সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
“বাংলা বিহার উড়িষ্যার পূর্বতন রাজধানী মুর্শিদাবাদে আপনাকে স্বাগত”, স্পষ্ট, কাটা কাটা করে বলা কথাগুলো কানে এলো প্রিয়মের। স্বর যদিও কিছুটা স্তিমিত। কে ওকে স্বাগত জানালো, প্রিয়ম বুঝতে পারল না। ও আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল্ না। এই জায়গাটা, মানে মুর্শিদাবাদ স্টেশনের লাগোয়া চত্বরটা এখন বেশ ফাঁকা। প্রিয়ম একাই একটা সিমেন্ট-বাঁধানো চাতালে বসে আছে। শীতের সকালের নরম রোদের ওম উপভোগ করছে। ওঠার তাড়া নেই। বিকেল পর্যন্ত সময় হাতে আছে। ফিরতি ট্রেনের আগে।
নির্দিষ্ট কোনো কাজ বা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রিয়ম মুর্শিদাবাদে আসেনি। খানিকটা খেয়ালের বশে ভোরের প্রথম লালগোলায় চেপে বসেছিল। সকাল সাড়ে আটটায় নেমেছে এখানে। ইউনিভার্সিটির পাট শেষ করে প্রিয়ম এখন খবরের কাগজে ফ্রি ল্যান্সিং করে। এই বাংলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান নিয়ে একটা কলাম লিখছে ওর কাগজে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। সেই কাজে গত মাসেই ও মুর্শিদাবাদে ঘুরে গেছে। কিন্তু পেশাগত প্রয়োজনের বাইরে ওর আবার এখানে আসার ইচ্ছেটা পেয়ে বসেছিল। তার একটা কারণও ছিল অবশ্য। সে কথা ভাবলে ওর এখানে আসাটা একেবার উদ্দেশ্যহীন বলা যায় না।
প্রিয়ম আগেরবারই দেখেছিল, এখানে টাঙ্গার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। টাঙ্গার প্রতি ওর আকর্ষণ ছোটবেলা থেকে। যখনই এখানে বেড়াতে এসেছে, টাঙ্গায় চড়ে ঘুরেছে। সেই টাঙ্গার অনুপস্থিতি ওর কাছে মুর্শিদাবাদের মহিমা যেন একটু খাটো করে দিয়েছে। এবার তাই প্রিয়ম ভেবেছে, বিষয়টা নিয়ে খোঁজ খবর করবে।
ছোটবেলা থেকে দেখা মুর্শিদাবাদ স্টেশনের চেহারার বদল ঘটেছে অনেকটাই। উন্নয়নের রূপটান লেগেছে এর গায়ে। ভিড় বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে এই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই ভিড় যথেষ্ট ভীতিপ্রদ, ট্রেনে বসেই টের পেয়েছে প্রিয়ম। সেই ভিড়ের ধাক্কা এড়িয়ে চলতেই প্রিয়ম বেশ খানিকক্ষণ হল এখানে বসে আছে। ট্রেন থেকে নামা শেষ মানুষটিও চলে গেছেন খানিক আগে। থেমে গেছে রিকশা, টোটোর হাঁকাহাঁকি। পুরো চত্বর শুনশান হয়ে এলে প্রিয়ম মন্থর পদে স্টেশনের বাইরে আসে। কয়েক পা এগিয়ে বাঁ দিকে দেখতে পায় লেখা, টাঙ্গা স্ট্যান্ড। কিন্তু সেখানে না আছে টাঙ্গা, না আছে কোনো মানুষ! ওর কাছাকাছি একটা সিমেন্টের চাতালে এসে প্রিয়ম বসে পড়ে। স্ট্যাণ্ড যখন, এখানে খানিক বাদে হলেও টাঙ্গার দেখা মিলবে নিশ্চয়ই! প্রিয়ম অপেক্ষা করে। সকালের মিঠে রোদে বসে থাকতে মন্দ লাগছে না!
“বাংলা বিহার উড়িষ্যার পূর্বতন রাজধানী মুর্শিদাবাদে আপনাকে স্বাগত”, কথাটা আবার একই স্বরে ভেসে আসে! উচ্চারণের মধ্যে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। প্রিয়ম এদিক ওদিক তাকায়। নাঃ, কেউ কোত্থাও নেই! আশে পাশের গুমটি দোকানগুলো থেকে নিশ্চয়ই কথাটা আসছে না! ও তো সেখান থেকে খানিক দূরেই বসে আছে! তবে কী এই বিজন স্টেশনে ভূতের পাল্লায় পড়ল সক্কাল সক্কাল! কথাটা ভেবে নিজেই হেসে ফেলে প্রিয়ম। আলগোছে পেছন ঘুরে ও কোনাকুনি একটা সাদা ঘোড়া দেখতে পায়। স্ট্যাণ্ডের একেবারে কোনার দিকে একটা ভাঙা শেডের তলায় ঘোড়াটা কিছু একটা চিবোচ্ছে। সূর্যের আলো ওর ঠিক আগে এসে থমকে গেছে। ফলে ওর শরীরের সাদা রঙে আঁধারের প্রলেপ পড়েছে। খানিকটা তফাতে থেকেও প্রিয়ম ওর পাঁজরের হাড়গুলোকে গুনতে পারছে। মুখে লাগাম পরানো না থাকলেও তার স্মৃতি আছে। প্রিয়মের কানে বিলীয়মান স্মৃতির টগবগ টগবগ শব্দ ঘোড়াটার খাদ্যবস্তু চিবোনোর শব্দে এসে থিতু হয়। প্রিয়মের মনে হয়, ভেসে আসা এই স্বাগত বাণী এই ঘোটকের মুখনিঃসৃত। ও আস্তে আস্তে ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে যায়। ওর গায়ে হাত রাখে। ঘোড়াটি ওর চর্বণক্রিয়া বন্ধ রাখে। প্রিয়মের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করে হয়ত! প্রিয়ম জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম?
নবাব।
প্রিয়ম ঝুঁকে পড়ে ওকে অভিবাদন জানায়!
অদ্ভূত এই মুর্শিদাবাদ শহরটা! শহুরে সমস্ত লক্ষণ ট্রেনে চড়ে এখানে এসে পড়ে, ট্রেন বেরিয়ে যাবার পর সেসবও বিদায় নেয়, শহর তার আড়ষ্ট ভাব ঝেড়ে ফেলে পল্লীপ্রকৃতির নকশীকাঁথায় নিজেকে প্রসন্ন উদারতায় মেলে ধরে! সকাল সাড়ে ন’টার মুর্শিদাবাদ শহরের দিকে তাকিয়ে প্রিয়মের সে কথাই মনে হল। নবাবের সঙ্গে আলাপ জমার পর ওর নিশ্চিত ভাবেই মনে হয়, নবলব্ধ এই সখাই ওকে দোরে দোরে নিয়ে যাবে, পরিচয় করাবে সকলের সঙ্গে।
প্রিয়ম নবাবের সাথে চলতে শুরু করে। দুজনেই দুজনের গতির সঙ্গে তাল মেলায়। এক মন্থর, ছন্দোবদ্ধ চালে ওরা স্টেশন এলাকা ছাড়িয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে।
স্টেশনের ধারে কাছের হোটেল, দোকানপাট ছাড়িয়ে এলে চাষের ক্ষেত চোখে পড়ে। তার ওপর দিয়ে রেললাইন দেখা যায়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখে প্রিয়মের মন অনেকদিন পর ভালোলাগায় ভরে ওঠে। রাস্তার ওপর লাফাতে থাকা ছাগলছানার মতো ওর মনও নেচে ওঠে!
তোমার মালিকের নাম?
নবাবের মালিক আবার কে হবে, খোদাতাল্লা ছাড়া? ঘোড়াটার চিঁহি চিঁহি শব্দে প্রিয়ম যেন হাসির আভাস পায়। ও অপ্রস্তুতে পড়ে! নবাব সেটা টের পেয়েই যেন বলে, সাদিকুর। সাদিকুর শেখ। চলো তোমায় আলাপ করাবো সাদিকুরের সঙ্গে। যাবে? প্রিয়ম সম্মতিতে মাথা নাড়ে।
একটু দূর থেকে নবাব দেখিয়ে দেয় সাদিকুরের বাসা। তুমি যাবে না? প্রিয়মের এই প্রশ্নের উত্তরে নবাব জানায়, না। আমায় দেখলে সাদিকুর অস্থির হয়ে পড়বে। কী দরকার বুড়োটাকে ঝামেলায় ফেলে!
ক্ষয়াটে চেহারা। কালচে বাদামী গায়ের রঙ। থুতনিতে সামান্য এলোমেলো দাড়ি ঝুলছে। কোটরগত চোখে শূন্য দৃষ্টি। একটা সাদা ফতুয়া আর নীল চেক লুঙ্গি পরে ঘরের বাইরে বসে আছে সাদিকুর। ঠোঁটে ঝুলছে নিভে যাওয়া বিড়ি। কাজে যাওনি চাচা? প্রিয়মের এই প্রশ্নে সাদিকুর দুনিয়ার বিস্ময় মুখে জড়ো করে ওর দিকে তাকায়। অপরিচিত আগন্তুককে দেখে ও যতটা না অবাক হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হয়েছে ওর কাণ্ডজ্ঞানহীন রসিকতার প্রশ্ন শুনে! কিন্তু প্রিয়ম আলাপে ওস্তাদ। ঝুলন্ত বিড়িতে আগুন দিয়ে ও সাদিকুরের পাশে বসে পড়ে। কথায় কথায় সাদিকুরেরও মনে হয়, এতদিনের পাক খেয়ে মরা কথাগুলো একে তো বলাই যায়!
কোথা থেকে টাঙ্গা দেখবে বাপ? টাঙ্গাও্য়ালাদের দিন শেষ! এখন টুকটুকির সময়! যারা ঘুরতে আসে, তাদেরও ঘড়িতে দম লাগানো থাকে! যত জলদি যত বেশি জায়গায় ঘুরা যায়! সময় শুধু আমাদের হাতেই মেলা পড়ে আছে। পার করবার যো নাই!
তুমি তো দেখছ টুকটুকিগুলা। ওই মিনমিন করে চলা টুকটুকিকে আমরা বয়সকালে পায়ে হেঁটে পার হয়ে যাবার পারতাম! ওগুলার সঙ্গে ঘোড়ার তুলনা? একটানা কথা বলার জন্যই হোক, বা ঘেন্নায়, সাদিকুর একদলা থুতু ফেলে একটু দম নেয়!
প্রিয়ম এদিক ওদিক চোখ ঘোরায়। চাচা কি একা মানুষ, না পরিবার আছে! ছেলেমেয়ে? এক লপ্তে এত কথা জিজ্ঞেস করা শোভা পায় না। কিন্তু প্রিয়মের জিজ্ঞাসা সাদিকুরের চোখ এড়ায় না সম্ভবত। সাদিকুর হাঁক দেয়, টুলুর মা, বাপজানেরে এট্টু জল দাও। কলকেতা থেকে আসেছে। কিছুক্ষণ পরে একটা ঝকঝকে স্টিলের ঘটি ভর্তি জল, আর একটা সস্তা রেকাবিতে এক খণ্ড গুড় নিয়ে আসে টুলুর মা। পরনে ছাপা শাড়ি। মাথার ঘোমটা আলগোছে টানা। প্রিয়ম এতক্ষণে টের পায়, ওর অসম্ভব তেষ্টা পেয়েছিল!
টুলুর মা ওদের সামনে এলে সাদিকুর দু’পর্দা স্বর নামিয়ে বলে, সে ছোঁড়ারে কটা ছোলা-গুড় দিয়ো টুলুর মা। ইধারেই সে ঘাপটি মেরে আছে! সে কথা শুনে চমকে ওঠে প্রিয়ম! ওর অভিব্যক্তি দেখে করুণ হাসি হাসে সাদিকুর! বলে, শুধু শুধু ঘরে রেখে খাওয়ানো আমাগোর চলে, বলো! ছেলেরা চায় না। বলে, টাঙ্গা চলে না, নবাবের বয়সও হয়েছে। চরে খাক। আমি বলি, এই ভিটেটা আমারে বাঁচায়ে দিল রে বাপ! না হলে.. কথা শেষ করে না সাদিকুর। বিড়িতে ব্যর্থ টান দেয়। প্রিয়ম আবার আগুন যোগান দেয়।
একটা বাইক ঘরঘর শব্দে এসে দাঁড়ায়। সাদা জামা, সাদা প্যাণ্ট, চোখে নীল রঙের সানগ্লাস পরে একটা ছেলে এসে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢোক। আবার বাইক উড়িয়ে বেরিয়েও যায়। সাদিকুর জানায়, আমার ছোট পোলা। বড়টা যোগানের কাজ করে। শাদি করে পাশেই ভেন্ন থাকে। এই ছোঁড়া নেকাপড়া করে পাস দিল। কোথায় ইস্কুলে চাকরি হবে বলে আফজলেরে টাকা দিছিল। আমি জমি বেচে সে টাকা ধরে দিলাম। কোথায় চাকরি! কোথায় আফজল! আমি কিন্তু বলেছিলাম, ওই আফজল পাটির চক্করে ঘোরে, ফেউয়া মাল! ওরে ট্যাহা দিস না! তা মুখ্যু বাপের কথা শুনবে কেডা! বলে, সবাই দেছে! সবাইরে ঠকাবে, এতবড় বাপের ব্যাটা সে! তা হল তো! তাগোর কেউ এখন বাপের হাল চষে, কেউ টুকটুকি চালায়। এক পোলা তো হুনি, লাইনে গলা দেছে! মেলা দ্যানা হয়েছিল। কী করবার পারলি তোরা, ছ্যামড়ার দল! আফজল তো ট্যাহা নিয়ে ভোঁ ভাঁ! ওর বাপে আবার চোপা দেখায়ে কয়, যে টাকার রঙ দ্যাখলাম না চোখে, তার জিম্মাদার আমি হব ক্যানে! সাদিকুরের বোধহয় আরেকবার থুতু ফেলার ইচ্ছে হয়, কিন্তু ও একটা ঢোক গিলে হাসে! শীতের রোদ্দূরও প্রিয়মের গায়ে চড়া হয়ে লাগে। ও উঠে পড়ে। ওর সঙ্গে সঙ্গে সাদিকুরও ওঠে। তারপর খুব গোপন কোনো কথা জিজ্ঞেস করছে, এমন ভাবে প্রিয়মের কানের কাছে মুখ এনে বলে, কিছু শুনলা? তুমরা তো কাগজের লোক। আমাগো কি ভাগায়েই ছাড়বে? কত নকশার কাগজ তো চাইতেই আছে এরা! টুলু আসে খবর দেয়! প্রিয়ম মৌন থেকে এগিয়ে যায়!
নবাব খানিকটা রসিকতার ঢঙে ওকে বলে, আমাদের অন্তত এই একটা বাঁচোয়া। ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের চক্কর আমাদের নাই। প্রিয়ম হাসে। সাদিকুরের ঘর ছেড়ে ওরা একটা মোড়ের মাথা থেকে ডান হাতের রাস্তা ধরে। বাঁ দিকে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নামে কলেজ। বড় ক্যাম্পাস। আরেকটু এগোলে মহকুমা হাসপাতাল, কোর্ট। এইখানে ভিড়ভাট্টা খুব বেশি। চিকিৎসাপ্রার্থী, এবং বিচারপ্রার্থী সকলকেই এক ঝটকায় দেখলে কেমন সাদিকুরের মতো মনে হয়! এক চেহারা, এক দৃষ্টি! প্রিয়ম এলাকাটা তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে। নবাব এগিয়ে গেছে। প্রিয়ম দেখে রাস্তার মোড়ের সিভিক ভলান্টিয়ার আলতো চাপড়ে নবাবকে মাঝ রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।
ট্র্যাফিক মোড় পার করে নবাব ডানদিকে ঘুরে যায়, ওর দেখাদেখি প্রিয়মও। একটা বড়, ঘেরা জায়গায় ঢুকে নবাব বলে, এটা হল নবাবী আমলের আস্তাবল। জায়গাটার নামও আস্তাবল মোড়। আমাদের কত পূর্বপুরুষের থাকার যায়গা ছিল। এখন দেখে কিছু মনে হয়? দেখ, কেমন সুন্দর রোদ পড়েছে! কী নির্লজ্জ, ফ্যটফ্যাটে বাহার! শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কিছু যায় আসে না! একটা জ্যয়গার নাম আস্তাবল, অথচ সেখানে একটাও ঘোড়া নেই, কতদিন ধরে নেই, তাকেই সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়েছে! ভাবো একবার! সাদিকুরেরা এমনি এমনি ভয় পায় না! একটানা কথা গুলো বলে নবাব বেশ হাঁপিয়ে ওঠে। খানিক্ষণ জিরিয়ে প্রিয়মকে বলে, এর পেছনের অংশে বাজার হয়েছে। সবজি, মাছের বাজার। চলো, তোমায় দেখাবো!
বাজারের দিকে আসার পর নবাব থেমে যায়! বলে, যাও, দেখে এসো সবটা। আমাকে দেখলেই খেদাবে!
বাজারটা দেখে প্রিয়ম বেশ অবাক হয়। বড় একটা অংশ জুড়ে দু’পাশে বাজার বসেছে। মাথার অনেক উঁচুতে নবাবী আমলের ছাদ। এখন বেশিরভাগটাই ভাঙা। নীচ থেকে পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে! পুরোনো কাঠের খিলানগুলো অসহায় ইতিহাস হয়ে ঝুলছে! যে সব দোকানদারেরা বসে আছে, বা ক্রেতারা, সকলেই সেই ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন বলেই ওর মনে হয়।
হাজারদুয়ারীর সামনের প্রান্তরে এসে প্রিয়ম একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচে! নবাবও যেন একটু উত্তেজিত। বেশ কয়েকটা ঘোড়া এখানে নিজের মতো চরে বেড়াচ্ছে। একটা দুটো টাঙ্গাও আছে। নবাব যথারীতি একটা কোণা বেছে নিয়েছে। অপেক্ষকৃত নির্জন। দূর থেকে নজর রাখছে প্রিয়মকে, প্রিয়মের এরকমই মনে হয়।
এখানে বেশ ভালো ভিড় আছে। টিকিট কাটার লম্বা লাইন। বাইরেও প্রচুর লোকের ঘোরাফেরা। এটাসেটা কিনছে, খাচ্ছে, ঘন ঘন সেলফি তুলছে। পেশাদার ক্যামেরাওয়ালা ঘুরে ঘুরে ছবি তোলার অনুরোধ জানাচ্ছে সবাইকে। প্রিয়মকেও জানালো। এখন সকলের হাতে মোবাইল হওয়াতে এই ফটোওয়ালাদের দলও আস্তে আস্তে মুছে আসছে। প্রিয়মের এই সামান্য বয়সের দেখার মধ্যেই ও কত কিছুকেই হারিয়ে যেতে দেখছে, ভাবতে বসলে অবাক হতে হয়! একটাকে হটিয়ে দিতে না পারলে বাকিদের এগোনো থমকে যায়, এ এক আজব কল!
কতগুলো বাচ্চা বল খেলছিল। প্রিয়মের দিকে বল গড়িয়ে এলে ও বলটা তুলে ওদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। কিছুক্ষণ বাদে আবার সেই বল ওর দিকে উড়ে আসে। ও লুফে নেয়! খেলুড়ের দল হাততালি দিয়ে ওঠে! একজন দৌড়ে আসে ওর দিকে। বলে, খেলবে আমাদের সঙ্গে? প্রিয়ম হেসে, হাত নেড়ে ওদের ‘না’ বলে। ছেলের দল মুষড়ে পড়ে। বলে, দেখো না, সবাই একদলে থাকতে চায়! দল ভাগ না হলে ম্যাচ খেলব কি করে? প্রিয়ম কিছু না বলে, হেসে নবাবের কাছে এগিয়ে যায়।
নবাব ওকে বলে, সবাই বিপক্ষ চায়। বিপক্ষকে হারাতে না পারলে আরেকজন জিতবে কীকরে? আর না জিততে পারলে সুখ কোথায়, বলো? তাই একজন প্রতিপক্ষ দরকার। সবসময়। সব কালে।
দিনের আলো মরে আসে ক্রমশ। ঠাণ্ডাটা বেশ লাগছে গায়ে। প্রিয়মের ফেরার ট্রেনের সময় হয়ে এল। প্রিয়ম নবাবের গায়ে হাত বুলিয়ে নীরবে ওর কাছে বিদায় চায়। নবাবের নীরব দৃষ্টি বাঙ্ময় হয়ে ওকে কিছু বলতে চায়। প্রিয়ম সে জন্য অপেক্ষ করে। খানিক্ষণ পরে নিজেকে যেন খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে নবাব বলে, আবার দখা হবে বন্ধু।
প্রিয়ম বলে, হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে। ঘোড়ারা শুয়ে পড়ে কখন জানো তো? মরণকালে। তাই দাঁড়ানো, ছুটে চলা আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই জরুরী। বাঁচতে তো হবে। তাই ছুটতেও হবে। প্রিয়ম বিকেলের আলো-মাখা হাসি হাসে।
প্ল্যাটফর্মে প্রিয়ম এসে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসার খবর হয় মাইকে। প্রিয়ম প্ল্যাটফর্মের বাইরে তাকিয়ে ফেলে আসা দিনটাকে দেখতে চায় যেন! একসময় ঝমাঝম শব্দে ট্রেন ঢুকে পড়লে প্রিয়মের কানে সেই শব্দ ছাপিয়ে উঠে আসে এক দৃপ্ত টগবগ টগবগ শব্দ!