের বিপরীত নয় এতো জীবনের অংশ তারই পরিণতি, তাই না?
তারপর সে নীলিমাকে যেন কিছুটা শান্ত করার জন্য বলে, দ্যাখো আমরা মোটামুটি চার রকমের মৃত্যুকে দেখি; এক, হঠাৎ কম বয়েসে অ্যাকসিডেন্ট বা হার্ট অ্যাটাক; দুই, টার্মিনাল রোগ যেমন ক্যান্সার; তিন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের বিকল হওয়া ফুসফুস, কিডনি বা লিভার; এবং সব শেষে বৃদ্ধ বয়সে জরাগ্রস্ত, দুর্বল হয়ে মৃত্যু। এখন রোগীর গড় বয়স প্রথম দুই ক্ষেত্রে কম হলেও কিন্তু পরের দুই ক্ষেত্রে বেশি এবং বাঁচানোর চেষ্টাও আলাদা। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই মৃত্যুকে একই রকম ভাবে অজানা এক ভীতির সঙ্গে দূরে ঠেলে ফেলা হয়। এর সঙ্গে রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টার কোন সম্পর্ক নেই। একজন যুবককের অ্যাকসিডেন্ট বা একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের কিডনির কাজ না করা, বা একজন নব্বই বছর বয়সী মানুষের নিউমোনিয়া - এই সব মৃত্যুকেই আমরা একই রকম ভাবে কেন দেখবো? তাকে তো কখনো না কখনো সহজ ভাবে নিতে হবে, যদি তা না নি তাহলে আমরা অসুখের যন্ত্রণার সাথে, মৃত্যুভয়ের যন্ত্রণাকে যোগ করব।
দুজনেই চুপ করে বসে থাকে, কারোরই এখন আর কোন তাড়া নেই। নীলিমা ব্যাপারটাকে কিছুটা হালকা করার জন্য বলে কিন্তু তুমি যে বলছ আমাদের মধ্যে মৃত্যু নিয়ে কোন আলোচনা বা গল্প হয় না সেটা হয়ত ঠিক কিন্তু যদি হত তাহলে কি আলোচনা হত? সেখানে তোমার বক্তব্য কি হত? সুদীপ্তর মুখে মৃদু হাসির ছোঁয়া, সে বলে - প্রথম তো আমার এটা প্রশ্ন হত যে মৃত্যু কি? মৃত্যু কাকে বলে? নীলিমা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে সত্যি তো মৃত্যু কাকে বলে? সে একটু হেসে উত্তর দেয় - হাজার হাজার বছর ধরে এটা একটা বড় প্রশ্ন মানুষের কাছে। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে অন্য অনেক দেশের মতোই প্রথাগত মৃত্যুর সংজ্ঞা হচ্ছে অনেকটা এরকম; শ্বাস ও রক্ত চলাচলের অপরিবর্তনীয় সমাপ্তি। কিন্তু প্রকৃত মৃত্যু ঘটে মস্তিষ্কে যখন সেখানকার স্নায়ুকোষেরা একবার মারা গিয়ে আর পুনর্জীবন পায় না বা নূতন করে ফিরে আসে না বা কাজ করে না। এখনো প্রকৃত মৃত্যু নিয়ে নানা দেশে নানা রকমের আইনি সংজ্ঞা আছে, অর্থাৎ কিনা সেখানেও একটা বিভ্রান্তি রয়েছে।
এটা শুনে নীলিমা হেসে বলে তা তোমার আর কি কি প্রশ্ন আছে এর সম্পর্কে? সে বলে - তা সে হৃদয় বা মস্তিষ্ক যাই হোক, এই দেহের শেষই কি মৃত্যু? আর তা যদি হয় তাহলে জীবন মানে কি কেবল এই দেহই? এই যে আমাদের চেতনা যা মনকে চালায় তার অবস্থান মৃত্যুর সাথে কি? যখন এই জীবনের শেষে আমাদের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হবে তখন এই চেতনা, মন আর দেহের যে সম্পর্ক, তার কি হবে? চেতনা আর মন কোথায় যাবে? এই সব আর কি। নীলিমাও হেসে ফেলল বলল - বাবা! এতে তো মৃত্যুর থেকে জীবনকে নিয়ে বেশি ভাবতে হবে।
সুদীপ্ত বলে তোমার তাই মনে হচ্ছে? তারপর ওর স্বভাব বিরুদ্ধ কিছুটা নাটকীয় ভঙ্গিতে ও বলে ওঠে; “আমরা আপনার কাছে মৃত্যুকে জানতে চাই” এবং তিনি বললেন “তোমরা মৃত্যুর রহস্য জানিবে। কিন্তু তোমরা তাহাকে পাইবে কি করিয়া যদি না তাহাকে তোমরা জীবনের গভীরে সন্ধান করো? যে নিশাচর পেচকের চক্ষু দিনের আলোক রশ্মির সামনে অন্ধ, সে আলোকের রহস্যকে কেমন করিয়া উন্মোচন করিবে? যদি তোমরা সত্যই মৃত্যুর আত্মাকে উপলব্ধি করিতে চাও তাহলে তোমাদের হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করে দাও জীবনের সন্মুখে। জীবন ও মৃত্যু অভিন্ন, যেমন নদী এবং সাগর এক”।
নীলিমা অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করে - কার লেখা ? তোমার নাকি? সুদীপ্ত জোরে হেসে ফেলে বলে না খালিল জিব্রান, তবে অনুবাদ আমার।
নীলিমা বলে ও ‘প্রফেট’ থেকে বললে - বাঃ তোমার বেশ মনে থাকে তো। তারপর একটু ভাবতে ভাবতে বলে জীবনের গভীরেই মৃত্যুর উপলব্ধি! বেশ নতুন চিন্তা তো।
—হ্যাঁ। এক গভীর উপলব্ধি। আসলে মৃত্যু আমাদের মনে করায় আমাদের অনিত্যতাকে তাই হয়ত আমরা ভুলে থাকতে চাই মৃত্যুকে। কিন্তু যারা ভয় না পেয়ে তার মুখোমুখি হতে পেরেছে তারাই উপলব্ধি করেছে জীবনের অসীম গুরুত্বকে। আমরা মৃত্যুকে ভুলে যখনই ভাবি জীবন নিত্য, এর যেন শেষ নেই, তখনই হয়ত আমরা যেমন তেমন করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাঁচি, অপচয় করি জীবনকে, বাঁচার প্রতি মুহূর্তকে। আমাদের দিন শেষ হয়ে আসবে তাই জীবনের প্রত্যেক মুহূর্ত দামী, তাই মৃত্যু থেকে ভয়ে পালানো নয়, এতো আমাদের জীবনের তটরেখায় দাঁড়িয়ে থাকা লাইটহাউস। দশমীর বিসর্জনের জন্যই আমরা সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমীর প্রতি মুহূর্তকে উপভোগ করতে চাই।
দুজনেই চুপ করে সামনের গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে, নিমের ছোট ছোট সবুজ কচি পাতারা হাওয়া নাচতে থাকে। নীলিমা ধীরে ধীরে বলে, সত্যি কি কেউ আছে যে মৃত্যু ভয়ে ভীত নয়। অন্যদিক থেকে উত্তর আসে – কেন নচিকেতা।
নীলিমা ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে সত্যিই অনেক আগে পড়েছিলাম যম আর নচিকেতার গল্প। মৃত্যু নিয়েই তো যমের কাছে ছিল নচিকেতার প্রশ্ন, কিন্তু কি বলেছিল তা আর মনে নেই। বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে তাকায় সুদীপ্তর দিকে।
সুদীপ্ত স্ত্রীর কথায় হেসে বলে - তুমি নয় খুব কম লোকেরই মনে থাকে যম ও নচিকেতার সেই বিখ্যাত কথোপকথন যদিও অনেকেই গল্পের ঘটনাকে মনে রাখে। আসলে ঐ গল্প কঠোপনিষদের অবতারণা মাত্র, কথোপকথনটাই উপনিষদের মূল কথা। সেখানে যমের তৃতীয় বরের বিনিময়ে কিশোর নচিকেতা জানতে চায় “কেউ কেউ বলে মৃত্যুর পরেও অন্য জীবন শুরু হয় আবার কেউ কেউ বলে তা সত্য নয় এই জীবনই একমাত্র জীবন যা মৃত্যুর সাথে শেষ হয়। আমাকে প্রকৃত সত্য কি তা বলুন”।
নীলিমা থাকতে না পরে বলে ওঠে - বাঃ বুদ্ধিমান ছেলে, এর উত্তর তো যমের কাছেই থাকবে। সুদীপ্ত বলে - তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে যমের তৃতীয় বরে সে অনেক কিছু চাইতে পারত কিন্তু সেই কিশোর যার সামনে সমগ্র জীবন, যৌবন পড়ে আছে, সে ধন, মান, সম্পদ, রূপ কোন কিছু না চেয়ে মৃত্যু কি জানতে চাইলো, যখন কিনা আমরা মৃত্যু নিয়ে ভাবতেও ভয় পাই, আমাদের জীবনের সেই গভীর বাস্তবকে আমরা জোর করে ভুলে থাকতে চাই। তাই না? নচিকেতা সত্যই বুদ্ধিমান কারণ সে জানত সামনে মৃত্যুই একমাত্র বাস্তব যাকে কিছুতেই এড়ানো যাবে না, বাকি সব কিছু ক্ষণস্থায়ী, আসবে চলে যাবে। কাজেই তাকে জানাই সব থেকে প্রয়োজনীয় এই জীবনে। আর ঠিকই বলেছ, মৃত্যুর দেবতা যমই এর সঠিক উত্তর জানবে।
—যম কি বলেছিল?
—সে অনেক কথা, প্রথমে যম নচিকেতাকে ছোটছেলে ভেবে তাকে নানান চেষ্টা করে যাতে সে এই প্রশ্ন ভুলে যায়। কিন্তু নচিকেতা ভোলে না। সে পরম সত্যকে জানার এই সুবর্ণ সুযোগ ছাড়তে চায় না। আসলে নচিকেতা আছে আমাদেরই অন্তরের গভীরে, যখন তাকে অস্বীকার করি, তখনই মৃত্যু দেবতা ভয়ানক হয়ে ওঠেন।
তারপর একটু ভেবে সে বলে - এক কথায় বললে যম যা বলেছিল তা আমি যে খুব বুঝেছি তা বলব না, তবে তা অনেকটা এরকম; প্রকৃত আমি বা আত্মা অমর, তার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই, সে শাশ্বত, অবিনাশী, এর কোন শুরু বা শেষ নেই। কেবল দেহের মৃত্যু হয় কিন্তু আত্মা অমর অজর। যে ভাবে সে হত্যাকারী বা যে ভাবে সে হত, দুজনেই অজ্ঞানী। আত্মা হত্যা করেও না বা তাকে হত্যা করাও যায় না। দ্যাখো, কি আশ্চর্য! মৃত্যুর দেবতাই অমরত্বের সন্ধান দিচ্ছেন। জীবন ও মৃত্যুকে অতিক্রম করার কথা বলছেন। জানিনা তা সত্যি সম্ভব কিনা, কিন্তু নচিকেতার উত্তরসূরি হিসাবে মৃত্যুকে অতিক্রম করে অমরত্ব খোঁজায় দোষ কোথায়? আর তাকে দূরে সরিয়েও তো আমরা তাকে জয় করি না কেবল ভয় পেতে থাকি, ভুলতে চেষ্টা করি।
নীলিমা একটু চিন্তিত হয়ে বলে এই কথার সাথে গীতার কোন কোন শ্লোকের বেশ মিল আছে বলে মনে হয় না? উল্টোদিকে কিছু নীরব সম্মতির ঘাড় নাড়া দেখে সে কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বলে যম নিশ্চয়ই এই আত্মার ব্যপারে কিছু বলে ছিল।
—হাঁ, এখানে মৃত্যুর প্রসঙ্গে এমন এক ‘আমি’ বা ‘আত্মাকে’ নিয়ে আসা হয় যা অমর, অজর, যার ব্যপারে আমাদের শাস্ত্রে নানা কথা লেখা থাকলেও আমাদের জীবনে, চিন্তায় মননে তার কোন উপস্থিতিই নেই। কাজেই স্বাভাবিক ভাবেই তা এক বড় ধোঁয়াশা, একই রকমের জটিল।
সেটা শুনে নীলিমা প্রশ্ন করে কি রকম?
—যম বলেন, আত্মা ক্ষুদ্রতম বস্তুর থেকেও ক্ষুদ্র একই সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের বৃহত্তম বস্তুর থেকেও বৃহৎ। তাকে বুদ্ধি দিয়ে বা আলোচনা করে বা শিক্ষার মাধ্যমে জানা যায় না তা প্রকৃত জিজ্ঞাসুর সামনে স্বপ্রকাশিত। তাকে উপলব্ধির রাস্তা অন্ধকার রাত্রে ধারালো ক্ষুরের উপর দিয়ে হাঁটার মতোই ভীষণ কঠিন, তাই সময় নষ্ট কোর না, তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানর জন্য ওঠো, জাগো এগিয়ে চলো।
—তার মানে উপনিষদের ঋষি থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেই মৃত্যু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করেছেন?
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সুদীপ্ত বলে ওঠে, আসলে উপনিষদের কবি, রবি ঠাকুর বা খালিল জিব্রানের মতো মানুষদের কাছে জীবন এক মহার্ঘ, অনির্বচনীয় আনন্দ আর তাই এরা সকলেই মৃত্যুকে জীবনের দিগন্ত হিসাবে দেখেছেন, সেই দিগন্ত যা জগতের আনন্দ যজ্ঞের এক মাত্রা।
বেলা বাড়ছে নিম গাছটা রোদে আরো ঝলমল করছে।
সুদীপ্তর আবদারে নীলিমা ধীরে ধীরে গান ধরে -
বেলা যে ফুরায়ে যায়, খেলা কি ভাঙে না হায়
অবোধ জীবনপথ যাত্রী।
কে ভুলায়ে বসাইল কপট-পাশায়
সকলি হারিলি তায়, তবু খেলা না ফুরায়।
পথের সম্বল গৃহের দান
বিবেক-উজ্জ্বল সুন্দর প্রাণ,
তা কি পণে রাখা যায়
খেলায় তাকে হারায়।
আসিছে রাত্রি কত রবি মাতি,
সাথীরা যে চলে যায়, খেলা ফেলে চলে আয়।