সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ভারতীয় শাস্ত্রে বর্ণ ও জাতব্যবস্থা
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ যখন মতুয়াদের (গোড়ায় চণ্ডাল, পরে নমঃশূদ্র) সাহায্য চেয়েছিলেন, তখন উত্তরে গুরুচাঁদ ঠাকুর তীক্ষ্ণ ভাষায় লিখেছিলেন, “নমঃশূদ্ররা গরিব লোকজন। না তারা বিলাসিতা করতে জানে, না করে। একমাত্র যে বিদেশি জিনিস তারা ব্যবহার করে তা হল আমদানি হওয়া সস্তা বিদেশি কাপড়। বিদেশি জিনিস ব্যবহারে অভ্যস্ত উঁচু জাতের লোকজন। এই বয়কট আন্দোলন অতএব শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। নমঃশূদ্ররা এখনো অব্দি কোনো রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নিজেদের জন্মভূমিতেই তারা নিদারুণভাবে নিপীড়িত এবং শোষিত। উচুঁ জাতের হিন্দুরা তাদের কোনোরকম কোনো রাজনৈতিক অধিকার দেবার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। অতএব [আগে] তারা নিচু জাত সম্পর্কে ভ্রাতৃত্ববোধ অর্জন করুক, তা নাহলে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কোনোরকম আন্দোলনে উঁচু জাতের হিন্দুদের সঙ্গে দলিত বা নিচু জাতের লোকজন সহযোগিতা করবে না।”
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই বক্তব্য থেকে যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে, সেগুলি হল যথাক্রমে,
১. নমঃশূদ্ররা বিলাসিতা করতে জানেও না, করেও না।
২. উঁচু জাতের লোকজনের হাতে তাদের সর্বাঙ্গীন লাঞ্ছনা। তাদের বঞ্চনা, নিপীড়ন ও শোষণ।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রথম বক্তব্যটা ভারতবর্ষের সর্বক্ষেত্রে খাটে, ‘নমঃশূদ্র’ শব্দটার জায়গায় ‘নিম্নবর্গের মানুষ’ শব্দদুটো বসিয়ে নিলেই হয়, তাতে বক্তব্যের সারবস্তু বদলাবে না। দ্বিতীয়টাও তাই, শুধু প্রাদেশিক ভিন্নতাভেদে। এমন নয় যে এ শুধু ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বা সামাজিক বঞ্চনা ও শোষণ, অর্থনৈতিক শোষণের সঙ্গে এইসব শোষণ এক অচ্ছেদ্যবন্ধনে জড়িত। বরং আরো পরিষ্কার হয় বললে যে বাকি শোষণগুলো অর্থনৈতিক শোষণেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
এই প্রসঙ্গে যেটা ভাবিত করে সেটা হচ্ছে এই শোষণের শুরু কবে? বেদের সৃষ্টি প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং ঋগবেদের প্রায় শেষে গিয়ে ১০ম মণ্ডলের ৯০ সূক্তে প্রথম ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই ক্রমবিন্যাসের উল্লেখ পাই। তবে এমন কথা বলা নেই যে সেগুলি বর্ণ (বর্ণ শব্দটা ঋগবেদের কোথাও কোথাও আছে, কিন্তু তা রং অর্থে। মাত্র দু’ জায়গায় মানুষের ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ পাই, আর্য ও দস্যু বা দাস বর্ণ, ভেবে দেখলে সেটাও রং হিসেবে)। পরবর্তী কোনো এক সময় থেকে এই ক্রমবিন্যাস বর্ণব্যবস্থা নামে অভিহিত হতে থাকে। Louis Dumont মনে করেন, এই বর্ণব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল পবিত্র-অপবিত্র তত্ত্বের ওপর--পবিত্রতম, পবিত্রতর, পবিত্র > অপবিত্র, অপবিত্রতর, অপবিত্রতম। ব্রাহ্মণরা হল পবিত্রতম যেহেতু তারা ব্রহ্মার প্রতিভূ, অপবিত্রতম হল অস্পৃশ্যরা বা অচ্ছুৎরা। প্রথম দিকে পঞ্চম বর্ণ ছিল না, সবটাই ছিল চতুর্বর্ণের অন্তর্গত, পরে পঞ্চম বর্ণ যোগ হয়, অচ্ছুৎরা (চণ্ডাল, অন্ত্যজ ইত্যাদি) হল অপবিত্রতম। ছান্দোগ্য উপনিষদে উষস্তি চাক্রায়নের একটা কাহিনি আছে, সে কাহিনিটা এখানে পেশ করা যায় যেহেতু সেটা পবিত্র-অপবিত্র তত্ত্বের একটা উদাহরণ এবং সে কাহিনি এটাও প্রমাণ করে যে এই বিচ্ছিন্নতার জন্ম বহু আগে। কুরুদেশ শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হলে চক্রের (ঋষি) পুত্র উষস্তি স্ত্রীকে নিয়ে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় ইভ্য গ্রামে বাস করছিলেন। একজন ইভ্য মাসকলাই খাচ্ছে দেখে উষস্তি তার কাছে গিয়ে নিজের খাবার জন্যে ও তাঁর স্ত্রীর জন্যে নিয়ে যাবেন বলে মাসকলাই ভিক্ষে করলেন। ইভ্য বলল যে থালায় এঁটো কিছু মাসকলাই রয়ে গেছে, তা ছাড়া আর কিছু নেই। উষস্তি বললেন তারই কিছু অংশ তাঁকে দিতে। ইভ্য দিল, দিয়ে বলল, “এই জলটাও কি দেব? ওটাও কিন্তু এঁটো।” উষস্তি বললেন, “না। তাহলে আমার উচ্ছিষ্ট পান করা হবে।” ইভ্য জিগ্যেস করল, “মাসকলাইটাও কি উচ্ছিষ্ট নয়?” উষস্তি উত্তর দিলেন, “ওটা না খেলে আমি বাঁচতাম না। জল খাওয়া না খাওয়া আমার ব্যাপার।”
কিন্তু আর্য নামধেয় গোষ্ঠীগুলির পূর্বাঞ্চলে (অর্থাৎ আজকের বিহার, বাংলা) প্রবেশের পরেও আর্যসংস্কৃতি এখানে চেপে বসতে পারেনি। অজস্র বর্ণ, জন ও কোম ছিল যেগুলির সঙ্গে বর্ণব্যবস্থার কোনো সম্পর্ক ছিল না। নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, “এই চতুর্বর্ণ প্রথা অলীক উপন্যাস, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। ভারতবর্ষে এই চতুর্বর্ণের বাহিরে অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোম বিদ্যমান ছিল, প্রত্যেক বর্ণ, জন ও কোমের ভিতর আবার ছিল অসংখ্য স্তর-উপস্তর। ধর্মসূত্র ও স্মৃতিকারেরা নানা অভিনব অবাস্তব উপায়ে এইসব বিচিত্র বর্ণ, জন ও কোমের স্তর-উপস্তর ইত্যাদি ব্যাখ্যা করিতে এবং সব কিছুকেই আদি চতুর্বর্ণের কাঠামোর যুক্তিপদ্ধতিতে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছেন। সেই যাজ্ঞবল্ক্যের সময় হইতে আরম্ভ করিয়া পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এই চেষ্টার কখনও বিরাম হয় নাই।”
বদলের শুরু হল দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুষ্যমিত্র শূঙ্গের সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে, যেটা ছিল মৌর্যযুগের একটা বড় ঘটনা। পুষ্যমিত্র ছিলেন মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথের সেনাপতি, বৃহদ্রথকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। বর্ণে ব্রাহ্মণ হওয়ায় বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত পক্ষপাত ছিল। শূঙ্গ বংশের শাসনকালের চারশ’ বছরের মধ্যেই অর্থাৎ প্রথম শতাব্দী থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে মনুসংহিতার সৃষ্টি হয় এবং এই মনুসংহিতাই ব্রাহ্মণপ্রাধান্যকে নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং শূদ্রদের অসম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছে দেয়। পবিত্র-অপবিত্র তত্ত্বের যে স্তরবিন্যাস, তাতে শূদ্রদের ঠাঁই হয় অপবিত্র থেকে অপবিত্রতম এই তিনটি স্তরে। সহজেই অনুমেয় এই স্তর অনুযায়ী নিম্নবর্গের পক্ষে দ্বিজ তিন বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা যেসব ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করতেন সেসবের নাগাল পাওয়া আর সম্ভব ছিল না। ফলে তাদের পক্ষে জৈন ও বৌদ্ধ যুগে তারা যেভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হয়ে উঠছিল, তাতে বাধা পড়ে।
কিন্তু জাত ব্যাপারটা কোথেকে এল? মনুসংহিতাতেও তো বেশির ভাগ আলোচনাই বর্ণকেন্দ্রিক, জাতি শব্দটা কখনো-সখনো এসেছে, তা অন্য অর্থে, জাত বলতে আমরা যা বুঝি তা আসেনি। দীপঙ্কর গুপ্তের অভিমত, জাত এসেছে ভিন্ন সূত্রে। মৌর্যযুগে কৃষকদের, বণিকদের ও কারিগরদের সংঘগুলি তৈরি হয় এবং মৌর্য-পরবর্তী যুগে জাতি হিসেবে দানা বাঁধে, যার থেকে উৎপত্তি হয় সামন্ততন্ত্রের। কিন্তু তার বহু আগেই একটা ঘটনা ঘটেছিল। আর্যীকরণের পর এইসব সংঘগুলি শূদ্রবর্ণের অধীন হয়ে যাবার ফলে আর্যীকরণের আগে সংঘগুলি সমাজে যে সম্মানজনক অবস্থানে ছিল, তা আর ছিল না। সংঘ থেকে জাতিতে রূপান্তরের সময় তাদের জন্যে দুটো জিনিস নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এক, তাদের বংশানুক্রমিক হয়ে যাওয়া, দুই, পেশাগত হয়ে যাওয়া। যদিও মনে হয় জাতিগুলোর বংশানুক্রমিক হয়ে যাওয়ার একটা অন্য কারণও ছিল, সেটা হল তাদের পেশাগুলো চালিত হত পরম্পরাগত শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে। যাই হোক, এর সঙ্গে যোগ হল পঞ্চম বর্ণ হিসেবে অন্ত্যজরা, শুরু থেকেই তারা ছিল ঘৃণিত, অতএব তাদের অবস্থার কথা না বলাই ভালো।
তা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের একটা চলিষ্ণুতা ছিল, তার কারণ কী? তার কারণ, তখনকার ভারতবর্ষে বাস্তবে মনু সংহিতার একাধিপত্য ছিল না। এগুলো ছিল ব্রাহ্মণ-প্রধান সমাজের আদর্শের মত, কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও সমাজে এই আদর্শ শেকড় গাড়েনি। বেশির ভাগ রাজাই মানবধর্মশাস্ত্র মেনে রাজ্যশাসন করতেন না। যেমন, Nicolas Dirks দেখিয়েছেন, দক্ষিণে রাজারা ব্রাহ্মণদের অধীন ছিলেন না।
পুরো ছবিটা পালটে গেল ব্রিটিশরা আসার পর। এমনকি মুঘল আমলেও শাসকের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ ঘটে না থাকলে অথবা রাজস্ব-সংক্রান্ত ব্যাপার না হলে তারা সমাজের কোনো ব্যাপারে (যেমন জাত কিংবা বেরাদরি) হস্তক্ষেপ করত না। Nicolas Dirks ভারতের বর্তমান জাতব্যবস্থাকে আধুনিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, “এ প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রাচীন ভারতের অপরিবর্তিত টিঁকে থাকা নয়, এমন কোনো একক ব্যবস্থাও নয় যা একটি মূল সভ্যতার মূল্যকে প্রতিফলিত করে, নয় কোনো ভারতীয় ঐতিহ্যের মৌলিক অভিব্যক্তিও।” এই জাতব্যবস্থা হল তাঁর ব্যাখ্যায়, পশ্চিমী উপনিবেশিক আধুনিকতার সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক মোলাকাতের ফল। ভারতের অসংখ্য সামাজিক অস্তিত্বকে প্রণালীবদ্ধ করতে গিয়ে ব্রিটিশরা caste শব্দটা ব্যবহার করতে করে, যে শব্দটা তার পেয়েছিল পর্তুগিজদের casta থেকে। Dirks বলেছেন, সংক্ষেপে আজকে যাকে আমরা caste হিসেবে অভিহিত করছি তা উপনিবেশিকবাদের অবদান।
ব্রিটিশরা এদেশে এসেছিল বণিক হিসেবে। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তারা কিছুই জানত না। তারা নিজেদের দেশের আইনি বাঁধনের ধাঁচে ভারতবর্ষকে বাঁধার চেষ্টা করল। উত্তরাধিকার নিয়ে, বিয়ে নিয়ে, জাত কিংবা ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে যেসব সমস্যা দেখা দিচ্ছিল, ওয়ারেন হেস্টিংস সেগুলোর সমাধানকল্পে মুসলিম সংহিতার (Muslim Code) ধাঁচে শাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে হিন্দু সংহিতা (Hindu Code) তৈরির কথা ভাবলেন। এ জন্যে তিনি ১১ জন পণ্ডিতের একটা দল তৈরি করলেন যাঁরা শ্রুতি, স্মৃতি, শাস্ত্র ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে হিন্দু সংহিতা রচনা করবেন। এ ব্যাপারে তিনি উইলিয়ম জোন্সের সাহায্য পেলেন, যদিও জোন্স সাহেবের পাণ্ডিত্য ভ্রমাত্মক হয়ে রইল। জোন্স সাহেব বুঝতেই পারলেন না এদেশে খুব কম ব্রাহ্মণই পুরোহিত এবং প্রচুর এমন পুরোহিত আছে যারা অব্রাহ্মণ। একইভাবে, পণ্ডিতরা খ্রিস্টধর্মের মত কোনো বিশপ অথবা সেই ধরনের কেউ দ্বারা নিয়োজিত নয়। যাই হোক, এর ফলে হেস্টিংস-জোন্স-কোলব্রুক ইত্যাদিদের মিলিত হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, যেন শাস্ত্র দ্বারাই হিন্দুদের জীবন চালিত হয়। ব্রিটিশরা বর্ণব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। তারা সবাইকেই জাতব্যবস্থার মধ্যে ফেলেছিল। ফলে লোকগণনাতেও সেই জাতপাতই প্রতিফলিত হতে লাগল।
বিহারের জাতগণনা ২০২৩
আশি বছর পরে ২০২৩ সালে আবার জাতগণনা হল বিহারে। শেষবার হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৯৩১ সালে, যদিও সেটা লোকগণনার অংশ হিসেবে। তারপর মণ্ডল কমিশন ১৯৮০ সালের ৩১ ডিসেম্বর একটা রিপোর্ট দেয়। এই রিপোর্টে সামাজিকভাবে এবং শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং তাদের জন্য সংরক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছিল। অবশ্য তার কিছু আগেই ১৯৭৮ সালে বিহারে কর্পূরী ঠাকুরের সরকার পিছিয়ে পড়া জাতিদের সংরক্ষণের ব্যাপারে মুঙ্গেরিলাল কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত করে। তারপর এই জাতগণনা। এই জাতগণনায় যে ছবিটা সামনে এল, সেটা নিচের তালিকাদুটো দিয়ে বোঝানো যেতে পারে।
তালিকা ১
সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, এখন বিহারের লোকসংখ্যা ১৩ কোটিরও ওপরে। তার মধ্যে জাতবিভাগ অনুযায়ী, সাধারণ জাতি ১৫.৫২ শতাংশ, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি ২৭.১২ শতাংশ, চূড়ান্তভাবে পিছিয়ে পড়া জাতি ৩৬.০১ শতাংশ, তফশিলি জাতি ১৯.৬৫ শতাংশ, তফশিলি উপজাতি ১.৬৯ শতাংশ।
তালিকা ২
এবার দেখা যাক অর্থনৈতিক অবস্থানের নিরিখে জাতবিভাগ অনুযায়ী লোকসংখ্যার কত শতাংশ কি অবস্থায় আছে।
সাধারণঃ
৬০০০ টাকা মাসিক আয় ২৫ শতাংশ; ৬০০০—১০০০০ ২৩ শতাংশ; ১০০০০—২০০০০ প্রায় ১৯ শতাংশ; ২০০০০—৫০০০০ ১৬ শতাংশ (প্রায়); ৫০০০০-এর ঊর্ধ্বে ৯ শতাংশ
অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিঃ
৬০০০ ৩৩ শতাংশ; ৬০০০—১০০০০ অন্তত ২৯ শতাংশ; ১০০০০—২০০০০ অন্তত ১৮ শতাংশ; ২০০০০—৫০০০০ ১০ শতাংশ; ৫০০০০-এর ঊর্ধ্বে ৪ শতাংশ
চূড়ান্তভাবে পিছিয়ে পড়া জাতিঃ
৬০০০ ৩৩ শতাংশ; ৬০০০—১০০০০ ৩২ শতাংশ; ১০০০০—২০০০০ অন্তত ১৮ শতাংশ; ২০০০০—৫০০০০ ৮ শতাংশ; ৫০০০০-এর ঊর্ধ্বে ২ শতাংশ
তফশিলি জাতিঃ
৬০০০, ৪২ শতাংশ; ৬০০০—১০০০০, ২৯ শতাংশ; ১০০০০—২০০০০ ১৫ শতাংশ; ২০০০০—৫০০০০, ৫ শতাংশ; ৫০০০০-এর ঊর্ধ্বে ১ শতাংশ
তফশিলি উপজাতিঃ
৬০০০ ৪২ শতাংশ; ৬০০০—১০০০০ ২৫ শতাংশ;
১০০০০—২০০০০ ১৬ শতাংশ; ২০০০০—৫০০০০ ৮ শতাংশ;
৫০০০০-এর ঊর্ধ্বে ২.৫৩ শতাংশ
এই অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে যে সত্যটা উঠে আসে সেটা হল বিহারের মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশ মাসে ৫০০০০-এর বেশি টাকা আয় করে। বিপরীতে ৮৭ শতাংশ লোকের মাসিক আয় হল ৬০০০ টাকা, যার মধ্যে ৬৩ শতাংশ পিছিয়ে পড়া জাতির মধ্যে পড়ে।
বিহারের জাতগণনা নিয়ে আরএসএস/বিজেপির এত অস্বস্তি কেন?
সংযুক্ত সোসালিস্ট পার্টির (সংসোপা) প্রতিষ্ঠাতা রামমনোহর লোহিয়া ১৯৬০ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা স্লোগান তুলেছিলেনঃ সংসোপা নে বান্ধি গাঁঠ, পিছড়ে পাওয়েঁ শও মে ষাট, রাজপাট হ্যায় কিসকে হাথ, অংরেজি ঔর ঊঁচি জাত অর্থাৎ, কাদের হাতে এখন সব ক্ষমতা? ইংরেজিভাষী উঁচু জাতের হাতে। সংসোপা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, একশোটার মধ্যে ষাটটা আসন পিছিয়ে পড়া জাতের হাতে যাবে। লোহিয়াপন্থী নীতিশকুমার ২০২৩ সালে এসে আবার যখন জাতগণনার খাতাটা খুললেন, তখন অনেকেরই স্মৃতিপথে এই স্লোগানটার উদয় হয়েছিল। অনেকে এমনও বললেন, বিহারে নতুন করে আবার সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের জন্ম হল। সর্বভারতীয় স্তরে অনেকদিন ধরেই বিরোধী পক্ষ জাতগণনার দাবি তুলছিল। বিজেপি কর্ণপাত করেনি। নীতিশকুমার পথ দেখালেন।
কিন্তু দেখা গেল বিজেপির এই জাতগণনা মেনে নিতে অসুবিধে আছে, যদিও তারা এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। প্রধানমন্ত্রী মোদি বললেন, বিরোধীরা জাতপাত দিয়ে ভারতবর্ষকে ভাগ করতে চাইছে। বর্ষীয়ান নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং বললেন, জাতগণনা করে মুখ্যমন্ত্রী নীতিশকুমার বিহারের জনগণকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ওদিকে আবার ঠিক তখনই বিহারের বর্ষীয়ান নেতা ও রাজ্যসভার এমপি সুশীলকুমার মোদি বললেন, বিহারের জাতগণনা বিজেপি যখন নীতিশকুমারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সরকারে ছিল তখন বিজেপিরই তৈরি কার্যক্রম। বিহারের বিজেপি ইউনিটের সভাপতি সম্রাট চৌধরী একটু সাবধানতা অবলম্বন করে বললেন, এই জাতগণনা কী প্রণালীতে হয়েছে না জেনে দল কোনো অবস্থান নিতে পারবে না। গেরুয়া শিবিরের এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, সর্বভারতীয় স্তরে জাতগণনা নিয়ে বিজেপি স্পষ্টতই জোসেফ হেলার কথিত ক্যাচ টোয়েন্টি টু অবস্থায় আছে। না পারছে গিলতে, না পারছে উগরোতে।
আরএসএস/বিজেপি সম্পর্কে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বুঝতে হবে। আরএসএস ক্রমাগত পাল্টাচ্ছে, সেই সঙ্গে বিজেপিও। চল্লিশ বছর আগে যে আরএসএস ছিল, আজ সে তার থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরেছে। প্রথম ব্যাপারটা হল, আগে যে জন্য সে তফশিলি জাতি, তফশিলি উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি এবং দলিতদের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য ছিল না, সেই মনুবাদী/ব্রাহ্মণ্যবাদী তকমা ক্রমাগত সে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হল, ফ্যাসিস্ট ইমেজ ভেঙে অতি দ্রুত তারা ভারতীয় গণতন্ত্রের আঙিনায় ঢুকে পড়ছে। কারণ তারা বুঝেছে গণতন্ত্রের সাহায্যেই যদি ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে ফ্যাসিবাদী তকমা বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না, সংখ্যাধিক্যের সাহায্যে গণতন্ত্রের ফাঁকফোকর গলে এই গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি রক্ষা করা যায়। কিন্তু ফ্যাসিস্ট ইমেজের কথায় আপাতত যাচ্ছি না, সে এক অন্য এবং বৃহত্তর প্রসঙ্গ।
আপাতত সেইসব তফশিলি জাতি, তফশিলি উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি এবং দলিতদের কথা বলি, যাদের আরএসএস/বিজেপি আপ্রাণ ‘জাত’ পরিচয় থেকে সরিয়ে এনে তাদের ‘হিন্দু’ পরিচয়ের বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং এ ব্যাপারে তারা খানিকটা সফলও হয়েছে। যেমন দলিতদের কথা যদি ধরি, পাসি রাজভরদের নায়ক সুহেলদেওকে তারা হিন্দু নায়ক হিসেবে ঘোষণা করেছে, যেহেতু সুহেলদেও গজনভি সেনাপতিকে পরাস্ত করেছিলেন। মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষে করার জন্য গোটা জাতটাকে তারা যোদ্ধা হিসেবে ‘রাষ্ট্র রক্ষক শিরোমণি’ উপাধিতে ভূষিত করেছে।
চিতোরায় সুহেলদেওর স্মৃতিতে কিছুদিন আগে একটা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। পাসিদের বলদেও এবং দলদেও নামের আরো দুই নায়ককে, যাদের বিএসপি এতদিন উঁচু জাতের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, তাদের জাতীয় ‘হিন্দু’ নায়ক হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার গাজিপুর থেকে দিল্লি যাওয়ার একটি সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনকে সুহেলদেওয়ের নামে নামাঙ্কিত করেছে। এইরকম আরো কিছু উদাহরণ হল জাতব সম্প্রদায়ের রবিদাস এবং সুপাচ ঋষি; মুসাহাররা যাঁর পূজা করে সেই দিনা-ভদ্রি যিনি বন্ধকী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছিলেন; আহিরদের নায়ক লোরিক যাদব এবং সর্বোপরি কূর্মি সম্প্রদায়ের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। একইভাবে, তারা নাথপন্থ, রবিদাসিয়া এবং কবিরপন্থের অনুসারী দলিতদের, প্রান্তিক পিছিয়ে পড়া জাতিগুলিকে এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিগুলিকে ‘হিন্দু’ পরিচয়ের মধ্যে আনার চেষ্টা করে চলেছে। তফশিলি উপজাতিগুলির ক্ষেত্রে, একহাতে খ্রিস্টান মিশনারি এবং নকশালদের ঠেকাতে আদিবাসীদের তারা তাদের আদিবাসী পরিচয়ের বাইরে নিয়ে গিয়ে ‘বনবাসী’ পরিচয়ে ভূষিত করছে। সেসব এলাকায় তারা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবিকা নিয়ে নানারকম পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছে, যে প্রচেষ্টাগুলো মূলত প্রসাধনী। এবং ‘পরাবর্তন’ অভিযানের মাধ্যমে হয় তাদের হিন্দু ধর্মের অথবা তাদের যার যার নিজস্ব ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে।
মোদ্দা আরএসএস/বিজেপি গোটা দেশটাকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’র পেটকোঁচরে পুরে ফেলতে চাইছে। এমতাবস্থায় নীতিশকুমার যখন জাত পরিচয়ের ব্যাপারটা সামনে নিয়ে আসেন, তখন তারা ফাঁপরে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তার কারণ যদিও সামাজিক-অর্থনৈতিক মর্যাদা (শিক্ষা, পেশা, আয় এবং ব্যক্তিগত মালিকানায় যা আছে) অনুযায়ী বিহারের জনগণের অবস্থান এখনো সামনে আসে নি, কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থানের আকারে যেটুকু এসেছে, সেটুকুর সামাল দেওয়াও বিজেপির পক্ষে অসম্ভব। বিহারের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিজেপির কোনো কার্যক্রমই দেশের মানুষের বেহাল অবস্থাকে একচুল পাল্টাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ নীতির মধ্যেও সেই বঞ্চনা প্রকট। যেমন, কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ ঘোষণা করেছিলেন যার মাপকাঠি ছিল বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ টাকার কম হতে হবে, যার থেকে বোঝা যায় যে ব্যবস্থাটি ছিল উঁচু জাতের জন্যে। ২০২৩ সালের বিহারের জাতগণনার সমীক্ষার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উঁচু জাত যেখানে ১৫ শতাংশের সামান্য ওপরে, সেখানে তাদের জন্য সংরক্ষণের শতাংশ হল ১০, অথচ যে পিছিয়ে পড়া জাতির শতাংশ ৬৩, তাদের জন্য সংরক্ষণের পরিমাণ মাত্র ২৭।
গ্রন্থপঞ্জী
১. ঋগবেদ
২.ছান্দোগ্য উপনিষদ
৩. নীহাররঞ্জন রায় -- বাঙ্গালীর ইতিহাস
৪. Dipankar Gupta -- Interrogating Caste: Understanding hierarchy and difference in Indian Society –
৫. Nicolas Dirks – Castes of Mind
৬. The Statesman, 6 November issue
৭. Badri Narayan – Republic of Hindutva