সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
এখন সারা বিশ্বের মানুষ একটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে। বলা ভালো নাক-মুখ-চোখ চাপা দিয়ে প্রায় দমবন্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে আমরা এখন দূরত্ব বজায় রেখে প্রায় ঘরবন্দি। ওদিকে প্রায় ১০০টা দেশ কোটি ডলারের বাজি ধরে ‘কোভ্যাক্স’ তৈরিতে ব্যস্ত। এ যুদ্ধের স্লোগান ‘ভাইরাসের বদলা ভ্যাকসিন’। মাত্র সাত-আট মাসের জীবনকালে এই নবতম করোনা ভাইরাসের অবতারটি মানবসভ্যতার অনেক কিছুই ওলটপালট করে দিয়েছে। আর আমরা বুঝেছি বিশ্ব-মহামারীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভ্যাকসিন গবেষণার দৌড় এক অসম লড়াই। ধরা যাক আর কটা দিন পরেই আমরা কোভিড-১৯কে ভ্যাকসিন দিয়ে একদম ভাগিয়ে দেব। অবশ্যই তত্ত্ব ও প্রয়োগের ফাঁক-ফোকর ধরে নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই যে লকডাউনে অর্থনীতির মহাবিপর্যয় আর যাদের পায়ের তলার চামড়া খসে পড়ল রাস্তায়, তার কি হবে? তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন কোভিড-২০ কিংবা কোভিড-২১ এর জন্য আমরা কোন ভগবানে ভরসা রেখে ঘুমোতে যাবো? কোনরকমে জানটা বাঁচলেও জীবিকাটা বাঁচবে তো?
অথচ সেই খ্রীষ্টপূর্ব চার শতকে চিকিৎসার জনক বিখ্যাত গ্রীক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস প্রথম বলেছিলেন মানুষের রোগ জ্বালা আসলে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর যে জীবজগত তার মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য রোগজীবাণু আর সেই জীবাণুবাহক প্রাণীরাও। ঐ সব হাজার জীবাণু আর প্রাণীরা অনেকেই মানুষের উপকারী আর বেশ কিছু দুর্জন বা শত্রু। কিন্তু একটা কথা তো মানতেই হবে, পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনের একদম প্রথমেই এইসব অনুজীবদের উদ্ভব। মেরুদন্ডী এবং চতুষ্পদ জীবদের আবির্ভাবের অনেক যুগ আগে থেকেই জীবাণুদের অস্তিত্ত্ব ছিলো।
স্বাস্থ্যের পরিবেশ
মানুষের সংক্রামক ব্যাধির উৎস খুজতে গিয়ে একদল বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন যে বেশ কয়েকটি একই প্রজাতির পরজীবী রোগজীবাণু পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকার বিভিন্ন বন্য প্রাণীর মধ্যে। সবরকম সম্ভাব্য সূত্র যাচাই করে বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। চল্লিশ থেকে তিরিশ লক্ষ বছর আগে শুরু হওয়া কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট-এর ফলে মহাদেশগুলো আলাদা হয়ে যাবার আগে থেকেই সেই আদিসংযুক্ত-মহাদেশ বা প্যাঞ্জিয়াতে এই পরজীবীরা ছিল। মানেটা পরিষ্কার যে আফ্রিকায় প্রথম হোমোস্যাপিয়েন্স জন্ম নেবার (৮০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে) অনেক আগে থেকেই তাকে কাবু করার জন্য রোগজীবাণু তৈরি হয়েই ছিল। উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে ‘লেইস্ম্যানিয়াস্’ এবং ‘ট্রাইপ্যানোসোমস্’ পরজীবী দুটিকে। বর্তমান বিশ্বে ২০ প্রজাতির লেইস্ম্যানিয়াস্ প্রায় ৯০ প্রজাতির বালি-মাছিদের দ্বারা বাহিত হয়ে মূলতঃ তিন ধরণের রোগ ছড়ায়। তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম কালাজ্বর। আর খুব কম হলেও আফ্রিকার স্লিপিং সিক্নেস বা ট্রাইপ্যানোসোমিয়াসিস্ এখনও মানুষকে আক্রান্ত করে। এই মারাত্মক রোগটি ছড়ায় বাহক সেট্সি মাছির কামড়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় আজও এই রোগ ঘোড়া ও গবাদিপশুদের সংক্রামিত করে।
এছাড়াও দেখা যাচ্ছে মানববিবর্তনের ধারায় বানর, বনমানুষ হয়ে মানুষের পাকস্থলীতে প্রবাহিত হয়েছে মোট ১১টি প্রোটোজোয়া। পীতজ্বর আর ম্যালেরিয়াও মানুষ ও তার নিকট প্রজাতিদের মধ্যেই রয়ে গেছে হাজার হাজার বছর ধরে। এর কারণ মানুষের দেহই এদের মূল আশ্রয়দাতা বা হোস্ট। যদিও এই রোগদুটির পরজীবী শুধুমাত্র নির্দিষ্ট উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়াতেই বাঁচতে পারে।
ইতিহাসের নিরিখে সংক্রামক ব্যাধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌছায় শেষতম হিম যুগের শেষে। উপযুক্ত উষ্ণ আবহাওয়া আর প্রচুর জলসিক্ত মাটির সহজলভ্যতায় আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষরা ক্রমশ কৃষিকাজ আর পশুপালন শুরু করেন। আর সেজন্যই মানুষ ক্রমশ নির্দিষ্ট জায়গায় স্থায়ী বাসস্থান বানাতে বাধ্য হয়। বন্যপশুকে পোষ মানিয়ে মানুষের নতুন নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে কুকুর, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগী, শুকর আর স্থায়ী বসবাসের ফলে একই জায়গায় গাছপালা পশুপাখির সঙ্গেও মানুষের অনেক বেশি নিয়মিত সংযোগ ও মিথস্ক্রিয়া (Interaction) ঘটতে লাগল। আর সেই সুযোগে মানুষের অজান্তেই ঘটে চলল অনুজৈবিক কর্মকাণ্ড। পশুপাখির শরীরের অসংখ্য রোগজীবাণু বারবার মানুষের শরীরের সংস্পর্শে আসার সুযোগে বিবর্তিত হয়ে ঠাঁই করে নিল মানুষের চামড়ায়, পাকস্থলীতে কিংবা রক্তে। তারপর আর এক ধাপ এগিয়ে ঐসব রোগজীবাণু মানুষ থেকে সরাসরি মানুষে ছড়াতে বিভিন্ন মাধ্যম আশ্রয় করল যেমন মশা, মাছি, কৃমি, লালা, রক্ত, প্রভৃতি।
একইভাবে জীবিকা আর আবিষ্কারের প্রয়োজনে মানুষের জগৎ জোড়া পরিযানের অভ্যাসও তাকে পৌঁছে দিল নানা বিচিত্র জলবায়ু ও প্রাকৃতিক অঞ্চলে। সেখানেও দেখা হল নতুন জীবজন্তু, গাছপালা আর জীবাণুদের সঙ্গে। তার মধ্যে কিছু কিছু মানুষকে সংক্রামিত করল, বাসা বাঁধল শরীরে। অবশ্য ফেলে আসা অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা কিছু রোগ জীবাণু স্বাভাবিক কারণে নির্মূল হল নতুন পরিবেশে। এভাবেই ক্রমশ প্রতিটি প্রাকৃতিক অঞ্চলভিত্তিক কিছু স্থানীয় বা দেশগত (endemic) রোগ চিহ্নিত হল যেগুলোর বিস্তার একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে মানুষ তার মেধা আর পর্যবেক্ষণের সাহায্যে প্রত্যেক অঞ্চলের প্রকৃতি থেকে রোগনিরাময়ের ওষুধও আবিষ্কার করতে থাকল। অতএব একই অরণ্য-প্রকৃতি তাকে দিল খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান আবার রোগব্যাধি ও তার নিরাময়ও। এক অনন্য ঐকতান গড়ে উঠল মানুষ আর তার আবাসস্থলের প্রকৃতির মধ্যে। আর সেই কারণেই আদিকাল থেকে এত রোগজীবাণুর মধ্যেও মানুষজাতির সফল বিবর্তন ঘটেছে। এটাই হল মানুষের অসাধারণ মানিয়ে নেবার ক্ষমতা (adaptive habit) বা অভিযোজন প্রবণতা। এখন প্রশ্ন হল আদি মানুষ ভয়ঙ্কর সব দ্রুত সংক্রামিত ব্যাধি এবং মহামারী থেকে নিজেকে এত হাজার বছর বাঁচাল কিভাবে? আসলে সব রোগই সংক্রামক নয় আর যে কোন সংক্রামক রোগের মহামারী রূপ নেবার জন্য কিছু বিশেষ অবস্থা বা কার্যকারণ থাকতে হয়।
সেইসব রোগ-মহামারীর সম্বন্ধে প্রাথমিক বিস্ময় আর অপদেবতা, দানব, পিশাচ, ডাইনীর মতবাদ ডিঙিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা করে যে বিদ্যার সূত্রপাত করেছিলেন সেই হিপোক্রেটিস, আজ তারই নাম মহামারী-সংক্রান্ত বিদ্যা বা এপিডেমিওলজি। প্রধানত সংক্রামক রোগের উৎস, কারণ ও বিস্তারকে সহজবোদ্ধভাবে দেখানো হয় এপিডেমিওলজিক্যাল ত্রিভুজের মাধ্যমে।
(ক) রোগজীবাণু বা Agent হচ্ছে সবরকম সংক্রমণকারী অনুজীব বা প্যাথোজেন (Pathogen) যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াম, প্যারাসাইট ইত্যাদি। এদের ক্ষমতা আছে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে হারিয়ে যে কোন বড়ো প্রাণী ও মানুষকে রোগগ্রস্ত করে দেবার। অবশ্য কোন প্রাণী এদের সংস্পর্শে আসলে তবেই। আর বিস্তারিত ভাবে দেখলে বিভিন্ন রাসায়নিক, ভৌত অথবা ভৌত-রাসায়নিক কারণ এবং আঘাতজনিত কারণগুলোকেও মেনে নেওয়া হয়েছে।
(খ) মানুষ স্বয়ং রোগের আশ্রয়দাতা বা Host, অর্থাৎ যে রোগগ্রস্ত হয়। সব মানুষই অবশ্য একই সময়ে একই পরিবেশে একই জীবাণুর সংক্রমণে রোগগ্রস্ত হয় না। কারণ সেখানে কাজ করে risk factors বা মানুষের শরীরের মধ্যে আগে থেকে ঘটে থাকা নানা রকমের রোগ প্রতিরোধের দুর্বলতা অথবা কো-মর্বিডিটি বা উপস্থিত অসুস্থতা। এছাড়া অন্য কারণগুলোর মধ্যে আছে মানুষের জিনগত চরিত্র এবং তার পরিবর্তন বা সামগ্রিক পরিবেশ হচ্ছে ঐ ত্রিভুজের তৃতীয় এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী কারণ। এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো হচ্ছে পাথর, মাটি, খনিজ, জল, হাওয়া, আর্দ্রতা, উষ্ণতা এবং উদ্ভিদ ও পশুপাখি-পোকা-মাকড়। আর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে রয়েছে লোকসংখ্যা ও তার ঘনত্ব, স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার ব্যবস্থা আর মানুষের নানা রকমের প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, আচার-বিচার, সংস্কার ইত্যাদি।
অতএব বোঝা গেল যে কোন সংক্রামক রোগের ছড়িয়ে পড়া ও মহামারী রূপ নেওয়ার জন্যও পরের তিনটি উৎপাদকের নিজ নিজ অবস্থা ও তিনটির মধ্যে বিশেষ মিথস্ক্রিয়াজাত সম্পর্ক থাকা দরকার। ঐ তিনটির মধ্যে সাম্যাবস্থা বা সুস্থিতির অভাব ঘটলে রোগ-মারী ঘটতে পারবে।
বিশেষত মহামারী ও বিশ্ব-মহামারী হতে গেলে আরও কয়েকটি পরিবেশ ও পরিস্থিতির শর্ত পুরণ করতে হয়। মহামারী সংক্রান্ত বিজ্ঞানীরা বিগত দশকে প্রমাণ দেখাতে পেরেছিলেন যে কমপক্ষে ১০ লক্ষ মানুষ ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চলে থাকলে তবেই কোন সংক্রামক রোগের মহামারী ঘটতে পারে। আর এই আবিষ্কারই প্রমাণ করে যে মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০০ বছরের আগে মানব সমাজে কোন মহামারী ঘটতে পারেনি।
SARS (2002), MARS (2012), Avian Flu আর Swine Flu যে সংকেত দিয়েছিল Novel Corona Virus বা SARS-CoV-2 সেটাই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। প্রকৃতির ওপর বিজয় ঘোষণাকারী অতিআধুনিক উন্নত মানবসমাজ সেই প্রকৃতির ছোট একটা চ্যালেঞ্জের কাছে আজ কতটাই অসহায়। এতদিনে আমরা জানতে পেরেছি যে প্রাকৃতিক অঞ্চল বা জলবায়ুগত বৈচিত্র্যই হোক অথবা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, সম্পদ, জ্ঞানগত তফাৎ এই ভাইরাসের কাছে কোন রেহাই নেই। শুধুমাত্র মানুষের সুস্বাস্থ্য আর তারুণ্যের তেজ মানুষকে কিছুটা সুবিধা দিচ্ছে এই ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের’ লড়াইতে। এবার তাই আমাদের স্বীকার করার সময় এসেছে মানুষের সুস্বাস্থ্য আসলে নির্ভর করে প্রকৃতির সুস্বাস্থ্যের ওপর। যেমন, সুস্থ মায়ের সুস্থ সন্তান। আজকের অসুস্থ ধরণীতে তাই মানুষের অসীম অসুস্থতা।
সেই ১৯৩০-এ আবিষ্কৃত করোনা ভাইরাস প্রাথমিকভাবে দেখা দিতে থাকে অনেক ধরণের বন্যপ্রাণী আর গবাদিপশুদের মধ্যে যেমন শুয়োর, ঘোড়া, উট, কুকুর, বেড়াল, ইঁদুর, পাখি আর বাদুড়ের মধ্যে এবং অজানা কিছু মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে।
তারপর মানুষের সঙ্গে এই করোনা আক্রান্ত পশু-পাখিদের নানাভাবে সংযোগের ফলে ভাইরাসটি চরিত্র বদলিয়ে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে সক্ষম হয়। ১৯৬৫ সালে মানুষের মধ্যে প্রথমবার করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়। নাম দেওয়া হয়েছিল HCoV-22GE। তারপর থেকে আজকের এই SARS-Cov-2 হচ্ছে এর সপ্তম অবতার। এদের সঙ্গে সোয়াইন আর এভিয়ান ফ্লুকে যোগ করলে ফলাফল পরিষ্কার যে বর্তমান পৃথিবীতে পশু-পাখি থেকে সংক্রামিত ভাইরাসগুলোই মানুষের কাছে সবচেয়ে ক্ষতিকর ও ভয়ঙ্কর শত্রু। এই যে অন্য প্রাণী থেকে মানুষের দেহে সংক্রমণের প্রক্রিয়া তার কেতাবী নাম ‘জুনোসিস’ আর এই প্রক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া মানুষের রোগগুলোকে বলা হয় ‘জুনোটিক্’ রোগ। এখানে বলে রাখি মানুষের মধ্যে দেখা দেওয়া নতুন রোগের ৭৫ ভাগ এবং মোট সংক্রামক রোগের ৬০ ভাগই জুনোটিক্। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে হিসেব করে জানা গিয়েছে যে প্রায় ৩,২০,০০০ ভাইরাস শুধু স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বাস করে। তার মধ্যে অধিকাংশই উপকারী হলেও ঠিক কতগুলো রোগের কারণ হতে পারে সেটা জানা নেই। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা বা WHO জানিয়েছে যে বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ৫০ কোটি মানুষ জুনোটিক্ রোগে আক্রান্ত হয় এবং ২৭ লক্ষ মারা যায়।
পরিবেশের স্বাস্থ্য
হালফিলের সমীক্ষা বলছে কম পক্ষে ৮৭ লক্ষ প্রজাতি পৃথিবীতে মানুষের জীবনধারণের প্রাথমিক সুরক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু মানুষেরই ‘উন্নয়নের’ খাতিরে ৭৫ ভাগ স্থল এবং ৬৬ ভাগ সমুদ্রের স্বাভাবিক পরিবেশ খুব বেশিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রধানতঃ অরণ্য বিনাশ, অত্যধিক মাছধরা, বন্যপ্রাণী শিকার এবং চোরা শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ এবং অজানা প্রজাতির আক্রমণের কারণে সবচেয়ে বেশি প্রকৃতি ধ্বংস প্রক্রিয়াকে কমানো বা পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনবার সম্ভাবনা খুবই কম (UN Report) ।
এইভাবেই মানুষের দ্বারা পরিবর্তিত অসুস্থ পরিবেশ অনেক পুরোনো ও নতুন জীবাণুদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি এবং চরিত্র পাল্টাতে সাহায্য করে। যেগুলো এতদিন গভীর অরণ্যে পশু-পাখিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সেইসব রোগজীবাণু আর রোগের বাহকরা মানুষের সংস্পর্শে এসে পড়ে। এ ধরণের রোগ সংক্রমণ প্রক্রিয়ার বা জুনোসিস-এর অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
ধান ক্ষেতের মেঠো ইঁদুরের মাধ্যমে চীন দেশে হান্তান্ ভাইরাস প্রতিবছরই প্রায় এক লাখ মানুষকে সংক্রামিত করে কোরিয়ান জ্বরে। অধ্যাপক মোরসে তার ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে চীন দেশে বহুল প্রচলিত নিবিড় শুকর-হাঁস মিশ্র কৃষিব্যবস্থা থেকে নতুন নতুন ফ্লু ভাইরাস জন্ম নিয়েছে এবং বিশ্ব-মহামারীর রূপ নিয়েছে। দেখা গেছে এই হাঁসের প্রজাতিরা রোগের আশ্রয়দাতা আর শুকররা মধ্যবর্তী বাহক হিসাবে মানুষ
ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সংক্রমণের উপযুক্ত করে তোলে ভাইরাসগুলোকে। আসলে চীনদেশের এই সকল কৃষিব্যবস্থা একদিকে যেমন অনেক মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা দিয়েছে, অন্যদিকে ফ্লু ভাইরাসের বিস্তীর্ণ আঁতুড়ঘর বানিয়েছে।
তেমনই গারো পাহাড়ে সমীক্ষা করার সময় দেখেছি, আদিবাসীরাও স্বীকার করে যে ঝুম পদ্ধতির আদি প্রথা ছেড়ে সেচযুক্ত ধানচাষের প্রথায় অভ্যস্ত হতেই এই পুরো অঞ্চলটাই মারাত্মক পিএফ্ ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত হয়ে যায়। তার আগে পাহাড়বাসীদের মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রায় অনুপস্থিত ছিল। এশিয়া মহাদেশে জাপানী এনকেফেলাইটিসের বাহক মশার প্রজনন খুব বেড়ে যায় জলে ডোবা ধানক্ষেতে। অনেক সময় মানুষ এই সব রোগের সরাসরি কারণ না হলেও আমাদের হাতে হওয়া ক্রমাগত অরণ্যবিনাশের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য অনেক রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। যেমন ভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে বহুকাল আগের হ্যান্ডাভাইরাস(HPS) থেকে মহামারী দেখা দিয়েছিল ১৯৯৩-তে। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আর্দ্র শীতকালে হঠাৎই সেবছর ঐ ভাইরাসের বাহক এক ধরণের ইঁদুরের বংশবৃদ্ধি ঘটে। অপ্রতুল গবেষণা সত্ত্বেও আমাদের দেশে এই ধরণের উদাহরণ আছে বেশ কিছু।
ভারতের ‘বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ’গুলোর মধ্যে অরণ্যবাসী আদিবাসীদের
স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন সমীক্ষা ও গবেষণার কাজের সুবাদে অদ্ভুত কিছু বিপরীতধর্মী অবস্থার প্রমাণ পেয়েছি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল আমাদের দেশের সবচেয়ে সুস্থ ও জৈববৈচিত্র্যের আধার এইসব অরণ্য পরিবেশে হাজার বছর ধরে বসবাসকারীরাও অনেকরকম রোগগ্রস্ত। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক রোগের প্রকোপ। ভারতের বিভিন্ন প্রাকৃতিক অঞ্চলে অবস্থিত ছয়টি বায়োস্ফিয়ারের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রধান রোগগুলোর প্রকোপ দেখানো হয়েছে ওপরের সারণীতে।
প্রথমতঃ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থাকলেও ছটি বায়োস্ফিয়ারে মূলতঃ তিন ধরণের রোগের প্রকোপ বেশি। শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ বা ভাইরাসজনিত, ম্যালেরিয়া অর্থাৎ মশাবাহিত আর ডায়ারিয়াজনিত অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ। দ্বিতীয়ত সুউচ্চ হিমালয় থেকে নদী-দ্বীপ অঞ্চলের প্রাকৃতিক চরিত্র অনুসারে রোগগুলো প্রথম তিনটি সারির মধ্যে জায়গা বদলেছে। লক্ষণীয় যে ছটি অঞ্চলের মধ্যে তিনটিতেই শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ প্রথম সারিতে আছে হিমালয়ের উচ্চতায় বা পাদদেশে। আর কম উচ্চতা ও উষ্ণতর অরণ্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। সুউচ্চ ট্রান্সহিমালয়ের স্পিতি উপত্যকায় ঠাণ্ডা মরু অঞ্চলে চোখের নানারকম রোগের প্রকোপও বেশি। প্রধানতঃ তীব্রসূর্যকিরণ ও অতিবেগুনী রশ্মির কারণে।
এককথায় বোঝা গেল প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয়ত অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশেও রোগের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে বেশি। শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের জন্য অবশ্য জুনোটিক্ কারণ ছাড়াও নানাধরণের ফুলের রেণুকেও দায়ী করা হয়। যদিও রেণু থেকে সাধারণ সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। আসলে বিস্তারিত সমীক্ষায় অবশ্যই জানা যাবে যে এইসব জঙ্গলের মধ্যেও মানুষের প্রভাবে প্রকৃতির মধ্যে নানা পরিবর্তন এসেছে। বন্যপ্রাণী আর অনুজীবদের বাসস্থানে হামলা হয়েছে এবং মানুষের সঙ্গে তাদের সংঘাতও বেড়েছে। ভয়ের কারণ হচ্ছে অন্যদেশ থেকে আসা পরিযায়ী পাখির দল যে কোন সময়ে বার্ড ফ্লুএর ভাইরাস নিয়ে আসতে পারে এইসব অরণ্যবাসীদের মধ্যে। আশেপাশের গৃহপালিত পশুর থেকেও বন্যপ্রাণীদের মধ্যে রোগ সংক্রমণ ছড়াতে পারে জঙ্গলে এবং উল্টোটাও। একটাই ভরসা এই আদি অরণ্যবাসীদের প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক এবং রোগ প্রতিরোধের স্বাভাবিক ক্ষমতা।
দেখা গেছে যে জঙ্গল নির্মূল হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে মারাত্মক পিএফ্ ম্যালেরিয়া খুব বেড়ে যায়। অরণ্যের সূক্ষ্ম বাস্তুতন্ত্রে রোগজীবাণুর সংক্রমণের প্রক্রিয়াও বেশ জটিল বিশেষত্বপূর্ণ। সেই সূক্ষ্মতন্ত্রীতে আঘাত পড়লে তার তরঙ্গায়িত প্রভাব মানুষের সমাজে বিভিন্নভাবে পড়বেই। আজ আমাদের স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে প্রকৃতি-প্রাণী আর মানুষের জীবন একই সূত্রে বাঁধা তেমনই এদের স্বাস্থ্যও।
গবেষকদের মতে আমাদের দেশটা বর্তমানে জুনোটিক, ওষুধপ্রতিরোধী এবং ভেক্টরজাত রোগের এক ‘হটস্পট’। শাহিদ জামিল তাঁর ২০১৭ সালের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে ভারতে ১৩৪ কোটি জনসংখ্যা, ৫১.২ কোটি গৃহপালিত পশু এবং ৭২.৯ কোটি পোলট্রির পাখি নিয়ে মানুষের সঙ্গে পশুপাখি, পশুপাখির সঙ্গে পশুপাখির আর মানুষের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শের ঘটনা ও সম্ভবনা দুটোই খুব বেশি। তাছাড়া ভারতে বিগত তিন দশকে মোট ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছে। এ সবই জুনোসিস্ প্রক্রিয়ার সহায়ক। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তেমনকিছু গবেষণা করা হচ্ছে না। আর্থিক হিসাব করলেই বোঝা যাবে যে একটি মহামারীর জন্য যে বিপুল ক্ষতি হয় তার থেকে এইসব ভাইরাসগুলোকে খুঁজে বার করা এবং প্রয়োজনীয় গবেষণা ও পরিকল্পনা রূপায়ণে অনেক কম খরচ পড়বে।
আরও মনে রাখতে হবে যে প্রযুক্তি আর আর্থিক স্বচ্ছলতায় আমরা যে বিশ্বায়নের অঙ্গ, সেখানে বিশ্বজুড়ে মানুষের যাতায়াত ও পরিযান খুবই সহজ হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গেই সহজ ও স্বাভাবিক হয়েছে মানুষবাহিত সংক্রামক রোগের অতিদ্রুত বিস্তার। একই কারণে এক প্রান্তে উৎপাদিত জৈব এবং খাদ্যসামগ্রী পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে পৌঁছচ্ছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এবং সঙ্গে কিছু রোগজীবাণুও। অন্যদিকে রোগজীবাণুরাও পরিবেশ অনুযায়ী দ্রুত নিজেদের পাল্টিয়ে ফেলছে। চাষের ক্ষেতে কীটনাশক অথবা পশুখামারে এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের ফলে অনেকক্ষেত্রেই জীবাণুরা ঐ সবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ওষুধ ও কীটনাশক প্রতিরোধী জীবাণু, প্যারাসাইট।
অভিন্ন-স্বাস্থ্য পরিকল্পনা
WHO আর অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সিডিসি (Central Disease Control and Prevention) গত ২০১৭ সাল থেকে মানুষ, পশু আর পরিবেশের এই সম্পর্ককে মাথায় রেখে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নতুন কৌশল হিসেবে ‘One Health Approach’ বা ‘অভিন্ন-স্বাস্থ্য অভিমুখ’-এর প্রস্তাব ও প্রচার শুরু করেছে। ক্রমশ অন্যান্য দেশও যোগ দিয়েছে। এককথায় মানুষ-পশু-পরিবেশের স্বাস্থ্যকে একই চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা। সহজ উদাহরণ হচ্ছে জলাতঙ্ক রোগ থেকে মানুষকে বাঁচাতে যেমন কুকুরকে প্রতিষেধক দিতে হয়। এই নতুন ব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে হলে প্রথমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং ক্রমশঃ পরিবার-গোষ্ঠী-দেশ-মহাদেশ এবং সারা বিশ্বকে জুড়ে ফেলতে হবে চিকিৎসা ও পরিবেশ সংরক্ষণের সামগ্রিক রূপরেখা নিয়ে। আপাততঃ আমেরিকায় বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘একস্বাস্থ্য’ সচেতনতা প্রচারের দলগুলো কাজ করে সুফল পেতে শুরু করেছে। যদিও আমাদের দেশে এই নতুন অভিমুখ নিয়ে তেমন কোন কাজ এগোয়নি। মোট ৪৬০টি মেডিকেল কলেজ আর ৪৬টি ভেটেরিনারি কলেজ থাকা সত্ত্বেও এই জুনোসিস্ নিয়ে গবেষণার অভাব রয়েছে। আশার কথা ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এবং পশুকল্যাণ পর্ষদের এক মামলায় পরিবেশকেন্দ্রীক আদেশকে মান্যতা দিয়েছে এবং আমদের গ্রীন ট্রাইবুনাল বর্তমানে অনেকটাই পরিবেশ বাঁচানোর পক্ষে এগিয়ে আসছে। অন্যদিকে আবার চিন্তার বিষয় ভারতীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক প্রস্তাবিত EIA Act 2020তে শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় পরিবেশ রক্ষার কবচগুলোকে ভয়ঙ্করভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
বিশ্বজোড়া এই মহামারীর পর্বত প্রমাণ ক্ষতির পেছন থেকে একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সেই ১৯৭০-এর স্টকহোম ঘোষণা থেকে বলে আসা যে সতর্কবার্তাগুলো আমরা সবাই কানে তুলিনি আজ এই ক্ষুদ্র সার্স-কোভ-২ ভাইরাস যদি ভয় দেখিয়ে, ঘাড় ধরে সেগুলো মানতে বাধ্য করায় – তাহলে ভবিষ্যতের আতঙ্কময় দিনগুলো থেকে রেহাই পাবো আমরাই – মানুষের আগামী প্রজন্ম। মনে রাখতে হবে আগামী মহামারীর মোকাবিলার জন্য মানুষের চিকিৎসার সঙ্গে প্রাধান্য দিতে হবে এই রোগগ্রস্ত পরিবেশের ‘চিকিৎসাকে’। দেরী হয়ে গেলেও, সঠিক অনুপাতে নীরোগ অরণ্য আর জলাভূমিই মানবজাতীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রকৃত ভরসা হতে পারে।
তথ্যসূত্র
Cockburn, A (1979) In: Health and Disease in Tribal Societies, Ciba Foundation Symposium 49, 102-113; Amsterdam, Oxford, New York.
IPBES (2019) Global Assessment Report on Biodiversity and Ecosystem Intergovernmental Science-Policy Platform on Biodiversity and Ecosystem Services (IPBES)
ISBN No: 978-3-947851-13-3
Jameel, S (2017) Emerging Infectious Diseases, One Health and India, - The Hindu, July 15, 2017
Mukherjee. S (2019) Geo-Medical Aspects of Acute Respiratory Infections among the Forest Dwellers of North-East India – Anthropos India, Vol. 5, No. 2, July – Dec 2019
Rapport, D.J. (2010) The Health of Ecology and Ecology of Health in Human and Ecological Risk Assessment: An International Journal: Vol – 8, No. 1