সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
তুমি শুনেছ ?
হ্যাঁ, পাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছিলো জীবনে একবার। সে গল্প তোমাকে তো বলেছিলাম।
বাব্বা, বেশ মনে পড়ে আমি তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছি। একদিন দেখলাম একটা চাকু নিয়ে ঘুরছে। আমাকে বলল - সাবধানে চলাফেরা করবি ; তোদের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। অথচ জানো একদম ভয় পাইনি। তুমি তখন কোথায় ?
কোথায়? মনে নেই। হয়ত কোনো গ্রামে। শেষের কয়েকমাস আমরা একই সেলে ছিলাম।
কিছু ভাবছ?
তিনদিন বৃষ্টির পর, গতরাত্রে বৃষ্টি হয়নি। অথচ হতে পারত। তাই সমস্ত বাড়ির জানালা বন্ধ ছিলো। ছিলো ঠাণ্ডা বাতাস। যারা বাড়ির বাইরে ছিলো, সে সময় তারা অবশ্যই আশেপাশের বাড়ীর কোন শিশু হঠাৎ কেঁদেছিলো কিনা শুনতে পায়নি। এবং ঘরের ভিতরে যারা ছিলো তারা কেউই সম্ভবত জানতো না, বাইরে তিনজন মানুষ একজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে। এই অপেক্ষা শুরু হয়েছিলো রাত্রি দশটা থেকে।
সাধারণ নিয়মে শহরতলির এই অঞ্চলে রাত্রি হয় আরো দেরিতে। অন্তত বারোটা। যদিও এখনও শীত আসতে অনেক দেরী। তবু বারোটার পর রাস্তায় কাউকে প্রায় দেখা যায় না।
কিন্তু তিনদিন বৃষ্টিতে সমস্ত রাস্তা ডুবে গেছে। বেশির ভাগ মানুষ অফিসে যেতে পারেনি। শহরে স্টেশনের কাছে যাদের দোকান আছে তারাও অনেকেই দোকান খোলেনি এবং যারা খুলেছিলো, তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেছে। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়ায়, দরজা জানালা বন্ধ ঘরে চাদরের তলায় উষ্ণতা ছিলো।
এরই মধ্যে দ্বীপের মতো ছোট একটা জায়গা, তিন রাস্তার মোড়ে জল জমেনি। পাকা রাস্তা বৃষ্টির জলে ধোয়া। স্টেশন থেকে জায়গাটা প্রায় দশ মিনিটের পথ। অবশ্য কে কেমন জোরে হাঁটে বা কত রাতে বাড়ী ফিরবে তার উপর সময় অনেকখানি নির্ভর করে। এখানে একটা কালভার্ট আছে। তলায় নর্দমা। পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছের ছায়া পড়েছে। উল্টো দিকের বাড়ীর বাইরের আলোটা সারারাত জ্বলে। ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল একজন। সে কোনো সন্দেহ না-রেখেই একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। অন্য দুজন তখন পরখ করছিল তাদের হাতের শক্তি। কালভার্টের উপর হাত রেখে পাঞ্জা লড়ছিলো, নিঃশব্দে। যে হারছিলো সে ভীষণ রেগে যাচ্ছিল। আর জিতছিল যে সে ও রাগে ভিতর থেকে একটা গরগর আওয়াজ করছিলো। তার একটা কারণ হতে পারে তারা অনেকক্ষণ ধরে, প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করছে।
অপেক্ষা করছে। স্টেশন চত্বরে যে বাজার, সেখান থেকে একজন ফুলওয়ালা, ফুলের দোকানদার ফিরবে এই রাস্তায়। এটাই তার বাড়ি যাওয়ার রাস্তা। খবর আছে। বর্ষার বৃষ্টি নয়। তিন দিনের পর এখন বৃষ্টিও থেমে গেছে। যে সব বস্তি ও নীচু জমির মানুষদের বাড়ি ডুবে গেছে, তারা তিনতলা স্কুলের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। সম্ভবত তারা সন্ধ্যায় যে চিঁড়ে ও গুড় পেয়েছিল তাই খেয়ে এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। জায়গাটা কালভার্ট থেকে মিনিট তিনেকের রাস্তা। স্কুল বাড়ির তলায় গেটের গায়ে দুটো ল্যাজ ঝোলা লাল পতাকা কোনাকুনি বাঁধা।
তবে এইমাত্র একটা মালগাড়ি যাওয়ার শব্দ থেমে গেল। অর্থাৎ ঐ অঞ্চলে কয়েকজন মানুষের সকাল হয়েছে।
আজ কি খাবে ?
সেবার বর্ষায় দীঘার সমুদ্র, মনে পড়ে? কিন্তু এবার তেমন রাত নেই। সেই, তুমি প্রশ্ন করেছিলে দিগবসনা, মানে কী।
মনে পড়ে। আজ কি রান্না হবে তাড়াতাড়ি বলো।
বৃষ্টি পড়ছে, তাহলে খিচুড়ি।
খিচুড়ি-খিচুড়ি বেগুনভাজা-- বেগুনভাজা ডিমভাজা-- ডিমভাজা ডিম নেই, ব্যাস।
এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। কিন্তু আবার মেঘ উঠছে। মেঘ প্রায় চাঁদের কাছাকাছি এসে গেছে। যে কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে ছিলো সে লক্ষ করছিলো মেঘের এগিয়ে আসা। আর ভাবছিলো - প্রথমার চাঁদ? দ্বিতীয়া? তৃতীয়া? চতুর্থী? পঞ্চমী? ষষ্ঠী? সপ্তমী? অষ্টমী? নবমী? দশমী? তারপর তার মানে হলো বিসর্জন, প্রণাম করলেই নাড়ু। এই ভেবে শব্দ করে হেসে ফেললো। রাত বেড়ে গেছে অনেক। রুলিং পার্টির পেমেন্ট ভালো। হতে পারে খবরটা ভুল ছিলো।
হাসির শব্দে অন্য দুজন চমকে তাকালো। স্টেশনের দিকের রাস্তাটা ভালো করে দেখে নিলো। আকাশের দিকে তাকালো। পাঞ্জা লড়তে লড়তে তারা ক্লান্ত হয়ে গেছে। একজন কোমর থেকে হাত তিনেক একটা মোমে পাকানো দড়ি বার করলো। মোটা দড়ি। দড়িটাকে দু'জন দু'দিক থেকে টানতে শুরু করলো। যদিও তারা জানতো ভীষণ শক্ত। আগে একবার এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিলো। ঝামেলা কম। একজন বাঁ হাত দিয়ে পকেটের ক্ষুরধার অস্তিত্ব পরখ করে নিলো।
কিন্তু এই দু'জন ক্রমশ আরো বিরক্ত হচ্ছে। তাদের সহ্য হচ্ছে না, আরো অপেক্ষা করা, আজ তো দোকান বন্ধ ছিলো। লাইনের ওপারের মদের আড্ডা থেকে ফেরার কথা। বাড়ীতে একমাত্র বুড়ি মা। এত রাত করা উচিত নয়। তবু অপেক্ষা করতেই হবে। মোট ষোল আনা, তার মধ্যে এরা দু'জন পাবে আট আনার আট আনা করে। সাব কনট্রাকটর।
তুমি কি দেখতে যাবে?
গেলে খুশি হবে?
জানি না।
না গেলে?
জানি না।
কয়েকমাস আগে একদিন দেখা হয়েছিলো। বলেছিলো চারু মজুমদার বেঁচে আছেন। মাও সেতুং বেঁচে আছেন। ওকে নাকি কারা ঝুলিয়ে গেছে। আমারও হঠাৎ মনে হলো সকলেই বেঁচে আছেন। সরোজ দত্ত ময়দানে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাইকে একটা করে তারা উপহার দিচ্ছেন। ঝকঝকে হেমন্তের রাত্রি। আমাকে কেবল দিলেন না। যাঃ বড্ড ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। এক কাপ না খাওয়াবে? তোমার খিচুড়ি বসিয়েছ?
যাই হোক ছেলেটা ভালো ছিলো, তবে মাথাটা একেবারে ইঁট।
আস্তে আস্তে চাঁদ মেঘের আড়ালে চলে গেলো। বাড়ীর বাইরের আলোটা জ্বলছে। সারা আকাশটা জুড়েই কালো মেঘ। ঠাণ্ডা বাতাস এখন আর নেই। কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা নড়ছে না। ফুল ফুটতে এখনও ঢের দেরি।
তিনজন খেয়াল করল একটা শব্দ থেমে গেলো। এতক্ষণ ব্যাঙ ডাকছিলো। শুধু কালভার্টের তলা দিয়ে মৃদু শব্দে জল যাচ্ছে। এই নোংরা জল একটা মজা খালে গিয়ে মিশবে।
মালগাড়িটা অনেকক্ষণ চলে গেছে। দু'একটা কাক ডাকছে সকাল হয়েছে, মনে করে। অথচ সেটা নিতান্তই ভুল করে। কারণ কালো মেঘে রাত্রি আরো অন্ধকার হয়েছে। যদিও সময়টা প্রায় কাক ভোর।
দূরে একজন মানুষকে দেখা গেলো। তিনজন পরস্পরের দিকে একবার তাকালো। কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে যে ছিলো তার হাঁ করে দুই ঠোঁটের কোণায় চুলকানো বন্ধ হতেই অন্য দু'জন নিশ্চিন্ত হলো। একজন পকেট থেকে বোতলটা বার করে দু'জনে খুব দ্রুত ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। অন্যজন এখন আগের চাইতেও নির্বিকার। এই মদ খাওয়ার প্রতিযোগিতায় সে অংশগ্রহণ করল না।
দূরের মানুষটা কাছাকাছি এসে গেছে। একেবারে কালভার্টের কাছে। বোধ হয় মৃদুস্বরে কোনো গান গাইছিলো।
একটু পরেই জোরে বৃষ্টি নামল।
কি বুঝলি?
কিছু না স্যার।
কিছুই না?
ইলেকশন আসছে স্যার।
আর? কত বছর চাকরি করছি জানিস ?
না, স্যার।
ছাব্বিশ বছর। তার মানে বুঝিস ?
না, স্যার।
তার মানে, ছাব্বিশ বছর রাজনীতি করছি।
হ্যাঁ স্যার।
কি রাজনীতি বলত ?
বলুন স্যার।
খিচুড়ি রাজনীতি। বুঝিস ?
না, স্যার।
পুলিশকে করতে হয়। তোদের সময় তোরা করতিস, তখনও আমি ছিলাম। এদের সময় এরা করে, তখনও আমি আছি। তোরা এখন গোপনে করবি। যাক যাক কোনোটাতেই ঝামেলা নেই। শুধু নকশাল তাড়া করলে তোরাও আছিস ওরাও আছে - এ ভরসায় বউকে সান্ত্বনা দেই, বুঝলি ?
হ্যাঁ স্যার। আমি এখন সংসার করছি।
বাধা তো নেই।
হ্যাঁ স্যার না স্যার।
ভোরের আগে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো, মাঝে একটু কমেছিলো মাত্র। আবার জোরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির জলে সমস্ত রক্ত ধুয়ে গেছে। বৃষ্টির কয়েকদিন ফুলের দোকান বন্ধ ছিলো। আজও আছে।
ভোটের আর বেশি দেরি নেই। কালভার্টের আশেপাশে জল জমতে শুরু করেছে। কয়েকজন মানুষ ছাতা মাথায় দিয়ে পরিচিতদের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। কারণ - পাশেই পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে। আশে পাশের বাড়ির জানালা মাঝে মাঝে খুলছে, আবার বন্ধ হচ্ছে।
জলের উপর কিছু হতভাগ্য লটারির টিকিট, সিনেমা সুন্দরসুন্দরীদের পরস্পরকে আঁকড়ে ধরা ছবি মার্কা ঠোঙা ভাসছে। একটা ঠোঙার ভিতর একটা, সম্ভবত কই মাছ ঢুকে গিয়েছিলো। সেটা ঠোঙা শুদ্ধ জলের এদিক ওদিক ও উপর নীচে ওঠা নামা করছিলো। জনৈক দর্শক সরষের তেলে নিজের হাতে ধরা মাছ ভাজার গন্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। না। বেশ কয়েকজনই চেষ্টা করছেন।
বড় দারোগাবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন গামবুট পরে। চোখে চশমা। রোদ উঠলে কালো হবে। এখন তাঁর চোখ দেখা যাচ্ছে। যদিও এখন তিনি রুলিং পার্টির হাফ উচ্চস্তরের স্থানীয় নেতার সঙ্গে কথা বলছেন। নেতার সহযোগী আত্মার আত্মীয়রা উচ্চস্বরে সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে একটা মিছিল বার করা নিয়ে আলোচনা করছেন। যদিও সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া ছিলো।
স্যার লাশ এবার গাড়ীতে তুললে হয়?
হুঁ।
একটা কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছেন, স্যার? বোধহয় লোকজন আসছে, শুনছেন?
তোমাকে দেখলে আমার চাকরি জীবনের প্রথম দিককার কথা মনে পড়ে। ক’টা বাজলো?
দশ’টা, স্যার।
চলো।