সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
[আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবার ক্রমশ দারিদ্র্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে এমন একটা সময়ে সুব্রতর জন্ম। সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের সীমার মধ্যে থেকেই আমরা পরিবারের সদস্যরা কয়েকজন ক্রমে স্বচ্ছল জীবনে পৌঁছেছি। যে ভাইবোনরা তা পারেনি তাদের সঙ্গে সহযোগিতাও করেছি। মাঝে মাঝে একটু সরে যেতে বাধ্য হলেও সাধারণভাবে সুব্রত আমাদের ছুঁয়ে থেকেছে। সাধারণভাবে তার মতো করে নানা জনের সঙ্গে সহযোগিতাও করেছে। কিন্তু সাধারণভাবে সমাজের এবং বিশেষতঃ আমাদের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। কিছুটা ছেলেমানুষী, অবুঝপনা হয়ত তার মজ্জাগত ছিল। শেষদিন পর্যন্ত। দারিদ্র্যের চাপে, সামজিক কাজের ঝোঁকে এবং নিজের জ্ঞানবুদ্ধি কম থাকায় আমি প্রথম দিকে তার দিকে যথাযথ সহানুভূতির হাত বাড়াতে পারিনি। সে কী বাড়ির সমস্যাগুলো বুঝতে পারে না? নাকি বুঝতে চায় না, সেটা ভেবেই ঠিক করতে পারিনি। পরে যখন অনেকটা বুঝতে শিখেছি তার অবুঝপনা সম্পর্কে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছিল, আর কিছু করার ছিল না।
ব্যক্তিগত অবস্থান ও পারিবারিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার এই সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ।]
জন্ম: ভাই আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। ভাইয়ের জন্ম হয়েছিল এক রাতে। খড়ের চালের মাটির দাওয়ায় চটে ঘেরা আঁতুড় ঘরে। সেখানেই আমাদের জন্ম হত। আমার এবং আমার চেয়ে ছোট তিন ভাইবোনের বেলায় এমনই ঘটেছিল। আমার উপরের দিদির ব্যাপারটা জানিনা। তার উপরের দাদার জন্মের সময় আমাদের বাড়িটা তৈরি হয়নি। বাড়িটা হয়েছিল সম্ভবত ১৯৫০ বা ১৯৫১ সালে। বিঘে দেড়েক জমির এক পাশে বাড়ি। মাটির ঘর, চারপাশ ঘেরা পাঁচিল। সব মাটির। পাঁচিলের দেওয়াল আর ঘরের দেওয়াল একই। একটু বড় একটা শোবার ঘর, একটা রান্না ঘর, গোয়াল ঘর। ফাঁকা জমির মাঝে একটা ছোট ডোবা, আমরা অবশ্য পুকুর বলতাম। বাড়ি করার সময় খানিকটা জমিতে ডোবাটা খুঁড়ে সেই মাটি দিয়ে বাড়ি করা হয়েছিল। গ্রামের নাম হাদিপুর। চন্দ্রকেতু গড়ের নাম এখন অনেকে জানে। আমাদের গ্রামের এক পাশেই চন্দ্রকেতু গড়ের শুরু।
সকালে উঠে মাকে চটে ঘেরা ঘরে দেখে আমি অবাক। তারপর দেখি একটা ছোট্ট ছেলে। জানতে চাইলাম, কোথা থেকে সে এল! মা হেসে বললেন, কাঁঠাল গাছ থেকে। আমাদের বাড়ির পাশে নানা গাছ ছিল। সেখান থেকে ছোট ছোট নানা প্রাণী মাঝে মাঝেই ঘরে ঢুকে পড়ত। তাই আমি ভাবলাম, হয়ত হবে বা!
নামকরণ: সেযুগে নানা ধরনের ডাকনাম দিতেন আত্মীয়রা। আমারও অনেক ডাক নাম ছিল। সুব্রতকে আমরা “ভাই” বলে ডাকতাম। তবে “ভাই” ছাড়া আরও অন্তত তিনটে ডাক নাম ছিল তার: দুষ্টু, দোলা আর ডাক্তার। দুষ্টু ডাকনামের একটা ইতিহাস নিশ্চয়ই আছে। আমি ছোটবেলায় কেমন দুষ্টু ছিলাম জানি না। তবে আমাদের দুই ভাইয়ের মাঝের বোন রমা একেবারে শান্তশিষ্ট ছিল। তাই হয়ত ভাই “দুষ্টু”। “দোলা”র ইতিহাস একটু বেশি দুলতে পছন্দ করা। তবে কাঠিকুঠি দিয়ে খোঁচাখুঁচি করার একটা ঝোঁক ছিল তার। সুযোগ পেলে মানুষদেরও। এসব থেকেই “ডাক্তার”। স্বভাবতই অনেকে বলত, বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে।
যাহোক, বলার মতো ঘটনাটা ঘটল ভাইয়ের “ভালো” নাম ঠিক করার সময়। তখন তার বয়স তিন বছর কয়েক মাস। তখনও বাবা কলকাতায় কাজ করতেন। একটা তেল কলে খাতা লেখার কাজ। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন, সোমবার সকালে আবার কলকাতায় চলে যেতেন। একটা শনিবার এসে বললেন, ভাই-এর নাম হবে সুব্রত। আমি তখনও প্রাইমারি স্কুলে, স্কুলে আমার নাম অসিত। কিন্তু আমার নামও ভাই-এর নামের সঙ্গে মিলিয়ে বদলানো হবে। কী নাম হবে? দেবব্রত। স্কুলে নাম বদলানো কঠিন ছিল না। কারণ স্কুলের হেডমাস্টারমশাই আমার বড় মামা, মায়ের পরের ভাই।
এভাবে ভাই হল সুব্রত আর আমি হলাম দেবব্রত।
ছোটবেলার গ্রামের জীবন: বাড়ির প্রথা মতো বয়স বছর পাঁচেক হওয়ার আগেই তাকে পড়তে লিখতে শেখানোর চেষ্টা শুরু হল। কিন্তু সে তখনও বয়সোচিত খেলা আর দুষ্টুমিতে মত্ত। দিদিমা আমাদের বাড়িতেই তখন থাকতেন। দিদিমার খুব আদরের ছিল সে। দিদিমা বোঝাতেন, লেখাপড়ার মতো ভালো কিচ্ছু নেই। একেবারে “বিনা পুঁজির ব্যবসা”। কিন্তু সে পড়তে রাজি নয়। বলত, তুমি পড়নি কেন? দিদিমার উত্তর তৈরি ছিল: ‘তখন মেয়েদের পড়ার নিয়ম ছিল না। পড়তে গেলেই লোক বলত, ওহ, লিখাপড়া শিখে “পি চি রায়” হবেন!’ পি চি রায় হলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
আসলে দিদিমার বাপের বাড়ি ছিল আচার্যর বাড়ির কাছে। খুলনা জেলার রাঢ়ুলি কাঠপাড়ার কাছাকাছি একটা গ্রামে। দিদিমার ছোটবেলায় প্রফুল্ল চন্দ্র রায় উদীয়মান বিজ্ঞানী। তাই লেখাপড়া শেখার বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষের বিদ্রুপের ভাষা ওটা।
যাহোক আমাদের তো লেখাপড়া তো শিখতেই হবে। চাকরি করতেই হবে। চাষের জমি ছিল না। ব্যবসা করার পুঁজি ছিল না। তাই “বিনা পুঁজির ব্যবসা”ই ভবিষ্যতের ভরসা। তাই তার উপর পড়ার জন্য চাপ দেওয়া হতেই থাকল।
আর বছর দুয়েক পর হঠাৎ বাবা অসুস্থ হলে পড়লেন। এদিকে চালের দাম অকস্মাৎ তিন-চারগুণ হয়ে গেল। সংসারের অবস্থা আর বলার নয়! দিদি চাকরি পেয়ে যাওয়ায় একেবারে না খেতে মরার অবস্থা সামলে গেল। দিদি মানে মায়ের বড় মেয়ে, আমরা অবশ্য একান্নবর্তী পরিবারের নিয়ম মেনে ছোড়দি বলে ডাকতাম। আমরা আট জন সহোদর ভাইবোন। পরের সবাইকে আমরা নাম বা ডাকনাম ধরে তার পাশে দা বা দি জুড়ে ডাকতাম। যেমন কবিতাদি।
যাহোক, এই সময় আমাকে গ্রামের বাড়ির বাইরের কাজকর্মের মূল দায়িত্ব নিতে হল। দিদি যে টাকা দিতে পারত তা দিয়ে আর পুকুর পাড়ের গাছে জন্মানো ফল সব্জি বেচে সংসার চালাতে হত। আমি আশা করতাম ভাইও পরিস্থিতি বুঝতে শিখবে। কিন্তু সেটা হবার নয়। তার ছেলেমানুষি যতটা কমলে আমরা সবাই খুশি হতাম, ততটা কমল না। কয়েক বছর পর বাবা মারা গেলেন। আমি তখন সবে ক্লাস ইলেভেনে উঠেছি। ভাই হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে সেবার। বাবা প্রায় বছর তিনেকর মতো ভুগছিলেন। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য সেকথা সবাই জানতাম। বাবা প্রতিদিন নিজের মৃত্যু কামনা করতেন। যাহোক, বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের খরচ, অতি সামান্য হলেও, একটু কমল। আরও মাস ছয়েক পরে দাদা চাকরি পেল। তাতে অভাব আর একটু কমল। তখন ভাইয়ের বয়স প্রায় দশ বছর।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে আমি কলকাতায় চলে এলাম। তখন আমাদের কলকাতার বাসস্থান দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের কাছে একটা ভাড়া বাড়ি। আমি মৌলানা আজাদ কলেজে ভর্তি হলাম। পরপর দু’বছরে দুই বোনও কলকাতায় চলে এল। ভাই, আমার উপরের দিদি আর মা রইলেন গ্রামের বাড়িতে। আমার ঐ দিদি তখন মানসিকভাবে একেবারে অসুস্থ। সাধ্যমতো কিছু চিকিৎসা করেও কিছু হয়নি। দারিদ্র্যের চাপটা দিদি একেবারেই নিতে পারে নি।
বছরখানেক পরে হঠাৎ একদিন খেলতে গিয়ে ভাইয়ের পা ভেঙে গেল। তখন সে তখন ক্লাস নাইন-এ পড়ত। কলকাতায় মাস দুয়েক থেকে মোটামুটি সুস্থ হল। কিন্তু ভাঙা পা-টা দু-এক মিলিমিটার ছোট হয়ে গেল বলে মনে হয়। যাহোক, বাড়ি ফিরে সেখান থেকেই ভাই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল। ভাই ছিল নতুন মাধ্যমিকের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ঐ একই স্কুল থেকে আমি এগারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছিলাম। স্কুলটার নাম বেড়াচাঁপা দেউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়।
কলকাতায় আসার পরে: ভাই মাধ্যমিক পাশ করার পর ভাই, দিদি ও মা তিনজনই কলকাতায় চলে এলেন। তার কিছুদিন আগে আমরা দমদম জংশন স্টেশনের কাছ একটা ভাড়াবাড়িতে চলে এসেছি। ভাই ক্লাস ইলেভেনে কমার্স নিয়ে ভর্তি হল দমদম কুমার আশুতোষ ইন্সটিটিউশনে। আমি তখন এম এস সি পড়ছি এবং যথাসাধ্য বেশি টিউশন করছি। বাড়িতে খুব কম জায়গা। লোক অনেক। দাদা-বৌদি, মা, খুকুদি (মানসিকভাবে পুরো অসুস্থ), আমি, রমা, ভাই আর ছোট বোন পত্র। ছোড়দি তার কিছুদিন আগে দমদমের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল।
যাহোক, কষ্টেসৃষ্টে দিন কেটে গেল। ভাই হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বি কম পড়তে কলেজে ভর্তি হল। কিছুদিন পর আমি এম এস সি পাস করে খানাকুলে কলেজে পড়ানোর চাকরি পেয়ে চলে গেলাম। ছোট বোনও আমাদের কলেজে পড়তে গেল। বাড়িতে ভীড় একটু কমল।
বি কম পাশ করার পর ভাই ফটোগ্রাফি শেখার চেষ্টা শুরু করল। এর পাশাপাশি কথাশিল্প নামক একটা বইয়ের দোকানে (এখন আর দোকানটা নেই) কিছু কাজ করত। এই সময় সে অন্য কিছু চাকরির চেষ্টাও করত বলে মনে হয়। এছাড়া আর কি করত সেটা জানিনা। সত্যি বলতে এই সময় থেকে তার কাজকর্ম এবং ভাবনাচিন্তার কথা হয়ত অন্য অনেকে আমার চেয়ে ভালো জানেন। আমি যেটুকুও বা জানি তার সব কিছু কালানুক্রমিকভাবে মনে নেই। তবু স্মৃতি থেকে কিছু কথা বলব। ছোট দুই বোনের কাছ থেকে কিছু জেনেও নিয়েছি। তবু কিছু কিছু ভুল হতে পারে।
পরিবারের দিক থেকে ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ক্রমশ সমস্যার হতে থাকল। কারণ, প্রচলিত অর্থে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা তার মধ্যে বিশেষ দেখা গেল না। তা নিয়ে বাড়িতে কিছু অশান্তি হতে থাকল। সংসারের কাজ বুঝে, গুছিয়ে করতেও শিখল না। তবে কারুর অসুখ বিসুখে সে খুব সাহায্য করত। যেমন, বৌদির হাঁপানির জন্য কবিরাজের ওষুধ আনা, কবিরাজের কাছ নিয়ে যাওয়া। ছোট বোন পত্রলেখার ছেলের জন্ম হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে। আগের দিন দমদম কেন, সারা কলকাতা জল থইথই। ভাই বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে অ্যানেস্থেসিস্টকে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ে এসেছিল ভাই।
এই সময় থেকেই তার বমি আর হেঁচকি এই দুই লক্ষণ নিয়ে অসুস্থ হওয়া শুরু। ১৯৮৬ তে স্থানীয় এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার দেখলেন। তাতে সেরেও গেল। ১৯৮৭র আগস্ট মাসে আবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। লক্ষ্মণ সেই বমি আর হেঁচকি। এবার আর হোমিওপ্যাথ ওষুধে সারল না। রক্ত বমিও হল। তারপর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে প্রশান্তদার সাহায্য নিয়ে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হল। আমি খবর পেলাম বেশ কয়েকদিন পরে। সম্ভবত পোস্টকার্ডের চিঠিতে। যাহোক, জানতে পারার পরই দেখতে এলাম। এসে দেখি তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে। মুখ-হাত বেঁকেচুরে গেছে। হসপিটালে থাকল অনেকদিন। ওষুধ, ফিজিওথেরাপি চলল হাসপাতালেই। কিন্তু অবস্থার বিশেষ উন্নতি হল না। একটা পর্যায়ে ডাক্তাররা বললেন, বাড়িতে নিয়ে ফিজিওথেরাপি করতে হবে। প্রথমে উল্টাডাঙায় ছোড়দির কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হল। সেখান কয়েকদিন থাকার পরে আবার আনা হল দমদমের বাড়িতে। এই দুই বাড়িতে থাকা অবস্থায় যথাসাধ্য ব্যায়াম ইত্যাদি করিয়েও বিশেষ উন্নতি হল না।
অবশেষে একজন নাম করা হোমিওপ্যাথ ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনি আমাদের দমদমের বাসস্থানের খুব কাছেই থাকতেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার বিস্ময়কর উন্নতি হল। সেটা হোমিওপ্যাথ ওষুধের জন্য নাকি এমনিতেই সময়ের সঙ্গে সেটা হত তা বলা সম্ভব নয়। তবে তার হাতের আঙুলের কিছু সমস্যা রয়ে গেল। কথাও পুরোপুরি স্পষ্ট হল না।
আমাদের বৌদি নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিলেন। ওখানে ভাইয়ের হাতের, পায়ের, কথা বলার সমস্যা দেখিয়ে বৌদি তার চল্লিশ শতাংশ প্রতিবন্ধীত্বের সার্টিফিকেট জোগাড় করে দিলেন। আমি ঠিক জানি না, এই সার্টিফিকেট পাওয়ায় বৌদির সুপারিশের কোনো ভূমিকা ছিল কিনা। তবে যে জন্য এত কিছু করা সে ব্যাপারে কিছু লাভ হল না। সাধারণ বা সংরক্ষিত কোনো একটা শ্রেণির চাকরির জন্য সে কোথাও আবেদন করেছিল অন্তত একবার। ইন্টারভিউও পেয়েছিল। কিন্তু তখন আবিষ্কার হল যে তার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে।
সার্টিফিকেট আবার পাওয়া কঠিন নয়। কিন্তু সে চেষ্টা করেছিল বলে মনে হয় না। চাকরির চেষ্টা করা নিয়ে এক-দুবার আমিও কথা বলেছিলাম। মনে হয়েছিল, আংশিকভাবে সরকারি চাকরি করায় কিছু আদর্শগত আপত্তি আর অংশত ধরাবাঁধা কাজ করতে পারার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব জন্মে গেছিল। স্বনির্ভর হওয়ার অনীহা নিয়েই সম্ভবত এই সময় দাদার সঙ্গে তার কিছু মারাত্মক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল।
আলাদা থাকা: এই সবের ফলশ্রুতিতে সে যশোর রোডের পাশের মাইকেল নগর অঞ্চলে এক জায়গায় ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকতে শুরু করল। কথাশিল্পে কাজ করার সময় সে বইপত্রের প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজ কিছুটা শিখেছিল। প্রুফ দেখা এবং ছাপার আগের-পরের আরও দু-একটা কাজ। এই ধরনের কাজই এই সময় সে করত। সে কাজের থেকে যা আয় হত তাতে হয়ত যাহোক করে নিজের থাকা খাওয়ার খরচ হত। কিন্তু ১৯৯০তে সে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছুদিন দমদমে থাকে। সেই সময় তার কানের ছোটখাট একটা অপারেশনও হয়। তবে মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর আবার মাইকেল নগরে ফিরে যায়।
এরপর আমি “পরীক্ষা” নামে একটা বই প্রকাশ করেছিলাম। সেটার প্রকাশনার কাজ দেখভাল করার কথা বলেছিলাম ভাইকে। সেজন্য যা পারিশ্রমিক বলেছিল সেটা দিয়েওছিলাম। কিন্তু গোটা কাজের মান এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠা আমাকে খুশি করেনি। সেই ছোটবেলার অগোছালো ভাব কাটেনি। আমাকেই অধিকাংশ কাজ করতে হয়েছিল। সব দেখে মনে হয়েছিল এই ধরনের কাজ করে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
মাইকেল নগরে সে কীভাবে থাকে তা দেখতে চেয়েছিলেন মা। আমি নিয়েও গিয়েছিলাম মাকে। সেখানে তার অতি অগোছালো জীবনযাত্রা দেখে খুব দুঃখ পেলেন। তবে সেই বাড়ির মালিকের মেয়ের সে বিষয়ে কাতরতা দেখে মা কিছু বুঝে নিলেন। বললেন ওখানে অল্প একটু জমি কিনে ভাইয়ের জন্য একটা বাড়ি করে দিতে আর ঐ মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিতে। সেটা করার সামর্থ্য আমার ছিল কিনা সেটা পরের প্রশ্ন, সেটা করা উচিৎ নয় এটাই ছোড়দি এবং আমরা ভাবলাম।
এর কিছু পরে কালধ্বনি পত্রিকায় শিক্ষা বিষয়ে আমার একটা লেখা ছাপা হয়। লেখাটার নাম “সাক্ষরতা ও উচ্চশিক্ষার ভিত গঠন -পরস্পরের প্রতিযোগী না পরিপূরক”। পাইকপাড়া/লেক টাউন অঞ্চলের আদ্যনাথ স্কুলের শিক্ষক শ্যামলবাবু লেখাটা পত্রিকা অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই লেখা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছিল সম্ভবত। তবে তখন ভাইয়ের সঙ্গে সহজে দেখা হত না।
লেখাটায় যেসব প্রস্তাব ছিল তার প্রথমটা আংশিকভাবে বাস্তবে রূপায়ণ করার উদ্দেশ্যে অনেক পরে, ২০০২ সালে, “শেখার সাথী” নামক সংগঠন গড়ে তোলা হয়। যে মিটিংয়ে সেই সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয় সেখানে ভাই উপস্থিত ছিল। কিন্তু সংগঠনে যুক্ত হতে রাজি হয়নি। তবে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা কী তা নিয়ে খোঁজ খবর নিত। সে বিষয়ে কালধ্বনির জন্য একটা লেখা দেওয়ার কথা বলেছিল ২০১৬ সালে, আমি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পরই। আমি রাজিও হয়েছিলাম। কিন্তু লেখাটা এখনও মনে সেভাবে দানা বাঁধেনি।
যাহোক, আগের কথায় আবার ফিরে আসি। ১৯৯৬-এ মা মারা গেলেন। ১৯৯৮-তে ছোড়দি উল্টাডাঙার কোয়ার্টারে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেটা জানতে পেরে ভাই ছোড়দিকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায় খুব সাহায্য করেছিল।
২০০০ সালে আমি দুবছরের জন্য কলকাতায় থাকতে এলাম। বুড়ো বয়সে পিএইচ ডি করব। দমদম ক্যান্টনমেন্টে তখন ছোড়দি একটা ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছে। আমি সেখানেই থাকতাম। ছোড়দি ভাইকে নানাভাবে সাহায্য করতে চাইত। কিন্তু তার চেয়েও বেশি চাইত যে সে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে উঠুক। প্রকাশনার কাজেই সে যাতে বেশি সময় ও শ্রম দিতে পারে তার জন্য ক্যান্টনমেন্টে দিদির ফ্ল্যাটের কাছেই একটা ঘর ভাড়া করলাম তার থাকার জন্য। কিন্তু ছোড়দির দাবি তার কাছ থেকে কিছু টাকা নিতে হবে। ছোড়দির সর্বদা ভয় তাকে আমি বেশি প্রশ্রয় দিয়ে অকর্মণ্য করে ফেলব।
ছোড়দি বকাবকি করত। বলত, “তুই কোনো কাজ করিস না।“ ভাই চুপ করে থাকত। কখনো বলত, “আমি যে এত পড়ি সেটা কী কাজ নয়?”
সেই ছেলেমানুষী! দুজনের বিচারের পদ্ধতি দুরকম!
পুরনো দিনের একান্নবর্তী পরিবারে এমন চরিত্রের এক-দুজন সব সময়েই থাকত। আমাদের পরিবারটা সেদিনে নেই আবার সেদিন থেকে পুরোপুরি বেরিয়েও আসেনি।
বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে শিখেছি, ভাইয়ের এই অবুঝপনা মেনে নেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু ছোড়দি যে ভাইবোনদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় সব স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়েছে! চাকরি পাওয়ার পর প্রথম দিকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে বললেও মিথ্যা বলা হবে। ভোর পাঁচটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত পরিশ্রম করেছে। অফিসেই সকাল দশটা থেকে পাঁচটার পর চার ঘন্টা ওভারটাইম করেছে। তারপর যাওয়া আসা, রান্নাবান্না! তাই সবাইকে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার চেষ্টা ছেড়ে দেওয়া ছোড়দির পক্ষে খুব কঠিন ছিল। তবে যারা স্বনির্ভর হতে পারল না তাদের থাকা-খাওয়ার ন্যূনতম ব্যবস্থা করে ছোড়দি ২০০৬ সালে মারা গেল।
স্থায়ীভাবে দমদম ক্যান্টনমেন্টে: ছোড়দির মৃত্যুর পর থেকে ভাই আর রমা ছোড়দির রেখে যাওয়া ফ্ল্যাটবাড়িতে মোটামুটি সুস্থির ও স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন শুরু করল। আমি বা অন্য কেউ আর তাকে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য কিছু বলিনি।
কিন্তু এই সময়ের আগে এবং পরে এক-দুই-তিন বছর অন্তর অন্তর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াটা তার ক্ষেত্রে প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়াল। ২০০১ সালে একবার জন্ডিস হয়েছিল। তখন শ্যামবাজারের ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোমে চিকিৎসা হুয়েছিল। রক্ত দিতে হয়েছিল। অন্য ক্ষেত্রে মূল লক্ষণ সেই বমি এবং হেঁচকি। নানারকম প্যাথলজিক্যাল টেস্টে কোনোবারই কিছু তেমন সমস্যা মিলছিল ন। বড় জোর রক্তে সোডিয়াম একটু কমে যাওয়ার মতো কিছু সমস্যা পাওয়া যাচ্ছিল। দিন কয়েক কিছু ওষুধ, স্যালাইন ইত্যাদি দিয়ে চিকিৎসার পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে যাচ্ছিল।
এবারেও সোডিয়াম কমে গিয়েছিল। প্রথমবার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে একটু বেশি খাওয়া-দাওয়া করা শুরু করল। শরীরের শক্তি বাড়ানো দরকারও তো বটে! কিন্তু দু সপ্তাহ না কাটতেই আবার ভর্তি করতে হল। আবার দেখা গেল সোডিয়াম কম। কিন্তু কেন বারবার সোডিয়াম কমে যাচ্ছে? একাধিকবার করে আলট্রাসনোগ্রাফি করা হল। সমস্যা ব্রেনে কিনা তা বুঝতে সিটি স্ক্যান, এম আর আই সবই করা হল। এন্ডোস্কোপিও হল। কিন্তু তেমন কিছু রোগ নির্ণয় হল না। বেশি খেলে হেঁচকি হয়। তাই বেশি খেতে দেওয়া যাচ্ছিল না।
মৃত্যু ও তারপর: শেষ পর্যন্ত দুর্বল শরীরে হেঁচকির ধকল নিতে না পেরেই বোধহয় মৃত্যু হল। ডাক্তারি টেকনিক্যাল ভাষায় অবশ্য অন্য কিছু কারণ এবং হার্টফেল লেখা হয়েছে।
ভাইয়ের চোখ ও দেহদান করার সুযোগ পেয়ে সেটা আমরা করেছি। তাতে অনেক হাঙ্গামা হয়েছে অবশ্য। সবচেয়ে বড় কথা মৃতদেহের অধিকার কার তা প্রতিষ্ঠা করা। যার একমাত্র সন্তান ছাড়া কেউ নেই তার ক্ষেত্রে সমস্যা কম। কিন্তু একাধিক “ওয়ারিশন” থাকলে সমস্যা। তাদের একজনকে যতক্ষণ না বাকী সবাই এফিডেভিটের মাধ্যমে স্বত্বাধিকারী করছেন ততক্ষণ মৃতদেহ গৃহীত হবে না। এই সব আইনগত সমস্যার জন্য সেদিন দেখলাম একজন লিখেছেন তাঁর বাবার চোখ দান করতে পারলেও দেহদান করতে পারেননি, এ দুঃখ তাঁকে সারা জীবন বইতে হবে।
কিছু ভাবনা নিয়ে পোস্টস্ক্রিপ্ট: মানুষের জীবন এবং মৃত্যু দুইই স্বাভাবিক। তবে ভাইয়ের শেষবার অসুস্থতার সময়ে চিকিৎসা ঠিকমতো করা হয়ে ওঠেনি এটা নিয়ে আমাদের দুঃখ রয়ে গেল। রোগ খুজে না পেয়ে ডাক্তার বড় কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। অনেক চেষ্টার পর সে ব্যবস্থা হল। কিন্তু যেদিন সকালে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা তার আগের রাত্রে সে চলে গেল। তবে তার বমি হেঁচকি লক্ষ্মণের অসুখ তো ১৯৮৬ সাল থেকে।.৩৬-৩৭ বছরে অন্তত ১০ বার নানা জায়গায় চিকিৎসা হয়েছে, কিন্তু কোনোদিনই জানা যায়নি কেন এই সমস্যা। কিছু কিছু সমস্যা এমন থাকে।
মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি, এ বোধ ভাইয়েরও (খুব সম্ভবত) গড়ে উঠেছিল। মৃত্যুর আগের দিন চোখটা একটু অস্বাভাবিক মনে হল। কথাও বলছিল না। আমাকে চিনতে পারছে কিনা জানতে চাইলাম। যেভাবে সে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল তাতে আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল সে শেষবার আমার সঙ্গে কিছু বলছে ভেবে কথা বলছে। ভাবছে তার মৃত্যু খুব কাছাকাছি এসে গেছে। পরে বুঝলাম, আমার আশঙ্কা ঠিকই ছিল। ভাই সেরে ওঠার বিশ্বাস ক্রমে হারিয়ে ফেলছিল।
আমাদের বাবা এবং ছোড়দি ভাইয়ের মতো বয়সেই মারা গেছেন। তাই মৃত্যুর বয়স নিয়েও তার খুব বেশি দুঃখ থাকার কথা নয়। তবে তার জীবনের একটা অসম্পূর্ণতা নিয়ে দুঃখ ছিল। তা নিয়ে আমারও দুঃখ রয়ে গেল। অন্যান্য জীবের মতো মানুষেরও যৌবনে খাদ্য যোগাড় হওয়ার পরই যৌনতার দাবি থাকে। অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান বলা হয়। কিন্তু যৌনতাটা “বলতে নেই” বলে অন্নের পর উহ্য থাকে। সাধারণভাবে ভাইয়েরও সে দাবি খুব স্পষ্টভাবেই ছিল। কিন্তু কোনো সম্পর্ককে বিয়ের স্তরে নিয়ে যেতে গেলেই সে তার দায়িত্ব আমাকে (এবং অংশত রমাকেও) দিতে চাইত। কিন্তু আমরা কী করে সে দায়িত্ব নিতে পারি? যে মেয়ে তাকে বিয়ে করবে সে তো তাকেই বিয়ে করবে! তাই আমি সর্বদাই তার সেই দাবিতে নিরুত্তর থাকতে বাধ্য হয়েছি। এখানেও তার বাস্তববোধের অভাব ভেবে বেদনা অনুভব করা ছাড়া কিছু উপায় খুঁজে পাইনি।
ভাই নিশ্চয়ই অন্য অনেকের কাছে অন্য অনেকভাবে পরিচিত ছিল। সেখানে তার সামর্থ্যের অনেক প্রকাশ আছে সম্ভবত। প্রশান্তদা তাকে স্নেহ এবং শাসন করে পরিণত করে তোলার অনেক চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে আমরা যখন কল্যাণী যাচ্ছি তখন অনেকেই সেখানে শেষ বারের জন্য তাকে দেখতে এসেছিলেন। তাঁরা নিশ্চয়ই ভাইয়ের অনেক গুণের কথা জানেন। তাঁদের কাছ থেকে ভাইয়ের সম্পর্ক সে সব বিষয়ে জানতে পারলে ভালো লাগবে। ভাইকে নিয়ে কালধ্বনি অফিসে যেদিন আলোচনা হল সেদিন আমি যেতে পারিনি। শিক্ষা নিয়ে নানারকম প্রোগ্রামে আমি খুব ব্যস্ত থাকি। সেদিন তেমন একটা প্রোগ্রামে ব্যস্ত ছিলাম। তাই সেদিন সবার কথা শোনার ইচ্ছা থাকলেও শোনা হয়নি। তাঁদের লিখিত বক্তব্য পড়ার ইচ্ছা রইল।